শমীক ঘোষ
গোটা বাসের মধ্যে পুরুষ-মানুষ বলতে শুধু আমি। পুরুষেরা ছাদে ওঠে। আমি শহুরে মানুষ, আমাকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। বাসের ভিতর আমি, কয়েকজন মেয়েমানুষ, মুরগি, ছাগল, বেশ কয়েকটা বস্তা ভর্তি ধুনো, চাল, তামাকপাতা। বাস ছাড়ল আলিপুরদুয়ার শহর থেকে, ধীর গতিতে হেলতে দুলতে।
খানিক পরেই ধীর গতি। দু’পা যায়, থমকায় আবার দু’পা যায়, থমকায়। গাছের ডাল ছাদ ছুঁলেই থমকাচ্ছে। ছাদের লোকগুলো নেমে যাচ্ছে, বাস আবার এগোলেই আবার একে একে উঠে যাচ্ছে ছাদে। এই ব্যবস্থা।
ইন্ডিয়ার টাকার খুচরো মেলে না। ভুটানি টাকা চলে। বলতে গেলেই এক গাল হাসি কন্ডাকটরের, আগেতো ভুটানই ছিল। অনেককাল আগে। ওই যে রাজাভাতখাওয়া ওইখানেই সন্ধি হয়েছিল, ইংরেজদের লিখে দিয়েছিল এই ভুখণ্ড। তা বলে কি ভুটানি নেই? ওই দেখনা চায়ের দোকানের গায়ে, পাঁচিলে ইতি উতি ভুটানি অক্ষর। যদিও একবর্ণও বুঝতে পারবে না।
জঙ্গলে হারিয়ে যায় পিচ রাস্তা। মাটি মিশে যায় ঘাসে। নেই আবার আছেও, ঠিক যেখানে চাকা পড়বে সেই জায়গাদুটো পিচ, মাঝে বুনো আগাছা, ঘাস। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের রাস্তা। বাস আবার ঝাঁকুনি খায়, সারি দেওয়া জঙ্গলের মধ্যে রাশি রাশি নুড়ি, এপার ওপার কয়েকশো ফুট। তা বলে রাস্তা ভেব না যেন। নদী। বর্ষায় যখন জল নামে তখন এমন বাস ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে, ভাসিয়ে নিয়ে যায় পাথর। বর্ষার অন্ধকারে যদি দেখ, মনে হবে যেন জলের সাথে গুলে গুলে যাচ্ছে অসংখ্য জোনাকি। জল ছুঁচ্ছে, জলে ভাসছে, আবার ডুবেও যাচ্ছে। পাথর ঘষা খাচ্ছে পাথরের গায়ে। বর্ষার প্রবল স্রোতে পাহাড়ের গা থেকে খসে যাওয়া অসংখ্য পাথর।
এমন ছ’ ছটা নদী পেরিয়ে বাস এসে থামল। গাঁ গেরাম ভাবতে পার, আবার খানিক জঙ্গলও ভাবতে পার। প্রকাণ্ড বটগাছ, হাত পা মেলে রেখে মাটিকে ছঁয়েছে, যেন অতি বৃদ্ধা নারী, মাটি স্পর্শ করে করে ঘষটে এগুবে।
ওইখানে জহরবাবু দাঁড়িয়েছিলেন। বাস থেকে নামতেই ধরলেন। তার ঠিক একটু আগে গাছের পাতা থেকে চলকে পড়া সবুজ, রোদের আলোয় মিশে বিকেল রঙ নিয়েছে। আর তক্ষকের দল গাছের কোটরে ফিরে যাওয়ার আগে গলা ফুলিয়ে আফশোস করে যাচ্ছে এক নাগাড়ে। কি ছিল কি নেই, কি কি বদলেছে মাঝখানে।
সব ছিল একসময়। ডোলোমাইট ছিল মাটির গভীরে। ক্যোয়ারি ছিল তা তোলার। অফিস ছিল, বাবু ছিল, বস্তি ভর্তি শ্রমিক ছিল। তার পর এক বর্ষায় সব অতীত। নদী ফুলে ফুলে পাড় ভাঙল, পাহাড় ভাঙল, অফিস ভাসাল, বাবুদের কোয়ার্টার ভাসাল। যাদের পয়সা ছিল তারা চলে গেল। যাদের ছিল না, সেই বস্তির শ্রমিকেরা থেকে গেল।
আর ছিল সরকার বাহাদুর আর তার অনেক গোমস্তা। আঁক কষে মেপে জুকে তারা বলল এও ফরেস্ট, কোর এরিয়া। আর ডোলোমাইট ক্যোয়ারি হবে না। গ্রাম থাকলে থাকুক, কিন্তু কোন রোজগার থাকবে না। মদেসিয়া, নেপালি বস্তির লোকগুলো কাজহীন রোজগারহীন, গাছ কাটতে লাগল বনের তারপর চোরাশিকারী হয়ে গেল। হবেই তাই নিয়তি।
জহরবাবু বলছিলেন এই সব। বিড়ির টানের মাঝে যতটুকু নিশ্বাস রাখা যায়, এক-একবারে ততটুকু করে। জহরবাবু গাইড, জঙ্গল দেখান। আর একটা স্যাটেলাইট টেলিফোন বসিয়েছেন। টুরিস্টরা ফোন করে। ক্যোয়ারির আমলে ছোট টেলিফোন এক্সচেঞ্জও নাকি ছিল, এখন স্মৃতিতে আছে, কিংবা হয়ত সবটুকুই কল্পনা।
সন্ধ্যারাত। লাল রঙের চাঁদ গাছের সারির অল্প উপরে ভেসে আছে। নামবেও না উঠবেও না। ঠিক গাছের একটু উপরে। সামান্য চাঁদের আলোয়, বাংলোয় কেয়ারটেকার সুনীল সিং-এর ডিমের ঝোলের গন্ধে মাখামাখি একটা বারান্দা। দূরে জয়ন্তী নদী, জল নেই পাথর শুধু। আর জঙ্গুলে হাওয়া গাছের শরীরে জমা কথা আরো জমিয়ে, গল্প করে, জহরবাবুর বলা শব্দগুলোকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। বাইরে তাকাই, ঠাহর করতে পারিনা, আবছা অন্ধকারে ঢেকে দিয়েছে সব।
গোটা বাসের মধ্যে পুরুষ-মানুষ বলতে শুধু আমি। পুরুষেরা ছাদে ওঠে। আমি শহুরে মানুষ, আমাকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। বাসের ভিতর আমি, কয়েকজন মেয়েমানুষ, মুরগি, ছাগল, বেশ কয়েকটা বস্তা ভর্তি ধুনো, চাল, তামাকপাতা। বাস ছাড়ল আলিপুরদুয়ার শহর থেকে, ধীর গতিতে হেলতে দুলতে।
খানিক পরেই ধীর গতি। দু’পা যায়, থমকায় আবার দু’পা যায়, থমকায়। গাছের ডাল ছাদ ছুঁলেই থমকাচ্ছে। ছাদের লোকগুলো নেমে যাচ্ছে, বাস আবার এগোলেই আবার একে একে উঠে যাচ্ছে ছাদে। এই ব্যবস্থা।
ইন্ডিয়ার টাকার খুচরো মেলে না। ভুটানি টাকা চলে। বলতে গেলেই এক গাল হাসি কন্ডাকটরের, আগেতো ভুটানই ছিল। অনেককাল আগে। ওই যে রাজাভাতখাওয়া ওইখানেই সন্ধি হয়েছিল, ইংরেজদের লিখে দিয়েছিল এই ভুখণ্ড। তা বলে কি ভুটানি নেই? ওই দেখনা চায়ের দোকানের গায়ে, পাঁচিলে ইতি উতি ভুটানি অক্ষর। যদিও একবর্ণও বুঝতে পারবে না।
জঙ্গলে হারিয়ে যায় পিচ রাস্তা। মাটি মিশে যায় ঘাসে। নেই আবার আছেও, ঠিক যেখানে চাকা পড়বে সেই জায়গাদুটো পিচ, মাঝে বুনো আগাছা, ঘাস। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের রাস্তা। বাস আবার ঝাঁকুনি খায়, সারি দেওয়া জঙ্গলের মধ্যে রাশি রাশি নুড়ি, এপার ওপার কয়েকশো ফুট। তা বলে রাস্তা ভেব না যেন। নদী। বর্ষায় যখন জল নামে তখন এমন বাস ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে, ভাসিয়ে নিয়ে যায় পাথর। বর্ষার অন্ধকারে যদি দেখ, মনে হবে যেন জলের সাথে গুলে গুলে যাচ্ছে অসংখ্য জোনাকি। জল ছুঁচ্ছে, জলে ভাসছে, আবার ডুবেও যাচ্ছে। পাথর ঘষা খাচ্ছে পাথরের গায়ে। বর্ষার প্রবল স্রোতে পাহাড়ের গা থেকে খসে যাওয়া অসংখ্য পাথর।
এমন ছ’ ছটা নদী পেরিয়ে বাস এসে থামল। গাঁ গেরাম ভাবতে পার, আবার খানিক জঙ্গলও ভাবতে পার। প্রকাণ্ড বটগাছ, হাত পা মেলে রেখে মাটিকে ছঁয়েছে, যেন অতি বৃদ্ধা নারী, মাটি স্পর্শ করে করে ঘষটে এগুবে।
ওইখানে জহরবাবু দাঁড়িয়েছিলেন। বাস থেকে নামতেই ধরলেন। তার ঠিক একটু আগে গাছের পাতা থেকে চলকে পড়া সবুজ, রোদের আলোয় মিশে বিকেল রঙ নিয়েছে। আর তক্ষকের দল গাছের কোটরে ফিরে যাওয়ার আগে গলা ফুলিয়ে আফশোস করে যাচ্ছে এক নাগাড়ে। কি ছিল কি নেই, কি কি বদলেছে মাঝখানে।
সব ছিল একসময়। ডোলোমাইট ছিল মাটির গভীরে। ক্যোয়ারি ছিল তা তোলার। অফিস ছিল, বাবু ছিল, বস্তি ভর্তি শ্রমিক ছিল। তার পর এক বর্ষায় সব অতীত। নদী ফুলে ফুলে পাড় ভাঙল, পাহাড় ভাঙল, অফিস ভাসাল, বাবুদের কোয়ার্টার ভাসাল। যাদের পয়সা ছিল তারা চলে গেল। যাদের ছিল না, সেই বস্তির শ্রমিকেরা থেকে গেল।
আর ছিল সরকার বাহাদুর আর তার অনেক গোমস্তা। আঁক কষে মেপে জুকে তারা বলল এও ফরেস্ট, কোর এরিয়া। আর ডোলোমাইট ক্যোয়ারি হবে না। গ্রাম থাকলে থাকুক, কিন্তু কোন রোজগার থাকবে না। মদেসিয়া, নেপালি বস্তির লোকগুলো কাজহীন রোজগারহীন, গাছ কাটতে লাগল বনের তারপর চোরাশিকারী হয়ে গেল। হবেই তাই নিয়তি।
জহরবাবু বলছিলেন এই সব। বিড়ির টানের মাঝে যতটুকু নিশ্বাস রাখা যায়, এক-একবারে ততটুকু করে। জহরবাবু গাইড, জঙ্গল দেখান। আর একটা স্যাটেলাইট টেলিফোন বসিয়েছেন। টুরিস্টরা ফোন করে। ক্যোয়ারির আমলে ছোট টেলিফোন এক্সচেঞ্জও নাকি ছিল, এখন স্মৃতিতে আছে, কিংবা হয়ত সবটুকুই কল্পনা।
সন্ধ্যারাত। লাল রঙের চাঁদ গাছের সারির অল্প উপরে ভেসে আছে। নামবেও না উঠবেও না। ঠিক গাছের একটু উপরে। সামান্য চাঁদের আলোয়, বাংলোয় কেয়ারটেকার সুনীল সিং-এর ডিমের ঝোলের গন্ধে মাখামাখি একটা বারান্দা। দূরে জয়ন্তী নদী, জল নেই পাথর শুধু। আর জঙ্গুলে হাওয়া গাছের শরীরে জমা কথা আরো জমিয়ে, গল্প করে, জহরবাবুর বলা শব্দগুলোকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। বাইরে তাকাই, ঠাহর করতে পারিনা, আবছা অন্ধকারে ঢেকে দিয়েছে সব।
0 মন্তব্যসমূহ