আজ ২ আষাঢ় ১৪২২ বঙ্গাব্দ। চৌদ্দ পনের দিন বৃষ্টির দেখা নেই। মাটি ফেটে চৌচির। দিনের ভাবেসাবে মনে হয় চৈত্র মাস। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাওয়ার দশা। তবু, জীবন তো থেমে থাকবার নয়। খেতে হবে। তার জন্যে কাজও করতে হবে। ভানু মাটির ঝাঁপি নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে ছোটে। যেখানেই পা ফেলে ফাটা জমি আর ধান গাছের ন্যাড়া। পায়ে সুঁইয়ের মতো বিঁধে। ব্যথা পায়। মাথার ওপর গনগন করে গরম বাতাস। কপাল থেকে ঝরঝর ঘাম ঝরে পড়ে। নাক-মুখ দিয়ে ফসফস নিশ্বাস পড়ে। ভানু থামে না। থামলেই দেরি। এখনো আধ মাইল পথ বাকি। যত দ্রুত যাবে তত তাড়াতাড়ি নিষ্কৃতি।
সূর্য অস্তপথে। ভানু এসে বাড়ি ঢুকে। ডানে বামে না তাকিয়ে সোজা মাটির ঢিবির কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। ঝাঁপি উল্টে মাটি ঢেলে গিয়ে বারান্দায় বসে।
তার বৃদ্ধা শাশুড়ি প্রমীলা জল নিয়ে আসে। ভানু জলের গ্লাসটা যেন কেড়ে নিল, এমন করে দ্রুত ঢকঢক করে খেয়ে নেয়। ঘনঘন দম ছাড়ে।
শাশুড়ি আঁচল দিয়ে তাকে একটু হাওয়া করে। বলে, এত কষ্ট করিস না বউ। এত দূর থেইকা মাটি আননের দরকারটা কি লাগছে? একটু ভার স্থির হইয়া আনলে তো জানটা বাঁচে।
-না আনলে চলে কেমনে মা? বৃষ্টি শুরু হইলে তো আর মাটি আনার সুযোগ নাই। মাটি ছাড়া চলব কেমনে?
একটু জিড়িয়ে নিয়ে পুকুরঘাটে ভানু ঘোলা জলে ডুব দেয়। সারাদিন মাটি টেনে গা চিটচিট করছিল। ক্ষুধায় গা গুলাচ্ছিল। ডুব সাঁতারে খারাপ লাগা বোধ লাঘব হয়। সে জল থেকে উঠে আসে। পাড়ে দাঁড়িয়ে শাড়ি পরে। এরপর ভিজা কাপড় ধুয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।
শাশুড়ির বয়স প্রায় সত্তর ছোঁয় ছোঁয়। একসময় ভানুর মত সেও ঝাঁপির ঝাঁপি মাটি টেনে এনেছে। পালকি, পুতুল বানিয়েছে। বয়সের ভারে এই শরীর পড়ে গেছে। কোমর এখন মাটির বোঝা বইতে পারে না। নিজের শরীরের বোঝাও বইতে পারে না। তবে ভিতর বাড়ির কাজকর্ম এখনো সেই করে। শাশুড়ি আছেন বলেই ভানু নিশ্চিতে বাইরে যেতে পারে। ঘরে ফিরে বাড়া ভাত কটাও খেতে পারে। নিত্যি পূজা এখনো তিনিই করেন।
ভানু ভিজা কাপড়গুলো বারান্দায় ছড়িয়ে দিয়ে গিয়ে তুলসী তলায় দাঁড়ায়। শাড়ির আঁচলটা গলায় জড়িয়ে গড় হয়ে প্রণাম করে। এরপর ভিজা কাপড় বারান্দায় ছড়িয়ে দিয়ে ঘরে যায়। প্রমীলা পাল বউকে ডাকে।
আয়রে বউ। খাইয়া নে।
কী রানছেন মা?
বউ, খুদ আর মরিচ পুড়ছি। একটু কচু শাকও রানছি।
চাইল কি শেষ মা?
হু। খুদ কয়টা আছে। তিন চার দিন চলবে।
পুতুল কয়টা বানাইয়া দিলে কিছু পয়সা আসব মা। কয়টা দিন চালায়া নেন।
আপনার ছেলে খাইছে?
হু। বিকালেই খাইছে।
ভানু থালা টেনে খুদভাতে মরিচ ঘষে। দুজনের কেউ কোনও কথা বলে না। চুপচাপ খেয়ে নেয়। এরপর বাসন কোসন ঠিকঠাক করে রেখে ঘরে যায়।
একটাই ঘর। মাঝখানে তল্লার বেড়া। বেড়ার দুই পাশে দুই চকি। ভানু গিয়ে তার বিছানায় শুয়ে পড়ে। তার স্বামী মাধব জেগেই ছিল। ভানু'র দেখা পেয়ে সে কথা বলে।
কি রে ভানু আইছস?
হু।
খাইছস?
হু।
মা খাইছে?
হু
ভানু কথা বলতে চাচ্ছে না বুঝে মাধব আর কথা বাড়ায় না। ভানু ঘুমিয়ে যায়। মাধব জেগে থাকে। অন্ধকারে তাকিয়ে থাকে ফ্যালফ্যাল করে। মাধবের দিন রাত সমান। বিষণ্ণ দুপুর ঘুমিয়েই কাটে। রাতে ঘুম আসে না। খুব ইচ্ছা করে একটু ঘুমাতে। মা যেমন করে ঘুমায়, ভানু যেমন ঘুমায়। কিন্তু এমন ঘুম কি আর তার হবে! দিনের কখন সে ঘুমায়, কখন জাগে তার কি কোন হিসেব আছে। সেই হিসেব তো চুকে গেছে আরো সাত বছর আগে। যেদিন হঠাৎ করে কোমরের নিচের দিকটা অবশ হয়ে গেল। ডাক্তার কবিরাজে কাজ হল না। সেদিন থেকেই তো সে মৃত। সংসারে থেকেও নেই। সংসারে বৃদ্ধা মা এখনো যা পারে মাধব তাও পারে না। সংসারের জোয়াল এখন ভানুর কাঁধে। এই জোয়াল টানতে টানতে ভানুর মুখটা দিনদিন কেমন শক্ত হয়ে যাচ্ছে। অন্ধকারে মাধব সে শক্ত মুখ দেখতে পায় আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ডান হাতটি ভানুর বুকের ওপর রাখে। ভানু টের পায় না। অন্ধকারেও সে ভানুর মুখের ছায়া দেখতে পায়। কী সুন্দর না ছিল ভানু। যেন মাটির একটা পুতুল। সেই পুতুল শক্ত হতে হতে এখন লোহার পুতুলের মত লাগে। মাধব ঘুমন্ত ভানুর মুখে হাত বুলায়। ভানু টের পেয়ে ছিটকে ওঠে-
ওহ! অসহ্য। নিজেও ঘুমায় না। আমারেও ঘুমাইতে দেয় না। গরম লাগে। হাতটা সরান।
মাধব ধীরে ধীরে হাতটা গুটিয়ে নেয়।
*
মাটির পুতুল বানায় ভানু। তার মত পুতুল কুমারপাড়ায় আজ আর কেউ বানাতে পারে না। অবশ্য এক সময় এ-পাড়ায় অনেক কারিগর ছিল যারা সুন্দর সুন্দর পুতুল বানাত। সেসব অনেক দিন আগেকার কথা। কুমারপাড়ায় তখন এক'শ ঘরের বসতি ছিল। সবার উঠানে রোদ পোহাতো রঙবেরঙ্গের মাটির পুতুল, পালকি, হাতি-ঘোড়া, ময়ূর, বুড়া-বুড়ি, লক্ষ্মী-স্বরস্বতী-গণেশ-কার্তিকসহ কত দেবদেবীর মূর্তি, মাটির প্রদীপ, হাঁড়ি-পাতিল-কলস, আরো কত কী! সারা বছর কুমারপাড়া ব্যস্ত। তখন কি আর গাঁয়ে বউ ঝিয়েদের কাঁখে মাটির কলস ছাড়া কিছু দেখা যেত? মাটির হাঁড়িতেই তখন ভাত রান্না হত, মাটির ভাড়ায় পাক দেয়া হত মাঠা। কুমারদের দম ফেলবার টাইম ছিল না। কেউ মাটি আনছে, কেউ মাটি গুলাচ্ছে, কেউ মাটি ময়ান করছে, কেউ ছাঁচে ফেলে জিনিসপত্র তৈরি করছে, কেউ হাতেই কিছু একটা বানাচ্ছে, কেউ মাটির জিনিস আগুনে পোড়াচ্ছে, কেউ রং করছে, কেউ কাঁচা মাটিতে নকশা তুলছে। বেশ রমরমা ছিল দিন।
কুমারপাড়ার সেই দিন আর নেই। গ্রামের ঘরে ঘরে এখন এল্যুমিনিয়ামের বাসন কোসন। প্লাস্টিকের পুতুল, হাতিঘোড়া আরো কত খেলনা। ঠাকুরের আসনে এখন পিতলের মূর্তি, কাচে বাঁধানো দেবদেবীর ফটো। এদের সাথে পাল্লা দিয়ে কুমাররা পারে না। মাটি এনে, এত কষ্ট করে জিনিসপত্র বানিয়ে যে দামে বিক্রি করতে হয় তাতে শিল্পের সম্মানী তো দূরের কথা শিল্পীর তিনবেলা খাবারেরও নিশ্চয়তা মেলে না। ফলে বাপ দাদার পেশা ছেড়ে অনেক পরিবার চলে গেছে শহরে। ঘর গুনলে এখন চল্লিশ পঞ্চাশ এর বেশি হবে না। যারা আছে তাদের অনেকে মাটির জিনিসপত্র বানানোর পাশাপাশি অন্যকাজও করে। কয়েক ঘরের ছেলেপুলেরা স্কুল কলেজ পাশ দিয়ে চাকরিও করছে। তবে এখনো বিশ পঁচিশ ঘর আছে যারা মাটি হাতড়েই খেয়ে পরে আছে। তাই কুমারপাড়া নামে একটি পাড়া এখনো আছে মনিকাঞ্চনপুর গ্রামে। প্রয়োজন ও শখে এ-গ্রামের লোকজন এখনো কুমারপাড়ায় আসে। কখনো কখনো বেড়াতে আসা আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে আসে। এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যায়। দেখে শুনে পছন্দসই জিনিস কিনে।
গাঁয়ের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা হাতের মুঠিতে পয়সা নিয়ে ছুটে আসে ভানুর কাছে। বলে, দেও না একটা পুতুল। ভানু পয়সার সংখ্যা দেখে না, দিয়ে দেয় পুতুল। এখন তো আর চারআনা নেই তাই আটানার নিচে কেউ দেয় না। তবে দেখা যায় আট আনা দিয়ে পুতুল নিতে এসেছে তিনজন। তখন তিনজনকেই পুতুল দিয়ে দেয় ভানু। ওরা খুশিতে পুতুল নিয়ে দৌড়ে চলে যায়। ভানু নয়ন ভরে ওদের দেখে।
কাঁদা মাটি ভানুর হাতে পড়ে কত কী না জন্ম হয়। কেবল একটা বাচ্চাই জন্ম দিতে পারে না সে। বাচ্চারা পুতুল নিতে এলে তাই ভানুরও আনন্দ হয়। গুটিগুটি পায়ে ওরা হেঁটে আসে। কী সুন্দর করে হাসে, কথা বলে, পুতুল নিয়ে নাচতে নাচতে চলে যায় মাঠের দিকে। ভানু দেখে। নিত্য-শ্বাসের সঙ্গে একটি শ্বাস যেন বেশি পড়ে। গলার ভিতরে কিছু একটা দলা পাকিয়ে ওঠে। ভানু তা ঢোক গিলে পাকস্থলির দিকে ঠেলে দেয় এরপর আবার পুতুল বানানোর কাজে মন দেয়। মাটির দলাটাকে হাতে টিপে টিপে মুখ বানায়, নাক বানায়, হাত পা চোখ বানায়। কাঠি দিয়ে পুতুলের গলায় মালা পরায়। কানে দুল পরায়।
ভানুর পুতুল শহরেও যায়। শহরের দোকান থেকে বেপারী আসে পুতুল কিনতে। রাজা পুতুল, রানি পুতুল, সাদা চুলের বুড়ো পুতুল, বাচ্চা পুতুল কত ধরনের পুতুল যে ভানু বানাতে পারে। মূর্তি বানানোতে তার জুড়ি নেই। লক্ষ্মী, স্বরস্বতী, কার্তিক, গণেশ সারাবছর তার ঘরে সাজানো থাকে। কিন্তু এতে আর পয়সা কত? ত্রিশ-চল্লিশটা পুতুল বিক্রি করলে এক কেজি চালের দাম হয়। পূজার সিজন ছাড়া তো মূর্তি বিক্রি হয় না। তবু এই করে সংসার চালিয়ে নেয় ভানু।
আজ মনা পুতুল নিতে আসবে। ছোট পুতুলের চেয়ে মাপে একটু বড় পুতুলের অর্ডার করেছে সে। ভানু বারান্দায় সারি সারি পুতুল সাজিয়ে রাখে। লাল নীল রঙের বাহারী পুতুল। একটু বড় হওয়ায় প্রতি পুতুলে আটানা। এই পুতুল নিয়ে মনা তাকে পঞ্চাশ টাকা দিবে। এক দেড় মাস পরপর ভানু মনাকে একশ করে পুতুল বানিয়ে দেয়।
মনা পুতুল ফেরিওয়ালা। মাঝে সাঝে পালকি, ময়ুর, হাতি, ঘোড়াও নিয়ে যায়। শহরে ফেরি করে সে পালকি পুতুল বিক্রি করে। মনা মাঝে মাঝে গল্প করে, বসে না থেকে ফেরি করে বিক্রি করলেই লাভ। সে ভানুকেও শহরে যেতে বলে। ভানু রাজি হয় না।
ঘরে আজ চাল নেই। সকালে কয়টা চিড়া ধুয়ে মাধবকে দেয়া হয়েছে। সারাদিন বউ শ্বাশুড়ি কারো পেটেই দানাটি পড়েনি। ভানু মনার জন্যে অপেক্ষা করে। মনা এলে তবেই সে চাল কিনবে। মনা না এলে আজ উপোস ছাড়া উপায় নেই। ভানু মনে মনে মনার আসার অপেক্ষা করে।
আকাশে মেঘ করেছে। বৃষ্টি আসবে। আজ দু-দিন ধরেই অল্প স্বল্প বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি হওয়ায় গ্রামের মানুষগুলো প্রাণ ফিরে পেয়েছে। মাটির ঢিবিটা ঢেকে দেয়া দরকার। এই মাটি দিয়েই বর্ষাটা চালাতে হবে। ভানু উঠে যায়। ত্রিপল দিয়ে মাটির ঢিবিটা ঢেকে দেয়। এমন সময় শাশুড়ি কতগুলো লতা হাতে বাড়িতে ঢোকে। ভাত না জুটলে এই লতা সিদ্ধ করে খাবে।
ভানুর মন খারাপ হয়। এই বৃদ্ধার জন্যে কিছুই সে করতে পারে না। পোড়া কপাল, তা না হলে এমন জোয়ান বেটা বিছানায় পড়বে কেন। মাথার ওপর এখনো ছাতা হয়ে আছেন ইনি। ভর বিপদে এখনো তিনিই পথ দেখায় ভানুকে। শাশুড়ি না থাকলে তার সুখ দুঃখ ভাগ করার মত কেউ থাকত না।
শেষ বিকেলে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মনা এসে পৌঁছে। মনাকে দেখে ভানুর চোখ নেচে ওঠে। বারান্দায় মনাকে বসতে দেয় ভানু। পুতুলগুলো পছন্দ হয়েছে মনার। টাকা দেয়। ভানু তাকে পরেরবার দশ টাকা বাড়িয়ে দিতে বলে। প্রমীলা লতা রান্না করছিল। ভানু টাকা কয়টা বাড়িয়ে দেয় তার দিকে।
-মা, পুতুল নিতে আইছে। টেকা দিছে। আপনে গিয়া কয়টা চাল নিয়া আসেন।
বৃদ্ধা হাত বাড়িয়ে পুত্রবধূর কাছ থেকে টাকা নেয়। নির্জীব মন চঞ্চল হয়। চোখে যেন খুশির ঝিলিক দেখা যায়। সে টাকাটা নিয়ে দেরি করে না। বেগ আর ভাঙ্গা ছাতা নিয়ে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতে বের হয়ে যায়। ভানু গিয়ে বারান্দায় বসে। পুতুল গুনে গুনে মনার ঝাঁপিতে তুলে রাখে। মনা চেয়ে থাকে বৃষ্টির দিকে। বৃষ্টি তখন ঝুমিয়ে নামে।
এত্ত বিষ্টি, যাইবেন কেমনে?
তাই চিন্তা করি। আগে তো টের পাইলে আজ আসতাম না।
ভানু মনে মনে বলে, আইসা ভালা করছ গো মনা বাবু। আজ না আসলে আমাদের উপোস দিয়া থাকন লাগত।
কী ভাব ভানু?
না ভাবি, এই বিষ্টিত যাইবেন কেমনে।
দেখি যদি বিষ্টি না থামে পুতুল থাকব আমি না হয় কাল আবার আসব।
আসা যাওয়ায় তো টেকা শেষ। ।
হোক শেষ। টেকা দিয়া আর কাম কী? আমার কি ঘর সংসার আছে? মনার কথার পৃষ্ঠে ভানু আর কোন উত্তর দেয়না। বাইরে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকে। ঝুম বৃষ্টি।
অনেকক্ষণ হল প্রমীলা চাল সমেত ফিরে এসেছে। ভাত ফোটার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ভাত বোধহয় হয়ে এল। কিন্তু ভানু নড়তে পারছে না। মনা বসে আছে।
ভানু পুতুলগুলো ঝাঁপিতে সাজিয়ে রাখে। মনা আড়চোখে ভানুকে দেখে । ভানু পুতুল নাড়াচাড়া করে। মাঝে সাঝে ওরা এক দুটো কথা বলে। চুপ হয়ে যায়। আবার কথা বলে।
ভানু শহরে যাইবা?
শহরে গিয়া কী হইবো?
না, আমার লগে পুতুল বেচলা।
তাই কি হয়? শহরে গিয়া থাকব কই?
কেন আমি যেইখানে থাকি। কতবার তোমারে কইলাম। শহরে তোমার পুতুল আরো বেশি দামে বিক্রি করতা পারবা।
আমি গেলে তো আপনের ভাত মাইর। তা আমারে নিতা চান কেন মনা বাবু?
চাই, মন কয় তাই চাই। তুমি পুতুল বানাইবা আর আমি ফেরি কইরা বেচাম।
ভানু হেসে উঠে। আপনে পাগল। বেভুজের মত কথা কইন। তাই কেমনে হয়। সংসার ফালাইয়া যাই কেমনে?
সংসার কিসের! তোমার তো ছানা পোনা হয় নাই। হইবেও না। তুমি চল ভানু।
রাখেন তো আওলা বাওলা কথা। খালি নাই পেচাল। লোকে শুনলে তো আমার মরণ ছাড়া গতি নাই। ঘরে সোয়ামী রাইখা পরপুরুষের লগে শহরে যাওয়ান।
মনা আর কথা বলে না। আঁধার-করা-বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকে। অঝোরে বৃষ্টি বয়ে যায়। ভানুও হাত পা মুড়ে বসে থাকে। বৃষ্টির ফোঁটা যেন ভানুর বুকে গিয়ে বিঁধছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ভেসে যায় বৃষ্টি ও বাতাসে। মনা বারান্দা থেকে উঠানে নেমে যায়। ভর বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে চলে যায় শহরের পথে। ভানু অন্ধকারে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকে। ইচ্ছে করে, বৃষ্টিতে নেমে যেতে। মনার সাথে ঐ পথে একবার চলে গেলেই বা ক্ষতি কি? বুকের ভীতরটা ছটফট ছটফট করে। এই মনা দুইবছর ধরে পুতুল-পালকি-খেলনা কিনে নিয়ে যায় তার কাছ থেকে। কখনো সে আসে বানানোর কথা বলতে, কখনো মাপ-রং দেখতে, কখনো টাকা দিতে, কখনো মাল নিতে। কত ছলেই না সে ভানুর কাছে আসে। ইশারা ইঙ্গিতে ভানুকে ঘর ছাড়ার কথা বলে। ভানু হাসির ছলে পাশ কাটিয়ে যায়। মনা তবু হাল ছাড়ে না। তোতা পাখির মত কয়টা কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে। ভানু এড়িয়ে যায়। অথচ মনে মনে সে মনার আসার অপেক্ষাও করে।
ভানুর ভয় ভয় করে। ভাত বাড়তে বাড়তে তার প্রমীলা তার দিকে তাকিয়ে আছে। ভানু গজ গজ করে বলে, কাস্টমার বইসা থাকলে আইসা কি খাওন যায়? বিষ্টিরও সময় নাই। বেটা তোরেই বা বিকালে আসার দরকারটা কি ছিল? দূরের রাস্তা সক্কাল সক্কাল আইলে ক্ষতি কি!
শাশুড়ি তাকে শান্ত সুরে বলে, বউ, কাস্টমার হইলো লক্ষ্মী। এমনে কইতে নাই। ঐ ছেরা কি জানে যে বিষ্টি আসব! না আসলেও তো আইজ না খাইয়া থাকন লাগত।
শাশুড়ির এই কথা শুনে ভানু স্বস্তি পায়। মনাকে নিয়ে শ্বাশুড়ির যে কোনও শঙ্কা নাই সেটা বুঝতে পেরে খিদেটা বেড়ে যায়। ভানু তড়িঘড়ি করে গরাস মুখে তুলে নেয়।
*
ভানু বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মাধব জেগে থাকে। এক নাগাড়ে বৃষ্টিতে চালের খড় পচে পচে পড়ছে। এ নিয়ে মাধবের খানিক চিন্তা হয়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে মাধবের সারাদিনের কাজ হল চিন্তা করা। দীর্ঘ রাতে কত শত চিন্তা। কিন্তু কোন চিন্তাই স্থায়ী থাকে না। প্রহরের সাথে চিন্তা পাল্টায়। চিন্তার বিষয়বস্তু পাল্টায়। চিন্তা করতে করতে মাধব বৃষ্টির শব্দ শোনে। মাঝরাতের বৃষ্টিতে উচাটন হয় মন। একবার ভানুর মুখটা দেখতে ইচ্ছা করে। পুতুল পুতুল মুখটা। যে মুখটা মাটির ঢিবিতে হারিয়ে গেছে। মনে হয়, মাটি খুড়ে যদি নিয়ে আসতে পারত সে মুখখানা। মনে হয়, চোখের পলকে সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যাক। ঝাঁপি ভরে ভরে মাটি আনুক। হাঁড়িপাতিল বানাক। সারদিন খেটেখুটে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরুক। ভানু পাশে বসে একটু বাতাস করুক। ভাত বেড়ে পাশে বসে থাকুক। মা দুয়ারে বসে তার খাওয়া দেখুক। রাতগুলো এমন একলা একলা না লাগুক।
ভাবতে ভাবতে মাধবের শরীরটা যেন কেঁপে উঠে। মুহূর্তের শিহরণে সে জোর করে শরীরটা ভানুর দিকে ফেরায়। কাঁপা হাতটি ধীরে ধীরে ভানুর মুখ স্পর্শ করে। সব কেমন খরখরে ধারাল লাগে।
ভানু হাত দিয়ে মাধবের হাতটি সরিয়ে দেয়। মাধব ফুঁসে ওঠে, লুলা জামাই ভালা লাগে না তোর। আমি বুঝি না, বুঝি। তা যা না কোন গোলামের লগে যা। শইল্যে হাত দিলে চিকরা মাছের মত ছইট মারছ! আমি কিছু বুঝি না ভাবস?
কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় বিরক্ত ভানু হয়েছে। মাধমের কথার উত্তর দেয় ছন ছন করে, কি বোঝেন। কি বোঝেন আপনি?
পাখনা গজাইছে বুঝি না আমি? পুতুলওয়ালার লগে অত কী কথা কস তুই? বুঝি না আমি।
বোঝো, তা নিজে মাটির কাম কর। বেচো। আমি ঘরে থাকি। হেই মুরাদ তো নাই। খালি মইরচা জ্বালা কথা। ভাত দেওনের মুরাদ নাই কিল মারনের গুসাই।
মাধব চুপসে যায়। এই একটি জায়গায় আঘাত করলে মাধব আর এগুতে পারে না। ভানু যে তাকে খাওয়াচ্ছে পরাচ্ছে সেই তো বেশি। এমন অনেক রাতেই মাধব ফুঁসে উঠে। ব্যর্থ হয়ে ঝগড়া করে। আবার নিস্তেজ হয়ে যায়। এ-জীবন ফুঁসে উঠবার নয়। এ-জীবন শুধুই নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকবার। মাধব তা-ই থাকে। মাধব মরার মত বিছানায় পড়ে থাকে।
বৃষ্টি এবার ঘরে ঢুকছে। বৃষ্টিতে চালের খড় সরে গেছে। ঝুপঝুপ ঝরে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা। ভানু বোধহয় জেগেই ছিল। টের পেয়ে উঠে বসে। বালিশের নিচ থেকে টর্চ লাইটটি নিয়ে নেমে যায় বিছানা থেকে। ঘরের এপাশ থেকে ওপাশে যায়। ওপাশ থেকে রান্না ঘর। শাশুড়ি জেগেই ছিল। মধ্যরাতে তারা ব্যস্ত হয়ে উঠে বৃষ্টি নিয়ে। ভানু জলের বাসন কোসন এনে চালের ফুটার নিচে রাখে। টুপটুপ জল এসে পাত্রে পড়ে । কোনটায় বা পড়ে না। ভানু পাত্র সরিয়ে ফুটার সোজা রেখে দেয়। টর্চ দিয়ে দেখে ঠিক আছে কি না। এরপর বিছানায় এসে নিশ্চিন্তে চোখ বন্ধ করে। খড় পচা জল চুইয়ে চুইয়ে পড়ে বালতিতে। টুপটাপ শব্দ হয়।
চোখে রাজ্যের ঘুম ভানুর। সে ঘুমানোর চেষ্টা করে। মনা বৃষ্টিতে ভিজে চলে যাওয়ার পর থেকেই অস্থির অস্থির লাগছে। তারমধ্যে মধ্যরাতে নানা রকম উৎপাত। বৃষ্টির উৎপাত, মাধবের উৎপাত। ভাবতে ভাবতে ভানু ঘুমিয়ে যায়।
খড় পচা জল চুইয়ে চুইয়ে এখন মাধবের মুখ বরাবর পড়ছে। মাধব উসখুস উসখুস করে। ভানুর ঘুমে আবারো বেঘাত ঘটে। সে উঠে বসে। বুঝতে পেরে মাধবকে টেনে তার দিকটায় আনে। মাধবের বালিশটা এতক্ষণে ভিজে গেছে। ভানু ভিজা বালিশ সরিয়ে অন্যদিকে রাখে। কাঁথার চেয়ে কিঞ্চিত ভারি তোষকটা বৃষ্টি থেকে বাঁচানোর জন্যে গুটিয়ে রাখে। এরপর বড় একটি মাটির মটকা এনে বিছানার ওপর তুলে দেয়। বৃষ্টি এসে জমা হয় সেখানে।
বৃষ্টির জোর ক্রমেই বাড়ছে। ঘরে রাখা বালতি, হাঁড়ি এরই মধ্যে ভরে গেছে। ভানু জমা হওয়া জল বাইরে ফেলে দিয়ে আবার এনে যথাস্থানে রাখে। ঘুরে ফিরে আরো একবার দেখে নেয় কোথাও নতুন ফুটা হল কি না। এরপর এসে বিছানার সামনে দাঁড়ায়। শোবার আর জায়গা নেই। শাশুড়ির চকিটাও বাঁশের মাচার মত ছোট। সুতরাং কোন একভাবে বসে দাঁড়িয়ে বাকি রাতটা পার করতে হবে। কিন্তু ঘুমে যে চোখ দুটো খুলে রাখা যাচ্ছে না। ভানু গিয়ে মাধবের পায়ের কাছটায় বসে। ঝিমুনি লাগে।
মাধবের বুক টনটন করে। নিজে শুয়ে আছে বউটাকে বসিয়ে রেখে। ঘুমে তার চোখ ঢুলু ঢুলু করছে কিন্তু শোবার জায়গা নেই। মাধব মুহূর্তেই রাগ ভুলে যায়। সে ভানুকে ডাকে, ও ভানু আমার পা দুইটা ভাজ কইরা দে। এরপর শুইয়া থাক।
ভানু বিরোধিতা করে না। মাধবের পা-দুটো একটু সরিয়ে এলিয়ে পড়ে বিছানায়। মাধবের পায়ে মাথা দিয়ে শরীরটা কুঁজো করে চোখ বন্ধ করে। মাধব জেগে থাকে। তার একবার ভানুর মুখটা দেখতে ইচ্ছে করে। সেই মুখটা- পুতুল পুতুল মুখটা। অনেক বরষায় যে-মুখটা পুতুলের মত কোমল ছিল। তার সংসারে এসে যে মুখটা শক্ত খরখরা হয়ে গেছে! মাধব দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বিড়বিড় করে বলতে থাকে, চইলা যা ভানু। ঐ পুতুলওলার লগে চইলা যা। ঐখানে গেলে তোর মুখটা আবার পুতুলের মত সুন্দর হয়া যাইব।
মাধবের কোনও কথাই ভানুর কানে পৌঁছায় না...
লেখক পরিচিতি
জয়শ্রী সরকার
বাড়ি নেত্রকোনায়।
সংস্কৃতি কর্মী।
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সদস্য।
গবেষক। কবি। গল্পকার।
প্রকাশিত বইঃ কবিতা- শূন্যতা (২০০৬), উপন্যাসঃ অম্বা আখ্যান (২০১৫),
গবেষণাগ্রন্থঃ প্রান্তবাসী হরিজনদের কথা (২০১২)।
প্রকাশিত বইঃ কবিতা- শূন্যতা (২০০৬), উপন্যাসঃ অম্বা আখ্যান (২০১৫),
গবেষণাগ্রন্থঃ প্রান্তবাসী হরিজনদের কথা (২০১২)।
5 মন্তব্যসমূহ
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনঅনেক দিন পর এমন ভালো একটা লেখা পড়লাম। ধন্যবাদ লেখককে।
উত্তরমুছুনআমি গ্রামের মেয়ে। লেখাটির দৃশ্যপট যেন আমি গ্রামে অনেকবার দেখেছি। সত্যি সত্যিই তো এমন ঘটে........গ্রামের কথা মনে পড়ে গেল......
উত্তরমুছুনকুমোর পাড়ার গন্ধ পেলাম............
উত্তরমুছুনগ্রামীণ পরিবেশে দারিদ্রের সাথে বাঁচার আখ্যান। ভীষণ ভালো লাগল।
উত্তরমুছুন