ভদ্রলোকের টুপিতে হলুদ রঙের নামফলক আছে। সেটা দেখে হোটেল ‘ভার্সেই’র মুটে যুবকটি কোনোরকমে উদ্ধার করে খ্রিস্টান নাম পড়তে পেরেছে । তার পৈত্রিক নাম ‘কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচ’* । নামটি বেশ খটোমটো আর উচ্চারণে দাঁত ভেঙে যেতে চায়।। মুটে যুবকটি কার্ড হাতে নিয়ে এদিক-ওদিক করে উল্টেপাল্টে খুঁটিয়ে দেখে । আগুন্তুক ভদ্রলোক কার্ডের সঙ্গে পাসপোর্টও দিয়েছে । যুবকটি তা-ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। ঘাড় উঁচিয়ে শ্রাগ করে। ‘ভার্সেই’-এ থাকার জন্য অতিথিদেরকে কার্ড দেওয়া লাগে না। সে কার্ড ও পাসপোর্ট টেবিলের উপর রাখে ।
তারপর ভদ্রলোকটি টেবিলে বিছানো ঝাপসা আয়নায় নিজেকে আবার দেখে নেয়। চিরুনি দিয়ে মাথার ঘন চুল আঁচড়াতে থাকে । তার পরনে ওভারকোট। পায়ে চকচকে বুট জুতা । এছাড়া তার টুপির উপর স্বর্ণালি কারুকাজ। বয়সের মলিন ছাপ স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে সে কারুকাজে।
কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচ মস্কোর উদ্দেশ্যে কিয়েভ ত্যাগ করেছেন এপ্রিলের আট তারিখ । সেদিন ছিল ‘গুড ফ্রাইডে’ । একটা টেলিগ্রাম পেয়েই সে রওনা হয়েছে এবং টেলিগ্রামে মাত্র একটা শব্দ লেখা ছিল ‘দশই’ । সে কোনোরকমে ভাড়ার অর্থকড়ি সংগ্রহ করতে পেরেছে এবং রেলগাড়ির দ্বিতীয় শ্রেণীর কক্ষে আসন নিয়েছে । কক্ষটি ছিল ধূসর এবং অনুজ্জ্বল, কিন্তু সত্যিকার অর্থে তাকে আরাম এবং বিলাসবহুল পরিবেশের অনুভূতি দিয়েছে । রেলগাড়ির মধ্যে তাপমাত্রা বেশি ছিল । সেখানে ছিল রেলগাড়ির-বগির তাপ, গরম হওয়া যন্ত্রপাতির এক ধরনের গন্ধ এবং ছোট হাতুড়ি পেটানোর তীক্ষ্ণ আওয়াজ। এসব কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচকে অন্য সময়ের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে । কখনো তার কাছে মনে হয়েছে--পুনরায় শীতকাল এসে গেছে । ফসলের জমিনে রয়েছে বিবর্ণ রঙের কন্টকিত খড়কুটা এবং বিশাল নিরানন্দ জলাশয়। এ জলাশয়ে বুনো হাঁসেরা সাঁতার কাটে। এখন অত্যন্ত সফেদ বরফকুঁচিতে ঢেকে আছে । কিন্তু অকস্মাৎ প্রায়ই তুষার-ঝড় থেমে যায় এবং বরফ গলতে শুরু করে । তখন ফসলের জমিন উজ্জ্বল দেখায় এবং যে কেউ অনুভব করবে--মেঘের আড়ালে লুকিয়ে আছে আলো এবং কৃষ্ণবর্ণের বরফ গলা ভেজা রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম । এছাড়া তার মনে হবে কোথাও যেন পাতাবিহীন নগ্ন পপলার গাছের ডালে বসে দাঁড়কাক ডাকছে ।
প্রতিটি বড় স্টেশনে নেমে কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচ জলখাবারের দোকানে পানীয় কেনার জন্য যায় এবং হাতে করে খবরের কাগজ নিয়ে আবার ট্রেনের কক্ষে ফিরে আসে । কিন্তু সে খবরের কাগজ পড়েনি । সে শুধু বসে থাকে। আর সিগারেটের ঘন ধোঁয়ার মধ্যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকে । টানার সময় জ্বলন্ত সিগারেট উজ্জ্বল হয়ে ওঠে । সেই সময় তার আশেপাশের যাত্রীরা, ওডেশার ইহুদীরা তাস খেলায় মেতে আছে। কেউ একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি ।
তার পরনে ছিল শরৎকালীন ওভারকোট। ছেঁড়া পকেট। মাথায় অনেক দিনের পুরনো কালো রঙের টুপি। অল্প দামের বুট জুতা পরেছে। জুতোটি বেশ ভারী। আর নতুন নয়। সে যখন সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করেছে, তখন তার হাত একজন অভ্যস্ত মাতাল এবং পাতালঘরে বসবাসকারী বৃদ্ধের সাধারণ হাতের মতোই কাঁপছিল । তার সব কিছুর মধ্যে দারিদ্রতা এবং মাতালের চিহ্ন রয়েছে। সার্টের আস্তিনের অগ্রভাগ নেই। ময়লা কলার। মান্ধাতা আমলের টাই। মুখমন্ডল উদ্দিপ্ত হলেও বিধ্বস্থ। উজ্জ্বল-নীল চোখ অশ্রুভেজা । তার দু’পাশের গোঁফ জোড়া দৃষ্টিকটূ বাদামি রঙে রাঙানো। এটা তার মুখে অস্বাভাবিক চেহারা ফুটিয়ে তুলেছে । তাকে ক্লান্ত এবং উপেক্ষিত দেখাচ্ছিল।
পরদিন ট্রেন মস্কোতে পৌঁছেছে।কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছৈনি। সাত ঘন্টা দেরি হয়েছে । আবহাওয়া এদিকেও ছিল না, এমনকি ওদিকেও ছিল না । তবে মস্কোর আবহাওয়া কিয়েভের আবহাওয়া থেকে ভালো এবং শুকনো । বাতাসে আলোড়িত একটা কিছুর উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয় । কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচ দরদাম না করে একটা ট্যাক্সিতে চেপে বসে। সরাসরি ‘ভার্সেই’ হোটেলে যাওয়ার জন্য চালককে তাড়া দেয় ।
“আমি অই হোটেল খুব ভালো করে চিনি, জনাব,” হঠাৎ মৌনতা ভেঙে গাড়ির চালক বলল, “আমার ছাত্র জীবন থেকেই চেনা ।”
‘ভার্সেই’ হোটেলে পৌঁছানোর পর দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা তার ছোট ব্যাগ খুলে নির্দিষ্ট কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর সে ট্যাক্সি থেকে বেরিয়ে আসে ।
তখন প্রায় সন্ধ্যায় ঘনিয়ে আসছিল। বাতাস ছিল উষ্ণ। বৃক্ষশোভিত প্রশস্ত সড়কের দু’পাশের মরা গাছগুলো সবুজ দেখাচ্ছিল । সবখানেই মানুষের ভিড়, মোটরগাড়ি এবং ঘোড়ার গাড়ির সমাগম । মস্কোতে কর্মচঞ্চলতা বেশি এবং সবাই ব্যস্ত । এটাই মস্কোর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা এবং এর মাঝেও শহরটি অজ্ঞাতে যেন বসন্তকে স্বাগতম জানিয়েছে । লোকারণ্য শহরে যে মানুষ তার জীবন অতিবাহিত করেছে, তার কাছেও বসন্তের সন্ধ্যায় নিজেকে সেই শহরে অপরিচিত মনে হয় । কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচ বৃক্ষশোভিত প্রশস্ত রাস্তা তারস্কির পুরোটা হেঁটেছে । সে আরেকবার স্ট্যাসনয় মঠের উপর স্থাপিত ধ্যানমগ্ন পুশকিনের লোহার মূর্তি দেখেছে। মূর্তিটি রং সোনালি এবং কিছুটা নীলচে। প্রায় এক ঘন্টার মতো সময় সে ক্যাফে ফিলিপভে বসেছিল । সেখানে চকলেটের পানীয় পান করেছে এবং হাস্য-কৌতুকের ম্যাগাজিন পড়েছে । তারপর সে সিনেমা দেখতে যায়। সেই সিনেমার উজ্জ্বল বিজ্ঞাপন গোধূলিতেও দূরের তারস্কায়া থেকে দেখা যাচ্ছিল । সিনেমা থেকে বেরিয়ে সে বৃক্ষশোভিত প্রশস্ত রাস্তার পাশে ছাত্রজীবন থেকে পরিচিত এক রেঁস্তোরায় প্রবেশ করে । এক বুড়ো তাকে ঘোড়ার গাড়িতে করে সেখানে নিয়ে যায় । বুড়ো কুঁজো হয়ে কুর্নিশ করে । তার দুঃখমাখা চেহারায় বিরক্তি, নিজের মধ্যে ধ্যনমগ্ন, চোখেমুখে বার্ধ্যকের গভীর চিন্তার ছাপ ফুটে ওঠে । ক্লান্ত ও অবসন্ন বুড়ো শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে অলস ঘোড়াকে চলতে সাহায্য করে । বিড়বিড় করে সে কিছু একটা বলে এবং মাঝেমাঝে বিরক্ত হয়ে দাঁত খিঁচিয়ে ঘোড়াকে গালমন্দ করে । অবশেষে একসময় বুড়ো গন্তব্যে পৌঁছায় । সে ঘোড়ার জোয়াল খুলে ক্লান্তিতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে এবং ভাড়া নেয় ।
“নামটা আমি বুঝতে পারিনি এবং ভেবেছি আপনি ‘ব্রাগ’ বলেছেন,” বুড়ো বিড়বিড় করে বলল এবং ধীর গতিতে ঘোড়াকে উল্টো দিকে ঘোরায় । মুখভঙ্গি দেখে মনে হয় সে রীতিমতো বিরক্ত, যদিও ‘প্রাগ’ অনেক দূরের শহর ।
“আমিও ‘প্রাগ’ চিনি, বুড়ো,” জবাবে বলল কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচ । “নিশ্চয়ই তুমি অনেক দিন ধরে মস্কোতে গাড়ি চালাচ্ছ ।”
“গাড়া চালানো?” বুড়ো লোকটি বলল । “আমি একান্ন বছর ধরে গাড়ি চালাই ।”
“তার মানেহলো তুমি হয়তো আগেও আমাকে নিয়ে গাড়ি চালিয়েছ,” বলল কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচ।
“হয়তো আমি চালিয়েছি,” বিরস মুখে বলল বুড়ো লোকটি । “এই পৃথিবীতে অনেক মানুষের বসবাস । একজনের পক্ষে সবাইকে মনে রাখা সম্ভব নয় ।”
পুরনো আমলের রেঁস্তোরা । একসময় কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচের কাছে পরিচিত ছিল । এখন সেখানে শুধু নামটাই আছে । যদিও আটপৌড়ে, তবে এখন বিশাল এবং প্রথম শ্রেণীর রেঁস্তোরা বানিয়েছে । প্রবেশ দরোজার উপরে একটা বৈদ্যুতিক লন্ঠনের চিমনি জ্বলছে। চিমনিটা অপ্রীতিকর, কাপুরুষের মতো নির্লজ্জ, ক্ষীণ এবং নিষ্ঠুর আলোয় আলোকিত করেছে । স্যাঁতস্যাঁতে হলঘরের মেঝেতে পাত্রের মধ্যে জলপাইজাতীয় সবুজ পাতার গাছ এবং গ্রীষ্ম অঞ্চলের গাছগাছালী রাখা হয়েছে । এসব গাছপালা বিয়েশাদীর অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ার জায়গায় দেখা যায় । মুটেদের ঘর থেকে কয়েকজন তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচের কাছে চলে যায় । সবার মাথায় একই ধরনের কোঁচকানো চুল। এটা ‘ভার্সেই’ হোটেলের মুটেদের মাথায় দেখা গিয়েছিল । ফরাসী স্থাপত্যে সাজানো বিশাল সবুজাভ কক্ষে কয়েকটি বড়ো আয়না রয়েছে এবং কক্ষের এক কোণে রাখা একটা বিশেষ ধরনের বাতি গাঢ় লাল রঙের আলো ছড়াচ্ছে । তারপরও কক্ষটি ফাঁকা এবং সেখানে কয়েকটি বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে । সেই কক্ষে কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচ দীর্ঘ সময় একাকী বসেছিল। আর কোনো কিছুই করেনি। সবাই বুঝবে-- জানালার পেছনের লম্বা সাদা পর্দার আড়ালে বসন্তকালীন সন্ধ্যায় তখনো অন্ধকারে ছেয়ে যায়নি এবং রাস্তা থেকে ঘোড়ার ক্ষুরের ধুপধুপ শব্দ ভেসে আসছিল । কক্ষের মাঝখানে একটা গোলাকৃতি অ্যাক্যোয়্যারিয়্যামের মাঝে ছোট্ট একটা ঝরণা থেকে এক ঘেঁয়েমীর সুরে পানি পড়ার শব্দ হচ্ছিল । অ্যাক্যোয়্যারিয়্যামের মধ্যে নীচ থেকে বিশেষ ভাবে আলোর ব্যবস্থা ছিল। তার পানিতে আঁশ ছাড়া গোল্ড-ফিশ সাঁতার কাটছিল । সাদা পোশাকের একজন বেয়ারা এসে খাবার পরিবেশন করে । খাবারের মধ্যে ছিল রুটি এবং শীতল ভোদকা । কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচ ভোদকা পান করা শুরু করে । সে খানিকটা সময় মুখের ভেতরে রেখে পরে গলার ভেতর পাচার করে । অত্যন্ত অপছন্দ সত্ত্বেও সে কালো রুটির গন্ধ শোঁকে । সম্পূর্ণ আকস্মিকভাবে তার সামনে সবকিছুই যেন শুরু হয়ে যায়। ঘরের মধ্যে প্রচণ্ড শব্দ করে সারা গ্রামোফোনে বেজে ওঠে রাশিয়ার মিশ্রিত সঙ্গীতের সুর। এ সুর একসময় তুমুল হৈচৈ এবং কোলাহলপূর্ণ।এখন আবার প্রচন্ড শান্ত, মন্থর গতি, আবেগের রসে সিক্ত ... । আর চারপাশের পরিবেশ কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচের লালচে চোখ জলে ভিজে ওঠে ।
মনির এক জর্জিয়ান বেয়ারা তাকে প্লেটে করে আধা রান্না করা গন্ধযুক্ত মাংস নিয়ে আসে। তার ধূসর ও কোঁকড়ানো চুল এবং কালো চোখ। ওয়েটার বিশাল লোহার আঁকশিতে মাংস গেঁথে অভদ্র ভাবে এলোপাথারি কাটতে থাকে । তার আচরণ এশিয়াবাসীদের মতো। সে পিঁয়াজকুচি, লবন এবং গুড়া মশলা হাতে নিয়ে মাংসের উপর ছড়িয়ে-ছিঁটিয়ে দেয় । সেই সময় গ্রামোফোনের শব্দ ফাঁকা হলরুমে জোরে বাজছিল। সে বাজনা যে কাউকে উদ্দীপ্ত করার জন্য যথেষ্ট ছিল । তারপর কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচকে পনির, ফলমূল, শরাব, কফি, মিনারেল ওয়াটার, আঙুরের রস পরিবেশন করা হয় ... অনেক আগেই গ্রামোফোন থেমে গেছে । তার পরিবর্তে সাদা পোশাক পরিহিতা এক জার্মান মহিলা সামান্য উঁচু জায়গায় অর্কেষ্ট্রা বাজাচ্ছিল । আলোকিত হলঘরে সারাক্ষণই মানুষ আসতে থাকে । মানুষের ভীড়ে হলঘরের তাপমাত্রা উষ্ণ হয়ে ওঠে। সিগারেটের ধোঁয়ায় হয়ে ওঠে চারপাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন। ঘরের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের খাবারের ভারী গন্ধ মৌ মৌ করে । বেয়ারারা চরকির মতো ঘুরে লোকজনের চাহিদা পূরণ করায় ব্যস্ত। মাতাল লোকজন সিগার আনার কথা বলে। এটা তৎক্ষণাৎ তাদের অসুস্থ করে তোলে । প্রধান বেয়ারারা নিজেদের আত্মসম্মান বজায় রেখে নৈতিক দায়িত্ব পালন করে । আয়নায় অত্যন্ত কোলাহলপূর্ণ বিশাল এবং জটিল একটা কিছুর প্রতিবিম্ব দেখা যায় । কয়েকবার কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচ গুমোট হলঘর থেকে বেরিয়ে ঠান্ডা বাতাসের বারান্দায় এবং শীতল ওয়াশরুমে গিয়েছে । সেখানে অদ্ভূত রকমের সামুদ্রিক সুবাস ভেসে বেড়াচ্ছিল । সে পায়চারি করে এবং নিজের আসনে ফিরে এসে পুনরায় মদের অর্ডার করে । মাঝরাত্তিরের পরে চোখের পাতা বন্ধ করে এবং নাকের ফুঁটো দিয়ে নেশাগ্রস্ত মাথার ভেতর টাটকা বাতাস টেনে সে রাবারের চাকাওয়ালা সাইকেলে চড়ে । তারপর তড়িঘড়ি করে শহরের বাইরে এক নিষিদ্ধ পল্লীতে যায় । দূরের অসংখ্য বাতির আলো দেখতে পেয়ে সে পাহাড়ের ঢালু বেয়ে নেমে যায়। আবার উপরের দিকে ওঠে । কিন্তু সে এমন ভাবে দেখে যেন সে নয়, অন্য কেউ দেখছে । নিষিদ্ধপল্লীতে শক্তিশালী একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে সে প্রায় মারামারিতে জড়িয়ে পড়েছিল । ভদ্রলোক তাকে আক্রমণ করেছিল এবং চিৎকার করে বলছিল যে, রাশিয়ার চিন্তকদের কাছে সে পরিচিত । তারপর পরনের পোশাক না পাল্টে একটা প্রশস্ত বিছানায় কাভার দেওয়া লেপের ভেতর ঢুকে পড়ে । আয়তনে ঘরটা ছোট এবং সিলিংয়ের আকাশী রঙের লন্ঠনের আধা-আলোয় ছিল আলোকিত । ঘরের মধ্যে সুগন্ধী সাবানের আঠালো সুবাস এবং দরজার আংটায় ঝোলানো ছিল পোশাক । বিছানার কাছে ঝুড়িতে ফলফলাদি রাখা আছে। কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচকে আনন্দ দেওয়ার জন্য যে মেয়েটিকে ভাড়া করা হয়েছে, সে চুপচাপ ঝুড়ি থেকে একটা নাশপাতি তুলে নেয় এবং ছুরি দিয়ে কেটে পেটুকের মতো খেতে শুরু করে । তার মাংসল হাত তার অনাবৃত। সে শুধু একটা শেমিজ পরেছে। এজন্য তাকে ছোট্ট মেয়ের মতো দেখাচ্ছিল । তাদের দুজনের উপস্থিতি উপেক্ষা করে মেয়েটি দ্রুত গতিতে টেবিলের উপর কিছু একটা লিখে যাচ্ছিল । লেখা শেষ করে সে কাঁদছিল, কিন্তু কিসের জন্য? পৃথিবীতে অনেক লোকজনের বসতি; একজনের পক্ষে সবকিছু জানা সম্ভব নয় ।
এপ্রিলে দশ তারিখে কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচ তাড়াতড়ি জেগে ওঠে । চোখের পাতা খোলার পর থেকে তার অভিভূত চেহারা দেখে যে কেউ বুঝতে পারবে সে মস্কোতে আছে । ভোর চারটার পরে সে ফিরে এসেছে । টলোমলো ভঙ্গিতে সে ‘ভার্সেই’-এর সিঁড়ে বেয়ে উপরে ওঠে এবং কোনো ভুলচুক না করে লম্বা ও দূর্গন্ধময় বারান্দা পেরিয়ে সোজা তার কক্ষে প্রবেশ করে । প্রবেশদ্বারের ছোট্ট বাতির টিমটিমে আলোয় আলোকিত ছিল বারান্দা । প্রতিটি কক্ষের বাইরে সাধারণ জুতা এবং বুটজুতা – সবাই আগুন্তুক, কেউ কারোর কাছে পরিচিত নয়। আর একের সঙ্গে অপরের যেন শত্রুতা । অকস্মাৎ একটা কক্ষের দরজা খুলে যায় এবং কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচকে প্রায় ভড়কে দিয়েছিল । একজন বুড়ো বেরিয়ে আসে । তাকে দেখতে অনেকটা ‘দ্য মেম্যোয়্যার অব এ লুনাটিক’-এর তৃতীয়-শ্রেণীর অভিনেতার মতো মনে হয়েছে । কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচ সবুজ শেডের নিচে একটা বাতি এবং কক্ষের ভেতর স্তুপ করে রাখা অনেক জিনিসপত্র দেখতে পায় । ঘরটা গুহার মতো এবং একজন নিঃসঙ্গ মানুষের বসতি। ঘরের কোণে রাখা প্রতিমূর্তির পাশে সিগারেটের অসংখ্য খালি বাক্স প্রায় সিলিং পর্যন্ত থরে থরে সাজানো রয়েছে । সেই অর্ধ-পাগল লেখক, যে কিনা সাধু-সন্নাসীদের জীবনী লিখেছিল, তেইশ বছর আগে ‘ভার্সেই’-এ ছিল না? কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচের অন্ধকার ঘরে ভীষণ গরম এবং সেখানে মারাত্বক ধরনের গন্ধ আর শুকনো হাওয়া। ... দরজার উপরের জানালা গলিয়ে ক্ষীণ আলো এসে অন্ধকারে ঢুকে পড়েছে । কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচ পর্দার আড়ালে যায়, পাতলা ও আঠালো চুলের উপর থেকে টুপি খোলে। পরনের কোট খুলে খালি বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে ... যেই মাত্র সে বিছানায় শোয়, সবকিছুই যেন তার চতুর্দিকে ঘুরতে থাকে । ঘুমের অতলান্তে যাওয়ার জন্য তার ভীষণ তাড়া থাকায় তৎক্ষণাৎ সে ঘুমিয়ে পড়ে । ঘুমের মাঝেও তার মুখের সামনে রাখা কাপড় রাখার লোহার স্ট্যান্ডের গন্ধ আসার জন্য সে সর্বদা সচেতন । একসময় সে স্বপ্ন দেখে বসন্তকালের একটি দিন, পুষ্পরাজিতে ভরা গাছপালা, জমিদার বাড়ির হলঘর এবং যেকোন মুহূর্তে বিশপের আগমনের জন্য কয়েকজন লোক অপেক্ষা করছে । তাদের চোখেমুখে উৎন্ঠার ছাপ । অপেক্ষারত লোকজনের জন্য সারারাত সে রীতিমতো চিন্তিত এবং বিক্ষিপ্ত ছিল ... এখন ‘ভার্সেই’-এর বারান্দায় লোকগনের সমাগম, ত্রস্ত-ব্যস্ততা, একজন আরেকজনকে ডাকাডাকি করছে । পর্দার পেছনের জানালার ধূলিমাখা দু’পাল্লার ফাঁক গলিয়ে সূর্যের আলো এসে ঠিকরে পড়েছে । ইতোমধ্যে ঘরের ভেতরটা অনেকটা তেতে উঠেছে ... কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচ পরনের জ্যাকেট খুলে ফেলে, বেল বাজায় এবং ধোওয়া শুরু করে । চঞ্চল চোখের একটা ছেলে আসে । তার মাথা ভর্তি শেয়াল-রঙের চুল, পড়নে গোলাপী সার্ট এবং ঢিলেঢালা কোট ।
“এক টুকরো রুটি, সামোভার** এবং বাতাবি লেবু,” ছেলেটির দিকে না তাকিয়ে বলল কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচ ।
“এবং চা ও চিনি?” ছেলেটি মস্কোবাসীদের মতো তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞাসা করে ।
এক মিনিট পরেই ছেলেটি ফুটন্ত পানির সামোভার হাতে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করে । তারপর সে নিচু হয়ে কাঁধ অবধি উচ্চতায় ধরে। সোফার সামনে গোলটেবিলের উপর তড়িঘড়ি করে গ্লাস ও পিতলের একটা পাত্রসহ ট্রে রাখে । অবশেষে সে ট্রের উপর সামোভার নামিয়ে রাখে ... চা ঢালার সময় কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচ ‘মস্কো ডেইলি’ খবরের কাগজ খোলে। পত্রিকাটি সামোভারের সঙ্গে ছেলেটি নিয়ে এসেছিল । তার দৃষ্টি একটা সংবাদের উপর আটকে যায় । গতকাল একজন অপরিচিত লোককে অবেচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ... “অবচেতন লোকটিকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে,” সংবাদটি সে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে খবরের কাগজ ছুঁড়ে ফেলে দেয় । তার খারাপ লাগতে শুরু করে-- অস্বস্তি অনুভব করে । একসময় উঠে গিয়ে জানালার পাল্লা খোলে । জানালার মুখ উঠানের দিকে । সে তাজা বাতাস বুকের ভেতর টেনে নেয় এবং তার মনে হয় পুরো শহরটাই যেন কাছে চলে এসেছে । হকারদের কন্ঠস্বর তার কানে বাজে; শোনা যায় উল্টোদিকের বাড়ির পেছনে ঘোড়ার-ট্রেনের ঘন্টাধ্বনি, চলন্ত গাড়ির শব্দ এবং গির্জার ঘন্টার সঙ্গীতময় আওয়াজ । অনেক আগেই শহরটা জেগে উঠেছে এবং উজ্জ্বল, হাসিখুশি ও অনেকটা বসন্তকালীন দিনের কর্মচঞ্চলতা শুরু হয়েছে । কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচ এক গ্লাস চায়ে লেবু চিপে রস ঢালে এবং হা-হুতাশের মতো গাঢ় ও টক চায়ের গ্লাসে চুমুক দেয় । তারপর সে পর্দার পেছনে যায় । ‘ভার্সেই’-এর পরিবেশ চুপচাপ । চারপাশ মনোরম এবং শান্ত । তার দৃষ্টি হোটেলের দেয়ালে ঝোলানো নোটিশ বোর্ডের উপর অলস ভাবে ঘোরাঘুরি করে। তার কাছে মনে হয় “তিন ঘন্টা থাকা পুরো একদিন থাকার সমান ।” আলমারির ছিদ্র দিয়ে একটা ইঁদুর একটুকরো চিনি টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। এ চিনি হয়তো আগের কোনো অতিথি ফেলে গিয়েছিল। যতক্ষণ না পর্যন্ত ঘরের ভেতর থেকে সূর্যের আলো বিদায় নেয় এবং জানালা গলিয়ে আরেকটা টাটকা হাওয়া এসে ঘর ভরিয়ে তোলে, সন্ধ্যার সজীবতা এসে পড়ে, ততক্ষণ আধা ঘুমে বিভোর কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচ শুয়ে থাকে ।
তারপর সে কাজগুলোকে ক্রমানুসারে নিজের মতো করে সাজায় । সে ব্যাগ খোলে। অন্তর্বাস বদলায়। সস্তা কিন্তু পরিস্কার রুমাল নেয়। ব্রাশ দিয়ে চকমকে কোট পরিস্কার করে। মাথার টুপি এবং ওভারকোট নেয়। কোটের ছেঁড়া পকেট থেকে জানুয়ারি পনের তারিখের দুমড়ানো-মোচড়ানো কিয়েভের খবরের কাগজ বের করে ঘরের এক কোণে ছুঁড়ে ফেলে । পোশাক পরার পরে সে রঙিন চিরুনী দিয়ে গোঁফ সোজা করে। অর্থকড়ি গোণে। পার্সের ভেতর মাত্র চার রুবল এবং সত্তর কোপেক আছে । তারপর সে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে । ঠিক ছয়টার সময় সে মলচানোভকার একটা প্রাচীন গির্জার সামনে গিয়ে পৌঁছে । গির্জাটি আকারে ছোটো ও নিচু। গির্জার পেছনের বেড়ার পাশের গাছগাছালি সদ্য সবুজ পাতায় সজীব হয়ে উঠেছে। সেখানে শিশুরা খেলা করছে । মোজা পরা একটা মেয়ে দড়ির উপর লাফাচ্ছে এবং অনবরত নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে । সেখানে সে একটা বেঞ্চের উপর বসে । বেঞ্চে রাশিয়ান পোশাক পরা নার্সরা ঘুমন্ত শিশুসহ হাতে-ঠেলা গাড়ি নিয়ে বসেছিল । গাছের ডালে চড়ুই পাখির কিচিরমিচির করছে। যদিও গরম দিন, কিন্তু মৃদুমন্দ বাতাস, এমনকি ধূলোবালিতেও গ্রীষ্মের একধরনের উৎকট গন্ধ লেগে আছে । বাড়িগুলোর পেছনে সূর্যাস্তের উপরের আকাশ সোনালি রঙে গলে গিয়েছে । কেউ একজনের আরো একবার মনে হবে যে, দুনিয়ার কোথাও আনন্দ, যৌবন এবং সুখ আছে । ইতোমধ্যে গির্জার ঝাড়বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে । গির্জার ভেতরে উঁচু প্রচারবেদী। আর তার সামনে ছোট একটা গালিচা বিছানো রয়েছে । কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচ সতর্কতার সঙ্গে টুপি খোলে, যেন মাথার চুল এলেমেলো না হয়। দুরুদুরু বুক নিয়ে গির্জার ভেতরে প্রবেশ করে । সেখানে এক জোড়া নারী-পুরুষের বিয়ের অনুষ্ঠান চলছিল। বিয়েটা দেখার জন্য সে এক কোণে যায়। । সে কারুকাজ করা খিলানের দিকে তাকায়। আর ধীরে ধীরে মাথা উঁচু করে গম্বুজের দিকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় । নিস্তব্ধ ঘরের ভেতর তার প্রতিটি নড়াচড়া এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ প্রতিধ্বনি হয়ে বাজে । গির্জার ভেতর স্বর্ণের ঔজ্জ্বলতায় ঝলমল করে। আশাতীত ভাবে মোমবাতি জ্বলছিল । এই সময় যাজক এবং বাদ্যযন্ত্রীর দল প্রবেশ করতে শুরু করে । অভ্যাস মতো তারা এক একজন করে ভেতরে ঢোকে । তাদের পেছনে ঢোকে মহিলারা, শিশু, বিয়ের অতিথিবৃন্দ এবং অনুষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক চিন্তিত কর্মকর্তা । বারান্দায় শব্দ শোনা যায়। ঘোড়ার গাড়ীর চাকার ঘচাং শব্দ হয়। সবাই ঘাড় ঘুড়িয়ে প্রবেশদ্বারের দিকে তাকায় । একসঙ্গে মাহাত্ম্যের কন্ঠস্বর শোনা যায়, “আসুন, ভেতরে আসুন ।” কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচের মুখ পান্ডুর দেখায় । তার বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়ে যায়। অবেচতন মনে সে এক পা এগিয়ে যায়। তার সামনে দিয়ে একজন সুসজ্জিত নারী হেঁটে যায় – মহিলার ঘোমটার একাংশ তাকে স্পর্শ করে। পাগলপারা সুগন্ধি এসে তার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করে। এই পৃথিবীতে তার কোনো অস্তিত্ব আছে এটা মহিলাটি জানে না যেন । তার পাশ কেটে চলে যায় । একসময় সুন্দর করে সাজানো মাথা সে আনত করে । বরফ-সাদা ফুলে সজ্জিত তাকে অপূর্ব দেখায় – দেখায় নিষ্পাপ, সুখী এবং ভীরু । মনে হয় যেন কোনো রাজকুমারী তার আকাঙ্খিত পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে যাচ্ছে। বর যখন রাজকুমারীর কাছে আসে, তখন কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচ তাকে সামান্য দেখতে পেরেছে । বরের গড়ন ছোটখাটো, প্রশস্ত কাঁধ এবং আধেক ছাঁটা চুল । নিচু করে থাকা মাথা, পুষ্পরাজি, ঘোমটা এবং কম্পিত হাতের দিকেই সে অনুষ্ঠানের পুরোটা সময় চেয়ে ছিল। মনে হয় সেই হাত যেন সাদা ফিতার গিঁট লাগানো জ্বলন্ত মোমবাতি ধরে রেখেছে ।
আনুমানিক দশটার সময় সে হোটেলে ফিরে আসে। তার পরনের কোটে বাসন্তি হাওয়ার পরশ লেগে আছে । গির্জা থেকে ফিরে আমার সময় বারান্দার কাছ থেকে সে মখমলের সাদা ফিতা দিয়ে সুসজ্জিত বিয়ের গাড়িটি দেখতে পেয়েছে। গাড়িটির জানালার কাঁচে সূর্যাস্তের আলো বিকিরণ করছে । জানালার উল্টোদিকে গাড়ির ভেতর শেষ বারের মতো তার চোখ ঝলকে ওঠে । সেখানে বসে আছে তার প্রিয়জন। চিরদিনের জন্য তার দৃষ্টির সীমানা থেকে এই প্রিয় জন দূরে চলে যাচ্ছে । তারপর সে সরু পথ ধরে বিক্ষিপ্ত ভাবে হাঁটাহাঁটি করে। অবশেষে গাছগাছালি ঘেরা নোভেনস্কি সড়কে এসে পৌঁছে । একসময় সে কাঁপা হাতে খুবই ধীরে গায়ের ওভারকোট খোলে । একটা কাগজের ব্যাগের ভেতর দু’টো কাঁচা শশা টেবিলের উপির রাখে। এই শশা সে কোন কারণে দোকান থেকে কিনেছিল। কাগজের ব্যাগের ভেতর থাকার পরেও শশার গায়ে বাসন্তি হাওয়ার পরশ লেগে আছে । জানালার শার্সির কাঁচের উপরের দিকে তাকালে দেখা যায় দূরের আকাশের বুকে এপ্রিলের চাঁদ রূপালি আলোয় ফুটে আছে
তখনো আকাশ অন্ধকারে পুরোপুরি ডুবে যায়নি । কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচ একটা মোমবাতি জ্বালায়। মোমবাতির টিমটিমে আলো তার আটপৌড়ে এবং বিমর্ষ ঘরের ভেতর ছড়িয়ে পড়ে । তারপর সে সোফায় বসে। মুখমন্ডলে সন্ধ্যার সজীবতা উপলব্ধি করে । সোফায় সে দীর্ঘ সময় বসে থাকে । কাউকে ডাকার জন্য সে কোনো বেল বাজায়নি। কোনো আদেশও করেনি। বরং নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে । ক্লান্ত পায়ে কক্ষের ভেতর প্রবেশ করার সময় এবং দরজার ছিদ্র থেকে চাবি বের করার ভঙ্গি দেখে মুটে ছেলেটি সন্দেহ করেছে--সে ভেতর ঢুকে নিজেকে বন্দি করবে । কয়েকবার মুটে ছেলেটি নিঃশব্দে দরজার কাছে আসে। চাবির ফুঁটো দিয়ে ঘরের ভেতর দেখে । সোফায় কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচ বসে আছে। রীতিমতো কাঁপছে এবং রুমাল দিয়ে মুখমন্ডল মুছছে । গভীর দুঃখে এবং শব্দ করে সে কাঁদছে। এই কান্নার জন্য বাদামি রঙ গলে গিয়ে সারা মুখে ছড়িয়ে পড়েছে ।
রাতে সে জানালার পর্দার রশি টেনে ছেড়ে। অশ্রুভেজা চোখে কিছুই দেখতে পায়নি । তারপর সে কাপড় ঝোলানোর দড়ি দিয়ে বাঁধতে শুরু করে। কিন্তু তার উপর মোমবাতির কম্পমান শিখা আর কাগজের ব্যাগের জন্য বন্ধ ঘরে ভয়ঙ্কর অন্ধকারের ঢেউ বয়ে যায় । সে বুড়ো মানুষ। কমজোরি এবং সে নিজেই তা জানে--না, নিজের হাতে মৃত্যু বরণ করার মতো তার কোনো শক্তি নেই।
সকালে সে ট্রেন ছাড়ার প্রায় তিন ঘন্টা আগেই স্টেশনে গিয়ে পৌঁছে যায় । সে অন্যসব যাত্রীদের মতো স্টেশনে চুপচাপ হাঁটাহাঁটি করে । তার দৃষ্টি ছিল মেঝের দিকে। আর চোখ ছিল জলে ভেজা। সে অপ্রত্যাশিতভাবে কোনো না কোনো কারণে থামতে পারতো এবং মৃদু স্বরে, এমনকি কোনো ধরনের মুখভঙ্গি না করে, সে তাড়াতাড়ি বলতে পারতো:
“ঈশ্বরের দোহাই ... আমি মরিয়া ... ব্রিয়াঙ্কসে যাওয়ার মতো আমার ভাড়া ... যদি অল্প কয়েক কোপেকও হয় ...”
কয়েকজন যাত্রী তার টুপির দিকে, রঙচটা ওভারকোটের ছেঁড়া ভেলভেট কলারের দিকে, এমনকি বেগুনী রঙের গোঁফসহ ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকানোর চেষ্টা না করে বরং মনের মধ্যে সন্দেহ নিয়ে চটজলদি কিছু খুচরো দান করে ।
তারপর সে দ্রুত গতিতে স্টশন ছেড়ে প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ায় । সে মানুষের ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে। আর রীতিমতো হারিয়ে যায় । ‘ভার্সেই’ হোটেলের যে কক্ষে সে গত দু’দিন কাটিয়েছে, সেই কক্ষ তখনও তার নামে বরাদ্দ ছিল । তারা শোবার ঘর থেকে তরল পদার্থ ফেলার বালতি বের করে নিয়ে যায়। এপ্রিলের সূর্যের আলো আর টাটকা বাতাসের জন্য জানালার পাল্লা খোলে, সশব্দে আসবাবপত্র গোছগাছ করে, ধূলোবালি ঝাড়ু দেয়। ঝাড়ু দেওয়ার সময় তারা দেখতে পায় টেবিলের চাদরের নিচে, যা মেঝেতে ঝুলে ছিল, তার লেখা কাগজের ছেঁড়া অংশ, যা সে নিতে ভুলে গিয়েছিল:
“আমি ঘোষণা করছি যে, আমার মৃত্যুর জন্য কাউকে দোষারূপ করা যাবে না । আমি আমার একমাত্র মেয়ের বিয়েতে ছিলাম । আমার মেয়ে ...”
--------------------------------------------------------------------------------------------------------
পাদটিকা.
* নামের সঙ্গে পারিবারিক পদবী নেই । নামটি পোলিশ, রাশিয়ার নাম নয় ।
** গরম করার নলসহ রাশিয়ার একধরনের চায়ের পাত্র ।
লেখক পরিচিতি:
ইভান বুনিন
রাশিয়ার প্রথম নোবেল বিজয়ী কথাসাহিত্যিক ও কবি এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুতে রাশিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় লেখক হিসাবে পরিচিতি ইভান বুনিন [পুরো নাম ইভান আলেক্সেয়েভিচ বুনিন] ছিলেন তাঁর সমসাময়িক স্টাইলিষ্ট লেখকদের মধ্যে অন্যতম । রাশিয়ার সর্বকালীন শ্রেষ্ঠ লেখকদের মধ্যে অন্যতম কথাসাহিত্যিক লিও তলস্তয় এবং আন্তভ চেকভের স্বার্থক উত্তরসূরী হিসাবে তাঁকে গণ্য করা হয় । ইভান বুনিনের জন্ম ভোরোনেজ শহরে, ১৮৭০ সালের ১০ অক্টোবর । রাশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের ইয়েলেটস্ শহরে তিনি মাধ্যমিক স্কুলে লেখাপড়া শুরু করেন । কিন্তু পরিবারের দারিদ্রতার কারণে তিনি শেষ করতে পারেননি । পরবর্তীতে তাঁর বড় ভাই তাঁকে পড়াশুনা করান । একসময় তিনি ‘দ্য অরলভোস্কি হেরাল্ড’ পত্রিকায় কাজ করেন ।
কবিতা ও ছোটগল্প লেখার মাধ্যমে ইভান বুনিনের সাহিত্য জগতে পদার্পণ । প্রথম কবিতার বই ‘পয়েট্রি: ১৮৮৭-১৮৯১’ প্রকাশিত হয় ১৮৯১ সালে । পরবর্তীতে তাঁর বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় । এগুলোর মধ্যে ‘আন্ডার দ্য ওপেন স্কাই’ (১৮৯৮), ‘ফলিং লীভস্’ (১৯০১) এবং ‘পয়েমস অব ১৯০৭’ (১৯০৮) উল্লেখযোগ্য । ভাষার নিঁখুত ব্যবহার, জটিল প্রকৃতি ও পরিবেশের স্বাভাবিক বর্ণনা, বিশদ মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ এবং গল্পের আখ্যান ও বিষয়কে স্বার্থক ভাবে ফুটিয়ে তোলায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত । তাঁর লেখনির মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায় বিভিন্ন নকশা (স্কেচ) এবং ছোটগল্পে । এসব নকশা এবং ছোটগল্পের মধ্য রয়েছে ‘আন্তোনভ অ্যাপেলস’ (১৯০০), ‘দ্য ভিলেজ’ (১৯১০), ‘ড্রাই ভ্যালী’(১৯১২), ‘দ্য জেন্টেলম্যান ফ্রম সানফ্রান্সিস্কো’ (১৯১৬), ‘দ্য ড্রিমস্ অব চ্যাঙ’ (১৯১৬), ‘লাইট ব্রিদিং’ (১৯২২) এবং ‘গ্রামার অব লভ’ (১৯২৯) । ‘দ্য লাইফ অব আর্সেনিভ’ (১৯৩৯) তাঁর উপন্যাস । তিনি অসংখ্য ছোটগল্প রচনা করেন । ‘ডার্ক অ্যাভেনিউজ অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৩ সালে এবং তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয় ‘লুপি ইয়ারস্ অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ (১৯৫৪) । বিশ্বসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ১৯৩৩ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন । তিনি ছিলেন রাশিয়ার অভিবাসী লেখকদের মধ্যে একজন যার লেখা যোসেফ স্ট্যালিনের মৃত্যুর পরে সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রকাশিত হয় । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলে বসবাস করেন । সেই সময় তিনি নাৎসি বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে অস্বীকৃতি জানান ও ইহুদীদের কাছ থেকে নিজেকে আড়ালে রাখেন । তবে যুদ্ধের পরে তাঁকে সোভিয়েত ইউনিয়নে ফিরে যেতে আমন্ত্রণ জানানো হয় । কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে ফ্রান্সেই থেকে যান । তাঁর মৃত্যু হয় প্যারিসে, ১৯৫৩ সালের ৮ নবেম্বর ।
গল্পসূত্র:
‘কাসিমির স্ত্যানিস্লাভোভিচ’ গল্পটি ইভান বুনিনের একই শিরোনামের গল্পের অনুবাদ । গল্পটি ১৯৩৪ সালে ইংরেজিতে প্রকাশিত লেখকের ‘দ্য জেন্টেলম্যান ফ্রম সানফ্রান্সিস্কো অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ ছোটগল্প সংকলনে অন্তর্ভুক্ত এবং সেখান নেওয়া হয়েছে । রুশ ভাষা থেকে সংকলনের গল্পগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করেন ডি. এইচ. লরেন্স, এস. এস. কোটেলিয়ানস্কি এবং লিওনার্ড উলফ্ ।
*****
0 মন্তব্যসমূহ