সাঁতারের সমান জল। বহুক্ষণ রাস্তার উপর থেকে ডাকাডাকি করে কারো কোনো খোঁজ না পেয়ে অতঃপর সেলিম গায়ের জামা খুলে ব্যাগটা মাথায় নিয়ে ডুবে যাওয়া সড়কের উপর দিয়ে বুক সমান জল ভেঙে হেঁটে চলে। শ্বাপদ শঙ্কুল পথ। আসপাশ থেকে ভেসে আসে পাট পঁচা ঘ্রাণ। তার মধ্য দিয়ে বেশ কিছু দূর এগিয়ে এবারে তার ব্যাগ জামাসহ সব হাতের উপর উঠিয়ে সে সাঁতার দেয়। এই সাঁতার ভিন্ন প্রকৃতির। শুধু পায়ে ভর রেখে জলের ভেতর দিয়ে সামনে এগিয়ে চলা। পাড়ের সন্ধান পেলে তারপর বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা। জলের পরিমাণ কমে আসে। পায়ের ছপ ছপ শব্দে বস্তুপাড়া জেগে ওঠে। কেউ কেউ কুপি জ্বালিয়ে জিজ্ঞেস করে,’এই ভরা রত্রিরে কে যায় ?’
উত্তর আসে,’কাহা, আমি ছেলিম।
‘ –‘ভাইস্তা, এতো রাইতেস কৈ গেছিল্যা?’
--যাত্রা গান শুনবার।
মুকুন্দু রামের হাট। এখানে প্রতিবছর বর্ষায় মনসার ভাসান হয়। এ ভাসান উপলক্ষ্যে মেলার আয়োজন হয়। এলাকায় এটি ভাসান মেলা নামে পরিচিত। এ অঞ্চলের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা এই মেলায় কোনো না কোনো সময় যায়-ই। মেলায় নারীদের চুড়ি-বালা থেকে শুরু করে ঘরের খাট পর্যন্ত সব পাওয়া যায়। এরপর পুতুল নাচ, সার্কাস, যাত্রা এসব তো আছেই। তরুণদের আকর্ষণ থাকে যাত্রা দিকে। সেলিমও সেই যাত্রারই একজন দর্শক শ্রোতা। ভাসান মেলার আগে সবার উপার্জন করা অর্থের একটি অংশ জমা করে। কারো ইচ্ছ থাকে যাত্রা দেখার, কেউ পুতুল নাচ, সার্কাস ইত্যাদি। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর সেলিমকে সবাই যাত্রার পালা নিয়ে জিজ্ঞেস করে। তারপরে সবার চক্ষু চড়ক গাছ হয়। কারণ এবারে আর যাত্রা হবে না। গভীর রাতে যাত্রার দল পালিয়ে গেছে।
জোৎস্না অপেরার পালা করার কথা ছিল। প্রথম পালা ‘শশীবাবুর সংসার’। তার রিহের্সালও চলেছে বেশ ক’দিন। বিপত্তিটা ঘটেছে ওখানে। যাত্রা দলের নায়িকা চরিত্রে অভিনেত্রী জ্যোৎস্নাকে দেখে এলাকার উপজেলা চেয়ারম্যান তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। কোনোটাতে জ্যোৎস্না রাজি না হলে অবশেষে বিয়ের প্রস্তাব। যাত্রাদলের মালিক সতুবাবু বিভিন্ন ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে, আসলে তারা সংস্কৃতি করতে এসেছে। এই সংস্কৃতিই তাদের জীবিকা। সংস্কৃতির উপরে কোনো রকমের কালিমা লেপন করে তারা সংস্কৃতি চর্চা করবে না। এই শালিসি থানা পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু উপজেলা চেয়ারম্যান অপ্রতিরোধ্য। আর তার চ্যালা-চামুণ্ডাদের হোণ্ডার ক্লাস চেপে ছড়ানো সন্ত্রাস আতঙ্ক ছড়ায় এলাকা থেকে এলাকান্তরে। কিন্তু জ্যোৎস্না অপেরা যেন জিম্মি হয়ে পড়ে।
অবশেষে এক রাত্রে দলবল নিয়ে সতুবাবু পালিয়ে এলাকা ত্যাগ করে। জ্যোৎস্না অপেরার সাথে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে সেলিমের সঙ্গেই এই অপেরার একটা ঘনিষ্ট যোগাযোগ গড়ে ওঠে। সেলিমের মামার বাড়ি জলির-পাড়। জ্যোৎস্না অপেরার নায়িকা জ্যোৎস্না সুলতানার বাড়ির পাশে। সেই সূত্র ধরে তাদের যাতায়াতের মধ্যদিয়ে জ্যোৎস্নার সাথে তার পরিচয়। পরিচয়ের রূপ-রস গাঢ় হতে হতে তা কত দূরে গিয়ে পৌছেছে সে কথা আজও বলা দুষ্কর। জ্যোৎস্নার বিয়ে হয়ে ছিল পাশের গ্রাম সাতপাড় গ্রামে। এ গ্রামের একটি ভিন্ন রেয়াজ চালু আছে। গ্রামের ছেলেরা অধিকাংশই কর্ম বিমুখ। কর্ম বিমুখতার কারণে তারা মাদক সেবন সহ বিভিন্ন ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। অভিভাবকরা উদ্বিগ্নতা কাটাতে পাশের গ্রামের কোনো পরিবারের থেকে যৌতুক স্বরূপ বিমান ভাড়া নিয়ে ছেলেকে বিয়ে করিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়। এভাবে এ অঞ্চলের অর্থনীতি বদলালেও মূল্যবোধের অবক্ষয় প্রকট আকার ধারণ করে। প্রাজ্ঞরা বলেন, ‘বাপু, বিয়ে না করা এক কথা। কিন্তু বিয়ে করার পর বউ স্বামী ছাড়া ও স্বামী বউ ছাড়া থাকলে সমাজে ঘোর অমঙ্গল নেমে আসে।‘ এ কথার ব্যাত্যয় কখনোই দেখা যায় নি।
জ্যোৎস্নার ক্ষেত্রে ঘটনাটাও এমনই। স্বামী বিয়ের এক মাসের মধ্যেই বিদেশে পাড়ি জমায়। কিন্তু তারপরে তার কোনো হদিস মেলে নি। ড্রামের ভেতরে অবৈধ অভিবাসী হয়ে জীবন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে অনেক মৃত্যুর মধ্যে তাকে বাঁচতে হয়েছে। যখন সে কোমর সোজা করে দাঁড়িয়েছে তখন দেড় বছর পাড় হয়ে গেছে। বাপের বাড়ির টাকার ঝাল যেন জ্যোৎস্নার উপর দিয়ে উঠাতে পারলেই তার ভাই-ভাবিরা সুস্থ। নির্বাক সহায় সম্বলহীন বাবা-মা’কে দশ কথা না শুনিয়ে জ্যোৎস্না চলে গেছে অপেরায়। নিজ গ্রামের মালিকের অপেরা। এখানে বিপদ আপদের ভয় নেই। এক মৌসুমে টাকাও কম নয়। আর না হোক, সারা বছরের খরচ চলে যায়। তাতে সমস্যা কি? এসব ভেবেই যাত্রা দলে জ্যোৎস্নার যাত্রা শুরু। সেলিমের সাথে জ্যোৎস্নার যে সম্পর্কোন্নয়ন তাতে ঘনিষ্টতা বেড়েছে ছাড়া কমে নি। এ কথা যাত্রা দলেও অনেকটা চাউড় হয়ে গেছে। যাত্রা দল যেখানেই যায়, জ্যোৎস্নার টানে সেলিম সেখানে গিয়ে হাজির হয়। জ্যোৎস্না যে যাত্রায় অভিনয় করে এটা এখন আর সেলিমের তেমন পছন্দ হয় না। অন্য পুরুষের সাথে জ্যোৎস্নাকে সে ভাবতেই পারে না। তাছাড়া যাত্রার মেকাপ পরে যখন সে মঞ্চে আসে তখন দর্শকদের যে করতালি তা সেলিমকে আহত করে। জ্যোৎস্নার শরীরের প্রতিটি ভাঁজে সেলিম যেন তার অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। সে উজার হয়ে যেতে চায়। জ্যোৎস্না নামে দ্বিতীয় কোনো শব্দ আর কোথাও শোনা যাবে নাÑ এমন ভাবনা সেলিমের। জ্যোৎস্নাকে সে একথা বললে জ্যোৎস্না উত্তর দেয়,’মাংসের শরীরে আগুন আমারও জ্বলে। কিন্তু তাই তো খালি চোখের গুহায় ঢাইকা রাখলে হবে না। আমারে একটা জায়গা তো দিতে হবে। আমি কোথায় যাবো ?’
জ্যোৎস্নার দেহ বল্লরি থেকে খসে পরে আলোর ছায়া পথ। সেখানে বিষ্ফোরিত হয় অন্তর্গত আণবিক শক্তির। দেহের ভেতরে দেহ। তার ভেতরে আগুন। সে আগুনে দাহ্য হয় দু’জন। কোনো মিমাংসায় আসে না। সেলিম শুধু বলে যায়,’এইবার আউশ ধান উঠলেই আমরা ঘর বাঁধুম।‘
ঘর বাঁধার স্বপ্নে বিভোর দুই জনÑ একজন যাত্রায়, একজন বাইরে। জ্যোৎস্না সেলিমকে বলে,’যা করার তাড়াতাড়ি কর। যাত্রার অবস্থা ভাল নাই। দলের মধ্যে এক অবস্থা, দলের বাইরে আরেক অবস্থা। সবাই মাংসের আনন্দ চায়। কেউ ঘর বাঁধতে চায় না। আর বাঁধলেই বা কী । একজনের সাথে তো বাঁধছিলাম, তার কোনো খবর নাই। খবর নেয়ারও কোনো সুযোগ নাই। মাংসের ঘরের এই শূন্যতা আমি কি দিয়া পূরণ করি। বয়সে ফাগুন প্রতিদিন ফুরাইয়া যায়। পুরুষেরা আইসা মিঠা মিঠা কথা কয়। কিন্তু রাত্তিরে যখন একলা থাকি তখন একটা রাক্ষস আমারে ছিড়া খুড়া খায়। আমি কোথায় যাব? মূল্যবোধ আর ভদ্দরলোকি সংলাপ তখন কোথায় থাকে? আমার এই বয়স প্রতিদিন ফুরাইয়া যায়। সবাই এরে খাবলাইয়া খাইতে চায়। নিরুত্তর সেলিম। জ্যোৎস্নারে কী যেন বুঝাইয়া চলে যায়। তখন বৃষ্টি। জ্যোৎস্না ডাক দেয়,’বাইরে অন্ধকার, একটু দাঁড়াই যাও' অন্ধকারের আলোতে জ্যোৎস্নাকে যেন আরো বেশি মোহময় মনে হয়। ঝড় নামে। সেই ঝড়ে দুই জনের ডালপালা ভাঙে।
ঝড় শেষ হলে চলে যায় সেলিম। এই বারের চলে যাওয়া সম্পূর্ণ আলাদা। গভীর রাত। অন্ধকারের রাস্তায় চলে। তার দূরত্ব পথের দূরত্বের চেয়ে বেশি। সে বাড়ি যায়। কিন্তু এবারে তার ভেতরে ঘর, নতুন ঘর। সেই ঘরে জ্যোৎস্না ও সে ছাড়া কেউ নাই। ভাবতে ভাবতে সে কোথায় হারিয়ে যায় তা সেও জানে না। এই ভাবে সেই রাত্তিরে সে বাড়ি গিয়ে পৌছে ছিল। কিন্তু রাতে ঘুম হয় নাই। রাত তার শূন্য লেগেছে। এই শূন্যতার অপেক্ষায় সে দিনের পর দিন বসে ছিল পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে। তার সেই শূন্যতা পূরণ হয়েছে। এখন শুধু আউশের মৌসুমের অপেক্ষা।
জ্যোৎস্নার স্বামী স্বপন দূর্জেয় জীবন সংগ্রামের পর দুবাইতে গিয়ে এলাকার প্রবাসিদের কল্যাণে ঠিকঠাক মতো চাকরি পায়। জ্যোৎস্নার কথা বারবার মনে হয়। কখনো টেলিফোন করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বহু আসে সে নাম্বার হারিয়ে ফেলেছে। এলাকার একজনের কাছ থেকে নাম্বার সংগ্রহ করে। আজকাল করে ফোন করা হচ্ছে না। বউ তার পথ চেয়ে আছে কত দিন। ভাবতে তার বালিশ নোনা জলে ভরে যায়। দিনের কাজে মায়ামমত্ব নাই। কিন্তু রাত নামলেই প্রবাসি জীবনের অন্তর্দাহ যেন জ্বলে ওঠে। এই পেলব মাটির স্পর্শ ছাড়া একটু কালও কাটাতে ইচ্ছ করে না। তারপর জ্যোৎস্নার কথা তো আছেই।
এখন আউশের মৌসুম। স্বপন কিছু টাকা পাঠায় তার বাবার কাছে, ও জ্যোৎস্নার কাছে। টাকা পাওয়ার পরে বাবার টেলিফোন পেলেও জ্যোৎস্নার কোনো উত্তর না পেয়ে স্বপন ভাবে, এতো দিনের ঘটনা না জানা পর্যন্ত জ্যোৎস্নার হয়তো মান ভাঙবে না। রাতে ঘুমায়, ঘুম আসে না। পাশে বন্ধু ঘুমে। তাকে ডাক দেয়। সেও প্রায় জাগরণেই ছিল। গল্প করে তার সাথে। বউয়ের কথা, মায়ের কথা, বোনের কথা, ছোট ভাইটার লাটিম কেনার কথা। পাশের বন্ধু গল্প বলেÑ আমাগো বাড়িতে আগে বড় বড় গাভী ছিল। এক একটা গাভীর কত দুধ হই তো। আমরা খাইয়া পারতাম না। পরে সাপে আইসা খাইয়া ফেলতো। বাপজান যখন প্রথম এই গল্প করছিল প্রথমে আমার বিশ্বাস হয় নাই। পরে দেখেছি, গাভীর বানে চিকন চিকন দাঁতের দাগ। আবার পায়েও সাপের প্যাচের দাগ। গল্প শোনার পর স্বপন অস্থির হয়ে ওঠে। সে শুধু চায় এই রাত শেষ হোক। জানালাটা টান দিয়ে খোলে দেখে একখানা পরবাসি মেঘ উড়ে যায়। কালিদাস এই মেঘ দেখ উজ্জ্বয়নী নগরীতে তার প্রিয়তমা স্ত্রীর উদ্দেশ্যে একখানা চিঠি লিখে এই মেঘের কাছেই দিয়ে ছিল। কিন্তু স্বপন পরবাসি মেঘের কাছে চিঠি দেয়ার সময়ের বার চাইছে না। এই আউশের মৌসুমেই সে বাড়ি চলে যাবে।
উত্তর আসে,’কাহা, আমি ছেলিম।
‘ –‘ভাইস্তা, এতো রাইতেস কৈ গেছিল্যা?’
--যাত্রা গান শুনবার।
মুকুন্দু রামের হাট। এখানে প্রতিবছর বর্ষায় মনসার ভাসান হয়। এ ভাসান উপলক্ষ্যে মেলার আয়োজন হয়। এলাকায় এটি ভাসান মেলা নামে পরিচিত। এ অঞ্চলের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা এই মেলায় কোনো না কোনো সময় যায়-ই। মেলায় নারীদের চুড়ি-বালা থেকে শুরু করে ঘরের খাট পর্যন্ত সব পাওয়া যায়। এরপর পুতুল নাচ, সার্কাস, যাত্রা এসব তো আছেই। তরুণদের আকর্ষণ থাকে যাত্রা দিকে। সেলিমও সেই যাত্রারই একজন দর্শক শ্রোতা। ভাসান মেলার আগে সবার উপার্জন করা অর্থের একটি অংশ জমা করে। কারো ইচ্ছ থাকে যাত্রা দেখার, কেউ পুতুল নাচ, সার্কাস ইত্যাদি। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর সেলিমকে সবাই যাত্রার পালা নিয়ে জিজ্ঞেস করে। তারপরে সবার চক্ষু চড়ক গাছ হয়। কারণ এবারে আর যাত্রা হবে না। গভীর রাতে যাত্রার দল পালিয়ে গেছে।
জোৎস্না অপেরার পালা করার কথা ছিল। প্রথম পালা ‘শশীবাবুর সংসার’। তার রিহের্সালও চলেছে বেশ ক’দিন। বিপত্তিটা ঘটেছে ওখানে। যাত্রা দলের নায়িকা চরিত্রে অভিনেত্রী জ্যোৎস্নাকে দেখে এলাকার উপজেলা চেয়ারম্যান তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। কোনোটাতে জ্যোৎস্না রাজি না হলে অবশেষে বিয়ের প্রস্তাব। যাত্রাদলের মালিক সতুবাবু বিভিন্ন ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে, আসলে তারা সংস্কৃতি করতে এসেছে। এই সংস্কৃতিই তাদের জীবিকা। সংস্কৃতির উপরে কোনো রকমের কালিমা লেপন করে তারা সংস্কৃতি চর্চা করবে না। এই শালিসি থানা পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু উপজেলা চেয়ারম্যান অপ্রতিরোধ্য। আর তার চ্যালা-চামুণ্ডাদের হোণ্ডার ক্লাস চেপে ছড়ানো সন্ত্রাস আতঙ্ক ছড়ায় এলাকা থেকে এলাকান্তরে। কিন্তু জ্যোৎস্না অপেরা যেন জিম্মি হয়ে পড়ে।
অবশেষে এক রাত্রে দলবল নিয়ে সতুবাবু পালিয়ে এলাকা ত্যাগ করে। জ্যোৎস্না অপেরার সাথে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে সেলিমের সঙ্গেই এই অপেরার একটা ঘনিষ্ট যোগাযোগ গড়ে ওঠে। সেলিমের মামার বাড়ি জলির-পাড়। জ্যোৎস্না অপেরার নায়িকা জ্যোৎস্না সুলতানার বাড়ির পাশে। সেই সূত্র ধরে তাদের যাতায়াতের মধ্যদিয়ে জ্যোৎস্নার সাথে তার পরিচয়। পরিচয়ের রূপ-রস গাঢ় হতে হতে তা কত দূরে গিয়ে পৌছেছে সে কথা আজও বলা দুষ্কর। জ্যোৎস্নার বিয়ে হয়ে ছিল পাশের গ্রাম সাতপাড় গ্রামে। এ গ্রামের একটি ভিন্ন রেয়াজ চালু আছে। গ্রামের ছেলেরা অধিকাংশই কর্ম বিমুখ। কর্ম বিমুখতার কারণে তারা মাদক সেবন সহ বিভিন্ন ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। অভিভাবকরা উদ্বিগ্নতা কাটাতে পাশের গ্রামের কোনো পরিবারের থেকে যৌতুক স্বরূপ বিমান ভাড়া নিয়ে ছেলেকে বিয়ে করিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়। এভাবে এ অঞ্চলের অর্থনীতি বদলালেও মূল্যবোধের অবক্ষয় প্রকট আকার ধারণ করে। প্রাজ্ঞরা বলেন, ‘বাপু, বিয়ে না করা এক কথা। কিন্তু বিয়ে করার পর বউ স্বামী ছাড়া ও স্বামী বউ ছাড়া থাকলে সমাজে ঘোর অমঙ্গল নেমে আসে।‘ এ কথার ব্যাত্যয় কখনোই দেখা যায় নি।
জ্যোৎস্নার ক্ষেত্রে ঘটনাটাও এমনই। স্বামী বিয়ের এক মাসের মধ্যেই বিদেশে পাড়ি জমায়। কিন্তু তারপরে তার কোনো হদিস মেলে নি। ড্রামের ভেতরে অবৈধ অভিবাসী হয়ে জীবন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে অনেক মৃত্যুর মধ্যে তাকে বাঁচতে হয়েছে। যখন সে কোমর সোজা করে দাঁড়িয়েছে তখন দেড় বছর পাড় হয়ে গেছে। বাপের বাড়ির টাকার ঝাল যেন জ্যোৎস্নার উপর দিয়ে উঠাতে পারলেই তার ভাই-ভাবিরা সুস্থ। নির্বাক সহায় সম্বলহীন বাবা-মা’কে দশ কথা না শুনিয়ে জ্যোৎস্না চলে গেছে অপেরায়। নিজ গ্রামের মালিকের অপেরা। এখানে বিপদ আপদের ভয় নেই। এক মৌসুমে টাকাও কম নয়। আর না হোক, সারা বছরের খরচ চলে যায়। তাতে সমস্যা কি? এসব ভেবেই যাত্রা দলে জ্যোৎস্নার যাত্রা শুরু। সেলিমের সাথে জ্যোৎস্নার যে সম্পর্কোন্নয়ন তাতে ঘনিষ্টতা বেড়েছে ছাড়া কমে নি। এ কথা যাত্রা দলেও অনেকটা চাউড় হয়ে গেছে। যাত্রা দল যেখানেই যায়, জ্যোৎস্নার টানে সেলিম সেখানে গিয়ে হাজির হয়। জ্যোৎস্না যে যাত্রায় অভিনয় করে এটা এখন আর সেলিমের তেমন পছন্দ হয় না। অন্য পুরুষের সাথে জ্যোৎস্নাকে সে ভাবতেই পারে না। তাছাড়া যাত্রার মেকাপ পরে যখন সে মঞ্চে আসে তখন দর্শকদের যে করতালি তা সেলিমকে আহত করে। জ্যোৎস্নার শরীরের প্রতিটি ভাঁজে সেলিম যেন তার অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। সে উজার হয়ে যেতে চায়। জ্যোৎস্না নামে দ্বিতীয় কোনো শব্দ আর কোথাও শোনা যাবে নাÑ এমন ভাবনা সেলিমের। জ্যোৎস্নাকে সে একথা বললে জ্যোৎস্না উত্তর দেয়,’মাংসের শরীরে আগুন আমারও জ্বলে। কিন্তু তাই তো খালি চোখের গুহায় ঢাইকা রাখলে হবে না। আমারে একটা জায়গা তো দিতে হবে। আমি কোথায় যাবো ?’
জ্যোৎস্নার দেহ বল্লরি থেকে খসে পরে আলোর ছায়া পথ। সেখানে বিষ্ফোরিত হয় অন্তর্গত আণবিক শক্তির। দেহের ভেতরে দেহ। তার ভেতরে আগুন। সে আগুনে দাহ্য হয় দু’জন। কোনো মিমাংসায় আসে না। সেলিম শুধু বলে যায়,’এইবার আউশ ধান উঠলেই আমরা ঘর বাঁধুম।‘
ঘর বাঁধার স্বপ্নে বিভোর দুই জনÑ একজন যাত্রায়, একজন বাইরে। জ্যোৎস্না সেলিমকে বলে,’যা করার তাড়াতাড়ি কর। যাত্রার অবস্থা ভাল নাই। দলের মধ্যে এক অবস্থা, দলের বাইরে আরেক অবস্থা। সবাই মাংসের আনন্দ চায়। কেউ ঘর বাঁধতে চায় না। আর বাঁধলেই বা কী । একজনের সাথে তো বাঁধছিলাম, তার কোনো খবর নাই। খবর নেয়ারও কোনো সুযোগ নাই। মাংসের ঘরের এই শূন্যতা আমি কি দিয়া পূরণ করি। বয়সে ফাগুন প্রতিদিন ফুরাইয়া যায়। পুরুষেরা আইসা মিঠা মিঠা কথা কয়। কিন্তু রাত্তিরে যখন একলা থাকি তখন একটা রাক্ষস আমারে ছিড়া খুড়া খায়। আমি কোথায় যাব? মূল্যবোধ আর ভদ্দরলোকি সংলাপ তখন কোথায় থাকে? আমার এই বয়স প্রতিদিন ফুরাইয়া যায়। সবাই এরে খাবলাইয়া খাইতে চায়। নিরুত্তর সেলিম। জ্যোৎস্নারে কী যেন বুঝাইয়া চলে যায়। তখন বৃষ্টি। জ্যোৎস্না ডাক দেয়,’বাইরে অন্ধকার, একটু দাঁড়াই যাও' অন্ধকারের আলোতে জ্যোৎস্নাকে যেন আরো বেশি মোহময় মনে হয়। ঝড় নামে। সেই ঝড়ে দুই জনের ডালপালা ভাঙে।
ঝড় শেষ হলে চলে যায় সেলিম। এই বারের চলে যাওয়া সম্পূর্ণ আলাদা। গভীর রাত। অন্ধকারের রাস্তায় চলে। তার দূরত্ব পথের দূরত্বের চেয়ে বেশি। সে বাড়ি যায়। কিন্তু এবারে তার ভেতরে ঘর, নতুন ঘর। সেই ঘরে জ্যোৎস্না ও সে ছাড়া কেউ নাই। ভাবতে ভাবতে সে কোথায় হারিয়ে যায় তা সেও জানে না। এই ভাবে সেই রাত্তিরে সে বাড়ি গিয়ে পৌছে ছিল। কিন্তু রাতে ঘুম হয় নাই। রাত তার শূন্য লেগেছে। এই শূন্যতার অপেক্ষায় সে দিনের পর দিন বসে ছিল পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে। তার সেই শূন্যতা পূরণ হয়েছে। এখন শুধু আউশের মৌসুমের অপেক্ষা।
জ্যোৎস্নার স্বামী স্বপন দূর্জেয় জীবন সংগ্রামের পর দুবাইতে গিয়ে এলাকার প্রবাসিদের কল্যাণে ঠিকঠাক মতো চাকরি পায়। জ্যোৎস্নার কথা বারবার মনে হয়। কখনো টেলিফোন করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বহু আসে সে নাম্বার হারিয়ে ফেলেছে। এলাকার একজনের কাছ থেকে নাম্বার সংগ্রহ করে। আজকাল করে ফোন করা হচ্ছে না। বউ তার পথ চেয়ে আছে কত দিন। ভাবতে তার বালিশ নোনা জলে ভরে যায়। দিনের কাজে মায়ামমত্ব নাই। কিন্তু রাত নামলেই প্রবাসি জীবনের অন্তর্দাহ যেন জ্বলে ওঠে। এই পেলব মাটির স্পর্শ ছাড়া একটু কালও কাটাতে ইচ্ছ করে না। তারপর জ্যোৎস্নার কথা তো আছেই।
এখন আউশের মৌসুম। স্বপন কিছু টাকা পাঠায় তার বাবার কাছে, ও জ্যোৎস্নার কাছে। টাকা পাওয়ার পরে বাবার টেলিফোন পেলেও জ্যোৎস্নার কোনো উত্তর না পেয়ে স্বপন ভাবে, এতো দিনের ঘটনা না জানা পর্যন্ত জ্যোৎস্নার হয়তো মান ভাঙবে না। রাতে ঘুমায়, ঘুম আসে না। পাশে বন্ধু ঘুমে। তাকে ডাক দেয়। সেও প্রায় জাগরণেই ছিল। গল্প করে তার সাথে। বউয়ের কথা, মায়ের কথা, বোনের কথা, ছোট ভাইটার লাটিম কেনার কথা। পাশের বন্ধু গল্প বলেÑ আমাগো বাড়িতে আগে বড় বড় গাভী ছিল। এক একটা গাভীর কত দুধ হই তো। আমরা খাইয়া পারতাম না। পরে সাপে আইসা খাইয়া ফেলতো। বাপজান যখন প্রথম এই গল্প করছিল প্রথমে আমার বিশ্বাস হয় নাই। পরে দেখেছি, গাভীর বানে চিকন চিকন দাঁতের দাগ। আবার পায়েও সাপের প্যাচের দাগ। গল্প শোনার পর স্বপন অস্থির হয়ে ওঠে। সে শুধু চায় এই রাত শেষ হোক। জানালাটা টান দিয়ে খোলে দেখে একখানা পরবাসি মেঘ উড়ে যায়। কালিদাস এই মেঘ দেখ উজ্জ্বয়নী নগরীতে তার প্রিয়তমা স্ত্রীর উদ্দেশ্যে একখানা চিঠি লিখে এই মেঘের কাছেই দিয়ে ছিল। কিন্তু স্বপন পরবাসি মেঘের কাছে চিঠি দেয়ার সময়ের বার চাইছে না। এই আউশের মৌসুমেই সে বাড়ি চলে যাবে।
0 মন্তব্যসমূহ