ছ’জন মানুষ গাছেদের দুনিয়ায় থাকত। তিনজন ঝড়ের সঙ্গে আসত আর অন্য তিনজন জলের সঙ্গে। যদিও একসঙ্গে ওদের তিনজনের বেশি দেখা যেত না। তিনজন নদীতে লুকিয়ে থাকত। আর শুধু যারা ঝড়ের সাথে পাহাড় থেকে জল খেতে নিচে নামত তারাই ওদের দেখতে পেত।
যে তিনজন ঝড়ের মাঝে আসত তারা তাদের অন্তর্গত বিস্ময়ের খোলামেলা আবহে গ্রামাঞ্চলের মানুষের মধ্যে ঘোরাঘুরি করত।
যারা জলের সাথে আসত নদীর জলে তারা বহু সংখ্যা আর রঙে রঙিন ফল কামড়াতে গিয়ে বা পাখিদের চমকে দিতে গাছের ডাল থেকে ঝুলত।
সূর্য ওঠার আগেই যারা ঝড়ের সাথে আসত, অন্ধকার অন্ধকার যখন, তখন তারা পাখিদের মত পৃথিবীর মাটিতে জেগে উঠত। যে তিনজন জলের সাথে আসত তারা মাছের মত জলের গভীরে ফ্যাকাশে ও নমনীয় ঘাসের ওপরে, দারুণ ক্লান্ত এমন ভান করে গা ভাসিয়ে চলাফেরা করত। সূর্য ডুবে যাবার আগে তারা মাটির ওপর শুয়ে পড়ত।
যারা ঝড়ের সাথে আসত, পাখির মত তারা ফল খেয়ে বাঁচত।
যারা জলের সাথে আসত, মাছেদের মত তারা নক্ষত্র খেয়ে জীবন ধারণ করত।
যারা ঝড়ের সাথে আসত, সাপেরা যেমন পাতার নিচে কিংবা উঁচু ডালে কাঠবেড়ালি, কোয়াতিস, বানর, কিঙ্কাজোউস হনি বিয়ার, গাররোবো গোসাপ, র্যাকুন এইসব প্রাণিদের মাঝে ইচ্ছে করে হারিয়ে যায়, ঠিক সেভাবে রাতটা জঙ্গলে কাটাত।
যারা জলের সাথে আসত, জলজ ফুলের মধ্যে লুকিয়ে থাকত কিংবা স্বপ্নের মত টিকটিকির গর্তে পালিয়ে যেত, নইলে শালতির মত নোঙর ফেলে ঘুমোত।
আর যারা ঝড়ের সাথে গাছেদের গায়ে আসত তারা জল কেটে কেটে যেত। ঝড়ের সাথে আসা তিনজন জলের সাথে আসা তিনজন খারাপ ফলের থেকে ভালো ফলগুলো আলাদা না করেই খিদে মেটাত। কেননা প্রথম ধরনের লোকগুলোর কাছে কোন ফলই খারাপ ফল হত না, সব ফলই তাদের কাছে পৃথিবীর রক্ত। তাদের যার কাছে যেমন গাছ থাকত সেই অনুযায়ী ফলগুলোর মিষ্টি হয়ে ওঠা, টোকো হয়ে যাওয়া সম্ভব হত।
পাখির বাসা!
পাখিদের মধ্যে কিচমিচ আওয়াজ তুঙ্গে উঠেছিল।
বাতাসের সঙ্গে আসা লোকেদের মধ্যে একজন তার সঙ্গীদের দেখবার জন্য ফিরে এসেছিল তারা ওকে “পাখির বাসা” বলে ডাকল।
মোন্তে ছিল পাখিদের মধ্যে তার বাবা আর মায়ের স্মৃতি। একরকম বোকার মতই বয়ে আসা জলের মত রঙ তার। দুনিয়া জয় করার জন্য ওরা যাকে মেরে ফেলেছিল। ওর চোখের পাতার রঙ ছিল সোনারঙ। ওরা যাকে কালো ক্রশ এর গভীরে কড়ে আঙুলের মত আকারের মেয়েলি মাছের গন্ধের মাঝে আড়াল করে রাখত।
ভেজা সমুদ্রতীরটাকে সে মারা যাওয়াতে ওরা জয় করে ফেলেছিল। তার ফলে তীরের সৌন্দর্য পটরেখা জেগে উঠেছিল, যার একটা মন্ত্রের মত সুর ছিল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কালো পপলার গাছ আর দুরের জঙ্গলসমূহ, পাহাড়, নদী যেখানে উপত্যকার বিস্তৃত দৃশ্য অচল হয়ে থেমে থাকত... গাছেদের পৃথিবী!
সেই সূক্ষ্ম প্রাকৃতিক সমুদ্রতীর ধরে কোন বাধা ছাড়াই ওরা এগিয়ে গিয়েছিল যেন সেটা কোন আলোর হীরকহার। যতক্ষণ না ঠিক পরের মাথাগুলোর ওপর সবুজ মুকুট দেখা যায়, এবং নদীর কাছাকাছি এগিয়ে এসে প্রথমবারের মত তেষ্টা মেটানোর জন্য গিয়েছিল ওরা। দেখেছিল তিনজন মানুষ জলে পড়ে গেল।
“পাখির বাসা” তার সঙ্গীদের আশ্বস্ত করল। তারা সবাই অদ্ভুত চলমান উদ্ভিদ ছিল, যারা কথা বলতে না পেরে নদীর জলে নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখছিল।
- এগুলো আমাদের মুখোশ। এদের আড়ালে আমাদের নিজেদের মুখ আছে! এগুলো আমাদের ডামি। এরা থাকলে আমরা ছদ্মবেশ খুলতেই পারব না। এরা আমাদের মা, আমাদের বাবা, আর পাখিদের মধ্যে তাদের প্রতিনিধি হিসাবে ছিল মোন্তে। পাখিদের আমরা পৃথিবী জয় করতে গিয়ে মেরে ফেলেছিলাম। তারা আমাদের প্রেতাত্মা! আমাদের প্রকৃতিজাত।
প্রায় গাছের ডালের নিচটাতেই কাচের মত স্বচ্ছ তরল বাতাস। উপরিভাগের আলোআঁধারিতে নীল স্বচ্ছতা নিয়ে এবং গভীরে ফলের অপরিপক্কতা নিয়ে জঙ্গল শক্ত মাটিতে সমুদ্রের আভাস দিয়ে যায়।
যেন সমুদ্র থেকে দূরে সরে যাওয়ার কাজ অবশেষে সম্পন্ন হয়েছে। যেন জলের তৈরী আলো দেখা যেত প্রতিটি পাতায়, প্রতি পুষ্পলতায়, প্রতিটি সরীসৃপে, প্রতিটি ফুলে, প্রতি কীটের ভেতর...
জঙ্গলটা চারিয়ে গিয়েছিল আগ্নেয়গিরি পর্যন্ত। ফুঁসে ওঠা, ঘন, বেড়ে ওঠা আগ্নেয়গিরিটি ছিল চড়চড়ে আওয়াজ আর সাপের বন্ধ্যা উর্বরতায় ভরা। পাহাড়ের গায়ে বিস্ফোরিত পাতার সমুদ্রে তারা এঁকে দিত। পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানো জন্তুদের পায়ের চাপে উপচে পড়া সমতলে ... সূর্য-এর শ্বেত কণিকা এবং প্রজাপতির ভেতরেও চারিয়ে গিয়েছিল জঙ্গলটা। ।
তিনজন মানুষকে টেনে এনেছিল এমন একটা কিছু যা খন্ডে খন্ডে ভেঙে গিয়েছিল মেঘে। আর সেটা তাদের ঝিকিমিকি ঝলসানির ভেতর থেকে টেনে বের করে এনেছিল।
নদীর পায়ে চলার পথে দুটো পাহাড় তাদের চোখের পাতা সরিয়ে দিয়েছিল।
ওরা তাকে কাব্রাকান বলে ডাকত। সে এমন পাহাড় যার দুহাতের ভেতরে একটা জঙ্গলকে কেটে কুচিকুচি করার আর একটা শহরকে তার কাঁধে উঠিয়ে নেবার ক্ষমতা ছিল। যতক্ষণ না পৃথিবী জ্বলে ওঠে ততক্ষণ আগুনের লালার থুতু ফেলেছিল সে।
এবং সে আগুন জ্বালিয়েও দিয়েছিল।
ওরা তাকে উরাকান বলে ডাকত। সে ছিল মেঘের পাহাড়। নখ দিয়ে জ্বালামুখ চিরে দেবার জন্য সে আগ্নেয়গিরির মাথায় চড়েছিল।
সহসা আকাশ মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল, একটা গোটা দিনকে সূর্যবিহীন করে রেখে দিয়েছিল। শয়ে শয়ে ক্যানেস্তারার আওয়াজে ভয় পেয়ে খেচরেরা পালিয়ে যাচ্ছিল। ঝড়ের সাথে আসতে থাকা, ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা মাটির ওপরে নিরস্ত্র সেই তিনজন মানুষের চিৎকার ওদের কানে পৌঁছচ্ছিল না।
ধ্বংসস্তূপ থেকে বানরেরা পালিয়ে গেছিল। গাছের ডালের ফাঁকে পালানোর পথ ছিল। বাষ্পীভবনের মত উড়ে পালিয়ে গিয়েছিল হরিণেরা। বিশাল ঘূর্ণিবায়ুর মধ্যে পড়ে বোকাদের চোখের তারায় পাহাড়ের সব গাড়ি আর যত সিন্ডারেলারা জট পাকিয়ে গেছিল।
দাঁত খিঁচিয়ে অন্ধকারে একে অন্যকে ছুঁয়ে থাকতে থাকতে নেকড়েরা পালিয়েছিল। সে কী কাঁপুনি......!
ভয়ে অস্থির হয়ে রঙ বদলে গিরগিটিরাও পালিয়েছিল, তারপর তাকুয়াজিন ছুঁচো, ইগুয়ানা সরীসৃপ, তেপেস্কুইন্তেল বীভার, খরগোশ, বাদুড়, ব্যাঙ, কাঁকড়া, কুতেতে সরীসৃপ, তালতুসা বীভার, কোয়াতিস ভালুক, চিনচিনতোরেরাও পালিয়ে গেছিল। এর ছায়াই তাদের মেরে ফেলেছিল।
পিটভাইপার সাপেরা পালিয়েছিল। তাদের পিছু পিছু র্যাটলস্নেক ভাইপার সাপেরাও। দীর্ঘ পর্বতশ্রেণী জুড়ে যাদের তীক্ষ্ণ শিস আর লেজের ঝাপট বহু অধ্যবসায়ে আগুনের তীব্রতার ছাপ ফেলে রেখে গিয়েছিল। র্যাটলের লেজের ঝাপট আর ভেদকারী শিস জুড়ে গিয়েছিল একসাথে আর ভাঙ্গনের আওয়াজ এখানে ওখানে পুঁতে রেখে গিয়েছিল মাথাগুলো। দিগন্ত জোড়া মাঠ উন্মুক্ত করার জন্য চাবুকের আওয়াজ থেকে ভারমুক্ত করে গিয়েছিল।
তারা তাকালেই যখন মরে যাচ্ছিল গিরগিটিরা তখন সেখান থেকে পালিয়েছিল। আমেরিকান দান্তা হরিণেরা পালিয়েছিল, বিষধর বাসিলিস্ক সরীসৃপেরা পালিয়েছিল। পালিয়েছিল জাগুয়ার (সূর্যের ছিটিয়ে রাখা পাতারা) , পোষ মানানো ঘরোয়া পুমা, টিকটিকি, ছুঁচো, কচ্ছপ, ব্যাঙ, জোরিল- রা, প্রিয়জনেরা, সজারু , মাছি , পিঁপড়েরাও ...
আর শেবা গাছের গায়ে ধাক্কা খেতে খেতে পাথরেরাও বড় বড় লাফ দিয়ে পালাতে শুরু করেছিল। মরা মুরগীর মত পড়ছিল তারা। সবকিছুর দৌড়নোর কথা ছিল। জল, মাটির শিরায় শিরায় বয়ে যাওয়া রক্তকে অনুসরণ করে গড়িয়ে যাচ্ছি। সঙ্গী তার মাড়িতে বয়ে নিয়ে যাওয়া বিশাল সাদা একটা তেষ্টা। জ্বলন্ত লাভা যাদের পা মুছে দিয়েছিল সেইসব হরিণ, খরগোশ, পুমা, জাগুয়ার, কোয়োটে নেকড়েরা পালাচ্ছিল। ফুটন্ত নদীতে বয়ে চলছিল মাছেদের মৃতদেহ। পোড়া আলোর গুঁড়োতে চকচক করছিল যে জায়গাটা সেখানে পাখিদের পায়ের ছাপ। সূর্যের দৃষ্টিতে তখন ছাই ছাই আলো। ওরা ঝরে পড়ছিল পৃথিবীর বুকে। অন্ধ ভিখিরীটি জানত না যে ওরা তারার দল। ওরা যাতে না পুড়িয়ে দেয় তাই ওদের সে নিভিয়ে দিয়েছিল।
“পাখির বাসা” তার সঙ্গীদের আর সেই সঙ্গে তার সঙ্গী জোড়াটিকেও ঝড়ের গতির মুখে অদৃশ্য হতে দেখল। জলকে দেখল দ্রুত আগুনে অদৃশ্য হয়ে যেতে। ভুট্টা ক্ষেতের মাঝ বরাবর আকাশ থেকে বিদ্যুতের সঙ্গে ঝরে পড়েছিল তারা। যখন সে একা ছিল তখন শুধু ‘প্রতীক’ই একা বেঁচে থাকত। প্রতীক বলে উঠল- একদিনে এক শতকের ঘটনা ঘটে গেল যা বহু শতক ধরে টিকবে।
সেদিন গোটা দিনটা জুড়েই ছিল দুপুর। ঝকঝকে কোন গোধূলি বা ভোরের আলো ছাড়াই এক অটুট স্ফটিকের দিন।
“পাখির বাসা” র মনের ভেতর কে যেন ডেকে উঠল – অবশেষে এই পথে...
আমি কিন্তু কথা চালিয়ে যাই নি কেননা একটা নাটক্র্যাকার পাখি খুব কাছ দিয়ে চলে গেছিল। এতটাই কাছ দিয়ে যে তাহলে শুনতে পেত আমাদের কথা।
পরে “পাখির বাসার” মনের কন্ঠটি বৃথা অপেক্ষা করেছিল। অপেক্ষা করতে করতে সে বরং তার কন্ঠের পুনর্জন্ম ঘটায়। তার আত্মার ইচ্ছে হয়েছিল অন্য সুরের ছলে এক অচেনা দেশের দিকে হেঁটে যাওয়ার।
সে শুনতে পেল ওরা তাকে ডাকছে। অন্তহীন এক পথে, যেন সাপের রুটি আঁকার মত দৃশ্যপটে আঁকা ছবিটি, ওরা যাকে বড় গভীর গলায় ডাকত।
পথের বালুকণারা যেতে যেতে ডানায় রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছিল আর এটা দেখবার ছিল তারা কীভাবে পৃথিবীতে পায়ের কোন ছাপ না রেখেই, পিঠে এক কণা বালি নিয়েই এক ফালি সাদা আকাশে পৌঁছে গিয়েছিল। ।
সে হাঁটছিল আর হাঁটছিল।
সামনে জায়গাগুলোর চারপাশ ঘিরে এক আওয়াজ ছিল। মেঘেদের মাঝখান থেকে সেই কন্ঠ বারবার তার নাম বলছিল।
“পাখির বাসা”
“পাখির বাসা”
“পাখির বাসা”
“পাখির বাসা”
“পাখির বাসা”
“পাখির বাসা”
“পাখির বাসা”
গাছগুলো পাখির বাসায় ভরে গিয়েছিল। একটি ম্যাডোনা লিলি আর এক শিশুকে দেখেছিলেন কোন এক সন্ত। একজন সন্ত, একটি ফুল ও এক শিশু- এই পবিত্র ত্রয়ী শিশুটিকে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা শুনতে পেয়েছিলেন-
- “পাখির বাসা” আমি চাই তুমি আমায় একটা মন্দির গড়ে দাও!
ঝড়ে দুলতে থাকা গোলাপের স্তবকের মত তার গলা খুলে গিয়েছিল। আর সন্তের হাতে ফুটে উঠেছিল ম্যাডোনা লিলিফুল ও শিশুদের মুখের হাসি।
সেই দূরের দেশে কাচের গুটির মাঝখানে থাকা মেঘেদের মাঝখানে তার মিষ্টি প্রত্যাবর্তন হল। আগ্নেয়গিরিটি যেন তার হৃদয় বুজিয়ে দিচ্ছিল। তার ভেতরে কেঁদে কেঁদে চোখের জলের পুকুরে সে যেন জিপসির মত বন্দিনী। “পাখির বাসা”, যে কিনা তখনো তরুণ, বহু শতক টিকে থাকলেও সেদিনের পরে বুড়ো হয়ে গিয়েছিল। আর তার সময় ছিলনা। বরং এক জনপদকে ডুবিয়ে মারার জন্য সেই গ্রাম ঘিরে থাকতে থাকতে সে বুড়ো হয়ে গিয়েছিল। সময় হলেও সে তাকে ছেড়ে যায় নি। বরং কোন এক মন্দিরের চারপাশে একশ বাড়িওয়ালা একটি গ্রাম স্থাপন করতে সে রয়ে গিয়েছিল।
অনুবাদক
জয়া চৌধুরী
জয়া চৌধুরী
0 মন্তব্যসমূহ