মনিরা কায়েস
গলির চাপামুখে সন্ধের ছায়া জট পাকাচ্ছিল। পাশে আবর্জনা উপরানো একটা আঁস্তাকুড়। তিনটে কুকুর কী এক খাদ্য নিয়ে কাড়াকাড়ি করছিল। মাথার ওপর হাত বাড়ালেই টেলিফোনের মোটা তার, তার ওপর অজস্র ইলেকট্রিক তারের গ্যাঞ্জামে আকাশ প্রায় উধাও, পরিত্যক্ত ঘুড়ির টকটকে লাল লেজ কেবল পতপত করে উড়ে জানান দিচ্ছিল, বাতাসের বয়ে যাবার মতো জায়গা আছে যা হোক। রিকশাঅলা ঠিক একরকমই মুহূর্তে জানাল, আর যাবে না। আর যাবে না মানে !
অন্য সময় হলে সে খেপে উঠত। কিন্তু এখন এই চাপা গলির সংকীর্ণ মুখে যখন হাঁটাপথই প্রায় অসম্ভব মনে হচ্ছে, তখন আর কী করা, সে ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়ল। আঁস্তাকুড়ের ডান দিকে একটা আধাভাঙা রাস্তা নেমে গেছে। ওদিকেই যেতে হবে। দু’পাশের পাচিঁল-বেড়া সবকিছুতেই তীব্র ভেজা গন্ধ। আর রাস্তার মধ্যিখানে ইটের সারি দেয়া আছে চলার জন্য। আজ সারাদিন বৃষ্টি। বিকেলের দিকে যখন সে আর আসবেই না, এরকম এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে প্রায়, সে সময়ই অকস্মাৎ বৃষ্টি থেমে গেল। শেষ বিকেলের একটু লালচে ভাবও চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল যেন, শরাফত ভাই বললেন, কী যাবে নাকি ?
শরাফত ভাইএর উৎকন্ঠা অন্যখানে। আজ রাতে তুমুল আড্ডা হবে রুমে। অসীম তার কাস্টমসের এক বন্ধুর কাছ থেকে ক’বোতল দামী পানীয় জোগাড় করেছে, তার ওপর সঙ্গে থাকবে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শরাফত ভাইয়ের গুণমুগ্ধ দুই সুন্দরী তরুণী, যারা ভালো আবৃত্তি করে এবং ফ্ল্যাটারিতেও কম যায় না। তাদের একজন তো দিব্যি এই তুমুল বৃষ্টির ভেতর দুপর বেলায় শরাফত ভাইকে পদ্মার হাওয়া খাইয়ে নিয়ে এল। সে তখন গভীর ঘুমের আচ্ছাদনে ছিল। শরাফত ভাই এমনিতেই একটু উত্তেজিত, তাকে ঘুমোতে দেখে সজোরে ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠালেন, তারপর বললেন, নাজিম, তুমি এখনও ঘুমোচ্ছ ! দ্যাখো, কী সুন্দর দিন। দ্যাখো, অনুভব করো।
সে হুইস্কির গন্ধ ছড়ানো শরাফত ভাইকে দেখেই বুঝেছিল, ওই মেয়েটি, যার নাম শারমিন কি শর্মি, বেশ ভালোভাবেই কাৎ করেছে তাঁকে । সুতরাং আজ রাতে কবিতা আবৃত্তি কিংবা সাহিত্যের কী বাল ছেঁড়া হবে, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। সবটাই শেষ অবধি মদ ও মাংসে আটকে যাবে। আর এগুলোর ছবি যে সে ডকুমেন্ট হিসেবে রাখবে, তাও হবার নয়। শরাফত ভাইয়ের কড়া অনুরোধ, যত ছবি তোল আপত্তি নেই, কিন্তু বেসামাল কিংবা নারীঘটিত ছবি অবশ্যই নয়। তাই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের কিছু ছবি ছাড়া আর কিছু তোলা হয়নি গতকাল থেকে। যদিও সকালে অনেক রিকোয়েস্ট করেছে শারমিন না শর্মির বান্ধবীটি, তাদের ছবি তোলার জন্য। বাঙালীর স্বভাবই ঐ, বিনে পয়সায় যা পাওয়া যায়, তাতেই লাভ। অথচ সে যে অন্যান্য প্রফেশনাল ফটোগ্রাফাদের থেকে আলাদা, এ কথা কে বুঝবে। নেহাতই হাসানের ঠেলায় পড়ে এ কাজটা হাতে নিয়েছে এবং বেশ কিছু টাকার এডভ্যান্স সরাসরি দেয়ার কারণে সে আর কাজটাকে অবহেলা করতে পারছে না। তা’ বলে শরাফত ভাইয়ের পেছনে পেছনে এই সুদূর মফস্বলে চলে আসবে গত পরশুদিন, এটাও সে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। এর পেছনেও হাসানের হাত আছে। তার সোজা কথা, শরাফত ভাইয়ের সবরকম ছবিই তার প্রয়োজন। সামনের ফেব্রুয়ারির বইমেলায় একশো ছবিসহ শরাফত ভাইয়ের ওপর প্রামাণ্য গ্রন্থটি অবশ্যই হট ফেবারিট হবে। সুতরাং কোনও কিছুর প্রস্তুতি ছাড়াই তাকে আসতে হয়েছে একরকম। তবে সারাদিন কোচ জার্নির মতো একঘেয়ে জার্নি তাদের কাছে আর খারাপ লাগে নি বিএডিসির ধবধবে সাদা রাজহংসের মতো রেস্ট হাউসে ঢাউস ঢাউস রুম পেয়ে। চমৎকার টানা বারান্দার শেষ ঘর। ঘরের পেছনে অজস্র গাছ-গাছালির ভেতর দিয়ে চেষ্টা করলে শহররক্ষা বাঁধটা দেখা যায়। তারপরই নদী। এখন জল বেড়েছে ব’লে একটু ভরভরন্ত দেখায় তার শরীরটা, নইলে বছরের অধিকাংশ সময়ই কাড়িঁ কাড়িঁ বালি উজিয়ে শুয়ে থাকা। গতরাতে বৃষ্টি ছিল না ব’লে বেশ হাওয়া দিচ্ছিল, ঠিক পুরো না হলেও পৌনে এক বৃত্ত চাঁদ মেঘের ছানাপোনাদের নিয়ে হাসাহাসি করছিল রাজশাহীর আকাশে। শরাফত ভাইয়ের মেজাজ বেশ শরীফ ছিল সংবর্ধনা অনুষ্ঠান থেকে ফিরে, সোজা তাকে নিয়ে ছাদে উঠে গেলেন। ছাদে আবার তাজমহল গোলাপের টব সাজানো, বেশ বড় বড় গোলাপ ফুটেছে, নাকি শরৎকালের আভা কী ভাঁটফুলের গন্ধ, বোঝা যাচ্ছিল না, তবে মাদকতা ছিল সেই গন্ধে। শরাফত ভাই তাঁর পাঞ্জাবীটা খুলে রাখলেন রেলিঙে, দূরবর্তী নদীতে নিশ্চয়ই জলের শব্দ, না হয় কোথাও কারও গৃহস্থলী কাজে কোন ট্যাপ খোলা, বেশ ছপছপ শব্দ হচ্ছিল, যা জলের অগণন ঢেউয়ের শব্দ ছাড়া আর কিছু নয়। শরাফত ভাই তাঁর শাদাটে গাঁ চন্দ্রালোকে মেলে বললেন, নাজিম, বড় একা লাগছে এখন, বড় নি:সঙ্গ।
কেন ?
সে জানে কেন, তবু জিঙ্গেস করল। শর্মি না শারমিন মেয়েটির মসৃণ বাদামী রঙ, তার পাতলা জর্জেট ফেটে উপচেপড়া বুক কিংবা কটাচোখের বিহ্বলতা শরাফত ভাইকে কাতর করে তুলছে। অথচ মেয়েটি শরাফত ভাইয়ের ছোট মেয়ের সমবয়সী হবে বোধকরি। কী আশ্চর্য ! এর আগে একবার, সে তখন ময়মনসিংহে, শরাফত ভাই গিয়েছিলেন স্থানীয় এক কবিতা উৎসবে। নাজিমের সাংবাদিক বন্ধু আতিকের ভাগনীকে দেখা গেল ঘুর ঘুর করছে শরাফত ভাইয়ের পেছন পেছন। মেয়েটি কালো, তবে বেশ আকর্ষণীয়, বড় বড় চোখ। শরাফত ভাই কী করে যে তাকে মোহবিষ্ট করলেন, মেয়েটি নাকি সে রাতে তাঁর বাংলোয় যাবেই যাবে, শেষ-মেষ আতিককে রাখা হল ভাগনি পাহারায়। এদিকে সে গেছে ছবি তুলতে, তখন প্রায় রাত সাড়ে এগারটা, শরাফাত ভাই তো রেগে পানপাত্র ছুঁড়ে ফেললেন বারন্দায়, ওকে বললেন, নাজিম, তুমি যাওনা একটু । গিয়ে নিয়ে এসো । কিছু না, জাস্ট একটু গল্প করব। জানোই তো মেয়েটি কীরকম ভক্ত আমার।
সে বলল, বাদ দেন ওসব। জানেন তো মফস্বল শহর। একটু কিছু জানাজানি হলে ঝামেলা বেঁধে যাবে। এবং সত্যি সত্যিই ঝামেলা বেঁধেছিল। মেয়েটির প্রেমিক আনন্দমোহন কলেজের ছাত্র, গান-টান গেয়ে নাম করেছে বেশ, সে তো বেশ কিছু ছেলে জোগাড় করে ভোরবেলা এসে হাজির শরাফাত ভাইকে রাম-ধোলাই দেবার জন্য। তখন সে, আতিক আর শামসুল মিলে যদি তাঁকে এসকর্ট করে ঢাকাগামী ট্রেনে না তুলে দিত, তাহলে অপমানিত শরীর নিয়ে ফিরতে হত তাঁকে। সে কথা কি শরাফাত ভাই মনে রেখেছেন ? মনে রাখলে পুনরায় এই বিড়ালাক্ষী মেয়েটির জন্য দীর্ঘশ্বাসে বিচরণ কেন তাঁর । আসলে কবি-লেখকেরা বোধহয় কোনও পথেই সুখ পান না। এই যেমন ইফতেখার স্যার, যাঁর ছোটগল্প রীতিমতো বাঙলা সাহিত্যের অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে স্বীকৃত এখন, সেই ইফতেখার স্যার কিনা কান্দুপট্টিতে গিয়ে হারিয়ে আসেন তাঁর বাই ফোকাল চশমা, পরে তাঁরই এক ছাত্র, দুর্ভাগ্যক্রমে সেও সেদিন ছিল পতিতাগমনের যাত্রী এবং ঐ একই রমণীর ঘরে, সে’ই বাই ফোকাল চশমাটি উদ্ধার করে পরদিন ক্লাসে নিয়ে হাজির। পরে সে রসিয়ে রসিয়ে গল্প করেছে শাহবাগে তাদের সামনে। চশমাটি পেয়ে নাকি স্যার খুবই আনন্দিত কিন্তু সেই সঙ্গে কিছুটা ক্ষুব্দও। কেন সে অতগুলো ছাত্রের সম্মুখে চশমা ফিরিয়ে দিল, যদিও সে অভয় দিয়েছে কাউকে বলে নি, তবুও । এবং শেষে নাকি একটু অম্ল-মধুর উপদেশও দিয়েছেন, ‘ঘন ঘন যেও না বুঝলে। ওতে অভ্যেস খারাপ হয়ে যায়।
কী হাস্যকর উপদেশ ! নাজিম খেয়াল করেছে, এদিক থেকে শরাফত ভাইয়ের রুচি তুলনামূলকভাবে ভালো। অন্তত বিভিন্নভাব কিশোরী-প্রেমের কারণে হলেও তাঁর হাত দিয়ে কিছু ভালো কবিতা বের হয়ে আসছে।
শরাফাত ভাই বললেন, কেন জানি না এই চন্দ্রালোক, জলের শব্দ, সব কিছুর ভেতর যেন শূন্যতার বল কেবল লাফালাফি করছে, দেখতে পাচ্ছি।
সে বলল, চলুন ঘুমোই। ঘুমোলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
: হবে না । হবে না । কিছু ঠিক হবে না। তুমি জানো না নাজিম, আমার চারপাশে কেবল শূন্যতা । কেবল স্বার্থপরতা । আমাকে কেউ ভালোবাসেনা। কেউ না।
: দূর, কী যে বলেন ! ভাবী ? ভাবীকে তো দেখি আপনাকে কী চমৎকারভাবে আগলে রাখেন।
: ও’ তো আমার সন্তানদের মা। কখনও কখনও আমারও মা । কিন্তু নাজিম, সে তো আমার প্রেমিকা নয় !
কথাটা শুনে নাজিমের মাথায় কী রকম যেন আগুন বা বিদ্যুৎ জাতীয় কী একটা ঘুরপাক খেয়ে সশব্দে ফেটে পড়ল। সুন্দরী প্রেমিক যখন পরবর্তীতে স্ত্রী হয়, সন্তানদের মা হয়ে বিপুলাবক্ষ এবং স্বাস্থ্যবতী আকার ধারণ করেন – তখন তিনি হন অভিভাবক গোত্রধারী, প্রেমিকা নন। তার ইচ্ছে করছিল, শরাফাত ভাইয়ের ঐ টসটসে লাল ঠোঁট, যা এখন বিড়ালাক্ষী মেয়েটির বাদামী পলকা শরীরের স্বাদ নেবার জন্য উন্মুখ, এক ঘুষিতে ফাটিয়ে ফেলে। কিংবা লাথি মেরে এই তিনতলার ছাদ থেকে মাটিতে ছুঁড়ে দ্যায় তাঁর বহুভোগী প্রায়বৃদ্ধ শরীর। কিন্তু সে এর কিছুই করে না। বরং শরাফাত ভাইকে একা রেখে সে নেমে আসে ছাদ থেকে। কিন্তু ঘুম হয় না। খোলা জানালার আলো, আতা কী ভাঁটফুলের গন্ধ ওকে ঘুমোতে দেয় না অনেকক্ষণ। ছাদে মানুষ হাঁটার শব্দ হয়। বাতাবি লেবুর গাছে নিশাচর পাখির পাখসাট শোনা যায়। কোথায় যেন কাদের ছেলে কেঁদে ওঠে, রেস্টহাউসের কোলাপসিবল গেট ক্যাঁচ ক্যাঁচ ক’রে বন্ধ হয়, সিঁড়িতে পদশব্দ, কারা যেন ছাদে ওঠে। ওঠে আর নামে। শরাফাত ভাইয়ের সেই শূন্যের বলগুলোর মতো। নামে আর ওঠে। এরকম এক নামা-ওঠার টেন্স মাথায় রেখে এক সময় সে ঘুমিয়ে পড়ে।
: : :
কিন্তু সকাল আর হয় না। ভোরের আকাশ অকস্মাৎ একদল মেঘছত্রীসেনা দখল ক’রে ফেলায় আলো-হাওয়া সব ছত্রভংগ হয়ে যায়। সে বাথরুম থেকে বের হয়ে শরাফাত ভাইয়ের রুমের দিকে যাবে কিনা ভাবতেই একটা জংলী প্রিন্ট শাড়ি চোখের সামনে দুলে উঠল। সোমনাথ হোড়ের ছবি থেকে কী বের হয়ে এল ওই প্রায়ান্ধকারিণী ? – নাকি নিছক দৃষ্টিভ্রম ! এই ব্ল্যাক এ্যান্ড হোয়াইট সকাল আর তাকে ভেঙে এগিয়ে যাওয়া প্রিন্টেড যুবতী কিছু রহস্য ছড়িয়ে গেল বোধের ভেতর। মেয়েটি কি শরাফত ভাইয়ের ঘর থেকে বের হয়ে এল না ! আর এলেই বা তার কী ! সে কি এখানে গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছে নাকি এসেছে ছবি তুলতে ।
তারপর তার মাথা একেবারে পরিষ্কার হয়ে আসে। পরশুর আগের দিন সি হুট করে রাজশাহী আসার যে সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেলেছিল তার পেছনে অবশ্য দুটো কারণ ছিল :
ক. হাসানের প্রামাণ্য এ্যালবামের জন্য শরাফাত ভাইয়ের ছবি তোলা ।
খ. জাকিরের পরিবারের সঙ্গে দেখা করা।
যদিও সে জানে না, তাঁরা কেউ আদৌ সেই বাড়িতে আছেন কিনা । জাকিরের সঙ্গে যখন এসেছিল, সেটা প্রায় সাত/আট বছর আগের কথা । তারা তখন কেবল ঢাকা ভার্সিটিতে ঢুকেছে। রক্ত গরম । সে আবার আন্তর্জাতিক এক ফটো কম্পিটিশনে পুরষ্কার পেয়ে গেছে সেই সময়েই । জাকিরই পরামর্শটা দিল হঠাৎ। বলল, ছবি তুলবি ? চল আমার সঙ্গে।
সেবার তারা পুরো সাতটা দিন একসঙ্গে কাটিয়েছিল। সোনা মসজিদ, জলহীন বরেন্দ্র অঞ্চলের রুক্ষভূমি, আমবাগান, আমনূরার সাঁওতাল পল্লী। সে প্রচুর ছবি তুলেছিল। কিন্তু তাকে আকর্ষণ করেছিল আসলে জাকিরের বাবা-মা। ল্যাবরেটরি স্কুলের এ্যাসিসটেন্ট হেডমাস্টার তার বাবা, গোটা বাড়িকে তাঁরা ক’রে রেখেছেন স্মৃতিশালা। জাকিরের বড়ভাই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ। রাজশাহী ভার্সিটির ছাত্র ছিলেন। সিতলাইয়ের কাছে এক বড় ধরণের অপারেশনে তিনি শহীদ হন। জাকিরের বাবা-মা তাদেঁর শহীদ ছেলের সমস্ত স্মৃতিচিহ্ন চমৎকারভাবে আগলে রেখেছেন। সে দেখেছিল, আজাদ ভাইয়ের চিলেকোঠাটা। রাশি রাশি বই । চে গুয়েভারের ছবি। আলনায় খদ্দরের পাঞ্জাবি, চটের ঝোলা, কোলপুরি স্যান্ডেল । ছাদের দিকের দরজাটা খুলে দিলে চমৎকার আলো আসে, বাতাসে পর্দার কম্পন ধরে।
জাকির বলেছিল, দ্যাখ নিজাম, আমার সমস্যাটা একটু ভেবে দ্যাখ। ভাইজান ছিলেন ব্রিলিয়ান্ট। কিন্তু আমি তা নই। সে ভালো ক্রিকেট খেলত, আমি এগুলোর কিছুই পারিনা। তবু দ্যাখ, বাবা চান আমি ফার্স্ট ক্লাস পাবার জন্য পস্তুতি নেই, মা চান কখনও সখনও ভাইজানের ক্রিকেট ব্যাটটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।
সে বলেছিল, অসুবিধে কী, চেষ্টা কর।
জাকির ওর ওপর বিরক্ত হয়েছিল মনে হয়। বলেছিল, আমার দ্বারা কিছু হবে না। তুই দেখে নিস। প্রয়োজনে নিজের জীবনটা কেবল দেশের জন্য দিয়ে যেতে পারি, ব্যস এটুকুই। এবং জাকির তার প্রমাণও রেখে গেছে নীলক্ষেত মোড়ে। যেন জীবনটা এমন কিছু নয়, এইভাবে অবহেলায় শরীরের রক্ত-মাংস-মজ্জা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। আসলে ভেতরে ভেতরে মুখচোরা জাকির যে এতদূর এগিয়ে গিয়েছিল তা সে ঠিক উপলব্ধি করতে পারেনি। নইলে সে কি একটু সাবধান করে দিতনা, যখন ঘটনার আগ থেকেই শোনা যাচ্ছিল চট্টগ্রাম থেকে বেশ কিছু আর্মড ক্যাডারের লোকজন এসে অবস্থান নিয়েছে তিন-চার জায়গায়। সে যে অবশ্যি চেষ্টা করেনি তা নয়, তুমুল গোলাগুলির মধ্যে তার মোটরসাইকেলের চাকা পাংচার হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সেটা ফেলেই দৌড়ে এগিয়ে যায় আর্টস বিল্ডিং এর দিকে। কেননা এফ, রহমান হলের ওদিক থেকে যে মিছিলটা আসবার কথা, সেটার লিডে থাকবে জাকির, সে শুনেছে কিছুক্ষণ আগেই। চতুর্দিকে শিস কেটে গুলি উড়ে যাচ্ছে, বোমা ফাটছে, আর্তচিৎকার আর উল্লাসের ভেতর দিয়ে সে ডানে আর্টস বিল্ডিং ফেলে আরেকটু সামনে এগিয়ে যেতেই দেখতে পায়, এগিয়ে আসা মিছিলটা ততক্ষণে খন্ড খন্ড দাঙ্গায় রুপ নিয়েছে। আর ঠিক এরকম মুহূর্তে সে আবিষ্কার করে জাকিরকে। প্রথমে সে বুঝতে পারেনি ওই রক্তাক্ত শরীরটা জাকিরের। ইউসুফই বলল । সেও ছবি তুলছে। সে’ই বলল, নাজিম ভাই, ড্রেনের এপাশে কে পড়ে আছে দ্যাখেন তো !
সে এগিয়ে দ্যাখে, জাকির। শরীরে গুলির ক্ষত। সেইসঙ্গে দু’হাতের রগ কাটা। মৃত জাকিরের দৃষ্টি ছিল তখন খোলা। যেন দেখতে চেয়েছিল হত্যাকারীর মুখ।
আচ্ছা, সে রাতে সে কি আর ঘুমোতে পেরেছিল ? সে মনে করতে পারে না । তবে জাকিরের শরীর আর তার চারপাশের ঝরাপাতার স্তূপ, যার ওপর ছোট-খাট একটা রক্তের নালা তৈরি হয়েছিল, এই দৃশ্য মাঝে-মধ্যেই তাকে স্বপ্নে কিংবা জাগরণে ক্ষত-বিক্ষত করে তোলে। একজন মানুষের শরীরে এত রক্ত থাকে ! এত রক্ত !
ইটের ওপর পা রাখতেই কর্দমাক্ত জল ভুড়ভুড়ি কাটে পায়ের নিচে। এদিকটা অজস্র বাড়িঘরের চাপে এখন প্রায় শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা যেন। এই ক’বছরে এত বাড়িঘর উঠেছে চারদিকে যে আগের সেই সিপাইপাড়া আর নেই। তবে পুকুরটাকে পাওয়া যাচ্ছে বাম হাতে, সুতরাং ডানদিকে অনিবার্যভাবে থাকবার কথা এ্যারোমা ব্রেড এ্যান্ড বিস্কিটের কারখানা, তার পাশে হ্যান্ডসাম টেইলার্স, সূর্যতরুণ স্পোর্টিং ক্লাব কিন্তু এগুলোর চিহ্নমাত্র নেই সেখানে। পরিবর্তে দেখা যাচ্ছে চারতলা বিল্ডিং এর কন্সট্রাকশন চলছে। এই চাপা গলির ভেতর এতবড় বিল্ডিং উঠে করবেটা কী, যেখানে রিকশা ঢুকলে আর বেরোবার পথ খুজেঁ পায় না ! নাকি রুটির কারখানা, টেইলার্স-এর মতো এইসব পুরনো বাড়ি, তাদের ছিপছিপে পথও একদন অদৃশ্য হয়ে যাবে ! স্বাভাবিক তো কিছু নয়। তবে সামনের পরিত্যক্ত মন্দিরটিকে ঠিকঠাক মতো পাওয়া গেলে সে হাঁফ ছেড়ে বাচেঁ। চুড়োর বটগাছটি এখন আর বামন নয়, ঢেংগাকৃতি ধারণ করেছে। মন্দির পেরোলেই জাকিরদের বাসা। ঠিক আগের মতোই আছে। সেই কাঠের গেট, জুঁইলতা, গন্ধরাজ, স্বর্ণচাপা, শেফালি গাছ। সদর দরজা খোলাই ছিল। সে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করতেই ভেতর থেকে একজন বেরিয়ে এল। বাবলী না ? ফ্রকের খোলস ছেড়ে এখন কামিজে উত্তীর্ণ হয়েছে ব’লে আর গোলগাল নয়, এখন রীতিমতো কৃশকায়া। একটু কুজোও। বলল, আপনি, আপনি নাজিম ভাই না ?
সে হ্যা সূচক কিছু বলার আগেই মেয়েটি অস্ফুট স্বরে ‘ভেতরে আসুন’ বলে বৈঠক ঘরে বাতি জ্বালিয়ে দিল। অন্ধকার এখন গাঢ়। নোনাধরা দেয়াল তার ঈষৎ ভেজা গুমোট গন্ধ আর কেমন একটা ধোঁয়াটে বিষণ্ণতা তাকে অগ্রিম বেদনার আভাস দিল। মেয়েটি বলল, শুনেছি ঢাকা থেকে শরাফত ভাই এসেছেন। কিন্তু আপনি এসেছেন, তা তো শুনিনি।
: আসলে আমি এসেছি ছবি তুলতে।
: কিসের ছবি ? রাজশাহীর এইসব কৃতী সন্তানদের ছবি ?
: ঠিক তা না। সে একটু মুশকিলে পড়ে গেল, আসলে এসেছি শরাফত ভাইয়ের জন্য। তাঁর ছবি নিয়ে একটা এ্যালবাম হচ্ছে, তাই।
মেয়েটি আধো আলো আধো অন্ধকারে এক ধরণের রহস্যময় হাসি ঠোটেঁ ঝুলিয়ে ভেতরে চলে গেলে সে বৈঠকঘর ছেড়ে ভেতরের বারন্দায় বের হয়ে আসে। রান্নাঘরে আলো জ্বলছে। উঠোনে দোপাটির ঝাড়ে তীব্র ঝিঝিঁর শব্দ, ফলশা গাছের বড় বড় পাতায় এখনও কিছুটা সন্ধে রঙ লেগে আছে যেন। বারন্দার শেষ মাথায় ইজি চেয়ারের ওপর একটা দুধশাদা বেড়াল উলের বল হয়ে শুয়ে আছে। জাকিরের সেই ‘বুড়ি’ নয় তো ? না: বরং তার জ্ঞাতিগোষ্ঠির কেউ হতে পারে। সে নি:শব্দতা ভাঙবার জন্য একটু কেশে উঠে বেড়ালটাকে জাগিয়ে দিল। বাবলী চা হাতে হেঁটে এল তক্ষুণি। পিরিচে নারকোলের নাড়ু।
: খালাম্মা কই ?
বাবলী কোন উত্তর দিল না । মুখ ঘুরিয়ে আকাশ দেখতে লাগল। অথচ নারকেলের নাড়ুতে কর্পুরের গন্ধ। এখানে শরাফত ভাইদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজনকারী হেলাল ভাইকে সে জিঙ্গেস করেছিল জাকিরের বাবা-মা’র কথা, এমনকি রাজশাহীর কৃতি সন্তানদের তালিকায় আজাদ ভাই এর নাম নেই কেন – এ ধরণের একটি প্রশ্নও সে উত্থাপন করেছিল ; কিন্তু এগুলোর উত্তর হেলাল ভাই দিতে পারেনি।
: খালুজান ?
: আছেন, ওই ঘরে ।
মেয়েটি সামনের ঘর ইশারায় দেখিয়ে বলল, নাজিম ভাই, আপনার ছবিটা আমি ‘সংবাদ’ থেকে কেটে রেখেছি। ছোটদার তো ওইটাই শেষ ছবি, তাই না ?
: হ্যা ।
: খুব কষ্ট পেয়েছিল, না ? ওরা গুলি করেছিল তিনটা, তারপর হাতের রগগুলোও কেন কেটেছিল নাজিম ভাই ?
সে চা মুখে নিয়ে নামিয়ে রাখে। মেয়েটার মুখে যন্ত্রণার ছায়া, সেই ছায়ার ভেতরে সে শূন্যতার নাম-ওঠা দেখতে পেল। সে কী উত্তর দেবে এই মেয়েটাকে, যখন নিজেই সে উত্তর জানে না ! ঝরাপাতার স্তূপে যেখানে জাকিরের লাশ পড়েছিল, ঊর্ধ্বগামী ছিল তার চোখ, সেখানে একটা স্মৃতিস্তম্ভ গড়েছিল তারা, কিছুদিন আগে সেটা কারা যেন ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। এখন সেখানে আবার ঘাস গজিয়ে মুছে ফেলেছে সব রক্তস্মৃতিগন্ধ, অর্জুনের পাতা ঝ’রে ঝ’রে আবার আরেকজনের জন্য জায়গা করে রেখেছে সেখানে, নতুন কেউ আসবে, আবার বুকে তিনটে গুলি নিয়ে শুয়ে পড়বে সেই শয্যায়, হত্যাকারীরা তার দু’হাতের রগ কেটে দেবে, রক্তের নালা ব’য়ে গড়িয়ে পড়বে রাস্তায়। আচ্ছা, তারও চোখ কী অমন ঊর্ধ্বগামী থাকবে, সেও কী দেখতে চাইবে হত্যাকারীর মুখ ?
জাকিরের লাশের সঙ্গে তাদের বেশকিছু বন্ধু-সহপাঠী রাজশাহী এসেছিল। কিন্তু সে আসতে পারেনি। এক ধরণের অপরাধবোধ তাকে আসতে দেয়নি। খালাম্মাকে সে কী জবাবদিহি করত ! সেই ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে সে যখন জাকিরের সঙ্গে এসেছিল, তখন তিনি বলেছিলেন, তোমরা ওকে একটু দেখে রেখো বাবা । ওর ওপর আমাদের অনেক আশা ।
কিন্তু শেষের দিকে জাকিরের সঙ্গে তার দ্যাখাই হত না বলতে গেলে। সে তখন ব্যস্ত তার ছবি তোলা নিয়ে, জাপানে পাঠাতে হবে। তবে ঘটনার আগের রাতে জাকির নাকি তাদের বাসায় এসেছিল। সে নেই দেখে বসেনি। এখন ওর মনে হয়, জাকির কি কিছু বলতে এসেছিল তাকে ? কিংবা কিছু কি জানতে পেরেছিল ? বাবলী বলল, শরাফত ভাই বাবার ছাত্র ছিলেন, জানেন তো ?
: তাই নাকি ?
সে বিস্মিত হয়। শরাফত ভাই একবারও তো বলেননি সেকথা। নাকি খেয়াল করেননি !
: বাবা আজ সকাল থেকে, জানেন ভীষণ অস্থির হয়ে আছেন। বার বার কেবল বলছেন, আমার ‘আজাদ’ এত বড় মুক্তিযোদ্ধা হয়েও রাজশাহীর কৃতি সন্তান হতে পারল না ! আমার জাকিরকেও ওরা মেরে ফেলল, তাহলে আর কী থাকে আমার ? শেষে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ওঁকে গুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।
: কখন উঠবেন, জানো কিছু ?
: এই তো উঠে যাবেন । আপনি আসেন । আমি ছাদের ঘরটা খুলে দি ।
বাবলী ছাদের ঘরটা খুলে বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে নিচে নেমে গেল। আজাদ ভাইয়ের ঘর। সেই গুলটেক্সের পুরনো পর্দা, চে গুয়েভারের ছবি, রাশি রাশি বই ; কিন্তু আলনায় এখন আজাদ ভাইয়ের খদ্দরের পাঞ্জাবির পাশে ‘ক্যাটস আই’ এর জলপাই সবুজ পপলিনের শার্ট এসে যুক্ত হয়েছে। কোলাপুরি চটির পাশে একজোড়া কেডস। জাকিরের নিশ্চয়ই। দেয়ালে দু’ভাইয়ের একটা ঝাপসা ফটোগ্রাফ ঝুলছে। দু’ ভাই হাসছে। কী আশ্চর্য প্রাণবন্ত ছবিটা। যেন কানের কাছে অস্পষ্ট হাসির শব্দ ভেসে এল। সে ছাদের দিকের দরজাটা খুলে ফেলল। ভ্যাপসা গরম ভেতরে। শ্যাওলা পড়া ছাদে মনে হয় বিশেষ কেউ আসে না। দু’তিনটে বটপাকুড়ের কচি গাছ এদিক-ওদিক উকিঁ মারছে। এ্যান্টেনায় একটা মরা কাক, জলের ট্যাঙ্কির কাছে পচা দুর্গন্ধ, ইঁদুর-টিদুর মরে পড়ে আছে বোধহয়। মাথার ওপর কালো আকাশের দীর্ঘশ্বাস।
: বাবা উঠেছেন ।
বাবলী খুব আস্তে করে বললেও সে চমকে ওঠে। ক’টা বাজে এখন ? রেস্ট হাউসে ফিরতে হবে। সিড়িঁ দিয়ে নামতে নামতে বাবলী বলে, নাজিম ভাই, বাবার শরীর খুবই খারাপ। আর ভাইজান কিংবা ছোটদার ও বন্ধু-বান্ধবকে দেখলে কেন যেন খুবই উত্তেজিত হয়ে যান। সেদিন সেলিম ভাই এসেছিলেন। কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে পড়তে যাচ্ছেন, তাই। জানেন, বাবা তাঁর সঙ্গে একটা কথাও বললেন না। একটাও না।
: কেন ?
: জানি না । তবে বাবার খুব রাগ আপনাদের ওপর। আমি বাবাকে আপনার কথা বলেছি । মনে হয় চিনতে পরেছেন ।
কিন্তু কতটুকু চিনতে পেরেছেন, তা কিছু বোঝা গেল না ঘরে ঢুকে । একপাশ হয়ে শুয়ে ছিলেন । বৃদ্ধ, কিন্তু অভিজ্ঞ মুখ । সাইড টেবিলে ওষুধপত্র, জলের গ্লাস । কম পাওয়ারের লাল আলোয় ঘরটা ধোঁয়াচূর্ণে ভাসমান যেন। অথবা এমন হতে পারে, একটু আগে ধুপের ধোঁয়া দেয়া হয়েছে, নাকি তারই হালকা ঝাঁঝ। তাকে দেখে কোনও ভাবান্তর হল না ল্যাবরেটরি স্কুলের এ্যাসিসটেন্ট হেডমাস্টারের। তবে হাত ইশারায় বসতে বললেন।
: কী চাই ? খুব জড়ানো ক্লান্ত স্বরে জিঙ্গেস করলেন তিনি ।
সে বলল, কিছু না। আপনাকে এমনই দেখতে এসেছি।
: এমনি তো কেউ এখানে আসে না !
তিনি যেন একটু নড়েচড়ে উঠলেন। বাবলী তাঁর পাশে এসে বসল। কপালের ঘাম মুছিয়ে বলল, বাবা, মনে নেই ছোটদার সেই ছবিটার কথা ? ওটা উনিই তুলেছিলেন।
: ও । বলেই পূর্ণ দৃষ্টিতে কী যেন দেখতে থাকলেন তার দিকে । বলিরেখাময় তামাটে মুখ, পোড় খাওয়া করুণ চোখ। কিন্তু এখনও কী তীর্যক দৃষ্টি সেই চোখের। নাজিম ভেতরে ভেতরে ঘেমে উঠল একেবারে।
: তুমি তাহলে ছবি তোলো । কিন্তু আর সবাই ? ওরা, ওরা কে কী করছে সব ?
সে ঠিক বুঝতে পারে না তিনি কী বলছেন । বাবলী নিচু স্বরে বলে, বাবা ছোটদার অন্যান্য বন্ধুদের কথা জিঙ্গেস করছেন।
সে এসব ছেড়ে তখন স্মৃতিময় প্রান্তর ঘেঁষে হাঁটতে থাকে । জাকিরের বন্ধূ মানে তো তারও বন্ধু। অথচ কেন কারও মুখ কিংবা অবয়ব তেমনভাবে মনে পড়ছে না ? তবে কি সে স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে পড়ছে ! নাকি পুরনো স্মৃতিকে সে তার বুকের ভেতর আর লালন করতে চায় না ! আসলে ছাত্রজীবনে জাকির ছাড়া আর কারও সঙ্গে তার তেমন ঘনিষ্ঠতা হয়নি, কিন্তু জাকির মৃদুভাষী হলেও ছিল প্রচন্ড বন্ধুবৎসল । সে মনে ক’রে দেখল, ফেব্রুয়ারির বইমেলা কিংবা এদিক-ওদিকে হঠাৎ করে দু’চারজনের সঙ্গে যে দ্যাখা হয় না তা নয় ; তবে তাদের আর পরিচিত মনে হয় না আগের মতো, মনে হয় তারা যেন অন্য পৃথিবীমুখী, যেন সে তাদের সঙ্গে এতটা বছর কাটিয়ে আসেনি। অনেক সময় আবার এমনও হয়, যখন আর্টস বিল্ডিং, কার্জন হল, টিএসসির সামনে গেলে নিজেকে মনে হয় একা। যেন কেউ কোথাও নেই। অপরিচিত জনস্রোত, গাছ-গাছালির সবুজ ছায়া কিংবা রোদের কার্নিশ সব কিছুতেই যেন অচেনা গন্ধ। অথচ একটু চেষ্টা করলেই ঐ টিএসসির খোলা বুক, আর্টস বিল্ডিং, কার্জন হল, বাংলা একাডেমী থেকে বেরিয়ে আসবে অজস্র স্মৃতির মিছিল, যেগুলো মুহূর্তেই মাথার ভেতর পাকিয়ে ফেলতে পারে বিশালাকায় স্মৃতিজট, কিন্তু নাজিম সেই চেষ্টাটুকুও করে না। কেন যেন নিস্পৃহথাই তার কাছে বেশি প্রিয়। তাই মুহূর্তে যখন তার নিজের সহপাঠীদের বর্তমান অবস্থানের দিকে মনোয়োগ দিতে হলো তখণ অযাচিতভাবেই তার কাছে এসে দাঁড়াল পুরনো দিন, আড়ালে থাকা স্মৃতিগন্ধময় বিগত জীবন। সে চোখ বন্ধ করে হাতড়ে হাতড়ে ঠিক ঠিক জড়ো করে ফেলল তাদের। বোধের ভেতর সারিবদ্ব দাঁড়াল তারা।
সে বলল, ফারুক এখন গার্মেন্টস চালায়, মিলু সিলেটে, নাজাত নবাবগঞ্জে। বিশ্বজিৎ,উত্তম,কায়সার এরা সবাই পত্রিকায়।
: আর ?
: আর অনীক, অসীম, খালেদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এখন। শফিক কৃষি মন্ত্রণালয়ে, রব্বানী ইংল্যান্ডে... আর মন্টি টেক্সাসে... ।
: অথচ....
তিনি ঈষৎ জড়ানো ক্লান্ত স্বরের ডানা ছড়ালেন হঠাৎ, ঘরের লালচে ধোঁয়া আলো ভেদ করে তাঁর হাহাকার পুঞ্জিভূত ক্ষোভে রুপান্তরিত হল, অথচ দ্যাখো... এক বন্ধু প’ড়ে রইল পাতার ওপর, গুলি বুকে, রগ কাটা... তোমরা তাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে এলে এতদূর... অথচ কেউ তার জন্যে দাঁড়ালে না ! কেউ না... ! ব’লেই তিনি হাঁপাতে লাগলেন। তাঁর চোখ থেকে জলপ্রপাত নেমে এসে বালিশে আছড়ে পড়তে থাকল। বালিশটা হলদে বিবর্ণ। অনেকটা মৃত পত্রাবলির মতো। সে শিহরিত হল। ওটা কি বালিশ ? নাকি অর্জুনের ঝরাপাতার স্তূপ ! আর সে যে লবণাক্ত জল দেখছে, তা কি শুধু জলই – রক্ত নয় ! বাবলী তার বাবার চোখ-মুখ মুছিয়ে দিচ্ছিল, আর সে ভাবল – জাকির। জাকিরই তো । প’ড়ে আছে পাতার স্তূপে । অবিকল আগের মতো । দু’ হাত ছড়িয়ে. ঊর্ধ্বগামী চোখে। কিন্তু ও এবার কাকে দেখতে চাইছে ? পরাজিত পলায়নমুখি ওর এই সহাপাঠীকে কি নয় ? যে কিংবা যারা ওকে পেছনে ফেলে দিব্যি হেঁটে এসেছে এতটা পথ । এতটা বছর।
তোর জন্যে আসলে কিছুই করতে পারিনি। সে বোধের ভেতর নি:শব্দে কথা বলতে থাকে, কিছুই না ! অথচ তোর হত্যাকারীরা বীরদর্পে হেঁটে বেড়ায় চারপাশে। ইট কিংবা লৌহখন্ড দিয়ে মানুষের মাথা ভেঙে বৃদ্ধিবৃত্তির শাঁস বের ক’রে নেয়। হাত-পা’র রগ কাটে... মধ্যযুগীয় ছুরি শাণায়...স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে গুড়িয়ে দেয়... অথচ দ্যাখ, আমরা কেমন দাঁড়িয়ে থাকি নির্বিকার... কিছুই করতে পারিনা... আর কিছুই না !
সে ভেতরে ভেতরে নিষ্ফলা আক্রোশে ক্ষত-বিক্ষত হয়। হলুদ পাতার উপর রগ কাটা হাত নিয়ে শুয়ে থাকে জাকির। প্রবাহিত রক্তের লৌহগন্ধ ঘরের আলো-আঁধারীতে মিলেমিশে যায়। জাকির... জাকির... সে এক শরীর কষ্ট নিয়ে ঝুঁকে প’ড়ে ওর হাত স্পর্শ করতে গেলে ভাঙা গলায় তিনি চিৎকার ক’রে ওঠেন তিনি।
তার বাড়িয়ে দেয়া হাত শূন্য থেকে ফিরে আসে স্পর্শহীন। বাদামী পাতার ভেতর থেকে রক্তাক্ত গলায় তিনি চিৎকার করতে করতে বলেন, বাবলী ওকে বল, ওকে বল যে, আমি ওদের কাউকে চিনি না... ।
গলির চাপামুখে সন্ধের ছায়া জট পাকাচ্ছিল। পাশে আবর্জনা উপরানো একটা আঁস্তাকুড়। তিনটে কুকুর কী এক খাদ্য নিয়ে কাড়াকাড়ি করছিল। মাথার ওপর হাত বাড়ালেই টেলিফোনের মোটা তার, তার ওপর অজস্র ইলেকট্রিক তারের গ্যাঞ্জামে আকাশ প্রায় উধাও, পরিত্যক্ত ঘুড়ির টকটকে লাল লেজ কেবল পতপত করে উড়ে জানান দিচ্ছিল, বাতাসের বয়ে যাবার মতো জায়গা আছে যা হোক। রিকশাঅলা ঠিক একরকমই মুহূর্তে জানাল, আর যাবে না। আর যাবে না মানে !
অন্য সময় হলে সে খেপে উঠত। কিন্তু এখন এই চাপা গলির সংকীর্ণ মুখে যখন হাঁটাপথই প্রায় অসম্ভব মনে হচ্ছে, তখন আর কী করা, সে ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়ল। আঁস্তাকুড়ের ডান দিকে একটা আধাভাঙা রাস্তা নেমে গেছে। ওদিকেই যেতে হবে। দু’পাশের পাচিঁল-বেড়া সবকিছুতেই তীব্র ভেজা গন্ধ। আর রাস্তার মধ্যিখানে ইটের সারি দেয়া আছে চলার জন্য। আজ সারাদিন বৃষ্টি। বিকেলের দিকে যখন সে আর আসবেই না, এরকম এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে প্রায়, সে সময়ই অকস্মাৎ বৃষ্টি থেমে গেল। শেষ বিকেলের একটু লালচে ভাবও চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল যেন, শরাফত ভাই বললেন, কী যাবে নাকি ?
শরাফত ভাইএর উৎকন্ঠা অন্যখানে। আজ রাতে তুমুল আড্ডা হবে রুমে। অসীম তার কাস্টমসের এক বন্ধুর কাছ থেকে ক’বোতল দামী পানীয় জোগাড় করেছে, তার ওপর সঙ্গে থাকবে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শরাফত ভাইয়ের গুণমুগ্ধ দুই সুন্দরী তরুণী, যারা ভালো আবৃত্তি করে এবং ফ্ল্যাটারিতেও কম যায় না। তাদের একজন তো দিব্যি এই তুমুল বৃষ্টির ভেতর দুপর বেলায় শরাফত ভাইকে পদ্মার হাওয়া খাইয়ে নিয়ে এল। সে তখন গভীর ঘুমের আচ্ছাদনে ছিল। শরাফত ভাই এমনিতেই একটু উত্তেজিত, তাকে ঘুমোতে দেখে সজোরে ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠালেন, তারপর বললেন, নাজিম, তুমি এখনও ঘুমোচ্ছ ! দ্যাখো, কী সুন্দর দিন। দ্যাখো, অনুভব করো।
সে হুইস্কির গন্ধ ছড়ানো শরাফত ভাইকে দেখেই বুঝেছিল, ওই মেয়েটি, যার নাম শারমিন কি শর্মি, বেশ ভালোভাবেই কাৎ করেছে তাঁকে । সুতরাং আজ রাতে কবিতা আবৃত্তি কিংবা সাহিত্যের কী বাল ছেঁড়া হবে, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। সবটাই শেষ অবধি মদ ও মাংসে আটকে যাবে। আর এগুলোর ছবি যে সে ডকুমেন্ট হিসেবে রাখবে, তাও হবার নয়। শরাফত ভাইয়ের কড়া অনুরোধ, যত ছবি তোল আপত্তি নেই, কিন্তু বেসামাল কিংবা নারীঘটিত ছবি অবশ্যই নয়। তাই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের কিছু ছবি ছাড়া আর কিছু তোলা হয়নি গতকাল থেকে। যদিও সকালে অনেক রিকোয়েস্ট করেছে শারমিন না শর্মির বান্ধবীটি, তাদের ছবি তোলার জন্য। বাঙালীর স্বভাবই ঐ, বিনে পয়সায় যা পাওয়া যায়, তাতেই লাভ। অথচ সে যে অন্যান্য প্রফেশনাল ফটোগ্রাফাদের থেকে আলাদা, এ কথা কে বুঝবে। নেহাতই হাসানের ঠেলায় পড়ে এ কাজটা হাতে নিয়েছে এবং বেশ কিছু টাকার এডভ্যান্স সরাসরি দেয়ার কারণে সে আর কাজটাকে অবহেলা করতে পারছে না। তা’ বলে শরাফত ভাইয়ের পেছনে পেছনে এই সুদূর মফস্বলে চলে আসবে গত পরশুদিন, এটাও সে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। এর পেছনেও হাসানের হাত আছে। তার সোজা কথা, শরাফত ভাইয়ের সবরকম ছবিই তার প্রয়োজন। সামনের ফেব্রুয়ারির বইমেলায় একশো ছবিসহ শরাফত ভাইয়ের ওপর প্রামাণ্য গ্রন্থটি অবশ্যই হট ফেবারিট হবে। সুতরাং কোনও কিছুর প্রস্তুতি ছাড়াই তাকে আসতে হয়েছে একরকম। তবে সারাদিন কোচ জার্নির মতো একঘেয়ে জার্নি তাদের কাছে আর খারাপ লাগে নি বিএডিসির ধবধবে সাদা রাজহংসের মতো রেস্ট হাউসে ঢাউস ঢাউস রুম পেয়ে। চমৎকার টানা বারান্দার শেষ ঘর। ঘরের পেছনে অজস্র গাছ-গাছালির ভেতর দিয়ে চেষ্টা করলে শহররক্ষা বাঁধটা দেখা যায়। তারপরই নদী। এখন জল বেড়েছে ব’লে একটু ভরভরন্ত দেখায় তার শরীরটা, নইলে বছরের অধিকাংশ সময়ই কাড়িঁ কাড়িঁ বালি উজিয়ে শুয়ে থাকা। গতরাতে বৃষ্টি ছিল না ব’লে বেশ হাওয়া দিচ্ছিল, ঠিক পুরো না হলেও পৌনে এক বৃত্ত চাঁদ মেঘের ছানাপোনাদের নিয়ে হাসাহাসি করছিল রাজশাহীর আকাশে। শরাফত ভাইয়ের মেজাজ বেশ শরীফ ছিল সংবর্ধনা অনুষ্ঠান থেকে ফিরে, সোজা তাকে নিয়ে ছাদে উঠে গেলেন। ছাদে আবার তাজমহল গোলাপের টব সাজানো, বেশ বড় বড় গোলাপ ফুটেছে, নাকি শরৎকালের আভা কী ভাঁটফুলের গন্ধ, বোঝা যাচ্ছিল না, তবে মাদকতা ছিল সেই গন্ধে। শরাফত ভাই তাঁর পাঞ্জাবীটা খুলে রাখলেন রেলিঙে, দূরবর্তী নদীতে নিশ্চয়ই জলের শব্দ, না হয় কোথাও কারও গৃহস্থলী কাজে কোন ট্যাপ খোলা, বেশ ছপছপ শব্দ হচ্ছিল, যা জলের অগণন ঢেউয়ের শব্দ ছাড়া আর কিছু নয়। শরাফত ভাই তাঁর শাদাটে গাঁ চন্দ্রালোকে মেলে বললেন, নাজিম, বড় একা লাগছে এখন, বড় নি:সঙ্গ।
কেন ?
সে জানে কেন, তবু জিঙ্গেস করল। শর্মি না শারমিন মেয়েটির মসৃণ বাদামী রঙ, তার পাতলা জর্জেট ফেটে উপচেপড়া বুক কিংবা কটাচোখের বিহ্বলতা শরাফত ভাইকে কাতর করে তুলছে। অথচ মেয়েটি শরাফত ভাইয়ের ছোট মেয়ের সমবয়সী হবে বোধকরি। কী আশ্চর্য ! এর আগে একবার, সে তখন ময়মনসিংহে, শরাফত ভাই গিয়েছিলেন স্থানীয় এক কবিতা উৎসবে। নাজিমের সাংবাদিক বন্ধু আতিকের ভাগনীকে দেখা গেল ঘুর ঘুর করছে শরাফত ভাইয়ের পেছন পেছন। মেয়েটি কালো, তবে বেশ আকর্ষণীয়, বড় বড় চোখ। শরাফত ভাই কী করে যে তাকে মোহবিষ্ট করলেন, মেয়েটি নাকি সে রাতে তাঁর বাংলোয় যাবেই যাবে, শেষ-মেষ আতিককে রাখা হল ভাগনি পাহারায়। এদিকে সে গেছে ছবি তুলতে, তখন প্রায় রাত সাড়ে এগারটা, শরাফাত ভাই তো রেগে পানপাত্র ছুঁড়ে ফেললেন বারন্দায়, ওকে বললেন, নাজিম, তুমি যাওনা একটু । গিয়ে নিয়ে এসো । কিছু না, জাস্ট একটু গল্প করব। জানোই তো মেয়েটি কীরকম ভক্ত আমার।
সে বলল, বাদ দেন ওসব। জানেন তো মফস্বল শহর। একটু কিছু জানাজানি হলে ঝামেলা বেঁধে যাবে। এবং সত্যি সত্যিই ঝামেলা বেঁধেছিল। মেয়েটির প্রেমিক আনন্দমোহন কলেজের ছাত্র, গান-টান গেয়ে নাম করেছে বেশ, সে তো বেশ কিছু ছেলে জোগাড় করে ভোরবেলা এসে হাজির শরাফাত ভাইকে রাম-ধোলাই দেবার জন্য। তখন সে, আতিক আর শামসুল মিলে যদি তাঁকে এসকর্ট করে ঢাকাগামী ট্রেনে না তুলে দিত, তাহলে অপমানিত শরীর নিয়ে ফিরতে হত তাঁকে। সে কথা কি শরাফাত ভাই মনে রেখেছেন ? মনে রাখলে পুনরায় এই বিড়ালাক্ষী মেয়েটির জন্য দীর্ঘশ্বাসে বিচরণ কেন তাঁর । আসলে কবি-লেখকেরা বোধহয় কোনও পথেই সুখ পান না। এই যেমন ইফতেখার স্যার, যাঁর ছোটগল্প রীতিমতো বাঙলা সাহিত্যের অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে স্বীকৃত এখন, সেই ইফতেখার স্যার কিনা কান্দুপট্টিতে গিয়ে হারিয়ে আসেন তাঁর বাই ফোকাল চশমা, পরে তাঁরই এক ছাত্র, দুর্ভাগ্যক্রমে সেও সেদিন ছিল পতিতাগমনের যাত্রী এবং ঐ একই রমণীর ঘরে, সে’ই বাই ফোকাল চশমাটি উদ্ধার করে পরদিন ক্লাসে নিয়ে হাজির। পরে সে রসিয়ে রসিয়ে গল্প করেছে শাহবাগে তাদের সামনে। চশমাটি পেয়ে নাকি স্যার খুবই আনন্দিত কিন্তু সেই সঙ্গে কিছুটা ক্ষুব্দও। কেন সে অতগুলো ছাত্রের সম্মুখে চশমা ফিরিয়ে দিল, যদিও সে অভয় দিয়েছে কাউকে বলে নি, তবুও । এবং শেষে নাকি একটু অম্ল-মধুর উপদেশও দিয়েছেন, ‘ঘন ঘন যেও না বুঝলে। ওতে অভ্যেস খারাপ হয়ে যায়।
কী হাস্যকর উপদেশ ! নাজিম খেয়াল করেছে, এদিক থেকে শরাফত ভাইয়ের রুচি তুলনামূলকভাবে ভালো। অন্তত বিভিন্নভাব কিশোরী-প্রেমের কারণে হলেও তাঁর হাত দিয়ে কিছু ভালো কবিতা বের হয়ে আসছে।
শরাফাত ভাই বললেন, কেন জানি না এই চন্দ্রালোক, জলের শব্দ, সব কিছুর ভেতর যেন শূন্যতার বল কেবল লাফালাফি করছে, দেখতে পাচ্ছি।
সে বলল, চলুন ঘুমোই। ঘুমোলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
: হবে না । হবে না । কিছু ঠিক হবে না। তুমি জানো না নাজিম, আমার চারপাশে কেবল শূন্যতা । কেবল স্বার্থপরতা । আমাকে কেউ ভালোবাসেনা। কেউ না।
: দূর, কী যে বলেন ! ভাবী ? ভাবীকে তো দেখি আপনাকে কী চমৎকারভাবে আগলে রাখেন।
: ও’ তো আমার সন্তানদের মা। কখনও কখনও আমারও মা । কিন্তু নাজিম, সে তো আমার প্রেমিকা নয় !
কথাটা শুনে নাজিমের মাথায় কী রকম যেন আগুন বা বিদ্যুৎ জাতীয় কী একটা ঘুরপাক খেয়ে সশব্দে ফেটে পড়ল। সুন্দরী প্রেমিক যখন পরবর্তীতে স্ত্রী হয়, সন্তানদের মা হয়ে বিপুলাবক্ষ এবং স্বাস্থ্যবতী আকার ধারণ করেন – তখন তিনি হন অভিভাবক গোত্রধারী, প্রেমিকা নন। তার ইচ্ছে করছিল, শরাফাত ভাইয়ের ঐ টসটসে লাল ঠোঁট, যা এখন বিড়ালাক্ষী মেয়েটির বাদামী পলকা শরীরের স্বাদ নেবার জন্য উন্মুখ, এক ঘুষিতে ফাটিয়ে ফেলে। কিংবা লাথি মেরে এই তিনতলার ছাদ থেকে মাটিতে ছুঁড়ে দ্যায় তাঁর বহুভোগী প্রায়বৃদ্ধ শরীর। কিন্তু সে এর কিছুই করে না। বরং শরাফাত ভাইকে একা রেখে সে নেমে আসে ছাদ থেকে। কিন্তু ঘুম হয় না। খোলা জানালার আলো, আতা কী ভাঁটফুলের গন্ধ ওকে ঘুমোতে দেয় না অনেকক্ষণ। ছাদে মানুষ হাঁটার শব্দ হয়। বাতাবি লেবুর গাছে নিশাচর পাখির পাখসাট শোনা যায়। কোথায় যেন কাদের ছেলে কেঁদে ওঠে, রেস্টহাউসের কোলাপসিবল গেট ক্যাঁচ ক্যাঁচ ক’রে বন্ধ হয়, সিঁড়িতে পদশব্দ, কারা যেন ছাদে ওঠে। ওঠে আর নামে। শরাফাত ভাইয়ের সেই শূন্যের বলগুলোর মতো। নামে আর ওঠে। এরকম এক নামা-ওঠার টেন্স মাথায় রেখে এক সময় সে ঘুমিয়ে পড়ে।
: : :
কিন্তু সকাল আর হয় না। ভোরের আকাশ অকস্মাৎ একদল মেঘছত্রীসেনা দখল ক’রে ফেলায় আলো-হাওয়া সব ছত্রভংগ হয়ে যায়। সে বাথরুম থেকে বের হয়ে শরাফাত ভাইয়ের রুমের দিকে যাবে কিনা ভাবতেই একটা জংলী প্রিন্ট শাড়ি চোখের সামনে দুলে উঠল। সোমনাথ হোড়ের ছবি থেকে কী বের হয়ে এল ওই প্রায়ান্ধকারিণী ? – নাকি নিছক দৃষ্টিভ্রম ! এই ব্ল্যাক এ্যান্ড হোয়াইট সকাল আর তাকে ভেঙে এগিয়ে যাওয়া প্রিন্টেড যুবতী কিছু রহস্য ছড়িয়ে গেল বোধের ভেতর। মেয়েটি কি শরাফত ভাইয়ের ঘর থেকে বের হয়ে এল না ! আর এলেই বা তার কী ! সে কি এখানে গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছে নাকি এসেছে ছবি তুলতে ।
তারপর তার মাথা একেবারে পরিষ্কার হয়ে আসে। পরশুর আগের দিন সি হুট করে রাজশাহী আসার যে সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেলেছিল তার পেছনে অবশ্য দুটো কারণ ছিল :
ক. হাসানের প্রামাণ্য এ্যালবামের জন্য শরাফাত ভাইয়ের ছবি তোলা ।
খ. জাকিরের পরিবারের সঙ্গে দেখা করা।
যদিও সে জানে না, তাঁরা কেউ আদৌ সেই বাড়িতে আছেন কিনা । জাকিরের সঙ্গে যখন এসেছিল, সেটা প্রায় সাত/আট বছর আগের কথা । তারা তখন কেবল ঢাকা ভার্সিটিতে ঢুকেছে। রক্ত গরম । সে আবার আন্তর্জাতিক এক ফটো কম্পিটিশনে পুরষ্কার পেয়ে গেছে সেই সময়েই । জাকিরই পরামর্শটা দিল হঠাৎ। বলল, ছবি তুলবি ? চল আমার সঙ্গে।
সেবার তারা পুরো সাতটা দিন একসঙ্গে কাটিয়েছিল। সোনা মসজিদ, জলহীন বরেন্দ্র অঞ্চলের রুক্ষভূমি, আমবাগান, আমনূরার সাঁওতাল পল্লী। সে প্রচুর ছবি তুলেছিল। কিন্তু তাকে আকর্ষণ করেছিল আসলে জাকিরের বাবা-মা। ল্যাবরেটরি স্কুলের এ্যাসিসটেন্ট হেডমাস্টার তার বাবা, গোটা বাড়িকে তাঁরা ক’রে রেখেছেন স্মৃতিশালা। জাকিরের বড়ভাই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ। রাজশাহী ভার্সিটির ছাত্র ছিলেন। সিতলাইয়ের কাছে এক বড় ধরণের অপারেশনে তিনি শহীদ হন। জাকিরের বাবা-মা তাদেঁর শহীদ ছেলের সমস্ত স্মৃতিচিহ্ন চমৎকারভাবে আগলে রেখেছেন। সে দেখেছিল, আজাদ ভাইয়ের চিলেকোঠাটা। রাশি রাশি বই । চে গুয়েভারের ছবি। আলনায় খদ্দরের পাঞ্জাবি, চটের ঝোলা, কোলপুরি স্যান্ডেল । ছাদের দিকের দরজাটা খুলে দিলে চমৎকার আলো আসে, বাতাসে পর্দার কম্পন ধরে।
জাকির বলেছিল, দ্যাখ নিজাম, আমার সমস্যাটা একটু ভেবে দ্যাখ। ভাইজান ছিলেন ব্রিলিয়ান্ট। কিন্তু আমি তা নই। সে ভালো ক্রিকেট খেলত, আমি এগুলোর কিছুই পারিনা। তবু দ্যাখ, বাবা চান আমি ফার্স্ট ক্লাস পাবার জন্য পস্তুতি নেই, মা চান কখনও সখনও ভাইজানের ক্রিকেট ব্যাটটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।
সে বলেছিল, অসুবিধে কী, চেষ্টা কর।
জাকির ওর ওপর বিরক্ত হয়েছিল মনে হয়। বলেছিল, আমার দ্বারা কিছু হবে না। তুই দেখে নিস। প্রয়োজনে নিজের জীবনটা কেবল দেশের জন্য দিয়ে যেতে পারি, ব্যস এটুকুই। এবং জাকির তার প্রমাণও রেখে গেছে নীলক্ষেত মোড়ে। যেন জীবনটা এমন কিছু নয়, এইভাবে অবহেলায় শরীরের রক্ত-মাংস-মজ্জা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। আসলে ভেতরে ভেতরে মুখচোরা জাকির যে এতদূর এগিয়ে গিয়েছিল তা সে ঠিক উপলব্ধি করতে পারেনি। নইলে সে কি একটু সাবধান করে দিতনা, যখন ঘটনার আগ থেকেই শোনা যাচ্ছিল চট্টগ্রাম থেকে বেশ কিছু আর্মড ক্যাডারের লোকজন এসে অবস্থান নিয়েছে তিন-চার জায়গায়। সে যে অবশ্যি চেষ্টা করেনি তা নয়, তুমুল গোলাগুলির মধ্যে তার মোটরসাইকেলের চাকা পাংচার হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সেটা ফেলেই দৌড়ে এগিয়ে যায় আর্টস বিল্ডিং এর দিকে। কেননা এফ, রহমান হলের ওদিক থেকে যে মিছিলটা আসবার কথা, সেটার লিডে থাকবে জাকির, সে শুনেছে কিছুক্ষণ আগেই। চতুর্দিকে শিস কেটে গুলি উড়ে যাচ্ছে, বোমা ফাটছে, আর্তচিৎকার আর উল্লাসের ভেতর দিয়ে সে ডানে আর্টস বিল্ডিং ফেলে আরেকটু সামনে এগিয়ে যেতেই দেখতে পায়, এগিয়ে আসা মিছিলটা ততক্ষণে খন্ড খন্ড দাঙ্গায় রুপ নিয়েছে। আর ঠিক এরকম মুহূর্তে সে আবিষ্কার করে জাকিরকে। প্রথমে সে বুঝতে পারেনি ওই রক্তাক্ত শরীরটা জাকিরের। ইউসুফই বলল । সেও ছবি তুলছে। সে’ই বলল, নাজিম ভাই, ড্রেনের এপাশে কে পড়ে আছে দ্যাখেন তো !
সে এগিয়ে দ্যাখে, জাকির। শরীরে গুলির ক্ষত। সেইসঙ্গে দু’হাতের রগ কাটা। মৃত জাকিরের দৃষ্টি ছিল তখন খোলা। যেন দেখতে চেয়েছিল হত্যাকারীর মুখ।
আচ্ছা, সে রাতে সে কি আর ঘুমোতে পেরেছিল ? সে মনে করতে পারে না । তবে জাকিরের শরীর আর তার চারপাশের ঝরাপাতার স্তূপ, যার ওপর ছোট-খাট একটা রক্তের নালা তৈরি হয়েছিল, এই দৃশ্য মাঝে-মধ্যেই তাকে স্বপ্নে কিংবা জাগরণে ক্ষত-বিক্ষত করে তোলে। একজন মানুষের শরীরে এত রক্ত থাকে ! এত রক্ত !
ইটের ওপর পা রাখতেই কর্দমাক্ত জল ভুড়ভুড়ি কাটে পায়ের নিচে। এদিকটা অজস্র বাড়িঘরের চাপে এখন প্রায় শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা যেন। এই ক’বছরে এত বাড়িঘর উঠেছে চারদিকে যে আগের সেই সিপাইপাড়া আর নেই। তবে পুকুরটাকে পাওয়া যাচ্ছে বাম হাতে, সুতরাং ডানদিকে অনিবার্যভাবে থাকবার কথা এ্যারোমা ব্রেড এ্যান্ড বিস্কিটের কারখানা, তার পাশে হ্যান্ডসাম টেইলার্স, সূর্যতরুণ স্পোর্টিং ক্লাব কিন্তু এগুলোর চিহ্নমাত্র নেই সেখানে। পরিবর্তে দেখা যাচ্ছে চারতলা বিল্ডিং এর কন্সট্রাকশন চলছে। এই চাপা গলির ভেতর এতবড় বিল্ডিং উঠে করবেটা কী, যেখানে রিকশা ঢুকলে আর বেরোবার পথ খুজেঁ পায় না ! নাকি রুটির কারখানা, টেইলার্স-এর মতো এইসব পুরনো বাড়ি, তাদের ছিপছিপে পথও একদন অদৃশ্য হয়ে যাবে ! স্বাভাবিক তো কিছু নয়। তবে সামনের পরিত্যক্ত মন্দিরটিকে ঠিকঠাক মতো পাওয়া গেলে সে হাঁফ ছেড়ে বাচেঁ। চুড়োর বটগাছটি এখন আর বামন নয়, ঢেংগাকৃতি ধারণ করেছে। মন্দির পেরোলেই জাকিরদের বাসা। ঠিক আগের মতোই আছে। সেই কাঠের গেট, জুঁইলতা, গন্ধরাজ, স্বর্ণচাপা, শেফালি গাছ। সদর দরজা খোলাই ছিল। সে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করতেই ভেতর থেকে একজন বেরিয়ে এল। বাবলী না ? ফ্রকের খোলস ছেড়ে এখন কামিজে উত্তীর্ণ হয়েছে ব’লে আর গোলগাল নয়, এখন রীতিমতো কৃশকায়া। একটু কুজোও। বলল, আপনি, আপনি নাজিম ভাই না ?
সে হ্যা সূচক কিছু বলার আগেই মেয়েটি অস্ফুট স্বরে ‘ভেতরে আসুন’ বলে বৈঠক ঘরে বাতি জ্বালিয়ে দিল। অন্ধকার এখন গাঢ়। নোনাধরা দেয়াল তার ঈষৎ ভেজা গুমোট গন্ধ আর কেমন একটা ধোঁয়াটে বিষণ্ণতা তাকে অগ্রিম বেদনার আভাস দিল। মেয়েটি বলল, শুনেছি ঢাকা থেকে শরাফত ভাই এসেছেন। কিন্তু আপনি এসেছেন, তা তো শুনিনি।
: আসলে আমি এসেছি ছবি তুলতে।
: কিসের ছবি ? রাজশাহীর এইসব কৃতী সন্তানদের ছবি ?
: ঠিক তা না। সে একটু মুশকিলে পড়ে গেল, আসলে এসেছি শরাফত ভাইয়ের জন্য। তাঁর ছবি নিয়ে একটা এ্যালবাম হচ্ছে, তাই।
মেয়েটি আধো আলো আধো অন্ধকারে এক ধরণের রহস্যময় হাসি ঠোটেঁ ঝুলিয়ে ভেতরে চলে গেলে সে বৈঠকঘর ছেড়ে ভেতরের বারন্দায় বের হয়ে আসে। রান্নাঘরে আলো জ্বলছে। উঠোনে দোপাটির ঝাড়ে তীব্র ঝিঝিঁর শব্দ, ফলশা গাছের বড় বড় পাতায় এখনও কিছুটা সন্ধে রঙ লেগে আছে যেন। বারন্দার শেষ মাথায় ইজি চেয়ারের ওপর একটা দুধশাদা বেড়াল উলের বল হয়ে শুয়ে আছে। জাকিরের সেই ‘বুড়ি’ নয় তো ? না: বরং তার জ্ঞাতিগোষ্ঠির কেউ হতে পারে। সে নি:শব্দতা ভাঙবার জন্য একটু কেশে উঠে বেড়ালটাকে জাগিয়ে দিল। বাবলী চা হাতে হেঁটে এল তক্ষুণি। পিরিচে নারকোলের নাড়ু।
: খালাম্মা কই ?
বাবলী কোন উত্তর দিল না । মুখ ঘুরিয়ে আকাশ দেখতে লাগল। অথচ নারকেলের নাড়ুতে কর্পুরের গন্ধ। এখানে শরাফত ভাইদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজনকারী হেলাল ভাইকে সে জিঙ্গেস করেছিল জাকিরের বাবা-মা’র কথা, এমনকি রাজশাহীর কৃতি সন্তানদের তালিকায় আজাদ ভাই এর নাম নেই কেন – এ ধরণের একটি প্রশ্নও সে উত্থাপন করেছিল ; কিন্তু এগুলোর উত্তর হেলাল ভাই দিতে পারেনি।
: খালুজান ?
: আছেন, ওই ঘরে ।
মেয়েটি সামনের ঘর ইশারায় দেখিয়ে বলল, নাজিম ভাই, আপনার ছবিটা আমি ‘সংবাদ’ থেকে কেটে রেখেছি। ছোটদার তো ওইটাই শেষ ছবি, তাই না ?
: হ্যা ।
: খুব কষ্ট পেয়েছিল, না ? ওরা গুলি করেছিল তিনটা, তারপর হাতের রগগুলোও কেন কেটেছিল নাজিম ভাই ?
সে চা মুখে নিয়ে নামিয়ে রাখে। মেয়েটার মুখে যন্ত্রণার ছায়া, সেই ছায়ার ভেতরে সে শূন্যতার নাম-ওঠা দেখতে পেল। সে কী উত্তর দেবে এই মেয়েটাকে, যখন নিজেই সে উত্তর জানে না ! ঝরাপাতার স্তূপে যেখানে জাকিরের লাশ পড়েছিল, ঊর্ধ্বগামী ছিল তার চোখ, সেখানে একটা স্মৃতিস্তম্ভ গড়েছিল তারা, কিছুদিন আগে সেটা কারা যেন ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। এখন সেখানে আবার ঘাস গজিয়ে মুছে ফেলেছে সব রক্তস্মৃতিগন্ধ, অর্জুনের পাতা ঝ’রে ঝ’রে আবার আরেকজনের জন্য জায়গা করে রেখেছে সেখানে, নতুন কেউ আসবে, আবার বুকে তিনটে গুলি নিয়ে শুয়ে পড়বে সেই শয্যায়, হত্যাকারীরা তার দু’হাতের রগ কেটে দেবে, রক্তের নালা ব’য়ে গড়িয়ে পড়বে রাস্তায়। আচ্ছা, তারও চোখ কী অমন ঊর্ধ্বগামী থাকবে, সেও কী দেখতে চাইবে হত্যাকারীর মুখ ?
জাকিরের লাশের সঙ্গে তাদের বেশকিছু বন্ধু-সহপাঠী রাজশাহী এসেছিল। কিন্তু সে আসতে পারেনি। এক ধরণের অপরাধবোধ তাকে আসতে দেয়নি। খালাম্মাকে সে কী জবাবদিহি করত ! সেই ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে সে যখন জাকিরের সঙ্গে এসেছিল, তখন তিনি বলেছিলেন, তোমরা ওকে একটু দেখে রেখো বাবা । ওর ওপর আমাদের অনেক আশা ।
কিন্তু শেষের দিকে জাকিরের সঙ্গে তার দ্যাখাই হত না বলতে গেলে। সে তখন ব্যস্ত তার ছবি তোলা নিয়ে, জাপানে পাঠাতে হবে। তবে ঘটনার আগের রাতে জাকির নাকি তাদের বাসায় এসেছিল। সে নেই দেখে বসেনি। এখন ওর মনে হয়, জাকির কি কিছু বলতে এসেছিল তাকে ? কিংবা কিছু কি জানতে পেরেছিল ? বাবলী বলল, শরাফত ভাই বাবার ছাত্র ছিলেন, জানেন তো ?
: তাই নাকি ?
সে বিস্মিত হয়। শরাফত ভাই একবারও তো বলেননি সেকথা। নাকি খেয়াল করেননি !
: বাবা আজ সকাল থেকে, জানেন ভীষণ অস্থির হয়ে আছেন। বার বার কেবল বলছেন, আমার ‘আজাদ’ এত বড় মুক্তিযোদ্ধা হয়েও রাজশাহীর কৃতি সন্তান হতে পারল না ! আমার জাকিরকেও ওরা মেরে ফেলল, তাহলে আর কী থাকে আমার ? শেষে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ওঁকে গুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।
: কখন উঠবেন, জানো কিছু ?
: এই তো উঠে যাবেন । আপনি আসেন । আমি ছাদের ঘরটা খুলে দি ।
বাবলী ছাদের ঘরটা খুলে বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে নিচে নেমে গেল। আজাদ ভাইয়ের ঘর। সেই গুলটেক্সের পুরনো পর্দা, চে গুয়েভারের ছবি, রাশি রাশি বই ; কিন্তু আলনায় এখন আজাদ ভাইয়ের খদ্দরের পাঞ্জাবির পাশে ‘ক্যাটস আই’ এর জলপাই সবুজ পপলিনের শার্ট এসে যুক্ত হয়েছে। কোলাপুরি চটির পাশে একজোড়া কেডস। জাকিরের নিশ্চয়ই। দেয়ালে দু’ভাইয়ের একটা ঝাপসা ফটোগ্রাফ ঝুলছে। দু’ ভাই হাসছে। কী আশ্চর্য প্রাণবন্ত ছবিটা। যেন কানের কাছে অস্পষ্ট হাসির শব্দ ভেসে এল। সে ছাদের দিকের দরজাটা খুলে ফেলল। ভ্যাপসা গরম ভেতরে। শ্যাওলা পড়া ছাদে মনে হয় বিশেষ কেউ আসে না। দু’তিনটে বটপাকুড়ের কচি গাছ এদিক-ওদিক উকিঁ মারছে। এ্যান্টেনায় একটা মরা কাক, জলের ট্যাঙ্কির কাছে পচা দুর্গন্ধ, ইঁদুর-টিদুর মরে পড়ে আছে বোধহয়। মাথার ওপর কালো আকাশের দীর্ঘশ্বাস।
: বাবা উঠেছেন ।
বাবলী খুব আস্তে করে বললেও সে চমকে ওঠে। ক’টা বাজে এখন ? রেস্ট হাউসে ফিরতে হবে। সিড়িঁ দিয়ে নামতে নামতে বাবলী বলে, নাজিম ভাই, বাবার শরীর খুবই খারাপ। আর ভাইজান কিংবা ছোটদার ও বন্ধু-বান্ধবকে দেখলে কেন যেন খুবই উত্তেজিত হয়ে যান। সেদিন সেলিম ভাই এসেছিলেন। কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে পড়তে যাচ্ছেন, তাই। জানেন, বাবা তাঁর সঙ্গে একটা কথাও বললেন না। একটাও না।
: কেন ?
: জানি না । তবে বাবার খুব রাগ আপনাদের ওপর। আমি বাবাকে আপনার কথা বলেছি । মনে হয় চিনতে পরেছেন ।
কিন্তু কতটুকু চিনতে পেরেছেন, তা কিছু বোঝা গেল না ঘরে ঢুকে । একপাশ হয়ে শুয়ে ছিলেন । বৃদ্ধ, কিন্তু অভিজ্ঞ মুখ । সাইড টেবিলে ওষুধপত্র, জলের গ্লাস । কম পাওয়ারের লাল আলোয় ঘরটা ধোঁয়াচূর্ণে ভাসমান যেন। অথবা এমন হতে পারে, একটু আগে ধুপের ধোঁয়া দেয়া হয়েছে, নাকি তারই হালকা ঝাঁঝ। তাকে দেখে কোনও ভাবান্তর হল না ল্যাবরেটরি স্কুলের এ্যাসিসটেন্ট হেডমাস্টারের। তবে হাত ইশারায় বসতে বললেন।
: কী চাই ? খুব জড়ানো ক্লান্ত স্বরে জিঙ্গেস করলেন তিনি ।
সে বলল, কিছু না। আপনাকে এমনই দেখতে এসেছি।
: এমনি তো কেউ এখানে আসে না !
তিনি যেন একটু নড়েচড়ে উঠলেন। বাবলী তাঁর পাশে এসে বসল। কপালের ঘাম মুছিয়ে বলল, বাবা, মনে নেই ছোটদার সেই ছবিটার কথা ? ওটা উনিই তুলেছিলেন।
: ও । বলেই পূর্ণ দৃষ্টিতে কী যেন দেখতে থাকলেন তার দিকে । বলিরেখাময় তামাটে মুখ, পোড় খাওয়া করুণ চোখ। কিন্তু এখনও কী তীর্যক দৃষ্টি সেই চোখের। নাজিম ভেতরে ভেতরে ঘেমে উঠল একেবারে।
: তুমি তাহলে ছবি তোলো । কিন্তু আর সবাই ? ওরা, ওরা কে কী করছে সব ?
সে ঠিক বুঝতে পারে না তিনি কী বলছেন । বাবলী নিচু স্বরে বলে, বাবা ছোটদার অন্যান্য বন্ধুদের কথা জিঙ্গেস করছেন।
সে এসব ছেড়ে তখন স্মৃতিময় প্রান্তর ঘেঁষে হাঁটতে থাকে । জাকিরের বন্ধূ মানে তো তারও বন্ধু। অথচ কেন কারও মুখ কিংবা অবয়ব তেমনভাবে মনে পড়ছে না ? তবে কি সে স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে পড়ছে ! নাকি পুরনো স্মৃতিকে সে তার বুকের ভেতর আর লালন করতে চায় না ! আসলে ছাত্রজীবনে জাকির ছাড়া আর কারও সঙ্গে তার তেমন ঘনিষ্ঠতা হয়নি, কিন্তু জাকির মৃদুভাষী হলেও ছিল প্রচন্ড বন্ধুবৎসল । সে মনে ক’রে দেখল, ফেব্রুয়ারির বইমেলা কিংবা এদিক-ওদিকে হঠাৎ করে দু’চারজনের সঙ্গে যে দ্যাখা হয় না তা নয় ; তবে তাদের আর পরিচিত মনে হয় না আগের মতো, মনে হয় তারা যেন অন্য পৃথিবীমুখী, যেন সে তাদের সঙ্গে এতটা বছর কাটিয়ে আসেনি। অনেক সময় আবার এমনও হয়, যখন আর্টস বিল্ডিং, কার্জন হল, টিএসসির সামনে গেলে নিজেকে মনে হয় একা। যেন কেউ কোথাও নেই। অপরিচিত জনস্রোত, গাছ-গাছালির সবুজ ছায়া কিংবা রোদের কার্নিশ সব কিছুতেই যেন অচেনা গন্ধ। অথচ একটু চেষ্টা করলেই ঐ টিএসসির খোলা বুক, আর্টস বিল্ডিং, কার্জন হল, বাংলা একাডেমী থেকে বেরিয়ে আসবে অজস্র স্মৃতির মিছিল, যেগুলো মুহূর্তেই মাথার ভেতর পাকিয়ে ফেলতে পারে বিশালাকায় স্মৃতিজট, কিন্তু নাজিম সেই চেষ্টাটুকুও করে না। কেন যেন নিস্পৃহথাই তার কাছে বেশি প্রিয়। তাই মুহূর্তে যখন তার নিজের সহপাঠীদের বর্তমান অবস্থানের দিকে মনোয়োগ দিতে হলো তখণ অযাচিতভাবেই তার কাছে এসে দাঁড়াল পুরনো দিন, আড়ালে থাকা স্মৃতিগন্ধময় বিগত জীবন। সে চোখ বন্ধ করে হাতড়ে হাতড়ে ঠিক ঠিক জড়ো করে ফেলল তাদের। বোধের ভেতর সারিবদ্ব দাঁড়াল তারা।
সে বলল, ফারুক এখন গার্মেন্টস চালায়, মিলু সিলেটে, নাজাত নবাবগঞ্জে। বিশ্বজিৎ,উত্তম,কায়সার এরা সবাই পত্রিকায়।
: আর ?
: আর অনীক, অসীম, খালেদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এখন। শফিক কৃষি মন্ত্রণালয়ে, রব্বানী ইংল্যান্ডে... আর মন্টি টেক্সাসে... ।
: অথচ....
তিনি ঈষৎ জড়ানো ক্লান্ত স্বরের ডানা ছড়ালেন হঠাৎ, ঘরের লালচে ধোঁয়া আলো ভেদ করে তাঁর হাহাকার পুঞ্জিভূত ক্ষোভে রুপান্তরিত হল, অথচ দ্যাখো... এক বন্ধু প’ড়ে রইল পাতার ওপর, গুলি বুকে, রগ কাটা... তোমরা তাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে এলে এতদূর... অথচ কেউ তার জন্যে দাঁড়ালে না ! কেউ না... ! ব’লেই তিনি হাঁপাতে লাগলেন। তাঁর চোখ থেকে জলপ্রপাত নেমে এসে বালিশে আছড়ে পড়তে থাকল। বালিশটা হলদে বিবর্ণ। অনেকটা মৃত পত্রাবলির মতো। সে শিহরিত হল। ওটা কি বালিশ ? নাকি অর্জুনের ঝরাপাতার স্তূপ ! আর সে যে লবণাক্ত জল দেখছে, তা কি শুধু জলই – রক্ত নয় ! বাবলী তার বাবার চোখ-মুখ মুছিয়ে দিচ্ছিল, আর সে ভাবল – জাকির। জাকিরই তো । প’ড়ে আছে পাতার স্তূপে । অবিকল আগের মতো । দু’ হাত ছড়িয়ে. ঊর্ধ্বগামী চোখে। কিন্তু ও এবার কাকে দেখতে চাইছে ? পরাজিত পলায়নমুখি ওর এই সহাপাঠীকে কি নয় ? যে কিংবা যারা ওকে পেছনে ফেলে দিব্যি হেঁটে এসেছে এতটা পথ । এতটা বছর।
তোর জন্যে আসলে কিছুই করতে পারিনি। সে বোধের ভেতর নি:শব্দে কথা বলতে থাকে, কিছুই না ! অথচ তোর হত্যাকারীরা বীরদর্পে হেঁটে বেড়ায় চারপাশে। ইট কিংবা লৌহখন্ড দিয়ে মানুষের মাথা ভেঙে বৃদ্ধিবৃত্তির শাঁস বের ক’রে নেয়। হাত-পা’র রগ কাটে... মধ্যযুগীয় ছুরি শাণায়...স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে গুড়িয়ে দেয়... অথচ দ্যাখ, আমরা কেমন দাঁড়িয়ে থাকি নির্বিকার... কিছুই করতে পারিনা... আর কিছুই না !
সে ভেতরে ভেতরে নিষ্ফলা আক্রোশে ক্ষত-বিক্ষত হয়। হলুদ পাতার উপর রগ কাটা হাত নিয়ে শুয়ে থাকে জাকির। প্রবাহিত রক্তের লৌহগন্ধ ঘরের আলো-আঁধারীতে মিলেমিশে যায়। জাকির... জাকির... সে এক শরীর কষ্ট নিয়ে ঝুঁকে প’ড়ে ওর হাত স্পর্শ করতে গেলে ভাঙা গলায় তিনি চিৎকার ক’রে ওঠেন তিনি।
তার বাড়িয়ে দেয়া হাত শূন্য থেকে ফিরে আসে স্পর্শহীন। বাদামী পাতার ভেতর থেকে রক্তাক্ত গলায় তিনি চিৎকার করতে করতে বলেন, বাবলী ওকে বল, ওকে বল যে, আমি ওদের কাউকে চিনি না... ।
0 মন্তব্যসমূহ