অনুবাদক : এমদাদ রহমান
লেখকের লেখার কাজগুলি হল তার অলসতার ফল, আপনি সেটা সহজেই বুঝতে পারবেন। লেখকের মনের ভিতরে ভাবনার যে ভাঙাগড়া, কোনকিছু নিয়ে বিশেষ চিন্তা, দিবাস্বপ্ন, এমনই এক স্বপ্ন যা কাউকে গভীর ঘুমে তলিয়ে দেয় না বরং কল্পনা করতে বাধ্য করবে- একজন লেখকের কাজ আসলে তা-ই... এভাবেই প্রকৃত লেখাটি তার হাত দিয়ে প্রকাশিত হয়, আর এটাই তার মূল কাজ। একজন লেখককে সব সময় বিচার করা উচিত তাঁর শ্রেষ্ঠতম পৃষ্ঠাগুলি দিয়ে। বাবা আমাকে এই পরামর্শটা দিয়েছিলেন।
তিনি আমাকে প্রচুর পরিমাণে লিখতে বলতেন, প্রচুর পরিমাণে বাতিল করতে বলতেন, আর বলতেন প্রকাশের জন্য উন্মুখ না হতে, আর এই কারণে আমি প্রথম যে বইটি প্রকাশ করেছিলাম, fervor de Buenos Aires নামে, আসলে এই বইটি ছিল আমার তৃতীয় বই। বাবা আমাকে বলেছিলেন যে আমি যখন একটি বই লিখে ফেলব, তখন আমি যেন সমস্ত বইটিকেই প্রকাশের অযোগ্য মনে না করি...
পত্রিকা আমি কখনোই পড়িনি, তার একমাত্র কারণ আজকাল কী ঘটছে তার চেয়ে বরং বহুদিন আগে কী ঘটেছিল- আমার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা ছিল সেইসব ঘটনাবলীর প্রতি। এক ধরনের মানসিক বিকার। মনে আছে- প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হয়, আমি ছিলাম জেনেভায়। সেখানে আমি পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাসের উপর লেখা বইপত্র পড়ছিলাম। সেই সময় প্রায়ই ভাবতাম, একেবারেই সাদামাটা ছিল ভাবনাটা, আর, হ্যাঁ, বয়সও তখন চৌদ্দ কি পনেরো- আমি ভাবতাম- আরে কী অদ্ভুত ব্যাপার, সবাই যেন হঠাৎ করেই ইতিহাস নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে, ভাল কথা, কিন্তু, কী অদ্ভুত, সাম্প্রতিক ডামাডোলের ভিতর কেউই আগ্রহী নয় কার্থেজের যুদ্ধের ব্যাপারে, কিংবা কেউ আগ্রহী নয় পারসিক ও গ্রিকদের মধ্যকার যুদ্ধে কী ঘটেছিল সে ব্যাপারে জানতে, কিন্তু, সবাই আগ্রহী হয়ে পড়েছেন- সাম্প্রতিক ইতিহাস নিয়ে।

প্যারাবল | বোর্হেস ও আমি
সেই অন্য জন, যার নাম বোর্হেস, সেই অন্য জনের জীবনেই সবকিছু ঘটে। বুয়েনেস আইরেসের রাস্তা ধরে আমি চলতে থাকি, চলতে চলতে হঠাৎ থমকে দাঁড়াই, তাকিয়ে দেখি এক দালানের খিলান এবং প্রবেশ-দরোজার জাফরির কারুকাজ; বোর্হেস সম্পর্কে আমি জানতে পারি তার ঠিকানায় আসা চিঠিপত্রে, অধ্যাপকদের নামে করা একটি তালিকা থেকে কিংবা জীবন-কথা'র অভিধানে তার নাম দেখে। আমি ভালোবাসি বালিঘড়ি, ভূচিত্রাবলী আর আঠারো শতকের ছাপাখানার মুদ্রাক্ষর, কফির স্বাদ আর স্টিভেনশনের গদ্য; সে এইসব বিষয়ের গভীর অনুরাগী, কিন্তু যথাযথ শ্রদ্ধা ব্যতিরেখে এই বিষয়গুলিকে অভিনেতার স্বাভাবিক গুণ হিসেবে সে তৈরি করে নেয়। এটা অতিরঞ্জন হবে যদি বলি যে আমাদের মধ্যকার সম্পর্কটা বিদ্বেষপূর্ণ, তবু- আমি বেঁচে আছি, আমি জীবনটাকে যাপনের পথে চালিত করেছি; করেছি- বোর্হেস যাতে সাহিত্য রচনার কৌশলটি খুঁজে বের করতে পারে, এবং সেই সাহিত্যই আমাকে সার্থক করে তুলবে, আমার ন্যায্যতা দেবে। এই কথাটি স্বীকার করতে গিয়ে খুব বাড়িয়ে বলতে হয় না- কয়েক পৃষ্ঠা মূল্যবান লেখা সে লিখেছে, কিন্তু সেই কয়েকটি মাত্র পৃষ্ঠা আমাকে স্মরণীয় করতে পারবে না, সম্ভবত যা শ্রেষ্ঠ তা কেবল একজনের জন্য নয়, এমনকি সেও নয়, ভাষা এবং ঐতিহ্যই তার প্রকৃত উত্তরাধিকারী। এটাও বলে রাখি- ধ্বংস হওয়াই আমার নিয়তি, সুনিশ্চিতরূপে, শুধু আমার নিজের কয়েকটি মুহূর্ত তার মধ্যে বেঁচে থাকবে। একটু একটু করে আমার সমস্ত কিছুই তার হাতে সঁপে দিচ্ছি যদিও আমি তার সেই বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানি যে সে যুক্তির বিপরীতে গিয়ে সবকিছুকেই অতিশয়োক্তির জাল দিয়ে ঘিরে ফেলে, বিভ্রম তৈরি করে, কৃত্তিম করে ফেলে। স্পিনোজা জানতেন সমস্ত কিছুই তার আপন সত্তাটিকে রক্ষায় উন্মুখ; পাথর চিরদিন পাথরই হতে চায়, বাঘ হতে চায় বাঘ। বোর্হেসের মধ্যেই আমি বেঁচে থাকব, আমার মধ্যে নয় (যদি এটা সত্য হয় হয়ে থাকে যে আমি কেউ একজন), কিন্তু তার বইগুলোতে আমি নিজেকে খুব অল্পই খুঁজে পাই যেমনটা খুঁজে পাই অন্যদের রচনায়, গিটারের অস্বতঃস্ফূর্ত বাজানোয়। বহু বছর আগে তার কাছ থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছিলাম আর শহরগুলির প্রান্তদেশের পুরাণকথা লিপিবদ্ধ করা ছেড়ে শুরু করেছিলাম সময়কাল ও অনাদিপরম্পরা নিয়ে খেলা, কিন্তু সেই খেলার অধিকারী এখন বোর্হেস; সুতরাং আমাকে এখন অন্যকিছুর কল্পনায় ডুবতে হবে। এইভাবেই- আমার জীবন এখন এক পলায়ন এবং আমি আমার সবকিছুকেই হারিয়ে ফেলি, আর সেই সবকিছুর অধিকারী এখন বিস্মরণ, কিংবা সবকিছুই তার।
আমাদের দুজনের মধ্যে আসলে কে এই পৃষ্ঠাটির লেখক আমি জানি না।
[বোর্হেসমন্ত্র/প্যারাবল/বোর্হেস ও আমি/অনুবাদ/এমদাদ রহমান/ঋণ : অশ্রুকুমার সিকদার/নোট/হ্যাম্পশায়ার জার্নাল/এপ্রিল, ২০১৬।]
0 মন্তব্যসমূহ