অনুবাদ : সালেহা চৌধুরী
(রোয়াল্ড ডালের গল্প ‘দি সোয়ানের’ সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর। রোয়াল্ড ডালের জন্ম ১৯১৬ সালে ব্রিটেনের ওয়েলস এ। বাবা ও মা ছিলেন নরওয়ের। ইংল্যান্ডে পড়াশুনা শেষ করে শেল ওয়েল কোম্পানিতে কাজ নেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় আর এ এফ পাইলট হন। মাথায় একটা ভয়ানক আঘাত লেগেছিল সেইসময়। তখনই জন্ম নেয় তাঁর প্রথম গল্প। তারপর থেকে অনেক কিছু লিখেছেন। তাঁকে ব্রিটেনের সবচাইতে বড় শিশু সাহিত্যিক বলা হয়। বড়দের জন্যও অনেক গল্প লিখেছেন। বর্তমান গল্পটি বড়দের বই ‘হেনরি সুগার এ্যান্ড সিক্স মোর’ নামের গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। ১৯৯০ সালে মারা যান।)
আর্নিকে ওর জন্মদিনে ওর বাবা একখানা .২২ রাইফেল উপহার দিলেন। শনিবারের সকাল। বাবা সকাল সারে নয়টার টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখে একটু ঘুম ঘুম ভাব, বললেন -- দেখ তুই আমাদের জন্য কী ধরে আনতে পারিস। দেখ যদি পারিস দুপুরের খাবারের জন্য একটা কিছু ধরে আন।
-- বাবা লেকের উল্টোদিকে অনেক খরগোশ আছে। আর্নি একেবারে খুশী খুশী গলায় বাবাকে বলে। বলে -- ওদের আমি দেখেছি।
-- তাহলে যা একটা শিকার করে নিয়ে আয়। সকালের ব্রেকফাস্ট দুই দাঁতের মাঝখান থেকে খিলাল দিয়ে পরিস্কার করতে করতে বাবা বলেন। -- একটা খরগোশ ধরে আন যদি পারিস।
-- একটা কেন বাবা আমি দুটো খরগোশ ধরে আনব। আর্নি জানায়।
-- আর আসার সময় আমার জন্য খানিকটা বাদামি বিয়ার নিয়ে আসিস।
-- তোমার বিয়ার কিনবার টাকা দাও তাহলে। টেলিভিশনের থেকে চোখ না তুলে বাবা নিজের পকেট থেকে একটা পাউন্ড ছেলেকে দেয়। বলেন -- মনে রাখবি এখান থেকে কোন পয়সা সরাতে গেলে আমি বুঝে ফেলব। গতবার তাই করেছিলে তুই। জন্মদিন টন্মদিন কিছু মানব না যদি এমন হলে কান টেনে লাল করে দেব।
-- ও নিয়ে ভেব না। ঝপ করে বলে ফেলে আর্নি।
-- বন্দুকে চোখ লাগিয়ে কেমন করে শিকার করতে হয় সেটা যদি প্রাকটিস করতে চাস তাহলে প্রথমে পাখি শিকার করবি। একটা গুলি কতগুলো পাখি মারতে পারে সেটা জানতেও পারবি।
-- ঠিক। অনেক পাখি আছে। ওদের ধরা এমন কোন কঠিন কাজ নয়।
-- ছোট চড়াই ধরা যদি কঠিন মনে না হয় তাহলে বড় রেণপাখি ধরতে চেষ্টা করবি । যদি রেন ধরতে পারিস তাহলে বুুঝব তুই মস্ত শিকারী। ওরা কখনো গাছে চুপ করে বসে থাকে না। খালি এক ডাল থেকে আর এক ডালে যায়।
আর্নির মা সিংকে থালাবাসন ধুতে ধুতে বলে -- সকালবেলা পাখি ধরতে পাঠাচ্ছো ছেলেকে, ওরা হয়তো নিজের বাসায় একটু আরাম করছে, সেখানে গিয়ে ঠাস ঠাস করে গুলি করবে আর্নি?
-- চোপা বন্ধ কর। বাবা গর্জন করে ওঠেন। তোমার মতামত কেউ নিতে আসেনি। বাবা বলেন -- শোন আর্নি তুই বন্দুক নিয়ে বড় রাস্তায় দেখাতে দেখাতে যাবি না। কারণ এর লাইসেন্স নেই তোর কাছে। লুকিয়ে নিয়ে যাবি। যখন গ্রামের দিকে যাবি তখন বন্দুক বের করবি।
-- ওসব নিয়ে ভাববে না। এই বলে আর্নি বন্দুক আর গুলিভর্তি বাক্স নিয়ে বীরের মত রওনা দেয় বাপকে দেখাতে সে বন্দুক দিয়ে কী করতে পারে। আজ ওর বয়স পনেরো বছর। বেশ একটা বদমায়েশ এবং চাষারে মার্কা এই ছেলে। সে আদবকায়দার ধার ধারে না। ট্রাক ড্রাইভার বাবার মতই ধুর্ত ওর চোখ দুটো কপালের মাঝখানে জ্বল জ্বল করে। ঠোঁট গুলো সবসময় ভেজা ভেজা। প্রায়ই হাঁ করে থাকে। এমন বাড়িতে সে বড় হয়েছে যেখানে মারপিট, লাথ্যি, থাপ্পর কোন ব্যাপার নয়। সে নিজেও একজন হিংস্র প্রকৃতির ছেলে। প্রতি শনিবার ওরই মত কিছু বদমায়েশ ছেলের সঙ্গে ফুটবল খেলা দেখতে যায় এবং সেখানে যদি তারা মারামারি না করতে পারে মনে করে আজকের যাওয়াই অর্থহীন। ওর সবচেয়ে মজার কাজ হলো স্কুল ছুটির পর কোন ছোটখাটো, নিরিহ ছেলেকে ধরে হাত মুচড়ে দিয়ে এক ধরণের আনন্দ পাওয়া। তারপর ওইসব ছেলেদের মা বাবা সম্বন্ধে কুৎসিত অপমানজনক কথা বলে তাদের একেবারে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে --
ঘাতে শেষ মোচড় দেবার পর ছেলেটাকে হয়তো ছেড়ে দেয়। কাঁদতে কাঁদতে সেই নিরিহ ছেলে পালাতে পথ পায় না।
আর্নির সবচেয়ে ভালো বন্ধু রেমন্ড। সে চার বাড়ি পরে থাকে। সেও বয়সের তুলনায় ওরই মত বড় একজন। আর্নি বেশ মোটা আর স্থুল আর রেমন্ড পেশল, পাতলা ও লম্বা।
রেমন্ডের বাড়ির সামনে এসে মুখের ভেতর দুই আঙুল ঢুকিয়ে বিশেষ হুইসিলে ও রেমন্ডকে ডাকে। রেমন্ড ছুটে আসে। আর্নি বলে -- দেখ এবারের জন্মদিনে কী পেয়েছি আমি।
-- চমৎকার। এটা দিয়ে আমরা অনেককিছু করতে পারব।
--তাহলে চলে আয়। এবার আমরা লেকের ওইপারে গিয়ে খরগোশ শিকার করি।
এই দুই মহাশয়তান এবার রওনা দেয়। মে মাসের শনিবারের এক সুন্দর সকাল। ওরা দুইজন যেখানে বাস করে তার চারপাশ অত্যন্ত অপূর্ব দৃশ্যে নয়নাভিরাম। চেস্টনাটের গাছ গুলো ফুলে ফুলে ফুলময়। আর বেড়ার পাশের হর্থন গুলো ফুলে ফুলে সাদা। ওরা প্রথমে একটা সরু রাস্তা ধরে আধমাইল মত যায়। এরপর রেললাইন পার হয়ে লেকের ওপারে গেলে অনেক হাঁস, জলজ পাখি, জলের মোরগ এবং অসংখ্য পাখির কলতান শুনতে পায়। আর কাছের একটা ছোট পাহাড় বা টিলার কাছেই থাকে খরগোশেরা। মিস্টার ডগলাস নামের একজনের ব্যক্তিগত সম্পত্তি এ জায়গা। তিনি এখানে পাখির নিরাপত্তার জন্য সংরক্ষিত জায়গা বানিয়েছেন। যাকে ইংরাজিতে বলে ‘বার্ড সাংচুয়ারি’। যেখানে জলজ পাখিরা মনের আনন্দে বাস করে, কেউ তাদের বিরক্ত করে না। ওরা সেই সরু রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে পাখি শিকার করতে থাকে। একবার আর্নি বন্দুক নেয় একবার রেমন্ড। আর্নি চড়াই পাখি আর ফিংচ শিকার করে। আর রেমন্ড হলুদ গলার দুটো ফুটফুটে পাখি ঠাস করে ধরে হাসতে থাকে। ওরা পাখিগুলোকে দড়িতে ঝুলিয়ে কাঁধে ফেলে চলছে। রেমন্ড সবসময় সঙ্গে নেয় ছোট এক বান্ডিল দড়ি বা মোটা সুতো। এ তার অভ্যাস। কাজেই পাখি ঝোলাতে আর অসুবিধা কী। রেমন্ড বলে -- জানিস আর্নি এখন এগুলো আমরা খেতে পারি।
-- বোকার মত কথা বলিসনাতো রেমন্ড? কতটুকু মাংস আছে এইসব পাখির যে এখনি আমরা খেতে পারি।
-- অনেকেই খায়।
-- আগে সবগুলো ধরি। তারপর খাওয়া।
রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে যতগুলো পাখি পেল সবগুলো শিকার করতে লাগলো তারা। পাখিদের জীবনে এমন অভিজ্ঞতা প্রথম। অনেকগুলো পাখি দড়িতে ঝুলছে। ওরা দেখে--
একটু ঝোপবনের পাশে, রেলসরকের ধারে একটা হালকাপাতলা শান্ত ছোটছেলে দাঁড়িয়ে আছে। হাতের বাইনাকুলারে সে গাছের ডালে বসে থাকা একটা সবুজ পাখি দেখছে।
রেমন্ড বলে তুই জানিস ও কে? ও হলো সেই পচা তুচ্ছ এক ছোকরা। ওর নাম পিটার ওয়াটসন।
-- ঠিক বলেছিস। এ সেই পিটার ওয়াটসন। পৃথিবীর আবর্জনা।
পিটার ওয়াটসন চিরদিন ওদের শত্র“। ওরা ওকে পছন্দ করে না কারন সবদিক দিয়ে শান্ত ছেলেটা ওদের বিপরিত। ছোট একটা শরীর। ফর্সা মুখটা একটু ছিট ছিট। চোখের চশমায় পাওয়ার। পড়াশুনায় অত্যন্ত মেধাবী এই ছেলে। সে সঙ্গীত ভালোবাসে। চমৎকার পিয়ানো বাজায়। সে তেমন বাইরের হৈ চৈ খেলাধুলা করে না। আপনমনে থাকে। ওর বাবা এদের বাবার মত ট্রাক চালায় না। ব্যাংকে কাজ করে।
-- চল পুচকে ছোড়াকে একটা দারুণ ভয় দেখানো যাক।
ওরা খুব ধীরে ওই ছেলেটার সামনে হাজির। ও দেখতে পায়নি প্রথমে কারণ ওর চোখে তখনো বাইনাকুলার।
-- হাত তোল। হ্যান্ডসআপ। বন্দুক তাক করে বলে দুজন।
পিটার ওয়াটসন ভয় পেয়ে লাফ দিয়ে ওঠে। সে বাইনাকুলার নামিয়ে এই দুইজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর চোখে আতংক কারণ ওদের ও খুব ভালো করে চেনে।
-- হাত তোল। যা বললাম কর। আর্নি বলে চিৎকার করে।
-- কেন তোমরা আমার দিকে বন্দুক তাক করছো? এটা কী ভালো কাজ? পিটার বলে।
-- যা আদেশ করছি কর। প্যাচাল পারিস না।
ও দুই হাতে বাইনাকুলার ধরে আছে। সে একবার আর্নির দিকে একবার রেমন্ডের দিকে তাকায়। বুঝতে পারে ওরা ওকে নিয়ে এখন যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। বছরের পর বছর ও ওদের জানে। অনেক যন্ত্রনাও সহ্য করেছে পিটার ওদের হাতে। বলে -- তোমরা কী চাও?
-- কী চাই? হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাক এটাই আমরা চাই। -- তোল হাত তোল। তুই কী ইংরাজি বুঝতে পারছিস না যে কথা শুনিস না? আমি পাঁচ পর্যন্ত গুনছি তারপর যদি তুই হাত না তুলিস তোর পেট ফুটো হবে গুলিতে। -- এক দুই তিন চার ------।
পিটার ধীরে ধীরে ওর হাত দুটো উপরে তোলে। রেমন্ড গিয়ে ওর হাত থেকে বাইনাকুলার কেড়ে নেয়। -- এটা কী? তুই কার উপরে এমন স্পাইং করছিস?
-- কারো উপরে না। পিটার বলে।
-- মিথ্যা বলিস তোর তো খুব সাহস। তুই আমাদের উপর স্পাইংস করছিস।
-- না। আমি তোমাদের উপর স্পাইং করছি না।
-- এই রেমন্ড ওর কানটা একটু টেনে দেতো যেন ও এমন মিথ্যা না বলে। ভালো করে শেখা কখনো যেন চালাকি না করে।
-- কানতো টানবই। তার আগে চিন্তা করছি ওকে নিয়ে আর কী করা যায়।
পিটার বুঝতে পারছে এখন যদি পালাতে চায় দুই মিনিটের ভেতর ওরা ওকে ধরে ফেলবে। চিৎকার? কেউ নাই আশেপাশে। কাজেই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া ও আর কী করতে পারে?
-- হাত কখনো নামাবি না। এই বলে বন্দুক এমন করে ঘোরায় যেমন করে সিনেমার বড় বড় দস্যূরা। বলে -- ছোকরা তুই বলবি না কার উপরে স্পাইং করছিলি?
-- আমি বাইনাকুলার দিয়ে একটা সবুজ কাঠঠোকরা দেখছিলাম। বলে পিটার যতটা সুন্দর করে বলা যায় ততটা সুন্দর করে।
-- কী দেখছিলি?
-- একটা সবুজ কাঠঠোকরা।
-- কোথায় সেই পাখি। আমি ওকে গুলি করব।
পিটার দেখতে পায় দড়িতে ঝোলানো নানা পাখি। বলে কেবল -- ও নেই। তোমাদের পায়ের শব্দে উড়ে চলে গেছে।
-- ওসব পাখি দেখার কী আছে? তোর কী আর ভালো কিছু করবার নাই? পাখি দেখা? অর্থহীন কারবার।
-- আমি অর্থহীন মনে করি না।
-- আর আমরা যা করি তোর তা মোটেই পছন্দ নয় তাই না? মনে করিস আমরা যা করি তা অর্থহীন। পিটার এমন কথার কোন উত্তর দেয় না। কিন্তু হাত তুলে থাকতে থাকতে ওর দুই হাত বেদনা করতে শুরু করেছে। তখন মনে হলো ওর হাত দুটো একটু নামাই না কেন। জানে এমন কাজে ঝুঁকি। তবু।
-- তোল। হাত তোল।
-- যদি না তুলি? যেন একটু সাহস সঞ্চয় করেছে সে এমন করে বলে।
-- না তুলি? বাপেরজন্মেও এমন কথা শুনি নি। আমরা বলব তারপর কেউ শুনবে না। তোর নার্ভ মনে হয় বেশ শক্ত। আমি তোকে সাবধান করে দিচ্ছি শেষবারের মত। যদি কথা না শুনিস বন্দুকের গুলি তোর মাথা চুরমার করে দেবে।
-- সেটা তো একটা আইনভাঙ্গার কাজ হবে। তারপর পুলিস আসবে। পিটার বলে।
-- আর তুই সোজা হাসপাতালে তারপর ----
-- বন্দুক ছুড়তে চাইলে ছোঁড় তারপর বস্টলের জেলখানায় যেতে হবে তোমাদের। দেখে আর্নি কী যেন ভাবছে। রেমন্ড ওকে বলে -- তোর কান্ড দেখে মনে হয় এটাই তুই চাস।
-- আমি তোমাদের অনুরোধ করছি আমাকে রেখে তোমরা যা করছিলে কর। আমি তো তোমাদের কোন ক্ষতি করিনি।
-- তুই একটা শয়তান। তোর কিছু করতে হয় না। তুই পাজি, তোর মত খারাপ ছেলে আর নেই।
এখন রেমন্ড আর্নির কানে কানে কি যেন বল্।ে আর্নি শোনে। তারপর বলে -- তোর এই আইডিয়া দারুণরে রেমন্ড।
এরপর আর্নি ওর বন্দুক মাটিতে রেখে পিটারের দিকে এগিয়ে যায়। ওকে এক ধাক্কায় মাটিতে ফেলে দেয়। রেমন্ড পকেট থেকে দড়ি বের করে, কাটে। এরপর ওই দড়ি দিয়ে জোর করে পিটারের হাত দুটো পিঠের পেছনে শক্ত করে বাঁধে।
-- এরপর পা দুটো বাঁধতে হবে। পিটার বাধা দেবার চেষ্টা করলেই পেটে এক বড় ঘুসি পড়ে। এতবড় ঘুসি খেয়ে তার আর নড়বার ক্ষমতা থাকে না। এরপর ওকে এমন করে বাঁধা হয়,যেন একটা মুরগীর বাচ্চার মত অসহায় সে। এরপর ওরা বন্দুক কুড়িয়ে নিয়ে পিটারকে ছেঁছড়াতে ছেঁছড়াতে রেল লাইনের দিকে নিয়ে চলে। পিটার কী বলবে? যা বলবে তাতেই বিপদ বেড়ে যাবে। এরপর ওরা ওকে সোজা রেললাইনের উপর নিয়ে ফেলে। দুই রেললাইনের মাঝখানে শুইয়ে দেয়। -- তোমরা কী পাগল। এসব তোমরা করতে পারো না।
- কে বলে আমরা এসব করতে পারি না। এত কথা বলার শাস্তি এটা। বেশি বাড়াবাড়ির ফল। এরপর আরো দড়ি নেয় রেমন্ড। এরপর ওকে রেললাইনের ভেতর এমন করে বাঁধে ও নড়তে পারে না। কেবল নাড়াতে পারে মাথা। রেমন্ড বলে -- বেশ ভালো কাজ করেছি আমরা। এই ছোঁড়া এবার নড়–ক দেখি। আধ ঘন্টা পর পর ট্রেন আসে। আমাদের খুব বেশি অপেক্ষা করবার দরকার নেই।
-- এটা তো খুন।
-- তা কেন।
-- আমাকে যেতে দাও। এখন যদি ট্রেন আসে আমি মারা যাব।
-- যদি মরিস সেটা তোর দোষ। মাথা নাড়াবি না। একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে থাকবি ট্রেন উপর দিয়ে চলে যাবে তোর কিছু হবে না। যদি ট্রেনের তলায় একটু ফাঁকা থাকে তাহলে তুই ব্াঁচবি। এই রেমন্ড কতটা ফাঁকা থাকে ট্রেনের তলায়?
-- খুব বেশি না। ওরা তো প্রায় মাটি ঘেসে চলে।
-- আমার আর তোর জন্য হয়তো জায়গাটা অনেক। ওর জন্য নয়। ফ্যাঁক ফ্যাঁক করে হেসে বলে রেমন্ড। বলে -- জানিস কেন নয়?
-- কেন নয়?
-- ওর যে দুটো বড় বড় গাধার মত কান আছে সেইজন্য ওর জায়গা বেশি দরকার। যেতে যেতে ট্রেনটা ওর মুখটা সমান করে দিয়ে চলে যাবে।
-- ঠিক তাই রেমন্ড। ওর মুখ পালিশ হবে।
এই বলে সেই দুই ভয়ানক ছেলে একটু দূরে গিয়ে একটা ঝোপের ভেতর গিয়ে বসে। পকেট থেকে সিগারেট বের করে টানতে থাকে। বসে থাকে কখন ট্রেন আসবে সেই অপেক্ষায়।
নিরিহ ভালো ছেলে পিটার ওয়াটসন রেল লাইনের মাঝখানে স্থির হয়ে পড়ে আছে। এরা ভয়ানক খারাপ ছেলে। সবসময় ভবিষ্যত না ভেবে কাজ করে। সে ভাবছে এখন সে কী করতে পারে। সে দেখে তার নাকটা একটু উঁচু। যদি সে মাথাটাকে আরো একটু নিচুতে নিয়ে যেতে পারে তাহলে খানিকটা ফাঁকা জায়গা বেরোতে পারে। সে জানে না এইসব ডিজেলে ট্রেনের নিচে কতটা জায়গা ফাঁকা থাকে। ওর মাথাটা পড়েছিল কাদার মত জায়গায়। ও মাথা এদিক থেকে ওদিক নাড়াতে থাকে। এই করতে করতে মাথার নিচে খানিকটা গর্ত হয়। যেন মাথার নিচে একটু গর্ত হয়ে মাথাটা একটু নিচে নেমে যায়। মনে হয় দুই ইঞ্চি জায়গা বের হলো। আগে ছিল চার ইঞ্চি মত খালি এবার তার সঙ্গে দুই ইঞ্চি যোগ হলো। আর পা গুলো কী করবে? পা দুটোকে যতদূর সম্ভব সমান কওে রাখে। ড্রাইভার কী ওকে দেখতে পাবে? মনে হয় না। ড্রাইভার এসব ট্রেনে বসে কেবল সিগনালের দিকে চোখ রাখে। এখানে ট্রেন ঘন্টায় আশি মাইল বেগে যায়। সে অনেকদিন একটু দূরে বসে ট্রেনের যাওয়া আসা দেখেছে। কখনো ট্রেনের সময় আর ইঞ্জিনের নাম সে খাতায় লিখে রেখেছে। ট্রেন যদি ওর শরীর স্পর্শ নাও করে ভয়ানক শব্দইতো ওকে শেষ করে দিতে পারে। আর আশি মাইল স্পিডে যাওয়া ট্রেনের বাতাস ওকে কী টেনে নেবে? তা মোটেই অসম্ভব নয়। কী হবে ভাবতে ভাবতে শরীরটাকে যতটা সম্ভব মাটির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলতে চায়।
-- ওই ইঁদুরমুখো শয়তান কী করছিস তুই? ওরা ঝোপের ভেতর থেকে খি খি করে হাসতে হাসতে বলে। -- এখন মারা যাবি তার জন্য অপেক্ষা কেমন লাগছে তোর? ও ভাবে এসবের উত্তর দেওয়া ঠিক নয়। সে দেখে মাথার উপরের নীল আকাশ। মেঘের ভেতর নানা ছবি।
একসময় মাটির ভেতর কাঁপতে থাকে। প্রথমে খুব আস্তে। তারপর শব্দটা মনে হয় রেললাইনের ভেতর দিয়ে কাছে আসছে। অনেক দূর থেকে খুব কাছে। এতো তাহলে ট্রেন পিটার মনে মনে ভাবে। শব্দটা বেশ জোরে শোনা যায়। একটু একটু করে জোরে। সে মাথাটা একটু তুলে দূরে তাকায়। দীর্ঘ লাইন চলে গেছে। তখন মনে হলো ছোট একটা বিন্দুর মত কিছু। ট্রেনটা আস্তে আস্তে একটু বড় হয়। তারপর? এটা আর বিন্দু নয় একটা ইঞ্জিনের সামনের দিক।ও মাথা নামায়। গর্তের ভেতরে মাথাটাকে ঢোকাতে চেষ্টা করে। পা দুটোকে একপাশে নিয়ে যায়। চোখ দুটো বন্ধ করে। শরীরটা যতদূর সম্ভব মাটির সঙ্গে লাগিয়ে রাখে।
ভয়ানক একটা বিস্ফোরণ! ট্রেন ওর উপর দিয়ে চলে যায়। মাথার ভেতরে মনে হলো কে যেনো গুলি করেছে। এরপর মস্ত বড় এক ‘হারিকেনের’ ঝড়ের মত বিপুল বাতাস ওর নাকে, কানে, ঢোকে, ওর প্রায় দমবন্ধ করে ফেলে। আর শব্দ? ওকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে। মনে হয় ও আর দম ফেলতে পারবে না। এক
তারপর সব শেষ। ট্রেনটা চলে গেছে। পিটার এবার চোখ খোলে। দেখতে পায় আকাশের নীল মেঘ। সব শেষ হয়েছে আর ও এই সাংঘাতিক অবস্থার ভেতরেও বেঁচে আছে।
-- ওই ছোকরা বেঁচে গেছে। ছোকরাকে ট্রেন কিছু করতে পারেনি। কানের কাছে ওদের গলা।
-- ইস কেমন করে বাঁচলি রে তুই? আরেকজন বলে।
সে পাশে তাকায় এবং দেখে সেই দুই মহাশয়তান মস্তান।
-- ওর দড়ি দড়া কাট। একজন বলে।
রেমন্ড দড়ি কাটে। বলে আর্নি -- ওঠ।
পিটার দাঁড়ায়। -- এখনো তুই আমাদের বন্দি মনে রাখবি এই কথা।
-- খরগোশ শিকার কখন হবে? রেমন্ড বলে।
-- খরগোশ? সেটার জন্য ম্যালা সময় আছে। -- এখন চল আমরা এই পুচকেটাকে লেকের ধারে নিয়ে যাই। ওখানে ডোবাই।
-- তোমরা তো আমাকে নিয়ে অনেক মজা করেছো। এবার আমাকে যেতে দাও না কেন। পিটার সাহস করে বলে।
-- তোকে এখনো ছাড়া যাবে না কারণ তুই আমাদের বন্দি। সাধারণ বন্দি নস তুই। তুই হলো স্পাই। জানিস না স্পাইদের ধরলে কী করে? দেয়ালের সামনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে। পিটার আর কিছু বলে না। যা বলবে তাতেই ওরা আরো রেগে যাবে। যত কম কথা বলবে ততই হয়তো ভয়ানক কোন ক্ষতি থেকে ও বেঁচে যাবে। ও বুঝতে পারে ওরা ওকে নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। ওর মনে পড়ে আর্নি একবার ওয়ালি সিম্পসন নামের এক ছোট ছেলের হাত মুচড়ে ভেঙ্গে ফেলেছিল। ওর বাবা মা পুলিসের কাছে গিয়েছিল। প্রমানের অভাবে আর্নি বেঁচে যায়। একবার রেমন্ড ফুটবল মাঠে একজনকে মেরে মাটিতে ফেলে অনেকগুলো লাথি দিয়ে রক্তাক্ত করে বীরদর্পে ফিরে এসেছিল। ওরা যা বলবে করবে। তারপর হয়তো একসময় ওকে ছেড়ে দিয়ে দুই মস্তান অন্যকাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। ওরা বললো -- হাঁট। একজনের হাতে বন্দুক। আর একজনের হাতে বাইনাকুলার।
মে মাসের অপূর্ব সকালে লেকের দৃশ্য সত্যিই সুন্দর। দুইপাশে ঝাঁকরা সবুজ উইলো গাছ। একটু অপ্রসস্থ লেক বয়ে চলেছে সুন্দর ভাবে। আর কাছেই নলখাগড়া আর উলুখাগড়ার সঘন সারি -- এবার আমরা করব কী এই রক্তচোষাকে হ্রদের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দেব। দুই হাতের দিকে ধর আর আমি পায়ের দিকে ধরি। -- কেমন হচ্ছে আমার পরিকল্পনা?
-- চমৎকার। রেমন্ড বলে।
-- তোর কেমন লাগছে এই ছোঁড়া?
-- এটাই যদি তোমরা করতে চাও আমি কী বলব। ওর গলার স্বর শান্ত। কোন প্রকার উত্তেজনা নেই সেখানে।
-- এটাই আমরা করতে চাই। বাধা দেওয়ার চেষ্টা কর। দেখ আমরা কী করি।
-- একটা প্রশ্ন করব? পিটার বলে -- আচ্ছা তোমরা কী কখনো তোমাদের মত বড়সড় একজনকে নিয়ে এমন মজা করবার চেষ্টা কর? না কেবল আমাদের মত পুচকেদের নিয়ে?
যখনই কথাটা বলে ফেলেছে পিটার বুঝতে পারে ও এবার একটা ভয়ানক ভুল করলো। আর্নির মুখ টকটেক লাল। চোখের ভেতর হিংস্র আগুন। ঠিক সেইসময় রেমন্ড কী যেন একটা দেখে বলে -- দেখ দেখ নলখাড়গার ওখানে কী ভেসে চলেছে। একটা হাঁস। বুনোহাঁস যাদের বলে। -- চল ওইটাকে শিকার করি।
চমৎকার একটা হাঁস। সোনালি ঝকঝকে পাখায় ভেসে চলেছে। গলার কাছে সবুজ পান্নার মত নকশা। -- এটাকে ধরলেই খাওয়া যাবে।
আর্নি বলে -- আমি ধরব এটাকে। এই বলে পিটারের হাত ছেড়ে দিয়ে বন্দুক তাক করে। -- এটা পাখি সংরক্ষনএর জায়গা। একটা বার্ডসাংচুয়ারি। পিটার বলে।
-- কী বললি তুই?
-- এখানে পাখি ধরা নিষেধ। এখানে কেউ পাখি শিকার করতে পারে না। পিটার বলে।
-- কোন শালা বলে এখানে পাখি শিকার মানা?
-- মিস্টার ডগলাস হাইটন। এটা তারই সাংচুয়ারি।
-- আর ঠাট্টা করিস না পিটার। বলতে না বলতেই গুলি লাগে সেই সবুজ গলার ঝকঝকে হাঁসের শরীরে। -- আর্নি এবার ওর দড়ি কেটে দেই আমরা। আমরা যা শিকার করব ও গিয়ে তা কুড়িয়ে আনবে। এই বলে হাতের দড়ি কেটে বলে -- এই ছোঁড়া যা কাদার ভেতর দিয়ে হেঁটে হাঁসটাকে এনে আমাদের দে। পিটার তখন সেই সুন্দর হাঁস শিকারে মনে মনে অত্যন্ত বেদনার্ত। সে ভেতরে ভেতরে কাঁপছে। বলে -- যদি না যাই।
আর্নি ঠাস করে ওর গালে চড় লাগায়। ও মাটিতে পড়ে যায় নি। কিন্তু নাক দিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করেছে। -- খুব ভালো করে মনে রাখবি যা করতে বলব তা যদি করতে না চাস তাহলে তোর দাঁত একটাও থাকবে না।
পিটার কথা বলে না। -- উত্তর দে। যা বলছি বুঝতে পারছিস কিনা।
-- বুঝতে পারছি। পিটার বলে।
-- যা। হাঁসটা নিয়ে আয়।
কাদার ভেতর দিয়ে ও হ্রদের দিকে যায়। নলখাগড়ার বনের ভেতর থেকে হাঁসটাকে তুলে আনে। রেমন্ড ঝপ করে ওর হাত থেকে হাঁস নিয়ে দড়ি বাঁধে হাঁসের পায়ে।
-- এবার আমাদের সঙ্গে আছে এই কুকুর। আমরা যা শিকার করব ও মুখে করে আনবে। চল দেখি আর যদি হাঁস পাওয়া যায়। ওরা খুঁজছে। নলখাগড়ার বনের ভেতরে আর কোন হাঁস বা জলজ প্রানী আছে কিনা। -- চুপ, সুস। আর্নি বলে। রেমন্ড আমি যা দেখছি তুই তা দেখছিস নাকি?
আর্নি বলে -- ওরে বাবা এতো দেখছি একেবারে সুন্দরী একজন।
পিটারের পা দুটো কাদায় মাখামাখি। ওর ট্রাউজার গোটানো। ও দেখতে পায় একটি সুন্দর ধবধবে সাদা রাজহাঁস নলখাগড়ার বনে নিজের বাসায় বসে আছে। হয়তো ওর পেটের তলায় বাচ্চা। একটা অপরূপ রাজকীয় রাজহাঁস। যেন এই লেকের রাণী বসে আছে লেক আলো করে। মহানমহিমান্বিত রূপে -- ওরে বাবা এযে এক অপরূপ রাজহাঁস। রেমন্ড বলে। রাজহাঁস ঘাড়টা ঘুরিয়ে ওদের দেখছে। একটা ভয় মনে -- এরা কারা।
আর্নি বলে -- এটা দেখি যেটা ধরেছি তার চেয়েও বড়। ওকে শিকার করতে হবে।
--ওকে শিকার করতে পারবি তোর এই বন্দুক দিয়ে?
-- খুব পারব। গলায় গুলি মারব, ধপ করে পড়ে যাবে।
পিটারের মনের ভেতরে ভয়ানক একটা রাগ এবার কুন্ডলিপাকিয়ে বড় হতে শুরু করেছে। হ্রদয়টা তার পাখপাখালির জন্য দয়ামায়ায় পূর্ন। -- আমি বলছি ওই রাজহাঁসটাকে তোমরা কখনোই গুলি করে মারবে না। যদিও সে কথাটা শান্ত ভাবে বলছে কিন্তু ওর ভেতরে রাগ টগবগ করে ফুটছে। বলে আবার -- রাজহাঁস এদেশের সবচেয়ে বড় সংরক্ষিত পাখি। এদের মারা আইনত অন্যায়।
-- তাতে তোর কী? আর্নি বলে জোক করে।
-- আর একটা কথাও আমার বলার আছে। যে পাখি তার বাসায় বসে থাকে তাদের কখনোই মারতে নেই। ওর শরীরের নিচে হয়তো শাবক রয়ে গেছে। পিটার ভুলে গেছে ওর বর্তমান অবস্থা। নিজেকে সামলাতে পারেনি।
-- এটা তোর বানানো আইন নাকি রে ছোঁড়া -- মিস্টার পিটার ওয়াটসনের আইন। বাসায় বসে থাকলে পাখি মারা যাবে না।
-- আমার আইন নয়। পুরো দেশেই এমন নিয়ম।
তারপর কাতর হয়ে বলে -- প্লি¬জ আর্নি ওকে মেরো না। তার কাতর আর্তনাদ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। বলতে না বলতেই বন্দুকের গুলি রাজহাঁসের গলায় লাগে। সে মুখ থুবড়ে তার বাসার কাছে পড়ে যায়। -- যা নিয়ে আয়। আর্নি বলে।
-- চমৎকার তাক তোমার। রেমন্ড জানায়।
পিটারের সমস্ত শরীর অনড়। তার সমস্ত মুখ সাদা। সে যেন নড়াচড়া করবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। আর্নি কাছে এসে ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলে -- আমি শেষবারের মত বলছি যা রাজহাঁসটাকে নিয়ে আয়।
তখন পিটারের চোখ দিয়ে দর দর করে পানি পড়তে শুরু করেছে। আস্তে আস্তে কাঁদতে কাঁদতে ও পানি-কাদার ভেতর দিয়ে রওনা দেয়। দুইহাতে বুকের কাছে হাঁস ধরে, বড় নরমভাবে, তারপর বিষন্ন মনে ফিরে আসতে থাকে।
-- বাসায় কী কোন ডিম ছিল? আর্নি প্রশ্ন করে। ওযে বাসায় কয়েকটা নতুন ডিমফোটা বাচ্চা দেখেছে সে সন্বন্ধে কিছু বলে না। মনে মনে ভরসা পুরুষ রাজহাঁসটা ফিরে এসে যদি ওদের তা দিয়ে বড় করে। বলে কেবল -- না। কোন ডিম ছিল না।
পিটার আস্তে করে সেই হাঁস ওই দুই মস্তানের সামনে নামিয়ে রাখে। তখনো তার চোখের জলে গাল ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু সেখানে কষ্টের আগুন। সব ভুলে বলে -- এটা একটা গাধারমত অর্থহীন কাজ। তোমরা আসলে দুজন মুর্খ বোকা ছেলে। যদি এই রাজহাঁসের পরিবর্তে তোমরা নিজেরা মারা যেতে সেটাই ঠিক হতো।
পিটার নিজেও জানে না ও কী বলছে।
আর্নি এবার ওকে মারে না। সে একটু অবাক হয়ে গেছে এমন কথায়। এরপর ওর দুই কুতকুতে চোখে আর এক ভয়ানক কিছু। -- ও তুই তাহলে রাজহাঁস খুব পছন্দ করিস তাইতো?
-- রাজহাঁস খুবই পছন্দ করি। আর তোমাদের ঘৃণা করি।
-- তুই তাহলে চাস এই রাজহাঁসটা বেঁচে থাক ওর মরা ঠিক হয়নি এইতো?
-- এটা একটা বোকার মত প্রশ্ন। ও মারা গেছে এরপর ও কী করে বাঁচবে?
-- ওর কান ফাটিয়ে একটা চড় দেওয়া দরকার। বলে রেমন্ড।
শোন রেমন্ড আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। বলে পিটারের দিকে তাকিয়ে -- তুই চাস এই রাজহাঁস আবার প্রাণ ফিরে পেয়ে আকাশে দুই পাখা মেলে দিয়ে উড়–ক।
-- আবার একটা বোকার মত প্রশ্ন করেছো তোমরা। তোমরা নিজেদের কী মনে কর?
-- তোকে বলব আমরা কে এবং কী করতে পারি। আমি যাদুর মানুষ। আমি যাদু দিয়ে এমন করব এই হাঁস আবার আকাশে দুই পাখা মেলে দিয়ে উড়তে থাকবে।
-- যতসব রাবিশ। আমি যাব এবার।
-- যাবি। রেমেন্ড ওকে ধর ও যেন যেতে না পারে। রেমন্ড ওকে ধরে।
-- ছেড়ে দাও আমাকে। পিটার বলে। রেমন্ড একটা চড় দিয়ে বলে -- না আর আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবার চেষ্টা করবি না।
-- এই রেমন্ড তোর চাকুটা দেতো। চাকু নিয়ে আর্নি বসে রাজহাঁসের পাশে। তার দুই বিশাল পাখা দুই পাশে ছড়িয়ে দেয়। সে জানে কেমন করে রাজহাঁসের পাখা দুটোকে শরীর থেকে খুলে নেওয়া যায়।
-- তুমি কী করতে চাও। রেমন্ড তখনো জানে না আর্নির মনে কী আছে।
-- একটু অপেক্ষা কর জানতে পারবে। আর্নি জানায়। চাকুটা ধারালো। সে খুব ভালো করে পাখা দুটোকে অক্ষত অবস্থায় খুলে আনতে পারে। বলে এবার -- তোমার দড়ি দাও আমাকে।
রেমন্ড পিটারের হাতটা শক্ত করে ধরেছিল বলে -- এমন করে ডানা খুলে নেওয়া তুমি কোথায় শিখেছো আর্নি?
-- দে তোর দড়ি দেখ এবার কী করি।
রেমন্ড তাতে চিকনদড়ির বান্ডিল দিল। ও সেখান থেকে ছয়টা দড়ির অংশ ছোট করে কাটলো। ডানার উপরে সেই দড়ি সমানভাবে গেড়ো দিয়ে দিল। এরপর পিটারের কাছে গিয়ে বলে হাত লম্বা কর।
-- তোমরা সত্যিই ঘোর উন্মাদ। পিটার বলে।
-- যা বলছি তাই কর। এই রেমন্ড দেখতো ও যেন হাত বের করে। রেমন্ড নাকের কাছে ঘুসি দেখিয়ে বলে -- যেমন বলা হয়েছে তেমন কর। হাত বের কর ভালোছেলের মত।
পিটার কী করবে, কী করে এমন কাজে বাধা দেবে জানে না। সে আর্নির দিকে তাকায়। আর্নি তার ভয়ানক গনগনে চোখে এমন করে তাকায় মানে হলো যদি ও না করে আর্নি ওকে নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। পিটার বুঝতে পারে আর্নি যদি আরো রেগে যায় একজনকে খুন করতে ওর বেশি দেরী লাগে না। পিটার তার একটা হাত লম্বা করে বের করে।
আর্নি তখন সেই ঝোলানো দড়ি ওর বাজুতে একটার পর একটা লাগিয়ে শক্ত করে গেরো দিয়ে দেয়। যখন সবগুলো গেরো লাগানো হয় সেই ডানা পাখাখুলে পিটারের বাজুতে লেগে ওর পুরো হাত ঢেকে একধরণের পাখা তৈরী করে।
-- কেমন কাজ করলাম দেখ রেমন্ড এই রক্তচোষা ছোঁড়ার ডানা বানিয়ে দিলাম।
-- তাতো ঠিক কিন্তু একটা ডানা নিয়ে ও কী করে আকাশে উড়বে রে আর্নি?
-- আর একটা ডানাও হবে তুই একটু অপেক্ষা কর। বলে -- নে এবার তোর আর এক হাত লম্বা কর। পিটারের মনে হয় এমন ঘটনায় বমি হবে। আর্নি সেই পাখা ওর আর এক হাতে একই ভাবে লাগিয়ে দেয়।
-- এখন দুই ডানাওয়ালা এক রাজহাঁস ও হয়েছে কিনা দেখ। একেবারে জীবন্ত আর এক রাজহাঁস। বলেছি না আমি যাদু জানি। বলেছি না এমন যাদু করব এই মরা হাঁস প্রাণ পেয়ে আবার আকাশে উড়বে। আমার কথা ঠিক কিনা বল।
দুই হাতে পাখা নিয়ে মে মাসের চমৎকার সকালে লেকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে পিটার -- হতবুদ্ধি। ওদের খেলা কখন শেষ হবে জানে না। বলে -- তোমাদের খেলা শেষ হয়েছে?
-- এই ছোঁড়া কথা বলিস না, জানিস না রাজহাঁস কথা বলে না। এখন তোর শরীরের শক্তি কথা বলে শেষ করিস না। কারণ খানিকপর এই দুই ডানা নিয়ে তোকে আকাশে উড়তে হবে। আর্নি বন্দুক পিটারের গলায় ঠেকিয়ে বলে -- মার্চ কর। জোরে হাঁট।
ও হাঁটছে। ওরা পিছে পিছে আসছে। আসতে আসতে লেকের পাশের একটা বড় উইলো গাছের কাছে আসে। সেখানে ওরা থামে। সেই গাছের বড় বড় ডাল লেকের উপর ঝুঁকে পড়েছে। অনেক উঁচু সেই গাছ।
-- এইবার এই যাদুর হাঁস আমাদের যাদু দেখিয়ে আকাশে উড়বে। কাজেই তোকে এখন কী করতে হবে জানিস এই গাছের মগডালে তোকে উঠতে হবে। তারপর সেখান থেকে দুটো ডানা বের করে আকাশে উড়বি।
-- ফানটাসটিক আইডিয়া। রেমন্ড বলে।
-- দেখা যাক এই চালাক ছেলে এবার কী করে। এই রাজহাঁস এবার কতটা উড়তে পারে। ক্লাশে তোর বুদ্ধির কাছে আমরা হেরে যাই। এবার দেখা তোর বিশেষ বুদ্ধি এবং আকাশে উড়তে থাক। এই বলে জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে বলে -- নে ওঠ। গাছের মাথায় ওঠ আগে। তারপর উড়বি।
এদের এইসব উন্মাদ কারবার কতদূর যাবে পিটার বুঝতে পারছে না। ওর নিজেরও এখন আর প্রতিরোধ করবার কোন ইচ্ছা নাই। মনে হলো গাছের মাথায় উঠলে এদের হাত থেকে দূরে চলে যাবে। যদি দরকার হয় সে ওখানেই থাকবে যতক্ষণ থাকা যায়। মনে হলো যদি খুব একটা চিকনডালে ওঠে ওর হালকাপাতলা শরীর নিয়ে তাহলে এই দুইজন সেখানে উঠতে পারবে না ওদের মোটাসোটা শরীর নিয়ে। সে গাছে উঠতে তেমন পারে না। কিন্তু এখন সে ভাবছে যেমন করে হোক গাছের সবচেয়ে উঁচু আর চিকন ডালে সে উঠবে। আর যদি ওঠে পাতায় ঢেকে যাবে ওর শরীর। ওরা ওকে দেখতে পাবে না।
-- আরো উঁচুতে। থামিস না। নিচে থেকে চিৎকার করছে ওরা। পিটার উঠতেই থাকে। থামে না। এরপর সে এমন একটা ডালে ওঠে যেটা মানুষের হাতের মত চিকন। সেই ডালটা গাছের সবচেয়ে উঁচু ডাল। যার শেষভাগ ঝুঁকে আছে লেকের উপর। অন্য ডালগুলো খুব বেশি শক্ত নয়। তবে ও যার উপরে দাঁড়িয়ে আছে তা মোটামুটি শক্ত। মনে হলো সে বোধহয় কমসে কম পঞ্চাশ ফুট উপরে উঠেছে। নিচে তাকিয়ে প্রথমে ওদের দেখতে পায় না পিটার। মনে মনে ভাবে ওরা কী চলে গেছে?
-- এইযে রাজহাঁস সাহেব এবার আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছেন? আর্নির গলার স্বর কানে আসে। ওরা একটু দূরে সরে গিয়ে সেখান থেকে এই পিটারকে ভালো করে দেখছে। ও সেখানে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকায়। বুঝতে পারে এই গাছের পাতারা এমন বড় বড় নয় ওকে একেবারে ঢেকে দেবে। নিচের গলা বলে -- নে এবার এই ডালের মাঝখানে যা। তারপর দুই পাখা মেলে উড়তে থাক। পিটার নড়ে না। সে ওদের থেকে পঞ্চাশ ফুট উপরে। আর যাইহোক ওরা তো ওকে ধরতে পারবে না। ওরা দুইজন যতদূরেই থাক ওকে ঠিক দেখতে পাচ্ছে।
-- শোন রাজহাঁস এবার তোকে উড়তেই হবে। আমি দশ পর্যন্ত গুনব তারপর তুই উড়বি। না উড়লে খবর আছে। যদি না উড়িস এই বন্দুকের গুলি আবার তোকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে আনবে। তাহলে কী হবে জানিস একজনের জায়গায় দুইজন মরা রাজহাঁস আমাদের সামনে মরে পড়ে থাকবে। পিটার নিশ্চুপ, নিশ্চল। কথা নেই, নড়াচড়া নেই।
এক দুই তিন চার পাঁচ ছয় সাত আট নয় দশ তারপর বন্দুকটা সোজা ওকে তাক করে। ও শোনে গুলি বের হবার শব্দ। একটা গুলি ওর কানের পাশ দিয়ে চলে যায়। আতংকে পিটার আরো নিশ্চল।
-- এরপর যেটা ছুঁড়বো তোকে শেষ করবে। এই তোকে আমরা শেষ বারের মত বললাম।
পিটার চুপ করে অপেক্ষা করছে। মাঠের সবুজগাছের সাদা ফুলের উপর যারা দাঁড়িয়ে আছে তাদের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দ সে। ওরা তাক করছে। এরপর একটা গুলি এসে ওর পায়ে লাগে। মনে হলো কে যেন একটা হাতুড়ি দিয়ে ওর পায়ে আঘাত করেছে প্রচন্ডভাবে। সে প্রায় পড়ে যাবে, কোনমতে উপরের ডাল ধরে পড়ে যাওয়া ঠেকাতে চায়। কেউ কেউ আছে অত্যাচারের শেষ সীমায় পৌঁছে আর পারে না। অত্যাচারীর হাতে নিজেকে তুলে দেয় সমস্ত প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে। কেউ কেউ আছে তবে এদের সংখ্যা খুব বেশি নয় যারা কোনমতেই হার মানে না। অত্যাচারীর হাতে না মরা পর্যন্ত নিজেকে তুলে দেয় না। পিটার নামের সেই হালকাপলকা ছেলেটা এমনই একজন। মনের কাছে প্রতিজ্ঞা করে ওকে জয়ী হতেই হবে। তখন সে লেকের দিকে তাকায়, তাকায় একটু উপরে, দেখে এক আশ্চর্য আলো। এমন আলো, সে আলোতে এমন সৌন্দর্য ও চোখ ফেরাতে পারে না। সে আলো তাকে ডাকছে, আলোর কাছে যেতে বলছে, সে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই আলোর কাছে যাবে বলে।
সেদিন গ্রামের তিনজন লোক বলেছিল একই কথা। একটা বড় সাদা রাজহাঁস সারা গ্রামের মাথার উপর দিয়ে পাখা মেলে উড়ছে। সে দৃশ্য দেখেছিল স্কুল-শিক্ষক এমিলি মিড, একজন লোক বাড়ির ছাদ ঠিক করছিল সেও দেখেছিল এমন দৃশ্য আর একটা ছেলে জন মাঠে খেলনা এরোপে¬ন ওড়াচ্ছিল সেও এমন দৃশ্যে থমকে থেমে তাকিয়ে ছিল সেই আলোভরা সাদা বিশাল রাজহাঁসের দিকে।
পিটারের মা মিসেস ওয়াটসন রান্নাঘরের সিংকে থালাবাসন ধুতে ধুতে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখেন একটা রাজহাঁস উড়তে উড়তে তার বাড়ির পেছনের বাগানে এসে পড়েছে। ছুটে বাইরে গিয়েছিলেন মিসেস ওয়াটসন ঘটনা বুঝতে। দেখেছিলেন তার একমাত্র ছেলের শরীরটা কুঁকড়ে পড়ে আছে সেখানে। -- আমার সোনা আমার মানিক কি হয়েছে তোমার? কেমন করে এখানে এলে তুমি?
মাকে দেখতে পেয়ে চোখ খুলে কেবল বলেছিল পিটার -- মা আমার পায়ে অসহ্য যন্ত্রনা। তারপর সে জ্ঞান হারায়।
-- ও রে আমার ছেলের পা থেকে রক্ত পড়ছে। ওরে বাবা কেমন করে এমন হলো তোর? দুই হাতে ছেলেকে বুকে করে বাড়িতে এনেছিলেন মিসেস ওয়াটসন। তারপর তাড়াতাড়ি ডাক্তার আর এ্যাম্বুলেন্সকে ফোন করেছিলেন। ডাক্তার আর এ্যাম্বুলেন্স আসবার আগেই তাড়াতাড়ি একটা কেঁচি দিয়ে বিস্ময়ে ছেলের ডানা থেকে সেই দুই পাখা খুলে নিয়েছিলেন মা।
(রোয়াল্ড ডালের গল্প ‘দি সোয়ানের’ সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর। রোয়াল্ড ডালের জন্ম ১৯১৬ সালে ব্রিটেনের ওয়েলস এ। বাবা ও মা ছিলেন নরওয়ের। ইংল্যান্ডে পড়াশুনা শেষ করে শেল ওয়েল কোম্পানিতে কাজ নেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় আর এ এফ পাইলট হন। মাথায় একটা ভয়ানক আঘাত লেগেছিল সেইসময়। তখনই জন্ম নেয় তাঁর প্রথম গল্প। তারপর থেকে অনেক কিছু লিখেছেন। তাঁকে ব্রিটেনের সবচাইতে বড় শিশু সাহিত্যিক বলা হয়। বড়দের জন্যও অনেক গল্প লিখেছেন। বর্তমান গল্পটি বড়দের বই ‘হেনরি সুগার এ্যান্ড সিক্স মোর’ নামের গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। ১৯৯০ সালে মারা যান।)
আর্নিকে ওর জন্মদিনে ওর বাবা একখানা .২২ রাইফেল উপহার দিলেন। শনিবারের সকাল। বাবা সকাল সারে নয়টার টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখে একটু ঘুম ঘুম ভাব, বললেন -- দেখ তুই আমাদের জন্য কী ধরে আনতে পারিস। দেখ যদি পারিস দুপুরের খাবারের জন্য একটা কিছু ধরে আন।
-- বাবা লেকের উল্টোদিকে অনেক খরগোশ আছে। আর্নি একেবারে খুশী খুশী গলায় বাবাকে বলে। বলে -- ওদের আমি দেখেছি।
-- তাহলে যা একটা শিকার করে নিয়ে আয়। সকালের ব্রেকফাস্ট দুই দাঁতের মাঝখান থেকে খিলাল দিয়ে পরিস্কার করতে করতে বাবা বলেন। -- একটা খরগোশ ধরে আন যদি পারিস।
-- একটা কেন বাবা আমি দুটো খরগোশ ধরে আনব। আর্নি জানায়।
-- আর আসার সময় আমার জন্য খানিকটা বাদামি বিয়ার নিয়ে আসিস।
-- তোমার বিয়ার কিনবার টাকা দাও তাহলে। টেলিভিশনের থেকে চোখ না তুলে বাবা নিজের পকেট থেকে একটা পাউন্ড ছেলেকে দেয়। বলেন -- মনে রাখবি এখান থেকে কোন পয়সা সরাতে গেলে আমি বুঝে ফেলব। গতবার তাই করেছিলে তুই। জন্মদিন টন্মদিন কিছু মানব না যদি এমন হলে কান টেনে লাল করে দেব।
-- ও নিয়ে ভেব না। ঝপ করে বলে ফেলে আর্নি।
-- বন্দুকে চোখ লাগিয়ে কেমন করে শিকার করতে হয় সেটা যদি প্রাকটিস করতে চাস তাহলে প্রথমে পাখি শিকার করবি। একটা গুলি কতগুলো পাখি মারতে পারে সেটা জানতেও পারবি।
-- ঠিক। অনেক পাখি আছে। ওদের ধরা এমন কোন কঠিন কাজ নয়।
-- ছোট চড়াই ধরা যদি কঠিন মনে না হয় তাহলে বড় রেণপাখি ধরতে চেষ্টা করবি । যদি রেন ধরতে পারিস তাহলে বুুঝব তুই মস্ত শিকারী। ওরা কখনো গাছে চুপ করে বসে থাকে না। খালি এক ডাল থেকে আর এক ডালে যায়।
আর্নির মা সিংকে থালাবাসন ধুতে ধুতে বলে -- সকালবেলা পাখি ধরতে পাঠাচ্ছো ছেলেকে, ওরা হয়তো নিজের বাসায় একটু আরাম করছে, সেখানে গিয়ে ঠাস ঠাস করে গুলি করবে আর্নি?
-- চোপা বন্ধ কর। বাবা গর্জন করে ওঠেন। তোমার মতামত কেউ নিতে আসেনি। বাবা বলেন -- শোন আর্নি তুই বন্দুক নিয়ে বড় রাস্তায় দেখাতে দেখাতে যাবি না। কারণ এর লাইসেন্স নেই তোর কাছে। লুকিয়ে নিয়ে যাবি। যখন গ্রামের দিকে যাবি তখন বন্দুক বের করবি।
-- ওসব নিয়ে ভাববে না। এই বলে আর্নি বন্দুক আর গুলিভর্তি বাক্স নিয়ে বীরের মত রওনা দেয় বাপকে দেখাতে সে বন্দুক দিয়ে কী করতে পারে। আজ ওর বয়স পনেরো বছর। বেশ একটা বদমায়েশ এবং চাষারে মার্কা এই ছেলে। সে আদবকায়দার ধার ধারে না। ট্রাক ড্রাইভার বাবার মতই ধুর্ত ওর চোখ দুটো কপালের মাঝখানে জ্বল জ্বল করে। ঠোঁট গুলো সবসময় ভেজা ভেজা। প্রায়ই হাঁ করে থাকে। এমন বাড়িতে সে বড় হয়েছে যেখানে মারপিট, লাথ্যি, থাপ্পর কোন ব্যাপার নয়। সে নিজেও একজন হিংস্র প্রকৃতির ছেলে। প্রতি শনিবার ওরই মত কিছু বদমায়েশ ছেলের সঙ্গে ফুটবল খেলা দেখতে যায় এবং সেখানে যদি তারা মারামারি না করতে পারে মনে করে আজকের যাওয়াই অর্থহীন। ওর সবচেয়ে মজার কাজ হলো স্কুল ছুটির পর কোন ছোটখাটো, নিরিহ ছেলেকে ধরে হাত মুচড়ে দিয়ে এক ধরণের আনন্দ পাওয়া। তারপর ওইসব ছেলেদের মা বাবা সম্বন্ধে কুৎসিত অপমানজনক কথা বলে তাদের একেবারে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে --
ঘাতে শেষ মোচড় দেবার পর ছেলেটাকে হয়তো ছেড়ে দেয়। কাঁদতে কাঁদতে সেই নিরিহ ছেলে পালাতে পথ পায় না।
আর্নির সবচেয়ে ভালো বন্ধু রেমন্ড। সে চার বাড়ি পরে থাকে। সেও বয়সের তুলনায় ওরই মত বড় একজন। আর্নি বেশ মোটা আর স্থুল আর রেমন্ড পেশল, পাতলা ও লম্বা।
রেমন্ডের বাড়ির সামনে এসে মুখের ভেতর দুই আঙুল ঢুকিয়ে বিশেষ হুইসিলে ও রেমন্ডকে ডাকে। রেমন্ড ছুটে আসে। আর্নি বলে -- দেখ এবারের জন্মদিনে কী পেয়েছি আমি।
-- চমৎকার। এটা দিয়ে আমরা অনেককিছু করতে পারব।
--তাহলে চলে আয়। এবার আমরা লেকের ওইপারে গিয়ে খরগোশ শিকার করি।
এই দুই মহাশয়তান এবার রওনা দেয়। মে মাসের শনিবারের এক সুন্দর সকাল। ওরা দুইজন যেখানে বাস করে তার চারপাশ অত্যন্ত অপূর্ব দৃশ্যে নয়নাভিরাম। চেস্টনাটের গাছ গুলো ফুলে ফুলে ফুলময়। আর বেড়ার পাশের হর্থন গুলো ফুলে ফুলে সাদা। ওরা প্রথমে একটা সরু রাস্তা ধরে আধমাইল মত যায়। এরপর রেললাইন পার হয়ে লেকের ওপারে গেলে অনেক হাঁস, জলজ পাখি, জলের মোরগ এবং অসংখ্য পাখির কলতান শুনতে পায়। আর কাছের একটা ছোট পাহাড় বা টিলার কাছেই থাকে খরগোশেরা। মিস্টার ডগলাস নামের একজনের ব্যক্তিগত সম্পত্তি এ জায়গা। তিনি এখানে পাখির নিরাপত্তার জন্য সংরক্ষিত জায়গা বানিয়েছেন। যাকে ইংরাজিতে বলে ‘বার্ড সাংচুয়ারি’। যেখানে জলজ পাখিরা মনের আনন্দে বাস করে, কেউ তাদের বিরক্ত করে না। ওরা সেই সরু রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে পাখি শিকার করতে থাকে। একবার আর্নি বন্দুক নেয় একবার রেমন্ড। আর্নি চড়াই পাখি আর ফিংচ শিকার করে। আর রেমন্ড হলুদ গলার দুটো ফুটফুটে পাখি ঠাস করে ধরে হাসতে থাকে। ওরা পাখিগুলোকে দড়িতে ঝুলিয়ে কাঁধে ফেলে চলছে। রেমন্ড সবসময় সঙ্গে নেয় ছোট এক বান্ডিল দড়ি বা মোটা সুতো। এ তার অভ্যাস। কাজেই পাখি ঝোলাতে আর অসুবিধা কী। রেমন্ড বলে -- জানিস আর্নি এখন এগুলো আমরা খেতে পারি।
-- বোকার মত কথা বলিসনাতো রেমন্ড? কতটুকু মাংস আছে এইসব পাখির যে এখনি আমরা খেতে পারি।
-- অনেকেই খায়।
-- আগে সবগুলো ধরি। তারপর খাওয়া।
রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে যতগুলো পাখি পেল সবগুলো শিকার করতে লাগলো তারা। পাখিদের জীবনে এমন অভিজ্ঞতা প্রথম। অনেকগুলো পাখি দড়িতে ঝুলছে। ওরা দেখে--
একটু ঝোপবনের পাশে, রেলসরকের ধারে একটা হালকাপাতলা শান্ত ছোটছেলে দাঁড়িয়ে আছে। হাতের বাইনাকুলারে সে গাছের ডালে বসে থাকা একটা সবুজ পাখি দেখছে।
রেমন্ড বলে তুই জানিস ও কে? ও হলো সেই পচা তুচ্ছ এক ছোকরা। ওর নাম পিটার ওয়াটসন।
-- ঠিক বলেছিস। এ সেই পিটার ওয়াটসন। পৃথিবীর আবর্জনা।
পিটার ওয়াটসন চিরদিন ওদের শত্র“। ওরা ওকে পছন্দ করে না কারন সবদিক দিয়ে শান্ত ছেলেটা ওদের বিপরিত। ছোট একটা শরীর। ফর্সা মুখটা একটু ছিট ছিট। চোখের চশমায় পাওয়ার। পড়াশুনায় অত্যন্ত মেধাবী এই ছেলে। সে সঙ্গীত ভালোবাসে। চমৎকার পিয়ানো বাজায়। সে তেমন বাইরের হৈ চৈ খেলাধুলা করে না। আপনমনে থাকে। ওর বাবা এদের বাবার মত ট্রাক চালায় না। ব্যাংকে কাজ করে।
-- চল পুচকে ছোড়াকে একটা দারুণ ভয় দেখানো যাক।
ওরা খুব ধীরে ওই ছেলেটার সামনে হাজির। ও দেখতে পায়নি প্রথমে কারণ ওর চোখে তখনো বাইনাকুলার।
-- হাত তোল। হ্যান্ডসআপ। বন্দুক তাক করে বলে দুজন।
পিটার ওয়াটসন ভয় পেয়ে লাফ দিয়ে ওঠে। সে বাইনাকুলার নামিয়ে এই দুইজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর চোখে আতংক কারণ ওদের ও খুব ভালো করে চেনে।
-- হাত তোল। যা বললাম কর। আর্নি বলে চিৎকার করে।
-- কেন তোমরা আমার দিকে বন্দুক তাক করছো? এটা কী ভালো কাজ? পিটার বলে।
-- যা আদেশ করছি কর। প্যাচাল পারিস না।
ও দুই হাতে বাইনাকুলার ধরে আছে। সে একবার আর্নির দিকে একবার রেমন্ডের দিকে তাকায়। বুঝতে পারে ওরা ওকে নিয়ে এখন যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। বছরের পর বছর ও ওদের জানে। অনেক যন্ত্রনাও সহ্য করেছে পিটার ওদের হাতে। বলে -- তোমরা কী চাও?
-- কী চাই? হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাক এটাই আমরা চাই। -- তোল হাত তোল। তুই কী ইংরাজি বুঝতে পারছিস না যে কথা শুনিস না? আমি পাঁচ পর্যন্ত গুনছি তারপর যদি তুই হাত না তুলিস তোর পেট ফুটো হবে গুলিতে। -- এক দুই তিন চার ------।
পিটার ধীরে ধীরে ওর হাত দুটো উপরে তোলে। রেমন্ড গিয়ে ওর হাত থেকে বাইনাকুলার কেড়ে নেয়। -- এটা কী? তুই কার উপরে এমন স্পাইং করছিস?
-- কারো উপরে না। পিটার বলে।
-- মিথ্যা বলিস তোর তো খুব সাহস। তুই আমাদের উপর স্পাইংস করছিস।
-- না। আমি তোমাদের উপর স্পাইং করছি না।
-- এই রেমন্ড ওর কানটা একটু টেনে দেতো যেন ও এমন মিথ্যা না বলে। ভালো করে শেখা কখনো যেন চালাকি না করে।
-- কানতো টানবই। তার আগে চিন্তা করছি ওকে নিয়ে আর কী করা যায়।
পিটার বুঝতে পারছে এখন যদি পালাতে চায় দুই মিনিটের ভেতর ওরা ওকে ধরে ফেলবে। চিৎকার? কেউ নাই আশেপাশে। কাজেই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া ও আর কী করতে পারে?
-- হাত কখনো নামাবি না। এই বলে বন্দুক এমন করে ঘোরায় যেমন করে সিনেমার বড় বড় দস্যূরা। বলে -- ছোকরা তুই বলবি না কার উপরে স্পাইং করছিলি?
-- আমি বাইনাকুলার দিয়ে একটা সবুজ কাঠঠোকরা দেখছিলাম। বলে পিটার যতটা সুন্দর করে বলা যায় ততটা সুন্দর করে।
-- কী দেখছিলি?
-- একটা সবুজ কাঠঠোকরা।
-- কোথায় সেই পাখি। আমি ওকে গুলি করব।
পিটার দেখতে পায় দড়িতে ঝোলানো নানা পাখি। বলে কেবল -- ও নেই। তোমাদের পায়ের শব্দে উড়ে চলে গেছে।
-- ওসব পাখি দেখার কী আছে? তোর কী আর ভালো কিছু করবার নাই? পাখি দেখা? অর্থহীন কারবার।
-- আমি অর্থহীন মনে করি না।
-- আর আমরা যা করি তোর তা মোটেই পছন্দ নয় তাই না? মনে করিস আমরা যা করি তা অর্থহীন। পিটার এমন কথার কোন উত্তর দেয় না। কিন্তু হাত তুলে থাকতে থাকতে ওর দুই হাত বেদনা করতে শুরু করেছে। তখন মনে হলো ওর হাত দুটো একটু নামাই না কেন। জানে এমন কাজে ঝুঁকি। তবু।
-- তোল। হাত তোল।
-- যদি না তুলি? যেন একটু সাহস সঞ্চয় করেছে সে এমন করে বলে।
-- না তুলি? বাপেরজন্মেও এমন কথা শুনি নি। আমরা বলব তারপর কেউ শুনবে না। তোর নার্ভ মনে হয় বেশ শক্ত। আমি তোকে সাবধান করে দিচ্ছি শেষবারের মত। যদি কথা না শুনিস বন্দুকের গুলি তোর মাথা চুরমার করে দেবে।
-- সেটা তো একটা আইনভাঙ্গার কাজ হবে। তারপর পুলিস আসবে। পিটার বলে।
-- আর তুই সোজা হাসপাতালে তারপর ----
-- বন্দুক ছুড়তে চাইলে ছোঁড় তারপর বস্টলের জেলখানায় যেতে হবে তোমাদের। দেখে আর্নি কী যেন ভাবছে। রেমন্ড ওকে বলে -- তোর কান্ড দেখে মনে হয় এটাই তুই চাস।
-- আমি তোমাদের অনুরোধ করছি আমাকে রেখে তোমরা যা করছিলে কর। আমি তো তোমাদের কোন ক্ষতি করিনি।
-- তুই একটা শয়তান। তোর কিছু করতে হয় না। তুই পাজি, তোর মত খারাপ ছেলে আর নেই।
এখন রেমন্ড আর্নির কানে কানে কি যেন বল্।ে আর্নি শোনে। তারপর বলে -- তোর এই আইডিয়া দারুণরে রেমন্ড।
এরপর আর্নি ওর বন্দুক মাটিতে রেখে পিটারের দিকে এগিয়ে যায়। ওকে এক ধাক্কায় মাটিতে ফেলে দেয়। রেমন্ড পকেট থেকে দড়ি বের করে, কাটে। এরপর ওই দড়ি দিয়ে জোর করে পিটারের হাত দুটো পিঠের পেছনে শক্ত করে বাঁধে।
-- এরপর পা দুটো বাঁধতে হবে। পিটার বাধা দেবার চেষ্টা করলেই পেটে এক বড় ঘুসি পড়ে। এতবড় ঘুসি খেয়ে তার আর নড়বার ক্ষমতা থাকে না। এরপর ওকে এমন করে বাঁধা হয়,যেন একটা মুরগীর বাচ্চার মত অসহায় সে। এরপর ওরা বন্দুক কুড়িয়ে নিয়ে পিটারকে ছেঁছড়াতে ছেঁছড়াতে রেল লাইনের দিকে নিয়ে চলে। পিটার কী বলবে? যা বলবে তাতেই বিপদ বেড়ে যাবে। এরপর ওরা ওকে সোজা রেললাইনের উপর নিয়ে ফেলে। দুই রেললাইনের মাঝখানে শুইয়ে দেয়। -- তোমরা কী পাগল। এসব তোমরা করতে পারো না।
- কে বলে আমরা এসব করতে পারি না। এত কথা বলার শাস্তি এটা। বেশি বাড়াবাড়ির ফল। এরপর আরো দড়ি নেয় রেমন্ড। এরপর ওকে রেললাইনের ভেতর এমন করে বাঁধে ও নড়তে পারে না। কেবল নাড়াতে পারে মাথা। রেমন্ড বলে -- বেশ ভালো কাজ করেছি আমরা। এই ছোঁড়া এবার নড়–ক দেখি। আধ ঘন্টা পর পর ট্রেন আসে। আমাদের খুব বেশি অপেক্ষা করবার দরকার নেই।
-- এটা তো খুন।
-- তা কেন।
-- আমাকে যেতে দাও। এখন যদি ট্রেন আসে আমি মারা যাব।
-- যদি মরিস সেটা তোর দোষ। মাথা নাড়াবি না। একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে থাকবি ট্রেন উপর দিয়ে চলে যাবে তোর কিছু হবে না। যদি ট্রেনের তলায় একটু ফাঁকা থাকে তাহলে তুই ব্াঁচবি। এই রেমন্ড কতটা ফাঁকা থাকে ট্রেনের তলায়?
-- খুব বেশি না। ওরা তো প্রায় মাটি ঘেসে চলে।
-- আমার আর তোর জন্য হয়তো জায়গাটা অনেক। ওর জন্য নয়। ফ্যাঁক ফ্যাঁক করে হেসে বলে রেমন্ড। বলে -- জানিস কেন নয়?
-- কেন নয়?
-- ওর যে দুটো বড় বড় গাধার মত কান আছে সেইজন্য ওর জায়গা বেশি দরকার। যেতে যেতে ট্রেনটা ওর মুখটা সমান করে দিয়ে চলে যাবে।
-- ঠিক তাই রেমন্ড। ওর মুখ পালিশ হবে।
এই বলে সেই দুই ভয়ানক ছেলে একটু দূরে গিয়ে একটা ঝোপের ভেতর গিয়ে বসে। পকেট থেকে সিগারেট বের করে টানতে থাকে। বসে থাকে কখন ট্রেন আসবে সেই অপেক্ষায়।
নিরিহ ভালো ছেলে পিটার ওয়াটসন রেল লাইনের মাঝখানে স্থির হয়ে পড়ে আছে। এরা ভয়ানক খারাপ ছেলে। সবসময় ভবিষ্যত না ভেবে কাজ করে। সে ভাবছে এখন সে কী করতে পারে। সে দেখে তার নাকটা একটু উঁচু। যদি সে মাথাটাকে আরো একটু নিচুতে নিয়ে যেতে পারে তাহলে খানিকটা ফাঁকা জায়গা বেরোতে পারে। সে জানে না এইসব ডিজেলে ট্রেনের নিচে কতটা জায়গা ফাঁকা থাকে। ওর মাথাটা পড়েছিল কাদার মত জায়গায়। ও মাথা এদিক থেকে ওদিক নাড়াতে থাকে। এই করতে করতে মাথার নিচে খানিকটা গর্ত হয়। যেন মাথার নিচে একটু গর্ত হয়ে মাথাটা একটু নিচে নেমে যায়। মনে হয় দুই ইঞ্চি জায়গা বের হলো। আগে ছিল চার ইঞ্চি মত খালি এবার তার সঙ্গে দুই ইঞ্চি যোগ হলো। আর পা গুলো কী করবে? পা দুটোকে যতদূর সম্ভব সমান কওে রাখে। ড্রাইভার কী ওকে দেখতে পাবে? মনে হয় না। ড্রাইভার এসব ট্রেনে বসে কেবল সিগনালের দিকে চোখ রাখে। এখানে ট্রেন ঘন্টায় আশি মাইল বেগে যায়। সে অনেকদিন একটু দূরে বসে ট্রেনের যাওয়া আসা দেখেছে। কখনো ট্রেনের সময় আর ইঞ্জিনের নাম সে খাতায় লিখে রেখেছে। ট্রেন যদি ওর শরীর স্পর্শ নাও করে ভয়ানক শব্দইতো ওকে শেষ করে দিতে পারে। আর আশি মাইল স্পিডে যাওয়া ট্রেনের বাতাস ওকে কী টেনে নেবে? তা মোটেই অসম্ভব নয়। কী হবে ভাবতে ভাবতে শরীরটাকে যতটা সম্ভব মাটির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলতে চায়।
-- ওই ইঁদুরমুখো শয়তান কী করছিস তুই? ওরা ঝোপের ভেতর থেকে খি খি করে হাসতে হাসতে বলে। -- এখন মারা যাবি তার জন্য অপেক্ষা কেমন লাগছে তোর? ও ভাবে এসবের উত্তর দেওয়া ঠিক নয়। সে দেখে মাথার উপরের নীল আকাশ। মেঘের ভেতর নানা ছবি।
একসময় মাটির ভেতর কাঁপতে থাকে। প্রথমে খুব আস্তে। তারপর শব্দটা মনে হয় রেললাইনের ভেতর দিয়ে কাছে আসছে। অনেক দূর থেকে খুব কাছে। এতো তাহলে ট্রেন পিটার মনে মনে ভাবে। শব্দটা বেশ জোরে শোনা যায়। একটু একটু করে জোরে। সে মাথাটা একটু তুলে দূরে তাকায়। দীর্ঘ লাইন চলে গেছে। তখন মনে হলো ছোট একটা বিন্দুর মত কিছু। ট্রেনটা আস্তে আস্তে একটু বড় হয়। তারপর? এটা আর বিন্দু নয় একটা ইঞ্জিনের সামনের দিক।ও মাথা নামায়। গর্তের ভেতরে মাথাটাকে ঢোকাতে চেষ্টা করে। পা দুটোকে একপাশে নিয়ে যায়। চোখ দুটো বন্ধ করে। শরীরটা যতদূর সম্ভব মাটির সঙ্গে লাগিয়ে রাখে।
ভয়ানক একটা বিস্ফোরণ! ট্রেন ওর উপর দিয়ে চলে যায়। মাথার ভেতরে মনে হলো কে যেনো গুলি করেছে। এরপর মস্ত বড় এক ‘হারিকেনের’ ঝড়ের মত বিপুল বাতাস ওর নাকে, কানে, ঢোকে, ওর প্রায় দমবন্ধ করে ফেলে। আর শব্দ? ওকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে। মনে হয় ও আর দম ফেলতে পারবে না। এক
তারপর সব শেষ। ট্রেনটা চলে গেছে। পিটার এবার চোখ খোলে। দেখতে পায় আকাশের নীল মেঘ। সব শেষ হয়েছে আর ও এই সাংঘাতিক অবস্থার ভেতরেও বেঁচে আছে।
-- ওই ছোকরা বেঁচে গেছে। ছোকরাকে ট্রেন কিছু করতে পারেনি। কানের কাছে ওদের গলা।
-- ইস কেমন করে বাঁচলি রে তুই? আরেকজন বলে।
সে পাশে তাকায় এবং দেখে সেই দুই মহাশয়তান মস্তান।
-- ওর দড়ি দড়া কাট। একজন বলে।
রেমন্ড দড়ি কাটে। বলে আর্নি -- ওঠ।
পিটার দাঁড়ায়। -- এখনো তুই আমাদের বন্দি মনে রাখবি এই কথা।
-- খরগোশ শিকার কখন হবে? রেমন্ড বলে।
-- খরগোশ? সেটার জন্য ম্যালা সময় আছে। -- এখন চল আমরা এই পুচকেটাকে লেকের ধারে নিয়ে যাই। ওখানে ডোবাই।
-- তোমরা তো আমাকে নিয়ে অনেক মজা করেছো। এবার আমাকে যেতে দাও না কেন। পিটার সাহস করে বলে।
-- তোকে এখনো ছাড়া যাবে না কারণ তুই আমাদের বন্দি। সাধারণ বন্দি নস তুই। তুই হলো স্পাই। জানিস না স্পাইদের ধরলে কী করে? দেয়ালের সামনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে। পিটার আর কিছু বলে না। যা বলবে তাতেই ওরা আরো রেগে যাবে। যত কম কথা বলবে ততই হয়তো ভয়ানক কোন ক্ষতি থেকে ও বেঁচে যাবে। ও বুঝতে পারে ওরা ওকে নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। ওর মনে পড়ে আর্নি একবার ওয়ালি সিম্পসন নামের এক ছোট ছেলের হাত মুচড়ে ভেঙ্গে ফেলেছিল। ওর বাবা মা পুলিসের কাছে গিয়েছিল। প্রমানের অভাবে আর্নি বেঁচে যায়। একবার রেমন্ড ফুটবল মাঠে একজনকে মেরে মাটিতে ফেলে অনেকগুলো লাথি দিয়ে রক্তাক্ত করে বীরদর্পে ফিরে এসেছিল। ওরা যা বলবে করবে। তারপর হয়তো একসময় ওকে ছেড়ে দিয়ে দুই মস্তান অন্যকাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। ওরা বললো -- হাঁট। একজনের হাতে বন্দুক। আর একজনের হাতে বাইনাকুলার।
মে মাসের অপূর্ব সকালে লেকের দৃশ্য সত্যিই সুন্দর। দুইপাশে ঝাঁকরা সবুজ উইলো গাছ। একটু অপ্রসস্থ লেক বয়ে চলেছে সুন্দর ভাবে। আর কাছেই নলখাগড়া আর উলুখাগড়ার সঘন সারি -- এবার আমরা করব কী এই রক্তচোষাকে হ্রদের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দেব। দুই হাতের দিকে ধর আর আমি পায়ের দিকে ধরি। -- কেমন হচ্ছে আমার পরিকল্পনা?
-- চমৎকার। রেমন্ড বলে।
-- তোর কেমন লাগছে এই ছোঁড়া?
-- এটাই যদি তোমরা করতে চাও আমি কী বলব। ওর গলার স্বর শান্ত। কোন প্রকার উত্তেজনা নেই সেখানে।
-- এটাই আমরা করতে চাই। বাধা দেওয়ার চেষ্টা কর। দেখ আমরা কী করি।
-- একটা প্রশ্ন করব? পিটার বলে -- আচ্ছা তোমরা কী কখনো তোমাদের মত বড়সড় একজনকে নিয়ে এমন মজা করবার চেষ্টা কর? না কেবল আমাদের মত পুচকেদের নিয়ে?
যখনই কথাটা বলে ফেলেছে পিটার বুঝতে পারে ও এবার একটা ভয়ানক ভুল করলো। আর্নির মুখ টকটেক লাল। চোখের ভেতর হিংস্র আগুন। ঠিক সেইসময় রেমন্ড কী যেন একটা দেখে বলে -- দেখ দেখ নলখাড়গার ওখানে কী ভেসে চলেছে। একটা হাঁস। বুনোহাঁস যাদের বলে। -- চল ওইটাকে শিকার করি।
চমৎকার একটা হাঁস। সোনালি ঝকঝকে পাখায় ভেসে চলেছে। গলার কাছে সবুজ পান্নার মত নকশা। -- এটাকে ধরলেই খাওয়া যাবে।
আর্নি বলে -- আমি ধরব এটাকে। এই বলে পিটারের হাত ছেড়ে দিয়ে বন্দুক তাক করে। -- এটা পাখি সংরক্ষনএর জায়গা। একটা বার্ডসাংচুয়ারি। পিটার বলে।
-- কী বললি তুই?
-- এখানে পাখি ধরা নিষেধ। এখানে কেউ পাখি শিকার করতে পারে না। পিটার বলে।
-- কোন শালা বলে এখানে পাখি শিকার মানা?
-- মিস্টার ডগলাস হাইটন। এটা তারই সাংচুয়ারি।
-- আর ঠাট্টা করিস না পিটার। বলতে না বলতেই গুলি লাগে সেই সবুজ গলার ঝকঝকে হাঁসের শরীরে। -- আর্নি এবার ওর দড়ি কেটে দেই আমরা। আমরা যা শিকার করব ও গিয়ে তা কুড়িয়ে আনবে। এই বলে হাতের দড়ি কেটে বলে -- এই ছোঁড়া যা কাদার ভেতর দিয়ে হেঁটে হাঁসটাকে এনে আমাদের দে। পিটার তখন সেই সুন্দর হাঁস শিকারে মনে মনে অত্যন্ত বেদনার্ত। সে ভেতরে ভেতরে কাঁপছে। বলে -- যদি না যাই।
আর্নি ঠাস করে ওর গালে চড় লাগায়। ও মাটিতে পড়ে যায় নি। কিন্তু নাক দিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করেছে। -- খুব ভালো করে মনে রাখবি যা করতে বলব তা যদি করতে না চাস তাহলে তোর দাঁত একটাও থাকবে না।
পিটার কথা বলে না। -- উত্তর দে। যা বলছি বুঝতে পারছিস কিনা।
-- বুঝতে পারছি। পিটার বলে।
-- যা। হাঁসটা নিয়ে আয়।
কাদার ভেতর দিয়ে ও হ্রদের দিকে যায়। নলখাগড়ার বনের ভেতর থেকে হাঁসটাকে তুলে আনে। রেমন্ড ঝপ করে ওর হাত থেকে হাঁস নিয়ে দড়ি বাঁধে হাঁসের পায়ে।
-- এবার আমাদের সঙ্গে আছে এই কুকুর। আমরা যা শিকার করব ও মুখে করে আনবে। চল দেখি আর যদি হাঁস পাওয়া যায়। ওরা খুঁজছে। নলখাগড়ার বনের ভেতরে আর কোন হাঁস বা জলজ প্রানী আছে কিনা। -- চুপ, সুস। আর্নি বলে। রেমন্ড আমি যা দেখছি তুই তা দেখছিস নাকি?
আর্নি বলে -- ওরে বাবা এতো দেখছি একেবারে সুন্দরী একজন।
পিটারের পা দুটো কাদায় মাখামাখি। ওর ট্রাউজার গোটানো। ও দেখতে পায় একটি সুন্দর ধবধবে সাদা রাজহাঁস নলখাগড়ার বনে নিজের বাসায় বসে আছে। হয়তো ওর পেটের তলায় বাচ্চা। একটা অপরূপ রাজকীয় রাজহাঁস। যেন এই লেকের রাণী বসে আছে লেক আলো করে। মহানমহিমান্বিত রূপে -- ওরে বাবা এযে এক অপরূপ রাজহাঁস। রেমন্ড বলে। রাজহাঁস ঘাড়টা ঘুরিয়ে ওদের দেখছে। একটা ভয় মনে -- এরা কারা।
আর্নি বলে -- এটা দেখি যেটা ধরেছি তার চেয়েও বড়। ওকে শিকার করতে হবে।
--ওকে শিকার করতে পারবি তোর এই বন্দুক দিয়ে?
-- খুব পারব। গলায় গুলি মারব, ধপ করে পড়ে যাবে।
পিটারের মনের ভেতরে ভয়ানক একটা রাগ এবার কুন্ডলিপাকিয়ে বড় হতে শুরু করেছে। হ্রদয়টা তার পাখপাখালির জন্য দয়ামায়ায় পূর্ন। -- আমি বলছি ওই রাজহাঁসটাকে তোমরা কখনোই গুলি করে মারবে না। যদিও সে কথাটা শান্ত ভাবে বলছে কিন্তু ওর ভেতরে রাগ টগবগ করে ফুটছে। বলে আবার -- রাজহাঁস এদেশের সবচেয়ে বড় সংরক্ষিত পাখি। এদের মারা আইনত অন্যায়।
-- তাতে তোর কী? আর্নি বলে জোক করে।
-- আর একটা কথাও আমার বলার আছে। যে পাখি তার বাসায় বসে থাকে তাদের কখনোই মারতে নেই। ওর শরীরের নিচে হয়তো শাবক রয়ে গেছে। পিটার ভুলে গেছে ওর বর্তমান অবস্থা। নিজেকে সামলাতে পারেনি।
-- এটা তোর বানানো আইন নাকি রে ছোঁড়া -- মিস্টার পিটার ওয়াটসনের আইন। বাসায় বসে থাকলে পাখি মারা যাবে না।
-- আমার আইন নয়। পুরো দেশেই এমন নিয়ম।
তারপর কাতর হয়ে বলে -- প্লি¬জ আর্নি ওকে মেরো না। তার কাতর আর্তনাদ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। বলতে না বলতেই বন্দুকের গুলি রাজহাঁসের গলায় লাগে। সে মুখ থুবড়ে তার বাসার কাছে পড়ে যায়। -- যা নিয়ে আয়। আর্নি বলে।
-- চমৎকার তাক তোমার। রেমন্ড জানায়।
পিটারের সমস্ত শরীর অনড়। তার সমস্ত মুখ সাদা। সে যেন নড়াচড়া করবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। আর্নি কাছে এসে ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলে -- আমি শেষবারের মত বলছি যা রাজহাঁসটাকে নিয়ে আয়।
তখন পিটারের চোখ দিয়ে দর দর করে পানি পড়তে শুরু করেছে। আস্তে আস্তে কাঁদতে কাঁদতে ও পানি-কাদার ভেতর দিয়ে রওনা দেয়। দুইহাতে বুকের কাছে হাঁস ধরে, বড় নরমভাবে, তারপর বিষন্ন মনে ফিরে আসতে থাকে।
-- বাসায় কী কোন ডিম ছিল? আর্নি প্রশ্ন করে। ওযে বাসায় কয়েকটা নতুন ডিমফোটা বাচ্চা দেখেছে সে সন্বন্ধে কিছু বলে না। মনে মনে ভরসা পুরুষ রাজহাঁসটা ফিরে এসে যদি ওদের তা দিয়ে বড় করে। বলে কেবল -- না। কোন ডিম ছিল না।
পিটার আস্তে করে সেই হাঁস ওই দুই মস্তানের সামনে নামিয়ে রাখে। তখনো তার চোখের জলে গাল ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু সেখানে কষ্টের আগুন। সব ভুলে বলে -- এটা একটা গাধারমত অর্থহীন কাজ। তোমরা আসলে দুজন মুর্খ বোকা ছেলে। যদি এই রাজহাঁসের পরিবর্তে তোমরা নিজেরা মারা যেতে সেটাই ঠিক হতো।
পিটার নিজেও জানে না ও কী বলছে।
আর্নি এবার ওকে মারে না। সে একটু অবাক হয়ে গেছে এমন কথায়। এরপর ওর দুই কুতকুতে চোখে আর এক ভয়ানক কিছু। -- ও তুই তাহলে রাজহাঁস খুব পছন্দ করিস তাইতো?
-- রাজহাঁস খুবই পছন্দ করি। আর তোমাদের ঘৃণা করি।
-- তুই তাহলে চাস এই রাজহাঁসটা বেঁচে থাক ওর মরা ঠিক হয়নি এইতো?
-- এটা একটা বোকার মত প্রশ্ন। ও মারা গেছে এরপর ও কী করে বাঁচবে?
-- ওর কান ফাটিয়ে একটা চড় দেওয়া দরকার। বলে রেমন্ড।
শোন রেমন্ড আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। বলে পিটারের দিকে তাকিয়ে -- তুই চাস এই রাজহাঁস আবার প্রাণ ফিরে পেয়ে আকাশে দুই পাখা মেলে দিয়ে উড়–ক।
-- আবার একটা বোকার মত প্রশ্ন করেছো তোমরা। তোমরা নিজেদের কী মনে কর?
-- তোকে বলব আমরা কে এবং কী করতে পারি। আমি যাদুর মানুষ। আমি যাদু দিয়ে এমন করব এই হাঁস আবার আকাশে দুই পাখা মেলে দিয়ে উড়তে থাকবে।
-- যতসব রাবিশ। আমি যাব এবার।
-- যাবি। রেমেন্ড ওকে ধর ও যেন যেতে না পারে। রেমন্ড ওকে ধরে।
-- ছেড়ে দাও আমাকে। পিটার বলে। রেমন্ড একটা চড় দিয়ে বলে -- না আর আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবার চেষ্টা করবি না।
-- এই রেমন্ড তোর চাকুটা দেতো। চাকু নিয়ে আর্নি বসে রাজহাঁসের পাশে। তার দুই বিশাল পাখা দুই পাশে ছড়িয়ে দেয়। সে জানে কেমন করে রাজহাঁসের পাখা দুটোকে শরীর থেকে খুলে নেওয়া যায়।
-- তুমি কী করতে চাও। রেমন্ড তখনো জানে না আর্নির মনে কী আছে।
-- একটু অপেক্ষা কর জানতে পারবে। আর্নি জানায়। চাকুটা ধারালো। সে খুব ভালো করে পাখা দুটোকে অক্ষত অবস্থায় খুলে আনতে পারে। বলে এবার -- তোমার দড়ি দাও আমাকে।
রেমন্ড পিটারের হাতটা শক্ত করে ধরেছিল বলে -- এমন করে ডানা খুলে নেওয়া তুমি কোথায় শিখেছো আর্নি?
-- দে তোর দড়ি দেখ এবার কী করি।
রেমন্ড তাতে চিকনদড়ির বান্ডিল দিল। ও সেখান থেকে ছয়টা দড়ির অংশ ছোট করে কাটলো। ডানার উপরে সেই দড়ি সমানভাবে গেড়ো দিয়ে দিল। এরপর পিটারের কাছে গিয়ে বলে হাত লম্বা কর।
-- তোমরা সত্যিই ঘোর উন্মাদ। পিটার বলে।
-- যা বলছি তাই কর। এই রেমন্ড দেখতো ও যেন হাত বের করে। রেমন্ড নাকের কাছে ঘুসি দেখিয়ে বলে -- যেমন বলা হয়েছে তেমন কর। হাত বের কর ভালোছেলের মত।
পিটার কী করবে, কী করে এমন কাজে বাধা দেবে জানে না। সে আর্নির দিকে তাকায়। আর্নি তার ভয়ানক গনগনে চোখে এমন করে তাকায় মানে হলো যদি ও না করে আর্নি ওকে নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। পিটার বুঝতে পারে আর্নি যদি আরো রেগে যায় একজনকে খুন করতে ওর বেশি দেরী লাগে না। পিটার তার একটা হাত লম্বা করে বের করে।
আর্নি তখন সেই ঝোলানো দড়ি ওর বাজুতে একটার পর একটা লাগিয়ে শক্ত করে গেরো দিয়ে দেয়। যখন সবগুলো গেরো লাগানো হয় সেই ডানা পাখাখুলে পিটারের বাজুতে লেগে ওর পুরো হাত ঢেকে একধরণের পাখা তৈরী করে।
-- কেমন কাজ করলাম দেখ রেমন্ড এই রক্তচোষা ছোঁড়ার ডানা বানিয়ে দিলাম।
-- তাতো ঠিক কিন্তু একটা ডানা নিয়ে ও কী করে আকাশে উড়বে রে আর্নি?
-- আর একটা ডানাও হবে তুই একটু অপেক্ষা কর। বলে -- নে এবার তোর আর এক হাত লম্বা কর। পিটারের মনে হয় এমন ঘটনায় বমি হবে। আর্নি সেই পাখা ওর আর এক হাতে একই ভাবে লাগিয়ে দেয়।
-- এখন দুই ডানাওয়ালা এক রাজহাঁস ও হয়েছে কিনা দেখ। একেবারে জীবন্ত আর এক রাজহাঁস। বলেছি না আমি যাদু জানি। বলেছি না এমন যাদু করব এই মরা হাঁস প্রাণ পেয়ে আবার আকাশে উড়বে। আমার কথা ঠিক কিনা বল।
দুই হাতে পাখা নিয়ে মে মাসের চমৎকার সকালে লেকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে পিটার -- হতবুদ্ধি। ওদের খেলা কখন শেষ হবে জানে না। বলে -- তোমাদের খেলা শেষ হয়েছে?
-- এই ছোঁড়া কথা বলিস না, জানিস না রাজহাঁস কথা বলে না। এখন তোর শরীরের শক্তি কথা বলে শেষ করিস না। কারণ খানিকপর এই দুই ডানা নিয়ে তোকে আকাশে উড়তে হবে। আর্নি বন্দুক পিটারের গলায় ঠেকিয়ে বলে -- মার্চ কর। জোরে হাঁট।
ও হাঁটছে। ওরা পিছে পিছে আসছে। আসতে আসতে লেকের পাশের একটা বড় উইলো গাছের কাছে আসে। সেখানে ওরা থামে। সেই গাছের বড় বড় ডাল লেকের উপর ঝুঁকে পড়েছে। অনেক উঁচু সেই গাছ।
-- এইবার এই যাদুর হাঁস আমাদের যাদু দেখিয়ে আকাশে উড়বে। কাজেই তোকে এখন কী করতে হবে জানিস এই গাছের মগডালে তোকে উঠতে হবে। তারপর সেখান থেকে দুটো ডানা বের করে আকাশে উড়বি।
-- ফানটাসটিক আইডিয়া। রেমন্ড বলে।
-- দেখা যাক এই চালাক ছেলে এবার কী করে। এই রাজহাঁস এবার কতটা উড়তে পারে। ক্লাশে তোর বুদ্ধির কাছে আমরা হেরে যাই। এবার দেখা তোর বিশেষ বুদ্ধি এবং আকাশে উড়তে থাক। এই বলে জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে বলে -- নে ওঠ। গাছের মাথায় ওঠ আগে। তারপর উড়বি।
এদের এইসব উন্মাদ কারবার কতদূর যাবে পিটার বুঝতে পারছে না। ওর নিজেরও এখন আর প্রতিরোধ করবার কোন ইচ্ছা নাই। মনে হলো গাছের মাথায় উঠলে এদের হাত থেকে দূরে চলে যাবে। যদি দরকার হয় সে ওখানেই থাকবে যতক্ষণ থাকা যায়। মনে হলো যদি খুব একটা চিকনডালে ওঠে ওর হালকাপাতলা শরীর নিয়ে তাহলে এই দুইজন সেখানে উঠতে পারবে না ওদের মোটাসোটা শরীর নিয়ে। সে গাছে উঠতে তেমন পারে না। কিন্তু এখন সে ভাবছে যেমন করে হোক গাছের সবচেয়ে উঁচু আর চিকন ডালে সে উঠবে। আর যদি ওঠে পাতায় ঢেকে যাবে ওর শরীর। ওরা ওকে দেখতে পাবে না।
-- আরো উঁচুতে। থামিস না। নিচে থেকে চিৎকার করছে ওরা। পিটার উঠতেই থাকে। থামে না। এরপর সে এমন একটা ডালে ওঠে যেটা মানুষের হাতের মত চিকন। সেই ডালটা গাছের সবচেয়ে উঁচু ডাল। যার শেষভাগ ঝুঁকে আছে লেকের উপর। অন্য ডালগুলো খুব বেশি শক্ত নয়। তবে ও যার উপরে দাঁড়িয়ে আছে তা মোটামুটি শক্ত। মনে হলো সে বোধহয় কমসে কম পঞ্চাশ ফুট উপরে উঠেছে। নিচে তাকিয়ে প্রথমে ওদের দেখতে পায় না পিটার। মনে মনে ভাবে ওরা কী চলে গেছে?
-- এইযে রাজহাঁস সাহেব এবার আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছেন? আর্নির গলার স্বর কানে আসে। ওরা একটু দূরে সরে গিয়ে সেখান থেকে এই পিটারকে ভালো করে দেখছে। ও সেখানে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকায়। বুঝতে পারে এই গাছের পাতারা এমন বড় বড় নয় ওকে একেবারে ঢেকে দেবে। নিচের গলা বলে -- নে এবার এই ডালের মাঝখানে যা। তারপর দুই পাখা মেলে উড়তে থাক। পিটার নড়ে না। সে ওদের থেকে পঞ্চাশ ফুট উপরে। আর যাইহোক ওরা তো ওকে ধরতে পারবে না। ওরা দুইজন যতদূরেই থাক ওকে ঠিক দেখতে পাচ্ছে।
-- শোন রাজহাঁস এবার তোকে উড়তেই হবে। আমি দশ পর্যন্ত গুনব তারপর তুই উড়বি। না উড়লে খবর আছে। যদি না উড়িস এই বন্দুকের গুলি আবার তোকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে আনবে। তাহলে কী হবে জানিস একজনের জায়গায় দুইজন মরা রাজহাঁস আমাদের সামনে মরে পড়ে থাকবে। পিটার নিশ্চুপ, নিশ্চল। কথা নেই, নড়াচড়া নেই।
এক দুই তিন চার পাঁচ ছয় সাত আট নয় দশ তারপর বন্দুকটা সোজা ওকে তাক করে। ও শোনে গুলি বের হবার শব্দ। একটা গুলি ওর কানের পাশ দিয়ে চলে যায়। আতংকে পিটার আরো নিশ্চল।
-- এরপর যেটা ছুঁড়বো তোকে শেষ করবে। এই তোকে আমরা শেষ বারের মত বললাম।
পিটার চুপ করে অপেক্ষা করছে। মাঠের সবুজগাছের সাদা ফুলের উপর যারা দাঁড়িয়ে আছে তাদের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দ সে। ওরা তাক করছে। এরপর একটা গুলি এসে ওর পায়ে লাগে। মনে হলো কে যেন একটা হাতুড়ি দিয়ে ওর পায়ে আঘাত করেছে প্রচন্ডভাবে। সে প্রায় পড়ে যাবে, কোনমতে উপরের ডাল ধরে পড়ে যাওয়া ঠেকাতে চায়। কেউ কেউ আছে অত্যাচারের শেষ সীমায় পৌঁছে আর পারে না। অত্যাচারীর হাতে নিজেকে তুলে দেয় সমস্ত প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে। কেউ কেউ আছে তবে এদের সংখ্যা খুব বেশি নয় যারা কোনমতেই হার মানে না। অত্যাচারীর হাতে না মরা পর্যন্ত নিজেকে তুলে দেয় না। পিটার নামের সেই হালকাপলকা ছেলেটা এমনই একজন। মনের কাছে প্রতিজ্ঞা করে ওকে জয়ী হতেই হবে। তখন সে লেকের দিকে তাকায়, তাকায় একটু উপরে, দেখে এক আশ্চর্য আলো। এমন আলো, সে আলোতে এমন সৌন্দর্য ও চোখ ফেরাতে পারে না। সে আলো তাকে ডাকছে, আলোর কাছে যেতে বলছে, সে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই আলোর কাছে যাবে বলে।
সেদিন গ্রামের তিনজন লোক বলেছিল একই কথা। একটা বড় সাদা রাজহাঁস সারা গ্রামের মাথার উপর দিয়ে পাখা মেলে উড়ছে। সে দৃশ্য দেখেছিল স্কুল-শিক্ষক এমিলি মিড, একজন লোক বাড়ির ছাদ ঠিক করছিল সেও দেখেছিল এমন দৃশ্য আর একটা ছেলে জন মাঠে খেলনা এরোপে¬ন ওড়াচ্ছিল সেও এমন দৃশ্যে থমকে থেমে তাকিয়ে ছিল সেই আলোভরা সাদা বিশাল রাজহাঁসের দিকে।
পিটারের মা মিসেস ওয়াটসন রান্নাঘরের সিংকে থালাবাসন ধুতে ধুতে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখেন একটা রাজহাঁস উড়তে উড়তে তার বাড়ির পেছনের বাগানে এসে পড়েছে। ছুটে বাইরে গিয়েছিলেন মিসেস ওয়াটসন ঘটনা বুঝতে। দেখেছিলেন তার একমাত্র ছেলের শরীরটা কুঁকড়ে পড়ে আছে সেখানে। -- আমার সোনা আমার মানিক কি হয়েছে তোমার? কেমন করে এখানে এলে তুমি?
মাকে দেখতে পেয়ে চোখ খুলে কেবল বলেছিল পিটার -- মা আমার পায়ে অসহ্য যন্ত্রনা। তারপর সে জ্ঞান হারায়।
-- ও রে আমার ছেলের পা থেকে রক্ত পড়ছে। ওরে বাবা কেমন করে এমন হলো তোর? দুই হাতে ছেলেকে বুকে করে বাড়িতে এনেছিলেন মিসেস ওয়াটসন। তারপর তাড়াতাড়ি ডাক্তার আর এ্যাম্বুলেন্সকে ফোন করেছিলেন। ডাক্তার আর এ্যাম্বুলেন্স আসবার আগেই তাড়াতাড়ি একটা কেঁচি দিয়ে বিস্ময়ে ছেলের ডানা থেকে সেই দুই পাখা খুলে নিয়েছিলেন মা।
2 মন্তব্যসমূহ
কি বলা যেতে পারে। এমন গল্প পড়েছি বোলে মনে পড়ে না। অনুবাদ গল্পও যে কাউকে মিউটেট কোরতে পারে, এইমাত্র জানলাম। অজশ্র ধন্যবাদ সালেহাদি।
উত্তরমুছুনঅসাধারণ গল্প
উত্তরমুছুন