ঘাটে ফেরিটা ভিড়েছে ঠিকই কিন্তু কোনো গাড়ি নামতে পারছে না। একেবারে ফেরিতে ওঠার মুখেই পন্টুনের ওপর একটা মালবোঝাই ট্রাক মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, দু’পাশে যতোটুকু জায়গা খালি তা দিয়ে বড় গাড়ি আসতে পারবে কি পারবে না তা নিয়ে গবেষণা করছে লোকজন। ট্রাকটা আজকে পড়েনি হয়তো, তাই কেউ কেউ বলাবলি করছেন এর আগের ফেরি থেকেও ট্রাক এখান দিয়ে নেমে গেছে। অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বলাতো যায় না, যাত্রী ভর্তি বাস, কোরবানির পশু ভর্তি ট্রাক, যদি কিছু হয়ে যায়, সবাই খুব সতর্ক সে জন্য। এরকমই জটলার ভেতর ছেলেটিকে দেখলাম আমরা। আমরা দু’জন। আমি এবং সালমা। আমরা গাড়ির ভেতর বসে চারদিকে তাকাই। আমাদের ঠিক সামনেই লুঙ্গি পরা এক লোক তার অণ্ডকোষ চুলকে ছিঁড়ে আনবে বলে মনে হয়। আমরা হা হা করে হাসি তাকে দেখে, তখন আবারও ছেলেটির দিকে চোখ যায় আমাদের।
আমাদের কথা বলি একটুখানি। আমরা চল্লিশ পেরুলাম কিছুদিন আগে মাত্র, কিন্তু এখনও আমাদের বাইরে ভেতরে কোথাও চল্লিশের চিহ্ন পড়েনি। আমাদেরকে যারা দেখতে পারে না তারা হয়তো বলবে বা বলেও যে, “আরে সুন্তানাদিতো অয় নাই, অগো আর কি, গায়ে বাতাস লাগায়া ঘোরেফেরে”। ফরিদপুর অঞ্চলের টান থাকায় সহজেই সমালোচনাকারীকে সনাক্ত করা যায়, কারণ তারা আমাদেরকে চেনে এবং জানে। আমরা স্বাবলম্বী, দু’জনেই চাকরি করি ঢাকায়। আমরা একা একা যে যার মতো থাকি। সালমার সঙ্গে অবশ্য ওর মা থাকেন। আমার সঙ্গে কেউ না, কারণ আমার আসলে কেউ নেই থাকার মতো। আজকাল অবশ্য মনে হয়, সেই কোন এক অতীত কাল থেকে আমার কেউ নেই। সালমা ইদানিং প্রায়ই বলে, “কেন এমুন হয় কওতো? কেউ থাকলে কী হইতো আমাদের?” আমি সালমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। ওকে ঠিক বোঝাতে পারি না যে, কেউ থাকলেও এর চেয়ে যে খুব বেশি ভালো কিছু হতো, তা কিন্তু নয়। তাই চুপ করে থাকি। ঢাকা শহরে একা মেয়েদের থাকার চল শুরু হয়েছে আমাদের হাত ধরেই। এর আগে মেয়েরা সাধারণতঃ ছাত্রী হলে হলগুলোতে আর কর্মজীবী হলে মেয়ে হোস্টেলগুলোতে থাকতো। কিন্তু এখন কোনো কোনো বাড়িওয়ালা গাঁইগুই করলেও ভাড়া দেয়, অনেক বাড়িওয়ালাই এখন স্বীকার করে যে, ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা ঠিকমতো ভাড়া দেয় এবং ঝামেলাও আসলে কম দেয়। মানুষ মিষ্টির স্বাদ পেলে পিঁপড়েরও পাছা চুষে দ্যাখে।
এই সেদিনও কতো প্রশ্ন শুনতে হতো বাড়ি ভাড়া নিতে গিয়ে। বাড়িওয়ালা এক ধরনের প্রশ্ন করেনতো বাড়িওয়ালি আরেক ধরনের। প্রশ্নের পাহাড় ডিঙিয়ে বাড়ি ভাড়া জুটলেও হয় বাড়িওয়ালা ফোনে যন্ত্রণা দিতে শুরু করে নাহয় বাড়িওয়ালি তার স্বামীকে জড়িয়ে অহেতুক সন্দেহ শুরু করে। তখনকার ফ্যাঁকড়ার সঙ্গে কোনো যন্ত্রণারই মিল নেই। এখন এসব একটু কমেছে, মানুষ অর্থনীতি দিয়ে বিচার করতে শুরু করেছে জীবনকে, তাই যাপনের ক্ষেত্রে যেখান থেকে আদায় বেশি এবং কম ঝামেলার সেদিকেই মানুষের ঝোঁক।
সালমা একটা সফটওয়্যার ফার্মে কাজ করে, আমার নিজের ব্যবসা আছে, সেটাই দেখি। দু’জনের জন্মস্থান দেখতে গিয়েছিলাম আমরা, যেখানে বিশ্বকর্মা পূজোয় নৌকো বাইচ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ক্ষমতার দ্বন্দ্বে নৌকো বাইচতো হলোই না, দুপুর নাগাদ প্রশাসন সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করে দিলো, কারণ কি? দুই নেতার ঝগড়া, কে পুরষ্কার দেবে, কার আধিপত্য বজায় থাকবে। অথচ যে হাজার হাজার মানুষ এই নৌকো বাইচ আর পুজো দেখতে আসার কথা ছিল তাদের কথা কেউই ভাবলো না। তারা বৃষ্টিতে ভিজে ফাঁকা নদীর দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক। নদীর ওপর ভাঙাচোরা সেতুর কিনার ঘেঁষে মানুষের ঘোলা জলের দিকে তাকিয়ে থাকাটা কেমন অদ্ভূত আবহের জন্ম দিয়েছিল। আমরা অবশ্য গাড়ি থেকে নামিনি। নেমে কী হবে? শিশুকালের স্মৃতি নষ্ট হবে কেবল।
স্মৃতির কথা যখন এলোই তখন একটু স্মৃতিচারণ হোক। স্মরণ করি সেই সব দিনের কথা যখন এই নদী কোনো ভটভটির আওয়াজ শোনেনি, এখন যার ভয়ঙ্কর আওয়াজে দিনমান কুমারপারের এই ছোট্ট শহরটি রীতিমতো আতঙ্কিত থাকে। কিন্তু সেই সব ধানের ফুল ফোঁটা দিনে, যখন কই মাছের ঝাঁক লক্ষ্মী দীঘা ধানের ঝরে পড়া ফুল খেয়ে খেয়ে শরীরে হলুদ চর্বি জমাতো বলে মাছপ্রিয় মানুষেরা গল্প করতো সেই সময় একদিন খুব ভোর থেকেই শুরু হতো কাঁসরের বাজনা, পাশের বিল দিয়ে নৌকো যেতো। মানুষ তখন নৌকো বাইচকেও বলতো আড়ং। আর এই বাইচের দিনই বিক্রি হতো চালন, কুলো, পলো সহ বছরকার ব্যবহারযোগ্য জিনিসপত্র। মানুষ শুধু নৌকো বাইচ দেখতে নয়, বিশ্বকর্মার অবতার মানুষের তৈরি জিনিসপত্রও কিনতে আসতো আড়ং-এ। এবারও দেখলাম বাজার বসেছে রাস্তার দু’পাশে, সেতুর ওপরে, পসরা সাজানো, কিন্তু বেশিরভাগই সস্তার প্লাস্টিক, এমনকি যে কাঠের হেলিকপ্টার ছোটোবেলায় ছিল তাও আছে, এবং সেটাও প্লাস্টিকের। কেবল বদলায়নি, মিষ্টির দোকানগুলি। মিস্রি’র সাজের হাতি-ঘোড়া-ময়ূর-গণেশ, জিভেগজা, আমৃত্তি, ছানার জিলেপি আর খীরের চমচম, মানুষ এখনও হুমড়ি খেয়ে পড়ছে দোকানগুলোতে। আমার এখনও ভালোবাসার রাজভোগ, আমি নামি না, জানি নেমে সেই পুরোনো মুখ দেখবো না, তারা আছেন কি না তাওতো জানি না, তাই আর রিস্ক নেই না। আনিয়ে নেই, ঢাকায় নিয়ে আসার জন্য।
উৎসবের রঙ নাকি বদলায় না। হবে হয়তো। তবে একালেও সকাল থেকে ভটভটিতে প্রমাণ আকারের সাউন্ডবক্স লাগিয়ে, ডেগ ভর্তি করে বিরিয়ানি তুলে নিয়ে যে উচ্চতায় শব্দ পৌঁছুলে কান আর কিছু শুনতে পায় না সেরকম উচ্চ শব্দে হিন্দি সিনেমার সবচেয়ে তালের গানটি দিনভর বাজে, ভটভটি নাকি হিন্দি গান, কোন্্টির শব্দ কাকে খুন করে বোঝা না গেলেও আশেপাশের মানুষের কানের দফা রফা। কিন্তু তাতে কি? আনন্দতো, মানুষ মেনে নেয়, মনে নেয় না।
বেরুতে বেরুতে বিকেল হয়ে যায় আমাদের আর ফেরিঘাটে দিয়ে কোরবানীর পশুবাহী ট্রাকের পেছনে লাইন ধরে অপেক্ষা করতে করতে সন্ধ্যা প্রায় হয়েই যায়। কিন্তু তারপরও পদ্মার পারে অতো বিশাল আকাশকে অন্ধকার কি সহজে ঢাকতে পারে? বিকেলটা অদ্ভূত এক আলো ছড়িয়ে থমকে থাকে অনেকক্ষণ, যেনো বা নদীর জলে শেষবারের মতো নিজেকে দেখে নেয় দিন। পদ্মা সেতুর জন্য জমানো দৈত্যের মতো পাথরের ঢিঁপি, মনে হয় আচানক এখানেও পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। ছুটির দিন বলেই কিনা জানি না ঘাটে তেমন মানুষের ভীড় নেই। তাই হয়তো ছেলেটাকে আমাদের একেবারে আলাদা করে চোখে পড়ে। আমিই দেখাই সালমাকে, বলি, “দ্যাখো দ্যাখো, ছেলেটা কী লম্বা দেখতে?”
সালমা বলে, “হ্যাঁ রে, এক্কেবারে ইরানি ইরানি চেহারা”। বোঝা যায় একটু ফর্সা আর লম্বা চেহারার পুরুষ এখনও এদেশে ইরান কিংবা তুরান থেকে আসা, এই ধারণা আমাদের জীবনগত হয়ে গেছে। আমি হেসে ফেলি। তখনও আমাদের গাড়ি ফেরিতে ওঠার জন্য কসরত করে যাচ্ছে সমানে। অনেক ক্ষণ অপেক্ষার পর চালক বেচারা অধৈর্য্য হয়ে উঠেছে, কখন উঠবে ফেরিতে। আর যে মুহূর্তে মনে হলো যে, মুখ থুবড়ে থাকা ট্রাকটা কোনো বাঁধা নয় ঠিক সেই মুহূর্তেই হুড়মুড় করে নামতে শুরু করলো গাড়িগুলো। প্রথমে এদেশের কথিত ভিআইপিদের গাড়ি, যারা দরকার হলে ঢাকা থেকে বেরুনোর সময় ফোন করে ফেরি আটকে রাখে। আর হাজার হাজার মানুষ না জেনে অপেক্ষা করে পরবর্তী ফেরির। সেরকমই একটি কালো গাড়ি নেমে গেলো, তারপর একের পর এক ছোট গাড়ি, ট্রাক এবং বাস নামছে তো নামছেই, অথচ দূর থেকে ফেরিটিকে বেশ ছোটই মনে হয়, এতোগুলো গাড়ি ওর পেটে ধরলো কী করে? আমি ভাবি।
ছেলেটির গাড়িও নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে কোথাও, ম্লান আলোয় ছেলেটিকে কি একটু বিষণ্ন দেখায়? হঠাৎই আমার মাথায় প্রশ্নটি আসে, আচ্ছা আমার মা কি এরকম কোনো ছেলেকে দেখে নিজের ভেতর প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে বসতেন? সে সুযোগ কি তার হতো? কিংবা সাহস? মাত্রতো চল্লিশ বছরের ফারাক, চল্লিশ বছর পরেই তার কন্যা এরকম একটি বেগানা পুরুষকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভাবতে পারছে দ্বিধাহীন, এটাকে কি অর্জন বলবো? মাও হয়তো ভাবতেন, প্রকাশ করতে পারতেন না। মানুষতো, কতোটা আর বদল হবে, ভেতরে চিন্তার বীজতো থাকেই, তাই না? আমরা টুকটাক কথা বলি, ছেলেটাকে নিয়ে।
“ছেলেটা কি একা? কি মনে হয়?” সালমার দিকে তাকিয়ে আমি জানতে চাই।
“না মনে হয়, মাইক্রো বোঝাই লোকজন, নিশ্চয়ই ওর ভিড় ভালো লাগে না তাই নেমে আসছে”- সালমা বলে।
ছেলেটার হাতে লম্বা আখ, দাঁতে কাটছে। চুষে চুষে ফেলে দিচ্ছে মাটিতে। অন্য সময় হলে ঠিক ব্যাপারটা চোখে লাগতো, কী অসভ্যরে, খেয়ে খেয়ে জায়গা নোংরা করছে। কিন্তু ছেলেটার দিকে তাকিয়ে এসব কথা ভাবতে মন চাইছে না, আর চিবোনো আখের ছোবাতো আসলে পঁচেই মিশে যাবে মাটিতে, তাতে বরং মাটিরই উপকার। মনে মনে হেসে ফেলি আমি। সালমার দিকে তাকাই, বুঝতে চাই ও কী ভাবছে। কিন্তু ও দেখি প্রশ্ন করে গাড়ির চালককে, “কী সুমন ভাই, ফেরিতে উঠতে পারবেন তো? ওই যে দ্যাহেন পিছনে আরো ভিআইপি আইছে”। সত্যিই তাকিয়ে দেখি পেছনে কোনো জেলা প্রশাসক কিংবা জেলা পুলিশ সুপারের গাড়ি বহর। আতঙ্কিত হয়ে উঠি ভেতরে ভেতরে। কিন্তু সুমন সালমাকে আশ্বস্ত করে, “কোনো ভিআইপি টিআইপি মানুম না ম্যাডাম, ঠিক টান দিয়া উইঠ্ঠা যামু, তারপর যা হয় দেখা যাইবো”। আমি আঁতকে উঠি, যদি সত্যি সত্যিই কিছু হয়। আমার ভয়, এ পৃথিবীকে বড় ভয় আমার।
আমাদের সামনে কেবল একটি বাস দাঁড়ানো। চাইলে আমরা তার পরেই উঠতে পারি। কিন্তু না, ওপার থেকে আসা সব গাড়ি নেমে যাবার পর প্রথমেই বাসটিকে ডেকে নেয় ফেরির লোকেরা। আর তারপরই লক্ষ্য করি পিল পিল করে অসংখ্য গাড়ি এসে আমাদের পাশে, পেছনে জায়গা করে দাঁড়িয়ে আছে। ডেকে ডেকে তুলছে প্রথমে বড় গাড়িগুলো, যেগুলোর ভেতর বোবা পশুগুলো গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মায়া হয় দেখে। আমার মনে হয় যতো দ্রুত ওরা উঠতে পারে ততোই ভালো, মৃত্যু যখন অনিবার্য তখন তা এগিয়ে আসাই ভালো। কিন্তু তারপরই শুরু হয় ভিআইপি’দের জায়গা করে দেবার পালা। তাদের গাড়িকে তুলতে তুলতে তার পেছন পেছন টান মেরে আরো কতোগুলো গাড়ি ঢুকে যায় ফোকটে। আর তখনই আমাদের চালক যেনো নিজের শক্তি দিয়েই গাড়িটিকে টেনে ফেরিতে উঠিয়ে ফেলে। আমি আতঙ্কিত হয়ে ওঠার আগেই দেখতে পাই যে, আমরা ঠিক জায়গা করে নিতে পারছি। আর তখনই মনে হয়, আহারে, বেচারা কি এখনও আখ খাচ্ছে? পারলো কি ওদের গাড়িটা ফেরিতে উঠতে? ফেরির পেট ভরে যাচ্ছে দ্রুতই। তখনই সালমা একটি গাড়ি দেখিয়ে বলে, “ওই দ্যাখো, তোমার ইরানি লোকটার গাড়ি উঠছে”। আমি হেসে ফেলি, “যাহ্, ও ইরানি হবে কেন? একেবারেই আখ খাওয়া বাঙালি যুবক”। আমাদের গাড়ি থেকে পুরো ফেরিটা দেখা যায়, আর তাতেই আমরা দেখি যে, ছেলেটা ওর মোবাইল ফোনটা নিয়ে ফেরির দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ায়। এক মাথা চুল আর মুখভর্তি দাঁড়িতে ওকে একটু যীশু যীশু দেখায় বোধ করি। সালমা অবশ্য মুখ বেঁকিয়ে বলে, “নারে, ফিগারটা তেমন ভালো না, ক্যাংঠা!!”
আমার হাসি পায় সালমার কথায়। আবারও ভাবি, ভাবনার সত্যিই লাগাম নেই। ছেলেটা নিশ্চয়ই জানে না যে, তাকে নিয়ে আমরা কতো কিছু ভাবছি। ঢাকা শহর থেকে বাইরে বেরুতে আমার সবচেয়ে বড় ভয় পথে যদি বাথরুম পায়, তবে? ঢাকা শহরে নাহয় কোনো রেস্টুরেন্ট কিংবা কফি শপে গিয়ে করে নেওয়া যায় কিন্তু পথে? আতঙ্কে আমার তলপেট কেবলই কুঁকড়ে আসে। এসব ভুলতে আমি কতোকিছু নিয়ে যে ব্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করি, তার শেষ নেই। কিন্তু সালমার কোনো বিকার নেই, ও বলে, “আমার টয়লেট পাইছে। যাই দেখি করে আসি, তুমি যাবা?”
“পাগল তুমি? আমি এখান থেকে এক চুলও নড়বো না”- গাড়ির জানালার কাঁচ নামাতে নামাতে আমি বলি। গুমোট হাওয়া ধক্ করে এসে মুখে লাগে, পশুদের শরীরের গন্ধ মিশে যায় সে হাওয়ায়, ফেরিতে মানুষ বেশি উঠলো না পশু উঠলো? অবশ্য মানুষে আর পশুতে পার্থক্য কতোটুকুই বা? গোপাল ভাঁড় আজকের দিনে হলে নিশ্চয়ই বলতেন, আঁধ হাত মাত্র, কারণ সামান্য দূরেই গরু ভর্তি ট্রাকটা দাঁড় করানো। সালমা নেমে যাওয়ার আগে আমি ওকে বলি, “শোনো না, ছেলেটাকে একটু বলে যাও যে, ওই লাল গাড়ির ভেতর একজন ভদ্রমহিলা বসে আছেন, আপনাকে হয়তো চেনে, একটু যাবেন ওখানে?”
সালমা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “সত্যিই কবো? আমি কিন্তু বলতে পারি, কোনো অসুবিধা হবে না আমার। কিন্তু এইখানে আসলে তারে তুমি কি কবা?”
“কী আর বলবো? বলবো, বোর হচ্ছিলাম, গল্প করার কেউ নেই, আপনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনে হলো, গল্পের জন্য উপযুক্ত চেহারা। তাই আসতে বলেছি। আপনার গল্প করতে ইচ্ছে না হলে যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন সেখানে গিয়ে দাঁড়ানগে আবার”। আমি হাসতে হাসতে বলি। সালমা ধরে নেয়, আমি সত্যিই ওকে বলতে বলেছি। ঠিক সেই মুহূর্তে ওর চোখেমুখে কেমন দুষ্টুমি খেলা করে, আমি দেখতে পাই। ও গাড়ির দরোজা খুলে নামে। আমাদের চালক আসেপাশেই ছিল, তাকে নিয়ে সালমা সিঁড়ি দিয়ে ছেলেটার পাশ দিয়ে ওপরে উঠে যায়, আমি তাকিয়ে থাকি অপলক, দেখি কিছু বলে কি না। অন্ধকার তখনও ঝাঁপিয়ে পড়েনি, তাই দেখা যায়, সালমা ওকে এড়িয়ে ওপরে উঠে যায়। কিন্তু একটু পরেই আবার নেমে আসে। এসে ফেরীর নীচতলার ভেতরের দিকে যায়। আমি চিন্তা করতে থাকি, ওপরের টয়লেট কি বন্ধ? ছেলেটা তখন পকেট থেকে মোবাইল বের করে আকাশের গায়ে লেগে থাকা লাল-হলুদ-সোনালী রঙের ছবি তোলে। বাহ্্ ভেতরে সৌন্দর্যজ্ঞান আছে তো? কথা তবে বলাই যায়, যে ছেলে আকাশের রঙ বদলানো টের পায় তার সঙ্গে কথা বলতে ভালোই লাগবে মনে হয়। আমি উত্তেজিত ভেতরে ভেতরে। সালমা ফিরে আসে দ্রুতই।
সালমাও উত্তেজিত, “জানো, ওপরের টয়লেট বন্ধ, ভিআইপিরা রুম আঁটকে বসে আছে, ভাবো কী ভয়ঙ্কর। আমাকে সেই ভয়ঙ্কর টয়লেটে যাইতে হইলো। নিজেরে নোংরা লাগছে, পানি দাওতো এট্টু হাত ধুই”। আমি পানির বোতল এগিয়ে দেই আর ভাবি, এদেশে ভিআইপি হওয়াটা বিশেষ জরুরী, নাহলে বর্জ্য ত্যাগেরও সুযোগ পাওয়া যায় না। সালমা নিজেকে ধুয়ে টুয়ে ভেতরে আসে, আর গাড়ির ভেতর তখন বিষগরম, নিজেকে মনে হচ্ছে সেদ্ধ করতে দিয়েছি পাথরপোড়া গরমে। বিদেশে একেইতো সাউনা বলে, আমরা গরমের দেশের লোকেরাই কেবল সেটা বুঝতে চাইনে। আমি প্রসঙ্গ বদলাই, “এই তুমি ছেলেটাকে কিছু বললে নাযে? ডরাইছো?”
“ইস, কিসের ডর? আমি ভাবলাম তুমি ঠাট্টা করছো”- সালমা হাসে।
“ধূর ঠাট্টা ক্যান করবো? কী মজা হইতো বলো? ছেলেটার চেহারা নিশ্চয়ই বদলায়ে যেতো আমাদের সামনে এসে, তাই না?” - আমি বলি।
“তাহলে একটা পিচ্চিকে দিয়ে আমরা খবর পাঠাই চলো, ওই যে বাদামওয়ালা আসছে তাকে বলি”- সালমা বাদামওয়ালাকে ডাকে, “এই বাদাম, এই বাদাম”।
বাদামওয়ালা তখন চেঁচাচ্ছে, “এই নেন বাদাম, এই যে বাদাম, লবণমরিচ মিশায়া খান, মজা পাইবেন”, লোকটা এগিয়ে আসে। সালমা কিছু বলার আগে আমিই বলি, “কতো কইরা ভাই?”
ঃ দশ টাকা প্যাকেট।
ঃ দুই প্যাকেট দ্যান ভাই।
ততোক্ষণে আঁধার জমেছে একটু। ফেরিও ছেড়েছে বোঝা যায় কিন্তু বাতাস নেই কোনো দিক থেকেই। বাদামওয়ালা দুই প্যাকেট বাদাম দিতে দিতে একটা ছোট পলিথিনের ব্যাগও ধরিয়ে দেয়, বলে, “ম্যাডাম বাদাম ছিলা এর মইধ্যে ফালাইয়েন, এক্সটা দিলাম, ভিতরে লবন-মরিচ আছে, মাইখ্যা খাইয়েন, মজা পাইবেন”। আমি হেসে ফেলি, “ঠিক আছে, মাইখ্যাই খামু”।
ঃ আফাদের বাড়ি কোথায়? মানে ঢাকায় কই থাকেন? বাদামওয়ালা আমাদের সঙ্গে কথা বাড়াতে চায়। আমি অন্ধকারেও তাকিয়ে থাকি ওর দিকে। বোঝে কথা বাড়বে না। কিন্তু আমি সেজন্য তাকাইনি। আমি ওকে দেখতে চেয়েছিলাম। মানুষের মুখ-চোখ দেখা আমার স্বভাব। বাদামওয়ালা কী ভাবলো কে জানে? মিন মিন করে বললো, “আমারও বাড়ি পুরান ঢাকায়, তাই জিগাইছিলাম আর কি”। আমাদের বাদামের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বাদামওয়ালা সরে যায়। আর সালমা ততোক্ষণে বাদামওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে ফেলে, “কতোক্ষণ লাগবে পার হইতে?”
ঃ বেশিক্ষণ না আফা, কুসুমকুমারী ভিআইপি ফেরিতো, তাই আড়াই ঘুন্টা লাগবে, এর বেশি না। আর ফেরিডাও নতুন আনছে আফা।
আমাদের জানা হয়ে যায়, আমরা কুসুমকুমারী নামক ভিআইপি এবং নতুন ফেরিটিতে উঠেছি। আমাদের মনে এক ধরনের উৎফুল্ল ভাব আসে। আর সে ভাবেই আমরা বাদামওয়ালাকে বলি, মানে আমিই বলি, “ওই যে দেখছেন সিঁড়ির মাঝামাঝি একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন, দাঁড়িওয়ালা, তাকে গিয়ে বলবেন, এই গাড়ির ম্যাডাম তাকে ডাকছে, বলতে পারবেন না?” ছেলেটা তখনও পদ্মা সেতুর জন্য জমানো পাথুরে পাহাড়ের ছায়াকে মোবাইলবন্দী করছে। ওমা পাথরের ওপরেতো মানুষের অবয়বও দেখা যাচ্ছে, একজন দু’জন নয় বেশ মানুষ উঠেছে ওই অত্ত উঁচুতে? বাদামওয়ালা হেঁটে যায়, আমরা দু’জন মূর্তির মতো বসে থাকি। মুখ থেকে গুলি বেরিয়ে গেছে, গুলিতো নয়, বাদামওয়ালা, ছুটে যাচ্ছে ছেলেটার দিকে, সিঁড়ি দিয়ে উঠছে, কথা বলছে ছেলেটার সঙ্গে, ততোক্ষণে ফেরির টিমটিমে বাতিও জ্বলতে শুরু করেছে। ছেলেটি আমাদের গাড়ির দিকে তাকাচ্ছে, তারপর হাত দিয়ে চুল ঠিক করলো, এবং একটু থেমে থেমে নামতে শুরু করলো। বাদামওয়ালার পেছন পেছন নেমে ছেলেটা আমাদের গাড়ির দিকে এলো আর বাদামওয়ালা অন্যদিকে। ছেলেটি এসে সালমার দিককার জানালায় দাঁড়ালো প্রথমে। তারপর একটু ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলো, “ডেকেছেন?”
সালমা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি সপ্রতিভ হয়ে উঠি, বলি, “জি ডেকেছি, মনে হচ্ছিলো আপনাকে চিনি, নেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে সঙ্কোচ হচ্ছিলো, তাই আসতে বলেছি, কিছু মনে করেননিতো?”
ছেলেটি হাসে, স্বল্প আলোতেও টের পাই, হাসিটা মিষ্টি। আমি বয়স ভাববার চেষ্টা করি, ত্রিশের একটু বেশি হবে, হাত চালায় চুলের ভেতর আবার। বুঝতে পারি, ওরও ভেতরে প্রশ্ন, তাই চুলের ভেতর হাত দিয়ে তা তাড়ানোর চেষ্টা করছে। আমি নিজের নাম বলি, আর সালমার দিকে দেখিয়ে বলি, “ও সালমা। আপনার নাম কি তপু? আপনি কি কোনো টিভি চ্যানেলে আছেন? নাহলে এতো পরিচিত মনে হচ্ছে কেন?” খুবই দুর্বল এবং বানানো শোনায় শেষের প্রশ্নটি। নিজেকে খুব ন্যাকা ন্যাকা লাগে তাই নিজেকে সংশোধন করে ফেলি দ্রুত, বলি, “সত্যি কথা বলি, আসলে আমাদের কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো কারো সঙ্গে, তাই আপনাকে ডেকেছি, আপনিতো একা একা দাঁড়িয়ে মোবাইলে আঁধারবন্দী করছিলেন, তাই ভাবলাম হয়তো কথা বলতে আপনারও ভালো লাগতে পারে”।
ছেলেটির চোখেমুখে তখনও অবাক ভাব, কাটতে সময় নেবে বুঝতে পারি। কিন্তু তার আগেই সালমা বলে, “আমার কথা বলতে ইচ্ছে করে নাই কিন্তু, ওর করেছে, বুঝলেন?”
ঃ জি বুঝেছি। তাহলে নেমে আসুন আপনারা, কথা বলি।
বাহ্্ গলার স্বরটাতো বেশ। ভরাট। আমি সালমার দিকে তাকাই, বলি, “চলো, নেমে ফেরির পেছন দিকে যাই, ওপরেতো ভিআইপিরা দরোজা বন্ধ করে রেখেছে”। সালমা বলে, “তোমরা নামো, আমি আসছি একটু পরে, একটা ফোন করতে হবে আমার”- বুঝতে পারি, সালমা সময় নিচ্ছে। আমি দরোজা খুলে নামি। পরনের শাড়িটি সামলে নামতে একটু সময় লাগে। পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে তারপর নামি, তখনও ফেরি জুড়ে গোময়-এর গন্ধ ম ম করছে। ছেলেটি এগিয়ে আসে, বলে, “এইদিকে আসুন” হাত দিয়ে দেখিয়ে দেয় ফেরির সামনের দিকটা। সেখানে ইতিউতি লোকজন দাঁড়ানো, তবে জায়গা আছে ফাঁকা, দাঁড়ানোর মতো। আমরা গিয়ে দাঁড়াই এবং সেই প্রথম পদ্মা থেকে বাতাস ওঠে একটু খানি, জলগন্ধ মাখানো। আমার ভালো লাগে। আমি ফিরতে থাকি পেছনে, যখন আমার ষোল কি সতের বছর, তখনকার কোনো দিন। এমন আশ্বিনও হতে পারে। তুমুল বৃষ্টি আর ঢেউ ভেঙে পদ্মা পার হতে হতে আরেকজন মানুষকে আমি দেখছিলাম কেবলই, সেও তাকিয়েই ছিল সারাক্ষণ কিন্তু কথা বলার সাহস আমাদের কারোরই হয়নি। অথচ, আজ কি অনায়াসে আমি একটি ছেলেকে তার অবস্থান থেকে ডেকে সরিয়ে এনে গল্প করছি, নিজেকে আমার সাহাসী মনে হয় একটু। বলি, “আমি সত্যিই দুঃখিত, আপনাকে এভাবে ডেকে বিরক্ত করার জন্য”।
ঃ বিরক্ত হচ্ছি না, আপনি বলুন।
ঃ কী বলবো?
ঃ কথা বলতে চাইছিলেন না?
ঃ কথা, খুঁজে পাচ্ছিনাতো আর।
আমি সত্যিই কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না আর। তবে আমি ক্রমশঃ ফিরছিলাম অতীতে, মনে হচ্ছিলো আমি সেই ছেলেটির সঙ্গে কথা বলছি, যখন আমার বয়স ষোল, ছেলেটিরও হয়তো তাই। ভেতর থেকে কি কোনো দীর্ঘশ্বাস বেরুচ্ছে? বুঝি না।
আমার কথা শুনে ছেলেটি আবার হেসে ওঠে, বেশ উঁচু এবং দরাজ হাসি। অন্ধকার একটু একটু করে গলে পড়ে সে হাসিতে। আমি ছেলেটির মুখ দেখতে পাই না আর। কিন্তু আমার মুখের ওপর আলো পড়ছে বুঝতে পারি, চোখে এসে লাগে। তবুও দাঁড়িয়ে থাকি আমি। বলি, “কী নাম আপনার?”
ঃ ওই যে বললেন, তপু, আমার নাম ধরুন তপুই।
ঃ যাহ্ সত্যি নয়, সত্যি নাম বলুন। আচ্ছা থাক বলতে হবে না। আপনার নাম তপু। তা তপু কী করেন আপনি?
ঃ আপনিইতো বললেন, টিভি চ্যানেলে কাজ করি। ধরুন, তাই করি।
ঃ আচ্ছা, নাহয় তাই ধরলাম। কোথায় গিয়েছিলেন? বা কোথা থেকে ফিরলেন?
ঃ আপনি কি সব সময় এরকম করে কথা বলেন? বেশ গুছিয়ে?
ঃ নাহ্্ বলি না, এখন বলছি, ভেবে চিন্তে এবং গুছিয়ে।
ছেলেটি হাসে। ওহ্ ছেলেটির নাম তপু। “আচ্ছা তপু, এই যে আপনাকে ডেকে আনলাম আমরা, আপনি কি যে কেউ ডাকলেই যেতেন?”
ঃ উনিতো আমাকে ডাকেননি বললেন, আপনিই ডেকেছেন। আসতাম, কারণ আপনাদের আমি দেখেছি, যখন আখ খাচ্ছিলাম তখন।
বাহ্্, বেশ স্মার্টতো। আমি আগ্রহী হই। আমরা কথা বলতে থাকি। বহু পুরোনো কোনো ইতিহাস খুঁড়ে আনা কথামালা। পদ্মার জলের ওপর ঝুলে থাকা আঁধার, ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের শব্দ আমাদের কথাদের আরো উজ্জীবিত করে। আমাদের চারপাশে দৈওয়ালা হাঁকে। ছোট্ট ছোট্ট প্লাস্টিকের কাপে করে দৈ বিক্রি করছে। ছেলেটি বলে, খাবেন? আমি বলি, নিশ্চয়ই। আমরা দই কিনি, মহা মিষ্টি দই। খেতে পারি না, সালমার জন্য যেটা কিনি সেটা হাতে ধরে রাখি।
হঠাৎ অন্ধকার ফুঁড়ে সালমা এসে দাঁড়ায়। বলে, “ঘাট এসে গেছে, চলো যাই এবার”। সালমার হাতে দৈ দিতে দিতে আমরা গাড়ির দিকে এগুই। আমরা কেউ কোনো কথা না বলে যে যার মতো ফিরে যাই। গাড়িতে উঠি। কুসুমকুমারী ফেরি থেকে আমাদের গাড়িটি নামে ভিআইপিদের গাড়িরও বেশ কয়েকটি গাড়ি পরে। তারপর রাস্তার ওপর ঝুঁকে থাকা গাছের সারিকে গাড়ির হেডলাইটের আলোয় বিয়ের গেটের মতো মনে হতে থাকে আমাদের। কিন্তু ফিরতে ফিরতে আমরা দু’জনেই আর কেউ সেই ছেলেটির কথা বলি না। কেন বলি না সেটা বলতে পারবো না, তবে আমার মাথায় বাদামওয়ালার কাছ থেকে বাদাম কিনে খাওয়া-পরবর্তী আর কোনো স্মৃতি নেই। কিন্তু স্মৃতি না থাকলে কি হবে, আমাদের গাড়ির পেছন এবং সামনেটা ভর্তি করে নিয়ে আসি কচু শাক, ডাব, নারকেল, মিষ্টি, পিপুল পাতা, রুম্বি কলা, আরো কতো কি, যেনো পুরো শৈশব আমাদের গাড়িতে। আমরা ঢাকায় ফিরি, যে যার বাড়িতে নামি। কুসুমকুমারী ভিআইপি ফেরির কথা আর কখনও তুলি না আমরা।
আমাদের কথা বলি একটুখানি। আমরা চল্লিশ পেরুলাম কিছুদিন আগে মাত্র, কিন্তু এখনও আমাদের বাইরে ভেতরে কোথাও চল্লিশের চিহ্ন পড়েনি। আমাদেরকে যারা দেখতে পারে না তারা হয়তো বলবে বা বলেও যে, “আরে সুন্তানাদিতো অয় নাই, অগো আর কি, গায়ে বাতাস লাগায়া ঘোরেফেরে”। ফরিদপুর অঞ্চলের টান থাকায় সহজেই সমালোচনাকারীকে সনাক্ত করা যায়, কারণ তারা আমাদেরকে চেনে এবং জানে। আমরা স্বাবলম্বী, দু’জনেই চাকরি করি ঢাকায়। আমরা একা একা যে যার মতো থাকি। সালমার সঙ্গে অবশ্য ওর মা থাকেন। আমার সঙ্গে কেউ না, কারণ আমার আসলে কেউ নেই থাকার মতো। আজকাল অবশ্য মনে হয়, সেই কোন এক অতীত কাল থেকে আমার কেউ নেই। সালমা ইদানিং প্রায়ই বলে, “কেন এমুন হয় কওতো? কেউ থাকলে কী হইতো আমাদের?” আমি সালমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। ওকে ঠিক বোঝাতে পারি না যে, কেউ থাকলেও এর চেয়ে যে খুব বেশি ভালো কিছু হতো, তা কিন্তু নয়। তাই চুপ করে থাকি। ঢাকা শহরে একা মেয়েদের থাকার চল শুরু হয়েছে আমাদের হাত ধরেই। এর আগে মেয়েরা সাধারণতঃ ছাত্রী হলে হলগুলোতে আর কর্মজীবী হলে মেয়ে হোস্টেলগুলোতে থাকতো। কিন্তু এখন কোনো কোনো বাড়িওয়ালা গাঁইগুই করলেও ভাড়া দেয়, অনেক বাড়িওয়ালাই এখন স্বীকার করে যে, ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা ঠিকমতো ভাড়া দেয় এবং ঝামেলাও আসলে কম দেয়। মানুষ মিষ্টির স্বাদ পেলে পিঁপড়েরও পাছা চুষে দ্যাখে।
এই সেদিনও কতো প্রশ্ন শুনতে হতো বাড়ি ভাড়া নিতে গিয়ে। বাড়িওয়ালা এক ধরনের প্রশ্ন করেনতো বাড়িওয়ালি আরেক ধরনের। প্রশ্নের পাহাড় ডিঙিয়ে বাড়ি ভাড়া জুটলেও হয় বাড়িওয়ালা ফোনে যন্ত্রণা দিতে শুরু করে নাহয় বাড়িওয়ালি তার স্বামীকে জড়িয়ে অহেতুক সন্দেহ শুরু করে। তখনকার ফ্যাঁকড়ার সঙ্গে কোনো যন্ত্রণারই মিল নেই। এখন এসব একটু কমেছে, মানুষ অর্থনীতি দিয়ে বিচার করতে শুরু করেছে জীবনকে, তাই যাপনের ক্ষেত্রে যেখান থেকে আদায় বেশি এবং কম ঝামেলার সেদিকেই মানুষের ঝোঁক।
সালমা একটা সফটওয়্যার ফার্মে কাজ করে, আমার নিজের ব্যবসা আছে, সেটাই দেখি। দু’জনের জন্মস্থান দেখতে গিয়েছিলাম আমরা, যেখানে বিশ্বকর্মা পূজোয় নৌকো বাইচ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ক্ষমতার দ্বন্দ্বে নৌকো বাইচতো হলোই না, দুপুর নাগাদ প্রশাসন সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করে দিলো, কারণ কি? দুই নেতার ঝগড়া, কে পুরষ্কার দেবে, কার আধিপত্য বজায় থাকবে। অথচ যে হাজার হাজার মানুষ এই নৌকো বাইচ আর পুজো দেখতে আসার কথা ছিল তাদের কথা কেউই ভাবলো না। তারা বৃষ্টিতে ভিজে ফাঁকা নদীর দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক। নদীর ওপর ভাঙাচোরা সেতুর কিনার ঘেঁষে মানুষের ঘোলা জলের দিকে তাকিয়ে থাকাটা কেমন অদ্ভূত আবহের জন্ম দিয়েছিল। আমরা অবশ্য গাড়ি থেকে নামিনি। নেমে কী হবে? শিশুকালের স্মৃতি নষ্ট হবে কেবল।
স্মৃতির কথা যখন এলোই তখন একটু স্মৃতিচারণ হোক। স্মরণ করি সেই সব দিনের কথা যখন এই নদী কোনো ভটভটির আওয়াজ শোনেনি, এখন যার ভয়ঙ্কর আওয়াজে দিনমান কুমারপারের এই ছোট্ট শহরটি রীতিমতো আতঙ্কিত থাকে। কিন্তু সেই সব ধানের ফুল ফোঁটা দিনে, যখন কই মাছের ঝাঁক লক্ষ্মী দীঘা ধানের ঝরে পড়া ফুল খেয়ে খেয়ে শরীরে হলুদ চর্বি জমাতো বলে মাছপ্রিয় মানুষেরা গল্প করতো সেই সময় একদিন খুব ভোর থেকেই শুরু হতো কাঁসরের বাজনা, পাশের বিল দিয়ে নৌকো যেতো। মানুষ তখন নৌকো বাইচকেও বলতো আড়ং। আর এই বাইচের দিনই বিক্রি হতো চালন, কুলো, পলো সহ বছরকার ব্যবহারযোগ্য জিনিসপত্র। মানুষ শুধু নৌকো বাইচ দেখতে নয়, বিশ্বকর্মার অবতার মানুষের তৈরি জিনিসপত্রও কিনতে আসতো আড়ং-এ। এবারও দেখলাম বাজার বসেছে রাস্তার দু’পাশে, সেতুর ওপরে, পসরা সাজানো, কিন্তু বেশিরভাগই সস্তার প্লাস্টিক, এমনকি যে কাঠের হেলিকপ্টার ছোটোবেলায় ছিল তাও আছে, এবং সেটাও প্লাস্টিকের। কেবল বদলায়নি, মিষ্টির দোকানগুলি। মিস্রি’র সাজের হাতি-ঘোড়া-ময়ূর-গণেশ, জিভেগজা, আমৃত্তি, ছানার জিলেপি আর খীরের চমচম, মানুষ এখনও হুমড়ি খেয়ে পড়ছে দোকানগুলোতে। আমার এখনও ভালোবাসার রাজভোগ, আমি নামি না, জানি নেমে সেই পুরোনো মুখ দেখবো না, তারা আছেন কি না তাওতো জানি না, তাই আর রিস্ক নেই না। আনিয়ে নেই, ঢাকায় নিয়ে আসার জন্য।
উৎসবের রঙ নাকি বদলায় না। হবে হয়তো। তবে একালেও সকাল থেকে ভটভটিতে প্রমাণ আকারের সাউন্ডবক্স লাগিয়ে, ডেগ ভর্তি করে বিরিয়ানি তুলে নিয়ে যে উচ্চতায় শব্দ পৌঁছুলে কান আর কিছু শুনতে পায় না সেরকম উচ্চ শব্দে হিন্দি সিনেমার সবচেয়ে তালের গানটি দিনভর বাজে, ভটভটি নাকি হিন্দি গান, কোন্্টির শব্দ কাকে খুন করে বোঝা না গেলেও আশেপাশের মানুষের কানের দফা রফা। কিন্তু তাতে কি? আনন্দতো, মানুষ মেনে নেয়, মনে নেয় না।
বেরুতে বেরুতে বিকেল হয়ে যায় আমাদের আর ফেরিঘাটে দিয়ে কোরবানীর পশুবাহী ট্রাকের পেছনে লাইন ধরে অপেক্ষা করতে করতে সন্ধ্যা প্রায় হয়েই যায়। কিন্তু তারপরও পদ্মার পারে অতো বিশাল আকাশকে অন্ধকার কি সহজে ঢাকতে পারে? বিকেলটা অদ্ভূত এক আলো ছড়িয়ে থমকে থাকে অনেকক্ষণ, যেনো বা নদীর জলে শেষবারের মতো নিজেকে দেখে নেয় দিন। পদ্মা সেতুর জন্য জমানো দৈত্যের মতো পাথরের ঢিঁপি, মনে হয় আচানক এখানেও পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। ছুটির দিন বলেই কিনা জানি না ঘাটে তেমন মানুষের ভীড় নেই। তাই হয়তো ছেলেটাকে আমাদের একেবারে আলাদা করে চোখে পড়ে। আমিই দেখাই সালমাকে, বলি, “দ্যাখো দ্যাখো, ছেলেটা কী লম্বা দেখতে?”
সালমা বলে, “হ্যাঁ রে, এক্কেবারে ইরানি ইরানি চেহারা”। বোঝা যায় একটু ফর্সা আর লম্বা চেহারার পুরুষ এখনও এদেশে ইরান কিংবা তুরান থেকে আসা, এই ধারণা আমাদের জীবনগত হয়ে গেছে। আমি হেসে ফেলি। তখনও আমাদের গাড়ি ফেরিতে ওঠার জন্য কসরত করে যাচ্ছে সমানে। অনেক ক্ষণ অপেক্ষার পর চালক বেচারা অধৈর্য্য হয়ে উঠেছে, কখন উঠবে ফেরিতে। আর যে মুহূর্তে মনে হলো যে, মুখ থুবড়ে থাকা ট্রাকটা কোনো বাঁধা নয় ঠিক সেই মুহূর্তেই হুড়মুড় করে নামতে শুরু করলো গাড়িগুলো। প্রথমে এদেশের কথিত ভিআইপিদের গাড়ি, যারা দরকার হলে ঢাকা থেকে বেরুনোর সময় ফোন করে ফেরি আটকে রাখে। আর হাজার হাজার মানুষ না জেনে অপেক্ষা করে পরবর্তী ফেরির। সেরকমই একটি কালো গাড়ি নেমে গেলো, তারপর একের পর এক ছোট গাড়ি, ট্রাক এবং বাস নামছে তো নামছেই, অথচ দূর থেকে ফেরিটিকে বেশ ছোটই মনে হয়, এতোগুলো গাড়ি ওর পেটে ধরলো কী করে? আমি ভাবি।
ছেলেটির গাড়িও নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে কোথাও, ম্লান আলোয় ছেলেটিকে কি একটু বিষণ্ন দেখায়? হঠাৎই আমার মাথায় প্রশ্নটি আসে, আচ্ছা আমার মা কি এরকম কোনো ছেলেকে দেখে নিজের ভেতর প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে বসতেন? সে সুযোগ কি তার হতো? কিংবা সাহস? মাত্রতো চল্লিশ বছরের ফারাক, চল্লিশ বছর পরেই তার কন্যা এরকম একটি বেগানা পুরুষকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভাবতে পারছে দ্বিধাহীন, এটাকে কি অর্জন বলবো? মাও হয়তো ভাবতেন, প্রকাশ করতে পারতেন না। মানুষতো, কতোটা আর বদল হবে, ভেতরে চিন্তার বীজতো থাকেই, তাই না? আমরা টুকটাক কথা বলি, ছেলেটাকে নিয়ে।
“ছেলেটা কি একা? কি মনে হয়?” সালমার দিকে তাকিয়ে আমি জানতে চাই।
“না মনে হয়, মাইক্রো বোঝাই লোকজন, নিশ্চয়ই ওর ভিড় ভালো লাগে না তাই নেমে আসছে”- সালমা বলে।
ছেলেটার হাতে লম্বা আখ, দাঁতে কাটছে। চুষে চুষে ফেলে দিচ্ছে মাটিতে। অন্য সময় হলে ঠিক ব্যাপারটা চোখে লাগতো, কী অসভ্যরে, খেয়ে খেয়ে জায়গা নোংরা করছে। কিন্তু ছেলেটার দিকে তাকিয়ে এসব কথা ভাবতে মন চাইছে না, আর চিবোনো আখের ছোবাতো আসলে পঁচেই মিশে যাবে মাটিতে, তাতে বরং মাটিরই উপকার। মনে মনে হেসে ফেলি আমি। সালমার দিকে তাকাই, বুঝতে চাই ও কী ভাবছে। কিন্তু ও দেখি প্রশ্ন করে গাড়ির চালককে, “কী সুমন ভাই, ফেরিতে উঠতে পারবেন তো? ওই যে দ্যাহেন পিছনে আরো ভিআইপি আইছে”। সত্যিই তাকিয়ে দেখি পেছনে কোনো জেলা প্রশাসক কিংবা জেলা পুলিশ সুপারের গাড়ি বহর। আতঙ্কিত হয়ে উঠি ভেতরে ভেতরে। কিন্তু সুমন সালমাকে আশ্বস্ত করে, “কোনো ভিআইপি টিআইপি মানুম না ম্যাডাম, ঠিক টান দিয়া উইঠ্ঠা যামু, তারপর যা হয় দেখা যাইবো”। আমি আঁতকে উঠি, যদি সত্যি সত্যিই কিছু হয়। আমার ভয়, এ পৃথিবীকে বড় ভয় আমার।
আমাদের সামনে কেবল একটি বাস দাঁড়ানো। চাইলে আমরা তার পরেই উঠতে পারি। কিন্তু না, ওপার থেকে আসা সব গাড়ি নেমে যাবার পর প্রথমেই বাসটিকে ডেকে নেয় ফেরির লোকেরা। আর তারপরই লক্ষ্য করি পিল পিল করে অসংখ্য গাড়ি এসে আমাদের পাশে, পেছনে জায়গা করে দাঁড়িয়ে আছে। ডেকে ডেকে তুলছে প্রথমে বড় গাড়িগুলো, যেগুলোর ভেতর বোবা পশুগুলো গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মায়া হয় দেখে। আমার মনে হয় যতো দ্রুত ওরা উঠতে পারে ততোই ভালো, মৃত্যু যখন অনিবার্য তখন তা এগিয়ে আসাই ভালো। কিন্তু তারপরই শুরু হয় ভিআইপি’দের জায়গা করে দেবার পালা। তাদের গাড়িকে তুলতে তুলতে তার পেছন পেছন টান মেরে আরো কতোগুলো গাড়ি ঢুকে যায় ফোকটে। আর তখনই আমাদের চালক যেনো নিজের শক্তি দিয়েই গাড়িটিকে টেনে ফেরিতে উঠিয়ে ফেলে। আমি আতঙ্কিত হয়ে ওঠার আগেই দেখতে পাই যে, আমরা ঠিক জায়গা করে নিতে পারছি। আর তখনই মনে হয়, আহারে, বেচারা কি এখনও আখ খাচ্ছে? পারলো কি ওদের গাড়িটা ফেরিতে উঠতে? ফেরির পেট ভরে যাচ্ছে দ্রুতই। তখনই সালমা একটি গাড়ি দেখিয়ে বলে, “ওই দ্যাখো, তোমার ইরানি লোকটার গাড়ি উঠছে”। আমি হেসে ফেলি, “যাহ্, ও ইরানি হবে কেন? একেবারেই আখ খাওয়া বাঙালি যুবক”। আমাদের গাড়ি থেকে পুরো ফেরিটা দেখা যায়, আর তাতেই আমরা দেখি যে, ছেলেটা ওর মোবাইল ফোনটা নিয়ে ফেরির দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ায়। এক মাথা চুল আর মুখভর্তি দাঁড়িতে ওকে একটু যীশু যীশু দেখায় বোধ করি। সালমা অবশ্য মুখ বেঁকিয়ে বলে, “নারে, ফিগারটা তেমন ভালো না, ক্যাংঠা!!”
আমার হাসি পায় সালমার কথায়। আবারও ভাবি, ভাবনার সত্যিই লাগাম নেই। ছেলেটা নিশ্চয়ই জানে না যে, তাকে নিয়ে আমরা কতো কিছু ভাবছি। ঢাকা শহর থেকে বাইরে বেরুতে আমার সবচেয়ে বড় ভয় পথে যদি বাথরুম পায়, তবে? ঢাকা শহরে নাহয় কোনো রেস্টুরেন্ট কিংবা কফি শপে গিয়ে করে নেওয়া যায় কিন্তু পথে? আতঙ্কে আমার তলপেট কেবলই কুঁকড়ে আসে। এসব ভুলতে আমি কতোকিছু নিয়ে যে ব্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করি, তার শেষ নেই। কিন্তু সালমার কোনো বিকার নেই, ও বলে, “আমার টয়লেট পাইছে। যাই দেখি করে আসি, তুমি যাবা?”
“পাগল তুমি? আমি এখান থেকে এক চুলও নড়বো না”- গাড়ির জানালার কাঁচ নামাতে নামাতে আমি বলি। গুমোট হাওয়া ধক্ করে এসে মুখে লাগে, পশুদের শরীরের গন্ধ মিশে যায় সে হাওয়ায়, ফেরিতে মানুষ বেশি উঠলো না পশু উঠলো? অবশ্য মানুষে আর পশুতে পার্থক্য কতোটুকুই বা? গোপাল ভাঁড় আজকের দিনে হলে নিশ্চয়ই বলতেন, আঁধ হাত মাত্র, কারণ সামান্য দূরেই গরু ভর্তি ট্রাকটা দাঁড় করানো। সালমা নেমে যাওয়ার আগে আমি ওকে বলি, “শোনো না, ছেলেটাকে একটু বলে যাও যে, ওই লাল গাড়ির ভেতর একজন ভদ্রমহিলা বসে আছেন, আপনাকে হয়তো চেনে, একটু যাবেন ওখানে?”
সালমা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “সত্যিই কবো? আমি কিন্তু বলতে পারি, কোনো অসুবিধা হবে না আমার। কিন্তু এইখানে আসলে তারে তুমি কি কবা?”
“কী আর বলবো? বলবো, বোর হচ্ছিলাম, গল্প করার কেউ নেই, আপনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনে হলো, গল্পের জন্য উপযুক্ত চেহারা। তাই আসতে বলেছি। আপনার গল্প করতে ইচ্ছে না হলে যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন সেখানে গিয়ে দাঁড়ানগে আবার”। আমি হাসতে হাসতে বলি। সালমা ধরে নেয়, আমি সত্যিই ওকে বলতে বলেছি। ঠিক সেই মুহূর্তে ওর চোখেমুখে কেমন দুষ্টুমি খেলা করে, আমি দেখতে পাই। ও গাড়ির দরোজা খুলে নামে। আমাদের চালক আসেপাশেই ছিল, তাকে নিয়ে সালমা সিঁড়ি দিয়ে ছেলেটার পাশ দিয়ে ওপরে উঠে যায়, আমি তাকিয়ে থাকি অপলক, দেখি কিছু বলে কি না। অন্ধকার তখনও ঝাঁপিয়ে পড়েনি, তাই দেখা যায়, সালমা ওকে এড়িয়ে ওপরে উঠে যায়। কিন্তু একটু পরেই আবার নেমে আসে। এসে ফেরীর নীচতলার ভেতরের দিকে যায়। আমি চিন্তা করতে থাকি, ওপরের টয়লেট কি বন্ধ? ছেলেটা তখন পকেট থেকে মোবাইল বের করে আকাশের গায়ে লেগে থাকা লাল-হলুদ-সোনালী রঙের ছবি তোলে। বাহ্্ ভেতরে সৌন্দর্যজ্ঞান আছে তো? কথা তবে বলাই যায়, যে ছেলে আকাশের রঙ বদলানো টের পায় তার সঙ্গে কথা বলতে ভালোই লাগবে মনে হয়। আমি উত্তেজিত ভেতরে ভেতরে। সালমা ফিরে আসে দ্রুতই।
সালমাও উত্তেজিত, “জানো, ওপরের টয়লেট বন্ধ, ভিআইপিরা রুম আঁটকে বসে আছে, ভাবো কী ভয়ঙ্কর। আমাকে সেই ভয়ঙ্কর টয়লেটে যাইতে হইলো। নিজেরে নোংরা লাগছে, পানি দাওতো এট্টু হাত ধুই”। আমি পানির বোতল এগিয়ে দেই আর ভাবি, এদেশে ভিআইপি হওয়াটা বিশেষ জরুরী, নাহলে বর্জ্য ত্যাগেরও সুযোগ পাওয়া যায় না। সালমা নিজেকে ধুয়ে টুয়ে ভেতরে আসে, আর গাড়ির ভেতর তখন বিষগরম, নিজেকে মনে হচ্ছে সেদ্ধ করতে দিয়েছি পাথরপোড়া গরমে। বিদেশে একেইতো সাউনা বলে, আমরা গরমের দেশের লোকেরাই কেবল সেটা বুঝতে চাইনে। আমি প্রসঙ্গ বদলাই, “এই তুমি ছেলেটাকে কিছু বললে নাযে? ডরাইছো?”
“ইস, কিসের ডর? আমি ভাবলাম তুমি ঠাট্টা করছো”- সালমা হাসে।
“ধূর ঠাট্টা ক্যান করবো? কী মজা হইতো বলো? ছেলেটার চেহারা নিশ্চয়ই বদলায়ে যেতো আমাদের সামনে এসে, তাই না?” - আমি বলি।
“তাহলে একটা পিচ্চিকে দিয়ে আমরা খবর পাঠাই চলো, ওই যে বাদামওয়ালা আসছে তাকে বলি”- সালমা বাদামওয়ালাকে ডাকে, “এই বাদাম, এই বাদাম”।
বাদামওয়ালা তখন চেঁচাচ্ছে, “এই নেন বাদাম, এই যে বাদাম, লবণমরিচ মিশায়া খান, মজা পাইবেন”, লোকটা এগিয়ে আসে। সালমা কিছু বলার আগে আমিই বলি, “কতো কইরা ভাই?”
ঃ দশ টাকা প্যাকেট।
ঃ দুই প্যাকেট দ্যান ভাই।
ততোক্ষণে আঁধার জমেছে একটু। ফেরিও ছেড়েছে বোঝা যায় কিন্তু বাতাস নেই কোনো দিক থেকেই। বাদামওয়ালা দুই প্যাকেট বাদাম দিতে দিতে একটা ছোট পলিথিনের ব্যাগও ধরিয়ে দেয়, বলে, “ম্যাডাম বাদাম ছিলা এর মইধ্যে ফালাইয়েন, এক্সটা দিলাম, ভিতরে লবন-মরিচ আছে, মাইখ্যা খাইয়েন, মজা পাইবেন”। আমি হেসে ফেলি, “ঠিক আছে, মাইখ্যাই খামু”।
ঃ আফাদের বাড়ি কোথায়? মানে ঢাকায় কই থাকেন? বাদামওয়ালা আমাদের সঙ্গে কথা বাড়াতে চায়। আমি অন্ধকারেও তাকিয়ে থাকি ওর দিকে। বোঝে কথা বাড়বে না। কিন্তু আমি সেজন্য তাকাইনি। আমি ওকে দেখতে চেয়েছিলাম। মানুষের মুখ-চোখ দেখা আমার স্বভাব। বাদামওয়ালা কী ভাবলো কে জানে? মিন মিন করে বললো, “আমারও বাড়ি পুরান ঢাকায়, তাই জিগাইছিলাম আর কি”। আমাদের বাদামের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বাদামওয়ালা সরে যায়। আর সালমা ততোক্ষণে বাদামওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে ফেলে, “কতোক্ষণ লাগবে পার হইতে?”
ঃ বেশিক্ষণ না আফা, কুসুমকুমারী ভিআইপি ফেরিতো, তাই আড়াই ঘুন্টা লাগবে, এর বেশি না। আর ফেরিডাও নতুন আনছে আফা।
আমাদের জানা হয়ে যায়, আমরা কুসুমকুমারী নামক ভিআইপি এবং নতুন ফেরিটিতে উঠেছি। আমাদের মনে এক ধরনের উৎফুল্ল ভাব আসে। আর সে ভাবেই আমরা বাদামওয়ালাকে বলি, মানে আমিই বলি, “ওই যে দেখছেন সিঁড়ির মাঝামাঝি একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন, দাঁড়িওয়ালা, তাকে গিয়ে বলবেন, এই গাড়ির ম্যাডাম তাকে ডাকছে, বলতে পারবেন না?” ছেলেটা তখনও পদ্মা সেতুর জন্য জমানো পাথুরে পাহাড়ের ছায়াকে মোবাইলবন্দী করছে। ওমা পাথরের ওপরেতো মানুষের অবয়বও দেখা যাচ্ছে, একজন দু’জন নয় বেশ মানুষ উঠেছে ওই অত্ত উঁচুতে? বাদামওয়ালা হেঁটে যায়, আমরা দু’জন মূর্তির মতো বসে থাকি। মুখ থেকে গুলি বেরিয়ে গেছে, গুলিতো নয়, বাদামওয়ালা, ছুটে যাচ্ছে ছেলেটার দিকে, সিঁড়ি দিয়ে উঠছে, কথা বলছে ছেলেটার সঙ্গে, ততোক্ষণে ফেরির টিমটিমে বাতিও জ্বলতে শুরু করেছে। ছেলেটি আমাদের গাড়ির দিকে তাকাচ্ছে, তারপর হাত দিয়ে চুল ঠিক করলো, এবং একটু থেমে থেমে নামতে শুরু করলো। বাদামওয়ালার পেছন পেছন নেমে ছেলেটা আমাদের গাড়ির দিকে এলো আর বাদামওয়ালা অন্যদিকে। ছেলেটি এসে সালমার দিককার জানালায় দাঁড়ালো প্রথমে। তারপর একটু ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলো, “ডেকেছেন?”
সালমা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি সপ্রতিভ হয়ে উঠি, বলি, “জি ডেকেছি, মনে হচ্ছিলো আপনাকে চিনি, নেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে সঙ্কোচ হচ্ছিলো, তাই আসতে বলেছি, কিছু মনে করেননিতো?”
ছেলেটি হাসে, স্বল্প আলোতেও টের পাই, হাসিটা মিষ্টি। আমি বয়স ভাববার চেষ্টা করি, ত্রিশের একটু বেশি হবে, হাত চালায় চুলের ভেতর আবার। বুঝতে পারি, ওরও ভেতরে প্রশ্ন, তাই চুলের ভেতর হাত দিয়ে তা তাড়ানোর চেষ্টা করছে। আমি নিজের নাম বলি, আর সালমার দিকে দেখিয়ে বলি, “ও সালমা। আপনার নাম কি তপু? আপনি কি কোনো টিভি চ্যানেলে আছেন? নাহলে এতো পরিচিত মনে হচ্ছে কেন?” খুবই দুর্বল এবং বানানো শোনায় শেষের প্রশ্নটি। নিজেকে খুব ন্যাকা ন্যাকা লাগে তাই নিজেকে সংশোধন করে ফেলি দ্রুত, বলি, “সত্যি কথা বলি, আসলে আমাদের কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো কারো সঙ্গে, তাই আপনাকে ডেকেছি, আপনিতো একা একা দাঁড়িয়ে মোবাইলে আঁধারবন্দী করছিলেন, তাই ভাবলাম হয়তো কথা বলতে আপনারও ভালো লাগতে পারে”।
ছেলেটির চোখেমুখে তখনও অবাক ভাব, কাটতে সময় নেবে বুঝতে পারি। কিন্তু তার আগেই সালমা বলে, “আমার কথা বলতে ইচ্ছে করে নাই কিন্তু, ওর করেছে, বুঝলেন?”
ঃ জি বুঝেছি। তাহলে নেমে আসুন আপনারা, কথা বলি।
বাহ্্ গলার স্বরটাতো বেশ। ভরাট। আমি সালমার দিকে তাকাই, বলি, “চলো, নেমে ফেরির পেছন দিকে যাই, ওপরেতো ভিআইপিরা দরোজা বন্ধ করে রেখেছে”। সালমা বলে, “তোমরা নামো, আমি আসছি একটু পরে, একটা ফোন করতে হবে আমার”- বুঝতে পারি, সালমা সময় নিচ্ছে। আমি দরোজা খুলে নামি। পরনের শাড়িটি সামলে নামতে একটু সময় লাগে। পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে তারপর নামি, তখনও ফেরি জুড়ে গোময়-এর গন্ধ ম ম করছে। ছেলেটি এগিয়ে আসে, বলে, “এইদিকে আসুন” হাত দিয়ে দেখিয়ে দেয় ফেরির সামনের দিকটা। সেখানে ইতিউতি লোকজন দাঁড়ানো, তবে জায়গা আছে ফাঁকা, দাঁড়ানোর মতো। আমরা গিয়ে দাঁড়াই এবং সেই প্রথম পদ্মা থেকে বাতাস ওঠে একটু খানি, জলগন্ধ মাখানো। আমার ভালো লাগে। আমি ফিরতে থাকি পেছনে, যখন আমার ষোল কি সতের বছর, তখনকার কোনো দিন। এমন আশ্বিনও হতে পারে। তুমুল বৃষ্টি আর ঢেউ ভেঙে পদ্মা পার হতে হতে আরেকজন মানুষকে আমি দেখছিলাম কেবলই, সেও তাকিয়েই ছিল সারাক্ষণ কিন্তু কথা বলার সাহস আমাদের কারোরই হয়নি। অথচ, আজ কি অনায়াসে আমি একটি ছেলেকে তার অবস্থান থেকে ডেকে সরিয়ে এনে গল্প করছি, নিজেকে আমার সাহাসী মনে হয় একটু। বলি, “আমি সত্যিই দুঃখিত, আপনাকে এভাবে ডেকে বিরক্ত করার জন্য”।
ঃ বিরক্ত হচ্ছি না, আপনি বলুন।
ঃ কী বলবো?
ঃ কথা বলতে চাইছিলেন না?
ঃ কথা, খুঁজে পাচ্ছিনাতো আর।
আমি সত্যিই কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না আর। তবে আমি ক্রমশঃ ফিরছিলাম অতীতে, মনে হচ্ছিলো আমি সেই ছেলেটির সঙ্গে কথা বলছি, যখন আমার বয়স ষোল, ছেলেটিরও হয়তো তাই। ভেতর থেকে কি কোনো দীর্ঘশ্বাস বেরুচ্ছে? বুঝি না।
আমার কথা শুনে ছেলেটি আবার হেসে ওঠে, বেশ উঁচু এবং দরাজ হাসি। অন্ধকার একটু একটু করে গলে পড়ে সে হাসিতে। আমি ছেলেটির মুখ দেখতে পাই না আর। কিন্তু আমার মুখের ওপর আলো পড়ছে বুঝতে পারি, চোখে এসে লাগে। তবুও দাঁড়িয়ে থাকি আমি। বলি, “কী নাম আপনার?”
ঃ ওই যে বললেন, তপু, আমার নাম ধরুন তপুই।
ঃ যাহ্ সত্যি নয়, সত্যি নাম বলুন। আচ্ছা থাক বলতে হবে না। আপনার নাম তপু। তা তপু কী করেন আপনি?
ঃ আপনিইতো বললেন, টিভি চ্যানেলে কাজ করি। ধরুন, তাই করি।
ঃ আচ্ছা, নাহয় তাই ধরলাম। কোথায় গিয়েছিলেন? বা কোথা থেকে ফিরলেন?
ঃ আপনি কি সব সময় এরকম করে কথা বলেন? বেশ গুছিয়ে?
ঃ নাহ্্ বলি না, এখন বলছি, ভেবে চিন্তে এবং গুছিয়ে।
ছেলেটি হাসে। ওহ্ ছেলেটির নাম তপু। “আচ্ছা তপু, এই যে আপনাকে ডেকে আনলাম আমরা, আপনি কি যে কেউ ডাকলেই যেতেন?”
ঃ উনিতো আমাকে ডাকেননি বললেন, আপনিই ডেকেছেন। আসতাম, কারণ আপনাদের আমি দেখেছি, যখন আখ খাচ্ছিলাম তখন।
বাহ্্, বেশ স্মার্টতো। আমি আগ্রহী হই। আমরা কথা বলতে থাকি। বহু পুরোনো কোনো ইতিহাস খুঁড়ে আনা কথামালা। পদ্মার জলের ওপর ঝুলে থাকা আঁধার, ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের শব্দ আমাদের কথাদের আরো উজ্জীবিত করে। আমাদের চারপাশে দৈওয়ালা হাঁকে। ছোট্ট ছোট্ট প্লাস্টিকের কাপে করে দৈ বিক্রি করছে। ছেলেটি বলে, খাবেন? আমি বলি, নিশ্চয়ই। আমরা দই কিনি, মহা মিষ্টি দই। খেতে পারি না, সালমার জন্য যেটা কিনি সেটা হাতে ধরে রাখি।
হঠাৎ অন্ধকার ফুঁড়ে সালমা এসে দাঁড়ায়। বলে, “ঘাট এসে গেছে, চলো যাই এবার”। সালমার হাতে দৈ দিতে দিতে আমরা গাড়ির দিকে এগুই। আমরা কেউ কোনো কথা না বলে যে যার মতো ফিরে যাই। গাড়িতে উঠি। কুসুমকুমারী ফেরি থেকে আমাদের গাড়িটি নামে ভিআইপিদের গাড়িরও বেশ কয়েকটি গাড়ি পরে। তারপর রাস্তার ওপর ঝুঁকে থাকা গাছের সারিকে গাড়ির হেডলাইটের আলোয় বিয়ের গেটের মতো মনে হতে থাকে আমাদের। কিন্তু ফিরতে ফিরতে আমরা দু’জনেই আর কেউ সেই ছেলেটির কথা বলি না। কেন বলি না সেটা বলতে পারবো না, তবে আমার মাথায় বাদামওয়ালার কাছ থেকে বাদাম কিনে খাওয়া-পরবর্তী আর কোনো স্মৃতি নেই। কিন্তু স্মৃতি না থাকলে কি হবে, আমাদের গাড়ির পেছন এবং সামনেটা ভর্তি করে নিয়ে আসি কচু শাক, ডাব, নারকেল, মিষ্টি, পিপুল পাতা, রুম্বি কলা, আরো কতো কি, যেনো পুরো শৈশব আমাদের গাড়িতে। আমরা ঢাকায় ফিরি, যে যার বাড়িতে নামি। কুসুমকুমারী ভিআইপি ফেরির কথা আর কখনও তুলি না আমরা।
6 মন্তব্যসমূহ
Nice one Indeed ...!! Khub Bhalo laglo pore ...
উত্তরমুছুনএকটানে পড়া গেলো। ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুনভাল
উত্তরমুছুনভাল লেখা! তবে ওই যে বললেন "অন্যরকম", সেটা মনে হয়নি! একজন মেয়ের একটা ছেলেকে এরকম ডেকে কথা বলাটা অস্বাভাবিক মনে হয়নি আমার কাছে! হতেই তো পারে এরকম, তাইনা?
উত্তরমুছুনসুন্দর গল্প
উত্তরমুছুনExcellent
উত্তরমুছুন