মোহাম্মদ হানিফ মারা গেল। মৃত্যুটা সময়ের ব্যাপার ছিল মাত্র। সবাই মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল। অনেকদিন ধরেই মারাত্মক পাণ্ডুরোগে ভুগছিল হানিফ। হেপাটাইটিস বি পজেটিভ। ডাক্তার লতিফুর রহমান, এমআরসিপি (লন্ডন) মাথা নেড়ে বলেছিলেন, পসিবিলিটি অব রিকভারি ইজ ভেরি স্লিম, ফ্র্যাংলি টু সে, নিল; বড় জোর সাতদিন টিকতে পারে। ঢাকা কম্বাইন্ড মিলিটারি হসপিটালের একটি কেবিনে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করল হানিফ। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে থেকেই শরীরের স্থানে স্থানে রক্ত জমাট বাধতে শুরু করেছিল। চাপ চাপ রক্ত যাচ্ছিল পায়খানার সঙ্গে।
আত্মীয়-স্বজনদের ভিড় লেগে আছে অনেকদিন হল। যাদের চাকরি-বাকরি আছে বা অন্য জরুরি কাজ, তারা যায়, আবার ঘুরে আসে।
মৃত্যুকালে হানিফের বয়স পঁয়ত্রিশের মতো হয়েছিল। অ্যাকাডেমিক সার্টিফিকেট অনুযায়ী পঁয়ত্রিশ, প্রকৃত বয়স কত জানা নেই। আসলে মানুষের জন্মতারিখ নিয়েই যত ঝামেলা, কিন্তু কী অদ্ভুত, মৃত্যুদিন নিয়ে নেই কোনো দ্বিমত বা সংশয় ! একটি সরকারি ব্যাংকের মফস্বল ব্রাঞ্চের ম্যানেজার ছিল হানিফ। ব্যাংকার হিসেবে ওর ব্রাইট প্রসপেক্ট নিয়ে কারও মনে কোন সন্দেহ ছিল না। সবারই খুব পছন্দের লোক ছিল ও। এলাকার ব্যবসায়ী-আমলা থেকে আমজনতা সবাই খুব লাইক করত ওকে। ঘরেও ছিল সুখ। সুন্দরী বউ আর প্রাণচঞ্চল দুটো ছেলে। বড়টার বয়স পাঁচ-ছবছর, ছোটটার বছর তিনেক। ছেলে দুটোও ছিল বাপের বেজায় নেওটা। ব্যক্তিগত জীবনে হানিফ ছিল অত্যন্ত ডিসিপ্লিনড্। ব্যাংকের টার্গেট অ্যাচিভ করার জন্যে যেমন প্ল্যান আঁটতো, জীবনের ক্ষেত্রেও তেমনি। অথচ অনেক কাজ অসম্পন্ন রেখেই মারা গেল বেচারা, আহা!
সব প্রাণী-ই মারা যায়। মাছি চড়ুই ছাগল থেকে সমুদ্রের বিশাল তিমি আর কচ্ছপ। কচ্ছপের আয়ুই নাকি সবচে বেশিজ্জতিনশ বছর। ওরাও মরে! ভাবছিল যুবায়ের, হানিফের ছোটভাই হান্নানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু; একটা জাতীয় দৈনিকের স্টাফ-রিপোর্টার। হ্যাংলা-পাতলা দোহারা গড়ন, স্বল্পভাষী। বিয়েথা’ করেনি এখনো । থাকে দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়র সঙ্গেজ্জপেইংগেস্ট। আজ সকালে কচুখেতের বাসা থেকে আসার সময় পথের পাশে মরে-পড়ে-থাকা একটা দাঁড়কাক দেখেছিল জুবায়ের। মৃত দাঁড়কাকটা দেখে যুবায়েরের যথেষ্ট দুঃখ বোধ হয়েছিল।
কেমন একটা অশুভ ঘটনার ইঙ্গিতে ওর বুকটা কেঁপে উঠেছিল। ছোটকালে ভয় পেলে বুকে থুথু দিত, এখন দেয় না। বয়স এখন ওর বত্রিশ। যুবায়েরের মনে ইদানীং মৃত্যুচিন্তা বেশ জায়গা দখল করে থাকে। মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করার নাম জীবন, ত্রিভুজের তিনকোণের সমষ্টি দুইসমকোণের সমান, এ-রকমই জ্যামিতিক স্বতঃসিদ্ধের মত মনে হয় ব্যপারটা ওর কাছে। জীবনকে সাজানোর তাহলে কী মানে? কোরবানির পশুর গলায় বাহারি মালা, গলায় ঝোলানো পেতলের ঘন্টা বাজে টুং টাং, গোহাটা থেকে ক্রেতার ঘরে যেতে যেতে এ-দৃশ্যটি মনে এলেই যুবায়েরের হাসি পায়।
আবার মরা কাকটার কথা মনে পড়ল ওর। কী শান্তির সাথে কাকটা শুয়ে ছিল রাস্তার পাশেজ্জনরম ঘাসের ওপর। হাই ভোল্টেজ ইলেকট্রিক শকে ওর মৃত্যু হয়েছিল বোধহয়। শহুরে কাকদের ওরকম মৃত্যুই সচরাচর হয়ে থাকে। অপঘাতে এরকম একটা মৃত্যু সবার অলক্ষেই ঘটে গেছে। এখনওজ্জএবার কেমন একটা মমত্ববোধে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে; অথচ এখনও কারও ভ্রƒক্ষেপ নেই নিঃসাড় পড়ে-থাকা কাকটার দিকে, আশ্চর্য !
হান্নানের ভাইকে নিয়ে এখন আর ভাববার কিছু নেই। যা কিছু চিন্তা-ভাবনা-উৎকন্ঠা-আশঙ্কা-আশা প্রায় দুমাস ধরে ঘনিষ্ঠজনদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল তার পরিসমাপ্তি ঘটল এই কিছুক্ষণ আগে। এখন সবার চিন্তা এসে থেমে গেছে একটি বিন্দুতে; কোনো দ্বিমত নেই, নেই কোনো বিতর্কজ্জহানিফ মারা গেছে। মারা যাবার মুহূর্তটিতে যারা কাছে ছিল সবাই কান্নার সুরে কোরাসের মত করে উচ্চারণ করেছিল পবিত্র কালাম, ইন্নালিল্লাহে ওয়াইন্না ইলাহে রাজেউন। এই কালামের মধ্য দিয়েই মুসলমানদের জীবনের ফুলস্টপ ঘোষণা করা হয়! হানিফের ছেলে দুটো শুধু কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকেছিল বিলাপরত লোকজনদের পানে। বড়ছেলেটি বাপ মারা গেছে শুনে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল; ছোটটি ওর হাতের সুন্দর খেলনাটি যেন মাটিতে পড়ে না যায় সেজন্যে ছোটাছুটি-করা লোকজনদের ভিড় থেকে কিছুটা তফাতে দাঁড়িয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থেকেছিল।
শোকের ঘূর্ণিঝড়ে সবগুলো লোক বিচিত্র শারীরিক ভঙ্গিমা আর বিলাপে মেতে উঠল। ছফুট-একইঞ্চি লম্বা, স্বাস্থ্যবান-সুদর্শন হান্নান নাটকীয় কায়দায় শোক প্রকাশ করছিল। হান্নান মঞ্চ এবং টেলিভিশনে মাঝেমধ্যে নাটকটাটক করে তো। চাকরি করে একটা সরকারি কর্পরেশনে। শোক প্রকাশের মধ্যে শিল্প থাকা মন্দ কিছু নয়। জানামত যত শৈল্পিক শোকের দৃশ্য হান্নানের মনে আসছিল প্রায় সবগুলোই ফুটিয়ে তুলবার প্রাণান্ত চেষ্টা করছিল। ওর ভাবির ছোটভাই মোস্তফা; পুরো নাম গোলাম মোস্তফা চৌধুরী; বহুজাতিক এক কম্পানিতে চাকরি করে। অল্প বয়সে টাকাকড়ি ভালই বানিয়েছে। মেটালিক গ্রে রঙের টয়োটা করোলা হাকায়। ফিটফাট ওয়েস্টার্ন পোশাকে থাকে সবসময়। বছরে বেশ কবার ফরেনকান্ট্রি ট্যুর করে। ইমিডিয়েট বড়বোন রোকেয়াকে খুব ভালবাসে। ব্রাদার-ইন-ল’র অকালমৃত্যুতে কী-যে শোক ওর! বারবার বোনের সামনে গিয়ে দামি রুমালে চোখ মুছছিল আর ইংরেজি-বাংলায় যা বলছিল তার অর্থ দাঁড়ায়, আহা কী ভালই না বাসত দুলাভাই ওকে! খেতে পছন্দ করত বলে আপাকে চাইনিজ রেসিপি শিখতে উৎসাহ যুগিয়েছিল প্রফেশনাল শেফ ডেকে এনে। আর ও-ও তো দুলাভাই ছাড়া কিছুই বুঝত না। এবারও তো সিঙ্গাপুর থেকে দুলাভাইর জন্যে দামি স্যুটপিস নিয়ে এসেছিল। আহা, পরা হল না! বুক ঠেলে কান্না আসে ওর।
হান্নানের একদম পছন্দ নয় মোস্তফাকে। ব্যাটা একটা আস্ত হিপোকৃট! এখন ন্যাকামো দেখাচ্ছে! দুলাভাই প্রীতি! অথচ এইতো সেদিন, আমার ভাইটা তখন সুস্থ-সবল; বলিসনিজ্জআমাদের ঘরে বোন দিয়ে ফ্যামিলি স্ট্যাটাস খর্ব হয়েছে তোদের! টাকা থাকলেই স্ট্যাটাস হয়? নামের শেষে চৌধুরী যে-কেউ লিখতে পারে, লিখলে আপত্তি করবে কে? এ-ধরনের অনাচার ঠেকাতে দেশে তো কোনো আইনও নেই। মূল ব্যাপারটা হচ্ছে কালচার। সংস্কৃতি,... হ্যাঁ সংস্কৃতি। সংগীত বা নাটক-সার্কেলের কটা লোকের সঙ্গে ওঠাবসা তোর, শুনি? নিঃসন্দেহে নাটকই হল গে সংস্কৃতির প্রাণ...! আর আমাদের টাইটেলটাই বা কম কিসে। ভুঁইয়া। বিখ্যাত বারো ভুঁইয়া...ইশা খাঁ’র বংশধর। ইচ্ছা হয় না তাই লিখি না। তবে মানতেই হবে ভাবি গোবরে পদ্মফুল। আহা কী লক্ষ্মী মেয়ে গো...। হান্নান আড়চোখে তাকাচ্ছিল রোকেয়ার দিকে। আপেল-আদল রোকেয়ার মুখে শোক আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের স্পষ্ট ছাপ। অবিন্যস্ত চুল লুটিয়ে পড়েছে কপাল আর চিবুকের পর। স্লিভলেস ব্লাউজ ঘামে ভিজে সপ্সপে, এঁটে বসেছে স্লিম শরীরের সঙ্গে। বৃষ্টি-ধোয়া বাতাপি জামিরের মত সুডোল স্তনজোড়া লো-কাট ব্লাউজের ফাঁক গলিয়ে উঁকি দিচ্ছে। হান্নানের দৃষ্টি জোয়ারের সফেন লোনা তরঙ্গের মত আছড়ে পড়ে রোকেয়ার মুখ আর বুকের সৈকতে।
কোরবান আলী ভুঁইয়া, হান্নানের চাচা খুবই পরহেজগার লোক। একসময় মহাজনি ব্যবসা ছিল রমরমা। তা-ছাড়াও ছিল মজুতদারি। আকালের বছর সে-কী লাভ! সবই আল্লার ইচ্ছা! বছর দশেক আগে ওসব ব্যবসা ছেড়েছুড়ে দিয়ে হজ্ব করে এসেছেন। এখন আল্লাবিল্লা ছাড়া কিছুই বোঝেন না। থুতনিতে পাটের আঁশের মত মেন্দি লাগানো একগুচ্ছ দাড়ি, কপালে সালাত আদায়ের সাক্ষী কালো দাগ, মাথায় গোল টুপি। নাদান লোকগুলোর বেদাতিতে ভীষণ বিরক্ত বোধ করছেন তিনি। এ কী ধরনের বেশরিয়তি বেলেল্লাপনা! গম্ভীর গলায় গর্জে ওঠেন তিনি, ‘মুর্দারে নিয়া আহাজারি করা যায়েজ না। আল্লার মাল আল্লায় নিয়া গেছে। ওয়াইন্না ইলাহি রাজেউন মানে বোঝো মিঞারা ? আর বৌমা (একটু থেমে, রোকেয়াকে লক্ষ করে) অনেক বেগানা পুরুষ ... তুমি আওরাতগরে নিয়া অন্যখানে যাও। ইয়া আল্লাহ... রহমানুর রাহিম, মুর্দার গোনাখাতা মাফ কইরা দিও মাআবুদ। সবাই মনে মনে দোআদরুদ পড়েন... তাতে কাম হইব...।
হান্নানের ভগ্নিপতি মতলব ম-ল; ঠিকাদারি ব্যবসা করে; ফেনীতে সেটেলড্। পিকড ঝামার মত গায়ের রং। বেঁটেখাটো। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। হাতের আঙুলে বিভিন্ন পদের পাথর বসানো গোটা চারেক আংটি। দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়র সঙ্গে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে আলাপ করছিল। আলাপের ফাঁকে ফাঁকে আংটি-পড়া তর্জনী দিয়ে হাসপাতালের দেয়াল খুঁটছিল (এটা ওর একটা বাতিক। সিমেন্ট বালির প্রপোরশন ও আঙ্গুলে পরখ করতে পারে। ঝানু ঠিকেদার হিসেবে ওর যথেষ্ট সুনাম) আর খুব আফশোস করছিল হানিফের এ অসময়ে-চলে-যাওয়া নিয়ে, ‘বড় অমায়িক লোক আছিলেন ভাইছাব। খুব টান আছিল আমার প্রতি। একবার ব্যবসায় টাকার ঠ্যাকা পড়ে গেল, খুব উপকার করছিলেন। গায়ের চামড়া দিয়া ওর জুতা বানায়া দিলেও সেই উপকার শোধ হবার নয়। আহা, একটা শক্ত পিলার যেন ভাইঙ্গা গেল আমার ! ভাইছাব যে কী ভালই বাসতেন আমারে ... বলতে বলতে গলা ভারী হয়ে এল মতলবের, কত কাম ফালাইয়া আমি ছুইটা আসছি উনার অসুখের খবর শুইন্যা, জানেন? আর দুইদিন কাটাইয়া আসতে পারলে নাথেরপেটুয়া হেলথ কমপ্লেক্সের রিপিয়ারিং কজের সেকেন্ড রানিং বিলটা জমা দিতে পারতাম... যাক ওইটা কোনো ব্যাপারই না ... আল্লাহ, কী কঠিন শোকের মধ্যে তুমি ফালাইয়া দিলা... আল্লাহ ...।
কান্নাকাটির রোল কিছুটা থিতিয়ে পড়েছে। লাশ নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার। দাউদকান্দির সোনারচরে পৈত্রিক বাড়িতে, পারিবারিক গোরস্থানে লাশ দাফন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
রোকেয়ার বড় বোন ফারজানার স্বামী আর্মি অফিসার; লেফটেন্যান্ট কর্নেল। তবে সবাই কর্নেল সাহেব বলেই ডাকে। তাঁর চেষ্টাতেই তো হানিফ সিয়েমেইচে ভর্তি হতে পেরেছিল। কর্নেল বদরে আলম আর্মিতে চাকরি করলেও আত্মীয়-কুটুমের প্রতি তাঁর খুব দরদ। কিন্তু চেহারা দেখে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের পক্ষেও তাঁর মনের কথা আঁচ করা সম্ভব হত কি না যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে তাতে। ওকে দেখলে শিশুরা কেঁদে ওঠে। প্রকা- থলথলে সারা মুখে বসন্তের দাগ। বেজির লেজের মত একজোড়া গোঁফ আর মোটা মিশকালো ভুরু, কদমছাট চুল।
হানিফের মৃত্যুসংবাদ দিতে সেই কখন দুবোন গেছে, ফেরার নামগন্ধ নেই । হান্নান অস্থিরভাবে পায়চারি করতে থাকে আর বিড় বিড় করে আপন মনে কি যেন আওড়াতে থাকে। যুবায়ের নিচু গলায় বলে, ‘খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে না?
হান্নান বিরক্তি মেশানো সুরে বলে, ‘আমি কি করব? কর্নেল সাব না এলে লাশের কোন গতি নাই... আফটার অল কর্নেল তো যে-সে জিনিস নয়...
কিছুটা সংকোচ নিয়ে বলে যুবায়ের, একবার খোঁজ করলে হয় না? কথাটা বলেই কাঁচুমাচু করতে থাকে। ও-তো মৃতের আত্মীয়-কুটুম পর্যায়ের কেউ নয়। অতি আনন্দ বা অতি শোকের সময় মানুষ কিছু কিছু সামাজিকতা খুব কড়াকড়িভাবে মানতে পছন্দ করে। হাত কচলাতে থাকে যুবায়ের। অপ্রতিভ হলে হাত কচলানো ওর স্বভাব।
আর্মির গাড়িতে চেপে দুবোন আর কর্নেল বদরে আলম এসে পৌঁছোলেন। হাসপাতালের ডিউটিরত স্টাফরা মাটিতে পা আছড়ে অভিবাদন জানাল। একজন স্টাফকে লক্ষ করে ভরাট গলায় কর্নেল বললেন, ‘বেটা, জলদি মুর্দাকে পাঠানোর ব্যবস্থা কর...।
লাশের আশপাশে জড়ো হয়ে-থাকা লোকজন খুবই সমীহের সাথে দেখছিল কর্নেলের নড়াচড়া, কথাবার্তার ধরন। মতলব ম-ল ফিস ফিস করে পাশের কাকে যেন বলছিল, ‘ভাইছাবের ভাগ্য বটে, কয়জনের কপালে কর্নেল ভায়রা জোটে? হায়াত মৌত আল্লার হাতে... কিন্তু কত সম্মান পাইতেছেন ভাইছাব মৃত্যুর পরও ... বড়ই অমায়িক ও নেক বান্দা আছিলেন তো ...।
মতলব কর্নেলের আশেপাশে ঘুরঘুর করছিল আর এমন ভাব দেখাচ্ছিল যে, মৃত সৎকারের কাজে ওর জুড়ি নেই। মোস্তফা এমনভাবে কথাবার্তা বলছিল যেন ও-ই উপস্থিত লোকদের মধ্যে দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি। কর্নেল ওর আপন ব্রাদার-ইন-ল কিনা! হান্নান বাঁকাদৃষ্টিতে বারবার তাকাচ্ছিল মোস্তফার দিকে আর লম্বা লম্বা পা ফেলে অযথাই ছোটাছুটি করছিল এদিক-ওদিক। মাঝে মাঝে রোকেয়ার কাছে এসে চাপা স্বরে কথা বলছিল। দেখে মনে হচ্ছিল অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা। রোকেয়া অভিব্যক্তিহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সুমুখের দিকে। কোরবান আলী গলা খাঁকরে স্বগতোক্তি করেন, মাগরেবের সময় হইয়া আসল... নামাজটা সাইরা আসি আমি, হে পাক পারওয়ারদেগার...
সূর্য অস্ত গেছে কিছুক্ষণ হল। আকাশের বিশাল বক্ষ থেকে উপচে-পড়া রাত্রির নিঃশব্দ ঢল ধীরে ধীরে ছেয়ে ফেলছে বিশ্বচরাচর। এখন হেমন্তের মাঝামাঝি। সন্ধে গড়াতেই বাতাসে শীতের আমেজ। হাসপাতালের গাছগাছালিতে ঝুলে-থাকা কাফনের মত ফিনফিনে কুয়াশা ক্রমশ জমতে শুরু করেছে। গাছের ডালে বসে মাঝে মাঝে ডাকছে ক্লান্ত কয়েকটি কাক। প্রকৃতির সব রং ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে।
যুবায়ের পায়চারি করছিল হাসপাতালের লম্বা টানাবারান্দার এমাথা-ওমাথা। হানিফকে নিয়ে এখন ওর করবার কিছুই নেই। মনের মধ্যে ওর জেগে উঠছে বেশ কিছু স্মৃতি। হান্নানের বন্ধু হিসেবে প্রায় দুটো মাস ও হাসপাতালে যাওয়া-আসা করছে। হাসপাতাল খুব খারাপ লাগত একসময়। রোগীদের কাতরানো, স্যালাইন ও রক্তের ঝোলানো ব্যাগ, অক্সিজেন-সিলিন্ডার, ফিনাইল-ব্লিচিংপাউডারের ঝাঁজালো গন্ধ আর সর্বত্রই শোকের কেমন এক নিঃশব্দ পদচারণা। একটানা দুমাস আসা-যাওয়া করে গা-সওয়া হয়ে গেছে এসব। ভালই তো লাগে বেশ হাসপাতালের সময়গুলো এখন। এরই মধ্যে বেশ কিছু রোগীর সঙ্গে খাতির হয়েছে; রোগীদের আত্মীয়-স্বজন কারো কারো সঙ্গে গড়ে উঠেছে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা।
হানিফের পাশের কেবিনের রোগী ইমতিয়াজ আহমেদ। গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। সৌম্যদর্শন মাঝবয়সী ভদ্রলোক। চোখে সোনালি চিকন ফ্রেমের চশমা। বালিশে ঠেস দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় বই পড়ে কাটান বেশির-ভাগ সময়। দেখা হলেই স্মিত হেসে বলেন, কেমন আছেন? বসুন। গুন্টার গ্রাসের একটা উপন্যাস পড়ছি...দ্য টিন ড্রাম...পড়েছেন?
ইমতিয়াজ আহমেদের স্ত্রী একটি প্রাইভেট কলেজের লেকচারার। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রুচিশীল ছিমছাম মহিলা। প্রতিদিন সন্ধেয় আসেন স্বামীর জন্যে খাবার নিয়ে। হাতে থাকে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা, কিছু বই, সাময়িকী। সকালে আসে ওঁর ছোট বোনজ্জঝিম্লি । ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। সোশ্যালজিতে অনার্স থার্ডইয়ার। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম। থুতনির কাছটাতে ছোট্ট একটা তিল। ওপরের সারির একপাশের একটা দাঁত কিছুটা উঁচু, হাসলে ভালই দেখায়। সালোয়ার কামিজ পরে আসে। পাহাড়ি ঝরনার মত চঞ্চল ও প্রগলভ। যুবায়েরকে ডাকে যুবের ভাই। মেয়েটিকে ভাল লাগে যুবায়েরের। আজ সকালেও এসেছিল, খবর নিয়েছিল হানিফের। হানিফ কোমাতে। ঝিম্লির সুন্দর মুখের ওপর বিষাদের ছায়া নেমে এসেছিল। হঠাৎ করেই হাসপাতাল ছেড়ে যেতে যুবায়েরের বেশ খারাপ লাগছে এখন।
মানুষের জীবনে সুখ-দুঃখ খুব কাছাকাছি অবস্থান করে। মনে পড়ে, দিন সাতেক আগেও একদিন হানিফ হেসেছিল ম্লান হাসি, হান্নানের সরেস এক উক্তি শুনে। কনডেমড্ সেলের আসামিরাও হয়তো কখনও হঠাৎই হেসে ওঠে অতীতের সুখস্মৃতি মনে এলে, অথবা অকারণেই। হাসে না কি?
আজকের পর ইমতিয়াজ আহমেদকে দেখতে আসাটা কেমন দেখাবে, ভাবে যুবায়ের। কী ভাববে ওরা? ঝিম্লি কী...।
আর কটা দিন দেরি করে মারা গেলে কি চলত না হানিফের!
ট্রাক এসে গেছে। জোয়ানরা অত্যন্ত নিপুণভাবে এরই মধ্যে মুর্দাকে কফিনে পুরেছে। কোরবান আলী বেশ জোরে বলে ওঠেন, সবাই কলেমা তাইয়েবা পড়েন। খুব আস্তে সাবধানে মুর্দারে গাড়িতে তোলেন... খুব সাবধানে... কুনোখানে চোট লাগে না য্যান...
আবারও কোরাসের মত করে সবাই কলেমা তাইয়েবা উচ্চারণ করতে করতে কফিন কাঁধে নিয়ে ট্রাকের দিকে এগোতে থাকে। খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা ট্রাকে উঠে কফিন ঘিরে দাঁড়ায়। ফোঁপাতে ফোঁপাতে রোকেয়া দুসস্তান নিয়ে মোস্তফার করোলায় গিয়ে ওঠে। কর্নেল মিনিট দশেক ছিলেন। জোয়ানদের সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে ফারজানাকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেছেন। আজ আর্মি কমিউনিটি হল সেনাকুঞ্জে খুব জাঁকজমকপূর্ণ পার্টি আছে তো। বেশ কজন জেনারেল আসবেনজ্জচিফেরও আসবার কথা।
হান্নানের পীড়াপীড়িতে যুবায়েরকেও লাশের সঙ্গে রওনা দিতে হল।
ট্রাকে মেঘনা ঘাট। ওখান থেকে নৌকোয় কিছুটা। বেশ কিছুটা পথ কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যেতে হল লাশ। রাস্তার যা ছিরি, কয়েকবার কাঁধ থেকে লাশটা পড়তে পড়তে অল্পের জন্যে বেঁচে গেছে। ধানখেতের মধ্য দিয়ে পথ, তার ওপর আবার গাঢ় অন্ধকার। টর্চের আলোয় আর কতটুকুই বা কুলোয়। ভোর হয়ে গেল সোনারচর পৌঁছোতেই। বাড়ির সীমানায় লাশ-কাঁধে লোকজনের মিছিল পৌঁছোতেই মরাকান্নায় কুয়াশা-ভেজা ভোরের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। হানিফের মা ডায়রিয়ায় ভুগছেন বেশ কদিন ধরে। স্যালাইনের ওপর আছেন। বৃদ্ধ পিতা শওকত আলী বাতের ব্যথায় শয্যাশায়ী। সবচেয়ে ছোট বোনের স্বামী আক্কাস শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে-থাকা একমাত্র শক্ত-সমর্থ পুরুষ। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বর। খেত-খামার দেখাশোনা ছাড়া অন্য কোনো কাজকম্ম তেমন নেই।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকজনের ভিড় বাড়তে থাকে। কেউ চিৎকার করে বিলাপ করতে থাকে, কেউবা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। ঘনিষ্ঠ কেউ এলেই হান্নান জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। হাজার হলেও সহোদর ভাই, তার ওপর পিঠেপিঠি। সবাই হান্নানের ব্যথা বোঝে। কেউ ওর সাথে সুর মিলিয়ে কাঁদে, আবার কেউ সান্ত¦না দেয়, কী করবা কও, যে চইলা গেছে তারে তো আর ফিরাইয়া আনবার পারবা না...। মা-বাপ বুড়া, তারারে তসল্লি দেওন অহন তোমার কাম...
হান্নানের দূরসম্পর্কের আত্মীয়, এলাকার যথেষ্ট প্রভাবশালী ব্যক্তি, আবুল হোসেন মাস্টার পাটভাঙ্গা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে কাঁধের ওপর শেয়ালরঙা শাল ফেলে এসে উপস্থিত হলেন একটু দেরিতে। পুকুরপাড়ে পৌঁছোতেই হান্নান দৌড়ে গিয়ে তাঁকে এমনভাবে জাপটে ধরল যে, লোকটি আর একটু হলেই পুকুরে পড়ে যেতেন। যথেষ্ট কষ্ট করে নিজেকে সামলে নিলেন। শোকে মানুষ কি রকম কাতর হতে পারে হান্নানকে দেখে সবাই বুঝছিল। আবুল হোসেন মাস্টারের জন্যে ঘরের ভেতর থেকে চেয়ার আনা হল। বসতে যেতেই পাশ থেকে একজন এসে হৈ হৈ করে উঠল, বইয়েন না মাস্টারসাব, গামছা দিয়া মুইছ্যা দেই, কাউয়ার গু লাইগ্যা আছে মনে অয়...
কাঁধের চাদরটা টেনেটুনে ঠিক করে নিয়ে মাস্টার সাহেব তসরিফ রাখলেন। আবুল মাস্টার এসেছেন শুনে কোমরে দুহাত চেপে কুঁজো হয়ে কাশতে কাশতে শওকত আলী ভুঁইয়া ভেতরবাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। কেমন অদ্ভুত শব্দ বেরোচ্ছিল তাঁর মুখ থেকে। দৌড়ে গিয়ে একজন তাঁকে ধরে চেঁচিয়ে ওঠে, আরে আরে পইড়া যাইবো তো, ব্যারামি মানুষ, তার উপর আবার পুত্রশোক...
আরেকটা চেয়ার এনে বসানো হয় হান্নানের বৃদ্ধ পিতাকে। মাথায় বিরাট টাক, মুখে সাদা চাপদাড়ি, লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা, শরীরে জড়ানো মোটা চাদর। চেয়ারে বসেই হাঁপাতে থাকেন বেশ জোরে জোরে। শ্বাস নেয়ার সময় চিলের ডাকের মত মিহি এবং তীক্ষè একটা শব্দ বেরোচ্ছিল গলার সুরঙ্গ থেকে। শীত এলেই হাঁপানি চাঙা হয়ে ওঠে। হানিফের কফিনটা বৈঠকখানার সমুখের আম গাছটার ঠিক নিচে রাখা হয়েছে। বৃদ্ধ পিতা কফিনের দিকে তাকিয়ে ফোঁপাতে লাগলেন অনবরত। আবুল মাস্টার বৃদ্ধের হাত দুটো নিজের মুঠোয় চেপে ধরে খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। আশপাশে দাঁড়ানো ও হাঁটু গেড়ে-বসা লোকজন নিবিষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল মাস্টারের দিকে। মাস্টারের মুখ থেকে বেরোনো সান্ত¡নার বাণীগুলো সোৎসাহে গিলছিল লোকগুলো। মাস্টার মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকাচ্ছিলেন জটলার দিকে; ভালই লোক জমা হয়েছে। শ-দুয়েক তো হবেই। বেশি লোকের জমায়েতে দু-চার কথা বলতে পেলে মাস্টারের দারুণ ভাল লাগে। এখনই এত! জানাযায় না জানি কত হবে! আবুল মাস্টার পকেট থেকে একশ টাকার একটা নোট বার করে তাগড়ামত এক ছোকরার হাতে গুঁজে দিয়ে হুকুমের সুরে বললেন, ‘যা কুদ্দুইচ্যা পুরা এলাকায় নামাজে জানাযার মাইকিং কইরা দে... বাদ যোহর সোনারচর মাদ্রাসার মাঠে... হান্নানের বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী কন তাঅই সাব, ঠিক আছে না?
শওকত আলী ফোঁপাতে ফোঁপাতে মাথা নাড়েন
Ñমুর্দার গোছল দেওন আর কবরের ব্যবস্থাটাও অহনই কইরা ফ্যালান উচিত ... অ হান্নান মিঞা, অ আক্কাস মিঞা এইদিকে একটু শুনেন ... কি কন তাঅই সাব, সকলের সাথে পরামর্শ করন দরকার, না কি কন?’ Ñ শেষকৃত্যের এমন একটা অনুষ্ঠানের মূল নেতৃত্ব এখন আবুল মাস্টারের হাতে, ভাবতেই ভাল লাগছিল তাঁর। তাছাড়া এ তো যার-তার মৃত্যু নয়; সোনারচরের ভুঁইয়া বাড়ির বড় ছেলের। যথেষ্ট নামডাক ভুঁইয়া বাড়ির এতদঞ্চলেজ্জএকটুও বাড়ানো কথা নয়...।
বাড়ির ভেতর থেকে মহিলাদের আর্তস্বরে কান্নার শব্দ শোনা যেতে লাগল। সমুদ্রের জোয়ার ভাটার মতই যেন মাঝে মাঝে কান্নার বেগ বাড়ছিল কমছিল। রোকেয়া এইমাত্র এসে পৌঁছেছে। হান্নান ছুটে যায় বাড়ির ভেতর। ভাবির সঙ্গে ওর অনেক জরুরি আলাপ আছে তো।
আবুল মাস্টার হানিফের আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে মুর্দার দাফনের ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত।
যুবায়ের পুকুরপাড়ে একটা গাছের গুড়ির ওপর বসেছিল চুপচাপ। নিজেকে কিছুটা অবাঞ্ছিত মনে হচ্ছিল। হাতে গোনা কজন ছাড়া সবাই অপরিচিত। সারা রাত দু-চোখের পাতা এক হয়নি। ঘুমে চোখ ভেঙে আসছিল। কিছুই করার নেই। এমন শোকাচ্ছন্ন বাড়িতে ঘুমের জায়গা কোথায় পাবে? জায়গা পেলেই কি ঘুম আসবে?
মোস্তফাও এখানে খুব একটা জুত করতে পারছিল না। যুবায়েরের কাছে গিয়ে বসে আলাপ জমাতে চেষ্টা করে, কী একটা ম্যাসাকার হয়ে গেল, তাইনা যুবায়ের ভাই? বিশ্বাসই হতে চায় না। ও গড, হোআট অ্যা হার্ট রেন্ডিং সিচুয়েশন! আপা আর বাচ্চা দুটোর যে কি হবে এখন?
যুবায়ের কোন কথা বলে না।
Ñজানেন যুবায়ের ভাই, টু টেল ইউ ভেরি ফ্র্যাংকলি, এ বাড়িতে দুলাভাই ছাড়া একটা লোকের মধ্যেও ভালবাসা, ইমোশন, সিমপ্যাথি এসব মানবিক গুণের লেশমাত্র নেই। দুলাভাই আর আপার ওপর কী যে মানসিক নির্যাতন, আই মিন মেন্টাল টরচার হয়েছে তা যদি জানতেন... মোস্তফা বলেই চলে, শুধু গতরাত নয়, বেশ করাত ধরেই আমার চোখে ঘুম নেই, অফিসেও ইরেগুলার...। অথচ এ বাড়িতে কি তেমন কোন শোকের ছায়া দেখছেন? বলুন আপনার কি ধারণা? ফ্র্যাংকলি বলুন... আমি কিছু মাইন্ড করব না...।
কোনো কোনো সময় মানুষের খুব খোলামেলা কথা বলতে ভাল লাগে। পাত্র-অপাত্র জ্ঞান থাকে না। কেন এমন হয় যুবায়ের তা বোঝে না। মোস্তফার কথার কী জবাব দেবে, কথা খুঁজে পায় না যুবায়ের। কথা বলতে একদম ইচ্ছা করছে না ওর। শুধু বলে, খুবই শোকের ঘটনা বটে...।
মোস্তফা হতাশ হয়। ওর এতগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথায় কোনো আমলই দিল না যুবায়ের। দেবে কেন! আফটার অল, হান্নানের বুজম ফ্রেন্ড তো!
দূরে মাইকের আওয়াজ শোনা যায়, জানাযার মাইকিং। লোকের ভিড় ক্রমেই বাড়তে থাকে। চলতে থাকে একঘেয়ে কান্নাকাটি আর সান্ত¦নার বাণী। মাদ্রাসাসংলগ্ন মসজিদ থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসে। আবুল মাস্টার তাগাদা দেন,চলেন, মুর্দা নিয়া মসজিদে চলেন, আর বিলম্ব না...।
হানিফের লাশ মসজিদ থেকে-আনা খাটিয়াতে তোলা হয়। হান্নান বাড়ির ভেতর থেকে দৌড়ে এসে বলে, শেষবারের মত ভাবি আর মা ভাইয়ের মুখ দেখতে চায়, একটু অপেক্ষা করেন প্লিজ...।
আবার উচ্চস্বরে কান্নার রোল পড়ে যায়।
হান্নান কি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে! সবার সম্মুখে, হোক যতই শোক, ভাবিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে হবে এভাবে, ছিঃ! শওকত আলী ভেটকি মাছের মত লম্বা ঠোঁটদুটো কুঁচকে ফোঁসফোঁস করে ওঠেন, বড়ডারে তো খাইছে ওই বেডি, অহন ছোটডার উপর নজর... আমি বাইচ্যা থাকতে নট হয়েগা...।
কান্না থেমে আসে। তারপর শবাধার মাটি থেকে শূন্যে উঠে কাঁধে ভর করে। ধীরে ধীরে এগোতে থাকে মসজিদের দিকে, সরু মেঠো পথ ধরে। আগে-পিছে গিজগিজে লোক, লোকের মিছিল। সবার পেছনে ক্লান্ত পায়ে হাঁটতে থাকে যুবায়ের। পথের দুপাশের জমিতে যেন কেউ হলুদ চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। সর্ষেফুলের ঘ্রাণে কেমন মাদকতা। প্রজাপতি ওড়ে এখানে-ওখানে। যোহরের নামাজের পর মুসল্লিরা খাটিয়াকে সামনে রেখে কাতারবদ্ধ হয়ে দাঁড়ান। বহু লোকের সমাগম, মাদ্রাসার মাঠে তিল ধারণের স্থান নেই। এত বড় জানাযার নামাজ এলাকার লোক এর আগে আর কখনও দেখেনি। আবুল মাস্টার অত্যন্ত আবেগ জড়ানো কন্ঠে মরহুমের জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করলেন। ফাঁকে ফাঁকে লাল রুমালে চোখ মুছলেন। ইমাম সাহেব মরহুমের পক্ষ থেকে কাউকে কিছু বলার জন্যে অনুরোধ জানালেন। হান্নান কান্নাভেজা গলায় তার ভাইয়ের জন্যে সকলকে দোআ করতে বলল। কারো মনে আঘাত দিয়ে থাকলে নিজগুণে মাফ করে দিতে অনুরোধ করল। কারো কাছে ধারদেনা থেকে থাকলে তা পরিশোধের আশ্বাস দিল... ইত্যাদি।
ইমাম সাহেবের কানে কানে এক মুসল্লি যেন কি বলতে লাগল। তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনলেন আর মাথা নাড়লেন। একটু কেশে ইমাম সাহেব দরাজ গলায় বললেন, এহনই জানাযার নামাজ শুরু হইব, তয় তার আগে কিছূ কথা আছে...। কাতারবন্দি সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ইমাম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, মরহুম কত দিন অসুস্থ আছিলেন, কইতে পারেন কেউ...?
হান্নান চেঁচিয়ে বলল, দুই মাসের মত, হুজুর...।
ইমাম সাহেব বললেন, আরে সাহেব, মত কি, ঠিক কত দিন তাই কন...
কিছুক্ষণের জন্যে আবার নীরবতা। মনে মনে হিসেব করে হান্নান, তারপর জানায়, চৌষট্টি দিন... ঠিক চৌষট্টি দিন, ঘন্টা বলা লাগবে না তো?
ইমাম সাহেব বললেন, ঠিক তো, হিসাব ঠিক আছে তো?
হান্নানের জবাব, জি... ঠিক, একেবারে ঠিক...
ইমাম সাহেবের গলা, ইসালামি মতে রাইতের থেইক্যা কিন্তু দিন শুরু হয়, জানেন তো?
আবার নিস্তব্ধতা। বেশ কিছুক্ষণ পর ইমাম সাহেব নীরবতা ভাঙলেন,চৌষট্টি দিন মানে তিনশত চৌরাশি ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে নাই মাইয়েদ...ঠিক কি না? হিসাবে কি ভুল আছে?
মনে মনে চৌষট্টিকে পাঁচ দিয়ে গুণ করে হান্নান। ইমামের হিসেবের সঙ্গে মেলে না, কিন্তু মুখে কিছু বলে না। কেমন এক আড়ষ্ঠতা ওকে ছেঁকে ধরেছে !
চ্যাংড়ামত, দেখে কলেজ পড়–য়া মনে হয়, বলে ওঠে, দিনে পাঁচ ওয়াক্ত হইলে চৌষট্টি দিনে তো তিনশ বিশ ওয়াক্ত হয়, হুজুর...
মুখ বিকৃত করে হুজুর খেঁকিয়ে ওঠেন,জাহেল কোনেকার! আইজকালকার পোলাপানরা নামাজ আদায় করে না, ইস্কুল কলেজে কুফরি শিক্ষা শেখে, আর কি কয় পপ্ ডিসকু নাচে... হে ব্যাডারা বেতরের নামাজের কথা জানব কইত থন্...? হ, নামাজ ছয় ওয়াক্ত, পাঁচ ওয়াক্ত ফারজ্, এক ওয়াক্ত ওয়াজিব... ঠিক কি না?
সবাই নিশ্চুপ। ইমাম সাহেব বলে চলেন, প্রতি ওয়াক্ত নামাজের জন্য একটা ফেৎরা, এক সের তের ছটাক গম অর্থাৎ টাকায় পনের টাকা কাফ্ফারা পাওনা হইছে, ঠিক আছে?
নামাজে দাঁড়ানো লোকদের মধ্যে থেকে খোঁড়ামত একজন বলে ওঠে, জে, বিলকুল ঠিক আছে, হুজুর...
ইমাম বললেন,তা হইলে মোট কাফ্ফারা হয়... কত হয়? বাইর করেন দেহি কেউ... মানসাঙ্কে পাকা কেডা, পরীক্ষা হউক এই উছিলায়...। হুজুরের সফেদ দাড়ি কাঁপিয়ে ঝিলিক দিয়ে ওঠে নিঃশব্দ হাসি।
ভিড়ের মধ্য থেকে কে একজন বলে ওঠে পাঁচ হাজার সাত শত ষাইট টাকা হুজুর, তিন শত চৌরাশি ইন্টু পনের, তাই হয়। চোখে-মুখে গর্ব নিয়ে এদিক-ওদিক তাকায় লোকটি।
যুবায়ের এ-ধরনের ঘটনার মুখোমুখি আগে কখনও হয়নি। একজন মৃত্যুপথযাত্রী চৌষট্টি দিন নামাজ পড়েনি, নামাজ পড়ার মত অবস্থাই তো ছিল না, অথচ কী আশ্চর্য সে-জন্যে আজ তার ঘাড়ে কাফ্ফারা!
হান্নানও এ-নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে উদ্যত হয়, কিন্তু থেমে যায়। নিজেকে সংস্কৃতিবান নাট্যশিল্পী মনে-করা হান্নানের সব অহংকার যেন মুহূর্তে চুপসে যায়। চুপচাপ অধোমুখে দাঁড়িয়ে থাকে নামাজের কাতারে আর পায়ের নখ দিয়ে মাটি খুঁটতে থাকে। ইমাম সাহেব আবার তাগাদা দেন,কি হইল, কাফ্ফারার টাকাটা জলদি দিয়া ফালান। নামাজ শুরু করতে দেরি হইতেছে যে। মুর্দার কষ্ট হইতেছে।
হান্নান এবার যথেষ্ট বিনয়ের সঙ্গে বলে, ‘হুজুরের কথা ঠিক, আপনার হিসাব মতই টাকাটা দেওয়া হবে, আমি জবান দিচ্ছি...। এখন তো সাথে নিয়ে আসি নাই...। জানাযাটা মেহেরবানি করে পড়ান, বিকালেই টাকাটা আপনার হাতে পৌঁছে দেব... ওয়াদা, ... হান্নানের ওয়াদা কখনও খেলাফ হয় না...
কে যেন একজন ব্যঙ্গ করে বলে ওঠে,কত ওয়াদাই তো দেখলামরে ভাই... বাকি মানেই ফাঁকি ...
ইমাম সাহেব হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন,খামোশ... ব্যায়াদবের মত কেডা কথা কয়? আমি কথা বলতাছি ভাল লাগতেছে না বুঝি, অ্যাঁ? তো বাবা মোহাম্মদ আবদুল হান্নান, আপনেরা রাজধানীর লোক, উচ্চ শিক্ষিত্, আল্লার রহমতে ভাল আয়-রোজগার করেন, আল্লা আরও দেউক আপনাগরে, দোআ করি। তা বাবা কাফ্ফারা তো দিবেন তা জানি কিন্তু আল্লার ঘর এই মসজিদের দিকে একটু দেখবেন না? রাসুলের ঘর এই মাদ্রাসার দিকে একটু তাকাইবেন না? এইগুলাতো আপনাগরেরই, না কি মিছা কইলাম? মসজিদ মাদ্রাসায় দান সাদকায়ে যারিয়া। এক টাকা দান করলে হাশরের ময়দানে আল্লাপাক নিজ হাতে সত্তুর টাকার সওয়াব দিবেন। মাইয়েদের রুহের মাগফেরাতের থন বড় আর কি আছে, বলেন তো বাবারা, কিছু আছে? দুনিয়াদারি কয়দিনের ...’এক দমে কথাগুলো বলে ইমাম সাহেব থামলেন। তাঁর নূরানি চেহারার ওপর মিছরির কুঁচির মত ঘাম জমে উঠেছে। দুপুরের রোদে এখনও যথেষ্ট তেজ।
বিরক্তি আর ক্লান্তিতে শরীর গুলিয়ে উঠছে যুবায়েরের, বমি বমি লাগছে। সারারাত ঘুম নেই, তার ওপর ভরদুপুরের রৌদ্রে মাঠের মধ্যে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা!
হান্নান এবার নাটকীয় ভঙ্গিতে হাত জোড় করে বলে ওঠে, ওর কন্ঠ বাষ্পরুদ্ধ, আমি ওয়াদা করছি ইমাম সাহেব, বিকালেই টাকাটা দিয়ে দেব; হ্যা, তৌফিক মত দানও করব, দয়া করে জানাযাটা পড়ান...
কী আর করা। হাজার হলেও ভুঁইয়া-বাড়ির ছেলে। বড় চাকরি করে ঢাকায়। কে জানে ঠেকা বেঠেকায় তো এদের দরকার হতেও পারে! তাছাড়া কাফ্ফারা আর দান নিয়ে বেশি কষাকষি করা ভালও দেখায় না। ইমাম সাহেব সবাইকে জানাযার নামাজের নিয়ম বলে দিয়ে তাঁর কাজ শুরু করলেন।
জানাযা শেষ। অনেক লোকের মিছিল আবার খাটিয়া কাঁধে তুলে কলেমা তাইয়েবা পড়তে পড়তে ফিরে চলল ভুঁইয়া-বাড়ি অভিমুখে। অনেক পুরনো একটা স্মৃতি যুবায়েরের মনে ভেসে উঠল। ছোট বেলায় পিঁপড়েদের নিয়ে খেলা করত ও। পিঁপড়েদের সার বেঁধে চলাচল খুব মনোযোগ দিয়ে দেখত। একদিন একদল পিঁপড়েকে একটা মরা ফড়িং টেনে নিয়ে যেতে দেখেছিল গর্তের দিকে। গর্তে ফড়িংটিকে না-ঢোকানো পর্যন্ত একাগ্রমনে দৃশ্যটা দেখেছিল যুবায়ের।
পুকুরের পাড়ে কবর খোড়া হয়েছে। খুব নিখুঁতভাবে খোড়া হয়েছে কবরটা। চৌকোনো গর্তটা এতই মসৃণ যে দেখে মনে হচ্ছে সিমেন্ট দিয়ে তৈরি একটা চৌবাচ্চা! আমগাছটার ঠিক নিচেই খাটিয়াটা রাখা হয়েছে। গাছ থেকে কবর খুব একটা দূরে নয়।
যুবায়ের নীরবে দাঁড়িয়ে ছিল আমগাছটায় ঠেস দিয়ে। শরীর অবশ হয়ে আসছে যেন তার। এক গ্লাস পানি খেলে মন্দ হত নাজ্জবোধহয় কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যেত। কাকে বলবে, সবাই ব্যস্ত দাফনের কাজে। হঠাৎ-ই ফুলের মিষ্টি গন্ধ ওর নাকে এসে লাগে। মনে হয় বহুদিন এমন মিষ্টি গন্ধের ছোঁয়া নাকে লাগেনি। অবশ ভাবটা ধীরে ধীরে কেটে যেতে থাকে। গন্ধের উৎসের খোঁজে ঘাড় ফেরায় যুবায়ের; চোখ গিয়ে পড়ে হানিফের লাশ-রাখা খাটিয়ার ওপর। হানিফের মাথার কাছে নিথর দাঁড়িয়ে আছে ওর ছ-বছরের ছেলেটি। চেহারায় শোকের চিহ্ন নেই। ভাবখানা এমন, বাবা তার কোথাও যাচ্ছে কিছু দিনের জন্যে। বাবাকে ঘিরে এত লোকের এত আয়োজন আর কখনও দেখেনি সে। বাবার সম্পর্কে সবার মুখে এত ভাল ভাল কথা এর আগে শোনেনি কখনো। বাবাটা সত্যি খুব ভাল ছিল ওর! কত রাত ওকে পাশে নিয়ে শুয়ে ঘুম পাড়িয়েছে, মজার মজার গল্প শুনিয়েছে কত...। কোথা থেকে জোগাড়-করা বড় বড় কটা লাল গোলাপ আলগোছে ছড়িয়ে দিয়েছে বাপের বুকের ওপর।
ফুলগুলোকে হানিফের তাজা হৃৎপিণ্ডের মত দেখাচ্ছে যুবায়েরের কাছে তেমনটিই মনে হল।
পুকুরপাড়ের গাছগাছালি থেকে একঝাঁক দাঁড়কাক ডাক ছেড়ে উড়ে গেল রোদে-পোড়া আকাশের পানে।
দৈনিক জনকণ্ঠ:০৩.০৬.২০০৫
লেখক পরিচিতি
শামসুজ্জামান হীরা
মুক্তিযোদ্ধা।
গল্পকার। প্রবন্ধকার।
প্রকাশিত দুটি গল্পগ্রন্থ-- ‘দিঘির জলে পুরনো চাঁদের শব’ ও ‘কানাগলিতে কানামাছি’।
সম্পাদিত বই অরুণ সোম কর্তৃক অনূদিত নিকোলাই গোগলের ‘ওভারকোট’।
আত্মীয়-স্বজনদের ভিড় লেগে আছে অনেকদিন হল। যাদের চাকরি-বাকরি আছে বা অন্য জরুরি কাজ, তারা যায়, আবার ঘুরে আসে।
মৃত্যুকালে হানিফের বয়স পঁয়ত্রিশের মতো হয়েছিল। অ্যাকাডেমিক সার্টিফিকেট অনুযায়ী পঁয়ত্রিশ, প্রকৃত বয়স কত জানা নেই। আসলে মানুষের জন্মতারিখ নিয়েই যত ঝামেলা, কিন্তু কী অদ্ভুত, মৃত্যুদিন নিয়ে নেই কোনো দ্বিমত বা সংশয় ! একটি সরকারি ব্যাংকের মফস্বল ব্রাঞ্চের ম্যানেজার ছিল হানিফ। ব্যাংকার হিসেবে ওর ব্রাইট প্রসপেক্ট নিয়ে কারও মনে কোন সন্দেহ ছিল না। সবারই খুব পছন্দের লোক ছিল ও। এলাকার ব্যবসায়ী-আমলা থেকে আমজনতা সবাই খুব লাইক করত ওকে। ঘরেও ছিল সুখ। সুন্দরী বউ আর প্রাণচঞ্চল দুটো ছেলে। বড়টার বয়স পাঁচ-ছবছর, ছোটটার বছর তিনেক। ছেলে দুটোও ছিল বাপের বেজায় নেওটা। ব্যক্তিগত জীবনে হানিফ ছিল অত্যন্ত ডিসিপ্লিনড্। ব্যাংকের টার্গেট অ্যাচিভ করার জন্যে যেমন প্ল্যান আঁটতো, জীবনের ক্ষেত্রেও তেমনি। অথচ অনেক কাজ অসম্পন্ন রেখেই মারা গেল বেচারা, আহা!
সব প্রাণী-ই মারা যায়। মাছি চড়ুই ছাগল থেকে সমুদ্রের বিশাল তিমি আর কচ্ছপ। কচ্ছপের আয়ুই নাকি সবচে বেশিজ্জতিনশ বছর। ওরাও মরে! ভাবছিল যুবায়ের, হানিফের ছোটভাই হান্নানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু; একটা জাতীয় দৈনিকের স্টাফ-রিপোর্টার। হ্যাংলা-পাতলা দোহারা গড়ন, স্বল্পভাষী। বিয়েথা’ করেনি এখনো । থাকে দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়র সঙ্গেজ্জপেইংগেস্ট। আজ সকালে কচুখেতের বাসা থেকে আসার সময় পথের পাশে মরে-পড়ে-থাকা একটা দাঁড়কাক দেখেছিল জুবায়ের। মৃত দাঁড়কাকটা দেখে যুবায়েরের যথেষ্ট দুঃখ বোধ হয়েছিল।
কেমন একটা অশুভ ঘটনার ইঙ্গিতে ওর বুকটা কেঁপে উঠেছিল। ছোটকালে ভয় পেলে বুকে থুথু দিত, এখন দেয় না। বয়স এখন ওর বত্রিশ। যুবায়েরের মনে ইদানীং মৃত্যুচিন্তা বেশ জায়গা দখল করে থাকে। মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করার নাম জীবন, ত্রিভুজের তিনকোণের সমষ্টি দুইসমকোণের সমান, এ-রকমই জ্যামিতিক স্বতঃসিদ্ধের মত মনে হয় ব্যপারটা ওর কাছে। জীবনকে সাজানোর তাহলে কী মানে? কোরবানির পশুর গলায় বাহারি মালা, গলায় ঝোলানো পেতলের ঘন্টা বাজে টুং টাং, গোহাটা থেকে ক্রেতার ঘরে যেতে যেতে এ-দৃশ্যটি মনে এলেই যুবায়েরের হাসি পায়।
আবার মরা কাকটার কথা মনে পড়ল ওর। কী শান্তির সাথে কাকটা শুয়ে ছিল রাস্তার পাশেজ্জনরম ঘাসের ওপর। হাই ভোল্টেজ ইলেকট্রিক শকে ওর মৃত্যু হয়েছিল বোধহয়। শহুরে কাকদের ওরকম মৃত্যুই সচরাচর হয়ে থাকে। অপঘাতে এরকম একটা মৃত্যু সবার অলক্ষেই ঘটে গেছে। এখনওজ্জএবার কেমন একটা মমত্ববোধে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে; অথচ এখনও কারও ভ্রƒক্ষেপ নেই নিঃসাড় পড়ে-থাকা কাকটার দিকে, আশ্চর্য !
হান্নানের ভাইকে নিয়ে এখন আর ভাববার কিছু নেই। যা কিছু চিন্তা-ভাবনা-উৎকন্ঠা-আশঙ্কা-আশা প্রায় দুমাস ধরে ঘনিষ্ঠজনদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল তার পরিসমাপ্তি ঘটল এই কিছুক্ষণ আগে। এখন সবার চিন্তা এসে থেমে গেছে একটি বিন্দুতে; কোনো দ্বিমত নেই, নেই কোনো বিতর্কজ্জহানিফ মারা গেছে। মারা যাবার মুহূর্তটিতে যারা কাছে ছিল সবাই কান্নার সুরে কোরাসের মত করে উচ্চারণ করেছিল পবিত্র কালাম, ইন্নালিল্লাহে ওয়াইন্না ইলাহে রাজেউন। এই কালামের মধ্য দিয়েই মুসলমানদের জীবনের ফুলস্টপ ঘোষণা করা হয়! হানিফের ছেলে দুটো শুধু কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকেছিল বিলাপরত লোকজনদের পানে। বড়ছেলেটি বাপ মারা গেছে শুনে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল; ছোটটি ওর হাতের সুন্দর খেলনাটি যেন মাটিতে পড়ে না যায় সেজন্যে ছোটাছুটি-করা লোকজনদের ভিড় থেকে কিছুটা তফাতে দাঁড়িয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থেকেছিল।
শোকের ঘূর্ণিঝড়ে সবগুলো লোক বিচিত্র শারীরিক ভঙ্গিমা আর বিলাপে মেতে উঠল। ছফুট-একইঞ্চি লম্বা, স্বাস্থ্যবান-সুদর্শন হান্নান নাটকীয় কায়দায় শোক প্রকাশ করছিল। হান্নান মঞ্চ এবং টেলিভিশনে মাঝেমধ্যে নাটকটাটক করে তো। চাকরি করে একটা সরকারি কর্পরেশনে। শোক প্রকাশের মধ্যে শিল্প থাকা মন্দ কিছু নয়। জানামত যত শৈল্পিক শোকের দৃশ্য হান্নানের মনে আসছিল প্রায় সবগুলোই ফুটিয়ে তুলবার প্রাণান্ত চেষ্টা করছিল। ওর ভাবির ছোটভাই মোস্তফা; পুরো নাম গোলাম মোস্তফা চৌধুরী; বহুজাতিক এক কম্পানিতে চাকরি করে। অল্প বয়সে টাকাকড়ি ভালই বানিয়েছে। মেটালিক গ্রে রঙের টয়োটা করোলা হাকায়। ফিটফাট ওয়েস্টার্ন পোশাকে থাকে সবসময়। বছরে বেশ কবার ফরেনকান্ট্রি ট্যুর করে। ইমিডিয়েট বড়বোন রোকেয়াকে খুব ভালবাসে। ব্রাদার-ইন-ল’র অকালমৃত্যুতে কী-যে শোক ওর! বারবার বোনের সামনে গিয়ে দামি রুমালে চোখ মুছছিল আর ইংরেজি-বাংলায় যা বলছিল তার অর্থ দাঁড়ায়, আহা কী ভালই না বাসত দুলাভাই ওকে! খেতে পছন্দ করত বলে আপাকে চাইনিজ রেসিপি শিখতে উৎসাহ যুগিয়েছিল প্রফেশনাল শেফ ডেকে এনে। আর ও-ও তো দুলাভাই ছাড়া কিছুই বুঝত না। এবারও তো সিঙ্গাপুর থেকে দুলাভাইর জন্যে দামি স্যুটপিস নিয়ে এসেছিল। আহা, পরা হল না! বুক ঠেলে কান্না আসে ওর।
হান্নানের একদম পছন্দ নয় মোস্তফাকে। ব্যাটা একটা আস্ত হিপোকৃট! এখন ন্যাকামো দেখাচ্ছে! দুলাভাই প্রীতি! অথচ এইতো সেদিন, আমার ভাইটা তখন সুস্থ-সবল; বলিসনিজ্জআমাদের ঘরে বোন দিয়ে ফ্যামিলি স্ট্যাটাস খর্ব হয়েছে তোদের! টাকা থাকলেই স্ট্যাটাস হয়? নামের শেষে চৌধুরী যে-কেউ লিখতে পারে, লিখলে আপত্তি করবে কে? এ-ধরনের অনাচার ঠেকাতে দেশে তো কোনো আইনও নেই। মূল ব্যাপারটা হচ্ছে কালচার। সংস্কৃতি,... হ্যাঁ সংস্কৃতি। সংগীত বা নাটক-সার্কেলের কটা লোকের সঙ্গে ওঠাবসা তোর, শুনি? নিঃসন্দেহে নাটকই হল গে সংস্কৃতির প্রাণ...! আর আমাদের টাইটেলটাই বা কম কিসে। ভুঁইয়া। বিখ্যাত বারো ভুঁইয়া...ইশা খাঁ’র বংশধর। ইচ্ছা হয় না তাই লিখি না। তবে মানতেই হবে ভাবি গোবরে পদ্মফুল। আহা কী লক্ষ্মী মেয়ে গো...। হান্নান আড়চোখে তাকাচ্ছিল রোকেয়ার দিকে। আপেল-আদল রোকেয়ার মুখে শোক আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের স্পষ্ট ছাপ। অবিন্যস্ত চুল লুটিয়ে পড়েছে কপাল আর চিবুকের পর। স্লিভলেস ব্লাউজ ঘামে ভিজে সপ্সপে, এঁটে বসেছে স্লিম শরীরের সঙ্গে। বৃষ্টি-ধোয়া বাতাপি জামিরের মত সুডোল স্তনজোড়া লো-কাট ব্লাউজের ফাঁক গলিয়ে উঁকি দিচ্ছে। হান্নানের দৃষ্টি জোয়ারের সফেন লোনা তরঙ্গের মত আছড়ে পড়ে রোকেয়ার মুখ আর বুকের সৈকতে।
কোরবান আলী ভুঁইয়া, হান্নানের চাচা খুবই পরহেজগার লোক। একসময় মহাজনি ব্যবসা ছিল রমরমা। তা-ছাড়াও ছিল মজুতদারি। আকালের বছর সে-কী লাভ! সবই আল্লার ইচ্ছা! বছর দশেক আগে ওসব ব্যবসা ছেড়েছুড়ে দিয়ে হজ্ব করে এসেছেন। এখন আল্লাবিল্লা ছাড়া কিছুই বোঝেন না। থুতনিতে পাটের আঁশের মত মেন্দি লাগানো একগুচ্ছ দাড়ি, কপালে সালাত আদায়ের সাক্ষী কালো দাগ, মাথায় গোল টুপি। নাদান লোকগুলোর বেদাতিতে ভীষণ বিরক্ত বোধ করছেন তিনি। এ কী ধরনের বেশরিয়তি বেলেল্লাপনা! গম্ভীর গলায় গর্জে ওঠেন তিনি, ‘মুর্দারে নিয়া আহাজারি করা যায়েজ না। আল্লার মাল আল্লায় নিয়া গেছে। ওয়াইন্না ইলাহি রাজেউন মানে বোঝো মিঞারা ? আর বৌমা (একটু থেমে, রোকেয়াকে লক্ষ করে) অনেক বেগানা পুরুষ ... তুমি আওরাতগরে নিয়া অন্যখানে যাও। ইয়া আল্লাহ... রহমানুর রাহিম, মুর্দার গোনাখাতা মাফ কইরা দিও মাআবুদ। সবাই মনে মনে দোআদরুদ পড়েন... তাতে কাম হইব...।
হান্নানের ভগ্নিপতি মতলব ম-ল; ঠিকাদারি ব্যবসা করে; ফেনীতে সেটেলড্। পিকড ঝামার মত গায়ের রং। বেঁটেখাটো। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। হাতের আঙুলে বিভিন্ন পদের পাথর বসানো গোটা চারেক আংটি। দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়র সঙ্গে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে আলাপ করছিল। আলাপের ফাঁকে ফাঁকে আংটি-পড়া তর্জনী দিয়ে হাসপাতালের দেয়াল খুঁটছিল (এটা ওর একটা বাতিক। সিমেন্ট বালির প্রপোরশন ও আঙ্গুলে পরখ করতে পারে। ঝানু ঠিকেদার হিসেবে ওর যথেষ্ট সুনাম) আর খুব আফশোস করছিল হানিফের এ অসময়ে-চলে-যাওয়া নিয়ে, ‘বড় অমায়িক লোক আছিলেন ভাইছাব। খুব টান আছিল আমার প্রতি। একবার ব্যবসায় টাকার ঠ্যাকা পড়ে গেল, খুব উপকার করছিলেন। গায়ের চামড়া দিয়া ওর জুতা বানায়া দিলেও সেই উপকার শোধ হবার নয়। আহা, একটা শক্ত পিলার যেন ভাইঙ্গা গেল আমার ! ভাইছাব যে কী ভালই বাসতেন আমারে ... বলতে বলতে গলা ভারী হয়ে এল মতলবের, কত কাম ফালাইয়া আমি ছুইটা আসছি উনার অসুখের খবর শুইন্যা, জানেন? আর দুইদিন কাটাইয়া আসতে পারলে নাথেরপেটুয়া হেলথ কমপ্লেক্সের রিপিয়ারিং কজের সেকেন্ড রানিং বিলটা জমা দিতে পারতাম... যাক ওইটা কোনো ব্যাপারই না ... আল্লাহ, কী কঠিন শোকের মধ্যে তুমি ফালাইয়া দিলা... আল্লাহ ...।
কান্নাকাটির রোল কিছুটা থিতিয়ে পড়েছে। লাশ নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার। দাউদকান্দির সোনারচরে পৈত্রিক বাড়িতে, পারিবারিক গোরস্থানে লাশ দাফন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
রোকেয়ার বড় বোন ফারজানার স্বামী আর্মি অফিসার; লেফটেন্যান্ট কর্নেল। তবে সবাই কর্নেল সাহেব বলেই ডাকে। তাঁর চেষ্টাতেই তো হানিফ সিয়েমেইচে ভর্তি হতে পেরেছিল। কর্নেল বদরে আলম আর্মিতে চাকরি করলেও আত্মীয়-কুটুমের প্রতি তাঁর খুব দরদ। কিন্তু চেহারা দেখে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের পক্ষেও তাঁর মনের কথা আঁচ করা সম্ভব হত কি না যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে তাতে। ওকে দেখলে শিশুরা কেঁদে ওঠে। প্রকা- থলথলে সারা মুখে বসন্তের দাগ। বেজির লেজের মত একজোড়া গোঁফ আর মোটা মিশকালো ভুরু, কদমছাট চুল।
হানিফের মৃত্যুসংবাদ দিতে সেই কখন দুবোন গেছে, ফেরার নামগন্ধ নেই । হান্নান অস্থিরভাবে পায়চারি করতে থাকে আর বিড় বিড় করে আপন মনে কি যেন আওড়াতে থাকে। যুবায়ের নিচু গলায় বলে, ‘খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে না?
হান্নান বিরক্তি মেশানো সুরে বলে, ‘আমি কি করব? কর্নেল সাব না এলে লাশের কোন গতি নাই... আফটার অল কর্নেল তো যে-সে জিনিস নয়...
কিছুটা সংকোচ নিয়ে বলে যুবায়ের, একবার খোঁজ করলে হয় না? কথাটা বলেই কাঁচুমাচু করতে থাকে। ও-তো মৃতের আত্মীয়-কুটুম পর্যায়ের কেউ নয়। অতি আনন্দ বা অতি শোকের সময় মানুষ কিছু কিছু সামাজিকতা খুব কড়াকড়িভাবে মানতে পছন্দ করে। হাত কচলাতে থাকে যুবায়ের। অপ্রতিভ হলে হাত কচলানো ওর স্বভাব।
আর্মির গাড়িতে চেপে দুবোন আর কর্নেল বদরে আলম এসে পৌঁছোলেন। হাসপাতালের ডিউটিরত স্টাফরা মাটিতে পা আছড়ে অভিবাদন জানাল। একজন স্টাফকে লক্ষ করে ভরাট গলায় কর্নেল বললেন, ‘বেটা, জলদি মুর্দাকে পাঠানোর ব্যবস্থা কর...।
লাশের আশপাশে জড়ো হয়ে-থাকা লোকজন খুবই সমীহের সাথে দেখছিল কর্নেলের নড়াচড়া, কথাবার্তার ধরন। মতলব ম-ল ফিস ফিস করে পাশের কাকে যেন বলছিল, ‘ভাইছাবের ভাগ্য বটে, কয়জনের কপালে কর্নেল ভায়রা জোটে? হায়াত মৌত আল্লার হাতে... কিন্তু কত সম্মান পাইতেছেন ভাইছাব মৃত্যুর পরও ... বড়ই অমায়িক ও নেক বান্দা আছিলেন তো ...।
মতলব কর্নেলের আশেপাশে ঘুরঘুর করছিল আর এমন ভাব দেখাচ্ছিল যে, মৃত সৎকারের কাজে ওর জুড়ি নেই। মোস্তফা এমনভাবে কথাবার্তা বলছিল যেন ও-ই উপস্থিত লোকদের মধ্যে দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি। কর্নেল ওর আপন ব্রাদার-ইন-ল কিনা! হান্নান বাঁকাদৃষ্টিতে বারবার তাকাচ্ছিল মোস্তফার দিকে আর লম্বা লম্বা পা ফেলে অযথাই ছোটাছুটি করছিল এদিক-ওদিক। মাঝে মাঝে রোকেয়ার কাছে এসে চাপা স্বরে কথা বলছিল। দেখে মনে হচ্ছিল অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা। রোকেয়া অভিব্যক্তিহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সুমুখের দিকে। কোরবান আলী গলা খাঁকরে স্বগতোক্তি করেন, মাগরেবের সময় হইয়া আসল... নামাজটা সাইরা আসি আমি, হে পাক পারওয়ারদেগার...
সূর্য অস্ত গেছে কিছুক্ষণ হল। আকাশের বিশাল বক্ষ থেকে উপচে-পড়া রাত্রির নিঃশব্দ ঢল ধীরে ধীরে ছেয়ে ফেলছে বিশ্বচরাচর। এখন হেমন্তের মাঝামাঝি। সন্ধে গড়াতেই বাতাসে শীতের আমেজ। হাসপাতালের গাছগাছালিতে ঝুলে-থাকা কাফনের মত ফিনফিনে কুয়াশা ক্রমশ জমতে শুরু করেছে। গাছের ডালে বসে মাঝে মাঝে ডাকছে ক্লান্ত কয়েকটি কাক। প্রকৃতির সব রং ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে।
যুবায়ের পায়চারি করছিল হাসপাতালের লম্বা টানাবারান্দার এমাথা-ওমাথা। হানিফকে নিয়ে এখন ওর করবার কিছুই নেই। মনের মধ্যে ওর জেগে উঠছে বেশ কিছু স্মৃতি। হান্নানের বন্ধু হিসেবে প্রায় দুটো মাস ও হাসপাতালে যাওয়া-আসা করছে। হাসপাতাল খুব খারাপ লাগত একসময়। রোগীদের কাতরানো, স্যালাইন ও রক্তের ঝোলানো ব্যাগ, অক্সিজেন-সিলিন্ডার, ফিনাইল-ব্লিচিংপাউডারের ঝাঁজালো গন্ধ আর সর্বত্রই শোকের কেমন এক নিঃশব্দ পদচারণা। একটানা দুমাস আসা-যাওয়া করে গা-সওয়া হয়ে গেছে এসব। ভালই তো লাগে বেশ হাসপাতালের সময়গুলো এখন। এরই মধ্যে বেশ কিছু রোগীর সঙ্গে খাতির হয়েছে; রোগীদের আত্মীয়-স্বজন কারো কারো সঙ্গে গড়ে উঠেছে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা।
হানিফের পাশের কেবিনের রোগী ইমতিয়াজ আহমেদ। গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। সৌম্যদর্শন মাঝবয়সী ভদ্রলোক। চোখে সোনালি চিকন ফ্রেমের চশমা। বালিশে ঠেস দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় বই পড়ে কাটান বেশির-ভাগ সময়। দেখা হলেই স্মিত হেসে বলেন, কেমন আছেন? বসুন। গুন্টার গ্রাসের একটা উপন্যাস পড়ছি...দ্য টিন ড্রাম...পড়েছেন?
ইমতিয়াজ আহমেদের স্ত্রী একটি প্রাইভেট কলেজের লেকচারার। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রুচিশীল ছিমছাম মহিলা। প্রতিদিন সন্ধেয় আসেন স্বামীর জন্যে খাবার নিয়ে। হাতে থাকে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা, কিছু বই, সাময়িকী। সকালে আসে ওঁর ছোট বোনজ্জঝিম্লি । ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। সোশ্যালজিতে অনার্স থার্ডইয়ার। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম। থুতনির কাছটাতে ছোট্ট একটা তিল। ওপরের সারির একপাশের একটা দাঁত কিছুটা উঁচু, হাসলে ভালই দেখায়। সালোয়ার কামিজ পরে আসে। পাহাড়ি ঝরনার মত চঞ্চল ও প্রগলভ। যুবায়েরকে ডাকে যুবের ভাই। মেয়েটিকে ভাল লাগে যুবায়েরের। আজ সকালেও এসেছিল, খবর নিয়েছিল হানিফের। হানিফ কোমাতে। ঝিম্লির সুন্দর মুখের ওপর বিষাদের ছায়া নেমে এসেছিল। হঠাৎ করেই হাসপাতাল ছেড়ে যেতে যুবায়েরের বেশ খারাপ লাগছে এখন।
মানুষের জীবনে সুখ-দুঃখ খুব কাছাকাছি অবস্থান করে। মনে পড়ে, দিন সাতেক আগেও একদিন হানিফ হেসেছিল ম্লান হাসি, হান্নানের সরেস এক উক্তি শুনে। কনডেমড্ সেলের আসামিরাও হয়তো কখনও হঠাৎই হেসে ওঠে অতীতের সুখস্মৃতি মনে এলে, অথবা অকারণেই। হাসে না কি?
আজকের পর ইমতিয়াজ আহমেদকে দেখতে আসাটা কেমন দেখাবে, ভাবে যুবায়ের। কী ভাববে ওরা? ঝিম্লি কী...।
আর কটা দিন দেরি করে মারা গেলে কি চলত না হানিফের!
ট্রাক এসে গেছে। জোয়ানরা অত্যন্ত নিপুণভাবে এরই মধ্যে মুর্দাকে কফিনে পুরেছে। কোরবান আলী বেশ জোরে বলে ওঠেন, সবাই কলেমা তাইয়েবা পড়েন। খুব আস্তে সাবধানে মুর্দারে গাড়িতে তোলেন... খুব সাবধানে... কুনোখানে চোট লাগে না য্যান...
আবারও কোরাসের মত করে সবাই কলেমা তাইয়েবা উচ্চারণ করতে করতে কফিন কাঁধে নিয়ে ট্রাকের দিকে এগোতে থাকে। খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা ট্রাকে উঠে কফিন ঘিরে দাঁড়ায়। ফোঁপাতে ফোঁপাতে রোকেয়া দুসস্তান নিয়ে মোস্তফার করোলায় গিয়ে ওঠে। কর্নেল মিনিট দশেক ছিলেন। জোয়ানদের সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে ফারজানাকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেছেন। আজ আর্মি কমিউনিটি হল সেনাকুঞ্জে খুব জাঁকজমকপূর্ণ পার্টি আছে তো। বেশ কজন জেনারেল আসবেনজ্জচিফেরও আসবার কথা।
হান্নানের পীড়াপীড়িতে যুবায়েরকেও লাশের সঙ্গে রওনা দিতে হল।
ট্রাকে মেঘনা ঘাট। ওখান থেকে নৌকোয় কিছুটা। বেশ কিছুটা পথ কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যেতে হল লাশ। রাস্তার যা ছিরি, কয়েকবার কাঁধ থেকে লাশটা পড়তে পড়তে অল্পের জন্যে বেঁচে গেছে। ধানখেতের মধ্য দিয়ে পথ, তার ওপর আবার গাঢ় অন্ধকার। টর্চের আলোয় আর কতটুকুই বা কুলোয়। ভোর হয়ে গেল সোনারচর পৌঁছোতেই। বাড়ির সীমানায় লাশ-কাঁধে লোকজনের মিছিল পৌঁছোতেই মরাকান্নায় কুয়াশা-ভেজা ভোরের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। হানিফের মা ডায়রিয়ায় ভুগছেন বেশ কদিন ধরে। স্যালাইনের ওপর আছেন। বৃদ্ধ পিতা শওকত আলী বাতের ব্যথায় শয্যাশায়ী। সবচেয়ে ছোট বোনের স্বামী আক্কাস শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে-থাকা একমাত্র শক্ত-সমর্থ পুরুষ। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বর। খেত-খামার দেখাশোনা ছাড়া অন্য কোনো কাজকম্ম তেমন নেই।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকজনের ভিড় বাড়তে থাকে। কেউ চিৎকার করে বিলাপ করতে থাকে, কেউবা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। ঘনিষ্ঠ কেউ এলেই হান্নান জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। হাজার হলেও সহোদর ভাই, তার ওপর পিঠেপিঠি। সবাই হান্নানের ব্যথা বোঝে। কেউ ওর সাথে সুর মিলিয়ে কাঁদে, আবার কেউ সান্ত¦না দেয়, কী করবা কও, যে চইলা গেছে তারে তো আর ফিরাইয়া আনবার পারবা না...। মা-বাপ বুড়া, তারারে তসল্লি দেওন অহন তোমার কাম...
হান্নানের দূরসম্পর্কের আত্মীয়, এলাকার যথেষ্ট প্রভাবশালী ব্যক্তি, আবুল হোসেন মাস্টার পাটভাঙ্গা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে কাঁধের ওপর শেয়ালরঙা শাল ফেলে এসে উপস্থিত হলেন একটু দেরিতে। পুকুরপাড়ে পৌঁছোতেই হান্নান দৌড়ে গিয়ে তাঁকে এমনভাবে জাপটে ধরল যে, লোকটি আর একটু হলেই পুকুরে পড়ে যেতেন। যথেষ্ট কষ্ট করে নিজেকে সামলে নিলেন। শোকে মানুষ কি রকম কাতর হতে পারে হান্নানকে দেখে সবাই বুঝছিল। আবুল হোসেন মাস্টারের জন্যে ঘরের ভেতর থেকে চেয়ার আনা হল। বসতে যেতেই পাশ থেকে একজন এসে হৈ হৈ করে উঠল, বইয়েন না মাস্টারসাব, গামছা দিয়া মুইছ্যা দেই, কাউয়ার গু লাইগ্যা আছে মনে অয়...
কাঁধের চাদরটা টেনেটুনে ঠিক করে নিয়ে মাস্টার সাহেব তসরিফ রাখলেন। আবুল মাস্টার এসেছেন শুনে কোমরে দুহাত চেপে কুঁজো হয়ে কাশতে কাশতে শওকত আলী ভুঁইয়া ভেতরবাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। কেমন অদ্ভুত শব্দ বেরোচ্ছিল তাঁর মুখ থেকে। দৌড়ে গিয়ে একজন তাঁকে ধরে চেঁচিয়ে ওঠে, আরে আরে পইড়া যাইবো তো, ব্যারামি মানুষ, তার উপর আবার পুত্রশোক...
আরেকটা চেয়ার এনে বসানো হয় হান্নানের বৃদ্ধ পিতাকে। মাথায় বিরাট টাক, মুখে সাদা চাপদাড়ি, লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা, শরীরে জড়ানো মোটা চাদর। চেয়ারে বসেই হাঁপাতে থাকেন বেশ জোরে জোরে। শ্বাস নেয়ার সময় চিলের ডাকের মত মিহি এবং তীক্ষè একটা শব্দ বেরোচ্ছিল গলার সুরঙ্গ থেকে। শীত এলেই হাঁপানি চাঙা হয়ে ওঠে। হানিফের কফিনটা বৈঠকখানার সমুখের আম গাছটার ঠিক নিচে রাখা হয়েছে। বৃদ্ধ পিতা কফিনের দিকে তাকিয়ে ফোঁপাতে লাগলেন অনবরত। আবুল মাস্টার বৃদ্ধের হাত দুটো নিজের মুঠোয় চেপে ধরে খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। আশপাশে দাঁড়ানো ও হাঁটু গেড়ে-বসা লোকজন নিবিষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল মাস্টারের দিকে। মাস্টারের মুখ থেকে বেরোনো সান্ত¡নার বাণীগুলো সোৎসাহে গিলছিল লোকগুলো। মাস্টার মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকাচ্ছিলেন জটলার দিকে; ভালই লোক জমা হয়েছে। শ-দুয়েক তো হবেই। বেশি লোকের জমায়েতে দু-চার কথা বলতে পেলে মাস্টারের দারুণ ভাল লাগে। এখনই এত! জানাযায় না জানি কত হবে! আবুল মাস্টার পকেট থেকে একশ টাকার একটা নোট বার করে তাগড়ামত এক ছোকরার হাতে গুঁজে দিয়ে হুকুমের সুরে বললেন, ‘যা কুদ্দুইচ্যা পুরা এলাকায় নামাজে জানাযার মাইকিং কইরা দে... বাদ যোহর সোনারচর মাদ্রাসার মাঠে... হান্নানের বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী কন তাঅই সাব, ঠিক আছে না?
শওকত আলী ফোঁপাতে ফোঁপাতে মাথা নাড়েন
Ñমুর্দার গোছল দেওন আর কবরের ব্যবস্থাটাও অহনই কইরা ফ্যালান উচিত ... অ হান্নান মিঞা, অ আক্কাস মিঞা এইদিকে একটু শুনেন ... কি কন তাঅই সাব, সকলের সাথে পরামর্শ করন দরকার, না কি কন?’ Ñ শেষকৃত্যের এমন একটা অনুষ্ঠানের মূল নেতৃত্ব এখন আবুল মাস্টারের হাতে, ভাবতেই ভাল লাগছিল তাঁর। তাছাড়া এ তো যার-তার মৃত্যু নয়; সোনারচরের ভুঁইয়া বাড়ির বড় ছেলের। যথেষ্ট নামডাক ভুঁইয়া বাড়ির এতদঞ্চলেজ্জএকটুও বাড়ানো কথা নয়...।
বাড়ির ভেতর থেকে মহিলাদের আর্তস্বরে কান্নার শব্দ শোনা যেতে লাগল। সমুদ্রের জোয়ার ভাটার মতই যেন মাঝে মাঝে কান্নার বেগ বাড়ছিল কমছিল। রোকেয়া এইমাত্র এসে পৌঁছেছে। হান্নান ছুটে যায় বাড়ির ভেতর। ভাবির সঙ্গে ওর অনেক জরুরি আলাপ আছে তো।
আবুল মাস্টার হানিফের আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে মুর্দার দাফনের ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত।
যুবায়ের পুকুরপাড়ে একটা গাছের গুড়ির ওপর বসেছিল চুপচাপ। নিজেকে কিছুটা অবাঞ্ছিত মনে হচ্ছিল। হাতে গোনা কজন ছাড়া সবাই অপরিচিত। সারা রাত দু-চোখের পাতা এক হয়নি। ঘুমে চোখ ভেঙে আসছিল। কিছুই করার নেই। এমন শোকাচ্ছন্ন বাড়িতে ঘুমের জায়গা কোথায় পাবে? জায়গা পেলেই কি ঘুম আসবে?
মোস্তফাও এখানে খুব একটা জুত করতে পারছিল না। যুবায়েরের কাছে গিয়ে বসে আলাপ জমাতে চেষ্টা করে, কী একটা ম্যাসাকার হয়ে গেল, তাইনা যুবায়ের ভাই? বিশ্বাসই হতে চায় না। ও গড, হোআট অ্যা হার্ট রেন্ডিং সিচুয়েশন! আপা আর বাচ্চা দুটোর যে কি হবে এখন?
যুবায়ের কোন কথা বলে না।
Ñজানেন যুবায়ের ভাই, টু টেল ইউ ভেরি ফ্র্যাংকলি, এ বাড়িতে দুলাভাই ছাড়া একটা লোকের মধ্যেও ভালবাসা, ইমোশন, সিমপ্যাথি এসব মানবিক গুণের লেশমাত্র নেই। দুলাভাই আর আপার ওপর কী যে মানসিক নির্যাতন, আই মিন মেন্টাল টরচার হয়েছে তা যদি জানতেন... মোস্তফা বলেই চলে, শুধু গতরাত নয়, বেশ করাত ধরেই আমার চোখে ঘুম নেই, অফিসেও ইরেগুলার...। অথচ এ বাড়িতে কি তেমন কোন শোকের ছায়া দেখছেন? বলুন আপনার কি ধারণা? ফ্র্যাংকলি বলুন... আমি কিছু মাইন্ড করব না...।
কোনো কোনো সময় মানুষের খুব খোলামেলা কথা বলতে ভাল লাগে। পাত্র-অপাত্র জ্ঞান থাকে না। কেন এমন হয় যুবায়ের তা বোঝে না। মোস্তফার কথার কী জবাব দেবে, কথা খুঁজে পায় না যুবায়ের। কথা বলতে একদম ইচ্ছা করছে না ওর। শুধু বলে, খুবই শোকের ঘটনা বটে...।
মোস্তফা হতাশ হয়। ওর এতগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথায় কোনো আমলই দিল না যুবায়ের। দেবে কেন! আফটার অল, হান্নানের বুজম ফ্রেন্ড তো!
দূরে মাইকের আওয়াজ শোনা যায়, জানাযার মাইকিং। লোকের ভিড় ক্রমেই বাড়তে থাকে। চলতে থাকে একঘেয়ে কান্নাকাটি আর সান্ত¦নার বাণী। মাদ্রাসাসংলগ্ন মসজিদ থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসে। আবুল মাস্টার তাগাদা দেন,চলেন, মুর্দা নিয়া মসজিদে চলেন, আর বিলম্ব না...।
হানিফের লাশ মসজিদ থেকে-আনা খাটিয়াতে তোলা হয়। হান্নান বাড়ির ভেতর থেকে দৌড়ে এসে বলে, শেষবারের মত ভাবি আর মা ভাইয়ের মুখ দেখতে চায়, একটু অপেক্ষা করেন প্লিজ...।
আবার উচ্চস্বরে কান্নার রোল পড়ে যায়।
হান্নান কি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে! সবার সম্মুখে, হোক যতই শোক, ভাবিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে হবে এভাবে, ছিঃ! শওকত আলী ভেটকি মাছের মত লম্বা ঠোঁটদুটো কুঁচকে ফোঁসফোঁস করে ওঠেন, বড়ডারে তো খাইছে ওই বেডি, অহন ছোটডার উপর নজর... আমি বাইচ্যা থাকতে নট হয়েগা...।
কান্না থেমে আসে। তারপর শবাধার মাটি থেকে শূন্যে উঠে কাঁধে ভর করে। ধীরে ধীরে এগোতে থাকে মসজিদের দিকে, সরু মেঠো পথ ধরে। আগে-পিছে গিজগিজে লোক, লোকের মিছিল। সবার পেছনে ক্লান্ত পায়ে হাঁটতে থাকে যুবায়ের। পথের দুপাশের জমিতে যেন কেউ হলুদ চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। সর্ষেফুলের ঘ্রাণে কেমন মাদকতা। প্রজাপতি ওড়ে এখানে-ওখানে। যোহরের নামাজের পর মুসল্লিরা খাটিয়াকে সামনে রেখে কাতারবদ্ধ হয়ে দাঁড়ান। বহু লোকের সমাগম, মাদ্রাসার মাঠে তিল ধারণের স্থান নেই। এত বড় জানাযার নামাজ এলাকার লোক এর আগে আর কখনও দেখেনি। আবুল মাস্টার অত্যন্ত আবেগ জড়ানো কন্ঠে মরহুমের জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করলেন। ফাঁকে ফাঁকে লাল রুমালে চোখ মুছলেন। ইমাম সাহেব মরহুমের পক্ষ থেকে কাউকে কিছু বলার জন্যে অনুরোধ জানালেন। হান্নান কান্নাভেজা গলায় তার ভাইয়ের জন্যে সকলকে দোআ করতে বলল। কারো মনে আঘাত দিয়ে থাকলে নিজগুণে মাফ করে দিতে অনুরোধ করল। কারো কাছে ধারদেনা থেকে থাকলে তা পরিশোধের আশ্বাস দিল... ইত্যাদি।
ইমাম সাহেবের কানে কানে এক মুসল্লি যেন কি বলতে লাগল। তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনলেন আর মাথা নাড়লেন। একটু কেশে ইমাম সাহেব দরাজ গলায় বললেন, এহনই জানাযার নামাজ শুরু হইব, তয় তার আগে কিছূ কথা আছে...। কাতারবন্দি সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ইমাম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, মরহুম কত দিন অসুস্থ আছিলেন, কইতে পারেন কেউ...?
হান্নান চেঁচিয়ে বলল, দুই মাসের মত, হুজুর...।
ইমাম সাহেব বললেন, আরে সাহেব, মত কি, ঠিক কত দিন তাই কন...
কিছুক্ষণের জন্যে আবার নীরবতা। মনে মনে হিসেব করে হান্নান, তারপর জানায়, চৌষট্টি দিন... ঠিক চৌষট্টি দিন, ঘন্টা বলা লাগবে না তো?
ইমাম সাহেব বললেন, ঠিক তো, হিসাব ঠিক আছে তো?
হান্নানের জবাব, জি... ঠিক, একেবারে ঠিক...
ইমাম সাহেবের গলা, ইসালামি মতে রাইতের থেইক্যা কিন্তু দিন শুরু হয়, জানেন তো?
আবার নিস্তব্ধতা। বেশ কিছুক্ষণ পর ইমাম সাহেব নীরবতা ভাঙলেন,চৌষট্টি দিন মানে তিনশত চৌরাশি ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে নাই মাইয়েদ...ঠিক কি না? হিসাবে কি ভুল আছে?
মনে মনে চৌষট্টিকে পাঁচ দিয়ে গুণ করে হান্নান। ইমামের হিসেবের সঙ্গে মেলে না, কিন্তু মুখে কিছু বলে না। কেমন এক আড়ষ্ঠতা ওকে ছেঁকে ধরেছে !
চ্যাংড়ামত, দেখে কলেজ পড়–য়া মনে হয়, বলে ওঠে, দিনে পাঁচ ওয়াক্ত হইলে চৌষট্টি দিনে তো তিনশ বিশ ওয়াক্ত হয়, হুজুর...
মুখ বিকৃত করে হুজুর খেঁকিয়ে ওঠেন,জাহেল কোনেকার! আইজকালকার পোলাপানরা নামাজ আদায় করে না, ইস্কুল কলেজে কুফরি শিক্ষা শেখে, আর কি কয় পপ্ ডিসকু নাচে... হে ব্যাডারা বেতরের নামাজের কথা জানব কইত থন্...? হ, নামাজ ছয় ওয়াক্ত, পাঁচ ওয়াক্ত ফারজ্, এক ওয়াক্ত ওয়াজিব... ঠিক কি না?
সবাই নিশ্চুপ। ইমাম সাহেব বলে চলেন, প্রতি ওয়াক্ত নামাজের জন্য একটা ফেৎরা, এক সের তের ছটাক গম অর্থাৎ টাকায় পনের টাকা কাফ্ফারা পাওনা হইছে, ঠিক আছে?
নামাজে দাঁড়ানো লোকদের মধ্যে থেকে খোঁড়ামত একজন বলে ওঠে, জে, বিলকুল ঠিক আছে, হুজুর...
ইমাম বললেন,তা হইলে মোট কাফ্ফারা হয়... কত হয়? বাইর করেন দেহি কেউ... মানসাঙ্কে পাকা কেডা, পরীক্ষা হউক এই উছিলায়...। হুজুরের সফেদ দাড়ি কাঁপিয়ে ঝিলিক দিয়ে ওঠে নিঃশব্দ হাসি।
ভিড়ের মধ্য থেকে কে একজন বলে ওঠে পাঁচ হাজার সাত শত ষাইট টাকা হুজুর, তিন শত চৌরাশি ইন্টু পনের, তাই হয়। চোখে-মুখে গর্ব নিয়ে এদিক-ওদিক তাকায় লোকটি।
যুবায়ের এ-ধরনের ঘটনার মুখোমুখি আগে কখনও হয়নি। একজন মৃত্যুপথযাত্রী চৌষট্টি দিন নামাজ পড়েনি, নামাজ পড়ার মত অবস্থাই তো ছিল না, অথচ কী আশ্চর্য সে-জন্যে আজ তার ঘাড়ে কাফ্ফারা!
হান্নানও এ-নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে উদ্যত হয়, কিন্তু থেমে যায়। নিজেকে সংস্কৃতিবান নাট্যশিল্পী মনে-করা হান্নানের সব অহংকার যেন মুহূর্তে চুপসে যায়। চুপচাপ অধোমুখে দাঁড়িয়ে থাকে নামাজের কাতারে আর পায়ের নখ দিয়ে মাটি খুঁটতে থাকে। ইমাম সাহেব আবার তাগাদা দেন,কি হইল, কাফ্ফারার টাকাটা জলদি দিয়া ফালান। নামাজ শুরু করতে দেরি হইতেছে যে। মুর্দার কষ্ট হইতেছে।
হান্নান এবার যথেষ্ট বিনয়ের সঙ্গে বলে, ‘হুজুরের কথা ঠিক, আপনার হিসাব মতই টাকাটা দেওয়া হবে, আমি জবান দিচ্ছি...। এখন তো সাথে নিয়ে আসি নাই...। জানাযাটা মেহেরবানি করে পড়ান, বিকালেই টাকাটা আপনার হাতে পৌঁছে দেব... ওয়াদা, ... হান্নানের ওয়াদা কখনও খেলাফ হয় না...
কে যেন একজন ব্যঙ্গ করে বলে ওঠে,কত ওয়াদাই তো দেখলামরে ভাই... বাকি মানেই ফাঁকি ...
ইমাম সাহেব হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন,খামোশ... ব্যায়াদবের মত কেডা কথা কয়? আমি কথা বলতাছি ভাল লাগতেছে না বুঝি, অ্যাঁ? তো বাবা মোহাম্মদ আবদুল হান্নান, আপনেরা রাজধানীর লোক, উচ্চ শিক্ষিত্, আল্লার রহমতে ভাল আয়-রোজগার করেন, আল্লা আরও দেউক আপনাগরে, দোআ করি। তা বাবা কাফ্ফারা তো দিবেন তা জানি কিন্তু আল্লার ঘর এই মসজিদের দিকে একটু দেখবেন না? রাসুলের ঘর এই মাদ্রাসার দিকে একটু তাকাইবেন না? এইগুলাতো আপনাগরেরই, না কি মিছা কইলাম? মসজিদ মাদ্রাসায় দান সাদকায়ে যারিয়া। এক টাকা দান করলে হাশরের ময়দানে আল্লাপাক নিজ হাতে সত্তুর টাকার সওয়াব দিবেন। মাইয়েদের রুহের মাগফেরাতের থন বড় আর কি আছে, বলেন তো বাবারা, কিছু আছে? দুনিয়াদারি কয়দিনের ...’এক দমে কথাগুলো বলে ইমাম সাহেব থামলেন। তাঁর নূরানি চেহারার ওপর মিছরির কুঁচির মত ঘাম জমে উঠেছে। দুপুরের রোদে এখনও যথেষ্ট তেজ।
বিরক্তি আর ক্লান্তিতে শরীর গুলিয়ে উঠছে যুবায়েরের, বমি বমি লাগছে। সারারাত ঘুম নেই, তার ওপর ভরদুপুরের রৌদ্রে মাঠের মধ্যে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা!
হান্নান এবার নাটকীয় ভঙ্গিতে হাত জোড় করে বলে ওঠে, ওর কন্ঠ বাষ্পরুদ্ধ, আমি ওয়াদা করছি ইমাম সাহেব, বিকালেই টাকাটা দিয়ে দেব; হ্যা, তৌফিক মত দানও করব, দয়া করে জানাযাটা পড়ান...
কী আর করা। হাজার হলেও ভুঁইয়া-বাড়ির ছেলে। বড় চাকরি করে ঢাকায়। কে জানে ঠেকা বেঠেকায় তো এদের দরকার হতেও পারে! তাছাড়া কাফ্ফারা আর দান নিয়ে বেশি কষাকষি করা ভালও দেখায় না। ইমাম সাহেব সবাইকে জানাযার নামাজের নিয়ম বলে দিয়ে তাঁর কাজ শুরু করলেন।
জানাযা শেষ। অনেক লোকের মিছিল আবার খাটিয়া কাঁধে তুলে কলেমা তাইয়েবা পড়তে পড়তে ফিরে চলল ভুঁইয়া-বাড়ি অভিমুখে। অনেক পুরনো একটা স্মৃতি যুবায়েরের মনে ভেসে উঠল। ছোট বেলায় পিঁপড়েদের নিয়ে খেলা করত ও। পিঁপড়েদের সার বেঁধে চলাচল খুব মনোযোগ দিয়ে দেখত। একদিন একদল পিঁপড়েকে একটা মরা ফড়িং টেনে নিয়ে যেতে দেখেছিল গর্তের দিকে। গর্তে ফড়িংটিকে না-ঢোকানো পর্যন্ত একাগ্রমনে দৃশ্যটা দেখেছিল যুবায়ের।
পুকুরের পাড়ে কবর খোড়া হয়েছে। খুব নিখুঁতভাবে খোড়া হয়েছে কবরটা। চৌকোনো গর্তটা এতই মসৃণ যে দেখে মনে হচ্ছে সিমেন্ট দিয়ে তৈরি একটা চৌবাচ্চা! আমগাছটার ঠিক নিচেই খাটিয়াটা রাখা হয়েছে। গাছ থেকে কবর খুব একটা দূরে নয়।
যুবায়ের নীরবে দাঁড়িয়ে ছিল আমগাছটায় ঠেস দিয়ে। শরীর অবশ হয়ে আসছে যেন তার। এক গ্লাস পানি খেলে মন্দ হত নাজ্জবোধহয় কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যেত। কাকে বলবে, সবাই ব্যস্ত দাফনের কাজে। হঠাৎ-ই ফুলের মিষ্টি গন্ধ ওর নাকে এসে লাগে। মনে হয় বহুদিন এমন মিষ্টি গন্ধের ছোঁয়া নাকে লাগেনি। অবশ ভাবটা ধীরে ধীরে কেটে যেতে থাকে। গন্ধের উৎসের খোঁজে ঘাড় ফেরায় যুবায়ের; চোখ গিয়ে পড়ে হানিফের লাশ-রাখা খাটিয়ার ওপর। হানিফের মাথার কাছে নিথর দাঁড়িয়ে আছে ওর ছ-বছরের ছেলেটি। চেহারায় শোকের চিহ্ন নেই। ভাবখানা এমন, বাবা তার কোথাও যাচ্ছে কিছু দিনের জন্যে। বাবাকে ঘিরে এত লোকের এত আয়োজন আর কখনও দেখেনি সে। বাবার সম্পর্কে সবার মুখে এত ভাল ভাল কথা এর আগে শোনেনি কখনো। বাবাটা সত্যি খুব ভাল ছিল ওর! কত রাত ওকে পাশে নিয়ে শুয়ে ঘুম পাড়িয়েছে, মজার মজার গল্প শুনিয়েছে কত...। কোথা থেকে জোগাড়-করা বড় বড় কটা লাল গোলাপ আলগোছে ছড়িয়ে দিয়েছে বাপের বুকের ওপর।
ফুলগুলোকে হানিফের তাজা হৃৎপিণ্ডের মত দেখাচ্ছে যুবায়েরের কাছে তেমনটিই মনে হল।
পুকুরপাড়ের গাছগাছালি থেকে একঝাঁক দাঁড়কাক ডাক ছেড়ে উড়ে গেল রোদে-পোড়া আকাশের পানে।
দৈনিক জনকণ্ঠ:০৩.০৬.২০০৫
লেখক পরিচিতি
শামসুজ্জামান হীরা
মুক্তিযোদ্ধা।
গল্পকার। প্রবন্ধকার।
প্রকাশিত দুটি গল্পগ্রন্থ-- ‘দিঘির জলে পুরনো চাঁদের শব’ ও ‘কানাগলিতে কানামাছি’।
সম্পাদিত বই অরুণ সোম কর্তৃক অনূদিত নিকোলাই গোগলের ‘ওভারকোট’।
0 মন্তব্যসমূহ