১
কুচকুচে কালো চেহারায় একটা
ফোকলা দাঁত নিয়ে সারাদিন সে হাসে। ঘুরেফিরে যে ময়লা শার্টটা
বারবার পড়ে তার তিন নম্বর বোতামটা নেই। মুখে কয়েকটা মশার কামড় ছাড়া চেহারায় আর কোন
খুঁত নেই। বয়েস
পয়ত্রিশ কিন্তু দেখতে লাগে পঞ্চাশ! এটাকে অবশ্য কেউ খুঁত হিসেবে ধরেনা। নেতার বয়েস
একটু বেশী দেখালেই ভাল। সাইকেল নিয়ে গ্রামে ঘুরতে গেলেই দুয়েক বাড়ি থেকে মুড়ি খাবার
ডাক আসে। সেসব বাড়িতে ঢোকার আগে প্রতিবারই সে বুক পকেট থেকে ভাঙা
চিরুনীটা বের করে চুল আঁচড়ায়।
আজকাল এসবের ব্যতিক্রম হচ্ছে। দ্বিজেন আর হাসছেনা। গত কয়েকদিন ধরেই চিনিকল বাহিনী পুরো গ্রামটাকে ঘিরে রেখেছে। কোত্থেকে যেন একদল লোক এসেছে যাদের সবাই বাঙালী, ওরা দা কুড়াল নিয়ে হেঁটে হেঁটে রাস্তার ধারের গাছপালা, আখক্ষেত, যা পাচ্ছে কেটে কেটে শেষ করছে। আর সাঁওতালদের ধরে ধরে হুমকি দিয়ে বলছে, উঠে যেতে। নইলে ঘরে আগুন লাগিয়ে দেবে। শাবল দিয়ে খুঁড়ে খুঁড়ে রাস্তা গর্ত করে তাবু খাঁটিয়ে ওরা এলাকা পাহারা দিচ্ছে। প্রায় চার সপ্তাহ ধরে এ অবস্থা চলছে। বাড়ির বউরা প্রয়োজনে যাও একটু এপাড়া ওপাড়া করত সেটিও সম্পূর্ণ বন্ধ এখন। দলবল নিয়ে মোটরসাইকেল দিয়ে ঘিরে উত্তরপাড়া থেকে ঢাকা যাবার পথটাও বন্ধ করে দিয়েছে। রাস্তার ধারে ঘাসের উপর দা, কুড়াল, আরো সব ধারালো অস্ত্র পড়ে আছে। অবস্থা সুবিধের নয় ভেবে অনেক সাঁওতাল পরিবারই রাতের অন্ধকারে আখ ক্ষেত ধরে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। যারা যেতে পারছেনা বলে আফসোস করছিল, উপায় না থাকাতে চুলে জবাফুল গুঁজে পূজোয় বসে আছে ওরা। ঘরে খাবার নেই। এ অবস্থায় কতদিন থাকা যায়?
দ্বিজেন হেমব্রম তীর-ধনুক হাতে নিয়ে সারাদিন পাড়ার এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত হেঁটে পাহাড়া দিচ্ছিল যেন হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে খুঁজে পাওয়া যায়। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে সে সাঁওতালদের বলছে, কতকাল ধরে বাপ-দাদারা এই জমি ধরে আছে। অস্ত্র নেই, তাতে কি? তীর ধনুকতো আছে। এসব ছেড়ে কেনইবা যাবে ওরা?
আজকাল এসবের ব্যতিক্রম হচ্ছে। দ্বিজেন আর হাসছেনা। গত কয়েকদিন ধরেই চিনিকল বাহিনী পুরো গ্রামটাকে ঘিরে রেখেছে। কোত্থেকে যেন একদল লোক এসেছে যাদের সবাই বাঙালী, ওরা দা কুড়াল নিয়ে হেঁটে হেঁটে রাস্তার ধারের গাছপালা, আখক্ষেত, যা পাচ্ছে কেটে কেটে শেষ করছে। আর সাঁওতালদের ধরে ধরে হুমকি দিয়ে বলছে, উঠে যেতে। নইলে ঘরে আগুন লাগিয়ে দেবে। শাবল দিয়ে খুঁড়ে খুঁড়ে রাস্তা গর্ত করে তাবু খাঁটিয়ে ওরা এলাকা পাহারা দিচ্ছে। প্রায় চার সপ্তাহ ধরে এ অবস্থা চলছে। বাড়ির বউরা প্রয়োজনে যাও একটু এপাড়া ওপাড়া করত সেটিও সম্পূর্ণ বন্ধ এখন। দলবল নিয়ে মোটরসাইকেল দিয়ে ঘিরে উত্তরপাড়া থেকে ঢাকা যাবার পথটাও বন্ধ করে দিয়েছে। রাস্তার ধারে ঘাসের উপর দা, কুড়াল, আরো সব ধারালো অস্ত্র পড়ে আছে। অবস্থা সুবিধের নয় ভেবে অনেক সাঁওতাল পরিবারই রাতের অন্ধকারে আখ ক্ষেত ধরে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। যারা যেতে পারছেনা বলে আফসোস করছিল, উপায় না থাকাতে চুলে জবাফুল গুঁজে পূজোয় বসে আছে ওরা। ঘরে খাবার নেই। এ অবস্থায় কতদিন থাকা যায়?
দ্বিজেন হেমব্রম তীর-ধনুক হাতে নিয়ে সারাদিন পাড়ার এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত হেঁটে পাহাড়া দিচ্ছিল যেন হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে খুঁজে পাওয়া যায়। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে সে সাঁওতালদের বলছে, কতকাল ধরে বাপ-দাদারা এই জমি ধরে আছে। অস্ত্র নেই, তাতে কি? তীর ধনুকতো আছে। এসব ছেড়ে কেনইবা যাবে ওরা?
সারাদিন হাঁটাহাঁটির পর গেউস
আলীর বাড়ির কাছে যে কাচারীঘর তার পাশেই গামছাটা পেতে শুয়ে পড়েছিল
ক্লান্ত দ্বিজেন। দুপুর তখন বিকেল হবার জন্য
টলছে। ছায়াগুলো নুয়ে পড়েছে। শুয়ে শুয়ে ভাবছিল সে কি করে এ লড়াইয়ে জেতা যায়।
ঘুমটা যখন আসবে আসবে করছে ঠিক তখনই শুনতে পেল দূরে হৈ চৈ এর আওয়াজ আর সাঁওতালদের চিৎকার। ক্রমশ সেটা যেন কাছে আসতে থাকলো। তবে কি পুলিশ ওদের আবার ধাওয়া করলো? দূরে আকাশে আগুনের ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উপরের দিকে উঠছে। পুলিশসহ সাদা পোশাকে একদল লোক এদিকেই ছুটে আসছিল দেখে ঘুমটুম ফেলে টানা দৌড় দিল দ্বিজেন হেমব্রম । একসময় হুঁশ হল সে আখ ক্ষেতের ভেতরে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে দম ফেলছে। সারি সারি আখপাতা জড়াজড়ি করে বাতাসে দুলছে। ঘন পাতার মাঝখানে গিয়ে দম প্রায় বন্ধ করে লুকিয়ে রইল সে। হাত দিয়ে আস্তে আস্তে পাতা সরিয়ে কয়েকপা এগোতেই লাল পিপড়ার ঝাঁক পায়ের গোড়ালিটায় কামড়ে ধরল। মুহূর্তেই পিপড়াগুলো পা বেয়ে লুঙ্গির ভাজে জমতে শুরু করল। এক হাতে তীর-ধনুক। আরেক হাতে লুঙ্গিটা ঝাড়া দিতেই তীব্র শব্দটা কানে এ্সে লাগলো। একবার দু’বার না, পরপর কয়েকবার। গুলি ছুড়ছে পুলিশ।
দ্বিজেন দ্রুত স্থান বদলাতে চেষ্টা করল। কিন্তু পায়ে কি যেন বাধলো, ভারী কিছু। উলটে যেতে যেতে সামলে নিল নিজেকে। আশপাশে আখের ডালপালাগুলো ভেঙেচুড়ে মুচড়ে আছে। মাটির দিকে তাকাতেই আটকে গেল চোখ। গোপাল রক্ত চোখে আকাশের দিকে স্থির হয়ে তাঁকিয়ে আছে। শরীরটা নিথর পড়ে আছে মাটিতে। চোখ খোলা, কাদায় ভেজা রক্তাক্ত শরীর। বুকের বাম দিকে একটা গুলি লেগেছে। চোখের ঠিক উপর আরেকটা বুলেট। দ্বিজেনের হাত থেকে তীরধনুক পড়ে যায় কাদায়। ঝুঁকে পড়ে দুহাতে মাথাটা বুকে তুলে ধরে চাপা কষ্টে ডুকরে কেঁদে ওঠে.........গোপাল...গোপালরে...!
ঘুমটা যখন আসবে আসবে করছে ঠিক তখনই শুনতে পেল দূরে হৈ চৈ এর আওয়াজ আর সাঁওতালদের চিৎকার। ক্রমশ সেটা যেন কাছে আসতে থাকলো। তবে কি পুলিশ ওদের আবার ধাওয়া করলো? দূরে আকাশে আগুনের ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উপরের দিকে উঠছে। পুলিশসহ সাদা পোশাকে একদল লোক এদিকেই ছুটে আসছিল দেখে ঘুমটুম ফেলে টানা দৌড় দিল দ্বিজেন হেমব্রম । একসময় হুঁশ হল সে আখ ক্ষেতের ভেতরে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে দম ফেলছে। সারি সারি আখপাতা জড়াজড়ি করে বাতাসে দুলছে। ঘন পাতার মাঝখানে গিয়ে দম প্রায় বন্ধ করে লুকিয়ে রইল সে। হাত দিয়ে আস্তে আস্তে পাতা সরিয়ে কয়েকপা এগোতেই লাল পিপড়ার ঝাঁক পায়ের গোড়ালিটায় কামড়ে ধরল। মুহূর্তেই পিপড়াগুলো পা বেয়ে লুঙ্গির ভাজে জমতে শুরু করল। এক হাতে তীর-ধনুক। আরেক হাতে লুঙ্গিটা ঝাড়া দিতেই তীব্র শব্দটা কানে এ্সে লাগলো। একবার দু’বার না, পরপর কয়েকবার। গুলি ছুড়ছে পুলিশ।
দ্বিজেন দ্রুত স্থান বদলাতে চেষ্টা করল। কিন্তু পায়ে কি যেন বাধলো, ভারী কিছু। উলটে যেতে যেতে সামলে নিল নিজেকে। আশপাশে আখের ডালপালাগুলো ভেঙেচুড়ে মুচড়ে আছে। মাটির দিকে তাকাতেই আটকে গেল চোখ। গোপাল রক্ত চোখে আকাশের দিকে স্থির হয়ে তাঁকিয়ে আছে। শরীরটা নিথর পড়ে আছে মাটিতে। চোখ খোলা, কাদায় ভেজা রক্তাক্ত শরীর। বুকের বাম দিকে একটা গুলি লেগেছে। চোখের ঠিক উপর আরেকটা বুলেট। দ্বিজেনের হাত থেকে তীরধনুক পড়ে যায় কাদায়। ঝুঁকে পড়ে দুহাতে মাথাটা বুকে তুলে ধরে চাপা কষ্টে ডুকরে কেঁদে ওঠে.........গোপাল...গোপালরে...!
গতকালও মনমরা
হয়ে ছিল ছেলেটা। বলেছিল,‘আমরাওতো মানুষ। পেটে খিদে লাগেগো
দাদা। কদ্দিন না খেয়ি থাকবো বলো? গত সপ্তায় ভাত খেয়েছি চার বার। পাড়া থেকে একটু বেরুলেই
ওরা বলে মারবে। কোন কাজ কত্তি দ্যায়না। ক্ষুধার জ্বালাতো আর সইতে পারিনাগো দাদা। এর চ্যায়া ভাল আমায় আখ
ক্ষেত দিয়ে বের কর্যা দাও। সত্যি বলছি,
এবার যেখান থেকে এসেছিলাম সেখানে চলি যাবো। এ দেশে আর ফিরব না।’ দ্বিজেন ভাবে, গোপাল আখক্ষেত ধরে পালাতে
চেয়েছিল, পারেনি। আহা গোপাল!
কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকবার পর দ্বিজেন লাশ ফেলে উঠে দাঁড়ায়। মনে পড়ে, উত্তরপাড়ার স্বরণ টুডুও কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, ‘এমন কষ্ট জীবনে কোনদিন পাইনি বাপু। ওরা কইলো ঘর তুলো। তুললাম। হুট কইরা কয়, ঘর নামাও। ধার দেনা করে ঘর তুলিছিলাম। হুট করি নামাবো ক্যামতে? একি তুমাগো বাপ দাদার আবদার? বাপেরা মরছে আর জমিও বেহাত হতে চলেছে। পাকিস্তান পিরিয়ডে সরকার বলেছিল, ‘আঁখ না হইলে এ জমি তোমরা ফিরত পাবা’। আঁখ তেমন একটা হয়না। কিন্তু তারপরও জমি ফিরত পাওয়া যায়না।’
দ্বিজেন লক্ষ করে গোপালের হাতের মুঠোয় দুমাড়ানো মুচড়ানো আঁখের পাতা। তীর-ধুনক আর লাঠি শেখার কালে ট্রেনিংএ বলা হয়েছিল, পাতার মুঠো মানেই তোমরা জানবে, ‘আমাদের এক হতে হবে’। লাশটাকে পেছনে ফেলে তীর-ধনুক শক্ত হাতে ধরে আগুনের ধোঁয়া লক্ষ্য করে পা বাড়ায় শ্যামল হেমব্রমের পুত্র দ্বিজেন হেমব্রম।
কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকবার পর দ্বিজেন লাশ ফেলে উঠে দাঁড়ায়। মনে পড়ে, উত্তরপাড়ার স্বরণ টুডুও কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, ‘এমন কষ্ট জীবনে কোনদিন পাইনি বাপু। ওরা কইলো ঘর তুলো। তুললাম। হুট কইরা কয়, ঘর নামাও। ধার দেনা করে ঘর তুলিছিলাম। হুট করি নামাবো ক্যামতে? একি তুমাগো বাপ দাদার আবদার? বাপেরা মরছে আর জমিও বেহাত হতে চলেছে। পাকিস্তান পিরিয়ডে সরকার বলেছিল, ‘আঁখ না হইলে এ জমি তোমরা ফিরত পাবা’। আঁখ তেমন একটা হয়না। কিন্তু তারপরও জমি ফিরত পাওয়া যায়না।’
দ্বিজেন লক্ষ করে গোপালের হাতের মুঠোয় দুমাড়ানো মুচড়ানো আঁখের পাতা। তীর-ধুনক আর লাঠি শেখার কালে ট্রেনিংএ বলা হয়েছিল, পাতার মুঠো মানেই তোমরা জানবে, ‘আমাদের এক হতে হবে’। লাশটাকে পেছনে ফেলে তীর-ধনুক শক্ত হাতে ধরে আগুনের ধোঁয়া লক্ষ্য করে পা বাড়ায় শ্যামল হেমব্রমের পুত্র দ্বিজেন হেমব্রম।
২
মাথার উপর প্রকট রোদ। মাটি ফেটে চৌচির। ঘাম আর তীব্র গরমে নাজেহাল
অবস্থা নিয়েই হেলমেট আর বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পড়ে পুলিশ প্লাটুন জোট বেঁধে আখ
ক্ষেতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ওদেরই একজন
কন্সটেবল করিম মুন্সী। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি লম্বা। গায়ের রঙ কুচকুচে কালো, ছোট ছোট
চোখ, আর চ্যাপ্টা নাক। সহকর্মীরা কালু মুন্সী বলে ঠাট্টা করে।
বাবার সাথে মুন্সির চেহারার অনেক মিল। প্রথমে রংপুর হয়ে তারপর দিনাজপুরের চিরিরবন্দর গ্রামে মুন্সির পূর্বপুরুষেরা বসবাস শুরু করেছিল। ছোটবেলা থেকেই সে দেখে আসছে বাবা চিরির নদীতে বড় বড় নৌকায় করে ব্যবসার মালামাল আনা নেয়া করত। এ কাজে আসা যাওয়ায় কষ্ট হত বলে প্রায়ই উনি নদীর ওপারে থেকে যেতেন। মা একাই সব দেখাশুনা করতেন। তখন প্রাইমারী স্কুলে বাঙালী, আদিবাসী, সব মিলেমিশেই পড়ানো হত। মেট্রিক পর্যন্ত ঐ ইস্কুলেই পড়েছিল সে।
তারপর চলে যেতে হলো একটু দূরে। পুনর্ভবা নদীর পূর্ব তীরে দিনাজপুর সরকারী কলেজে। সেই সময় হঠাৎ অতিরিক্ত পরিশ্রমে বাবা মারা গেলেন আর সংসারের সব চাপ মুন্সির কাঁধে এসে পড়লো। চাকরীতে যোগ দেয়া ছাড়া উপায় ছিলনা কোন। তাও মা অনেক আত্মীয়স্বজনকে ধরে বহু কষ্টে পুলিশ সার্ভিসে চাকরীটা জোগাড় করতে পেরেছিলেন। যদিও মুন্সির ইচ্ছে ছিল সে বিজ্ঞান পড়বে। কিন্তু সব বাদ দিয়ে চাকরীতে ঢুকতে হল। তাও আবার পুলিশে। চুরি-ডাকাত ছিনতাই প্রতিরোধ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, জনসভা, নির্বাচনী এলাকা, সবধরনের ডিউটিতেই থাকতে হয়। পাঁচ বছর হতে চললো সেই এই কাজ করছে। রাগী মেজাজের কারণে জায়গা বদল হলেও পদের কোন বদল হয়নি। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বন বন করে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় ঘুরে বেড়ানো। সবশেষ গোবিন্দগঞ্জের এই সাহেবগঞ্জ। তবে রংপুরের মানুষ দেখে মুন্সীর মনে হয়েছে এরা ঠিক মানুষ নয়। হাওয়া খেয়েই দিন চলে যায় এদের। এই পোস্টিংটা যে খুব সুখের হবে না সেটা আগে থেকেই বুঝতে পারছিল মুন্সি। চিনিকল আর সাঁওতালদের নিয়ে এই পরিস্থিতির কথা সে শুনে এসেছে। কিন্তু বদলী ঠেকাবার উপায় ছিলনা তখন।
বাবার সাথে মুন্সির চেহারার অনেক মিল। প্রথমে রংপুর হয়ে তারপর দিনাজপুরের চিরিরবন্দর গ্রামে মুন্সির পূর্বপুরুষেরা বসবাস শুরু করেছিল। ছোটবেলা থেকেই সে দেখে আসছে বাবা চিরির নদীতে বড় বড় নৌকায় করে ব্যবসার মালামাল আনা নেয়া করত। এ কাজে আসা যাওয়ায় কষ্ট হত বলে প্রায়ই উনি নদীর ওপারে থেকে যেতেন। মা একাই সব দেখাশুনা করতেন। তখন প্রাইমারী স্কুলে বাঙালী, আদিবাসী, সব মিলেমিশেই পড়ানো হত। মেট্রিক পর্যন্ত ঐ ইস্কুলেই পড়েছিল সে।
তারপর চলে যেতে হলো একটু দূরে। পুনর্ভবা নদীর পূর্ব তীরে দিনাজপুর সরকারী কলেজে। সেই সময় হঠাৎ অতিরিক্ত পরিশ্রমে বাবা মারা গেলেন আর সংসারের সব চাপ মুন্সির কাঁধে এসে পড়লো। চাকরীতে যোগ দেয়া ছাড়া উপায় ছিলনা কোন। তাও মা অনেক আত্মীয়স্বজনকে ধরে বহু কষ্টে পুলিশ সার্ভিসে চাকরীটা জোগাড় করতে পেরেছিলেন। যদিও মুন্সির ইচ্ছে ছিল সে বিজ্ঞান পড়বে। কিন্তু সব বাদ দিয়ে চাকরীতে ঢুকতে হল। তাও আবার পুলিশে। চুরি-ডাকাত ছিনতাই প্রতিরোধ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, জনসভা, নির্বাচনী এলাকা, সবধরনের ডিউটিতেই থাকতে হয়। পাঁচ বছর হতে চললো সেই এই কাজ করছে। রাগী মেজাজের কারণে জায়গা বদল হলেও পদের কোন বদল হয়নি। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বন বন করে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় ঘুরে বেড়ানো। সবশেষ গোবিন্দগঞ্জের এই সাহেবগঞ্জ। তবে রংপুরের মানুষ দেখে মুন্সীর মনে হয়েছে এরা ঠিক মানুষ নয়। হাওয়া খেয়েই দিন চলে যায় এদের। এই পোস্টিংটা যে খুব সুখের হবে না সেটা আগে থেকেই বুঝতে পারছিল মুন্সি। চিনিকল আর সাঁওতালদের নিয়ে এই পরিস্থিতির কথা সে শুনে এসেছে। কিন্তু বদলী ঠেকাবার উপায় ছিলনা তখন।
জীবনটা যেমন দেখে সে বড় হয়েছে, আসলে ঠিক ঠিক সেটা
তেমন নয়। ইউনিফর্মধারী অনেকেরই অনেক অপকর্ম সে দেখছে এবং সহ্য করছে। বিশেষ করে
ছোটখাট বিষয়ে গরীব মানুষের কাছ থেকে ঘুষ নেয়ার ব্যাপারটা ছিচকে চোরের স্বভাব লাগে
তার। এসব নিয়ে ইন্সপেক্টরদের সাথে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়েছে কয়েকবার। তাতে উল্টো
ফল হয়েছে। তাকেই শাস্তি পেতে হয়েছে। আজকের
প্লাটুনে শফিক, ইসহাক সহ আরও বিশ পচিশজন কন্সটেবল আছে। সাদা পোশাকে চিনিকল কর্তৃপক্ষের লোকজনও আছে
কয়েকজন। আজ সাঁওতাল পাড়া দখলের পালা। করিম মুন্সির মন উচাটন। সে জানে সাঁওতালরা
কোন অপরাধ করেনি।
পুলিশবাহিনী দলবেঁধে
আখ ক্ষেতের কাছাকাছি পৌছুতেই হঠাৎ অন্যদিক থেকে তীর-ধনুক, লাঠিসোটা নিয়ে হৈ হৈ
করতে করতে ছুটে এলো সাঁওতাল বাহিনী। বেঁধে গেল সংঘর্ষ। মুন্সি দেখতে পেল তার সাথের
অন্য পুলিশেরা গুলি ছুড়ছে। আর পাল্টাপাল্টি তীর ছুড়ছে সাঁওতালরা। কিছুক্ষণ ধাওয়া
পালটা ধাওয়ার পর পিছিয়ে গেল সাঁওতালরা। মুন্সী যতই সামনের দিকে এগুচ্ছিল ততই যেন বুকের ভেতর দ্রাম দ্রাম বাজ
পড়ছিল। প্রায় বারো থেকে ষোল ঘন্টা ডিউটি, ছুটি নেই। মাথার
উপর সিনিয়র অফিসারের বকাঝকা, আর পাবলিকের গালিতো আছেই। এর মধ্যেই কেটে
যাচ্ছিল জীবন। কিন্তু আজ কি যে হয়েছে সে নিজেই জানেনা। রাইফেল তাক করেও গুলি ছুড়তে পারছেনা। মনে হচ্ছে,
নিজের ভাইদের সে মেরে ফেলছে, সেইযে ছোটবেলায় যুদ্ধ যুদ্ধ খেলেছিল পাশের বাড়ির উতঙ্গের সাথে, সেই রকম। কিছুতেই হারাতে পারছিলনা সেদিন উতঙ্গকে। আজও যেন
একইভাবে সে হেরে যাচ্ছে। কয়েকটা ফাঁকা গুলি করলেও তো
চলতো। কিন্তু নিজের সাথে প্রতারণা করতে পারলনা কিছুতেই।
চিনিকল
কর্তৃপক্ষ উচ্ছেদের জন্য বিপুলসংখ্যক পুলিশ জোগাড় করেছে এবার। স্থানীয় এমপিসহ মিলের শ্রমিক ও নেতারা জমির দখল নেবে।
যেভাবেই হোক জমি তাদের চাই। মুন্সি দেখলো প্রায় বিশ পঁচিশটা ঘর পোড়াবার
ব্যবস্থা হচ্ছে। সাদা
পোশাকের লোকেরা পুলিশকে দেখিয়ে দিচ্ছে কোন ঘরগুলো আগে পোড়াতে হবে। কথা ছিল পুলিশি
পাহারায় কর্তৃপক্ষ আখ কাটবে শুধু। মুন্সি অন্তত তাই জানতো। কিন্তু পরে জানা গেল
ঘটনা ভিন্ন, জমি দখলই আসল কাজ। কন্সটেবল
রফিক লাইটার জ্বালিয়ে ছনের ঘরে আগুন ধরাতে ব্যর্থ হল। লাইটার জ্বলছেনা। তখন গোলাপী
শার্ট পড়া এক লোক পকেট থেকে ম্যাচ বের করে আগুন লাগিয়ে দিল। দাউ দাউ করে ছনের ঘরটা জ্বলছে আর সেই আগুন তুলে
নিয়ে অন্যান্য ঘরগুলোতেও লাগানো হচ্ছে। বহুবছর ধরে বাপদাদার জমিতে বসবাস করছিল এই সাঁওতালরা। অথচ আজ সব পুড়ে ছাই। জীবন বাঁচাতে দিকবিদিক
ছুটছে ওরা। কারো কোন গন্তব্য জানা নেই। চারদিকে
শুধু হাহাকার চিৎকার। মুন্সীর
পা যেন মটকা মেরে দাঁড়িয়ে আছে, সহজে নড়ছেনা, তবু সে হাটছে। আগুন দেবার শক্তি ছিলনা
তার। সুগারমিলের এক শ্রমিক নেতা বড় বড় শেকলের চেইন
গলায় যার, সে মুন্সীকে ঠিক ঠিক লক্ষ করছিল। তেড়ে এসে সে বললো, ‘কিরে? আগুন দিচ্ছিস না ক্যান?’
‘দিচ্ছিতো...’
‘কই দিচ্ছিস, তুইতো ঠায়
দাঁড়িয়ে আছিস?’ বলে ডান হাত দিয়ে সানগ্লাসটা
মাথার উপর তুলে দিল লোকটা
‘তুই তুকারি করছেন কেন?’
‘ওমা! বলে কি? সরকারী চাকরকে
কি ‘আপনি’ বলবো? তোরতো অনেক
সাহস? মুখের উপর কথা বলছিস!! আগুন দে বলছি?’
‘দেবোনা’...বলে মুন্সি কঠিন
মুখে তাকিয়ে রইল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেন জেদ টগবগ করছিল ওর।
লোকটা রাগে গজগজ করতে
করতে শরীরটাকে ঘুরিয়ে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে তার ডান হাতের মোটাসোটা লাঠিটা ঠাস
বসিয়ে দিল মুন্সির বাম কান বরাবর। গরমের জন্যে কিচ্ছুক্ষণ আগেই
হেলমেটটা খুলেছিল মুন্সী। তাই আঘাতটা
একেবারে কানের ভেতরে গিয়ে লাগলো। মাথাটা যেন দুলছিল। মাটিতে পড়ে যাবার আগে
কোনমতে রাইফেলটা হাতে তুলে কাঠের বাটটা ঘুরিয়ে বেপোরোয়াভাবে লোকটার মাথায় মারার
চেষ্টা করল মুন্সি। কিন্তু সেটা গিয়ে পড়ল ব্যাটার কাঁধের উপর। ততক্ষনে কয়েকজন
পুলিশ সহকর্মী হাতাহাতি থামাতে এগিয়ে এসেছে। মুন্সি বাম হাত দিয়ে কানটা চেপে ধরে মাটিতে
বসে পড়ল। কোথাকার কোন শ্রমিক নেতা, চড় বসিয়ে
দিলো? সিনিয়র অফিসার সেটা চেয়ে চেয়ে দেখলো অথচ কিচ্ছু বললোনা! মুন্সির কালো মুখটা
রাগে অদ্ভূত বিষন্ন দেখালো। বাজার থেকে একটা রিকশা ভ্যান ডাকা হল মুন্সিকে সদর
হাসপাতালে নিতে হবে। কান দিয়ে রক্ত পড়ছে। কন্সটেবল শফিক আড়াআড়িভাবে জাপটে ধরে মুন্সিকে বললো, ‘চল হাসপাতাল চল’।
চিনিকলের ঐ নেতা নাকি সরকারী দলের
প্রভাবশালী মন্ত্রীর আত্মীয়। সে কারণে তার অপরাধ চোখে দেখছেনা
কেউ। হাসপাতালে যাবার আগে ইন্সপেক্টর উলটো তাকেই শাসিয়েছে,
‘জেনেশুনে
ভুল জায়গায় হাত দিস ক্যান? জানিস না চাকরী যাবে?’ মুন্সি থমথম মুখ করে
দাঁড়িয়ে ছিল। যে দৃশ্যটা সে দেখেছে সেটা এখনও চোখে আটকে আছে। গত
কয়েকদিন ধরেই চলছিল এরকম। লুটপাটের সময় আদিবাসীদের অনেকেই বাড়িতে ছিলনা।
সাঁওতালদের যারা বাজারে ছিল তাঁরা যেমন ফিরতে পারছিলনা ঠিক তেমনি গ্রামের ভেতরে
যারা রয়ে গেছিল তারাও আগুনে্র ভয়ে দিন গুনছিল। এরকম কিছু একটা যে হবে সেরকম অনুমান
করছিল পুলিশবাহিনী। উপর থেকে নির্দেশ ছিল পুলিশ যেন ওদের বেরুতে না দেয়। করিম
মুন্সি আগে কোনদিন এভাবে আগুনে ঘরবাড়ি পুড়তে দেখেনি। নাটক সিনেমায় দেখেছে।
টেলিভিশনে একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধ দেখেছে। সেই সময়ে ওদের বাড়িতে সাদাকালো টেলিভিশন
ছিল। পুরো গ্রামে একটাই টেলিভিশন। সদর থেকে ব্যাটারি চার্জ করে আনা হত। উঠোনে
টেবিল বসিয়ে টেলিভিশন দেখার ব্যবস্থা ছিল। গ্রামের লোকজন ঝাপিয়ে পড়তো উঠোনে
রাজ্জাক-কবরী জুটির সিনেমা দেখার জন্য। কিন্তু ব্যাটারীর চার্জ শেষ হয়ে যাবে বলে
সবসময় টেলিভিশন ছাড়া হত না।
৩
হাসপাতালের
ভেতরে ঢুকে তাকাতেই করিম মুন্সি দেখতে পেল বারান্দায় সারি সারি বিছানা। পুলিশের
গুলিতে আহত রোগীরা যন্ত্রণায়
কাতরাচ্ছে। চিকিৎসাধীন আহত তিনজন
সাঁওতালকে পুলিশ হাতকড়া দিয়ে বিছানার সঙ্গে বেঁধে রেখেছে। দ্বিজেন হেমব্রম তাদের একজন। সে চিৎকার করে বলছে, ‘কিছুই দেখি নারে...কিছুই দেখিনা...ওরা আমাদের বাড়িঘর ছাই করে
দিয়েছে, কিচ্ছু নাই...আর কিচ্ছু নাই। ক্যামনে বাঁচবো আমরা?’ বারান্দাতেও সাংবাদিকদের ভীড়। যেখানে যাকে
পাচ্ছে তাকেই ইন্টারভিউ
করার চেষ্টা করছে। একজন দ্বিজেনকে প্রশ্ন করল, ‘জমি নিয়ে কী ভাবছেন?’ উত্তর শোনা গেল,‘ওই জমি আমাগির বাপ-দাদার। পুলিশ আমাদের মেরে
আমাদেরই আসামি করল। কিন্তু এখন আবার আমাদের সব কেড়ে নেওয়া হলো। মরে গেলেও ওই জমি
ছাড়ব না।’ মুন্সি
লক্ষ করল, লোকটার বাম চোখ ফুলে ঢ্যাপা হয়ে আছে। বুলেট ঢুকেছে চোখে। দুটো চোখই
তীব্র লাল। আর কখনও দেখতে পাবে বলে মনে হয়না।
বারান্দার ঠিক
মাঝখানটায় বড় একটা খোলা দরজা। ওটার
ভেতরেই এমারজেন্সী রুম। করিম মুন্সি কান চেপে দাঁড়িয়ে রইল। সাদা এপ্রন পড়া পাওয়ারফুল চশমা চোখে
ছোটখাট মধ্যবয়েসী একজন ডাক্তার এলেন। বুকের বাম দিকে সেইফটিপিন দিয়ে একটা প্লাস্টিকের নেমপ্লেট আঁটকানো। তাতে নাম লেখা ডাঃ
তোফাজ্জল মবিন, এমবিবিএস।
চশমার ফাঁক গলিয়ে দুজনের
দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রশ্ন করলেন তিনি, ‘পুলিশ?’
করিম মুন্সী কোনমতে
মাথা উপর নিচু করে বললো, ‘জ্বী’।
‘আপনি পুলিশের লোক হয়ে কাকে মারছিলেন? আর উলটো মারইবা খেলেন কি করে,
মশাই?’ বলে মুচকি
মুচকি হাসতে থাকলেন। লোকটাকে বেশ রসিক মনে হলো মুন্সির। ঘাড়
শক্ত করেই উত্তর দিল সে,
‘সাঁওতালদের মারিনি। মেরেছি কারখানার
নেতাদের ভাড়া করা গুন্ডাদের। ওরা
পুলিশ টুলিশ কাউকেইতো পাত্তা দিচ্ছিলনা। নিরাপরাধ
মানুষগুলোকে ধরে ধরে মারছে...’
‘বলেন
কি? চাকরী আছেতো এখনও আপনাদের? কিন্তু এমনটা করা কি আপনাদের ঠিক হলো?’
‘সাঁওতালরা বাপদাদার জমি ফেরত পেতে কয়েক বছর ধরেইতো আন্দোলন করছিল। ঘরদোর
তুলে চাষাবাদও করছিল, যতদূর শুনেছি।’
কন্সটেবল
শফিক এতক্ষন শুনছিল দুজনের কথা। এখন সেও যোগ দিল,
‘চিনিকল কর্তৃপক্ষ বা স্থানীয় প্রশাসন কেউইতো বাধা দেয়নি বা আপত্তি
করেনি এতদিন। হঠাৎ তাদের মত পাল্টালো কেন সেটাতো সবাই বোঝে ডাক্তার সাহেব,
তাইনা,...আমরা পুলিশ বলে কি আমরা এসবের কিছু বুঝিনা।’
ডাক্তার
ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করলেন, ‘নতুন এসেছেন বুঝি?’
মুন্সি
উত্তর দিল, ‘জ্বী।’
‘তাহলেতো চুপচাপ থাকাই ভাল ছিল, কি বলেন?’
‘কিন্তু ওরা তো অন্যায়ভাবে জমিজমা কেড়ে নিতে চাইছে,’
মুন্সি উত্তর দিল।
‘ওদের মামলা ওরা বুঝুক। আপনারা মশাই পুলিশে চাকরী করেন এতসব
ঝামেলায় যাবার দরকার কি?’
শফিক
উত্তেজিত হয়ে বললো,‘আপনি কি জানেন, চেয়ারম্যান
সাহেবও উচ্ছেদ অভিযানে জড়িত আছে।’
‘সবাই জানে। জানবোনা কেন?’
‘এই চেয়ারম্যানই দীর্ঘ কয়েক বছর পরিশ্রম করে সাঁওতালদের ভূমি
উদ্ধার আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন। আর তাকে সমর্থন করেছিলেন এমপি সাহেব। আমি এখানে আছি তিন মাস। সব খবর জানি,’ শফিক বললো।
মুন্সি
ঘোর চোখে বলতে থাকলো। ‘এখন তারা বলছে, সাঁওতালদের
সহযোগিতা করে তারা ভুল করেছিল। ভুল বুঝতে পেরে সাওতালদের উচ্ছেদ করতে এখন এতটুকু দ্বিধা
করছেনা।’
‘নির্বাচনের আগের আর পরের রাজনীতি আলাদা। জানেনতো?’ ডাক্তার
যন্ত্রপাতি ঘাঁটতে ঘাঁটতে বললেন।
‘তাতো বটেই,’ শফিক উত্তর দিল।
‘আপনি হলে কি করতেন ডাক্তার সাহেব?’ মুন্সি পাল্টা প্রশ্ন
করল।
ভুরু
কুঁচকে ডাক্তার বললেন, ‘চাকরী বাঁচাতাম। আমার ঘরে
স্ত্রী সন্তান আছে, ভুলি কি করে!’
মুন্সির
ব্যথা বেড়েছে। ডাক্তার ইঞ্জেকশন দিলেন একটা। তারপর মাথার উপর টর্চলাইট বেঁধে গভীর
মনযোগের সাথে কানের ভেতরটা দেখতে লাগলেন। শফিক লক্ষ করল মুন্সি বকবক করেই যাচ্ছে। মায়ের
জন্যে মন টানছে কিনা কে জানে।
মুন্সি বললো, ‘ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের
নাম শুনেছেন? সেই রাজ্যের সাঁওতাল পারগানা জেলার ভগনাডিহি গ্রাম থেকে এসেছিল এরা।
এটা বাপদাদার কাছে শুনেছি।’
‘সেতো
ব্রিটিশ আমলের কথা। ওসব কথা কার মনে থাকে!’ ডাক্তার উত্তর দিল।
‘সে সময়েও
কিন্তু একই ঘটনা ঘটেছিল। অনাবৃষ্টি আর অভাবে সাঁওতালরা মারা যাচ্ছে আর পাহাড়ে ওদের
জমি কেড়ে নিচ্ছিল ব্রিটিশরা... আর স্থানীয় ভূমিদস্যুরা টাকা নিয়ে খুশী রাখছিল সরকারকে।’
‘আপনি তো
দেখি ম্যালা জানেন?...পড়াশুনা কদ্দুর?’ বলে
কান টেনে আবারো লাইট ফেলে ডাক্তার বললেন,
‘ব্যথা
বেশী? কথা বলতে অসুবিধা হচ্ছে?’
মুন্সির মনে পড়ে
গেল, চিরিরবন্দর ইস্কুলে হরিপদ স্যার প্রায়শই কান টানতেন। পড়া না পারলেই কান টেনে
পেছনের সাড়িতে বসিয়ে রাখতেন। পল্টু আর চন্দন ফেল্টুমার্কা ছাত্র ছিল। টুকটাক ঘুষ
না দিলে অল্পতেই মুন্সি ওদের কান মলা খাওয়াতো। আজ সেইসব দিনের হিসেব হচ্ছে হয়ত।
কান টানা খেয়ে ক্যা...করে মুখ বাকিয়ে...ব্যথা এড়ালো মুন্সি, বললো, ‘না...না...দিব্যি কথা বলতে পারছি, সেই সময়ে কি হয়েছিল জানেন? একজন
সাঁওতাল অসীম সাহস নিয়ে বিদ্রোহ ঘোষনা করেছিল। তাঁর নাম কি ছিল জানেন?’
‘না তো, কে
সে? ইস! ইতিহাস এত কম পড়া হয়েছে যে কি বলবো...’
‘বাবা তিলকা মাঝি। তার
আরেক নাম ছিল জাবরা পাহাড়িয়া। সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা
করেছিলেন তিনি। শোনা গেছে তিনি নাকি গাছের পাতায় ‘আমাদের এক হতে হবে’ এই বার্তা লিখে লিখে বিলি
করতেন। এগুলো আমি সব বইয়ে পড়েছি।’
‘এদিকে আপনার কানটা
কিন্তু গ্যাছে...’
‘পর্দা ফেটে গ্যাছে?’
‘হ্যাঁ...। খামোখা
একটা কান্ড বাধালেন। কানের পর্দার কাজ কি, জানেনতো?’
‘জ্বীনা, জানিনা।’
‘এটা মধ্যকর্ণ থেকে অন্তঃকর্ণের
মাঝখানে থাকে। খুবই স্পর্শকাতর,শব্দতরঙ্গ কানের পর্দায় কম্পন তৈরি করে। এই কম্পন
মধ্যকর্ণের ছোট ছোট হাড়ের মাধ্যমে অন্তঃকর্ণে পৌঁছায়। এবং তারপর অন্তঃকর্ণ থেকে
মস্তিষ্কে পৌঁছায়। এভাবে আমরা শুনতে পাই।’
‘কী জটিল ব্যাপার স্যাপার...তাহলে
কি কান আর ঠিক হবেনা?’
‘আরে হবে হবে...একটু কষ্ট পাবেন এই আর কি।’
‘কী করতে হবে?’
‘এন্টিবায়টিক খেতে হবে, ব্যাথা থাকলে প্যারাসিটামল, খোঁচানো যাবে না, ড্রপ
দেয়া যাবে না, সাঁতার কাটা যাবে না...তারপরও যদি ভাল না হয় তাহলে ঢাকায় গিয়ে
স্পেশালিস্টের কাছে মাইক্রোসার্জারি করতে হবে... বলেই তিনি মুন্সির কানের ভেতর
তুলো ঢোকালেন। ‘সরকারী হাসপাতাল না
হলে কিন্তু আপনাকে ফি দিতে বলতাম,’ ওষুধের নাম লিখতে লিখতে হাসতে
হাসতে ডাক্তার বললেন।
‘আমার যে টাকা নেই। ফি দেবো
কোত্থেকে?’
‘কেন? ঐ যে গল্পটা বলবেন। ‘বাবা তিলকা মাঝি’, ব্রিটিশ গল্প বলে
কথা,’ বলে হাসতে হাসতে ডাক্তার অন্য রোগীর কাছে চলে গেলেন...
৪
করিম
মুন্সি আর তার সহকর্মী কন্সটেবল শফিক ভ্যানে চড়ে হাসপাতাল থেকে গোবিন্দগঞ্জ থানার
দিকে রওনা দিল। শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ থেকে শুরু করে পুরো থানা এলাকা এখনও থমথমে।
শফিক
বেশ চিন্তিত মুখে বললো; তোমার কি মনে হয় সরকার আইন মেনে সাঁওতাল উচ্ছেদটা করছে?
‘কিভাবে? কোর্টের কোন নির্দেশ দেখেছো? সাঁওতাল আর বাঙালিদের
মিলিয়ে মোট ১৮টা গ্রামের প্রায় দুহাজার
একর জমি ক্যামন বেহাত হয়ে যাচ্ছে! মুন্সির
কন্ঠে হতাশা। লিজ যদি দিতেই হয় সেটা সাঁওতালদেরইতো দিতে পারতো? ঐ পাণ্ডাদের
কেন?’
‘কথা ঠিক। আবার
কাঁটাতারের বেড়াও দিয়ে দিচ্ছে ! আচ্ছা মুন্সি, তুমি ঐ গপ্পোটা কোথায় পাইলে বলতো?’
‘কোন গল্প?’ মুন্সি ঘাড় ঘুরিয়ে
শফিকের দিকে তাকালো।
‘ঐ
যে বাবা তিলকা মাঝি?’
‘হুম......ইস্কুলে সমাজ স্যার বলছিলো। সে ছিল
আদিবাসী সাঁওতাল।’
‘ডাক্তাররে যে তুমি বললা, বইয়ে পড়সো?’
‘আরে...ওতো চাপা মেরে দিয়েছি..’
‘তাইলে গল্পোডা তুমি জানোনা?’
‘জানিতো..।’
‘তাইলে যেতে যেতে বলে ফ্যালো পড়ে কি হলো....।’
‘সাঁওতালদের
উপর যখন ব্রিটিশ অত্যাচার বেড়েছে তখন বাবা তিলকা মাঝি তার নিজের বাহিনী
গড়ে তুলেছিল...পাহাড় জঙ্গল সব কিছু নখদর্পণে ছিল
তার...ব্রিটিশরা ধরতে গেলেই পিছলে যেত...তীর-ধনুক নিয়েই আক্রমণ
চালাতো এই তিলকা বাহিনী। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাল হলো ১৭৮৪।’
‘এতো ম্যালা আগের কথা দেকছি...আবার মিথ্যে কতা বলছোনা তো
মুন্সি?’
গম্ভীর
হয়ে মুন্সি বললো, ‘না।
তারপর শোন; ঐ বছরেই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে একদিন ঘোড়ায় করে এগিয়ে আসছিল লেফটেন্যান্ট
ক্লিভল্যান্ড। গাছের উপরে বসে থাকা তিলকার তীরের অব্যর্থ নিশানায় প্রাণ যায়
ইংরেজ এই কমান্ডারের। এই ঘটনার পর তিলকাকে ধরার জন্যে উঠে পড়ে লাগে ইংরেজ সরকার। এই
যে গত ক’দিন
ধরে গোবিন্দগঞ্জে দেখছো সাঁওতালদের ঘিরে রেখেছে চারদিক, ওদের বাজারে যেতে দেয়নি, খাবার
জোগার করতে দেয়নি, কোথাও বেরুতে দেয়নি, ...এটা কিন্তু ঐ বৃটিশ বুদ্ধি।’
‘বৃটিশ বুদ্ধি কি করে হলো?’
‘তিলকাকে ধরার জন্য নতুন নতুন কৌশল আবিষ্কার করত ইংরেজরা। দরকার
হলে গোটা পাহাড় ঘিরে ফেলতো। একবার পাহাড়ে লুকিয়ে থাকতে থাকতে খাবারের অভাবে পড়ে
গেল তিলকা বাহিনী। একদিকে খাবারের অভাব,আহত সেনা আর অন্যদিকে শত্রুপক্ষের আক্রমণ। সবকিছু মিলিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে
যায় ওদের।’
‘এতো দেখছি গোবিন্দগঞ্জ! তারপর কি হলো, বলো।’
‘একদিন
মুখোমুখি গেরিলা যুদ্ধে শত্রুপক্ষের হাতে আচমকা ধরা পরে গেল তিলকা মাঝি। ইংরেজরা
খুশীতে আটখানা হয়ে প্রকাশ্যে গাছে ঝুলিয়ে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করল তাঁকে।
‘ইসসস...বলো কি?
কি মারাত্মক ঘটনা! এডা কিন্তু মাস্টারদা সূর্যসেনের মতন গপ্পো কইলেগো মুন্সি...।’
‘আরি...এই তিলকা মাঝির সাহসইতো তিতুমীর,মাস্টারদা সূর্যসেনের মত বিপ্লবী বানিয়েছে। এইযে দ্যাখনা আজ কতদিন পর এনজিওরা
ত্রাণ নিয়ে এসেছে, কতঘন্টা দাঁড়িয়ে আছে কে
জানে, তবু সাঁওতালরা ত্রাণ নিচ্ছেনা। কারণ এদের রক্তে
মিশে আছে তিলকা মাঝি।’
‘ত্রাণ না নিলেতো একদিন মরে যাবে। তুমিই বলো, সেই ব্রিটিশ
পিরিয়ড কি আর এখন আছে? এসব কে মান্য করেগো মুন্সি... তা...তুমিতো সরকারী লোক
...তুমি কেন সাঁওতালদের পক্ষ নিলে?’
‘আমার চেহারাডার দিকে ভাল করে তাকায় দ্যাখো হে কন্সটেবল...,
কিছু কি মিল পাও?’
‘তুমারতো বুচা নাক, ছোট চোখ। জাপানী জাপানী, তুমিও কি সাঁওতাল
নাকি? সন্দেহের চোখে তাকিয়ে থাকে কন্সটেবল শফিক আর বড় বড় চোখে
নিস্পলক তাকিয়ে দেখে একজন কালো মানুষকে।
কানে
হাত চেপে মিহি সুরে টলতে টলতে সুর ভাজে মুন্সি...
‘কালো জলে কুচলা তলে
ডুবল সনাতন, আজ সারা না,কাল সারা না পাই যে দরসন...
লদীর ধারে চাষে বঁধু মিছাই কর আস, ঝিরিহিরি
বাঁকা লদি বইছে বারমাস...’
‘এ গান
কোথায় শিখলেগো মুন্সি?’
‘‘উত্তরা’ সিনেমার গান। বীরভূম -বাঁকুড়া অঞ্চলের
সাঁওতালী লোকগীতি। তুমি
বুঝবা ক্যামনে? তুমি কি সিনেমা দ্যাখো? না বোঝ?
‘মশকরা কইরোনা মুন্সি’, আর্ট ফিলিম দেইখে তুমিতো পন্ডিত হয়েছ’।
৫
পরেরদিন দুপর
বেলা মুন্সি যখন মেসের বিছানায় শুয়ে যন্ত্রণায় কাঁতরাচ্ছিল, তখনই থানা থেকে সমন
এলো যে তাঁকে মর্গে গিয়ে লাশ সনাক্ত করতে
হবে। কানের ভেতর তখনও প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছিল; ‘.....মুন্সি,
তোমার
পরিচয়টা কী?’ প...রি...চ...য়...টা...কী...? পরিচয় জানলে কি
সহজে পুলিশে চাকরী হত? শ্যামল হেমব্রমের বংশের ধারাবাহিকতায় দ্বিজেন হেমব্রম, মঙ্গল মার্ড, রমেশ টুডু, সিধু মাঝি সহ কত সাঁওতালইতো ঝাড়খণ্ড
ছেড়ে লম্বা পথ ধরে বোকারো, জামতাড়া, পাকুর, ফারাক্কা-গঙ্গা আর মালদা পাড়ি দিয়ে এই গোবিন্দগঞ্জে এসেছিল, তাঁদের সত্যিকার পরিচয় কজনা জানতো? মায়ের
কাছে শোনা এসব গল্প। তবে দিনাজপুরের প্রাইমারী
ইস্কুলে নামখাতায় সিধু মাঝির ছেলে কি
করে করিম মুন্সি হয়ে গিয়েছিল সে গল্পটা অজানা রয়ে গেল। শ্যামল,
মঙ্গল এবং রমেশ এই তিনজন গতরাতে পুলিশের গুলিতে মারা গেছে। কোথায় কীভাবে এই হত্যাকাণ্ড হলো
এ নিয়ে ভয়ে কেউ কিছু বলছেনা। শফিক যে ঘুষ খেয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করল সেটা নিয়ে মুন্সির মনে যত না বেদনা হল তার
চেয়ে হাজার গুণ কষ্ট হল একথা ভেবে যে, শফিকের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে করিম মাঝিকে
লাশ সনাক্ত করতে যেতে হল।
থানায়
রিপোর্ট শেষ করে বগুড়া-রংপুর রোড ধরে হাটতে থাকে মুন্সি। সীমাহীন নীল আকাশ দূরে খয়েরী মাটিতে মিলে গেছে।
ঝাপটা বাতাস শরীর থেকে যেন একেকটি আক্রোশ খসে ফেলছে। সেই কবে হেমব্রম রুখা
টাঁড় জমিতে আখ পুঁতেছিল, আজ তার বিস্তার ঘটেছে এমন যে কেউ চাইলেই শেকড় উপরে
ফেলতে পারবেনা। মুন্সির গায়ে আজ গাঢ় নীল রঙের জেলা পুলিশের পোশাকটি নেই। কয়েকটা
আখের পাতা পকেটে কুচিমুচি পড়ে আছে। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে মুন্সি দেখতে পায়, গোবিন্দগঞ্জ
থানার গায়ে শ্যাওলার পলেস্তরা। তাতে বড় বড় কালো অক্ষরে লেখা আছে ‘সেবাই
পুলিশের ধর্ম’।
নভেম্বর, ২০১৭
দীপেন ভট্টাচার্যের পাঠপ্রতিক্রিয়া পড়ুন--
মুঠিবদ্ধ আঁখের পাতা-মৌসুমী কাদেরের হেমব্রমের উত্তরায়ণ পড়ে।
দীপেন ভট্টাচার্যের পাঠপ্রতিক্রিয়া পড়ুন--
মুঠিবদ্ধ আঁখের পাতা-মৌসুমী কাদেরের হেমব্রমের উত্তরায়ণ পড়ে।
লেখক পরিচিতি
মৌসুমী কাদের
গল্পকার। অনুবাদক। সঙ্গীতশিল্পী।
টরেন্টো, কানাডাতে থাকেন।
মৌসুমী কাদের
গল্পকার। অনুবাদক। সঙ্গীতশিল্পী।
টরেন্টো, কানাডাতে থাকেন।
1 মন্তব্যসমূহ
গল্পের মধ্যে গল্প। মানুষের মধ্যে অন্য মানুষ। জীবনের মধ্যে অন্য জীবন। ফিলসফিক্যালি এটা এক জীবন থেকে আরেক জীবনে উত্তরণের গল্প। অন্য দিকে এটি সমকালীন মর্মভেদী ঘটনা নিয়ে গল্প। একজন সাংবাদিক লিখলে এখানে কিছু সংখ্যা, মানুষের নাম, হতাহতের ঘটনা, ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান থাকতো। মানবাধিকার/ সমাজকর্মীর পত্রিকার পাতায় লেখা কলামের বর্ণনা পড়ে আমরা হয়তো মরে যাওয়া গোপাল কিংবা তাদের কারোর অন্ধ হবার খবরে বা দাউ দাউ আগুনে পুড়ে যাওয়া ঘরের খবর পড়ে 'হায় মানবাধিকার', বলে চোখের পানি ফেলতাম। কিন্তু এসব কে ছাড়িয়ে এই সমকালীন ঘটনাটি হয়ে উঠেছে একটি অসাধারণ গল্প। লেখকের হয়তো সামাজিক সচেতনতা বোধের কারণে এক ধরনের কমিটমেন্ট আছে সাঁওতাল দের পক্ষে। কিন্তু সেই কমিটমেনট এর টোন রাজনৈতিক শ্লোগান হয়ে উঠেনি, সাহিত্য'র অংশ সে এখানে, অন্য স্বরে তার প্রকাশ। এ ধরনের গল্প লেখায় ঝুকি থাকে পক্ষপাতের, একমুখি ঝোঁকের। কোন এক আদর্শ বর্ণনার ভঙ্গীতে আটকে গেলেও গল্প হয়তো হয়, কিন্তু সাহিত্য আর থাকে না। এই গল্প সেই বিপদ এড়াতে পেরেছে। গল্পটি এখানেই সার্থক। অন্তর্নিহিত অনুভুতির উন্মোচন, অন্তর্গত মানুষের এক জীবন থেকে আরেক জীবনে উত্তরণ - সব মিলিয়ে অসাধারণ।
উত্তরমুছুন