ভগীরথ মিশ্র এর গল্প রাবণ

এক

গত রাতে এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেছে।
আমার খেজুর গুড়ের মহালে প্রহরাজ বেজ খুন হয়ে গিয়েছে। সে বড় মর্মবিদারক মরণ। পরম শত্রুর মরণও যেন এমন না হয়।

আমি ভোরে উঠে নিমের ভাল দিয়ে দাঁতন করছিলাম। ক্ষুদিরাম সিং—আমার গুড়ের মহালের মাইন্দার এসে খবরটা দিল। "ওহ! লরক-যন্তন্না সইতে সইতে মরেছে গো লোকটা। লাখো লাখো বিষপিঁপড়া উয়ার সর্বাঙ্গ কুরে কুরে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। চোখদুটা বেমালুম নাই। "

চোর-ডাকাতের দৌরাত্ম্যটা দিনকতক বেড়েছে এ তল্লাটে। এখন মহালে গুড় বানানো চলছে। গুড়, লবাত..। সেই আশ্বিনের শেষ থেকে গাছ কামানো, হাড়ি টাঙানো শুরু হয়েছে। এখন পৌষেও চলছে। মাঘ মাসের মাঝামাঝিতক চলবে। ইজারাবন্দী খেজুর গাছে গাছে খিল গোঁজা রয়েছে। গুঁজি ঝুলছে। আমার মহালে রোজ দু’শো গাছের রস আসে। দু’শো গুঁজি। অর্থাৎ, প্রায় একশো কেজি মতো রস। তা থেকে গুড় পাচ্ছি অবিশ্যি রোজ এক কুইন্টালের থেকে কিছু কম। পাইকাররা আসছে, আসছে বাঁকুড়া, তালডাংরা, শিমলাপাল থেকে। দরদাম করছে। কিনে নিচ্ছে গুড়। ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে সে গুড় চলে যাচ্ছে দূরে-দূরান্তে। কাঁচা টাকা কিছু না-কিছু রোজ ঢুকছে মহালে। রাতের জাগুয়া আছে সব মহালেই। যেমন আমার ছিল প্রহরাজ বেজ। তবুও, গুড়ের গন্ধে যেমন পিঁপড়া আসে, গুয়ের গন্ধে মাছি, ঠিক তেমনি, রাতের আঁধারে মহালে হানা দেয় রাত-কুটুমের দল। সুলুকসন্ধান খোঁজে। সুযোগ মত লুটেপুটে নিয়ে যায়। শিমলাপাল থানা থেকে 'পুলুশ’ আসে। লাঠিধারী কনিষ্ঠবল'। তারা চোর ধরতে আসে না। আসে মাল-টাল খেতে। তা দিই, মহাল-মালিকেরা যুক্তিবুদ্ধি করে দু'এক পাইট রাখি মহালে। লচেৎ উয়ারা আইবেক ক্যানে শুদুমুদু আতখানি পথ ঠেঙিয়ে ? ঠাকুর-দ্যাব্তা হেন চিজ, উয়ারাও শুদুমুদু আসেন না। দস্তুর মতো পাঠা দুবো, পূজা দুবো' বলে ডাকতে লাগে। আর ইয়ারা তো লেহাৎই মনিষ্যি। তায় আবার পুলুশ। তবু উয়ারা রাতেভিতে মহালে মহালে পার ধুলাটা দেয় বলেই টুকচান বাঁচোয়া। রাতের কুটুমরা ভেবেচিত্তে হানা দেয়।

ক্ষুদিরাম সিং দু'চোখ কপালে তুলে বলে যাচ্ছিল প্রহরাজ বেজের নরক-যন্ত্রণার কাহিনী। সম্পূর্ণ ন্যাংটো মানুষটা রাতভর লাখে লাখে বিষপিপড়ার খাদ্য হয়ে মরেছে। বললাম, 'বলু কি রে? চোখদুটা এক্কেরে নাই?'

‘লয় আইজ্ঞা।' ক্ষুদিরাম সিং ভয়ে রক্তশূন্য, চোখের থানে একজোড়া বিশাল গভ্ভর। উয়ার মধ্যে কালো রক্তের ঢেলা। তা বাদে লিঙ্গ, এ্যাড়কুষায়ও শতেক ছিদ্র করে সুডুং বাইনেছে বিষপিঁপড়ার দল।"

'থামরে। শুইন্তে লারি। ক্ষুদিরাম সিংকে ধমকে থামিয়ে দিই, 'যা, প্রহরাজের বউকে বল, শিমলাপাল থানায় একটা খবর দিক। আর মাচাতোড়া পঞ্চাৎ অফিসে।'

ক্ষুদিরাম সিং চলে যায়। আমি চুপটি মেরে বসে থাকি। মনশ্চক্ষে দেখতে থাকি হৃদয়বিদারক দৃশ্যটা। সারা শরীর সহসা কেমন গুলিয়ে ওঠে আমার। এহ্! বড় বিদ্ ঘুটে মরণটা দুনিয়ার কোনও কষ্টের সাথেই বোধ লেয় তুলনা চলে না এমন মৃত্যুর। চোরেরা বিরক্ত হয়ে মাঝে মধ্যে বেয়াড়া জাগুয়াদের সাজাটাজা দেয় বটে। বছরটাক আগে মাচাতোড়ার শম্ভু গুচ্ছাতের মহালের জাগুয়াটির ঠোঁটের ধার থেকে গল অবধি ছুরি দিয়ে ফালা করে দিয়েছিল। রাতভর ‘হো-হো-খবরদার-বলে চিল্লানোর সাজা। মরেনি। তবে বহুত দিগদারি পেয়েছিলো লোকটা। প্রহরাজের কষ্টের সাথে অবশ্য তার তুলনা হয় না। এমনকি সতীকান্ত সিংহবাবুর মরণটাও এর তুলনায় নগণ্য। সতীকান্তসিংহবাবু। জিরাবাইদ গায়ের সেই প্রতাপশালী মনিষ্যিটির মরণতো আমি নিজের চোখে দেখেছি। তখন ওর নব্বইয়ের ওধাৱে উম্বর। অঙ্গের সব ইন্দ্রিয়ের দুয়ার শিথিল। নখ দন্তহীন ব্যাঘ্র। দিনরাত শুয়ে থাকে বিছানায়। তলা দিয়ে বাহ্যি বেরিয়ে যায়। সুমুখপানে পেচ্ছাব। দেহের কোনও বস্তু তো নয়ই, মনের বাকি্যগুলানও চেপে রাখতে পারে না একতিল। ফোকলা মুখে অবিরাম বিড়বিড় বকে চলে। আক্ষেপ, অভিযোগ, অভিমান। নিজের উপর, বউ-ছাওয়ালের উপর। উপরওয়ালা—যিনি দিনকে রাত করেন—তার ওপর। চব্বিশ ঘণ্টা বিছানাবন্দী। শীতে, গ্রীষ্মে, বর্যায়। তবুও মরে না। বুকের খাঁচা থেকে শেষ হাওয়াটুকু আর বেরোয় না কিছুতেই। বিছানাতে পাশ ফিরিয়ে দিতে হতো। দিনের মধ্যে যতবার সম্ভব। দিত, যার যখন সময় হতো। চিৎ থেকে উপুড়। উপুড় থেকে বাঁ-পাশ। যেন কড়াইয়ের ওপর ভাজা কই মাছ ওলটানো। আবার সংসারের মানুষ জন কাজে-কর্মে বেরিয়ে গেলে, তখন ঘন্টার পর ঘণ্টা এক মুদ্রায় শয়ন। অসহায় সতীকান্ত চিল-চিৎকার জুড়ে দেয়। আরে গু-খাউকীর ব্যাটা-বেটিরা, একপাশে শুয়ো শুয়ো যে কাঠ হইয়ে গেলাম রে খাল-মুয়ার দল! কেউ শোনে না। ইদানিং চিল্লানোর ক্ষমতাটাও প্রায় নেই বললেই চলে। কাজেই কাঁটাসার একটি শরীর দিনের পর দিন শুয়ে থাকে তেল চিটচিটে বিছানায়। চিৎ হয়েই শুয়ে থাকে অধিকাংশ সময়। চোখের কোনায় জলের ধারা শুকিয়ে থাকে। দু'চোখে মরা মরা চাউনি নিয়ে সে কেবল নিঃশব্দে দিন গুনে যায়।

এইভাবে হয়ে থাকতে থাকতে সতীকাত্তর পিঠের ছোট ছোট কুক্কুড়িগুলো বড় হলো। বিছানার সাথে তাদের ঘষাঘষি চলল অবিরাম। রস চোঁয়ালে। ঘা হলো। কাল কালে দগদগে হলো সে ঘা। দুৰ্গন্ধ ছড়াল। মাছি ভনভনালো ঘায়ের ওপর। তখন কার সাধ্যি সতীকাত্তর ঘরে ঢোকে। ফলে, কালেভদ্রে যারা উল্ট পাল্টে দিতে আসত, তারাও যেন না আসতে পারলে বেঁচে যায়। চানের আগে আগে মনে পড়লে তবু উল্টে দেবার ইচ্ছেটা জাগে একটু আধটু। উল্টে দিয়েই সোজা পুকুরে গিয়ে ডুব মারা। একটা সময় এলো, যখন দিন যায়, রাত যায়, একলা ঘরে একরাশ আঁধার, মাছি, দুর্গন্ ও যন্ত্রণা নিয়ে শুয়ে থাকত সতীকান্ত সিংহবাবু। দিন নয়, তখন কেবল ক্ষণই শুনত। তখন প্রতিটি দণ্ডকে মনে হতো যেন এক একটি যুগ।

সতীকাত্ত সিংহবাবুর ঐ সময়টাতেই আমি ওর ঘরে যেতাম। রোজ পালা করে একবার। নাকে কাপড় চাপা না দিয়েই ঘরের মধ্যে ঢুকতাম। থির পলকে দেখতাম ওকে। শুধু দেখবার জনাই তো যেতাম। অন্য কোনও কারণেই নয়। সতীকান্ত সিংহবাবুর মতো একটা মানুষ মরছে। দণ্ডে-দণ্ডে, পলে-পলে সেটাই তাকিয়ে দেখবার মতো ব্যাপার ছিল আমার কাছে। সতীকান্তও আমার দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকত। অবোলা সময় বয়ে যেত তিরতিরিয়ে। পুরনো দিনগুলো কি ওর মনের মধ্যে ঘাই মারে এখনও? ওর সেই দাপটের দিনগুলো অনুতাপ হয়? আমন আকণ্ঠ যন্ত্রণার দিনেও কি পুরনো দিনের স্মৃতিগুলান মজলিশ বসায় উয়ার মগজে কে জানে! মাঝে মাঝে অতি ক্ষীণ গলায় কতকিছু বলে যেত সতীকান্ত সিংহবাবু। কথার বারো আনাই ছিল অভিযোগ। আত্মীয়-স্বজন, গরম-খাম, মশা-মাছি, সরকার আর ভগবানের বিরুদ্ধে।

ফিসফিস করে বলত,' ভগবান যদি বর দিতে চায় তুয়াকে, সোনাদানা, যশ-খ্যাতি, রূপ-বৈভব-না, না, লিবি নাই উসব। বইলবি, কিচ্ছেটি নাই চাই আইজ্ঞা। শুধু আচম্বিতে মরণ দাও। আচম্বিতে মরণ।' যেন বহু দূর থেকে ভেসে আসে ওর ক্ষীণ গলা, “আইছু যখন এ দুনিয়ায়, ফেরৎ যাবিই। তেবে সার কথাটি শুনে লে। আসা যত সহজ, যাবা তত সহজ লয় হে—।'

আমি রা" কড়ি না। শুধু নয়ন ভরে দেখে যাই। কান ভরে শুনে যাই। একসময় পায়ে পায়ে বেরিয়ে আসি ওর ঘর থেকে। তখন সর্বাঙ্গ জুড়ে কুলকুল করে নদী বয়! মাস কয় বাদে মরে গেল সতীকাস্ত সিংহবাবু, সবাই স্বস্তির শ্বাস ফেলল, কেবল আমি ছাড়া। বড় দুঃখু হয়েছিল আমার। হায়রের! অত জলদি মরে গেল! আরো কিছো দিন দেইখতে পেলাম নাই শালার লরক যন্ত্রনাটা। আমার বুকের মইধ্যে একটা শাগনার বাচ্চা, সেই ছা’ বেলা থেকেই কাছে। অহরহ শুধুই কাঁদিছে। সতীকান্ত সিংহবাবুর লরকভোগের দৃশ্যটা দেখে সে টুকচান থামাত তার কান্নাটা। আসলে উই শাগন ছা'র কাঁদনাটা থামাবার তরেই লিত্যদিন সতীকাত্তর ঘরে যেতাম আমি।


দুই
তখন আমার বয়েস সাত কি আট। জিরাবাইদ ইস্কুলে পড়ি। ইস্কুলের এক নম্বর পড়ুয়া ছিলাম আমি। বাড়ির লাগাও একটা জমিন ছিল আমাদের। এক চাকেই প্রায় চার বিঘা। ঐ জমিনের ওপর পেট চলত ছটা। বাবা, দিদি আর আমরা চার ভাই। কাজেই পেট চালাতে বাড়ির সব্বাই অষ্টপ্রহর পড়ে রইত ঐ জমিনে। শোল জমিন ছিল। সবার মেহনতে ফলত হাতিঠেলা ধান। আধপেটা খেয়ে আমাদের দিন চলে যেত কোনও গতিকে। সতীকান্ত সিংহবাবু বংশের শেষ জমিদার। তারপরেই জমিদারী লোপ পায় সরকারি আইনে। জিরাবাইদ গাঁয়ে ছিল তার বিশাল বাখুল, গড়। তার সুমুখে খাড়া হলে সিংহও নিমেষে হয়ে যেত মুষাটি। অনেক গুণের অধিকারী ছিলেন তিনি। সারাক্ষণ মদের নেশায় চুর হয়ে থাকতেন। তার ওপর ছিল মেয়ামানুষের দোষ। বিত্তবানদের এ রোগটা বোধ করি মজ্জাগত। অর্থবৈভব পেলেই মইনষের সখ হয় মেয়েমানুষ পোষার। নিজের অন্দরমহলে মা লক্ষীর পায়ের ছাপটি পড়লেই, মানুষ অন্যের অন্দর মহলে নিজের পায়ের ছাপটি ফেলতে চায়। তো অতুল বৈভবের মধ্যে সতীকান্ত সিংহবাবু কেবল নিজের ঘরের মেয়ামানুষটিকে লিয়ে আর কিছুতেই সাধ মিটছিল না। লিত্যিদিন সে নতুন মেয়ে মানুষ খোঁজে। চারপাশের গাঁর এ-ঘরে ও-ঘরে তার অনের স্বাধ-আহ্লাদ মেটাবার ঠেক। আর বাঘও আড়াল করে খায় কিন্তু সতীকান্ত সিংহবাবু কদাচ সেই আড়ালখানও রাখত না। দিনে-দুপুরে শতচক্ষুর সুমুখ দিয়ে ছাতি ফুলিয়ে সে রক্ষিতার বাড়ি যেত। সিংহবাবু-বংশের বড়কর্তাকে ঠেকাবে, আমন ছাতির পাটা কার? বড় হয়ে বুঝেছি আমাদের ঘরেও সেধাবার সাধ হয়েছিল তার। দিদির তখন বছর আঠারো বয়স। বিয়ের উপাড় আসছে। বাবা ছিল এমনিতে খুব নরম আর দুর্বল ধাতের মানুষ। সতীকান্ত সিংহবাবুর মতো মানুষের সুমুখে একতাল কাদাটি। কিন্তু এই একটা ব্যাপারে সে রাজি হয়নি সতীকান্তর প্রস্তাবে। ছোটোবেলায় অতসব ব্যাপার মোটেই বুঝিনি। কেবল দেখেছিলাম, একদিন ঠায় দুপুরে বাবা ফিরল মাঠ থেকে। সেটা বোধ করি কার্তিকের শেষ। ধানের ডগায় শীষ এসেছে। কাঁদি পড়ছে। দুধ জমছে বুকে। বাবা ঘরে ঢুকেই বাখান জুড়লেন আর খুঁজতে লাগলেন বড়দাকে। আজ উয়ার একদিন কি আমার একদিন। গাইটাকে চরাই বুলাই আনতে্য পাঠালাম উয়াকে। গাই ছেইড়ে উ লেবেছে ভূতদীঘির জলায় পদ্মচাকির তরে। উদিকে গাই লেবেছে সিংহবাবুর জমিনে। প্রায় চার হাত আন্দাজ জমিনের ধানগাছ লণ্ডভণ্ড । বড়দা লুকিয়ে লুকিয়ে রইল সারা দুপুর। বাবাও গুম মেরে রইলেন সারাক্ষণ। সারা মুখে অপার দুশ্চিস্তা নিয়ে।

দুপুরের তেজ একটুখানি পড়তেই সাহেব-বাঁধের পাড় ধরে হেলতে দুলতে এলেন সতীকান্ত সিংহবাবু। বিশাল বপূখানি নিয়ে দাঁড়ালেন আমাদের জমিনের আলে। পেছনে পেছনে পাইকের কাঁধে চড়ে এলো তার পেয়ারের কুর্শিটা। বত্রিশ সিংহাসনের পুতুলের মতন নকশা কাটা তার সর্বাঙ্গে। কুর্শির পিছু পিছু এলো তার রূপোবাঁধানো আলবোলা। সোনালী ঝালর দেওয়া পাখা নিয়ে এলো সিংহবাবু-বাড়ির পুরনো ঝি বিন্দুবাসিনী। সিংহবাবু কুর্শি জ্যাঁকিয়ে বসলেন প্রশস্ত আলের ওপর। লগেন বাগ্দী ছাতা ধরল মাথায়। হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করতে লাগল বিন্দুবাসিনী। পুরুষ মাইনষের হাতের হাওয়া সিংহবাবুর শরীরে সয় না। জলপ্ত কলকে বসানো হলো আলবেলায়। লম্বা নলটি ধরিয়ে দেওয়া হলো সিংহৰাবুর হাতে। ভুভুক ভুভুক আওয়াজ তুলে তামাক খেতে লাগলেন তিনি মৌজ করে। সুগন্ধি অম্বুরী তামাকের তীব্র সুবাস ছড়িয়ে গেল হাওয়ায়। সতীকান্ত সিংহবাবুর মুখ থমথমে। চক্ষু রক্তবর্ণ। দেখে শুনে প্ৰমাদ গুনি আমরা। ভয়ে যেন কাপাস পাতা। আড়ালে আৰডালে লুকিয়ে চুরিয়ে দেখতে থাকি ওঁকে। কেবল বাবাই এগিয়ে গিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম সেরে পাশটিতে দাঁড়ান। দাঁড়িয়েই থাকেন বোবার মতন। সতিকান্ত সিংহবাবুর অমন সাড়ম্বরে আগমনের হেতুটা জিগাতেও সাহস হয় না তার।

সতীকান্ত সিংহবাবুর আগমণের হেতুটা অল্প বাদেই দেখা গেল স্বচক্ষে। জমিন থেকে অল্প তফাতে এসে দাঁড়াল সিংহবাবুদের বাছাবাছা জনাদশেক লাঠিধারী পাইক আর গোটাবিশেক পাহাড়িয়া গরু। আলবোলায় সুগন্ধি ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে একবার আড়চোখে তাকালেন বাবার দিকে। ারপর ইঙ্গিত করলেন লগদীদের। ইঙ্গিত পাওয়া মাত্তর বিশটা পাহাড়িয়া গরু নেমে পড়লো আমাদের জমিনে। মনের পুলকে খেতে লাগলো সবুজ ধানের গাছ। গোছায় গোছায়। জমিনের চৌহদ্দি ঘিরে আলের ওপর খাড়া রইলো লগদীর দল। হাতে তাদের তেল মাখানো লম্বা লাঠি। বাবা হাউমাউ করে ছুটে যাচ্ছিলেন গরুগুলোকে তাড়াতে। দু’জন লগদ দুডানায় ধরে থামিয়ে দিল তাকে। ঐ বাবা ঝাঁপিয়ে পড়লেন সিংহবাবুর পায়ের তলায়। আছাড়ি-পিছড়ি খেয়ে মড়াকান্না কাঁদতে লাগিলেন। তার চিৎকারে দুচার জন পাড়া-পড়শী জমল এধার-ওপার থেকে । আশে-পাশে এসে পুতুলের মতো দাঁড়াল। কিন্তু মুখ থেকে কথা খসায়, সাধি্য কি ওদের, কে আর সেধে সিংহবাবুর কোপে পড়তে চায়!

সিংহবাবু মৌজ করে তামাক খেতে লাগলেন। তাঁর দশাসই গরুগুলান প্রাণভরে খেতে লাগল আমাদের জমিনের ধানগাছ। খেলো যত, মাড়াল তার চেয়েও বেশি। আর, বাবা সারাক্ষণ সিংহবাবুর পায়ের তলায় নিথর হয়ে পড়ে রইলেন। আমরা আড়াল থেকে পাথরের মতন শক্ত হয়ে দেখতে লাগলাম দৃশ্যটা। ভয়ে কেঁদে কাঠ হয়ে গেছি সক্কলে। ধীরে ধীরে আমাদের জমিনটা ফাঁকা হতে লাগল। কাদায় চট্কে লণ্ডভণ্ড।

এক সময় সুয্যিদেব পাটে বসলেন। তার সোনার বর্ণ চাকি লাল হয়ে এলো পশ্চিম গগনে। সিংহবাবু উঠে দাঁড়ালেন কুর্শি থেকে। ভারি ভারি পা ফেলে ফিরে চললেন গড়ের দিকে। পেছন পেছন তার কুশর্ি, গড়গড়া, পাখাশুন্ধু বিন্দুবাসিনী, লগদী, গরু ও লোকলস্কর। আমাদের চার বিঘার চাকটিতে তখন একটি ধানগাছও আস্ত নেই।

ধাক্কটা হয়তো কোন প্রকারে সামলে নিতেন বাবা, কিন্তু বিধি বাম। পরের বছরই হলো অজন্মা। দেশ জুড়ে দারুণ খাটারশাল। ফলে একটা-দুটা করে তাবৎ জিনিসপত্তর, গরু-ছাগল, জমিজিরাত, মায় ভিটাটি পর্যন্ত বিক্রি কিংবা বন্ধক দিতে দিতে বছর দুয়েকের মধ্যে একেবারে ফতুর হয়ে গেলাম আমরা। আর, ঐ জমিনের বারো আনাই জলের দামে কিনে নিল সতীকান্ত সিংহবাবু। ধাক্কাটা বাবা সইতে পারল নাই কিছুতেই। সেই দুপুরের গুম মারা ভাবখানা আর নড়ল না তার মুখ থেকে। সর্বদাই বসে বসে শুধু ভাবত আর খকরখকর কাশত। বছর দুই না পেরাতে অতবড় জোয়ান লোকটা কেমন বুড়িয়ে ডাং মেরে গেল। এবং একদিন টুপ করে ঝরে গেল।

তার পরের অবস্থা আর কহতব্য নয়। দুদিন না যেতেই ভিটা থেকে হটিয়ে দিল সিংহবাবু। আমরা পথে দাঁড়ালাম। দিন কতক এধার-ওধার ফল-পাকুড় খেয়ে, ভিখফিঞ্চ মেগে একেবারে হেদিয়ে পড়লাম আমরা। শুরু হলো আসল অর্থে উপবাস। পেটের জ্বালায় আমরা, যে যেদিকে মন চায় পালালাম। বড়দা কোন এক মাটিকাটা দলের সাথে পালিয়ে গেল গোরাবাড়ির দিকে। সেখানে কংসাবতীর উপর ড্যামের কাজ চলছে। মেজদা ছিল চিররুগনা। সে শিমলাপালের বাজারে চট বিছিয়ে ভিখ মাগতে লাগলো। আমার তলার ভাইটার তখন বছর সাত-আট বয়েস। এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াত। ফল-পাকুড় পেড়ে খেতো। শিলাবতীর ঝিরঝিরে জলে ন্যাকড়া দিয়ে মাছ ধরত। একদিন রিঠা ফল পাড়তে গাছে উঠেছিল সাহেব বাঁধের পড়ে। মাচাতোড়ার গুচ্ছাতদের সেজবৌয়ের মাথা ঘষবার জন্য। মাত্তর এক কাঁসি পাস্তাভাতের লেভে। পা ফসকে পড়ল মাটিতে।বাপ বলার সময় দিল না। মুখে রক্ত উঠল ঝলকে ঝলকে। আমি তখন বাঁশকানালী গাঁয়ে শক্তি চদের ইস্টেটে পেষ্টভাতুয়ায় থাকি। ওদের ছাগল-টাগল চরাই। ছা-ছাওয়াল ধরি। খবর পেয়ে ছুটে গেলাম মাছতোড়ায়। চোখের জলে বুক ভাসালাম। শক্তি চঁদের কাছ থেকে কুড়ি টাকা কর্জ নিয়ে সৎকার করলাম ভাইকে। তারপর ফিরে এলাম বাঁশকনালী। আর দিদি—যার জন্য সতীকান্ত সিংহবাবুর কোপে পড়ে আমাদের হেন দুরবস্থা–তার ঠাঁই হলো পাঁচ থান ঘুরে সিংহবাবুদেরই বাখুলে। দিদি তখন চারপাশের গা-গুলোতে পাগলিনীর মতো ঘুরছিল। কোনও ভদ্র ঘরে দিনরাত হাড়ভাঙা খাটালির বদলে একচিলতে আশ্রয়ের তরে। কিন্তু দিদিকে ঠাঁই দিতে ভরসা পায়নি কেউ। দিদি যে ঘরে ঠাঁই নেবে, সেই ঘরেই তো আনাগোনা জুড়বে সতীকান্ত সিংহবাবু। কালে কালে তার দৃষ্টিবাণ দিদিকে ছাড়িয়ে ঐ বাড়ির অন্যদের ওপর পড়াও বিচিত্র নয়। আরে রামো কহো! ঘরে হাঁস-মুরগীর ভাড়ি বানিয়ে কে আর শিয়াল আমদানি করতে চায় নিজের ভিটায়।

গাঁয়ে গাঁয়ে ঠাই না পেয়ে দিদি দিনকয় ছিল শিমলাপাল বাজারের হরিবোল মেলায়। সেখানে প্রথম রাতে হাজির হলো লঙ্কা পায়ররার মতো একদল ছোকরা। পরের রাতে ওদের হটিয়ে হরিবেলে-মেলার দখল নিল একদল খাঁকি। খাকি চোখের আড়াল হতেই এলো এক দালাল। সে দিদিকে নিয়ে যেতে চায় কোলকাতায়। সেখানে নাকি অতুল সুখ, বৈভব। দিনের বেলায় যেমন তেমন, রাতটি হলেই ভয়ে কাঁটা হয়ে যায় দিদি। বুকের মধ্যে একটা জন্তু যেন হাঁচোড়-পাঁচোড় মাটি আঁচড়ায়। গর্ত খোড়ে। সারারাত।
শেষ অবধি সতীকান্ত সিংহবাবুর দুয়োরেই মাথা খুঁড়তে হলো দিদিকে। এমনিতে পেটের জ্বালার তুল্য জ্বালা নাই এ দুনিয়ায়, মানুষের ইহকাল-পরকাল ভুলিয়ে দেয়—ঠাঁই নিতে হতোই, কোথাও না কোথাও। দালালের সাথে কলকাতা যাওয়ার চেয়ে এ বরং ভালো। কথায় বলে, অচেনা দহ আর চেনা শ্মশান, দুটোই ভয়ের। দিদির কাছে, এ হলো অচেনা দহর বদলে এক চেনা দহ।

সিংহবাবুদের গড়ে থাকাকালীনই একদিন গলায় দড়ি দিয়েছিল দিদি। জিভ ঝুলে পড়েছিল হাতটাক। চোখ বেরিয়ে এসেছিল কোটর ঠেলে। যে দেখেছে, সেই আঁতকে উঠেছে।

সাহেব বাঁধের পাড়ে দেখা হতেই তারিণী ওঝা আমায় একান্তে বলেছিল, "শুধু তুয়ার দিদি লয়। পেটের মইধ্যেও একটা মইরল উই সাথে।'

শুধু তারিণী ওঝা নয়, তল্লাটের সব্বাই জানত ওটা আত্মহত্যা নয়। দিদিকে মেরে ওরা ঝুলিয়ে দিয়েছিল দড়িতে। সে নাকি সতীকান্ত সিংহবাবুর হাজার পীড়াপীড়িতেও পেট নামাতে রাজি হয়নি। ফলে, সিংহবাবু-বংশের মর্যাদা রাখতে মরতে হলো দিদিকে।
আমি তখনও বাশকনালীর শক্তি চদের দোরে পেটভাতুয়া আছি। খবরটা তারিণী ওঝার মুখে শোনামাত্তরই ছুটে গিয়েছিলাম জিরাবাইদ গাঁয়ে, ওরা লাশ জুলিয়ে দিয়েছে ততক্ষণে। আমার জীবনে এই প্রথম শরীরের তাবৎ রক্ত উথাল-পাথাল মাথায় জ্বলন্ত রাবণের চিতা। শয়তান জেগে উঠেছে মনে। প্রসন্ন ঠাকুরের আমবাগানে তপনি-ভাটের ঝোড়ের মধ্যে লুকিয়ে বসে রইলাম সারা রাত। হাতে নিলাম মাছ মারবার ক্যাঁচা। ঐ পথ দিয়েই সতীকান্ত সিংহবাবু আনাগোনা করে রোজ। আম বাগিচার পশ্চিম কোলেই ওর এক রাঢ়ের ঘর। কিন্তু না। আমার কপাল মন্দ। পরপর তিন-চার রাত উজাগর হয়েও ধরতে পারলাম না সিংহবাবুকে। শালা বোধ লেয় কোনো কিছু আন্দাজ করে সতর হয়ে গিয়েছিল। বাধ্য হয়ে ফের ফিরে এলাম শক্তি চঁদের গুড়ের মহালে। সেখানে দিনভর গুড়ে জ্বাল দিতে দিতে রাগের ফেনটা মরে গেল দু'দশ দিনেই। আসল রাগটা ক্রমশ আঠা-গুড়ের মতোই গাঢ় হতে লাগল। একটা ছবি বুকের মধ্যে ছিলই। একটা খালময়া, সব-খাউকী বিকালের ছবি। একটা পুরুষ্ট ধানের চাক। তার থোড়ে থোড়ে গাঢ় দুধ। এক বিকালের মধ্যে শতচক্ষুর সুমুখে উড়ে গেল, যেন সতীকান্ত সিংহবাবুর অম্বুরী তামাকের ধোঁয়ার সাথে ধোঁয়া হয়ে। এর সঙ্গে আর একখান ছবি যোগ হলো। ফুলের মতন একটি মেয়া উঁচু কড়িকাঠে অসহায় ঝুলছে। তার জিভ ঝুলে পড়েছে। দু'চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে কোটর ঠেলে। তার পেটের মধ্যে নিম্পাপ এক শিশু।


তিন
প্রহরাজের বউটা বড় আছাড়ি পিছড়ি কাঁদছে। আমারই ঘরের দাওয়ায় আমার পা দুটো জাপটে ধরে কাটা পাঁঠার মতো ছটকাতে লেগেছে। কিছুতেই প্রবোধ দেয়া যাচ্ছে না তাকে। হাজার হোক, মেয়ামাইনষের প্রাণ। সোয়ামীর অমন দগ্ধে দগ্ধে মরণ। চরম অসতীও সইতে লারে। এতো ফের ভালা ঘরের ঝি। গরীব হলেও উত্তম বংশে জনম।

ওর মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিই আমি। বলি, "মেয়া তুই কঁদিস না। প্রহরাজ ছিল আমার মহিন্দার। সে বিহনে তুয়ার সব দায়-দায়িত্ব আমার। সেটুকু মনুষ্যত্ব আমার আছে বটে। বিশ্ব-সনসার জানে সেটা। মাইন্দারী করে করে এ থানে উইঠেছি আমি। মাইন্দারের জীবনের দিগ্‌দারিটা বুঝি।

প্রহরাজের বউয়ের কানে ঢোকে না বুঝি কথা। সে কেবল অবোধের মতন কুলকুলিয়ে কেঁদে যায়। মেয়ার মনটা ভারি নরম। মায়া-মমতাও অঢেল। আমি জানি। তিল তিল করে আমার মনে তেমন প্রত্যয় জন্মেছে। সে ঘটনাগুলো বড় মনে পড়ছে আজ।

আমার গুড়ের মহালে কর্মচারীর সংখ্যা ছিল তিন। ক্ষুদিরাম সিং আর গুলু মাঝি ছিল মহালের মাইন্দার। আর প্রহরাজ বেজ ছিল রাতের জাগুয়া। জাগুয়া হবার যোগ্য মনিয্যি সে বটে। ইয়া বড় ছাতি। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। মুগুরের পারা বাহু। আকাট জোয়ান সে। সাহসও ধরে মনে। আর, নিজের কাজটি চেনে ষোল আনার জায়গায় আঠারো আনা। রাতের বেলায় সে দু'চোখের পাতা এক করে না। ছিচকে চোরবাটপাড়দের যম সে।

মহালে মহালে চুরির হিড়িক বেড়েছে। আমার ভরসা প্রহরাজ বেজ।

ঐ আনন্দেহ ছিলাম। কিন্তু আনন্দটা মাটি করে দিল শিমলাপাল থানার বাঁটুল সিপাই। থানার পাশেই পঞ্চাৎ অফিস। গেটের সুমুখে খাড়া হয়ে দাঁত খোঁটাচ্ছিল বাঁটুল। আমাকে দেখে দাঁতের কানাচে হাসলো। বলল, মাস মাইনে দিয়ে পাহারাদার পুষছো রাবণ। রাতে পাখি খাঁচায় থাকে তো? নাকি পাখনা মেলে ফুডুৎ।

প্রবল ধন্দের মধ্যে ডুবে যেতে যেতে শুধোই, 'তার মানে?'
" মানে, তিন রাত পরপর গিয়েও তাকে মহালে পাইনি। বাঁটুল সিপাই আবারও হাসে।

মালের লোভে এরা রাতের বেলায় মহালে মহালে ঘুরে বেড়ায়, এটা ঠিক। শুধু শুধু মিছে বলবার লোক নয় এরা।
আমি মহা ভাবনায় পড়ে গেলাম।
সেই রাতেই বেরলাম আমি। মহালে পৌছে দু'চোখ ছানাবড়া। মহাল খাঁ খাঁ। কুমা'র মধ্যে কেউ নেই। তিনটি কুঠরিই বাইরে থেকে তালা দেওয়া।
সকাল হতেই প্রহরাজকে তলব দিলাম বাখুলে। বাঘের ঝাপট নিলাম ওর ওপর। অতবড় জোয়ানটা আমার ধমক-ধামকের মুখে সারাক্ষণ মাথা হেঁট করে খাড়া রইলো। শেষমেষ অধোবদন হয়ে লজ্জ্বায় মরে যেতে যেতে বলল, 'বউটা, আইজ্ঞে, রাইতের বেলায় একলাটি লইতে লারে।'

রোগটা এতক্ষণে ধরা পড়েছে আমার কাছে। গেল ফাল্গুনে বিয়া করেছে প্রহরাজ বেজ! ফাগুনের বউ আগুন। তা, সে নাকি সত্যসত্যই এক আগুনের খাপরা। শোনা কথা। চর্মচক্ষে দেখি নাই। তো, এই কারনে প্রহরাজ রাতের বেলায় মহাল ছাড়ে? আমি তাকে এই মারি তো সেই মারি। শালা, মোর হাজার টাকার চিজ রইলো মহালে আর, তুই চইললি বউর কোড়ে শুইতে। কালকেই শালা ডাইরি কইরবো তুয়ার নামে। মহালে চুরি হলে্য তুয়াকে বি' বাঁধবেক পুলুশ। মুখে ধমক দেই বটে। কিন্তু মনে মনে হাসি। ঘরে সাক্ষাৎ আগুনের খাপরাটি গণগইন্যা হইয়ে জ্বলবেক রাতভর, আর প্রহরাজ বেজ লিত্যিদিন শরীলের সখ স্বাধ চেপে পাহারা দিবেক আমার গুড়ের মহাল। তাও কি হয়? নিজে বিয়া-থা না করলেও সেটা আমি বুঝি। কিন্তু একেরে ঢিলাও দেওয়া যায় না। মহালটি লাটে উঠবে তা'লে। তাছাড়া মাসটি গেলে বিশটি টাকা দিচ্ছি ওকে। ছ'মাসের আগাম নিয়েছে। করকরে একশো বিশটি টাকা। সে তো আর লিতি্যদিন বউয়ের কোড়ে গিয়ে শোবার তরে নয়। কাজেই ফোঁস করতেই হয়। ধমকধামক খেয়ে সে দুরাত মহাল জাগে তো তৃতীয় রাতে বিগড়ায়। আমি বিষম ভাবনায় পড়ি।

মাঝে মাঝে ওই আগুনের খাপরাটিকে একটিবার দেখতে সাধ হয়। দেখি কেমন সে মেয়া, কি উয়ার অপার মায়া, যার তরে বাঁধা চাকরিকে তুচ্ছ করে প্রহরাজ বেজ ফি রাতে পালায় কাজের থান থেকে উয়ার সঙ্গ লালসায়।

একদিন কানে এলো, প্রহরাজের নাকি বেজায় জ্বর। শুনে, গেলাম ওর বাড়ি। প্রহরাজের বউ তড়িঘড়ি আসন এনে পেতে দিল দাওয়ায়। ঘটিতে জল এনে বসিয়ে দিল সুমুখে। আমি লয়ন ভরে দেখলাম ওকে। ডাগর-ডোগর শরীরে যৌবনের ভিয়েন চড়েছে যেন! কারণে অকারণে হাঁসের মতো পায়ের পাতা মেলে ঘুরে বেড়াচ্ছিল প্রহরাজের বউ। আমি ওকে পলকহীন দেখতে থাকি। একসময় ট্যাক থেকে ফস করে বের করে ফেলি একটি পাঁচ টাকার নোট। বউকে কাছে ডাকি। নোটখানা গুজে দিই ওর হতে। অল্প দূরে বসে বসে কুলকুচো করছিল প্রহরাজ বেজ। লাজুক হেসে শুধোয়, "ফের টাকা কিসের লেগে আইজ্ঞা?"
পরথম এল্যাম যে। বউয়ের মু দেখতে হয় টাকা দিয়ে।
টাকাটি হাতে মুঠো করে ধরে বউ গড় হয়ে প্রণাম করল আমাকে। আমি ওর মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে আশির্বাদ করি।
বলি, বাহ ভারী সুলক্ষণ মেয়া। সর্ব অঙ্গে সুলক্ষণ। বাইচে থাকো মা।

অতপর প্রহরাজের শরীরের খোঁজ খবর করি আমি। অনেকক্ষন ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয় ওর বারামের সুলুকসন্ধান নিই। উঠোনে নামতে নামতে বলি, ভয় নাই তুয়ার। আমি তো আছি। ফের বৈকালে এসে খোঁজ লিয়ে যাবো। চলি বৌমা।

অমন উদার ‘গলা, (মালিক) ক'জনের কপালে হয়? প্রহরাজ আর তার বউ কৃতজ্ঞতায় গলে যেতে থাকে।

জ্বর সারলে প্রহরাজ যোগ দেয় কাজে। একটা ছোট্ট কলসীতে সের-দুই গুড় ভরে তুলে দিলাম প্রহরাজের হাতে। লিয়ে যা। বৌমা গুড়-মুড়ি খাবেক।

দিনদুই বাদে সেই গুড় ফিরে আসে কলাপাতার ঠোঙায়, গুড় পিঠা হয়ে। প্রহরাজ বলে, আপন মু দেইখবার টাকা দিছলেন। উই টাকায় তেল আর আওয়াচাল কিনেছে মেয়া। আর আপনারদিবা গুড়। তিনে মিলে এই গুড়পিঠা
শুনতে শুনতে আমার মনে পুলক আর ধরে না। মুচকি হেসে বলি, আমন গুড়পিঠা পেইলে আমি রোজ রোজ গিয়ে বৌমাকে মু দেখানি টাকা দিয়ে আসবে।"

শুনে প্রহরাজ বেজ হলদে দাত বের করে হাসে। বলে, আপনার বৌমা বলে, একদিন আপনাকে পাত পেইড়ে খাবাব্যেক। মুরলা মাছের টক রাধবেক পাকা তেঁতুল দিয়ে। আলতি দিয়ে মৌ-ডাল ছাতুর ঝাল। কাল্লা দিয়ে লটিয়া শাক। আমচুর দিয়ে মুসুর-কলাইয়ের ডাল-' n

শুনতে শুনতে আমার মনে পুলক আর ধরে না। মুচকি হেসে বলি, আমন গুড়পিঠা পেইলে আমি রোজ রোজ গিয়ে বৌমাকে মু দেখানি টাকা দিয়ে আসবো।"

শুনে প্রহরাজ বেজ হলদে দাত বের করে হাসে। বলে, আপনার বৌমা বলে, একদিন আপনাকে পাত পেইড়ে খাবাব্যেক। মুরলা মাছের টক রাধবেক পাকা তেঁতুল দিয়ে। আলতি দিয়ে মৌ-ডাল ছাতুর ঝাল। কাল্লা দিয়ে লটিয়া শাক। আমচুর দিয়ে মুসুর-কলাইয়ের ডাল-'

শুইনতে শুইনতে আমার জিভে জল সরে রে! আহা! ঝিমির ঝিমির পানি হবেক। তখন আমচুর দিয়ে মুসুর-কলাইয়ের ভাল। সাথে টুকচান পত্ত দিয়ে চুড়চুড়ি মতন। আ–হা তা, কবে? সিট্যা হবেক কবে? বোমাকে শুধাই আইবি কাল।"

লাজুক লাজুক গলায় আকাট জোয়ানটা বলতে থাকে, “তুমার তরে বড় দুখ করে তুমার বৌমা বলে, আহা-রে, বেবসাপাতি, গুড়ের মহাল, দু'পাকিটে টাকা, কিন্তু টুকচান আদর সুহাগ দিবার কেউ নাই বিশ্ব-সনসারে। একটা বিয়া-থাও করলেক নাই ইখন তঙ্কো।"

শুনতে শুনতে মনটা যেন ভুয়াশ গাছের কোটর। কেমন খা-খাঁ ফাকা-ফাকা লাগে। সারা জীবনটাকে মনে হয় যেন এক বগচরা বিল। যুঝতে যুঝতে কবে চলে গেল বিয়ার সময় কবে? শক্তি টদের মহালে? ব্যাঙ্কবাবুর পশ্চাতে কে জানে!

কোনও গতিকে মনের কথা চেপে বলি, উসব কথা ছাড় তো। আগে বল, উই মুরলা মাছের টক কবে খাবাবেক আমার বোমা ?


চার

শক্তি চঁদের মহালে রসে জ্বাল দিচ্ছিলাম সকাল থেকে। বৈশাখ মাস। তাল-গুড়ের সময়। উনানে ডেগ্‌ চাপিয়ে তালরস ছেকে ছেকে ঢালি জ্বাল দিতে থাকি উনানের পেটে। রস ফুটতে ফুটতে গাঢ় হতে থাকে। কিন্তু সে যে কী কষ্টের কাম। রোদের তাপ বাড়তে না বাড়তেই সারা অঙ্গে জ্বালা ধরে। তার ওপর আগুনের তাপ। আঙরা-পোড়া হয়ে যায় শরীর। আগুনের বেষ্টনীর মধ্যে কেটে যায় দিন-রাত-মাস-মরসুম।

একদিন দুপুরবেলা তলব এলো শক্তির চঁদের বাখুল থেকে। বিডো সাহেব এসেছেন। তাকে জীপে তুলতে যেতে হবে্যক। সাহেবদের মহিমা আমার ভালোই জানা আছে। মাঝে মাঝে এক ব্যাঙ্কের বাবু আসেন শক্তি চঁদের দুয়োরে। সাহেব-বাঁধের ওপারে তার ভুটভুটি। কেজি দুই গুড়, কেজিটাক লবাৎ, আধসেরটাক নিমফুলের মধু কিংবা খড়ে জড়ানো পাকা রুই মাঝে মাঝেই পৌছে দিতে হয় আমাকে ভুটভুটির পাশে। আজ দেখলাম বিড়ো সাহেব বসে রয়েছেন শক্তি চঁদের বারান্দায়। সামনে রাখা মাটির কলসীতে গুড়, সের পাড়েক। পাতার ঠোঙায় লবাৎ।

বিডো সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে তুলে নিলাম সাহেবের সুটকেস। ডানহাতে গুড়ের কলসীখান তুলতে যাচ্ছি, সাহেব বললেন, ওগুলা থাক। তাহলে এবার থেকে মজুরদের খাতাপত্রগুলো ঠিকঠাক রাখবেন। একবার ছেড়ে দিলাম, বারবার ছাড়বো না। আমি তো থ, হাতের লক্ষী পায়ে ঠেলে, এ কেমন ধারা সাহেব ? অগত্যা সুটকেসখানা বাঁগিয়েই হাঁটতে থাকি সাহেবের পিছু পিছু। মাথার ওপর সূয্যিদেব জ্বলতে থাকেন।

হাটতে হাটতে সেই পুরনো লোভটা ভুট কাটল মনে। ব্যাঙ্কের বাবুকে যে আর্জিটা জানিয়ে জানিয়ে থকে গেছি, সেটাই ফের উগরে বসলাম বিডো সাহেবের সাক্ষাতে।

একটা লোন-পাতি কিছো কইরে দান আইজ্ঞা। এই চৈত বৈশাখের রোদগরমে দিনরাত একঠাই আগুনের পাশে বইসে রক্ত আমশা ধইরে গেল।

বিডো সাহেব শুধোন, "তোর নাম কি?"

বলি, অধমের নাম আইজ্ঞা, রাবণ মাঝি।'

বিডো সাহেব শুধোন, এখানে তোর মাইনে কত ?

‘মইনা নাই আইজ্ঞা। আমি চঁটদের দুয়ারে পেটভাতুয়া।"

অল্প চমক খেলেন বিড়ো সাহেব, মানে? মইনে নেই?"

লয় আইজ্ঞা। ছা বেলায় ছুটো ভাইটা গাছ থিক্যে আছাড় খেইয়ে মরলেক উয়ার সৎকার কইরতে বিশ টাকা লিল্যম শক্তি চঁদের পাশ থিক্যে। সে কর্জ সুদে-আসলে শোধ হইলো পর মাইনে দিবেক।
বিডো সাহেবের চোখ কপালে উঠে যাচ্ছিল। বললেন-কর্জ শোধ হতে আর কত বাকি?

- "সে আমি কি জানি ? চঁদবাবু জানে বটে।

গুম মেরে গেলেন বিডো সাহেব! হাঁটতে লাগলেন চুপটি করে। একটু বাদে বললেন, ব্যাঙ্ক থেকে কঞ্জ দিলে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবি?

শুনে আমার ছতি কাঁপে। ভর লাগে। ফের লোভ হয়। জবাব দিই না। বিডো সাহেব বলেন, টাকা পেলে কি করবি?

ভেবে টেবে জবাব দেই। একটা ঘোড়ার গাড়ী ভাড়ায় খাটাবো আইজ্ঞা। ইদিগ সম্বচ্ছর গুড়ের মরসুম। তাবাদে মাছের ডিমের পাউস আছে অনেক। ঘোড়াগড়ির চাহিদা খো-ব৷"

আমার নাম করে একটা ফরম আনিস বান্ধ থেকে। বলবি, মৈত্র সাহেব পাঠিয়েছেন।"
বিড়ো সাহেবের দয়ায় ঘোড়ার গাড়ি পেলাম ব্যাঙ্ক থেকে। মাসে দেড়শো টাকা শোধ দিতে হবে। শক্তি চঁদ তো রেগে কাঁই। শালা নিমক হারাম। জেলের ঘানি টানাবো তুয়াকে। মৈত্র সাহেব আর কদিন? তারপর তুয়াকে কে বাঁচায়?

চৈত-বৈশাখে দেদার তালের রস নামে। মহালে মহালে গুড় হয়। আবার কার্তিক থেকে মাঘ অবধি খেজুর গুড়। ওড়ের টিনে গড়ি বোঝাই করে আমি জোরসে ছুটাই।
দিনভর। ভাড়া যা পাই মন্দ নয়। খেয়েদেয়ে কিছু বাঁচে।

আকাট দুপুরে রাস্তার ধারে গাড়ী থামিয়ে মুরলার চায়ের দোকানে চা আর লেড়ে বিস্কুট খাই আরাম করি বসে বসে। ঘোড়াটা গাড়ির সাথেই বাঁধা থাকে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পিঠ পুড়ায়। তপ্ত মাটিতে বেশিক্ষণ পা রাখতে পারে না। মাঝে মাঝেই পা তুলে নেয় মাটি থেকে। ক্ষুরে ক্ষুরে খটখট আওয়াজ তোলে।

মৈত্র সাহেব মানুষটি বড় ভালো। তাই মাসখানেক বাদে যখন একটা মহাল খোলবার লোনের জন্য আর্জি জানালাম, পঞ্চাত্কে বলে, করে দিলেন লোনটা। বললেন, "ঘোড়া গাড়িটার কি গতি হবে?

বললাম, সিটা আমি যজ্ঞেশ্বর লোহারকে ভাড়ায় দুবো। মাসে মাসে ভাড়া দিবেক সে। ব্যাংকের লুন তো শোধ কইরে দিছি, আইজ্ঞা।

মহালটা চালু হলো । চলছেও খোব! ভিটা কিনেছি। ঘর বানিয়েছি। সহায়-সম্বল হয়েছে। তবুও যখন-তখন মনটা বড় খাঁ-খাঁ করে। মনে হয় কিছুই যেন নাই আমার। সবাই বলে, ইবার একটা বিয়া-টিয়া কর হে রাবণ। বংশে বাতি দিবেক কে?"

শুনে মনটা খারাব হয়ে যায়। ফোঁপরা বাঁশের মতন বাজে। আড়াই কুড়ি উম্বর হলো আমার। বিয়া করবার কি আর বইস আছে?


পাঁচ

মুরলা মাছের টক খেয়ে ফের নিমপাতা দিয়ে সইজ্না ডাটার শুক্তানি খাওয়ার সাধ জাগল মনে। তারপর বেশি পরিমাণে রসুন দিয়ে বগা লাউয়ের ছেঁচকি। তারপর জলা গুড় দিয়ে মুড়ির ছাতু। সিঁদুর-পাকা আমের সাথে ধবলী গাইয়ের মারা দুধ...।

প্রহরাজ বেজের যদ্দিনে হুশ হলো, তদ্দিনে মাছির পা আটকে গেছে গুড়ে। প্রহরাজ লোকটার যেমন ষাঁড়ের মতো বল, তেমনি ষাঁড়ের মতো গোঁয়ারও। আর গোঁয়ার লোকগুলো যেমন সরল, ক্ষেপে গেলে তেমনি বিপজ্জনক। বউটাকে গুমসে গুমসে আম-ছাঁচা করল প্রথমে। তারপর রাতের বেলায় হেতার নিয়ে বসে রইল সাহেব বাঁধের পাড়ে। নিজেকে দিয়ে বুঝি তো। ঐ ক্ষণটা বড় খ্যারাব। দিদি যেদিন মরল, সেদিন রাতে সতীকান্ত সিংহবাবু প্ৰসন্ন ঠাকুরের আমবাগিচা দিয়ে হাঁটলে ঐ রাতেই খতম হয়ে যেত। বাপ বলে আর উঠে দাঁড়াতে হতো না। ভাবলাম, নাহ। সংযম হারানো ঠিক লয়। আজকের রাতে ফিরে যাওয়াই উচিত। বড় কষ্টে কাটল সারা রাত।

একদিন সকালবেলা প্রহরাজ এসে হাজির। আমি তখন উঠোনের আকোড় গাছটার তলায় বসে খিয়ান জালখানা সারাচ্ছিলাম মনোযোগ দিয়ে।

বললাম, কিরে ? সকাল সকাল বড় যে ?

চুপটি করে দাড়িয়ে রইল প্রহরাজ।

বললাম, দাদন-টাদন এখন হবেক নাই। আগের গুলান আগে শোধ কর।

প্রহরাজের মুখখানা গম্ভীর লাগছিল। রগের শিরা টানটান। একটুখানি চুপ থেকে আচমকা বলে উঠল, একটা কথা জিগাবার লহগ্যে এল্যাম্
“কি কথা?”
'বউ ক্যানে লিদের ঘোরে তুমার নাম আউড়ায় ? '
আমি চমকে উঠি। হাতের ফাতি থেমে যায়। হা করে তাকিয়ে থাকি প্রহরাজের দিকে। তারপর হা-হা রবে হেসে উঠি৷
'আউড়ায় নাকি? আমার নাম? তুই শুইনেছিস ?'

- নীরবে মাথা দোলায় প্রহরাজ। বিড় বিড় কইরে তোমার নামই আউরায়। শুকনো খটখাট গলায় বলে, 'কিন্তু আউড়ায় ক্যানে সিট্যা বল।"

আমার মনে পুলক আর বাগ মানছিল না। আড়চোখে প্রহরাজকে একবার দেখে নিয়ে বলি-'সিট্যা আমি জানবো ক্যামন করে্য?' মিচিক মিচিক হাসি আমি, 'তুয়ার বউকে জিগাস নাই?"

'জিগাইছিলাম। শালী বলে,স্বপনের কথা আমি কি জানি?' বলতে বলতে প্রহরাজের মুখ অসহায় হয়ে ওঠে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে- 'আমার বউটাকে তুমি ছেইড়ে দাও রাবণদা। সে তুয়ার মেয়ার মতন।'

এই দ্যাখ আমি নাচার হয়ে বলি, 'শুধুমুদু আমাকে দোষ দিস তুই। যাহ্ শালা, ঘরে যা।' আমি ফের ফাতি চালাতে থাকি জালে।

অল্পক্ষণ চুপ করে খাড়া থেকে ঘরের দিকে পা বাড়ায় প্রহরাজ।
একটা কথা। আমি পেছন থেকে ওকে ডাকি, ‘তুই বাপ আজ ফের ধরা পইডলি আমার পাশ। রাতের বেলায় মহাল ছেইড়ে ফের ঘর পালাচ্ছু তুই। তা না'লে স্বপনের কথা জানলি ক্যামনে?'

প্রহরাজজ দাঁড়াল বটে। তবে জবাব দিল না আমার কথার।
আমি খিচিয়ে উঠি, 'অমন করলে ঘাড়টি ধরে দূর কইরে দুবো মহাল থিক্যে। আর একটা দিন দেখি। ভাত ছড়ালে আমার কাগের অভাব হবেক নাই।'

মাথা নিচু করে প্রহরাজ পায়ে পায়ে বেরিয়ে গেল আমার উঠান থেকে।

বললাম বটে, তাড়াব, তা বলে কি সত্যি সত্যিই তাড়াব? তাই কি আমি পারি? এককালের মাইন্দার হয়ে মাইন্দারের চাকরি খাব আমি? তাছাড়া প্রহরাজকে তাড়ানো মানে নিজের পায়ে নিজে কুড়াট মারা। আমি তাড়ালে সে অন্য মহালে গিয়ে মাইন্দারের কাজ নেবে। রাত কাটাবে নিজের ঘরে। তার মানে আমার ইহকাল ফর্সা। এখন তবু ৱাতগুলোতে আমাতে আর প্রহরাজেতে ভাগাভাগি করে চলছে। না, প্রহরাজ বেজকে তাড়ানো যাবে না। তার বদলে, দরকার হলে, আরও দাদন দিয়ে ওকে পাকে-প্রকারে বেঁধে ফেলতে হবে।

পাশের গাঁয়ের যজ্ঞেশ্বর লোহার আমার প্রাণের বন্ধু। শক্তি চঁদের মহালে বহুদিন পাশাপাশি গুড় পাক করেছি দু’জনে। এখন আমার ঘোড়ার গাড়িখানা ওই ভাড়ায় চালায়।

যজ্ঞেশ্বর একদিন সঙ্গোপনে বলল, মানুষকে কব্জা করতে হইলে লিশা খাবাও হে। লিশার পাশ দ্যাবতাও জব্দ।"

সিংহবাবুর বাড়িতে একটা চন্দনা ছিল। খাঁচার মধ্যে নয়। বাবুদের বাগানে ওড়াওড়ি করত। কিন্তু পালাত না। দিনের মধ্যে রোজ দুবার একটি নির্দিষ্ট টাইমে সে অন্দরমহলে গিয়ে দানাপানি খেত। তারপর ফের উড়ে যেত বাগানে। ভারি অবাক লIগত আমার। বাঁধা নেই, ছাদা নেই, ডানক ছাঁটার বালাই নেই, পাখি তবুও পালায় না। পরে জেনেছিলাম, পাখিটাকে আফিম খাওয়াত ওরা। আফিমের নেশার কাছে বশ ছিল ওটা।

কাজেই যজ্ঞেশ্বরের কথাটা মনে ধরে আমার। কয়েক বোতল দেশী নিয়ে ঘড়িটাক রাতে গেলাম মহালে। প্রহরাজ তখনও ঘরের দিকে পা বাড়ায়নি। আমাকে দেখে অবাক।

বললাম, মনটা ভালো নেই রে প্রহরাজ, ভালো নেই। আজ আমি থাইকবো মহালে।
ছুটটে যা দেখি। হাইস্কুলের পাশ থিকে একঠোঙা ফুলুরি কিনে লিয়ে আয়। এই লে টাকা।
ফুলুরি দিয়ে মদ খেতে লাগলাম আমি। প্রহরাজ পাশটিতে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল ভুলভুল করে।
বললাম, আয় বস। বসল ও।
বললাম, খা। ওর লাজ-সঙ্কোচ যায় না তখনও।
বললাম খা না। লজ্জা কি? আমি অতো মালিক চাকর নাই বুঝি। আরে, দুদিন আগে তো চাকরই ছিলাম। শক্তি চঁদের গুলাম'
বলতে বলতে একটা বোতল এগিয়ে দিলাম প্রহরাজের দিকে। বোতলটা খুলে চকঢ়ক করে দু'টোক খেলো প্রহরাজ।
শক্তি চঁদেরর মহালে রসে জ্বাল দিতে দিতে আমার সর্বাঙ্গের চাম সিদ্ধ হয়ে্য যেতো। আমি পুরনো দিনের কথা পাড়লাম, একদিন ভোখের জ্বালায় এক মগ রস খেইয়েঁছিলাম বলে শক্তি চঁদ মু চিরে ঢেলে দিয়েছিলো এক মগ গরম গুড়। মুয়ের সেই পোড়া দাগ, এই দ্যাখ ইখনো রয়েছে থোট, নাকে, গলে। এই দ্যাখ, এই দ্যাখ্য'

বলতে বলতে গলা ধরে আসে আমার। চোখের কোনা চিকিকিয়ে ওঠে। বুঝি, নেশটা হচ্ছে। নেশা হলেই আমার ভিতরের বহুৎ কিছু ভুট মারতে মারতে উঠে আসে ওপরে। কিছু কিছু গুপ্ত ইচ্ছা প্রকট হতে থাকে।
একটা নতুন বোতল খুলে দু'টোক গলায় ঢেলে বলি, “খেজুর গাছের তবো দয়া মায়া আছে, বল শীতকালেই বেশির ভাগ রস পয়দা করে। শীতের রস জ্বাল দিতে অত কষ্ট নাই। আগুনের পাশে আরাম। দয়া নাই তাল গাছের। শালা ঘোর বৈশাখে রস ঝরাবেক। বৈশাখে বলে এমনিতেই মাইনষের অঙ্গের চাম সৰ্বক্ষণ জ্বইলছে। উয়ার মধ্যে রস জ্বাল দাও দিনরাত। শালা বেজন্মা গাছ। গাছ বলে তুমার একটা বেবেচনা থাইকবেক নাই হে!"

প্রহরাজ নিঃশব্দে খাচ্ছিল। ওরা সারা মুখে ঘাম জমছিল। চোখের ললিটা গাঢ় হচ্ছিল। ঠোট কাঁপছিল। বিড়বিড় করে বলল, 'এ দুনিয়ায় কারই বা বেবেচনা আছে? সব শালা মা-মেইগাকে চিনা আছে।"

এমন কথায় বড় ব্যথা পেলাম আমি। মানুষ জাতের ওপর প্রহরাজের ঘৃণা যে মূলত আমাকে কেন্দ্র করেই, সেটা বুঝি। একটা আলতো টেকুর তুলে আমি তাকালাম ওর দিকে। মনটা কেমন হাঙ্কা লাগছে। ভাবনাগুলান যেন শিমূল তুলার মতন ফুরফুরে হয়ে উড়ছে মগজে। বড় উদার উদার লাগছে নিজেকে।

বললাম, একটা কথা তুয়াকে সোজাসুজি বলি প্রহরাজ। তুয়ার বউটাকে দেইখে ইদানিং ফের বিয়ার ইচ্ছা জেইগেছে রে। বড় ভালা বটে তুয়ার বউটা। অর্থাৎ কিনা আমার বৌমাটা। কেমন বাঁশপাতির পারা নাক...। চালতাফুলি মুখ. জামিরের কুয়ার পারা থোঁট...।

প্রহরাজ নিঃশব্দে তাকিয়েছিল আমার দিকে। আমার মুখে নিজের বউয়ের অঙ্গের বাখান শুনছিল মন দিয়ে।
ফিক করে হেসে বললাম, তুই দেখিস নাই

প্রহরাজের মুখের সে ধার নেই এখন চোখেও নেই সেই আগুন। তার বদলে ঘোলাটে চোখে একধরনের ভোঁতা নজর! চাল-ধোওয়া জলের মতন। মাথা নাড়তে নাড়তে প্রহরাজ বলল, লয়। দেখি নাই।

- ধুশ শালা আমি ঢোক-দুই খাই। তারপর ওর কাধে চাপড় মেরে বলি, ইসব না ভাইললে বউ তো রাতের বলায় আমার নাম আউড়াবেকই।

কেমন অসহায় লাগছিল প্রহরাজকে। ঢুলু ঢুলু চোখে একধরনের বোবা যন্তন্না। একটা চার-পা-বাধা শুয়ারের মতন লাগছিল ওকে। সহসা খাওয়াটা বাড়িয়ে দিল সে। এক এক ঢেকে বোতলের মাল নাৰতে লাগল তলায়। মাথাটা মাটির দিকে ঝুঁকিয়ে ঢুলতে লাগল ও ।

এক সময় মুখ তুলে ফিক করে হাসল। বলল, তুমাকে একটা কথা বলি নাই।'
আমি চোখ তুলে তাকাই, কী কথা বল।
হি-হি করে হাসল প্রহরাজ। তারপর বলল, আমরা আর নাই থাকবো ই-তল্পাটে। "মানে ? আমি ভীষণ চমকে উঠি।

আমরা চলে যাবে বেলিয়াতোড়। সেখোনে আমার একটা মামু আছে না? উয়ার তো ছেইলা-পুইল্যা নাই। উ" আমাদেরকে জমিন দিবেক। ঘর কইরে দিবেক।
হি-হি করে হাসতে লাগল প্রহরাজ। আমার চুপসে আসা মুখখানার দিকে তাকিয়ে সহসা হাসিখানা বেড়ে গেল তার। বলল, মামু কয়, প্ররাজ রে, এ শালা মহাল পাহারা দিতে দিতে কবে না কবে চোরের হাতে মরবি তুই। তার চে’ আমার ঘরে চল। কথাটা তুমার পাশ ভাঙি নাই, রাবণদা। তুমি বাদী হবে, তাই। আজ আচমকা মু ফুইটো বাহার হইয়ে গেল কথাটা।"

শুনতে শুনতে নেশাটা কেটে যাচ্ছিল দ্রুত। বললাম, চইলে যাবি মানে? আমার মহাল পাহারা দিবেক কে? ঘোর মরসুম ইখন।

প্রহরাজ বেজ বালকের মতো সরলপানা হাসে। তারপর মাথার ওপর আঙুল তুলে দেখায়, উই। উ-ই যে, যিনি উপরে আছেন, তিনি জাগবেক তুমার মহাল।"

‘থাম। তামাশা রাখ- সহসা জেগে ওঠে পিতল-চোঁয়া রাগ, আমার বকেয়া দান ফেরত দিয়ে তবেই লড়বি ইখেন থিক্যে।
প্রহরাজ যেন নেতিয়ে পড়ছে ক্রমশ। তার মধ্যেও বিড়বিড় করে বলল, দুবো। মামুর সম্পত্তিটা পেইলে্যসবার ধার মিঁটাই দিবো কড়ায়-গন্ডায়। বলতে বলতে খেজুরপাতার তালাইয়ের ওপর সটান ওয়ে পড়ল প্রহরাজ বেজ। শুয়েই চোখ বুজল৷

আমার ভেতরের সব কলকব্জায় ততক্ষণে আওয়াজ উঠেছে ঝনাঝন প্রহরাজকে দুহাতে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলি, এই প্রহরাজ, এই শালা, কবে যাবি তুয়ারা? কবে?

আমার ঝাকুনিতে চোখ খুললো প্রহরাজ। যেন এই মাত্তর এক অন্য জগৎ থেকে ফিরে এলো। মুখখানা অকারণে চুষছিল সে। যেন যষ্টিমধু চুষছে। কিন্তু জবাব দেবার ক্ষমতা নেই তাঁর। তবুও কোনওক্রমে উচ্চারণ করল, ঠিক নাই। কাল ভোরেও চইলে্য যেতে পারি। ফের বেঁহুশ হয়ে গেল প্রহরাজ বেজ।

আমার ভেতর একটা ঘন্টা বাজছিল অবিরাম। ঘন্টাটা থামছিলো না কিছুতেই। দুহাত বুকের উপর আড়াআড়ি রেখে আমি বসে রইলাম অনেকক্ষণ।

একসময় আমি উঠে দাঁড়ালাম। পায়ে পায়ে প্রহরাজের পাশটিতে গেলাম। শক্ত হাতে ওকে তুলে ধরে বসালাম। চোখ দুটো অনেক কষ্টে খুললো প্রহরাজ। পাতনি কুচকে তাকালো আমার দিকে।

বললাম, কাল ভোরে গা ছাড়বি শালা, আজ রাতভর মদ গিলছিস ইখ্যেনে? ওদিকে কচি লাউডগার পারা মেয়াটা হয়তো ভয়ে-ভাবনায় কাঠ। শালা চামার, উঠ। উঠ শালা ভোঁদর।

আমার বাখানের চোটে প্রহরাজের নেশাটা যেন অল্প পাতলা হলো। আমার দিকে একপলক তাকিয়ে খাড়া হলো সে। তারপর ভেঁউ ভেঁউ করে কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়লো আমার পায়ের তলায়।

-আমার বউটাকে তুমি ছেইড়ে দাও রাবণদা। পায় পড়ি তুমার। তুমার ধরম হবেক হে-।
আমার পায়ের তলায় শুয়ে কাটা পাঁঠার মতো ছটকাতে থাকে প্রহরাজ বেজ। খানিকবাদে ফের ঘুমিয়ে পড়ে। আমি ওকে টেনে তুলি। খাড়া করে দাঁড় করাই।

বলি, চল বাপ। তুয়াকে বৌমার পাশ পৌঁছে দিয়ে আসি। আহা, সোনার বন্ন মেয়া সে। তুই বিহনে উয়ার চোখের কোনায় কালি জইমছে। রাত পুহালে তুয়াদ্যারর ফের কত ঝঙ্কট।"

আমার কাঁধে ভর দিয়ে বাইরে বেরয় প্রহরাজ। টলোমলো পায়ে হাঁটতে থাকে। আমার বাঁ-হাতে আর কাধে তার মুখের দুর্গন্ধময় লালা গড়িয়ে পড়ে।

উঠানের মধ্যে একটা তেঁতুলগাছ। বছর দশেক বয়েস তার। চামড়ায় সবে ফাট ধরেছে। উল্কি ছাপ পড়েছে গায়ে। লাল বিষপিপড়ের দল আনাগোনার পথ বানিয়েছে গাছের সারা অঙ্গে।

ঐ অবধি গিয়ে আর হাটতে পারল না প্রহরাজ। গাছের গায়ে ঠেশ দিয়ে পঁড়িয়ে রইল।

আমি বলি, কি হইল্যাক রে? চল। বৌমার পাশ যাবি নাই?

আলতো মাথা দোলায় প্রহরাজ। যাবে। মুখ দিয়ে কথাগুলো বলতে পারে না সে। কেবল গোঙানির মতো একজাতের আওয়াজ বেরিয়ে আসে।

একি ফ্যাসাদে ফেইললি বলতো এই মাঝরাতে! আমি নিজের মনে গজ-গজ করি, কাল ভোরেই যার জনমভূমি ছেইড়ে যাবার কথা, সে কিনা মাঝরাত অবধি মদ গিলে আমার ঘাড়টিতে চাপল্যাক্‌! দাঁড়া। খাড়া হইয়ে্য থাক ইখ্যেনে। দেখি,কি বেবস্থা কইরতে পারি।"
বলতে বলতে আমি ঝটিতি ঘরে ঢুকি। দু'গাছা মোটা পাটের দড়ি নিয়ে ফের ফিরে আসি তেঁতুল গাছের গোড়ায়। প্রথমে ওর হাত দুটাকে গাছের সাথে বেড় দিয়ে পেছনের দিকে শক্ত করে বাঁধি। বার-দুই হাত নাড়ায় সে। কিন্তু বেহঁশ ভাবটা কাটে না। তারপর তা পা দুটোকে একসাথে কষে বাঁধি। জোড়া-পা খিঁচে বেঁধে দিই গাছের সাথে। ততক্ষণে বোধ লেয় নেশটা খানিকে কেটে এসেছে ওর মৃদু টানাটানি জুড়ে দেয় প্রহরাজ। মুখে বিড়বিড় করে বলতে থাকে, আমাকে বাঁইধল্যে ক্যানে রাবণদা? বাঁইধলে ক্যানে ?"

অমনি রে। ভয় পাস নাই।’ বলতে বলতে ওর পরনের লৈতাখানা খুলে নিয়ে চরচর করে দুটুকরা করে ফেলি। এক টুকরা ওর মুখের মধ্যে ভালো করে গুঁজে দিই। অপর টুকরা দিয়ে ও মুখখানা ঠেসে বেঁধে দিই। এবার অন্য দড়িগাছা দিয়ে ওকে পা থেকে গলা অবধি গাছের সাথে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে আচ্ছাটি করে বাঁধি। বিপদের আঁচ পেয়ে তখন নিস্ফলা ছটকানি শুরু হয়েছে প্রহরাজের। কিন্তু ঐ পর্যন্ত। নড়াচড়া কিংবা কথা বলার আর কোনও উপায়ই নেই ওর।

আমার আর অল্পই কাজ বাকি ছিল। আড়ত থেকে একখানা গুড়ের পায়া এনে গাছের তলায় রাখি। তারপর খাবলা খাবলা গুড় নিয়ে যেমন করে আবড়া মেয়ার গায়ে তেল-হলুদ মাখায় বিয়ার আগে, ঠিক তেমনি করে মাখাতে থাকি প্রহরাজের সারা গায়ে। বেশ পরিপাটি করে মাখাই। নাকের ছ্যাঁদা, কানের গর্ত, চোখ, মুখ, লিঙ্গ, অণ্ডকোষ—কিছুই বাদ দিইনা।

গুড়ের মিঠে গন্ধটা আমার নাকে ধাক্কা মারছিল বারবার। গন্ধটা চিরকালই আমার বড় প্রিয়। আহা, কী মিঠা সুবাস! তেঁতুল গাছের বিষপিপড়াগুলানও এই গন্ধটাকে যে কী ভালবাসে।

গুড় মাখানো শেষ হলে আমি আড়তে ঢুকি। দু’চারটা গুড়ের পায়া ফাটাই। কিছু গুড় গড়িয়ে পড়ে মেঝেতে। বাঁধের জলে হাত ধুয়ে মদের বোতল আর শালপাতার ঠোঙাগুলো ছুড়ে দিই জলে। তারপর ফের ফিরে আসি তেঁতুল তলায়।

গাছের ছায়ার আঁধারে প্রহরাজের গুড় মাখানো শরীরখানা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কেবল, পিছু ফিরবার পূর্ব মুহুর্তে, দেখলাম একজোড়া পলকহীন চোখ। ভয়ে, তরাসে, অবিশ্বাসে, আতঙ্কে পাথরের মতন থির।

- আধারপথ ভাঙতে ভাঙতে আমি এগোচ্ছিলাম প্রহরাজের বাড়ির দিকে। প্রহরাজের বউটা নিশ্চয় এতোক্ষণে ভয়ে-তরাসে কাঠ। রাতের বেলা একলা থাকতে ভারি ডর লাগে সে মেয়ার। ইচ্ছা করছে, আজ রাতে টুকচান সাহস জুগাই তাকে। কিন্তু না। ঘরের কাছটিতে এসেই সামলে নিলাম নিজেকে। আজ রাতে কদাচ লয়। সতীকাত্ত সিংহবাবু বার বার বলতেন, কোনও অবস্থাতেই সংযম হারাতে নাই। যে রমণীর সোয়ামী লরক-যন্ত্রনা পেতে পেতে মরছে শীতের রাতে, তেঁতুল তলায়, নিঃশব্দে,— উয়ার সাথে সহবাস৷ মহাপাপ হবেক তাতে। আর, এ কথা দুনিয়ার কেই বা না জানে যে, পাপ উয়ার বাপকেও নাই ছাড়ে !


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ