আহমাদ মোস্তফা কামাল
আমার কোনো বন্ধু নেই। কথাটি হয়তো পুরোপুরি সত্যি বলা হলো না। বন্ধু আছে, সবার যেমন থাকে, তবে যে ধরনের বন্ধুর কাছে গিয়ে মন খুলে দেয়া যায়, সমস্যা-সংকট-দুঃখ-কষ্ট-অপমান আর গ্লানির কথা বলা যায়, প্রয়োজনে তার সামনে বসে কাঁদাও যায়-- তেমন কোনো বন্ধু নেই। থাকলেও, হয়তো কোনো সমাধান বা সান্ত্বনা দেয়া তার পক্ষে সম্ভব হতো না, কিন্তু মন খুলে কথা বলে বুকটা হালকা করে বাড়ি ফেরা যেত! বুকটা যে ভারি হয়ে আছে, ভীষণ ভারি। মনে হয়, যেন এক হিমালয়ের ভার আমি একা বহন করে চলেছি।
করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছি, ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, অনেক অনেক কানড়বা জমা হয়ে আছে বুকের ভেতর, অথচ কাঁদতেও পারছি না। যে কাঁদতে পারে না সে-ই কেবল বোঝে-- না কাঁদতে পারার যন্ত্রণাটা কী ভয়াবহ, আর কাঁদতে পারাটা কী কঠিন ব্যাপার! হয়তো কাঁদতে পারি না বলেই বুকের ভেতর অস্বস্তি হয়। ঠিক ব্যথা নয়, অন্যরকম এক যন্ত্রণা, কী রকম সেটা বোঝানোও কঠিন, মনে হয় কেউ যেন খামচে ধরে আছে। দীর্ঘদিন যন্ত্রণা ভোগ করে গিয়েছিলাম ডাক্তারের কাছে-- ডাক্তারের কাছে যাওয়াটা আমার স্বভাববিরুদ্ধ, এদের ব্যবহার তো আর মানব প্রজাতির ব্যবহার বলে মনে হয় না আজকাল। তবু গিয়েছিলাম, ভয়ে-- আমার বাবা মারা গিয়েছিলেন হার্ট এ্যাটাকে, প্রম এ্যাটাকেই শেষ-- ওরকম একটা হঠাৎ মৃত্যু আমার কাম্য নয়, বলাইবাহুল্য। নানারকম রোগ আবিস্কৃত হয়েছে। উচ্চ রক্তচাপ,হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে নিয়মহীনতা ইত্যাদি। কিন্তু ডাক্তার শুধু রোগ নির্ণয় করে আর ওষুধ দিয়েই ক্ষান্ত হননি, রোগের পেছনের কারণটি আবিষ্কার করে বলেছেন-- নিজেকে এক্সপ্রেস করবেন, রাগ হলে রাগ করবেন, কানড়বা পেলে কাঁদবেন ইত্যাদি। আমি মনে মনে হেসেছি। ব্যাপারটা এত সহজ হলে তো ভালোই হতো। আমি চিরকাল অন্তর্মুখী মানুষ, মনের কথা মনেই রয়ে যায়। আর এখন তো কথা বলার মানুষই নেই। বন্ধু নেই, সে কথা তো আগেই বলেছি। এক ছিলো মা, ছোটবেলা থেকেই যা-কিছু কথাবার্তা আমার, তা ওই মায়ের সঙ্গেই। সে-ও তো কোনো এক দূর সম্পর্কের আতড়বীয়ের বাসায় আশ্রিতা হয়ে পড়ে আছে। কালেভদ্রে দেখতে যাই, কথা হয় সামান্যই, তার অভিমানী চোখের সামনে বসে থাকতে কষ্ট হয় আমার। আমি থাকতে আমার মা কেন অন্যের বাসার আশ্রিতা হয়ে পড়ে থাকে, সেই কথা জানতে চাইছেন তো! সেটা বলার জন্যই তো এই গল্প। আমার আসলে এ বিষয়ে কিছু করার ছিলো না। বিয়ের পরে আমার বউ কিছুতেই মাকে মেনে নিতে পারলো না। অথচ মা আমার ভীষণ নিরীহ গোছের মানুষ, কারো সাতে-পাঁচে কোনোদিন ছিলো না, বরং নিজেকে নিয়ে যেন সবসময়ই একটা অপরাধবোধ ছিলো তার। যেন তার অস্তিত্বই সবার জন্য অস্বস্তিকর কিংবা বিপর্যয়কর একটা ব্যাপার-- এমন একটি শংকায় তাকে কাঁপতে দেখেছি সেই ছোটবেলা থেকে। বাবা ছিলেন মেজাজি মানুষ, তার মেজাজ-মর্জি অনুযায়ী চলতে-চলতে মা প্রায় মেশিনে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। এমনকি, আমরা যখন মানিকগঞ্জের বাড়িতে ছিলাম তখনও, চাচা-ফুপুদের হুকুম তালিম করার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি মাকে। শুনেছি, বাবার বিয়ের আগেই, অর্থাৎ মা ওই বাড়িতে বউ হয়ে আসার আগেই আমার দাদী মারা গিয়েছিলেন। মা এসে চারটে দেবর-ননদ পেয়েছিল, আর তাদেরকে মাতৃসেড়বহে বড় করে তুলেছিল। চাচারা বড় হয়ে যখন আলাদা সংসার পাততে চাইলো তখন বাবার তাতে অনুমোদন ছিলো না। কিন্তু একদিন চাচারা এসে বাবাকে বললো-- বউদের জন্য আমাদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যাক এটা নিশ্চয়ই আপনি চান না ভাইজান?কেন, তোদের ভাবী তেমন কিছু করছে নাকি?
আমার কোনো বন্ধু নেই। কথাটি হয়তো পুরোপুরি সত্যি বলা হলো না। বন্ধু আছে, সবার যেমন থাকে, তবে যে ধরনের বন্ধুর কাছে গিয়ে মন খুলে দেয়া যায়, সমস্যা-সংকট-দুঃখ-কষ্ট-অপমান আর গ্লানির কথা বলা যায়, প্রয়োজনে তার সামনে বসে কাঁদাও যায়-- তেমন কোনো বন্ধু নেই। থাকলেও, হয়তো কোনো সমাধান বা সান্ত্বনা দেয়া তার পক্ষে সম্ভব হতো না, কিন্তু মন খুলে কথা বলে বুকটা হালকা করে বাড়ি ফেরা যেত! বুকটা যে ভারি হয়ে আছে, ভীষণ ভারি। মনে হয়, যেন এক হিমালয়ের ভার আমি একা বহন করে চলেছি।
করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছি, ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, অনেক অনেক কানড়বা জমা হয়ে আছে বুকের ভেতর, অথচ কাঁদতেও পারছি না। যে কাঁদতে পারে না সে-ই কেবল বোঝে-- না কাঁদতে পারার যন্ত্রণাটা কী ভয়াবহ, আর কাঁদতে পারাটা কী কঠিন ব্যাপার! হয়তো কাঁদতে পারি না বলেই বুকের ভেতর অস্বস্তি হয়। ঠিক ব্যথা নয়, অন্যরকম এক যন্ত্রণা, কী রকম সেটা বোঝানোও কঠিন, মনে হয় কেউ যেন খামচে ধরে আছে। দীর্ঘদিন যন্ত্রণা ভোগ করে গিয়েছিলাম ডাক্তারের কাছে-- ডাক্তারের কাছে যাওয়াটা আমার স্বভাববিরুদ্ধ, এদের ব্যবহার তো আর মানব প্রজাতির ব্যবহার বলে মনে হয় না আজকাল। তবু গিয়েছিলাম, ভয়ে-- আমার বাবা মারা গিয়েছিলেন হার্ট এ্যাটাকে, প্রম এ্যাটাকেই শেষ-- ওরকম একটা হঠাৎ মৃত্যু আমার কাম্য নয়, বলাইবাহুল্য। নানারকম রোগ আবিস্কৃত হয়েছে। উচ্চ রক্তচাপ,হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে নিয়মহীনতা ইত্যাদি। কিন্তু ডাক্তার শুধু রোগ নির্ণয় করে আর ওষুধ দিয়েই ক্ষান্ত হননি, রোগের পেছনের কারণটি আবিষ্কার করে বলেছেন-- নিজেকে এক্সপ্রেস করবেন, রাগ হলে রাগ করবেন, কানড়বা পেলে কাঁদবেন ইত্যাদি। আমি মনে মনে হেসেছি। ব্যাপারটা এত সহজ হলে তো ভালোই হতো। আমি চিরকাল অন্তর্মুখী মানুষ, মনের কথা মনেই রয়ে যায়। আর এখন তো কথা বলার মানুষই নেই। বন্ধু নেই, সে কথা তো আগেই বলেছি। এক ছিলো মা, ছোটবেলা থেকেই যা-কিছু কথাবার্তা আমার, তা ওই মায়ের সঙ্গেই। সে-ও তো কোনো এক দূর সম্পর্কের আতড়বীয়ের বাসায় আশ্রিতা হয়ে পড়ে আছে। কালেভদ্রে দেখতে যাই, কথা হয় সামান্যই, তার অভিমানী চোখের সামনে বসে থাকতে কষ্ট হয় আমার। আমি থাকতে আমার মা কেন অন্যের বাসার আশ্রিতা হয়ে পড়ে থাকে, সেই কথা জানতে চাইছেন তো! সেটা বলার জন্যই তো এই গল্প। আমার আসলে এ বিষয়ে কিছু করার ছিলো না। বিয়ের পরে আমার বউ কিছুতেই মাকে মেনে নিতে পারলো না। অথচ মা আমার ভীষণ নিরীহ গোছের মানুষ, কারো সাতে-পাঁচে কোনোদিন ছিলো না, বরং নিজেকে নিয়ে যেন সবসময়ই একটা অপরাধবোধ ছিলো তার। যেন তার অস্তিত্বই সবার জন্য অস্বস্তিকর কিংবা বিপর্যয়কর একটা ব্যাপার-- এমন একটি শংকায় তাকে কাঁপতে দেখেছি সেই ছোটবেলা থেকে। বাবা ছিলেন মেজাজি মানুষ, তার মেজাজ-মর্জি অনুযায়ী চলতে-চলতে মা প্রায় মেশিনে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। এমনকি, আমরা যখন মানিকগঞ্জের বাড়িতে ছিলাম তখনও, চাচা-ফুপুদের হুকুম তালিম করার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি মাকে। শুনেছি, বাবার বিয়ের আগেই, অর্থাৎ মা ওই বাড়িতে বউ হয়ে আসার আগেই আমার দাদী মারা গিয়েছিলেন। মা এসে চারটে দেবর-ননদ পেয়েছিল, আর তাদেরকে মাতৃসেড়বহে বড় করে তুলেছিল। চাচারা বড় হয়ে যখন আলাদা সংসার পাততে চাইলো তখন বাবার তাতে অনুমোদন ছিলো না। কিন্তু একদিন চাচারা এসে বাবাকে বললো-- বউদের জন্য আমাদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যাক এটা নিশ্চয়ই আপনি চান না ভাইজান?কেন, তোদের ভাবী তেমন কিছু করছে নাকি?
ভাবী
করেনি। ভাবী তো শুধু আমাদের ভাবী না, মা-ও। আর ওই জিনিসটাই
অন্য বউরা সহ্য করতে পারে না। সেজন্যই বলছি, সবাইকে আলাদা
করে দেন, যে-যার
মতো থাকুক। বাবা
কথা না বাড়িয়ে আলাদা করে দিলেন। আমাদের ছোট্ট বাড়িতে একাধিক
ঘর উঠলো, দেয়াল
উঠলো, সেই দেয়াল শুধু
ইটের দেয়াল আর রইলো
না, মনের দেয়ালও হয়ে
গেলো। সেই ভাঙন আমার ভেতরে এক গভীর
ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। হঠাৎ দেখলাম, সবকিছু কেমন যেন বদলে যাচ্ছে।
আগে এক হাঁড়িতে রানড়বা হতো, চাচাতো ভাইবোনেরা একসঙ্গে বসেখেতাম,
হৈ-হুল্লোড়
হতো, ঝগড়াঝাঁটিও যে
হতো না তা নয়, মিটেও
যে দ্রুত।
একসঙ্গে ঘুমানো, একসঙ্গে
খেলাধুলা, একসঙ্গে
দল বেঁধে নদীতে ঝাঁপিয়ে
পড়া-- সবই যেন বন্ধ
হবার উপক্রম
হলো। আলাদা ঘর, আলাদা রান্না,
আলাদা খাওয়া,
ঘুমানো--
কেমন যেন একটা
দূরত্ব তৈরি হলো সবকিছুতেই।
আমি তখন কেবল কৈশোর পেরোচ্ছি, বাড়িতে আর ভালো লাগতো
না, স্কুল থেকে ফিরে
কালীগঙ্গার পাড়ে গিয়ে একা একা বসে থাকতাম।
বাড়ির পাশে নদী থাকার অর্থ অন্যরকম, নদী একসময় বন্ধু হয়ে যায়,
আমারও হলো। নদী
আর মা এই দুজনের সঙ্গেই আমার কথাবার্তা চলতো
কেবল, অন্য সবার সঙ্গে
মেলামেশা প্রায় বন্ধই হয়ে গেলো। সেই থেকে
আমি নিঃসঙ্গ হয়ে আছি, সেই থেকে নানারকম সংকট-সমস্যা-দুঃখ কষ্ট
মা আর কালীগঙ্গার কাছে বারবার ফিরতে ইচ্ছে করে আমার। কতোকাল
মানিকগঞ্জ যাওয়া হয় না আমার, তবু কালীগঙ্গার কথা খুব মনে পড়ে।
মনে হয় একছুটে চলে যাই, ঝাঁপিয়ে পড়ি কালীগঙ্গার স্বচ্ছ জলে, আলিঙ্গন
করি বন্ধুর মতো। এই ছিনড়বভিনড়ব সংসার দেখতে হয়তো বাবারও ভালো
লাগেনি, সরকারি
চাকরি করতেন, চেষ্টা
তদবির করে ঢাকায় চলে এলেন।
আর আমি যেন আরও বেশি নিঃসঙ্গ হয়ে গেলাম। যেন সবই হারিয়ে
গেলো জীবন থেকে। সেই থেকে আমি চিরকাল হারিয়ে ফেলার আতংকে
ভুগেছি। বাবা তো মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দু-একবার বেড়াতে যাওয়া ছাড়া
আর ও-বাড়িতে ফেরেনইনি। আমরাও সেই থেকে ঢাকায়। ক্ষুদ্র চাকরিজীবি
বাবা ঢাকায় এসে সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যেতেন, আর্থিক
টানাটানি লেগেই ছিলো, কিন্তু খুব যে দুঃখ-কষ্ট ছিলো সংসারে সেটা কখনো
মনে হয়নি। বাবা যে তার সহজ-সরল-নিরীহ বউকে বেশ পছন্দ করতেন
সেটা তার আচরণেই বোঝা যেত। মা-র কোনো-কোনো বোকামিতে তার
হয়তো রাগে ফেটে পড়ার কথা-- তার স্বভাব অনুযায়ী সেটিই স্বাভাবিক ছিলো--
তিনি তা না করে
অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে মাকে আরও বোকা বানিয়ে
দিতেন। একদিনের কথা খুব মনে পড়ে। আমার খুব পছন্দের খেলনা
ছিলো বল। কিন্তু এক বল বেশিদিন রাখতে পারতাম না, হারিয়ে ফেলতাম।
তারপর আবার বলের জন্য বায়না। বাবার সামর্থ্য ছিলো কম, তবু
প্রতিবারই কিনে দিতেন। কিন্তু একবার বেশ কিছুদিন বায়না ধরেও বল পেলাম
না। এখন বুঝি, ওই
সময় বাবার খুব হাত টানাটানি যাচ্ছিল, প্রতিটি পয়সা
খরচ করতে হতো হিসেব করে। তো একদিন, সেদিন বোধহয় ভাত চড়াবার
মতো চাল-ও ছিলো না ঘরে, বাবা মাকে কিছু টাকা দিয়ে অফিসে গিয়েছিলেন।
মা আমার মর্জিতে অতিষ্ট হয়ে চাল কেনার টাকা দিয়ে বল কিনে
দিয়েছিল। রানড়বা হয়নি। বাবা অফিস থেকে ফিরে এসে রাগ করার বদলে
হেসেই খুন-- ‘খোকার
মা, তুমি একটা আজব
মহিলা। না খেয়ে আছো,
তবু ছেলের আবদার
রাখতে হবে!’ তারপর
নিজেই দোকান থেকে চাল
কিনে এনে মাকে রাঁধতে বলে আমাকে ডাকলেন-- ‘আয়রে খোকা তোর সাথে
বল খেলি, তোর
মা এত শখ করে কিনেছে!’ তো, তার
তিন ছেলেমেয়েই
খুব মেধাবী বলে তিনি খুব বড় স্বপড়ব দেখতেন যে,
ছেলেমেয়েরাই
তার ব্যর্থতাগুলো ঢেকে দেবে! আমরা অবশ্য তার ইচ্ছে
অনুযায়ী
সবাই পড়াশোনা করেছি, কিন্তু
ব্যর্থতাগুলো ঢাকতে পারিনি। অন্তত
আমি
পারিনি। আমি পড়াশোনা শেষ করে একটা বহুজাতিক সংস্থায় চাকরি
পেলাম।
বোনটার বিয়ে হয়ে গেলো এক প্রবাসী পাত্রের সঙ্গে। শুনেছি ওরা
ভালো
আছে-- দুজনেই ডাক্তার।
ছোট ভাইটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে।
এরকম
একটি নির্ঝঞ্ঝাট পরিবারে এসে বউয়ের কোনো সমস্যা হওয়ার কথা
নয়।
কিন্তু হলো। আর সবার কথা থাক, মা-র মতো এরকম একজন নিরীহনিবির্
রোধ
মহিলাকে সে কিছুতেই মেনে নিলো না কেন, আমি তা বুঝতেই
পারলাম
না। ওর মধ্যে মায়া-মমতার মতো মানবিক গুণগুলো আদৌ আছে
কী
না আমার মাঝে-মাঝে সন্দেহ হয়। মা-র সঙ্গে কোনো কারণ ছাড়াই যা-
তা
রকমের দুর্ব্যবহার করতো ও; আমার সঙ্গে তো করেই। তবু আমরা--
মা-ছেলে,
এই লৌহমানবীর
একক দাপটের সামনে ভীরু কবুতরের মতো
টিকে
ছিলাম। সে যখন দেখলো এসব দুর্ব্যবহারে কোনো কাজই হচ্ছে না,
তখন
মা-র খাবার বন্ধ করে দিলো। আমি অফিস থেকে ফিরে দেখতাম--
আমার
বৃদ্ধ মা না খেয়ে মুখ শুকনো করে বসে আছে, আর আমার মহামান্য
স্ত্রী
খাবার-দাবার ফ্রিজে তালা দিয়ে দিব্যি ঘুমোচ্ছেন। চাবির খোঁজ আমার
জানা
ছিলো না, মা-র
জানার তো প্রশড়বই ওঠে না, সম্ভবত জানার অধিকারও
আমাদের
দুজনের কারোরই ছিলো না। হোটেল থেকে খাবার এনে মাকে
খাওয়াতাম,
মা-র চোখ ভিজে
উঠতো, তবু এমন
হাপুস-হুপুস করে খেয়ে
উঠতো
যে বুক ভেঙে আসতো কষ্টে-- ভয়াবহ ক্ষুধার্ত না হলে এভাবে কেউ
খায়
না। ছোটবেলায় দেখেছি, আমাদের বাড়িতে কোনো ভিক্ষুক এসেও না
খেয়ে
ফিরে যেত না, কাক-কুকুর-বিড়াল
এইসব বেওয়ারিশ পশুপাখিও
নিয়মিতই
মা-র কাছ থেকে খাবার পেতো। আর এই শেষ বয়সে এসে সেই
মাকে
না খেয়ে থাকতে হচ্ছে! প্রকৃতির নাকি ভারসাম্য আছে, লোকে বলে।
আমার
ইয়ে আছে। নইলে এই বয়সে এসে তাকে না খেয়ে থাকতে হতো
না।
যাহোক, মাকে যে আমি
বাইরে থেকে খাবার এনে খাওয়াই সেটা
একদিন
বুঝে ফেললো সে, পরিস্থিতি
হয়ে উঠলো ভয়াবহ জটিল। সেদিন সে
তার
ঝড়টা আমার বা মা-র ওপর দিয়ে না উঠিয়ে ওঠালো আমার
তিনবছরের
বাচ্চাটার ওপর। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাচ্চাটা ভীষণভাবে
মার
খেলো। সারাশরীর ফুলে গেলো মারের চোটে, রাতে গা কাঁপিয়ে জ্বর
এলো।
এইরকম অত্যাচার চললো আরো অনেক-অনেক দিন। বাচ্চাটা
স্থায়ীভাবে
অসুস্থ হয়ে পড়ার লক্ষণ μমাগত ফুটে উঠতে লাগলো। অবশেষে
একদিন
আর সইতে না পেরে মা বললো-- ‘আমাকে তুই অন্য কোথাও
রেখে
আয় বাবা, আমার
জন্য দুধের শিশুটা এত কষ্ট পাচ্ছে!’ অনেক
অত্যাচারেও
মা টিকে ছিলো, কিন্তু
নাতির কষ্ট সইতে পারলো না। কিন্তু
মাকে
কোথায় রেখে আসবো? আমার
তো এমন কোনো আতড়বীয়স্বজন নেই
যার
কাছে মাকে রেখে আসা যায়! বোনটা দেশের বাইরে। ভাইটা কেবল
ইউনিভার্সিটিতে
পড়ছে। আমার বাসাটা যথেষ্টই বড়, ওর জন্য একটা রুমও
বরাদ্দ
ছিলো, কিন্তু থাকতে
পারেনি। একদিন ওর ভাবীর সঙ্গে ঝগড়া করে,
আমাকে--
তোমার বাসায়
কোনো মানুষ থাকতে পারে না-- বলে হল-এ
গিয়ে
উঠেছে। ওর সঙ্গে আলাপ করার জন্য গোপনে ওর হলে গেলাম।
পরিস্থিতি
শুনে ও ক্ষেপে গেলো--
তুমি
এসব সহ্য করো কিভাবে ভাইয়া? তোমার কি ব্যক্তিত্ব বলে কিছু
নেই?
ছিলো,
এখন নেই। বিয়ে
করলে বুঝবি, ব্যক্তিত্ব
বিসর্জন দেয়াটাই সংসার
করার
পূর্বশর্ত।
বাজে
কথা বলো না। তুমি নিজে একটা কাপুরুষ, নিজের দোষ বিয়ের
কাঁধে
চাপাচ্ছো কেন! তুমি ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনো পুরুষ মানুষ নেই?
আর
কেউ সংসার করছে না?
করছে,
এবং সবক্ষেত্রেই
ওই একই ঘটনা। আমাকে কাছে থেকে
দেখছিস
বলে বুঝতে পারছিস, দূর
থেকে এসব বোঝা যায় না।
আমার
বোঝার দরকার নেই। তবে তোমার জায়গায় আমি হলে বউকে
শক্ত
করে মার লাগাতাম, নইলে
ডিভোর্স দিতাম।
পারতি
না। কোনোটাই পারতি না। মার যে লাগাবি, তোকে বাইরে
যেতে
হবে না! ফিরে এসে দেখবি তোর মা আর বাচ্চাটা মরে পড়ে আছে।
ডিভোর্সও
মুখের কথায় দেয়া যায় না। অন্তত বাচ্চা হওয়ার পর তো আরো
কঠিন।
বাচ্চাটার কথা ভেবেই সেটা সম্ভব নয়।
বাচ্চাটা
যেন এখন খুব ভালো আছে!
এসব
তুই বুঝবি না, এখন
মাকে নিয়ে কি করি বল?
ভাবীর
জন্য মা তোমার বাসায় থাকতে পারবে না, অথচ সেই বউ নিয়ে
তুমি
সংসার করবে, আমি
তো সেটা ভাবতেই পারছি না। তোমাকে আমি কি
সাজেশন
দেব? তুমি বরং আমাকে
কোনো একটা চাকরি জুটিয়ে দাও,
আমিই
মাকে নিয়ে থাকি।
আরে
দূর পাগল। পড়াশোনাটা শেষ কর, তারপর এসব ভাবিস-- আমি
খুব
স্বাভাবিক কণ্ঠে বলার চেষ্টা করলাম। যেন এটা খুবই সাধারণ একটা
ঘটনা,
অহরহই এমনটি ঘটে
থাকে।
পড়াশোনা
করে কি লাভ, যদি
তোমার মতো পরিণতি হয়! তারচেয়ে...
শোন,
পড়াশোনাটা শেষ
করতেই হবে, তারপর
যা করার করবি। তবে
তোকে
বলে রাখি, মাকে
যদি তুই তোর কাছে রাখতে চাস তাহলে এই
শহরের
মেয়ে বিয়ে করবি না। এই শহরের মেয়েরা পাথর দিয়ে তৈরি! আর
যদি
করিস-ই, তাহলে
অন্য সব সম্পর্কের কথা ভুলে যাবি। কোনো এক
মায়ের
গর্ভে তোর জন্ম হয়েছিল, কোনো এক বাবার আঙুল ধরে তুই প্রম
পৃথিবীর
পথে নেমেছিলি, একই
ছাদের নিচে কোনো ভাই-বোনের সঙ্গে
সুখদুঃখ
ভাগাভাগি করে বেড়ে উঠেছিলি-- এই সবকিছু ভুলে গিয়ে, এই
সবকিছু
বিসর্জন দিয়ে তারপর বিয়ে করবি।
ভাইটা
কোনো পরামর্শ দিতে পারলো না, উল্টো রাগারাগি করলো আমার
সঙ্গে,
হম্বিতম্বি করলো,
তারপর একসময়
কেঁদে ফেললো-- তুমি
আমার
জন্য
একটা চাকরি খুঁজে দাও ভাইয়া, পি−জ। এই
অবস্থায় পড়াশোনা করা
যায়,
বলো?
আমি
ফিরে এলাম। জীবন বড়ো কঠিন ব্যাপার। সংসার এক জটিল
যুদ্ধক্ষেত্র,
পৃথিবীতে এমন
জটিল আর কোনো যুদ্ধক্ষেত্র নেই। ও এখন এসব
বুঝবে
না। কিন্তু বড়ভাই হিসেবে ওকে ওর পড়াশোনাটা শেষ করে নিজের
পায়ে
দাঁড়াতে সাহায্য করার দায়িত্বটুকু আমার আছে।
কিন্তু
মাকে কোথায় রাখি? যে
বাড়িতে বাবা ফেরেননি সেই বাড়িতেই বা
কার
কাছে রেখে আসবো? যদিও
ওই বাড়িতে আমাদের অংশ আছে, বাবার
ঘরটাও
আছে। কিন্তু শুধু ঘর থাকলেই তো হয় না। মাকে দেখবে কে?
চাচারা
তো বোধহয় পারবে না, চাচীদের
কারণেই পারবে না। তাহলে? ওল্ড
হোম?
অসম্ভব। ওরকম
অনাতড়বীয় পরিবেশে মা বাঁচবেই না। অবশেষে মা-ই
পথ
বাতলালো। আমার দূর সম্পর্কের এক মামার বাসায় ব্যবস্থা হলো।
মামার
আর্থিক অবস্থা ভালো না। প্রতিমাসে মা-র জন্য যে টাকাটা দেবো,
সেটার
জন্যই হয়তো আগ্রহ দেখালো। এত টাকা লাগার কথা নয়, তবু
দিলাম--
যেন মার কোনো
অযতড়ব না হয়। নিজের কাছে রেখে যা করতে
পারিনি,
টাকা দিয়ে তাই
করার চেষ্টা। এখন জানি, মা অন্তত না খেয়ে থাকে
না।
মাকে মাসে একবার বা বড়জোর দুবার দেখতে যাই, তা-ও যথাসম্ভব
গোপনীয়তা
রক্ষা করে-- যদিও
সারাক্ষণ তার পাশে বসে থাকতে ইচ্ছে
করে।
মা প্রায়ই বাচ্চাটাকে দেখতে চাইতো, এখন তা-ও চায় না। বুঝে
গেছে,
এ জীবনে আর ওটা
হওয়ার নয়। এতকিছু করেও যে বউয়ের মেজাজ
কমাতে
পেরেছি, তা
নয়। বাচ্চাটাকে নির্যাতন করা তার অস্ত্রে পরিণত
হয়েছে।
নানা পরীক্ষা-নীরিক্ষার পর সে বুঝতে পেরেছে-- এই একটি
জায়গায়
আমি খুব দুর্বল হয়ে পড়ি। আমি তাই সবসময় নতজানু হয়ে
থাকি।
বউয়ের অপছন্দ হবে এমন কোনোকিছুর ধারেকাছে যাই না। যদি
আবার
বাচ্চাটা সেই ছুতোয় মার খায়! ভয়ে-আতংকে সারাক্ষণ অস্থির
থাকতে
হয়। সমস্যাটা আসলে অন্য জায়গায়। বউ আমাকে প্রম থেকেই
অপছন্দ
করে এসেছে। হয়তো স্বামী হিসেবে মেনেই নিতে পারেনি, সঙ্গী
হিসেবে
তো নয়ই। পারবেই বা কেন? আমি তো মফস্বল থেকে, গ্রাম
থেকেই
বলা যায়, উঠে
আসা নিমড়বমধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান আর ও শহরের
সচ্ছল
পরিবারের চাকচিক্যময় অভিজাত পরিবেশে বেড়ে ওঠা মেয়ে। আমি
বড়
হয়ে উঠেছি অনিশ্চয়তা, অভাব-দারিদ্র আর হারানোর আতংকের মধ্যে
দিয়ে।
হয়তো সেজন্যই আমি চিরকালের ভীতু, রুগড়ব, দূর্বল,
অসহায়,
মুখচোরা
মানুষ। ওর এরকম কোনো সমস্যা ছিলো না বলেই হয়তো সাহসী,
স্বাস্থ্যবতী,
উচ্ছল, প্রাণবন্ত, আতড়ববিশ্বাসে ভরপুর। আমি আপোসকামী,
ধমকের
কাছে নুইয়ে পড়ি, আর
সে রুখে দাঁড়ায়। আমি শান্ত, নির্বিরোধ; সে
মেজাজি,
পায়ে পা লাগিয়ে
ঝগড়া বাধাতেও কুণ্ঠা নেই। সে শহুরে নাগরিক
জীবনের
উজ্জ্বলতায় বড় হয়ে ওঠা মেয়ে, আর আমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে ওই
গ্রামসদৃশ
মফস্বল, ওই
কালীগঙ্গা নদী। ওর চোখে আমার সীমাহীন ত্র“টি তো
চোখে
পড়বেই। আসলে এত-এত বৈপরীত্য নিয়ে তো আমাদের মধ্যে
কোনো
সম্পর্কই হবার কথা নয়। ঘটনাμমে তথাকথিত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার
আইডেন্টিটির
জন্যই এই অসম বিয়েটা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু দাম্পত্য-জীবন
তো
আর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ইমেজ দিয়ে চলে না! ভুল হয়ে গেছে। আমার
উচিত
ছিলো গ্রামের একটা সহজ-সরল মেয়েকে বিয়ে করা যে আমার
আবেগ-অনুভূতির
মূল্য দেবে। শহরের পাথর-হৃদয় মেয়ে আমার জন্য নয়।
এই
ভুলের খেসারত আমাকে আজীবন ধরে দিয়ে যেতে হবে।
একদিকে
আমার নিষ্পাপ সন্তানের ওপর হিটলারি নির্যাতন, অন্যদিকে
মা-র
সঙ্গে অনিচ্ছাকৃত বিচ্ছিনড়বতা, একদিকে বন্ধুহীনতা অন্যদিকে সঙ্গী হবার
বদলে
বউয়ের লৌহমানবী হয়ে ওঠা, ঘরে বাইরে আরও বহু-বহু সমস্যাসংকট
আমার
মনটাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে।
মনে
হয়, বুকের ভেতর একশ
বছরের কানড়বা জমে আছে।
২
এই
গল্পের আসলে কোনো শেষ নেই। এই শহরের দাম্পত্য সম্পর্কগুলো তো
এরকম অভিজ্ঞতায় ভরপুর হয়ে আছে, এসব বলে শেষ করা যাবে? কিন্তু
সেদিনটা ছিলো একটু অন্যরকম, ঘটনাটি বহুদিন পর তাকে কাঁদিয়েছিলো।
সেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে সে দেখলো-- গলির মুখ বন্ধ
করে পাড়ার বাচ্চারা ক্রিকেট খেলছে। সে গলির মুখ থেকেই অফিসের গাড়িটা
ছেড়ে দিলো। ওদের খেলাটা নষ্ট করতে মন চাইলো না তার। এরকম
প্রায়ই হয়, ওরা
নিয়মিতই গলির মুখ বন্ধ করে ক্রিকেট খেলে, কিন্তু এই
গলির গাড়িওয়ালা বাসিন্দারা এই ব্যারিকেড মানে না, গাড়ি নিয়েই ঢুকে পড়ে
গলির ভেতর। সে অবশ্য তা করে না, ওদের জন্য খারাপ লাগে। মাঠ নেই,
গলি ছাড়া উপায়
কি, ওরা খেলবে কোথায়?
ওদের
ব্যাট-বল-উইকেটও নেই।
টেনিস বলে টেপ পেঁচিয়ে, ইট সাজিয়ে উইকেট বানিয়ে, সস্তা ব্যাট দিয়ে ক্রিকেট খেলে ওরা।
কিন্তু সেদিন দেখা গেল, খেলা বাদ দিয়ে ওরা একটা
টোকাইকে ঘিরে ধরেছে। উত্তেজিত, মারমুখি। টোকাইয়ের অপরাধ-- ও
বলটা চুরি করেছে। কিন্তু এতগুলো কিশোরের সম্মিলিত আক্রমণের মুখেও
অপরাধ স্বীকার করতে রাজি নয় টোকাইটা। তার ভাষ্য-- বলটা সে কুড়িয়ে
পেয়েছে, কুড়িয়ে
পাওয়া জিনিসের কোনো মালিক থাকে না, অতএব এই
বল যারই হোক না কেন, সে
দিতে বাধ্য নয়! অকাট্য যুক্তি। সে এগিয়ে গিয়ে
দেখলো-- সমস্যাটি
সমাধানের অযোগ্য, কিন্তু
সমাধান করতেই হবে, নইলে
হয়তো এই ছেলেগুলো টোকাইটাকে মারধোর শুরু করবে। সে গিয়ে টোকাইকে
নরম সুরে বলটি দিয়ে দিতে বললে সে আহত চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে
তার ঝোলা থেকে বলটা বের করে দিলো। সমবয়সীদের সঙ্গে লড়াই
করা যায়, বড়রা
এসে যদি কোনো পক্ষ নেয়, তাহলে আর লড়াই জমে
কিভাবে? কিশোররা
হৈ হৈ করে খেলায় ফিরে গেলো। টোকাইটা ব হারিয়ে
বিষণ্ণ। সেদিন সে নিজের ছেলের জন্য একটা টেনিস বল কিনে
এনেছিল।
বাচ্চাটা কয়েকদিন ধরেই টেনিস বলের বায়না ধরেছে। তার
মনেই
থাকে না। আজকে রীতিমতো সেলফোনে রিমাইন্ডার দিয়ে রেখেছিল,
অফিস
থেকে বেরিয়েই ড্রাইভারকে বলেছে কোনো দোকানের সামনে গাড়ি
থামাতে।
কিন্তু এই মুহূর্তে টোকাইয়ের বিষণড়ব মুখটি তার ছেলের মুখ
কিছুক্ষণের
জন্য ভুলিয়ে দিলে সে ছেলের জন্য কেনা বলটি টোকাইয়ের হাতে
তুলে
দিলো। প্রমে খানিকটা অবিশ্বাস নিয়ে, তারপর বিস্ময় নিয়ে, বলটি
হাতে
নিয়ে এক অনাবিল হাসিতে মুখ ভরিয়ে তুললো সে। তার মনে হলো--
এমন
হাসিকেই সম্ভবত স্বর্গীয় হাসি বলে, এই পংকিল পৃথিবীতে এমন হাসির
জন্ম
হয় না! এক গভীর প্রশান্তি নিয়ে সে বাসায় ফিরলো-- সে জানতো না
এই
অনুভূতি মুহূর্তের মধ্যেই ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। বাসায় ঢুকতেই
বাবার
অপেক্ষায় বা বলের অপেক্ষায় থাকা বাচ্চাটা বাবার হাতে বল না দেখে
মর্জি
শুরু করলো। পথে ঘটে যাওয়া অপ্রত্যাশিত ঘটনাটির জন্যই যে বলটি
কিনেও
বাসা পর্যন্ত আনা সম্ভব হয়নি, বাচ্চাটাকে তা কে বোঝাবে? সে
বলতে
লাগলো-- ‘একটু
পর তোমাকে সাথে করে গিয়ে নিয়ে আসবো
বাবা’--
কিন্তু সে
নাছোড়বান্দার মতো মর্জি করতেই লাগলো। এবং যে
আশংকা
সে করছিলো, তাই
ঘটলো-- প্রায় উন্মাদের
মতো ছুটে এসে
বাচ্চাটাকে
তার কাছ থেকে কেড়ে নিলো ওর মা। তারপর ছুড়ে মারলো
বিছানার
ওপর। বাচ্চাটার মাথা গিয়ে বাড়ি খেলো খাটের কার্নিশে। কিন্তু
সেটা
দেখার মতো সময় না দিয়েই বাচ্চাটাকে নির্মমভাবে পেটাতে লাগলো।
সে
তার বউকে নানাভাবে ফেরানোর চেষ্টা করেও পারলো না, উল্টো
বাচ্চাটার
গলা চেপে ধরলো ও-- ‘খবরদার
কাঁদবি না, একটা
শব্দ করবি না,
একদম
মেরে ফেলবো।’ গলায়
সাঁড়াশি-হাতের চাপে বাচ্চাটার চোখ
বিস্ফারিত
হয়ে গেলো, জিভ
বেরিয়ে পড়লো। সে গিয়ে জোর করে বউয়ের
হাত
সরালো-- কী
করছো, মরে যাবে তো!
যাক!
মরে না কেন? মরলেই
তো বাঁচি। এই হারামজাদার জন্যই তো
এই
নরকে পড়ে থাকতে হচ্ছে। ও মরলেই তো মুক্তি পাই।
সে
আর কিছু না বলে বাচ্চাটাকে কোলে করে ড্রয়িং রুমে নিয়ে এলো--
প্রচণ্ড
মার খেয়ে একেবারে এলিয়ে পড়েছে, ফুঁপিয়ে কাঁদতে-কাঁদতে
কিছুক্ষণের
মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লো ও। মার খাওয়া, কাঁদতে-কাঁদতে ঘুমিয়ে
পড়া
ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়লো
তার।
চাল কেনার টাকা দিয়ে বল কিনে দিয়েছিল মা, আর বাবা এসে রাগ
করার
বদলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিল, তারপর তার সঙ্গে বল নিয়ে
খেলায়
মেতে উঠেছিল। আহা শৈশব, সোনার শৈশব, সাধের শৈশব। তার
ছেলেটার
জন্য এমন কোনো স্মৃতিও সে রেখে যেতে পারলো না।
ছোটবেলার
কথা ভাবতে-ভাবতে সে-ও ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙলো কী এক
শব্দে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলো-- সন্ধ্যা নামছে। ক বিষণ্ন-সুন্দর
সন্ধ্যা! বুকের ওপর ঘুমোচ্ছে ছেলেটা। আর বাইরে, পাড়ার বাচ্চাগুলো
সুর করে কী একটা গান গাইছে-- সুরটা চেনা, খুব চেনা, কিন্তু শব্দগুলো
চেনা যাচ্ছে না। সুরটা তার ছেলেবেলার। এরকম একটা ছড়াগান গাইতে-গাইতে
তারাও খেলতো-- ওপেনটি
বাইস্কোপ-- ধরনের
একটা সুর। এই
সুর এখনও আছে! এখনও পৃথিবীতে চাঁদ ওঠে, ফুল ফোটে, পাখি গায়, শিশু-কিশোররা
সুর করে গান গাইতে-গাইতে খেলে! সবই যদি থাকে তাহলে
তার ছেলেটার জীবনে এসবের কোনোকিছুর অস্তিত্ব নেই কেন? হঠাৎ
সে খেয়াল করলো-- তার
দুই চোখ দিয়ে জলের ধারা নেমেছে, ভিজিয়ে
দিচ্ছে নিজের বুক আর ছেলের মুখ।
এপ্রিল, ২০০৭
এপ্রিল, ২০০৭
1 মন্তব্যসমূহ
SOTTI SOTTI EROKOM MAYE MANUSH PRITHIBITE ACHE? AMAR MONE HOY ASHUTHO MOHILA
উত্তরমুছুন.......