সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমামের গল্প : বৈরাগী স্কুল


স্কুলটি যখন গড়া হয় তখন কোনো গেট ছিল না। ছিল চারদিকেই খোলামেলা। আর টিনের ঘর। এই ঘরগুলোর সবচেয়ে যেটি বড় তার একটি খুঁটির গায়ে লেখা ছিল—সনাতন বৈরাগী। কাঠ কেটে লেখা।

এখন গেট হয়েছে। তার মধ্যে দিয়ে আসতে আসতে সুনীলকুমার রাহুতের বেশ আনন্দই হল। মনে হল তার নিজের বাড়িতে ঢুকছেন। তিনি বহুদিন যাবত এই স্কুলের হেড মাস্টার ছিলেন। তাকে সবাই সম্মান করত। যেতে দেখলে দাঁড়িয়ে যেত। কেউ প্রণাম করত। কেউ সালাম দিত। আজ কেউ ঠিক ওভাবে তাঁর দিকে নজর দিলনা। আগে হলে তিনি কষ্ট পেতেন। রাগও হত। আজকের আনন্দের জন্য এই সব ছোটখাটো ত্রুটি ধরা ঠিক হবে না ভেবে এসব পাত্তা দিলেন না সুনীল কুমার রাহুত।


গেটের কাছে বাঁশের খুটির মাথায় সটকে দেয়া মাইকের শব্দের তোড়ে স্কুলটা কাঁপছে গম গম করে। বিন্দিয়া চমকে গি, চুরি খানকেগি, মুঝে ইয়াদ পিআকি... হিন্দী গানের সুর স্কুল পেরিয়ে গোটা এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। তারই স্কুল থেকে গোটা এলাকাবাসীদের এ সব শব্দ শোনানো হচ্ছে দেখে মেজাজ বিগড়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু সুনীল কুমারের তাও হচ্ছেনা দেখে নিজেই অবাক হলেন। অনেকদিন পর এখানে এসে তাঁর আসলে সবই ভালো লাগছে।

এই স্কুলের ছাত্র সরকারের মন্ত্রী হয়েছে। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতায় সেই মন্ত্রী আসবে বলে ঢোকার মুখে কালভার্ট দুটো মেরামত হয়েছে। তারচেয়ে বড় কথা প্রাইমারী সেকশনের ঘরটায় এবার ছাদ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এতদিন বাচ্চারা খুব কষ্টই করতো। জৈষ্ঠ্য মাসে টিনের চাল তেতে ওদের মুখগুলো লাল হয়ে যেত। অমন সময় কি অংক মাথায় ঢোকে, না মাস্টারের হাত কামড়ে দিতে ইচ্ছে করে!

এখন নতুন ছাদের সঙ্গে ফ্যান ঝুলছে। তবে মাঘ মাস হলেও সুনীলকুমার অনেকটা পথ এসেছেন বলে কিছুটা ঘেমে গেছেন। তার বগলের তলা ভিজে পাঞ্জাবীর কিছু কিছু যায়গা শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে। ফ্যানের হাওয়া ঘুরতে দেখে মনে হল—তার নিচে বসে গেলে মন্দ হয় না। শরীরটা জুড়োবে। বাচ্চারা দেখলে কি ভাববে মনে করে নিজেই হেসে ফেললেন। এরই নাম ভালো লাগা। দীর্ঘ সময় ধরে কর্তৃত্ব করা দাপুটে মানুষটা এখন ক্লাশ রুমে বসে বাতাস খেতে চায়।

তিনি স্কুলের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দেখতে দেখতে এল-প্যাটার্নের বারান্দার কোনায় এসে দাঁড়ালেন। ক্লাশ রুমগুলোতে লম্বা বেঞ্চের বদলে ডেস্ক বসানো হয়েছে। পরিত্যক্ত একটা বেঞ্চ ফেলে রাখা বারান্দায়। তারই এককোনায় বসে সুনীলকুমার ভাবলেন, এখন নিশ্চয়ই আর বাচ্চারা আগের মত বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া করে বেঞ্চে পেন্সিল দিয়ে দাগ কেটে বলেনা, এই যে আমার অংশ। এদিকে আসবিনা। সময় কত দ্রুত বদলে যায়!

তার তেষ্টা পেয়েছে। এক গ্লাস ঠান্ডা জল দরকার। কাকে বলবেন, বুঝতে পারছেনা না। আশেপাশে স্কুল ড্রেস পরা সদ্য গোফ দেখা দেয়া যেসব মুখ ঘুরে বেড়াচ্ছে এরা অপরিচিত। এখন যারা ক্লাশ নাইন টেনে পড়ছে তারাও বড়জোড় ছয় বছর আগে ভর্তি হয়েছে। এসবই তার চলে যাবারও অনেক পরের ঘটনা। এদের বাবা-কাকারা এক সময় এ স্কুলেই পড়ত। তখন তার চুল পাকেনি। এখন কাশফুলের মত সব সাদা। বুঝতে পারলেন তিনি বহুদিন এই স্কুলে নেই। বুড়ো হয়েছেন। সুনীল কুমারের এই প্রথম বুকের ভেতর একটু কেমন করে উঠলো। তিনি উড়িয়ে দিলেন এই একটুকরো কেমন করে উঠা। বরং জল খাওয়া জরুরি। ঠিক তখনই সামনে এসে দাঁড়ালো একজন।

তিনি সিদ্দিক মাস্টার। তার কাছেই জয়েন করেছিল। তখন ছিল একেবারে ছোকরা গোছের। গত কয়েক বছরে সন্তান সম্ভবা নারীর মত শরীরের একটি যায়গা ফুলিয়ে তুলেছে। সেই সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে কমেছে তার কেশগুচ্ছ। চশমার ভেতর দিয়ে এসব দেখতে দেখতে সুনীল কুমার মুখ এগিয়ে বললেন, সিদ্দিক বাবু তেষ্টা পেয়েছে, জল দিতে পারেন?

সিদ্দিকুর রহমান কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, স্যার আপনার শরীর খারাপ?

- তেমন কিছু না, অনেকটা পথ এসেছি তো।

- রিটায়ারের পর কি গ্রামে চলে গেছেন?

সুনীলকুমার মাথা নাড়লেন। বললেন, শহরে বাড়ি-ঘর কিছু করিনি। গ্রামেই থাকতে সুবিধে হয়।

উত্তরটি সিদ্দিক শুনলেন কি শুনলেন না বোঝা গেল না। তার তাড়া আছে। বললেন, আচ্ছা স্যার, আপনি বসেন। আমি দেখি পানি খাওয়ানো যায় কিনা। আজ যে কে কোথায় আছে--ঠিক নেই। হাতের কাছে কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা।

আর সিদ্দিক মাস্টার খুবই ব্যস্ত। তিনি পুরনো শিক্ষক বলে তাকেই সবদিক সামলাতে হচ্ছে। সিদ্দিক মাস্টার ভেতরের দিকে চলে গেলেন।

সুনীলকুমার বসে রইলেন। স্কুলটাকে বিয়ে বাড়ির মত দেখাচ্ছে। গেট থেকে বারান্দা পর্যন্ত কয়েক লাইন দড়ি টানানো হয়েছে। তার গায়ে তিন কোনা কাটা রঙিন কাগজগুলো তির তির করে কাঁপছে পাতার মত। মাঠের একপাশে প্যান্ডেল-মঞ্চ। নতুন চুনকামে ঝকঝক করছে দেয়াল। বেশ সুন্দর লাগছে। রঙের ঘ্রান এখনো শুকোয়নি। তাতে কেমন নি:শ্বাস আটকে আসে। কিন্তু স্কুলের এই নবরূপ সুনীলকুমারের ভালোই লাগছে।

এই স্কুল একটা টিনের ঘর দিয়ে শুরু হয়েছিল। ছেলেপেলেরা সুর করে ঝুলে ঝুলে পড়া বলতো। ক্লাশ শুরুর আগে এ্যাসেম্বলি হতো। তখন জাতীয় সঙ্গীত আর শপথ পাঠ করতো সব ধর্মের শিক্ষার্থীরা। জলের জন্য অপেক্ষা করতে করতে দেখলেন, রোদের ভেতর মাঠের একপাশে ঝোলানো ঘণ্টাটা। এই ঘণ্টার শব্দ খুব তীক্ষ নয়। লোহার পাত ভারি বলে গ্রুম গ্রুম শব্দ হয়। এর আগে একটা কাঁসার ঘন্টা ছিল। সেটার মাঝখানে লাগানো দড়ি ধরে হাতুড়ি দিয়ে পেটালে বেশ রিনরিনে শব্দ হত।

অনেক বছর আগের কথা। চোখ বন্ধ করলে ছেলেদের মুখ এখনো চোখে ভাসে। হাফ প্যান্ট পরে ভর্তি হতো আর ম্যাট্রিক পাশ করে বেরিয়ে যাবার সময় তাদের পরনে ফুল প্যান্ট—পায়জামা। প্রায় কৈশোর শেষ। এ এলাকার বেশিরভাগ ছেলেই তাদের জীবনের দুরন্ত সময়টা পার করেছে বৈরাগী স্কুলে। স্কুলের পেছনের দিকটাতে ছিল ধান ক্ষেত। বর্ষায় সেই ধানের চারা ডুবে যেত পানিতে। এর ভেতর দিয়েই ছোট ছোট নৌকা চালিয়ে আসতো ডানপিটেগুলো। ওই দলে মুসাও ছিল। সবচেয়ে দুরন্ত ছেলেটা।

মুক্তিযুদ্ধের আগে এ অঞ্চলে অবস্থাসম্পন্ন হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যা খারাপ ছিলনা। তবে দেশভাগের পর থেকেই কমতে শুরু করে। ৬৪’র দাঙ্গা, এরপর ৭১ এ স্বাধীনতার যুদ্ধের সময়ে অবস্থাসম্পন্নদের বেশিরভাগই চলে গেছে। কিন্তু সুনীল কুমারের এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয়নি এ দেশ তার নয়। হয়ই বা কি করে! ধর্ম পরিচয় দিয়ে কি মাটির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ব্যবচ্ছেদ হয়! এই যে এই মাটির মানুষেরা প্রাণভয়ে অন্য ভূখন্ডে চলে গেলো-- তারা কি ভুলে গেছে তাদের গোপালপুরের শৈশব, কৈশোর, ঘরের চালে তুলে দেয়া গাছের ফুল আর পুকুরের পাশের আম গাছটার কথা! কবে যে এ অঞ্চলের নাম গোপালপুর হয়েছিল কেউ ঠিকঠাক বলতে পারেনা। হয়ত এ নামে কেউ যায়গা কিনে প্রথম জঙ্গল কেটে আগাছা পরিস্কার করে ঘর বানিয়েছিল। অথবা সেই পাল রাজবংশের জনক গোপালের নাম থেকে কোন এক বিদ্বান কবে ভেবেছিলেন একদিন এখানকার খুব সাধারণ কেউ অসাধারণ হয়ে উঠবে সেই পাল বংশের গোপালের মতো। বপ্যট নামে এক যোদ্ধার পুত্র এবং দয়িতবিষ্ণু নামে এক ‘সর্ববিদ্যাশুদ্ধ’ পণ্ডিতের পৌত্র গোপাল যেমন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজ বংশ । পরে হয়ত শুধু ‘পুর’ টুকু জুড়ে দেয়া হয়েছে । পুর বলতে সাধারণত বাড়ি বোঝায়।

একসময় এ এলাকার বেশিরভাগ জমিই ছিল হিন্দুদের। তবে বর্গা দেয়া। চাষ করতো মুসলমান কৃষকরা। শীতের দেড় দুই মাস প্রতিদিনিই কোন না কোন জমিতে ধান কাটা চলতো। আর স্কুলের সামনে দিয়ে গরুর গাড়ি বোঝাই করে ধান নিয়ে যাবার সময় ওই গাড়িতে উঠে পড়তো স্কুলের ছেলেরা। আবার মুসলমানদের বাড়ি থেকে গরু এনে ধানের মলন দিতো হিন্দুরা। মুসাদের মুন্সী পরিবারের বেশ কিছু গরু ছিল তখনই। অন্য সব মুসলমানদের চেয়ে সম্পত্তিও বেশি। মুসা প্রায়ই না হেঁটে গরুর পিঠে চরেই স্কুলে আসতো।

বারান্দায় বসে পানির জন্য অপেক্ষা করতে করতে আর রোদের দিকে তাকিয়ে এসব পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে সুনীলকুমারের মাথার ভেতরটা যেন কেমন করে উঠছে। ব্যস্ত মানুষ অবসরে গেলে মনের বাঁধন দুর্বল হয়। হঠাৎ মনে হতে লাগলো-- স্কুলের মাঠে মুসা অনেকগুলো গরু তাড়িয়ে নিয়ে আসছে। আর ওই পালের ভেতর হামাগুড়ি দিয়ে তিনি হাঁটছেন। এসব ভাবনা ভাবতে গিয়ে তার শরীরে একটু উত্তেজনা হচ্ছে। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। বুঝতে পারছেন শরীর বোধহয় একটু খারাপ করেছে। এ অবস্থায় আসাই ঠিক হয়নি। তবুও ভাবলেন-- বৈরাগী স্কুলের অনুষ্ঠান। আর তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বেশি সময় ধরে থাকা প্রধান শিক্ষক। না এলে হয় না। বৈরাগী স্কুল অনেক দিয়েছে এ অঞ্চলের মানুষকে ।

স্কুল বাড়িটি যখন গড়া হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, এলাকার লোকজন চাঁদাও দিয়েছিল স্বেচ্ছায়—তখন দেখা গেল এক লপ্তে জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। এলাকার মাখনবাবু যে জায়গাটি দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন, দেখা গেল জায়গাটি নিয়ে শরীকানার তীব্র বিবাদ আছে। স্কুল করতে গেলে রক্তারক্তি কাণ্ড বেঁধে যেতে পারে। স্কুল হতে গিয়েও হতে পারছে না। তবে হতে পারে। মাখনবাবুর দান করা জায়গাটির পাশে সনাতন বৈরাগীর বাড়ি। সেই বাড়ির জায়গাটি যদি পাওয়া যায় তবে শরীকদের বাদ দিয়েই স্কুলটি হতে পারে।

সনাতন বৈরাগীদের পেশা ঝাঁকা- কুলা বানানো, মাছ ধরার চাই বানানো। আর পুজোর সময়ে ঢাক-ঢোল পিটানো। সাথে মাঝে মাঝে গান গাওয়া। তারা সংবৎসরেই অভাব-অভিযোগে থাকে বলে স্কুলের জন্য চাঁদার জন্য তাদেরকে হিসেবের মধ্যে ধরা হয়নি।

কিন্তু কোনো উপায় না দেখে গ্রামের গণ্যমান্য লোকজন সনাতন বৈরাগীকেই গিয়ে ধরল। সবাই ভেবেছিল সনাতন তাদের কথা শুনবে না। কিন্তু সবাইকে অবাক করে সনাতন জমি দান করে দিল। বলল, আমরা ভাসমান মানুষ। আজ এইখানে—কাইল ওইখানে। আমাগোর কোনো ভুত-ভবিষ্যত নাই। কিন্তু স্কুলটি হইলি এলাকার মানুষজনের উজ্জ্বল ভবিষ্যত হবি।

শুধু সনাতন নয়—তার ভাই-বেরাদাররাও তাদের ভিটে ছেড়ে চলে গেল অন্য এলাকায়। তাদের এই আত্মত্যাগের কথা মনে রেখে স্কুলের নাম বৈরাগী বিদ্যালয় রাখা হয়েছে। এটা নিয়ে সে সময়ে তেমন কেউ কোনো আপত্তি করার সাহস করেনি অথচ ওই সময় কোনো ধনী হিন্দু-মুসলমানদের নামের বদলে নিম্নবর্গের বৈরাগীদের নামে স্কুল হওয়া ছিল কল্পনারও অতীত। সেই বৈরাগী স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাজ করে সুনীলকুমারের আলাদা একটা সম্মান বোধ করতেন।

তবে একটা ছোট কষ্ট বুকের ভেতর রয়েই গেছে সুনীল কুমার রাহুতের । এটা তাঁর ব্যক্তিগত কষ্ট বলে অভিমানটা কাউকে বলতেও পারেন না। রিটায়ারের পর স্কুল কমিটিতে তার নামটা রাখার অনুরোধ করেছিলেন। এখনো রাখা হয়নি। গোপালপুরের নামই পরে মুন্সী পাড়া হয়ে গেছে। তখনো তিনি চিঠি লিখেছিলেন পৌরসভায়, চেয়ারম্যান বলেছিলেন দেখবো। কত বছর হয়ে গেল কিন্তু দেখার সময় হয়নি আজও। সুনীলকুমারের নি:শ্বাসে একটু কষ্ট হচ্ছে। প্রধান অতিথি তার গাড়ি বহর নিয়ে সার্কিট হাউজে উঠেছে। সেখান থেকে ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে আসতে দেরী হবে। সুনীল্কুমারের মনে হল—তিনি উৎসাহে একটু আগেই এসে পড়েছেন।

পুরনো বেঞ্চটাতে বসে এসব স্মৃতিচারণের মধ্যে দপ্তরি কাঁচের গ্লাশে পানি নিয়ে এলো বারান্দায়। গ্লাশ নিয়ে গলায় ঢালতেই ছেলেদের হৈচৈ শোনা গেল। মিনিস্টার আসছে-- মিনিস্টার আসছে। শেষ পানিটুকু তার গলায় নামছে। কাঁচের তলানির ভেতর দিয়ে দেখলেন ছেলেরা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে গেটের দুপাশে। গেটের বাইরে গাড়ি বহরের ভিড়। সুনীল কুমারের ভেতরটা কেঁপে উঠছে আনন্দে।

মুসা কি তাকে দেখলে এখন চিনতে পারবে? ছোট বেলায় বহুবার অংকে ভুল করায় কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন তিনি। আজ সেই মুসা মন্ত্রী হয়ে নিজের স্কুলে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছে। সরকারি সাদা জিপের পেছনে পেছনে নিরাপত্তা বাহিনী আর ডেপুটি কমিশনারের গাড়ি। ছাত্ররা বুকে ব্যাচ পরেছে। তার বুকেই শুধু ব্যাচ নেই। কেউ তাকে পরিয়ে দেয়নি। সবাই ছুটোছুটি করছে। মন্ত্রী আজ অনুষ্ঠানে বৈরাগী বিদ্যালয় নিয়ে একটা ঘোষণা দিবেন-- তাই সবার মধ্যে উত্তেজনা।

এ পাড়ার ছেলে মন্ত্রী হওয়ার পর সবার খুব একটা আশা জেগেছে যে এবার বোধহয় দরিদ্র এই স্কুল এমপিও ভুক্ত হবে। তার না হয় আর কিছু পাওয়ার নেই-- কিন্তু এই স্কুলের শিক্ষকরা খুব আর্থিক কষ্টে আছে। তাছাড়া ছাত্ররা সারাবছর এখানে পড়ে যখন ম্যাট্রিকের সার্টিফিকেটটা অন্য স্কুল থেকে আনে ওদেরও মনটা ছোট হয়ে যায়।

মন্ত্রীর গাড়ি বহর মাঠের ভেতর থেমে পড়লো। সুনীল কুমার আনন্দ-আগ্রহ রাখতে না পেরে উঠে দাঁড়ালেন। পা ফেলে ফেলে এগিয়ে গেলেন ভিড়ের দিকে। তবে কাছে যাওয়া দূরের কথা । এত ভিড় দেখাই যায়না ভালো করে। তবুও এর ওর শরীরের পাশ দিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন তার ছাত্রকে। মন্ত্রী তার প্রশাসনিক দল সমেত শিক্ষক রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন। এদিকে মাঠে চেয়ার পাতা শুরু হয়েছে। ভিড় কমলে সুনীলকুমার শিক্ষক শ্রেণীর দিকে পা বাড়ালেন। নিরাপত্তা রক্ষী এসে আটকে মৃদু আপত্তি করলো। দু’এক কথার মাঝখানেই সেই সিদ্দিক স্যার উপস্থিত।

- স্যারের সঙ্গে দেখা করবেন?

- ওতো আমার ছাত্র ছিল।

- জি স্যার জানি। কিন্তু একটু অপেক্ষা করুন। মন্ত্রী সাহেব মাত্রই এলেন নিশ্চয়ই দেখা হবে।

- সিদ্দিক বাবু, ওকে একটু বলবেন তোমার মাস্টার মশাই আছে এখানে।

- অবশ্যই বলবো স্যার, আপনি আমাদের লাইব্রেরি রুমে বিশ্রাম নিন। কিছুক্ষণের মধ্যেই মন্ত্রী মঞ্চে উঠে সবার উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিবেন।

- আপনি বলেন, আমি আসছি। একটু দেখি ছেলেটাকে, গরুর পিঠে চরে স্কুলে আসা আমার মুসা এখন কত বড় মানুষ!

- মন্ত্রী আসলে হেড মাস্টার আর ডিসি সাহেবের সঙ্গে স্কুল নিয়ে কথা বলছেন। উনি নাকি এখান থেকেই ঢাকা ফিরে যাবেন। আচ্ছা, দাঁড়ান দেখি।



এরই মধ্যে হেডমাস্টারের কণ্ঠ শোনা গেল, আমাদের দিক থেকে কোন আপত্তি নেই, আপনার উপরই নির্ভর করছে সবকিছু। মন্ত্রী ঘরের ভেতর অনুষ্ঠান শুরুর নির্দেশ দিলেন। প্রধান শিক্ষক বেরিয়ে গেলেন আয়োজনের তাড়া দিতে। সিদ্দিক স্যার সুনীলকুমারকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকলেন রুমে। সুনীলকুমার এবার প্রায় ২০ বছর পর মুসাকে দেখ্লেন। এই সেই ছেলে নিজের চোখকে বিশ্বাস হয়না। ডাঙ্গুলি খেলতো অংক ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে। এখন মাঝ বয়সি হয়ে গেছে। তার ঝাপসা চোখ আরো কেমন আনন্দে ঝাঁপসা হয়ে আসতে চায়। এগিয়ে গেলেন কাছে।

মুসা তাকে দেখেই চিনেছে। চেয়ার থেকে উঠতে গিয়েও উঠে দাঁড়ায়নি। তবে খুব আন্তরিক সুরেই বললো, মাস্টার বাবু না? আছেন কেমন?

সুনীল কুমারের ভেতরটা আনন্দে ভেসে যাচ্ছে। মুসা তাকে চিনেছে! কিন্তু মুসাকে তুমি বলবে না মন্ত্রীকে আপনি বলা উচিত বুঝে উঠতে পারছে না। এর মধ্যে হেডমাস্টার এলেন মন্ত্রীকে মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সবাই তার জন্য অপেক্ষা করছে। সুনীলকুমারকেও তিনি সঙ্গে যেতে বললেন।

কাঠের মঞ্চের উপর সাদা ফরাস পাতা। লম্বা টেবিলের ওপাশে কয়েকটি চেয়ার। মাঝেরটা রাজকীয় ওটা প্রধান অতিথির। সুনীলকুমারের জন্য কোনো চেয়ার বরাদ্দ ছিলনা। তবুও তাকে এনে বসানো হয়েছে বলে গর্ব হচ্ছে। অনুষ্ঠান কর্মসূচি তালিকায় প্রথমে সুরা ফাতেহা ও গীতা পাঠ এবং জাতীয় সংগীত। দু’জনের পর প্রধান অতিথির ভাষণ। তিনি জানেন দাওয়াত পত্রে তার নাম নেই। কিন্তু মঞ্চে এনে যেহেতু বসানো হয়েছে, নিশ্চয়ই এরা কিছু না বলিয়ে ছাড়বেনা তাকে। সুনীল কুমার মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছেন কি বলবেন। এতদিন পর ছাত্রদের উদ্দেশ্যে কথা বলবেন তিনি। আজ যদি তার উপস্থিতিতে স্কুলটার এমপিও ভুক্ত করার ঘোষণা আসে তিনি সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন। শরীরটা এখন ভালো লাগছে।

অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। মঞ্চে বসে বসে সামনের ছাত্রদের মুখ দেখতে দেখতে বারবার পুরনো দিনের কথা মনে হচ্ছে সুনীল কুমারের। কত ছাত্র এই স্কুল থেকে পাশ করেছে? কত হাজার ছাত্র তাকে মাস্টার বাবু ডাকে? বক্তৃতায় হাত তালি পড়ছে। সভাপতির ভাষণের পর এবার মন্ত্রী বক্তৃতা দিবেন। অনুষ্ঠান নাকি সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। মন্ত্রী কয়েকটি কথা বলেই মঞ্চ ত্যাগ করবেন। সবাই প্রত্যাশার চোখ নিয়ে চেয়ে আছে।

মাইকে দাঁড়িয়ে যথারীতি আঞ্চলিক টানেই কথা শুরু করলেন মন্ত্রী। শিক্ষা ব্যবস্থা ও সকল স্কুলের উন্নয়নে তার সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে বলতেই হাত তালি পড়লো একবার। অনেকদিন আগে এখানকার মানুষজন বৈরাগীপাড়া স্কুলটি চালু করেছিল। তাদের সাহায্য সহযোগিতায় এতদিন চলে আসছে। কেউ সরকারী এমপিওভুক্ত করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। নিলেও কাজ হয়নি। আজ তিনি মন্ত্রী হয়েছেন। এই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে স্কুলটিকে এমপিওভুক্ত করার সব ধরনের চেষ্টা নেয়া হচ্ছে। মন্ত্রী বললেন, আশা করছি অচিরেই তা হয়ে যাবে। মন্ত্রীর এই আশ্বাসের পর হাত তালির বন্যা বয়ে গেল। সুনীলকুমারও আনন্দে চশমার ভেতর হাত দিয়ে চোখের কোনা মুছলেন।

মন্ত্রীর বক্তৃতা শেষ হয়নি। তিনি বললেন, ‘একটি কথা আছে। এ পাড়ার নাম এখন মুন্সী পাড়া। মুসলমান অধ্যুষিত একটি স্কুলের নাম বৈরাগী বিদ্যালয় ঠিক সামঞ্জস্য নয়’। সুনীলকুমারের মনে হল মন্ত্রীর এই কথায় মৃদু গুঞ্জন কি উঠলো, নাকি তিনি ভুল শুনছেন? মন্ত্রী বলছেন, ‘আমি স্কুলের নাম পরিবর্তন করে মুন্সী পাড়া উচ্চ বিদ্যালয় প্রস্তাব করছি’। সুনীল কুমারের নি:শ্বাস আটকে আসছে। কিছুতেই দম নিতে পারছেননা। কাউকে ডাকতে চাইছেন কিন্তু মাইকের শব্দে তার ফিসফিসে কণ্ঠস্বর নিজের কানেই পৌঁছায়না। গা ঘামছে তার...

মন্ত্রী বলে যাচ্ছেন, ‘আমি এখানে পড়েছি.’..সুনীল কুমারের চোখে স্কুলের পেছনের সেই ধান ক্ষেত তার ভেতর মাথা উঁচিয়ে থাকা সবুজ ধান সরে সরে যাচ্ছে...’স্কুলের ছাত্রদের জন্য ল্যাবেরটরি আর শিক্ষকদের যাতায়াতে একটি মাইক্রোবাসের ব্যবস্থা করবো’...মুসা গরুর পিঠে আসছে পেছনে একপাল গরুর ভেতর হামাগুড়ি দিয়ে আসছে সুনীল কুমার...’তবে এমপিওভুক্তির জন্য নামের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্কুলের ছেলেরা যাতে ধর্ম শিক্ষা পেয়ে সঠিক পথে চলতে পারে তাই একটি স্কুল মসজিদ স্থাপনের আকাংখা রাখি’...সুনীলকুমারের মনে হচ্ছে শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন বিষণ্ন বিকেলে স্কুলের মাঠে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন...মন্ত্রীর বক্তব্য প্রায় শেষের দিকে, ‘মসজিদসহ একটি স্কুলের নাম কি বৈরাগী হয়! তা ছাড়া এটা যখন এমপিও ভুক্ত হবে’...সুনীল কুমারের ঠাণ্ডা লাগছে। চারপাশে এত নি:শব্দ হলো কি করে হঠাৎ? মনে হচ্ছে বৈরাগী স্কুলের মাঠের ঘাসে পা ডুবে যাচ্ছে। সুনীলকুমার রাহুতের মনে হলো হঠাৎ দুখন্ড হয়ে গেছে স্কুলের মাঠ, পেতলের গোল ঘণ্টা। এমনকি নারকেল গাছটা। এমনকি ক্লাশ রুমের ব্ল্যাক বোর্ডটাও দু’ভাগ হয়ে গেল।

মন্ত্রী চলে গেল। সুনীলকুমার পুরনো টিনের ঘরটির দিকে এগিয়ে আরেকবার খুঁটির গায়ে সনাতন বৈরাগীর নামটি খুঁজতে চেষ্টা করলেন, খুঁজে পাচ্ছেন না।




লেখক পরিচিতি
সাদিয়া মাহজাবীন ইমাম

ফরিদপুর জেলার দয়ারামপুর গ্রামে।
পড়াশুনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও গণমাধ্যম নিয়ে গবেষণা করছেন।
২০০৬ থেকে সাংবাদিকতা করছেন।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : পা।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ

  1. এক নি:শ্বাসে আপনার গল্প পড়ে গেলাম। সাবলীল ভাষা। সুক্ষ্ম দৃষ্টি। অন্তর্ভেদী ঘটনা প্রবাহ। ভালো লেগেছে।

    উত্তরমুছুন