জাকির তালুকদার
দলটা ডোমারে এসে শুনল সামনের তিন দিন হরতাল।
তারা দুইভাগ হয়েছিল ডোমারে এসেই। কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছিল না
ভাগ হবার। যেমন তাদের দলবদ্ধ হবার জন্যও কোনো আনুষ্ঠানিকতার
প্রয়োজন পড়েনি। দুই-চারজনের ছোট ছোট দল পথের বিভিনড়ব পর্যায়ে
একত্রিত হতে হতে আপনা-আপনিই বড় হয়ে যায়।
একে অপরকে চিনেও
নেয় সহজে। তীর্থযাত্রীরা কিংবা ওরসে যারা যায়, তাদের যেমন চিহ্ন থাকে,
সেইরকম এদেরও চিহ্ন সর্বাঙ্গে। এদেরটা আরো প্রকট। কেননা এদের সবার
সামান প্রায় একই। কাঁথা একখানা ভাঁজ করতে করতে যতদূর ছোট করা
যায়, তার সঙ্গে লুঙ্গি-গেঞ্জি মিলে একটা বান্ডিল। জামা কিংবা ফতুয়া
সাধারণত একটাই। সেটা তাদের পরনে থাকে। আর থাকে একটা চটের
ব্যাগ। ব্যাগ ঝোলানোর ফাঁসের পাশ দিয়ে উঁকি মারে পাটের মোটা
ফেঁসোতে মোড়া কাস্তের ডগা। কারো একটা, কারো একাধিক।
এই রকম সময়ে, প্রতি বছর যখন ধানকাটার মরশুম আসে, আকাশ
থাকে কখনো রাগী, কখনো সজল, কখনো রোদ থাকে পিটের চামড়ায়
ফোসকা তোলার মতো যথেষ্ট উষ্ণ, বাতাসে থাকে ঝাঁওয়াল, ওরা গ্রাম ছেড়ে
দলে দলে বেরিয়ে পড়ে। তাদের গ্রামগুলো তখন পুরুষশূন্য। পনেরো থেকে
পঞ্চাশ বছরের কেউই পুরো একমাস গাঁয়ে থাকে না। থাকে শুধু দুই-তিন ঘর
বড়মানুষেরা। আর তাদের বাঁধা মুনিষেরা। আর থাকে তাদের ফসল পাহারা
দেবার নিজস্ব ভাড়াটে মানুষেরা।
বাকি সবাই, যারা বেরিয়ে পড়ে গ্রাম ছেড়ে, তাদের হিসাব দিন কিংবা
মাসে নেই। তাদের সংকেত দেয় ধানের ছড়া। নিজেদের এলাকায় ধানের
ছড়া ফুটতে দেখলেই ওরা বেরিয়ে পড়ার জন্য তৈরি হয়। তাদের সবারই
মুখস্ত খনার সেই বচন-- “শীষ দেখে বিশ দিন। কাটতে মারতে দশদিন।”
ধানের শীষ দেখার সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে পড়ার তোড়জোড়। ধানকাটার কাজে
কত পুরুষ ধরে যে অন্য এলাকায় যাচ্ছে তারা, সে হিসাব কেউ রাখে না।
তাদের এলাকায় যতটুক ধানের জোত, সেই ধানকাটার মতো মুনিষ
জোতদারের নিজেরই আছে। বাকিদের কোনো কাজের সংস্থান এই এলাকায়
নেই। তাই তারা বেরিয়ে পড়ে দলে দলে। সমস্ত গ্রামকে পুরুষশূন্য করে।
এবারের দলটা ডোমারে এসে থমকে যায়। গাড়ি চলাচল বন্ধ। কী
কারণ? না, তিন দিনের হরতাল। হরতাল ওরা সবাই এখন বোঝে। তবে
নিজেদের এলাকায় হরতাল-টরতালে ওদের কিছু আসে-যায় না। অন্য দিনের
মতো একই চালে তাদের জীবন চলে হরতালের দিনেও। গ্রামগুলোতে তো
দূরের কথা-- জলঢাকা, চিলমারি, উলিপুর থানা সদরগুলোতেও হরতালে
অন্যরকম কিছু ঘটে বলে তাদের জানা নেই। তারা মিছিল বলতে বোঝে
ইউনিয়ন পরিষদের ভোটের মিছিল আর নৌকা-ধানের শীষ-লাঙলের ভোটের
মিছিল। তবে মিছিলের মতো মিছিল হয় চেয়ারম্যান-মেম্বার ভোটে।
একজনের মিছিলে যদি থাকে তিন হাজার মানুষ, দশটা ঘোড়া, এক শ ভ্যান,
আর তিন হাজার পতাকা-- তো আরেকজনের মিছিলে থাকে নিদেনপক্ষে
মাহুতসহ একটা ভাড়া করা হাতি, এক ডজন ঘোড়া, এক শ ভ্যান, পাঁচ
হাজার মানুষ। ঐ সময় মিছিলে যারা যায়, তাদের ঝুলও ওঠে খুব বেশি।
তারা সমানে নাচে আর গানের সুরে সুরে শ্লোগান দেয়-- ও শাবানা, নেই
ভাবনা, হ্যারিকেনে সিল মারো না!
দেখা যায় বাপ চাকা মার্কার মিছিলে, তো ছাতার মিছিলে ছেলে,
হ্যারিকেনের মিছিলে ভাতিজা। কাজেই মিছিল বলতে তাদের কাছে বোঝায়
ভোটের মিছিল। বড়ই আনন্দের জিনিস। কিন্তু ডোমারে এসে তারা দেখল
হরতালের মিছিল। পঁচিশ-তিরিশজন মোটে মানুষ। কিন্তু খুব যুদ্ধংদেহী।
প্রত্যেকের হাতে ডাং। এই এক মিছিলই বন্ধ করে রেখেছে পুরো বন্দর।
কোনো গাড়ি চলছে না কোনোদিকে।
তবু তারা পথ বেছে নিতে থাকে।
তাদের মধ্যে যারা ঠিক করে রেখেছিল ট্রেনে যাবে, তারা চলে গেল
স্টেশনের দিকে। অন্যরা বাসস্ট্যান্ডে। বাস কিংবা ট্রাক পেলে উঠে পড়বে।
তারা বাসস্ট্যান্ডে আর রেলস্টেশনে অপেক্ষা করে থাকে। শুনেছে, রাতে
গাড়ি চললেও চলতে পারে। রেলস্টেশনে যে দলটি গিয়ে ঢোকে, তাদের
মধ্যে ছিল আজগর আলি। অনেক বছর পরে আজগর আলি ধানকাটার কাজে
বেরিয়েছে। মাঝখানের বছর দশেক সে বের হয়নি গ্রাম থেকে। কেননা
ছেলেটা বড় হয়ে দায়িত্ব নিয়েছিল সংসারের। সে-ই যেত। গত বছর ছেলে
গিয়েছিল অনেক দূরে বেশি মজুরির আশায়। পদ্মা পার হয়ে কুষ্টিয়ার ধানের
অঞ্চলে। ফেরার পথে উঠেছিল বাসের ছাদে। বাড়ি ফিরতে পারেনি। বাস
উল্টে রাস্তার সাথে পিষ্ট হয়ে থেঁতলে মরেছে। লাশ বাড়িতে যায়নি। তার
মজুরির টাকাও না। কাঁথা কিংবা কাস্তেও না। তাদের গ্রামের আর যারা
গিয়েছিল এবং বেঁচে ফিরেছিল, তারা খবরটা পৌঁছে দিয়েছিল আজগর
আলির ভিটায়।
ছেলে বড় হবার পর মোটামুটি সুখের সময় গেছে আজগর আলির। খুব
অভাবের সংসারে সচরাচর যা ঘটে, ছেলে বড় হয়ে বিয়ে-থা করলে বাপমাে
ক কলা দেখিয়ে দেয়, তার ছেলে তেমনটি করেনি। নিজে যা খেয়েছেপে
রছে, বাপকেও তা-ই দিয়েছে। ছেলে বউ ঘরে আনার আগেই মারা
গিয়েছিল তার মা। কাজেই আজগর আলির কাজ বলতে ছিল লুডু খেলা। খুব
একটা মিশুক মানুষ সে নয়। লুডু খেলতে চারজন লাগে, নিদেনপক্ষে
দুইজন। কিন্তু বউ মরার পর আজগর আলি সবসময় একা-একাই লুডু
ভেলে। সাপলুডু খেললেও একা, গুটি ঘরে ওঠা খেললেও একা। নিজের,
আর কাল্পনিক প্রতিপক্ষ-- দুজনের চাল আজগর আলি একাই চালে। চাল
দেয় দুই পক্ষেরই খুব মনোযোগের সাথে। নিজের জন্য নিজের প্রতিপক্ষের
বিরুদ্ধে কখনো পক্ষপাতিত্ব করে না চাল দিতে গিয়ে। তার খেলার সময়
আবার বাঁধা। রাতের খাবারের পর সে নাতি-নাতনির সাথে একটু-আধটু
খুনসুটি-আদরের পর লুডু বিছিয়ে খেলতে বসে। কুপি-হ্যারিকেন চায় না।
অতএব তেল খরচের জন্য ছেলের বউয়ের মুখ ঝামটাও তাকে সইতে হয়
না। সে লুডু খেলে মোমবাতির আলোয়। মন্তাজের দোকান থেকে সে দুইদিন
পর পর একটা করে মোমবাতি কেনে। অর্ধেক কেটে দোকানে রেখে দেয়,
বাকি অর্ধেক নিয়ে লুডু খেলতে বসে। মোমবাতিও শেষ, তার লুডুখেলাও
শেষ। সটান শুয়ে পড়ে আজগর আলি। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘুম। পরের রাতে
বাকি অর্ধেক মোমবাতিতে লুডু খেলা।
তার এই বিচিত্র বিনোদন পদ্ধতিতে ছেলে বেঁচে থাকতে হাসত। মোমের
খরচের জন্য তার ছেলের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। কেননা, যৎসামান্য
হলেও আজগর আলির নিজস্ব ইনকাম ছিল। চারুদাসের তামাক গুদামে
তামাকপাতা সিজিল-মিছিলের কাজ করত আজগর আলি। নিজের পান-গুয়াবিড়ি,
নাতি-নাতনির ছোট-খাট হাউসের আব্দার মেটানো, আর লুডু খেলার
মোমবাতির খরচ দিব্যি চলে যেত সেই উপার্জন দিয়ে। ধানকাটার মরশুমে
বাপকে ঘরে রেখে নিশ্চিন্ত মনে বিভূঁয়ে চলে যেতে পারত ছেলে। নিশ্চিন্তে;
কেননা ঘর আর ঘরের মানুষকে দেখার জন্য মানুষ রইল। ওদের চিরদিনের
অভিজ্ঞতা, বিভূঁই থেকে ফিরে, সবাই ঘরে এসে ঘরকে হুবহু আগের মতো
পায় না। কেউ কেউ ফিরে এসে আর ঘর বলতে যা বোঝায়, তার কিছুই পায়
না। ভিটে থাকে, ঘরের খুঁটি-চালা-দরজা-জানালা থাকে, কিন্তু ঘর থাকে না।
কারণ ঘরের মানুষ নেই। প্রতি বছরই যখন এইসব গাঁয়ের পুরুষরা
ধানকাটার মরশুমে অনুপস্থিত থাকে, তখন বেশকিছু ঘরের বউ-মেয়ে অভাব
সইতে না পেরে, অনাহার সইতে না পেরে, অনিশ্চিতর সাথে পাল্লা দিতে না
পেরে চলে যায় অন্য কারো হাত ধরে। কেউ কেউ ভিন জেলার ফেরিঅলার
হাত ধরে অন্যত্র, কেউ চলে যায় জোতদারের মুনিষ-সর্দার বা তাদের হাতানাতার
দখলে। যদিও ব্যাপারটাকে তাদের দারিদ্র্য এবং মৃত্যুর মতোই
অনিবার্য হিসাবে মেনে নিয়েছে তারা, তবু নিজের ঘর সুরক্ষিত দেখতে চায়
সবাই। সে কারণে আজগর আলি বাড়িতে থাকলে তার ছেলেটা খুশি হতো।
নিশ্চিন্তে বিভূঁয়ে চলে যেতে পারত ধান কাটতে।
এবার ঘর ফাকা করে বেরুতে হলো আজগর আলিকে। তার বয়সে যখন
সে বেরুত, ছেলে থাকত ঘরে। তারপরে, ছেলে বেরুলে সে থাকত ঘরে।
কিন্তু এবার ঘর ফাঁকা রেখেই বেরুতে হচ্ছে। একটু চিন্তা যে হচ্ছে না, তা
নয়। মাঝে কিছুদিন খেয়াল করেছে, নাসির মুদিঅলা ঘুর ঘুর করছে। তার
মুদির দোকানের অবস্থা মোটামুটি রমরমা। তার উপরে লোক লাগিয়ে
ইন্ডিয়ার মাল এপার-ওপার করে। থানার সঙ্গে তার চুক্তি আছে। অর্থাৎ সে
এখন গ্রামে বড় মানুষ। নিজের ঘরে বউ আছে। বাচ্চাও। কিন্তু এই রকম
পয়সাঅলা লোকের জন্য একটামাত্র বউ, তাদের এলাকার হিসাবে বড্ড কম
হয়ে যায়। একদিন শুনতে পেয়েছে আজগর আলি, আশ্বাস দিচ্ছে নাসির তার
ছেলের বউকে-- অ্যালা অসুবিদা নাই বাহে, তুমার ছোল-মায়্যাক মুই টানিবার
পারিব। মোর ঘরের আরো তিনজনার সাথত এই দুইজনা যোগ দিলে ঘরোত
মোর জায়গা অ্যালাও সট পড়বি না বাহে! এই পর্যন্ত শুনেই সরে এসেছিল
আজগর আলি। নিজেকে প্রবোধ দিয়েছে, এরকম তাদের এখানে
হরহামেশাই ঘটে। প্রত্যেক মেয়েমানুষই একটা শক্ত আশ্রয় চায়। তার
ছেলের বউও চাইতে পারে।
বউ নাসিরকে কী উত্তর দিয়েছে তা শোনেনি আজগর আলি। তবে একটু
অবাক হয়েই খেয়াল করেছে, নাসির আর এদিকে ঘেঁষে না। তার বদলে
বউকে দেখা যায় এনজিও থেকে লোন এনে গরু কিনতে। মহা উৎসাহে
গরুকে ঘাস-খড় খাওয়ায়, সাত বছরের ছেলেটার হাতে গরুর গলার দড়ি
ধরিয়ে দিয়ে চরাতে পাঠায়। গোবর দিয়ে ঘুঁটে আর দৈলা বানায়। আজগর
আলির ঘরের চারপাশে গরুর চোনার ঝাঁঝালো গন্ধ, বেড়া জুড়ে ঘুঁটে আর
দৈলা রোদে শুকোতে দেওয়া, উঠোন জুড়ে ঘাস-বিচালির টুকরো।
পনেরো দিন অন্তর অন্তর সাইকেল টিং টিং করে এনজিও-র সায়েব
আসে। ঘুঁটে বেচা টাকায় আর কীভাবে যেন জোটানো টাকা বউ কিস্তির দায়-
দেনা তুলে দেয় এনজিও সায়েবের হাতে।
হঠাৎ কয়েকদিন আগে চারুদাসের গুদাম থেকে ফিরে আজগর আলি
দেখল বউমা বারান্দায় বসে ফোঁপাচ্ছে। উঠোনের যে কোণে গরুর জন্য চালা
তুলে গোয়াল বানিয়েছিল, সেটা শূন্য। গরু নিয়ে গেছে এনজিও সায়েব।
কেননা কিস্তি বাকি পড়েছে। তার কিছুদিন আগে পিছলে পড়ে ডান কনুইয়ের
ওপরের হাড় ভেঙে গেছে নাতির। কবরেজ বাঁশ চেঁছে প্লাস্টার করে
দিয়েছিল। খোলার পরে দেখা গেল হাত বেঁকে থাকে বেচারার। শক্ত কোনো
কাজ করতে পারে না হাত দিয়ে।
টাউনোত লিয়্যা ডাক্তার দেখাও বাহে!
উপদেশ অনেকেই দেয়। কিন্তু খরচ! এই গ্রামেরই একজনের হাত
ভাঙার পরে শহরের ডাক্তার দিয়ে প্লাস্টার করে এনে হাত ভালো হয়েছে।
খরচ, রাহা খরচ বাদেই ছয় শ টাকা। অর্থাৎ কমপক্ষে সাত-আট শ টাকা
হলে নাতিকে শহরে নিয়ে যাওয়া চলে। তার সঙ্গে যোগ হলো এনজিও-র
কিস্তি খেলাপ।
অতএব আজগর আলিকে এবার বেরুতে হয় মরচেপড়া কাস্তে শান
দিয়ে।
২.
তিলকপুর ট্রেন পৌঁছুল ভোরের আলো ফোটারও আগে। ট্রেন ছেড়েছিল রাত
এগারোটার পরে। সারাদিনের অনিশ্চিত অপেক্ষমান যাত্রীদের সঙ্গে রেগুলার
প্যাসেঞ্জার যারা এই ট্রেনের-- বিশেষত পেট বাঁচানোর জন্য বিশ কেজি চাল
কিংবা বিশ কেজি লবণ কিংবা পাঁচ কেজি জিরা কিংবা পাঁচখানা শাড়ি ইন্ডিয়া
থেকে হিলি বর্ডার দিয়ে আনা-নেওয়া করে যে নারী-পুরুষরা, সবাই মিলে
ট্রেনটা ছিল ঠাসা। আজগর আলির ষাট বছরের দুর্বল বুক এমনিতেই বাতাস
বেশি টানতে পারে না। এই দমবন্ধ পরিবেশে তার বুকের খাঁচা পুরোটা
সময়ই বাতাসশূন্যতায় আঁকুপাকু করেছে। তবু তাকে দশ বছর আগের ‘কিছু
হবে না’ মার্কা সাহস নিজেকে যোগাতে হয়েছে সারাক্ষণ। তার তো ফেরার
পথ নেই।
তিলকপুরে নামল একদল। আজগর আলিও। প্লাটফর্মের বাইরেই
কামলার হাট। তারা সেখানে বসল জটলা করে। জটলা থেকে সবসময়ই
দূরে থাকার অভ্যেস আজগর আলির। কিন্তু এখন তাকে নিজেকে বিμি
করতে হবে। জটলায় না বসলে উপায় নেই। সারা ট্রেনযাত্রায় বুক ভরে
নিশ্বাস নেবার অবকাশ পায়নি। এখানে একটু খোলা হওয়া। তার বুকটা
নির্ভার হয়ে উঠল অনেকখানি। মুখের তালু, জিভ বিস্বাদ। তবু তিতকুটে মুখে
বিড়ি ধরাল সে।
বেলা ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আসতে শুরু করল জোতমালিকরা। কোনো
সংকেতের প্রয়োজন হলো না। দেখা গেল কামলারা সবাই সারিবন্দি হয়ে
দাঁড়িয়েছে নিজেরাই। একজন-দুইজন করে জোতমালিক কিংবা তাদের
লোকেরা আসে, দরদাম করে পছন্দ মতো কামলা নিয়ে চলে যায়। রোদ চড়া
হবার আগেই অনেকেরই কাজ জুটে যায়। তারা চলে যায় জোতমালিকের
সাথে। খালি পেটে ঘোলাটে হয়ে যাওয়া চোখ আর মাঝে মাঝে ঘুরে ওঠা
মাথা নিয়ে রেলদালানের ধীরে ধীরে কমে আসা ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকে আজগর
আলি। তার সঙ্গে এখন মাত্র কয়েকজন দুর্বল, অশক্ত আর বয়সী কামলা।
আজগর আলি বোঝে, একটু নড়া-চড়া না করলে তার কাজ জুটবে না। বুড়ো
মানুষকে নিয়ে হ্যাপা পোয়াতে চায় না কোনো জোতমালিকই। একজনকে
আসতে দেখে সে এগিয়ে যায়। কিন্তু তাকে অপাঙ্গে দেখে লোকটা অন্য
কামলাদের দিকে অনুসন্ধানী চোখে তাকায়। আজগর আলি নাছোড়।
জিজ্ঞেস করে-- আপনের কামলা লাগবি বাহে?
লোকটা তার দিকে ঘুরে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকায়। অর্থাৎ লাগবে।
মোক ন্যান। মুই ধান কাটিবার কামে আইছি।
ধুর! লোকটা তার মুখের ওপর তাচ্ছিল্য দেখায়। তার দরকার জোয়ান
কামলা। বুড়ো মানুষকে নিয়ে কাজ তো হবেই না, ঝামেলা হবে গাদা গাদা।
ঝামেলা হবি না মহাজন। মোক ন্যান। মুই অনেক বচ্ছর এই কাম
করি।
তা তুমার আবার এই বয়সে এখনো এই কাম করা লাগে ক্যা! বুড়া
হইছ, আল্লা-বিল্লা করবা, নাতি-নাতনিরে নিয়া খেলা-ধুলা করবা! তা না কর্যা
কামে আইছ ক্যা?
প্যাট, মহাজন প্যাট! মোক ন্যান!
না রে বাবা। তোমাক দিয়া হামার কাম চলবি না।
লোকটা সরে যায় অন্য কামলার খোঁজে।
ক্রমে বেলা বাড়ে। রেলদালানের ছায়াও কমতে কমতে নিজের মধ্যে
গুটিয়ে আসতে থাকে। আজগর আলির চাঁদি আর দাঁড়ি বেয়ে নেমে আসতে
থাকে ঘামের ধারা। তার চোখ একটু পর পর সবকিছুকে শূন্য দেখে।
আজগর আলি রেলদালানের দেয়ালে তখন ঠেস দিয়ে বসে পড়ে। মাথা
মাঝেমাঝেই ঘুরে উঠছে। মুখের মধ্যে লোনা পানির ধারা। আজগর আলি কী
অজ্ঞান হয়ে পড়বে! ষাট বছরের আজগর আলি তার সমস্ত জীবনীশক্তি
একত্রিত করে। অজ্ঞান হয়ে পড়া মানে এই অঞ্চলে আর কাজ না পাওয়া।
এমনিতেই বয়স্ক মানুষ, তার ওপর যদি সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে, তাহলে কেউই
তাকে কাজে নেবে না। কেই-ই বা বুড়া মেরে খুনের দায়ী হতে চায়!
দেয়ালে ঠেস দিয়ে চোখ বন্ধ করে রোদের মধ্যেই বসে রইল আজগর
আলি। কতক্ষণ পর্যন্ত খেয়াল নেই। হঠাৎ মনে হলো তার ওপরে একটা ছায়া
পড়েছে। চোখ খুলে দেখল তার ওপর ঝুঁকে আছে হাড়গিলে চেহারার এক
মানুষ। তাকে ডাকল লোকটা-- ও চাচামিয়া, ঘুমাইছ নাকি?
ঘোরের মধ্যে থাকা আজগর আলি প্রমে এই দৃশ্যের সাথে, এই রোদের
মধ্যে তার ওপর ঝুঁকে থাকা মানুষটির সাথে নিজের অবস্থানকে মেলাতে
পারে না। সে ভাষাহীন তাকায়। লোকটা আবার বলে-- ঘুমাইছ নাকি?
এবার সাড়া দিতে পারে আজগর আলি। দুর্বল স্বরে বলে-- না বাহে, খুব
ঝালো রোদ তো, তাই মুই চোখ বুজ্যা রাখিছি।
ও! লোকটা কিছুক্ষণ তার নিজের গালে হাতের তালু ঘষে-- তুমি কি
কামলা খাটতে আইছ? ধান কাটার কামে?
এবার ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে আজগর আলি-- হ্যাঁ বাহে!
লিব্যান মোক কামে?
হামি কীভাবে কামে লিবো! হামার কী আর জোত-জমি আছে! বলে
লোকটা হেসে ওঠে। আর আজগর আলি আবার ঝিমিয়ে পড়ে।
লোকটার চোখে আজগর আলির এই ঝিমিয়ে পড়াটাও এড়ায় না। সে
অল্প হাসে-- হ্যাঁ, হামার জমি-খ্যাত নাই। তয় হামি তোমাক কামলার কাম
জুটায়া দিবার পারি। মানে হামি জোতমালিকের কামলা সাপ্লাই করি।
কামলার ঠিকাদারিও কবার পারো।
আজগর আলি ফের সতেজ হবার চেষ্টা করে-- তো দ্যান বাহে! হামাক
কাম দ্যান!
তা কাম তোমাক হামি দিবার পারি। কিন্তু মজুরি তো তুমি অন্য জুয়ান
কামলার সমান পাবা না। তুমি খুব বেশি হলে রোজ পাবা চল্লিশ ট্যাকা।
ক্যান বাহে, এখন তো কামলার দর তিন কুড়ি ট্যাকা। মোক এত কম
দিব্যান ক্যান!
কম! কম আবার হলো কই! তোমাক তো কেউ কামেই লিতে চায় না।
এই বয়সের কামলা কি কেউ লিবার চায়? তুমি এক কাম করো। এই চল্লিশ
ট্যাকা রোজে কামে লাগো। ছানাউল্লাহ মাস্টারের জমির ধান কাটো। তাঁই
লোকখান ভালো। খাওয়া-দাওয়া ভালো পাবা।
দোনোমোনো করে রাজি হয় আজগর আলি। তার তো ফেরার পথ
নেই। সে নিজেকে নিজের দুই পায়ের ওপর দাঁড় করায়। বেডিং-ঝোলা তুলে
নিয়ে বলে-- চলেন বাহে! চল্লিশেই সই।
খাড়াও, খাড়াও! আমার কমিশনের কথাটা ঠিক করো।
কমিশন! সে আবার কী জিনিস!
লোকটা বলে-- হামি তোমাক কাম জুটায়া দিলাম। নিয়ম হলো, তুমি
হামাক কমিশন দিবা। তোমার চল্লিশ টাকার তিন ট্যাকা হামার।
তার মানে তার রোজ সাঁইত্রিশ ট্যাকা। আজগর আলি এমন কথা
কোনোদিন শোনেনি। দশ বছরে এত বদলে গেছে দুনিয়া আর দুনিয়াদারি!
তার মুখ ফুটে বেরোয়-- এইডা আবার কেমন কথা বাহে! মানুষের হক মারি
খাওয়া!
লোকটা চটে যায়-- এর নাম হক মারা না। এর নাম কমিশন। এইডা
এই দুনিয়ার নিয়ম। তুমি যদি নিয়ম না মানো তাহলে কাম জুটাতে পারবা
না। কমিশন দিলে কাম পাবা। তাহলে তোমার লাভ, হামারও লাভ।
আজগর আলি রাজি হয়ে যায়।
৩.
কেননা আজগর আলির রাজি না হয়ে উপায় থাকে না। কেননা আজগর
আলিদের জীবনে অন্যরকম কিছু ঘটে না। তারা অন্য কিছু ভাবার অবকাশও
পায় না। আর আজগর আলিরা অংকে ভীষণ কাঁচা। অংকে তাদের ভয়ও খুব
বেশি। তাই অংক না কষেই আজগর আলি কাজে যোগ দেয়। কিন্তু অংক
তো তাকে ছাড়ে না।
তারপর আজগর আলি পরবর্তী সাতাশ দিন তিলকপুর নিবাসী
সানাউল্লাহ মাস্টারের ফসলের জমিতে কাজ করে। পুরো সাতাশ দিনই সে
কাজ করতে পারে। তার মাথা ঘোরা, তার চোখ ঘোলাটে হয়ে আসা, তার
বিনোদনের লুডু-মোমবাতিবিহীন জীবন-- এই সবকিছুকেই যন্ত্রবৎ অস্বীকার
করে আজগর আলি সাতাশ দিন কাটিয়ে দেয়।
সন্ধ্যার পরপরই এই এলাকায় হুঁকো ঘিরে এক-একটা আসর বসে।
ফসলের অবস্থা, আকাশের শিলমেশানো বৃষ্টির ভয়, নৌকা না ধানের শীষ
এইসব নিয়ে গল্প হতে হতে কেউ কেউ গলা ছেড়ে হয়তো গেয়ে ওঠে চারপাঁচ
কলি ভাটিয়ালি গান। হুঁকোর আসরে সবাই খুব তাড়াতাড়ি সমান সমান
হয়ে উঠতে পারে। মালিক-জোতদার-কিষাণের ঠোঁট একই হুঁকোর ফুটো
থেকে নেশার খোরাক টেনে নেয়। তৃপ্তিও সবার একই রকম। তৃপ্তির
প্রকাশও।
আজগর আলির জটলা-এড়ানো স্বভাব এরা কয়েকদিনেই বুঝে নিয়েছে।
তাই সে যখন হুঁকোর আসর থেকে একটু দূরে বসে ঘোলা চোখে অন্ধকার
মাপে, তখন কেউ নেহায়েত দরকারি কথা ছাড়া তাকে বিরক্ত করে না।
ছেলের বউ তার ছেলে-মেয়ে দুটো নিয়ে কীভাবে এখন দিন কাটাচ্ছে,
সেই চিন্তা মাঝেমাঝেই আক্রমণ করে আজগর আলিকে। মাঝেমাঝে ভাবতে
ভাবতে অনেক দূর ভেবে ফেলে আজগর আলি। এই এলাকার সবরি
কলাগুলো খুব হৃষ্টপুষ্ট। স্বাদেও দারুণ। আর জিয়োল মাছ বেশ পাওয়া যায়।
আজগর আলিরা যাকে কানছা বলে জানে। আর জানে, এই মাছ বড়ই
রক্তবর্ধক, বলবর্ধক। তো হঠাৎ আজগর আলি নিজেকে জেগে থাকা স্বপেড়ব
কিংবা খেয়ালে ভাসায়-- ধরো কাইল সকালেও যদি মুই কাম ছাড়িয়া রওনা
করি, কামের মজুরি, দুই ছড়ি সবরি কলা, মুখঢাকা মাটির হাড়িত
পানিজিয়ানো এককুড়ি কানছা মাছ। নাতি-নাতনি দুইজনার গতরে তেজ খুব
কম। কানছা মাছ বলবর্ধক আর সবরি কলা দারুণ সুস্বাদু, পুষ্টিকর। তো
জিয়োল মাছ আর সবরি কলা আর মজুরির পকেট ভর্তি টাকা নিয়ে যদি ভোর
ভোর উঠে পড়া যায়, তিলকপুর স্টেশনে পৌঁছে চিলাহাটির ট্রেন ধরে দুপুরের
মধ্যে সোজা ডোমার। সেখানে কোনো হোটেলে চারটে ডাল-ভাত খেয়ে বাসে
উঠলে তিস্তাঘাট। নদী সাঁঝ সাঁঝ পেরোলে ভ্যানে ঘণ্টা খানেক। তারপর
হাঁটাপথ। নিজের ভিটায় পৌঁছাতে খুব বেশি হলে রাতের নয়টা কিংবা
দশটা। যদিও গাঁয়ের রাত দশটা মানে নিশুতি রাত, তবু নিজের গাঁয়ে রাতের
দশটাই কী আর এগারোটাই বা কী!
এই পর্যন্ত, জেগে থাকা স্বপেড়ব, খুব ফুরফুরে মেজাজে পেরিয়ে গেল
আজগর আলি। কিন্তু তারপরেই তার ফুরফুরে স্বপেড়বর মধ্যে আশঙ্কা টলমল
করে। ধরো, বাড়ি গিয়ে সে দেখল, কোনো ঘরে আলো নেই। সব সুনসান।
তবে কি বউমা আর নাতি-নাতনি দুইজনা ঘুমে একেবারে লছপছ! ধরো,
আজগর আলি ডাকে-- কই বাহে বউমা, এট্টু উঠো দেখি-- কিন্তু কোনো শব্দ
আসে না আড়মোড়া ভাঙার। অপেক্ষা করেও আলো জ্বলে না ঘরে। তখন
আজগর আলি জোর শব্দ করে দরজায়। তবু দরজার ওপাশ থেকে কারো
জেগে ওঠার শব্দ ভেসে আসে না। তখন সে দেশলাই জ্বালে। দেখতে পায়
দরজা ভেতর থেকে নয়, বন্ধ বাহির থেকে। তার দরজায় শিকল তোলা।
দেখেই কেঁপে ওঠে আজগর আলির বুক। এদিকে তার হাঁক-ডাকে পাশের
ঘর থেকে কুপি হাতে বেরিয়ে আসে আয়নালের মা-- ওমা আজগর ভাই, মাস
ফুরানের আগেই ফিরলে যে বাহে!
আজগার আলি মুখে না বলে এমন ভঙ্গি করলো, যাতে বোঝা গেল
ভিটের জন্য, বউমা-নাতি-নাতনির জন্য তার বুকটা ভীষণ মোচড়াচ্ছিল। তাই
কাজের মাঝপথেই সে চলে এসেছে। কিন্তু তার বউমা আর নাতি-নাতনিরা
কই! তখন আয়নালের মা খানিকটা লজ্জা, খানিকটা সহানুভূতির সাথে জানায়
যে, তার ছেলের বউ এখন নাসির মুদির ঘরে। জেগে দেখা দুঃস্বপেড়বর মধ্যেই
এই খবর শুনে স্তব্ধতায় আμাšও হয় আজগর আলি। দুঃস্বপেড়বর খেয়াল আরো
বাড়াতে তার ভয় করে। তবু সে এগিয়ে নিয়ে চলে দুঃস্বপড়বকে। এখন তার
বুকে ভর করেছে রাজ্যের উদারতা। কল্পনার মধ্যে আজগর আলি অনুনয়ের
গলায় বলে-- এট্টু মোর হয়্যা নাসিরের ঘরোত যাব্যান ভাবি!
এই রাতোত! আয়নালের মায়ের গলায় সংশয়। একটু ঝাঁঝালো গলায়
বলে-- ফির তার পাছোত যাওয়ার দরকারখানই বা কী! তাঁই তো নিজের
রাস্তা খুঁজি নিছে।
আজগর আলিও কী তা বোঝে না! কিন্তু তার বুক যে পোড়ে! তার
নাতনিটা ল্যাগবেগে পুতুলের মতো। কী দুর্বল! কী মায়াময়! তার নাতিটা
হাত ভেঙে নুলো হবার উপμম। গরুটা কিছুদিন উঠোনে ছিল। তার জন্যও
দরদ। সে তাই অনুরোধ করে আবার-- তাও তুমি একবার যান ভাবি! এই
সবরি কলা, এই যে কানছা মাছ, ছোঁড়া-ছুঁড়ি দুইডার গতরে জোর নাই। আর
এই টাকাগুলান দিব্যান বউমার হাতোত। এনজিও-র কিস্তি শোদ দিয়া গরুডা
ছাড়ান করুক। ছোঁড়া-ছুঁড়ি দুইজন গাই বিয়ান দিলে দুধ খাইবার পারিবে।
আর এই যে ট্যাকা, ছোঁড়াক টাউনোত ডাক্তারের কাছোত লিয়া যাবি। অরা
সক্কলে সুখে থাকিলেই হামার শান্তি ভাবি! হামারই যে রক্ত অরা!
এই পর্যন্ত কল্পনা করতে করতেই দুঃখে-কষ্টে-উদারতায়-সর্বস্ব হারানোর
বেদনায় আজগর আলির চোখের পানিতে দাঁড়ি ভিজে যায়। অন্ধকারে বোঝা
যায় না, তার দাঁড়ি থেকে ঝরে পড়া কয়েক ফোটা জল তার বুকের কাছের
গেঞ্জিও ভিজিয়ে দেয়।
এই সময় ভেতরে বাড়ি থেকে খবর আসে, রাতের রানড়বা হয়ে গেছে।
কামলা-কিষাণরা খেতে বসুক। আর আজগর আলি এই কয়দিনে চিনে ফেলা
পুকুরের ধাপগুলো অন্ধকারে বেয়ে নেমে মুখ-হাত ধুয়ে সঙ্গী কিষাণদের সঙ্গে
খেতে বসার উদ্যোগ করে।
ঐ কল্পনাই করেছিল। মাঝেমাঝেই করে। কিন্তু তাই বলে মাঝপথে কাজ
ছেড়ে আজগর আলি ঘরে ফেরে না।
সাতাশ দিন পরে ছানাউল্লা মাস্টারের ধান কাটার কাজ শেষ, মাড়াই
শেষ। পোয়াল আর ধান আলাদা আলাদা করে গুছিয়ে পোয়ালের ঠিক্কাছড়া
আর ধান গোলাবন্দি করা শেষ। এবার আজগর আলিদের মতো রোজের
কামলাদের বিদায়ের পালা। ছানাউল্লা মাস্টার লোকটা ভালো। আগের রাতে
বিদায়ীদের জন্য গরুর গোস্ত রানড়বা হয়। বোল্ডার গরুর লালচে ঢেলার মতো
টুকরো। তার সাথে শুকনো মরিচপেষা ছড়ানো প্রচুর ঝোল আর হল্যান্ডের
আলু দুই ফাঁক করে সেই ঝোলে ভাসানো। খুব ঝাল, খুব স্বাদ। ঝালের
চোটে তারা যখন উস-আস্ করে টাকরায় শব্দ তোলে, তখন বাড়ির ভেতর
থেকে মিষ্টি পায়েশ আসে। আসলে পায়েশ নয়, মিষ্টি জাউভাত। তাতে
আজগর আলিদের তেমন তফাৎ মনে হয় না। তারা মাংস-ভাতের পর মিষ্টানড়ব
পেয়ে যথেষ্ট খুশি এবং কৃতজ্ঞও।
সকালে ছানাউল্লা মাস্টার পাই পাই করে সবার পাওনা বুঝিয়ে দেয়।
এক শ টাকি, দশটাকি, পাঁচটাকি মিলিয়ে সাতাশ দিনের পরিশ্রমের পাওনা
তাদের তাৎক্ষণিক তৃপ্তি এনে দেয়। আজগর আলি বহুদিন পরে দুই হাতের
আঙুলে এতগুলো নোট স্পর্শ এবং গোনার সুযোগ পায়। আর তখনই তাকে
জাপটে ধরে অংক।
কমিশনের টাকা বাদ দেবার পরে, আর বিড়ি-গুয়া খরচের জন্য আগাম
যে কয়টা টাকা মাস্টারের কাছ থেকে নিয়েছিল, সেইগুলি বাদ দেবার পরেই
তার সামনে এসে হাজির হয় এই টাকা দিয়ে অবশ্যকরণীয়গুলোর তালিকা।
তার কাঁথা, লুঙ্গি, গেঞ্জি মিলিয়ে বান্ডিল বাঁধা শেষ, তার আরো ঝকমকে
হয়ে ওঠা কাস্তে দুটোকে পাটের ফেঁসোতে পেঁচিয়ে চটের ব্যাগে ঢোকানো
শেষ। এখন কাঁথা-লুঙ্গির বান্ডিল আর চটের ব্যাগের পাশে ছানাউল্লা
মাস্টারের পৈঠায় বসে আজগর আলি টাকা গোনে। গোনে আর খাতওয়ারি
আলাদা করে। প্রমে বউমার গরুটা ছাড়িয়ে আনার টাকা। মোট টাকা থেকে
সেই টাকাটা আলাদা করে আজগর আলি। বাম হাত সব টাকা। অন্যহাতের
আঙুল দিয়ে সেই পরিমাণটিকে আলাদা করে সে। তারপরে নাতিটার ভাঙা
হাড়ের চিকিৎসার জন্য টাকা। কিন্তু এই পরিমাণটায় পৌঁছানোর আগেই
আজগর আলি সবিস্ময়ে খেয়াল করে তার বাম হাতে আর টাকা নেই। অংক
তখন আজগর আলিকে ধন্দে ফেলে দেয়। সে বিড়বিড় করে-- তারপরে ধরো
ঘরোত ফিরার ভাড়া, একছড়ি সবরি কলা, এক কুড়ি কানছা মাছ, তারপর
ধরো ঘরের চাল-ডাল, তারপর ধরো...।
এতগুলো দিন কাজ করল আজগর আলি। কাজের শেষে মোট কত টাকা
পাবে, সে অংক করা হয়নি। সেই টাকা তার প্রয়োজন কতখানি মেটাতে
পারবে সেটাও ভাবা হয়নি।
কিন্তু এখন টাকা নিয়ে বিদায় নেবার সময় সে হিসাববিজ্ঞানের
গোলাকধাঁধায় পড়ে যায়। কিস্তি, ভাঙা হাত, চাল-ডাল, নাতি-নাতনির একটু
শখ, ঘরফেরত খরচ। এই টাকা দিয়ে কি সব হবে না? সে আবার বামহাতে
টাকা নিয়ে ডান হাতের আঙুল দিয়ে গুনে গুনে টাকাগুলোকে আলাদা আলাদা
করতে চায়। আবার খাতগুলো শেষ হবার আগেই দেখে যে তার বাম হাত
শূন্য। আজগর আলির মাথা একটু ঘুরে ওঠে। সে টাকার হিসাব বাদ দিয়ে
ঘোলাটে চোখে রোদের মধ্যে শুয়ে থাকা ন্যাড়া মাঠগুলো দেখে। কিছুক্ষণ
পরে আবার খাতওয়ারি হিসাব করে টাকাগুলো গুনে আলাদা করতে যায়।
এবং আবার খাতগুলো শেষ হবার আগেই তার টাকা শেষ হয়ে যায়।
আজগর আলির মাথাঘোরা আরো একটু বাড়ে। রোদপোয়ানো ন্যাড়া
মাঠগুলোর দিকে আবার কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে সে। তারপর আবার খাতওয়ারি
টাকাগুলোকে হিসাব করতে যায়। তার এতদিনের পরিশ্রমের টাকা আবার
খাত শেষ হবার আগেই শেষ হয়ে যায়। তার মাথাঘোরা আরো একটু বেড়ে
যায়। ন্যাড়া মাঠের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার সময়ও আর একটু
বাড়ে।
তারপর আবার সে খাত হিসাব করে টাকা আলাদা করতে শুরু করে,
তার টাকা খাত শেষ হবার আগেই যথারীতি শেষ হয়, তার মাথাঘোরা আর
শূন্যদৃষ্টিতে ন্যাড়া মাঠের দিকে তাকিয়ে হিসাব মেলানোর চেষ্টা করা বেড়ে
চলে, বেড়েই চলে, বেড়েই চলে...
লেখক পরিচিতি
জাকির তালুকদার
জাকির তালুকদার এসময়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ গল্পকার। তিনি লেখেন অভিজ্ঞতা থেকে। এবং এই অভিজ্ঞতার জন্য তাকে গ্রামে যেতে হয়নি। তিনি গ্রামেরই মানুষ। এর সঙ্গে মেল বন্ধন ঘটেছে তাঁর বহুমূখী পড়াশুনার। তিনি শুরু থেকে সিরিয়াস গল্পকার। কোনো অর্থেই সখ করে লেখেন না। ফলে তাঁর পাঠকও তাঁর সঙ্গে হয়ে ওঠেন সিরিয়াস। সম্ভবত জাকির তালুকদারই সাহিত্যের সেই প্রাচীন বংশের নিঃশ্ব সন্তান যিনি সত্যি সত্যি লেখালেখির জন্য সব ছেড়েছেন। নিজেকে বাজী ধরেছেন। এবং তাকে পড়া ছাড়া পাঠের পূণ্যি অসম্ভব।
গল্পের পাশাপাশি লিখছেন উপন্যাস ও প্রবন্ধ। প্রথম উপন্যাস কুরসিনামা। মুসলমানমঙ্গল উপন্যাসের মাধ্যমে পাঠকমহলে পরিচিতি পান। তার সর্বশেষ উপন্যাস পিতৃগণ সম্প্রতি জেমকন সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে।
দলটা ডোমারে এসে শুনল সামনের তিন দিন হরতাল।
তারা দুইভাগ হয়েছিল ডোমারে এসেই। কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছিল না
ভাগ হবার। যেমন তাদের দলবদ্ধ হবার জন্যও কোনো আনুষ্ঠানিকতার
প্রয়োজন পড়েনি। দুই-চারজনের ছোট ছোট দল পথের বিভিনড়ব পর্যায়ে
একত্রিত হতে হতে আপনা-আপনিই বড় হয়ে যায়।
একে অপরকে চিনেও
নেয় সহজে। তীর্থযাত্রীরা কিংবা ওরসে যারা যায়, তাদের যেমন চিহ্ন থাকে,
সেইরকম এদেরও চিহ্ন সর্বাঙ্গে। এদেরটা আরো প্রকট। কেননা এদের সবার
সামান প্রায় একই। কাঁথা একখানা ভাঁজ করতে করতে যতদূর ছোট করা
যায়, তার সঙ্গে লুঙ্গি-গেঞ্জি মিলে একটা বান্ডিল। জামা কিংবা ফতুয়া
সাধারণত একটাই। সেটা তাদের পরনে থাকে। আর থাকে একটা চটের
ব্যাগ। ব্যাগ ঝোলানোর ফাঁসের পাশ দিয়ে উঁকি মারে পাটের মোটা
ফেঁসোতে মোড়া কাস্তের ডগা। কারো একটা, কারো একাধিক।
এই রকম সময়ে, প্রতি বছর যখন ধানকাটার মরশুম আসে, আকাশ
থাকে কখনো রাগী, কখনো সজল, কখনো রোদ থাকে পিটের চামড়ায়
ফোসকা তোলার মতো যথেষ্ট উষ্ণ, বাতাসে থাকে ঝাঁওয়াল, ওরা গ্রাম ছেড়ে
দলে দলে বেরিয়ে পড়ে। তাদের গ্রামগুলো তখন পুরুষশূন্য। পনেরো থেকে
পঞ্চাশ বছরের কেউই পুরো একমাস গাঁয়ে থাকে না। থাকে শুধু দুই-তিন ঘর
বড়মানুষেরা। আর তাদের বাঁধা মুনিষেরা। আর থাকে তাদের ফসল পাহারা
দেবার নিজস্ব ভাড়াটে মানুষেরা।
বাকি সবাই, যারা বেরিয়ে পড়ে গ্রাম ছেড়ে, তাদের হিসাব দিন কিংবা
মাসে নেই। তাদের সংকেত দেয় ধানের ছড়া। নিজেদের এলাকায় ধানের
ছড়া ফুটতে দেখলেই ওরা বেরিয়ে পড়ার জন্য তৈরি হয়। তাদের সবারই
মুখস্ত খনার সেই বচন-- “শীষ দেখে বিশ দিন। কাটতে মারতে দশদিন।”
ধানের শীষ দেখার সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে পড়ার তোড়জোড়। ধানকাটার কাজে
কত পুরুষ ধরে যে অন্য এলাকায় যাচ্ছে তারা, সে হিসাব কেউ রাখে না।
তাদের এলাকায় যতটুক ধানের জোত, সেই ধানকাটার মতো মুনিষ
জোতদারের নিজেরই আছে। বাকিদের কোনো কাজের সংস্থান এই এলাকায়
নেই। তাই তারা বেরিয়ে পড়ে দলে দলে। সমস্ত গ্রামকে পুরুষশূন্য করে।
এবারের দলটা ডোমারে এসে থমকে যায়। গাড়ি চলাচল বন্ধ। কী
কারণ? না, তিন দিনের হরতাল। হরতাল ওরা সবাই এখন বোঝে। তবে
নিজেদের এলাকায় হরতাল-টরতালে ওদের কিছু আসে-যায় না। অন্য দিনের
মতো একই চালে তাদের জীবন চলে হরতালের দিনেও। গ্রামগুলোতে তো
দূরের কথা-- জলঢাকা, চিলমারি, উলিপুর থানা সদরগুলোতেও হরতালে
অন্যরকম কিছু ঘটে বলে তাদের জানা নেই। তারা মিছিল বলতে বোঝে
ইউনিয়ন পরিষদের ভোটের মিছিল আর নৌকা-ধানের শীষ-লাঙলের ভোটের
মিছিল। তবে মিছিলের মতো মিছিল হয় চেয়ারম্যান-মেম্বার ভোটে।
একজনের মিছিলে যদি থাকে তিন হাজার মানুষ, দশটা ঘোড়া, এক শ ভ্যান,
আর তিন হাজার পতাকা-- তো আরেকজনের মিছিলে থাকে নিদেনপক্ষে
মাহুতসহ একটা ভাড়া করা হাতি, এক ডজন ঘোড়া, এক শ ভ্যান, পাঁচ
হাজার মানুষ। ঐ সময় মিছিলে যারা যায়, তাদের ঝুলও ওঠে খুব বেশি।
তারা সমানে নাচে আর গানের সুরে সুরে শ্লোগান দেয়-- ও শাবানা, নেই
ভাবনা, হ্যারিকেনে সিল মারো না!
দেখা যায় বাপ চাকা মার্কার মিছিলে, তো ছাতার মিছিলে ছেলে,
হ্যারিকেনের মিছিলে ভাতিজা। কাজেই মিছিল বলতে তাদের কাছে বোঝায়
ভোটের মিছিল। বড়ই আনন্দের জিনিস। কিন্তু ডোমারে এসে তারা দেখল
হরতালের মিছিল। পঁচিশ-তিরিশজন মোটে মানুষ। কিন্তু খুব যুদ্ধংদেহী।
প্রত্যেকের হাতে ডাং। এই এক মিছিলই বন্ধ করে রেখেছে পুরো বন্দর।
কোনো গাড়ি চলছে না কোনোদিকে।
তবু তারা পথ বেছে নিতে থাকে।
তাদের মধ্যে যারা ঠিক করে রেখেছিল ট্রেনে যাবে, তারা চলে গেল
স্টেশনের দিকে। অন্যরা বাসস্ট্যান্ডে। বাস কিংবা ট্রাক পেলে উঠে পড়বে।
তারা বাসস্ট্যান্ডে আর রেলস্টেশনে অপেক্ষা করে থাকে। শুনেছে, রাতে
গাড়ি চললেও চলতে পারে। রেলস্টেশনে যে দলটি গিয়ে ঢোকে, তাদের
মধ্যে ছিল আজগর আলি। অনেক বছর পরে আজগর আলি ধানকাটার কাজে
বেরিয়েছে। মাঝখানের বছর দশেক সে বের হয়নি গ্রাম থেকে। কেননা
ছেলেটা বড় হয়ে দায়িত্ব নিয়েছিল সংসারের। সে-ই যেত। গত বছর ছেলে
গিয়েছিল অনেক দূরে বেশি মজুরির আশায়। পদ্মা পার হয়ে কুষ্টিয়ার ধানের
অঞ্চলে। ফেরার পথে উঠেছিল বাসের ছাদে। বাড়ি ফিরতে পারেনি। বাস
উল্টে রাস্তার সাথে পিষ্ট হয়ে থেঁতলে মরেছে। লাশ বাড়িতে যায়নি। তার
মজুরির টাকাও না। কাঁথা কিংবা কাস্তেও না। তাদের গ্রামের আর যারা
গিয়েছিল এবং বেঁচে ফিরেছিল, তারা খবরটা পৌঁছে দিয়েছিল আজগর
আলির ভিটায়।
ছেলে বড় হবার পর মোটামুটি সুখের সময় গেছে আজগর আলির। খুব
অভাবের সংসারে সচরাচর যা ঘটে, ছেলে বড় হয়ে বিয়ে-থা করলে বাপমাে
ক কলা দেখিয়ে দেয়, তার ছেলে তেমনটি করেনি। নিজে যা খেয়েছেপে
রছে, বাপকেও তা-ই দিয়েছে। ছেলে বউ ঘরে আনার আগেই মারা
গিয়েছিল তার মা। কাজেই আজগর আলির কাজ বলতে ছিল লুডু খেলা। খুব
একটা মিশুক মানুষ সে নয়। লুডু খেলতে চারজন লাগে, নিদেনপক্ষে
দুইজন। কিন্তু বউ মরার পর আজগর আলি সবসময় একা-একাই লুডু
ভেলে। সাপলুডু খেললেও একা, গুটি ঘরে ওঠা খেললেও একা। নিজের,
আর কাল্পনিক প্রতিপক্ষ-- দুজনের চাল আজগর আলি একাই চালে। চাল
দেয় দুই পক্ষেরই খুব মনোযোগের সাথে। নিজের জন্য নিজের প্রতিপক্ষের
বিরুদ্ধে কখনো পক্ষপাতিত্ব করে না চাল দিতে গিয়ে। তার খেলার সময়
আবার বাঁধা। রাতের খাবারের পর সে নাতি-নাতনির সাথে একটু-আধটু
খুনসুটি-আদরের পর লুডু বিছিয়ে খেলতে বসে। কুপি-হ্যারিকেন চায় না।
অতএব তেল খরচের জন্য ছেলের বউয়ের মুখ ঝামটাও তাকে সইতে হয়
না। সে লুডু খেলে মোমবাতির আলোয়। মন্তাজের দোকান থেকে সে দুইদিন
পর পর একটা করে মোমবাতি কেনে। অর্ধেক কেটে দোকানে রেখে দেয়,
বাকি অর্ধেক নিয়ে লুডু খেলতে বসে। মোমবাতিও শেষ, তার লুডুখেলাও
শেষ। সটান শুয়ে পড়ে আজগর আলি। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘুম। পরের রাতে
বাকি অর্ধেক মোমবাতিতে লুডু খেলা।
তার এই বিচিত্র বিনোদন পদ্ধতিতে ছেলে বেঁচে থাকতে হাসত। মোমের
খরচের জন্য তার ছেলের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। কেননা, যৎসামান্য
হলেও আজগর আলির নিজস্ব ইনকাম ছিল। চারুদাসের তামাক গুদামে
তামাকপাতা সিজিল-মিছিলের কাজ করত আজগর আলি। নিজের পান-গুয়াবিড়ি,
নাতি-নাতনির ছোট-খাট হাউসের আব্দার মেটানো, আর লুডু খেলার
মোমবাতির খরচ দিব্যি চলে যেত সেই উপার্জন দিয়ে। ধানকাটার মরশুমে
বাপকে ঘরে রেখে নিশ্চিন্ত মনে বিভূঁয়ে চলে যেতে পারত ছেলে। নিশ্চিন্তে;
কেননা ঘর আর ঘরের মানুষকে দেখার জন্য মানুষ রইল। ওদের চিরদিনের
অভিজ্ঞতা, বিভূঁই থেকে ফিরে, সবাই ঘরে এসে ঘরকে হুবহু আগের মতো
পায় না। কেউ কেউ ফিরে এসে আর ঘর বলতে যা বোঝায়, তার কিছুই পায়
না। ভিটে থাকে, ঘরের খুঁটি-চালা-দরজা-জানালা থাকে, কিন্তু ঘর থাকে না।
কারণ ঘরের মানুষ নেই। প্রতি বছরই যখন এইসব গাঁয়ের পুরুষরা
ধানকাটার মরশুমে অনুপস্থিত থাকে, তখন বেশকিছু ঘরের বউ-মেয়ে অভাব
সইতে না পেরে, অনাহার সইতে না পেরে, অনিশ্চিতর সাথে পাল্লা দিতে না
পেরে চলে যায় অন্য কারো হাত ধরে। কেউ কেউ ভিন জেলার ফেরিঅলার
হাত ধরে অন্যত্র, কেউ চলে যায় জোতদারের মুনিষ-সর্দার বা তাদের হাতানাতার
দখলে। যদিও ব্যাপারটাকে তাদের দারিদ্র্য এবং মৃত্যুর মতোই
অনিবার্য হিসাবে মেনে নিয়েছে তারা, তবু নিজের ঘর সুরক্ষিত দেখতে চায়
সবাই। সে কারণে আজগর আলি বাড়িতে থাকলে তার ছেলেটা খুশি হতো।
নিশ্চিন্তে বিভূঁয়ে চলে যেতে পারত ধান কাটতে।
এবার ঘর ফাকা করে বেরুতে হলো আজগর আলিকে। তার বয়সে যখন
সে বেরুত, ছেলে থাকত ঘরে। তারপরে, ছেলে বেরুলে সে থাকত ঘরে।
কিন্তু এবার ঘর ফাঁকা রেখেই বেরুতে হচ্ছে। একটু চিন্তা যে হচ্ছে না, তা
নয়। মাঝে কিছুদিন খেয়াল করেছে, নাসির মুদিঅলা ঘুর ঘুর করছে। তার
মুদির দোকানের অবস্থা মোটামুটি রমরমা। তার উপরে লোক লাগিয়ে
ইন্ডিয়ার মাল এপার-ওপার করে। থানার সঙ্গে তার চুক্তি আছে। অর্থাৎ সে
এখন গ্রামে বড় মানুষ। নিজের ঘরে বউ আছে। বাচ্চাও। কিন্তু এই রকম
পয়সাঅলা লোকের জন্য একটামাত্র বউ, তাদের এলাকার হিসাবে বড্ড কম
হয়ে যায়। একদিন শুনতে পেয়েছে আজগর আলি, আশ্বাস দিচ্ছে নাসির তার
ছেলের বউকে-- অ্যালা অসুবিদা নাই বাহে, তুমার ছোল-মায়্যাক মুই টানিবার
পারিব। মোর ঘরের আরো তিনজনার সাথত এই দুইজনা যোগ দিলে ঘরোত
মোর জায়গা অ্যালাও সট পড়বি না বাহে! এই পর্যন্ত শুনেই সরে এসেছিল
আজগর আলি। নিজেকে প্রবোধ দিয়েছে, এরকম তাদের এখানে
হরহামেশাই ঘটে। প্রত্যেক মেয়েমানুষই একটা শক্ত আশ্রয় চায়। তার
ছেলের বউও চাইতে পারে।
বউ নাসিরকে কী উত্তর দিয়েছে তা শোনেনি আজগর আলি। তবে একটু
অবাক হয়েই খেয়াল করেছে, নাসির আর এদিকে ঘেঁষে না। তার বদলে
বউকে দেখা যায় এনজিও থেকে লোন এনে গরু কিনতে। মহা উৎসাহে
গরুকে ঘাস-খড় খাওয়ায়, সাত বছরের ছেলেটার হাতে গরুর গলার দড়ি
ধরিয়ে দিয়ে চরাতে পাঠায়। গোবর দিয়ে ঘুঁটে আর দৈলা বানায়। আজগর
আলির ঘরের চারপাশে গরুর চোনার ঝাঁঝালো গন্ধ, বেড়া জুড়ে ঘুঁটে আর
দৈলা রোদে শুকোতে দেওয়া, উঠোন জুড়ে ঘাস-বিচালির টুকরো।
পনেরো দিন অন্তর অন্তর সাইকেল টিং টিং করে এনজিও-র সায়েব
আসে। ঘুঁটে বেচা টাকায় আর কীভাবে যেন জোটানো টাকা বউ কিস্তির দায়-
দেনা তুলে দেয় এনজিও সায়েবের হাতে।
হঠাৎ কয়েকদিন আগে চারুদাসের গুদাম থেকে ফিরে আজগর আলি
দেখল বউমা বারান্দায় বসে ফোঁপাচ্ছে। উঠোনের যে কোণে গরুর জন্য চালা
তুলে গোয়াল বানিয়েছিল, সেটা শূন্য। গরু নিয়ে গেছে এনজিও সায়েব।
কেননা কিস্তি বাকি পড়েছে। তার কিছুদিন আগে পিছলে পড়ে ডান কনুইয়ের
ওপরের হাড় ভেঙে গেছে নাতির। কবরেজ বাঁশ চেঁছে প্লাস্টার করে
দিয়েছিল। খোলার পরে দেখা গেল হাত বেঁকে থাকে বেচারার। শক্ত কোনো
কাজ করতে পারে না হাত দিয়ে।
টাউনোত লিয়্যা ডাক্তার দেখাও বাহে!
উপদেশ অনেকেই দেয়। কিন্তু খরচ! এই গ্রামেরই একজনের হাত
ভাঙার পরে শহরের ডাক্তার দিয়ে প্লাস্টার করে এনে হাত ভালো হয়েছে।
খরচ, রাহা খরচ বাদেই ছয় শ টাকা। অর্থাৎ কমপক্ষে সাত-আট শ টাকা
হলে নাতিকে শহরে নিয়ে যাওয়া চলে। তার সঙ্গে যোগ হলো এনজিও-র
কিস্তি খেলাপ।
অতএব আজগর আলিকে এবার বেরুতে হয় মরচেপড়া কাস্তে শান
দিয়ে।
২.
তিলকপুর ট্রেন পৌঁছুল ভোরের আলো ফোটারও আগে। ট্রেন ছেড়েছিল রাত
এগারোটার পরে। সারাদিনের অনিশ্চিত অপেক্ষমান যাত্রীদের সঙ্গে রেগুলার
প্যাসেঞ্জার যারা এই ট্রেনের-- বিশেষত পেট বাঁচানোর জন্য বিশ কেজি চাল
কিংবা বিশ কেজি লবণ কিংবা পাঁচ কেজি জিরা কিংবা পাঁচখানা শাড়ি ইন্ডিয়া
থেকে হিলি বর্ডার দিয়ে আনা-নেওয়া করে যে নারী-পুরুষরা, সবাই মিলে
ট্রেনটা ছিল ঠাসা। আজগর আলির ষাট বছরের দুর্বল বুক এমনিতেই বাতাস
বেশি টানতে পারে না। এই দমবন্ধ পরিবেশে তার বুকের খাঁচা পুরোটা
সময়ই বাতাসশূন্যতায় আঁকুপাকু করেছে। তবু তাকে দশ বছর আগের ‘কিছু
হবে না’ মার্কা সাহস নিজেকে যোগাতে হয়েছে সারাক্ষণ। তার তো ফেরার
পথ নেই।
তিলকপুরে নামল একদল। আজগর আলিও। প্লাটফর্মের বাইরেই
কামলার হাট। তারা সেখানে বসল জটলা করে। জটলা থেকে সবসময়ই
দূরে থাকার অভ্যেস আজগর আলির। কিন্তু এখন তাকে নিজেকে বিμি
করতে হবে। জটলায় না বসলে উপায় নেই। সারা ট্রেনযাত্রায় বুক ভরে
নিশ্বাস নেবার অবকাশ পায়নি। এখানে একটু খোলা হওয়া। তার বুকটা
নির্ভার হয়ে উঠল অনেকখানি। মুখের তালু, জিভ বিস্বাদ। তবু তিতকুটে মুখে
বিড়ি ধরাল সে।
বেলা ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আসতে শুরু করল জোতমালিকরা। কোনো
সংকেতের প্রয়োজন হলো না। দেখা গেল কামলারা সবাই সারিবন্দি হয়ে
দাঁড়িয়েছে নিজেরাই। একজন-দুইজন করে জোতমালিক কিংবা তাদের
লোকেরা আসে, দরদাম করে পছন্দ মতো কামলা নিয়ে চলে যায়। রোদ চড়া
হবার আগেই অনেকেরই কাজ জুটে যায়। তারা চলে যায় জোতমালিকের
সাথে। খালি পেটে ঘোলাটে হয়ে যাওয়া চোখ আর মাঝে মাঝে ঘুরে ওঠা
মাথা নিয়ে রেলদালানের ধীরে ধীরে কমে আসা ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকে আজগর
আলি। তার সঙ্গে এখন মাত্র কয়েকজন দুর্বল, অশক্ত আর বয়সী কামলা।
আজগর আলি বোঝে, একটু নড়া-চড়া না করলে তার কাজ জুটবে না। বুড়ো
মানুষকে নিয়ে হ্যাপা পোয়াতে চায় না কোনো জোতমালিকই। একজনকে
আসতে দেখে সে এগিয়ে যায়। কিন্তু তাকে অপাঙ্গে দেখে লোকটা অন্য
কামলাদের দিকে অনুসন্ধানী চোখে তাকায়। আজগর আলি নাছোড়।
জিজ্ঞেস করে-- আপনের কামলা লাগবি বাহে?
লোকটা তার দিকে ঘুরে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকায়। অর্থাৎ লাগবে।
মোক ন্যান। মুই ধান কাটিবার কামে আইছি।
ধুর! লোকটা তার মুখের ওপর তাচ্ছিল্য দেখায়। তার দরকার জোয়ান
কামলা। বুড়ো মানুষকে নিয়ে কাজ তো হবেই না, ঝামেলা হবে গাদা গাদা।
ঝামেলা হবি না মহাজন। মোক ন্যান। মুই অনেক বচ্ছর এই কাম
করি।
তা তুমার আবার এই বয়সে এখনো এই কাম করা লাগে ক্যা! বুড়া
হইছ, আল্লা-বিল্লা করবা, নাতি-নাতনিরে নিয়া খেলা-ধুলা করবা! তা না কর্যা
কামে আইছ ক্যা?
প্যাট, মহাজন প্যাট! মোক ন্যান!
না রে বাবা। তোমাক দিয়া হামার কাম চলবি না।
লোকটা সরে যায় অন্য কামলার খোঁজে।
ক্রমে বেলা বাড়ে। রেলদালানের ছায়াও কমতে কমতে নিজের মধ্যে
গুটিয়ে আসতে থাকে। আজগর আলির চাঁদি আর দাঁড়ি বেয়ে নেমে আসতে
থাকে ঘামের ধারা। তার চোখ একটু পর পর সবকিছুকে শূন্য দেখে।
আজগর আলি রেলদালানের দেয়ালে তখন ঠেস দিয়ে বসে পড়ে। মাথা
মাঝেমাঝেই ঘুরে উঠছে। মুখের মধ্যে লোনা পানির ধারা। আজগর আলি কী
অজ্ঞান হয়ে পড়বে! ষাট বছরের আজগর আলি তার সমস্ত জীবনীশক্তি
একত্রিত করে। অজ্ঞান হয়ে পড়া মানে এই অঞ্চলে আর কাজ না পাওয়া।
এমনিতেই বয়স্ক মানুষ, তার ওপর যদি সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে, তাহলে কেউই
তাকে কাজে নেবে না। কেই-ই বা বুড়া মেরে খুনের দায়ী হতে চায়!
দেয়ালে ঠেস দিয়ে চোখ বন্ধ করে রোদের মধ্যেই বসে রইল আজগর
আলি। কতক্ষণ পর্যন্ত খেয়াল নেই। হঠাৎ মনে হলো তার ওপরে একটা ছায়া
পড়েছে। চোখ খুলে দেখল তার ওপর ঝুঁকে আছে হাড়গিলে চেহারার এক
মানুষ। তাকে ডাকল লোকটা-- ও চাচামিয়া, ঘুমাইছ নাকি?
ঘোরের মধ্যে থাকা আজগর আলি প্রমে এই দৃশ্যের সাথে, এই রোদের
মধ্যে তার ওপর ঝুঁকে থাকা মানুষটির সাথে নিজের অবস্থানকে মেলাতে
পারে না। সে ভাষাহীন তাকায়। লোকটা আবার বলে-- ঘুমাইছ নাকি?
এবার সাড়া দিতে পারে আজগর আলি। দুর্বল স্বরে বলে-- না বাহে, খুব
ঝালো রোদ তো, তাই মুই চোখ বুজ্যা রাখিছি।
ও! লোকটা কিছুক্ষণ তার নিজের গালে হাতের তালু ঘষে-- তুমি কি
কামলা খাটতে আইছ? ধান কাটার কামে?
এবার ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে আজগর আলি-- হ্যাঁ বাহে!
লিব্যান মোক কামে?
হামি কীভাবে কামে লিবো! হামার কী আর জোত-জমি আছে! বলে
লোকটা হেসে ওঠে। আর আজগর আলি আবার ঝিমিয়ে পড়ে।
লোকটার চোখে আজগর আলির এই ঝিমিয়ে পড়াটাও এড়ায় না। সে
অল্প হাসে-- হ্যাঁ, হামার জমি-খ্যাত নাই। তয় হামি তোমাক কামলার কাম
জুটায়া দিবার পারি। মানে হামি জোতমালিকের কামলা সাপ্লাই করি।
কামলার ঠিকাদারিও কবার পারো।
আজগর আলি ফের সতেজ হবার চেষ্টা করে-- তো দ্যান বাহে! হামাক
কাম দ্যান!
তা কাম তোমাক হামি দিবার পারি। কিন্তু মজুরি তো তুমি অন্য জুয়ান
কামলার সমান পাবা না। তুমি খুব বেশি হলে রোজ পাবা চল্লিশ ট্যাকা।
ক্যান বাহে, এখন তো কামলার দর তিন কুড়ি ট্যাকা। মোক এত কম
দিব্যান ক্যান!
কম! কম আবার হলো কই! তোমাক তো কেউ কামেই লিতে চায় না।
এই বয়সের কামলা কি কেউ লিবার চায়? তুমি এক কাম করো। এই চল্লিশ
ট্যাকা রোজে কামে লাগো। ছানাউল্লাহ মাস্টারের জমির ধান কাটো। তাঁই
লোকখান ভালো। খাওয়া-দাওয়া ভালো পাবা।
দোনোমোনো করে রাজি হয় আজগর আলি। তার তো ফেরার পথ
নেই। সে নিজেকে নিজের দুই পায়ের ওপর দাঁড় করায়। বেডিং-ঝোলা তুলে
নিয়ে বলে-- চলেন বাহে! চল্লিশেই সই।
খাড়াও, খাড়াও! আমার কমিশনের কথাটা ঠিক করো।
কমিশন! সে আবার কী জিনিস!
লোকটা বলে-- হামি তোমাক কাম জুটায়া দিলাম। নিয়ম হলো, তুমি
হামাক কমিশন দিবা। তোমার চল্লিশ টাকার তিন ট্যাকা হামার।
তার মানে তার রোজ সাঁইত্রিশ ট্যাকা। আজগর আলি এমন কথা
কোনোদিন শোনেনি। দশ বছরে এত বদলে গেছে দুনিয়া আর দুনিয়াদারি!
তার মুখ ফুটে বেরোয়-- এইডা আবার কেমন কথা বাহে! মানুষের হক মারি
খাওয়া!
লোকটা চটে যায়-- এর নাম হক মারা না। এর নাম কমিশন। এইডা
এই দুনিয়ার নিয়ম। তুমি যদি নিয়ম না মানো তাহলে কাম জুটাতে পারবা
না। কমিশন দিলে কাম পাবা। তাহলে তোমার লাভ, হামারও লাভ।
আজগর আলি রাজি হয়ে যায়।
৩.
কেননা আজগর আলির রাজি না হয়ে উপায় থাকে না। কেননা আজগর
আলিদের জীবনে অন্যরকম কিছু ঘটে না। তারা অন্য কিছু ভাবার অবকাশও
পায় না। আর আজগর আলিরা অংকে ভীষণ কাঁচা। অংকে তাদের ভয়ও খুব
বেশি। তাই অংক না কষেই আজগর আলি কাজে যোগ দেয়। কিন্তু অংক
তো তাকে ছাড়ে না।
তারপর আজগর আলি পরবর্তী সাতাশ দিন তিলকপুর নিবাসী
সানাউল্লাহ মাস্টারের ফসলের জমিতে কাজ করে। পুরো সাতাশ দিনই সে
কাজ করতে পারে। তার মাথা ঘোরা, তার চোখ ঘোলাটে হয়ে আসা, তার
বিনোদনের লুডু-মোমবাতিবিহীন জীবন-- এই সবকিছুকেই যন্ত্রবৎ অস্বীকার
করে আজগর আলি সাতাশ দিন কাটিয়ে দেয়।
সন্ধ্যার পরপরই এই এলাকায় হুঁকো ঘিরে এক-একটা আসর বসে।
ফসলের অবস্থা, আকাশের শিলমেশানো বৃষ্টির ভয়, নৌকা না ধানের শীষ
এইসব নিয়ে গল্প হতে হতে কেউ কেউ গলা ছেড়ে হয়তো গেয়ে ওঠে চারপাঁচ
কলি ভাটিয়ালি গান। হুঁকোর আসরে সবাই খুব তাড়াতাড়ি সমান সমান
হয়ে উঠতে পারে। মালিক-জোতদার-কিষাণের ঠোঁট একই হুঁকোর ফুটো
থেকে নেশার খোরাক টেনে নেয়। তৃপ্তিও সবার একই রকম। তৃপ্তির
প্রকাশও।
আজগর আলির জটলা-এড়ানো স্বভাব এরা কয়েকদিনেই বুঝে নিয়েছে।
তাই সে যখন হুঁকোর আসর থেকে একটু দূরে বসে ঘোলা চোখে অন্ধকার
মাপে, তখন কেউ নেহায়েত দরকারি কথা ছাড়া তাকে বিরক্ত করে না।
ছেলের বউ তার ছেলে-মেয়ে দুটো নিয়ে কীভাবে এখন দিন কাটাচ্ছে,
সেই চিন্তা মাঝেমাঝেই আক্রমণ করে আজগর আলিকে। মাঝেমাঝে ভাবতে
ভাবতে অনেক দূর ভেবে ফেলে আজগর আলি। এই এলাকার সবরি
কলাগুলো খুব হৃষ্টপুষ্ট। স্বাদেও দারুণ। আর জিয়োল মাছ বেশ পাওয়া যায়।
আজগর আলিরা যাকে কানছা বলে জানে। আর জানে, এই মাছ বড়ই
রক্তবর্ধক, বলবর্ধক। তো হঠাৎ আজগর আলি নিজেকে জেগে থাকা স্বপেড়ব
কিংবা খেয়ালে ভাসায়-- ধরো কাইল সকালেও যদি মুই কাম ছাড়িয়া রওনা
করি, কামের মজুরি, দুই ছড়ি সবরি কলা, মুখঢাকা মাটির হাড়িত
পানিজিয়ানো এককুড়ি কানছা মাছ। নাতি-নাতনি দুইজনার গতরে তেজ খুব
কম। কানছা মাছ বলবর্ধক আর সবরি কলা দারুণ সুস্বাদু, পুষ্টিকর। তো
জিয়োল মাছ আর সবরি কলা আর মজুরির পকেট ভর্তি টাকা নিয়ে যদি ভোর
ভোর উঠে পড়া যায়, তিলকপুর স্টেশনে পৌঁছে চিলাহাটির ট্রেন ধরে দুপুরের
মধ্যে সোজা ডোমার। সেখানে কোনো হোটেলে চারটে ডাল-ভাত খেয়ে বাসে
উঠলে তিস্তাঘাট। নদী সাঁঝ সাঁঝ পেরোলে ভ্যানে ঘণ্টা খানেক। তারপর
হাঁটাপথ। নিজের ভিটায় পৌঁছাতে খুব বেশি হলে রাতের নয়টা কিংবা
দশটা। যদিও গাঁয়ের রাত দশটা মানে নিশুতি রাত, তবু নিজের গাঁয়ে রাতের
দশটাই কী আর এগারোটাই বা কী!
এই পর্যন্ত, জেগে থাকা স্বপেড়ব, খুব ফুরফুরে মেজাজে পেরিয়ে গেল
আজগর আলি। কিন্তু তারপরেই তার ফুরফুরে স্বপেড়বর মধ্যে আশঙ্কা টলমল
করে। ধরো, বাড়ি গিয়ে সে দেখল, কোনো ঘরে আলো নেই। সব সুনসান।
তবে কি বউমা আর নাতি-নাতনি দুইজনা ঘুমে একেবারে লছপছ! ধরো,
আজগর আলি ডাকে-- কই বাহে বউমা, এট্টু উঠো দেখি-- কিন্তু কোনো শব্দ
আসে না আড়মোড়া ভাঙার। অপেক্ষা করেও আলো জ্বলে না ঘরে। তখন
আজগর আলি জোর শব্দ করে দরজায়। তবু দরজার ওপাশ থেকে কারো
জেগে ওঠার শব্দ ভেসে আসে না। তখন সে দেশলাই জ্বালে। দেখতে পায়
দরজা ভেতর থেকে নয়, বন্ধ বাহির থেকে। তার দরজায় শিকল তোলা।
দেখেই কেঁপে ওঠে আজগর আলির বুক। এদিকে তার হাঁক-ডাকে পাশের
ঘর থেকে কুপি হাতে বেরিয়ে আসে আয়নালের মা-- ওমা আজগর ভাই, মাস
ফুরানের আগেই ফিরলে যে বাহে!
আজগার আলি মুখে না বলে এমন ভঙ্গি করলো, যাতে বোঝা গেল
ভিটের জন্য, বউমা-নাতি-নাতনির জন্য তার বুকটা ভীষণ মোচড়াচ্ছিল। তাই
কাজের মাঝপথেই সে চলে এসেছে। কিন্তু তার বউমা আর নাতি-নাতনিরা
কই! তখন আয়নালের মা খানিকটা লজ্জা, খানিকটা সহানুভূতির সাথে জানায়
যে, তার ছেলের বউ এখন নাসির মুদির ঘরে। জেগে দেখা দুঃস্বপেড়বর মধ্যেই
এই খবর শুনে স্তব্ধতায় আμাšও হয় আজগর আলি। দুঃস্বপেড়বর খেয়াল আরো
বাড়াতে তার ভয় করে। তবু সে এগিয়ে নিয়ে চলে দুঃস্বপড়বকে। এখন তার
বুকে ভর করেছে রাজ্যের উদারতা। কল্পনার মধ্যে আজগর আলি অনুনয়ের
গলায় বলে-- এট্টু মোর হয়্যা নাসিরের ঘরোত যাব্যান ভাবি!
এই রাতোত! আয়নালের মায়ের গলায় সংশয়। একটু ঝাঁঝালো গলায়
বলে-- ফির তার পাছোত যাওয়ার দরকারখানই বা কী! তাঁই তো নিজের
রাস্তা খুঁজি নিছে।
আজগর আলিও কী তা বোঝে না! কিন্তু তার বুক যে পোড়ে! তার
নাতনিটা ল্যাগবেগে পুতুলের মতো। কী দুর্বল! কী মায়াময়! তার নাতিটা
হাত ভেঙে নুলো হবার উপμম। গরুটা কিছুদিন উঠোনে ছিল। তার জন্যও
দরদ। সে তাই অনুরোধ করে আবার-- তাও তুমি একবার যান ভাবি! এই
সবরি কলা, এই যে কানছা মাছ, ছোঁড়া-ছুঁড়ি দুইডার গতরে জোর নাই। আর
এই টাকাগুলান দিব্যান বউমার হাতোত। এনজিও-র কিস্তি শোদ দিয়া গরুডা
ছাড়ান করুক। ছোঁড়া-ছুঁড়ি দুইজন গাই বিয়ান দিলে দুধ খাইবার পারিবে।
আর এই যে ট্যাকা, ছোঁড়াক টাউনোত ডাক্তারের কাছোত লিয়া যাবি। অরা
সক্কলে সুখে থাকিলেই হামার শান্তি ভাবি! হামারই যে রক্ত অরা!
এই পর্যন্ত কল্পনা করতে করতেই দুঃখে-কষ্টে-উদারতায়-সর্বস্ব হারানোর
বেদনায় আজগর আলির চোখের পানিতে দাঁড়ি ভিজে যায়। অন্ধকারে বোঝা
যায় না, তার দাঁড়ি থেকে ঝরে পড়া কয়েক ফোটা জল তার বুকের কাছের
গেঞ্জিও ভিজিয়ে দেয়।
এই সময় ভেতরে বাড়ি থেকে খবর আসে, রাতের রানড়বা হয়ে গেছে।
কামলা-কিষাণরা খেতে বসুক। আর আজগর আলি এই কয়দিনে চিনে ফেলা
পুকুরের ধাপগুলো অন্ধকারে বেয়ে নেমে মুখ-হাত ধুয়ে সঙ্গী কিষাণদের সঙ্গে
খেতে বসার উদ্যোগ করে।
ঐ কল্পনাই করেছিল। মাঝেমাঝেই করে। কিন্তু তাই বলে মাঝপথে কাজ
ছেড়ে আজগর আলি ঘরে ফেরে না।
সাতাশ দিন পরে ছানাউল্লা মাস্টারের ধান কাটার কাজ শেষ, মাড়াই
শেষ। পোয়াল আর ধান আলাদা আলাদা করে গুছিয়ে পোয়ালের ঠিক্কাছড়া
আর ধান গোলাবন্দি করা শেষ। এবার আজগর আলিদের মতো রোজের
কামলাদের বিদায়ের পালা। ছানাউল্লা মাস্টার লোকটা ভালো। আগের রাতে
বিদায়ীদের জন্য গরুর গোস্ত রানড়বা হয়। বোল্ডার গরুর লালচে ঢেলার মতো
টুকরো। তার সাথে শুকনো মরিচপেষা ছড়ানো প্রচুর ঝোল আর হল্যান্ডের
আলু দুই ফাঁক করে সেই ঝোলে ভাসানো। খুব ঝাল, খুব স্বাদ। ঝালের
চোটে তারা যখন উস-আস্ করে টাকরায় শব্দ তোলে, তখন বাড়ির ভেতর
থেকে মিষ্টি পায়েশ আসে। আসলে পায়েশ নয়, মিষ্টি জাউভাত। তাতে
আজগর আলিদের তেমন তফাৎ মনে হয় না। তারা মাংস-ভাতের পর মিষ্টানড়ব
পেয়ে যথেষ্ট খুশি এবং কৃতজ্ঞও।
সকালে ছানাউল্লা মাস্টার পাই পাই করে সবার পাওনা বুঝিয়ে দেয়।
এক শ টাকি, দশটাকি, পাঁচটাকি মিলিয়ে সাতাশ দিনের পরিশ্রমের পাওনা
তাদের তাৎক্ষণিক তৃপ্তি এনে দেয়। আজগর আলি বহুদিন পরে দুই হাতের
আঙুলে এতগুলো নোট স্পর্শ এবং গোনার সুযোগ পায়। আর তখনই তাকে
জাপটে ধরে অংক।
কমিশনের টাকা বাদ দেবার পরে, আর বিড়ি-গুয়া খরচের জন্য আগাম
যে কয়টা টাকা মাস্টারের কাছ থেকে নিয়েছিল, সেইগুলি বাদ দেবার পরেই
তার সামনে এসে হাজির হয় এই টাকা দিয়ে অবশ্যকরণীয়গুলোর তালিকা।
তার কাঁথা, লুঙ্গি, গেঞ্জি মিলিয়ে বান্ডিল বাঁধা শেষ, তার আরো ঝকমকে
হয়ে ওঠা কাস্তে দুটোকে পাটের ফেঁসোতে পেঁচিয়ে চটের ব্যাগে ঢোকানো
শেষ। এখন কাঁথা-লুঙ্গির বান্ডিল আর চটের ব্যাগের পাশে ছানাউল্লা
মাস্টারের পৈঠায় বসে আজগর আলি টাকা গোনে। গোনে আর খাতওয়ারি
আলাদা করে। প্রমে বউমার গরুটা ছাড়িয়ে আনার টাকা। মোট টাকা থেকে
সেই টাকাটা আলাদা করে আজগর আলি। বাম হাত সব টাকা। অন্যহাতের
আঙুল দিয়ে সেই পরিমাণটিকে আলাদা করে সে। তারপরে নাতিটার ভাঙা
হাড়ের চিকিৎসার জন্য টাকা। কিন্তু এই পরিমাণটায় পৌঁছানোর আগেই
আজগর আলি সবিস্ময়ে খেয়াল করে তার বাম হাতে আর টাকা নেই। অংক
তখন আজগর আলিকে ধন্দে ফেলে দেয়। সে বিড়বিড় করে-- তারপরে ধরো
ঘরোত ফিরার ভাড়া, একছড়ি সবরি কলা, এক কুড়ি কানছা মাছ, তারপর
ধরো ঘরের চাল-ডাল, তারপর ধরো...।
এতগুলো দিন কাজ করল আজগর আলি। কাজের শেষে মোট কত টাকা
পাবে, সে অংক করা হয়নি। সেই টাকা তার প্রয়োজন কতখানি মেটাতে
পারবে সেটাও ভাবা হয়নি।
কিন্তু এখন টাকা নিয়ে বিদায় নেবার সময় সে হিসাববিজ্ঞানের
গোলাকধাঁধায় পড়ে যায়। কিস্তি, ভাঙা হাত, চাল-ডাল, নাতি-নাতনির একটু
শখ, ঘরফেরত খরচ। এই টাকা দিয়ে কি সব হবে না? সে আবার বামহাতে
টাকা নিয়ে ডান হাতের আঙুল দিয়ে গুনে গুনে টাকাগুলোকে আলাদা আলাদা
করতে চায়। আবার খাতগুলো শেষ হবার আগেই দেখে যে তার বাম হাত
শূন্য। আজগর আলির মাথা একটু ঘুরে ওঠে। সে টাকার হিসাব বাদ দিয়ে
ঘোলাটে চোখে রোদের মধ্যে শুয়ে থাকা ন্যাড়া মাঠগুলো দেখে। কিছুক্ষণ
পরে আবার খাতওয়ারি হিসাব করে টাকাগুলো গুনে আলাদা করতে যায়।
এবং আবার খাতগুলো শেষ হবার আগেই তার টাকা শেষ হয়ে যায়।
আজগর আলির মাথাঘোরা আরো একটু বাড়ে। রোদপোয়ানো ন্যাড়া
মাঠগুলোর দিকে আবার কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে সে। তারপর আবার খাতওয়ারি
টাকাগুলোকে হিসাব করতে যায়। তার এতদিনের পরিশ্রমের টাকা আবার
খাত শেষ হবার আগেই শেষ হয়ে যায়। তার মাথাঘোরা আরো একটু বেড়ে
যায়। ন্যাড়া মাঠের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার সময়ও আর একটু
বাড়ে।
তারপর আবার সে খাত হিসাব করে টাকা আলাদা করতে শুরু করে,
তার টাকা খাত শেষ হবার আগেই যথারীতি শেষ হয়, তার মাথাঘোরা আর
শূন্যদৃষ্টিতে ন্যাড়া মাঠের দিকে তাকিয়ে হিসাব মেলানোর চেষ্টা করা বেড়ে
চলে, বেড়েই চলে, বেড়েই চলে...
লেখক পরিচিতি
জাকির তালুকদার
জাকির তালুকদার এসময়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ গল্পকার। তিনি লেখেন অভিজ্ঞতা থেকে। এবং এই অভিজ্ঞতার জন্য তাকে গ্রামে যেতে হয়নি। তিনি গ্রামেরই মানুষ। এর সঙ্গে মেল বন্ধন ঘটেছে তাঁর বহুমূখী পড়াশুনার। তিনি শুরু থেকে সিরিয়াস গল্পকার। কোনো অর্থেই সখ করে লেখেন না। ফলে তাঁর পাঠকও তাঁর সঙ্গে হয়ে ওঠেন সিরিয়াস। সম্ভবত জাকির তালুকদারই সাহিত্যের সেই প্রাচীন বংশের নিঃশ্ব সন্তান যিনি সত্যি সত্যি লেখালেখির জন্য সব ছেড়েছেন। নিজেকে বাজী ধরেছেন। এবং তাকে পড়া ছাড়া পাঠের পূণ্যি অসম্ভব।
গল্পের পাশাপাশি লিখছেন উপন্যাস ও প্রবন্ধ। প্রথম উপন্যাস কুরসিনামা। মুসলমানমঙ্গল উপন্যাসের মাধ্যমে পাঠকমহলে পরিচিতি পান। তার সর্বশেষ উপন্যাস পিতৃগণ সম্প্রতি জেমকন সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে।
0 মন্তব্যসমূহ