সৈকত আরেফিনের গল্প : রিহানা

একটা ঘোর তৈরি হয়েছে। যেন অনির্বচনীয় এক শূন্যতায় উড়ছি। ঘোরগ্রস্ত ঔদাসীন্যে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠছি, খাচ্ছি, টয়লেটে যাচ্ছি, অফিস করছি, ফিরে আবার ঘুমাচ্ছি। আর মনে হচ্ছে, যেন কিছুই করছি না। সকালে নিয়ম করে ফোন দিই রিহানাকে। ফোন বাজে, কখনো কখনো ওয়েলকাম টিউনে গান শোনা যায়--’ভালবেসে সখি নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখ’--ধরে না। কদিন হল, ও আমার ফোন ধরছে না। তার সঙ্গে কথা না হবার বিচ্ছিন্নতায় এই বিপন্ন হয়ে আছি। যাদুঘোরহ্বিলতায় হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি কুদ্দুসের পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকানে। প্রতিদিন তিন প্যাকেট করে বেনসন এন্ড হেজেস নিয়ে ফিরে বারান্দার চেয়ারে কাত হয়ে শুয়ে সারাক্ষণ ধোঁয়ার রিং তৈরি করছি। দুদিনেই ছাই হয়ে যাচ্ছে তরতাজা ৬০টি সিগারেট। আগুন দিয়ে সিগারেট পুড়িয়ে কী চাইছি আমি! সত্যিই কিছু কি চাইছি? সিগারেটের আগুনে কি যন্ত্রণা পোড়ে?


অথচ এভাবে যন্ত্রণাদগ্ধ হবার কথা নয় আমার! আমি কি এমন পাগল! ব্যথাতুর? এমন গভীর আবেগে ঘোরগ্রস্ত শূন্যতায় আমি মগ্ন হতে পারি! তারচেয়ে সেই ভাল আমার, ছেলে, মেয়ে বউ নিয়ে সুখের সংসার। ব্যতিক্রম কিছু তো কখনো ভাল লাগে নি! তেমন স্বপ্নও দেখি নি কখনো। ভাল স্বপ্ন, উজ্জ্বল আগামী কালের স্বপ্ন। খুব সাধারণ হয়ে, ডোবা পুকুরের জলে ডুব-সাঁতার খেলতে খেলতে বড় হয়েছি আমি। মাঠে-জঙ্গলে বিকিরিত রোদের পৃষ্ঠপোষকতায় শরীর তামাটে করে আত্রাইয়ের পাড়-ঘেঁষা ধুলোময় পথ ধরে স্কুলে গেছি। চারদিক খোলা, বেড়াহীন ভাঙা স্কুলে বর্ণমালা শিখে সেই মেঠোপথের ধুলো গায়ে মেখে বাড়ি ফিরে এসেছি। হারিকেনের নিবু নিবু আলোয় সুর করে পড়া মুখস্ত করতে গিয়ে বড়জোর পাখি হতে চেয়েছি। ‘আমি হব সকালবেলার পাখি/সবার আগে কুসুমবাগে উঠব আমি ডাকি।’ দমকা হাওয়ায়, ঝড়ে কখনো হারিকেন নিবে চারদিক অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। তখন জোনাকপোকা ধরে আলোময় বোতল তৈরি করেছি। জোনাকির আলোর বোতল হাতে নিয়েও জানতাম এই আলো মূলত মরীচিকা। এই আলোয় কখনো আমার মুখ চেনা যাবে না। স্কুলে কখনো ফার্স্ট হতে হবে ভাবি নি—সেকেন্ড হবার কথাও কখনো ভাবি নি। আমি স্কুলে গিয়ে সবার সঙ্গে বসেছি, দৌড়েছি, গোল্লাছুট খেলেছি, অন্য ছেলেরা, মেয়েরা আমার সঙ্গে কথা বলেছে, বন্ধুত্ব করেছে—এতেই আমি বর্তে গেছি। যেটুকু পড়েছি, আমার মত করে। পরীক্ষা এলে পরীক্ষা দিয়েছি। একদিন রেজাল্ট হয়েছে। রেজাল্ট নিয়ে একটুও ভাবি নি, অন্যরা যেমন ভেবেছে, ভেবে ভেবে উদ্বিগ্ন হয়েছে। রেজাল্টের কথা ভেবে আমি আমার আনন্দকে মাটি করি নি।

হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে ক্লাসেও আর মনোযোগ ছিল না আমার। স্যারদের কথা তেমন ভাল লাগত না। মনে হত, স্যারেরা অন্যদের জন্য বলছে, আমার জন্য না। সেই সময়, আমার বিহ্বলকালে ক্লাস এইট থেকে নাইনে উঠতে, যে ছেলেটি প্রতিবছর ফার্স্ট হয়, সেবার কোনো কারণে সে হয়তো পরীক্ষা ভাল দিতে পারে নি; আর যে ছেলেটি সেকেন্ড হত সে-ও আরও খারাপ করে থার্ড হয়ে গেছে। আমার রেজাল্ট নিয়ে বরাবরের মতোই কোন আগ্রহ ছিল না।

এরমধ্যে পয়লা বৈশাখের ছুটি। সেলন্দার জয়দেব পড়ত আমাদের সাথে। আমি জয়দেবের সাথে বাঘাবাড়ি সোহাগ সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে গিয়েছি। নববর্ষের প্রথমদিনে সিনেমা হলে খুব ভিড়; আমরা সকালের শো-তে টিকেট কাটতে পারি নি। বিকেলের শো সিনেমা দেখে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। সেলন্দা বাজারে এসে আমি আর জয়দেব মাধবকাকার মিষ্টি বিপণিতে দুটো করে রসগোল্লা খেলাম। নববর্ষে খরচের জন্য সারাবছর ধরে জমানো টাকা তখনও আমাদের পকেটে অবশিষ্ট ছিল। তাই টাকাপয়সা নিয়ে কোন চিন্তা ছিল না। বাবু ভাইয়ের চা-দোকানে দুজন মিলে দু-কাপ লাল চা খেয়ে যখন বিদায় নিচ্ছি তখন চারদিকে বেশ অন্ধকার নেমেছে। অন্ধকারের মধ্যে রাস্তায় একটা রিকশাও নেই। পয়লা বৈশাখ বলে অবশ্য রাস্তায় তখনও হাঁটা মানুষ আছে। ডেমরা স্কুলের কাছে এসে যখন পাথাইলহাটের রাস্তাটা ধরেছি বড় মসজিদটার কাছে কয়েকজন আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। খুব মারল আমাকে। কিল, ঘুষি, চড় থাপ্পর যে যা পারল। আমি একটুও কাঁদলাম না। চিৎকার করলাম না। শুধু ওদের জিজ্ঞেস করলাম, কেন মারছ আমাকে? কী করেছি আমি? তখন তাদের মধ্যে একটি ছেলে রাগে-দুঃখে-অপমানে আমার গালে দুটো থাপ্পড় দিয়ে বলল, শালা তোকে ফার্স্ট হতি কিডা কইছে? শালা তুমি ভাল ছাত্তর হইছ? ভাল ছাত্তর হওয়া তোমার বার করতেছি!

সেই কবে পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে! কবে আমি ফার্স্ট হয়েছি! হঠাৎ ফার্স্ট হয়ে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। আনন্দও হয়েছিল একটু। কিন্তু উচ্ছ্বসিত হই নি। কাউকে ঘাড় ফুলিয়ে বলি নি--দ্যাখ আমি ফার্স্টবয়। একদিনও বলি নি, একবারও নয়। তবুও এতদিন পরে আমাকে ফার্স্ট হবার জন্য মার খেতে হল!

সেই ছেলেটি রবিউল ইসলাম। প্রাইমারি স্কুলেও ও-ই ফার্স্ট হত। এবার সে সেকেন্ড হয়ে গেছে। তখন অপমানাহত রবিউলের কথা শুনে আমার খুব মায়া হয়েছিল। বাড়ি ফিরে কাউকে কিছু বলি নি। ফিরতে রাত হবার জন্য মা বকেছিল। জয়দেবদের বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছি বলে সে রাতে কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়েছিলাম। ঘুম আসছিল না। আমি রবিউলের বেদনা বুঝতে চাইছিলাম। যারা একবার ফার্স্ট হয়, তারা বারবার ফার্স্ট হতে চায়। সেজন্যে আমার উপর রবিউলের রাগ হয়েছিল। আমি আর কখনো ফার্স্ট হতে চাই নি। এরপর পরীক্ষার খাতায় জানা প্রশ্নগুলোও আমি এড়িয়ে যেতাম। অঙ্কের খাতায় এঁকে দিয়ে আসতাম নদীতে জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য। এমনভাবে লিখতাম যেন কেউ ভুল করেও আমাকে কখনো ফার্স্ট করতে না পারে।

এমন গাড্ডায় আমি বার বার পড়েছি। এখন রিহানা আমাকে আবারও গাড্ডায় ফেলেছে। দুদিনেই তিন প্যাকেট বেনসন এন্ড হেজেস ফুরিয়ে যাচ্ছে। বেদনা ফুরোচ্ছে না। কিন্তু আমার কেন বেদনা হচ্ছে, আমি কেন বেদনার উপলকল্লোলে ডুবতে ডুবতে শূন্যতায় উড়ছি সেটাও আমাকে বিহ্বল করে ভাসিয়ে রাখছে।

রিহানার সঙ্গে আমার পরিচয় ফোনে, মুঠোফোনে। ওর নম্বরটা দিয়েছিল আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোটভাই লিঙ্কন। পড়াশুনা শেষ করে যখন চট্টগ্রাম ছাড়ছি, লিঙ্কন নম্বরটা দিয়ে বলেছিল—এই নম্বরটা রাখেন, আমার খালাত বোনের নম্বর। দুলাভাই বড় ব্যবসায়ী। ঢাকায় গেলে যাইয়েন আমার বোনের কাছে। সেই থেকে নম্বরটা ছিল আমার কাছে। ছিল মাত্রই। চট্টগ্রাম থেকে এসে অনেকদিন ঢাকায় ছিলাম। তখন এখানে ওখানে চাকরির খোঁজে ছুটছি। তবু লিঙ্কনের বড়লোক দুলাভাইয়ের অনুকম্পা পাবার জন্য কখনো খালাত বোনের নম্বরে ফোন দিই নি। দেবার প্রয়োজন পড়ে নি। এরমধ্যে ক্যাডার সার্ভিসে চাকরি হয়ে গেল। পোস্টিং হল গণ্ডগ্রামে। যমুনা নদীর ভাঙনপ্রবণ কাজিপুরে কাটিয়ে দিলাম চারটি বছর। দেখতে দেখতে সময় পার হয়ে গেল। বিয়ে করি নি তখনও। অনেকের সঙ্গে ফোনে কথা বলতাম। অনেক মেয়েদের সঙ্গে। একজনের সঙ্গেও কখনো দেখা হয় নি এমনসব মেয়েদের সঙ্গেও কথা হত। নান্নু বলে একটা ছেলে ছিল সরকারি কলেজটার পাশেই। ফোনের দোকান চালাত সে। নান্নুর ফোন-দোকানে মাস শেষে হাজার হাজার টাকা শোধ করতে হত। অচেনা মেয়েদের সঙ্গে রাত জেগে কথা বলার মধ্যে কী আনন্দ তখন ছিল! কিন্তু তখনও রিহানার কথা একবারও মনে পড়ে নি। রিহানার নম্বরটা আমার হ্যান্ডসেটের ফোনবুকে খুব নীরবে গোপন হয়ে ছিল।

এরমধ্যে মা তাগাদা দিচ্ছিল বিয়ে করে ফেলতে। বেকার তো আর নই! ছোট ভাইটাও বিয়ে করার জন্য বলছে। না হলে ওর বিয়ে পিছিয়ে যাবে। আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে হল। চাটমোহরে একটা মেয়েকে দেখতে গিয়ে মায়ের খুব মেয়ে পছন্দ হয়ে গেল। মেয়ে শিক্ষিত, মা-বাবা বড়লোক। মায়েদের পছন্দ হতে আর কী লাগে! আমি দ্বিধা-বিহ্বলভাবে সম্মতি জানালাম। ওইদিনই শীলা আমার বউ হল। আমার বউ! একধরনের আনন্দ, ভয় আর শিহরণের মধ্যে রাত এল। বাসরঘরে আদর করতে যেয়ে শীলা আমার ঠোঁট কামড়ে রক্ত বের করে দিল। আমি চারদিন বাদে ঠোঁটে কামড়ের দাগ নিয়ে কাজিপুরে হাজির হলাম। যে আমি ফিরলাম, সে আমি আলাদা। তখন অন্য মেয়েরা আমার ফোন তালিকা থেকে হারিয়ে গেল। রাতভর কথা বলতাম শীলার সাথে। টান বাড়ছিল। প্রায়ই ছুটি নিয়ে শীলার কাছে ছুটে যেতাম।

কিন্তু শীলা আমার থাকে নি। শীলার কোন দোষ নেই। আমারও না। ভাগ্যের দোষ হয়তো। সম্পর্কের মধ্যে যখন টাকা একটা অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়ায় তখন ভালবাসা হারিয়ে যায়। শীলার বড়লোক বাবা-ভাইয়েরা আমার মত দুপয়সার সরকারি চাকুরের সাথে মেয়ে-বোন বিয়ে দিয়ে হয়তো ভুল করেছিল। ভুল শোধরাতে ওরা আমার কাছ থেকে শীলাকে ছাড়িয়ে নেয়। ও প্রেগনেন্ট ছিল। আমাকে বলেছিল--আমি কিন্তু মেয়ে চাই। ওকে বলেছিলাম, তোমার চাওয়াই আমার চাওয়া। ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পর জেনেছি, পাবনা শহরের একটা ক্লিনিকে অ্যাবরশনের দিন শীলা কোনমতে বেঁচে গেছে। বেঁচে থাক শীলা। ভাল থাক। যেখানেই থাকুক।

এর কিছুদিনের মধ্যে শীলার বড় ব্যবসায়ীর সঙ্গে শীলার বিয়ে হয়ে যায়। পারিবারিক ও সামাজিক কারণে নিতান্ত বাধ্য হয়ে আমাকেও আর একবার বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হল। শারমিনের সঙ্গে বিয়ের দিন মনে হয়েছিল—বংশদোষ এড়ানো এত সহজ নয়! আমাদের পরিবারে বাবা একজনমাত্র মানুষ যিনি, একটিমাত্র বিয়েতে জীবন কাটিয়ে চলে গেছেন। দাদা, কাকাদের সবাইকে একাধিক নারীর স্বামী হতে হয়েছিল। তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমার দ্বিতীয় বিয়ে আটকানো যায় নি।

শারমিনের সঙ্গে আমার কোন সমস্যা নেই। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে নির্দ্বিধায় আমি বলতে পারি--ভালবাসি। শারমিনের গর্ভে জন্ম নিয়েছে আমার দুটো বাচ্চা। বাচ্চারা আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে। আমি বুঝেছি, পিতৃত্ব কেমন! বুকের ভেতর হাহাকার করা তুমূল অনুভুতি নিয়ে আমার বাচ্চাদের দিকে আমি তাকাই। আমার ভাল লাগে।

কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল! কলেজ থেকে ফিরতে ফিরতে সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে গেলাম। আমি জানতাম শারমিন বাসায় নেই। বাচ্চাদের নিয়ে বাইরে গেছে। ঘুরতে। আমারও যাবার কথা ছিল। প্রিন্সিপাল ফোন করায় আমি কলেজে আটকে পড়েছিলাম। ফিরে স্নান করে খেয়ে শুয়ে এটা ওটা ভাবছিলাম। হাতে কোন কাজ ছিল না। বৃষ্টির পর প্রকৃতিতে কী একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল সেই বিকেলটায়। হ্যান্ডসেটটা হাতে নিয়ে মনে হল--কাউকে ফোন দেওয়া যায়। তখন এতদিন আমার ফোনবুকে নীরবে গোপন হয়ে থাকা রিহানা আমার কল রিসিভ করে বলল--’হ্যাঁ বলুন।’

রিহানার সঙ্গে আমার নতুন জীবন শুরু হল। এরকম হবার কথা ছিল না। ব্যতিক্রম আমি পছন্দ করি না। অথচ বার বার আমাকে এই গাড্ডায় পড়তে হয়। আমার মাথার মধ্যে রিহানার জন্য একটা জায়গা ফাঁকা হয়ে গেল। বুকের মধ্যেও। শারমিন বুঝতে পারছিল আমার কিছু একটা হয়েছে। বাচ্চারাও। মেয়েটা সেদিন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল--বাবা তোমার কি অসুখ করেছে? আমার আসলে অসুখ করেছে। রিহানা-অসুখ।

রিহানাকে আমি প্যাট বলে ডাকি। ও আমাকে বুদ্ধু বলে। বলে, বুদ্ধু তুমি জানো না, কী জীবন আমি যাপন করি! রিহানা দিনে দিনে অনেক কথাই বলে আমাকে। খুব ছোট বয়সে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল তার। ভালবাসার বিয়ে। যখন সে একটু বড় হলো, পূর্ণতা পেল তার নারীত্ব, ভাল করে বুঝতে শিখল চারপাশ, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ততদিনে তার স্বামী আব্দুর রশীদ অনেক দূরে সরে গেছে। চিৎকার চেঁচামেচি এ নিয়ে কম হত না। স্বামীকে তার দিকে ফেরাতে চেয়েছিল সে। পারে নি। ততদিনে বিছানা আলাদা হয়ে গেছে। রিহানা জেনে গেছে স্বামীর অন্য মেয়েসঙ্গর সব কথা। আব্দুর রশীদ অবশ্য তার মেয়েসঙ্গ নিয়ে কোন রাগঢাক রাখে নি।

স্বামী-স্ত্রীর এই ফোঁকরটা দূর থেকে দেখছিল আরেকজন। নিয়ামূল বাশার। দাড়ি-টুপি পরা লোক। বয়সে রিহানার অনেক বড়। শুধু বয়সে নয় চাতুরিতেও অনেক বড় ছিল সে। নিয়ামূল বাশার ছায়ার মত লেগে ছিল রিহানার সাথে। রিহানাও তার মধ্যে একটা আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিল। বিশ্বাস করেছিল। জলে ডুবে যেন আঁকড়ে ধরার মতো এক টুকরো কাঠের সন্ধান পেয়েছিল রিহানা। আস্থা ও শ্রদ্ধার সম্পর্ককে সুযোগ হিসেবে নিয়েছিল নিয়ামুল বাশার। ধর্মবুদ্ধি দিয়ে রিহানাকে বশ করে একটা ঘোরের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল তাকে। একসময় রাত জেগে নামাজ পড়াও অভ্যাস করে ফেলেছিল রিহানা। তখন নিয়ামূল বাশার রাতের বেলা রিহানার ঘরে আসতে শুরু করল। বিভ্রান্ত রিহানাকে সে এটাও বুঝাতে পেরেছিল, সে-ই তার আসল স্বামী। ফলে শারীরিক সম্পর্কেও কোন বাধা ছিল না। রিহানা রাতে নামাজ পড়তে পড়তে বাশারের অপেক্ষা করত। এই অদ্ভুত সম্পর্কের মধ্যে যখন রিহানা জড়িয়ে আছে তখন খালি বাড়িতে বৃষ্টিশেষের বিকেলে আমার হ্যান্ডসেটের ফোনবুকে নীরবে গোপন হয়ে থাকা নম্বরে কল করলে রিনরিনে গলায় রিহানা বলেছিল--’হ্যাঁ বলুন।

একদিন রিহানাকে বললাম--চল বিয়ে করে ফেলি। আমি যে এমনি এমনি বললাম এমন নয়। রিহানাও বুঝল। বলল--তোমারও তো বউ বাচ্চা আছে। ওদের কী হবে? তখন আমি ঘোরের মধ্যে রিহানার জন্য পাগল। বললাম, সব ছেড়েছুঁড়ে চল দুজন কোথাও চলে যাই। রিহানা হাসল। পাগল হয়েছ। ঠিক আছে, যাও তোমার সঙ্গে আর কথা বলব না। আমার জন্য তোমার সংসারে কোন অশান্তি হোক আমি চাই না। তাছাড়া নিজের সুখের জন্য আমি কিছু করব না। রিহানা ফোন রেখে দিল।

সেই থেকে একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছে দিন। কিছুতে এই ঘোর কাটছে না। এই যে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠছি, খাচ্ছি, বাইরে যাচ্ছি, অফিস থেকে ফিরে আবার ঘুমাচ্ছি। কিন্তু কিছুই করছি না অনুভূতি হচ্ছে। রিহানা আর আমার ফোন ধরছে না বা কেটে দিচ্ছে। আমার কেবল মনে হচ্ছে আমি হেরে যাচ্ছি। কোথাকার কে নিয়ামূল বাশার আমাকে বেমালুম হারিয়ে দিচ্ছে। এভাবে হেরে যাব আমি? রিহানা একদিন আমার বুকে মাথা রেখে বলবে না--আমি ভুলে গেছি আগের সব। আমার স্বামী, সংসার, নিয়ামুল বাশার সব ভুলে গেছি আমি। এবার তোমাকে পেয়েছি! তুমি যা বলবে তাই হবে।

আসলে আমি রিহানাকেই জিতিয়ে দিতে চাই। সে জানুক, যে মোহে সে আছে সেটা নিছকই মোহ। কিন্তু আমি জানতাম না ওকে নিয়ে পালাতে চাইলে কী প্রতিক্রিয়া সে দেখাবে! ওর পাঠানো এসএমএস শারমিন দেখে ফেলেছে জানলে ও আমাকে অসাবধানী বলে বকবে কি না! অথচ তখন রিহানা আমার ফোন রিসিভ করা বন্ধ করে দিল। আমি একটা ঘোর-গহ্বরে নিপতিত হলাম। তখনই বুঝতে পারলাম বেনসন এন্ড হেজেস খুব পাতলা সিগারেট। এখন আমাকে ব্র্যান্ড পাল্টাতে হবে। যে আমি কোনদিন ফার্স্ট হতে চাই নি, এ কেমন হল আমার! ‘পৃথিবীতে কে কাহার’ বলে যে আমি সামনে দিয়ে সবকিছু অনায়াসে চলে যেতে দিয়েছি, সেই আমাকে রিহানা বদলে দিল। নিয়ামুল বাশারকে আমি কিছুতেই ছাড়ব না।




লেখক পরিচিতি
সৈকত আরেফিন

জন্ম : ২৮ ফেব্রুয়ারী ১৯৮০, পাবনা।
পেশায় সাহিত্যের শিক্ষক।
গল্পকার।
কোনো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। একটি গল্পগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেছেন। নাম---পাতা ও পতত্রি।







একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. golpoti porlam. golpokarer godyobhasa osadharon. kintu eidhoroner negetive jiboner golpo kno golpopath prokash korbe? golpokar tar bhasashokti diye aro bhalo kaj korte parben.

    উত্তরমুছুন