মুর্শিদা জামানের গল্প: বহিরাগত

অনেক কিছু ছাড়তে পারলেও ব্লাক কফি আর ইজি ব্লাক ছাড়তে পাড়ছেনা শিলু। টানা তিন মাসের জন্য মানুষের বসতি ছেড়ে এই নিবিড় নির্জনে ছুটি কাটাতে এসেছে তবু লাভলি সিগারেট আর ডারলিং কফি সঙ্গে করে আনতে ভোলেনি। এমনকি দু’প্যাকেট কনডমও সাথে এসেছে।
বলা তো যায় না তিন মাসের এই ছুটিতে প্রেম জুটিয়ে ফেলে যদি! প্রেমের কথা ভাবতেই শিলু সিগারেট ধরাল একটা। শীতের নরম রোদ ক্ষয়ে বাদামি আভা ছড়াচ্ছে চারদিক। বাগানে হরেক রঙের গোলাপ, তাতে জলের পাইপ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে মালি। এই যে এত ফুল, এক রত্তি গন্ধ পায় না শিলু। পাপড়ি মেলে শুধু তাকিয়ে আছে গন্ধহীন গোলাপ।
অপূর্ব কাঠের বারান্দা তাতে বেতের চেয়ার আর আস্ত গাছের গুড়ি দিয়ে তৈরী মসৃণ টেবিল পাতা। শিলু যতবার এই গুড়িসমেত টেবিলটি দেখে ততবার নানাভাইয়ের মুখ দেখতে পায়। ছেলে বেলায় গরমের ছুটিতে কুষ্টিয়ায় গেলে দেখতো নানাভাই মাথায় গামছা বেঁধে নিড়ানি হাতে বাগান পরিস্কার করছে। শিলুও নানাভাইয়ের মত মাথায় গামছা চাপিয়ে নেমে পড়তো বাগানে। এটা ওটা তুলতো যখন নানাভাই ধরে ধরে চিনিয়ে দিত কোনটা আকন্দ, কোনটা ধুতুরা, কোনটা কালো কেশুড়। একবার এক বটের চারা টান দিয়ে তুলে ফেলতে যাচ্ছিল তখন নানাভাই দৌড়ে এসে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল, তুলনা এ হচ্ছে গাঁয়ের শোভা।

সেদিন নানাভাই এর কথার মাথামুন্ড বোঝেনি শিলু। তবে বড় হবার পর দেখেছে গ্রামের সীমায় দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বিশাল ডাল-পালা-পত্র-মায়া ছড়িয়ে বয়োঃবৃদ্ধ বট বৃক্ষ। কতশত আনন্দ, ভালোবাসা, জরা, মৃত্যু, শোক ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই। খোলা বারান্দা জুড়ে শিলুর ছুড়ে দেয়া ধোয়ার কুন্ডুলি। আর তার ভেতর ভাসছে ওর উ™£ান্ত ভাবনা। সবকিছু কেমন একঘেয়ে স্বাদহীন লাগছিল চুয়াল্লিশটা বছর পর নিজের মুখটাও বুঝি অচেনা। সেই একই সকাল, হুড়মুড় তান্ডব রান্নার ঘরে। চুলায় তাওয়া চাপাওরে, অমলেটে নুন ছড়াওরে, তারপর জুসারে কমলা লেবুর ঘূর্ণির সাথে সাথে ঘিলুর ভেতরও চলতো ঘূর্ণি, ঘড়ির কাটা টিক... টিক... টিক... খাওয়া হলো কি হলো না দে ছুট অফিস, এরপর একগাদা ফোন ইমেইল, বসের ঝাঁঝালো দৃষ্টি এবং বোরিং লাঞ্চ, বোরিং কলিগস, বোরিং টয়লেটের আয়না। ঘরে ফিরে চপিং বোর্ডে কাটাকুটি এবং যথারীতি রাতে শীতল ছটফট! যেন ভাগ্য ওর সাথে পণ করে ঘড়ির কাটার মত বাজিয়ে যাচ্ছিল ঘন্টা। সত্যি আর পারছিলনা ও। প্রেমহীন জীবনে আকন্ঠ বিষাদে ডুবে যাচ্ছিল যখন তখনই ধাম করে বলে দিল একদিন আরিফকে, “আলাদা থাকতে চাই”। বাক্য তো না যেন বোমা হয়ে ফুটেছিল সেদিন। সে বোমার ছাই ভস্মে আরিফের মুখখানা দেখার মত হয়েছিল বটে। হয়ত মুক্তির আনন্দে সেও ভাসছিল। কে আর চায় মধ্যবয়সে জোড়াতালির সংসার। হ্যাঁ শিলুকে বহুরাত বারান্দার ঠান্ডা রেলিং ধরে কাঁদতে হয়ছে একটু বন্য আর উদ্দাম ইন্টারকোর্সের জন্য। কিন্তু না আরিফের সেই একই আলোহীন গভীর রাত আর নিরব সঞ্চালন। যেন ওরা চুরি করতে এসেছে, যেন কত পাপ এতে এমনই ছিল তার ভাব। কিন্তু শিলু ধীরে ধীরে আবিস্কার করে নিজেকে। নিজের আমূল তৃষ্ণাকে! কতদিন অফিস ফিরতি পথে দাড়িভর্তি মুখের তীব্র চোখের পুরুষ দেখে ঝিমঝিম ভাব নিয়ে ফিরতো বাসায়। কোন কোন দিন অসম্ভব আদরে আরিফকে জড়িয়ে ধরলে সে বলতো, প্লিজ এখন না রাত হোক!

এরপর তো পদোন্নতির পর পদোন্নতি, কাজের ধাক্কায় শিলুর ভেতরে থাকা বন্য গন্ধ উবে গিয়েছিল একেবারে। ধুম করে অন্ধকার নেমে এলো। রাতের আগমন। ভালো লাগছে এই নিশ্চুপ অন্ধকার। মনের অজান্তেই ফোন খুঁজলো কিছুক্ষণ। ভুলেই গিয়েছিল, ও তো সমস্ত যোগাযোগের বাইরে এখন। সিলেটের এই রিসোর্টটি ওর চেনা এক বন্ধুর। দু’একবার অফিস ট্যুরে ঘুরেও গিয়েছে এর আগে। ফলে অনেকটা নির্ভার নির্বাসনেই আসতে পেরেছে। মজা হলো এটা একেবারেই নির্জন জায়গা। এব বেশ আন্তরিক এর সার্ভিস। ঘরে এসে ঝিন্দের বন্দি খুলে বসল ও। না পড়তে পড়তে অনভ্যাসে পরিণত হয়েছে মনোযোগ, খুব টের পাচ্ছে শিলু কিন্তু জেদ এঁটে বইয়ের পাতায় চোখ নিবন্ধ করে থাকলো। বেশ বেলা করে ছাড়লো বিছানা। ঘুম ভেঙ্গে যায় সেই আগের নিয়মে ছ’টায়। তবু পড়ে থাকলো শরীর আলগা করে। এ কটা মাস যা খুশি যা ইচ্ছে তাই করবে বলে মনস্থির করলেই কি, ওর আঙ্গুল তো কিড়মিড় করছে ফোনের স্ক্রীন স্ক্রোল করার জন্য। জানলার ধারেই ইউক্যালিপটাস গাছের পাতা বাতাসে দোল খেলছে। ইস দাদীর গায়ের গন্ধ যেন। বাবা যেখানেই গিয়েছেন মনে করে দাদীর জন্য ইউক্যালিপটাসের তেল নিয়ে আসতেন। দাদীর বাপের বাড়ি ছিল চব্বিশ পড়গনা। যেমন ধীর স্থির ছিল তাঁর মুখের ভাষা তেমনি ছিল পরিপাটি জীবনচারণ। বাবা ও কতকটা মায়ের স্বভাব পেয়েছিল কিন্তু শিলু? ও কার স্বভাব পেল - মায়ের না দাদীর না বাপের। তবে এটা বিশ্বাস করে অন্যদের মত না শিলু। আর একারনেই অনেক কিছুর সাথে নিজেকে নুইয়ে ফেলেনি কোনদিন। ইলেট্রিক কেটলিতে জল ফুটাতে দিয়ে ব্রেকফাস্ট চাইলো ফোন করে। নাহ আর এমন বেলা করে বিছানা ছাড়বেনা। শরীর ম্যাড়ম্যাড় করছে। এমা, রোদ তো তেতে উঠেছে প্রায়। যদিও রিসোর্ট এর নানা প্রান্তে কাঠের, বাঁশের বেঞ্চ পেতে বসার ব্যবস্থা আছে গাছের নিবিড় ছাঁয়ায়। ভাবছে পশ্চিমের ঐ বাঁশ ঝোপের কাছে দড়ির দোলনায় সময় কাটাবে একদম দুপুর নাগাদ। বই আর ক্যামেরা নেবে সাথে। ওদিকটায় প্রচুর অর্কিড ফুটেছে। হরেক রঙের প্রাজপতির আড্ডাও বেশ।

সময় যেন থির হয়ে আছে এখানটায়। হ্যামকে গা এলিয়ে বইয়ে যতনা দৃষ্টি অবনত তার চেয়ে বেশি নজর মালি বউয়ের বাসন মাজা অবস্থারত মাংসল পশ্চাৎদেশে। বাপরে! কি করে ওমন সুডৌল রেখেছে কে জানে। বিয়ের পর এনিয়ে কম কথা শোনায়নি ননদ জায়েরা। এমা! কি বউ! বুক পাছা মেশানো একেবারে! আরিফের অবশ্য কোন বোধবালাই ছিল না তাতে। কোনমতে বেড় হলেই চলতো ওর। তবুও শিলু চায় মালি বউয়ের মত ওমন ভারি পাছা, ব্লাউজ উপচানো মাখো মাখো বুক। রুপালি চেনের সাথে ফিকে গোলাপি রঙের পাথর নেমে গেছে বুকের ভাঁজে মতিয়ারা বানুর। ও যখন উপুর হয়ে পাতা ঝাড়ু দিচ্ছিলো সেদিন স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিল শিলু পাশের কটেজের ভদ্রলোকটি বউয়ের সাথে চা পান করতে করতে কালো বুকের ভাঁজেরও রসভোজনে ব্যস্ত ছিল। রিসোর্টের একেবারে শেষ প্রান্তে মাটির দেয়াল আর গোলপাতার ছাউনি আঁটা কুড়েতে মতিয়ারা বানুর সংসার। স্বামী-স্ত্রী মিলে মনের সুখে খেটে খায়। কি করে কি করে যেনো জুটে যায় এখানে। শিলু মনে করে এবার লেবু রঙের কাঁচের চুড়ি আর শাড়ি এনে দিয়েছে। বিনিময়ে যে হাসির ঝিলিক পেয়েছে ও তাতে সব ক্লান্তি চলে গিয়েছিল সেদিন। বছরের এ সময়টায় তেমন লোকজন থাকেনা রিসোর্টে। এবার মাত্র ওকে দিয়ে তিনটে কটেজে লোক আছে। পূবের দিকের কটেজটির নাম সোনালু। ওখানে উঠেছে প্রায় মধ্যবয়সি দম্পতি। বিকেলের দিকে পুকুরে দুজনই ছিপ পেতে বসে থাকে। শিলু দেখেছে দুজনেই বেশ কম কথা বলে দুজনের সাথে। তবে খুব গোছানো তারা। ছুটি কাটানোর পুরো সময়টা তাঁদের পরিপাটি ছকে বাঁধা। বিকেলে মাছ ধরা তো সকালে বাগানে হাঁটা। রাতে বারান্দায় বসে টিমটিমে আলোয় খাবার খাওয়া। ভদ্রলোকটির ডান গালে গভীর কোন ক্ষতের চিহ্ন যেমন ডান হাতের অনামিকায় তেমন জ্বলজ্বলে হিরে। শিলুকে কেমন টানে ব্যাপারটা। ইচ্ছে করে কথা বলতে, আড্ডা দিতে।

মতিয়ারা বানু বাসনগুলো রোদে উপুর করে দিয়ে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। মুখটা ঘামে জবজবে।

-​আইজ কি সাঁতার শিখবেন আপা?

শিলু পাতলা ট্রাউজার আর টিশার্ট পরে আছে। এই পোশাকে নামবে কি নামবে না ভাবনার দোলায় একটু দুললো মাত্র। চট করে নেমে এলো দোলনা থেকে।

-​হ্যাঁ চল। তোমার কাজ নেই তো এখন?

আবার সেই ঝিকঝিকে হাসি। কি ঠান্ডা পানি। অল্প স্বল্প সাঁতার জানে ও কিন্তু মতিয়ারা বানুর মত পুকুরে এপার ওপার করা সাঁতারটা শিখতে চায়। এ তো একদিনের কথা নয়। রোজ পুকুরে নামতে হবে ওদের। হাত পা এমন ভারি যে মোটেও ভেসে থাকতে পারছে না শিলু। মতিয়ারার শক্ত হাত মুহূর্তেই ধরে ফেললো ওকে। কৌশলগুলো শিখছিল যখন শিলু বার দু’য়েক মতিয়ারা বানুর বুকে ঘেঁষা খায় ওর মাথা। হোক না একই শরীর তবুও কেমন অস্বাভাবিক ফাঁকা ফাঁকা বোধ কাজ করে শিলুর মস্তিস্কে। কয়েক দফা দাপাদাপি করে আজকের মত ক্ষান্ত দিল সাঁতার শেখায়। মতিয়ারা বানু ওর সামনেই আঁচল সরিয়ে বুকের ভেতর হাত চালিয়ে একটা সাদা চিংড়ি বের করে আনলো। এরপর স্বাভাবিক গলায় বললো,

-​আর তিন চারদিন নামলে পানির ভাও শিখে যাবেন। তখন আমাকে ছাড়াই সাঁতড়াতে পারবেন।

পুকুরের পাড় হতে বাসনকোসন নিয়ে দুলতে দুলতে মতিয়ারা বানু চলে যায় সংসারে, চুলায় ভাত ফুটাতে, তরকারি কুটতে..... হয়তো স্বামীর সাথে ভাত খেয়ে ও দুপুরের ঘুম ঘুম বিছানায় শিলুর মত স্বামীকেও সাঁতার শেখাবে। শিলু কত কি ভাবে যে .......... কটেজে ফিরে মনে পড়ে বই ফেলে এসেছে দোলনায়, সাথে ক্যামেরাও। দুপুরের মেনুতে চিংড়ির মালাইকারি, কলমি শাকের ভেতর টাকি মাছের মাথা, কোয়েলের ডিম ভুনা আর চালতা ডাল। কিছুই খেতে ইচ্ছে হলোনা ওর। অনেকদিন পর মনে হচ্ছে এসব না মায়ের হাতের এক নলা ভাত খেতে ইচ্ছে করে। মা তো সেই ভাইয়ের সাথে আমেরিকা প্রবাসী। সংসার এক অদ্ভুতুরে ধাঁধা। চাইলেই যখন তখন যাকে তাকে পাওয়া যায় না। মা যখন বাপের বাড়ি থেকে ফিরতো গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ওদের স্কুলের ড্রেস কেঁচে দিত, আয়রন করে দিত। চুলে ঝুটি বেঁধে দিত।

বারান্দার চেয়ারেই ঘুমিয়ে গিয়েছিল ও। হঠাৎ জেগে গেলো মেঘের ডাকে। বৃষ্টি আসবে মনে হচ্ছে। রুম সার্ভিসের কল। ফোন তুলতেই, গম্ভীর স্বরে,

-​এক্সকিউজ মি, আপনার বই এবং ক্যামেরাটা বোধহয় ফেলে এসেছিলেন। এখানে রেখে যাচ্ছি কেমন।

-​প্লিজ, অনেকটা কাকুতির মত শোনা গেল শিলুর গলা।

-​এক্ষুনি নামছি। একটু দাঁড়ান।

বেতের চেয়ারটায় যে মানুষটি বসা সে আর কেউ নন, পূবের কটেজে আসা ভদ্রলোকটি। শিলু চোখ বুলিয়ে বউকে খুঁজলো পলকে। না নেই।

-​স্যরি, আপনি কষ্ট করলেন। আমি শিলা মাহতাব।

-​ওহ, হাফিজুর রহমান।

বাহিরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে এরই ভেতর। দুজনেই বাহিরে তাকিয়ে হাসলো। চলুন ওপরের বারান্দায়। অন্তত কফি খাওয়ানোর সুযোগ দিন আমাকে। বলেই শিলু অবাক। একটু কি বেশি বলা হয়ে গেল।

-​আপনি বুঝি জার্নালিস্ট?

ক্যামেরাটা বাড়িয়ে দিতে দিতে বললেন হাফিজুর রহমান।

-​আরে না না, শখে ছবি তুলি।

কফি নিয়ে বারান্দায় বসতে না বসতে বজ্রপাত। এবার আলাপ মার্জিন মতো এগোতে থাকলো। শিলু জানে মাটির দেয়াল ঘেরা ছোট্ট কুঁড়েতে তখন কি চলছে। মনে হচ্ছে এক ছুঁটে গিয়ে মতিয়ারা বানুকে বলে চল আমি আবার পুকুরে নামতে চাই। আমাকে সাঁতার শেখাও।

-​আপনার কাছে ছাতা আছে?

-​উ! ওহ স্যরি নেই তো!

হাসলেন হাফিজুর রহমান।

-​কিছু ভাবছিলেন বুঝি?

-​নাহ। তেমন কিছু নয়। আচ্ছা বৃষ্টিতে ভিজলে কেমন হয়?

-​ভালোই। তবে অসময় হয়ে যায়না এখন?

-​ছুটি কাটানোর দিনে সময় আবার অসময় কি! মন যা চায় তাই করে ফেলা ভালো নয় কি?

-​আসলেই তা পারা যায়?

পাল্টা প্রশ্ন করলেন ভদ্রলোক। শিলু সামান্য হাসলো।

-​আপনার ওয়াইফ খুঁজছে নিশ্চই আপনাকে?

গালের ক্ষতে লম্বা রেখা ফেলে কোমল হাসলেন হাফিজুর রহমান।

-​ও আমার যমজ বোন। সম্প্রতি ওর হাজবেন্ড মারা গিয়েছেন। ছেলেপুলেরা বাইরে থাকে। আমি ছুটে এসেছি পর্তুগাল থেকে। এখানে সেখানে নিয়ে যাচ্ছি। সংসারের চাপে কিছুই তো দেখেনি বাইরের দুনিয়া। এখন সব ছুটি মিলেছে সুবর্ণার। বলেই আবার হাসলেন। তবে রেখা ফেলে নয় ঠোঁট টিপে। সবশুনে রীতিমত চমকে গেল শিলু।

-​আই অ্যাম স্যরি।

-​আরে না না। সবাই একই ভুল করে।

প্রশ্ন চালাচালি আর কতক্ষণ করবে জানেনা ও। একটু দম নিলো বুঝি। হঠাৎ,

-​চলুন বৃষ্টিতে ভিজি।

বলেই চেয়ার ছাড়রেন হাফিজুর রহমান।

-​ওহ প্লিজ। আপনার ঠান্ডা ধরে যাবে তো!

জবা গাছের এতগুলো ঝোপ এদিকে খেয়ালই করেনি শিলু। ভিজতে ভিজতে ওরা পশ্চিম প্রান্তে চলে এসেছে প্রায়। পায়ের তলায় লাল ইটের কুচি সুড়সুড়ি দিলেও ভালোই লাগছে খালি পায়ে হাঁটতে। তাড়াহুড়োয় চটি আনতে পারেনি। প্রাচীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা অর্জুন গাছগুলো ভিজে অদ্ভুত আকৃতি পেয়েছে। বুনো গন্ধে ভরে আছে গোটা বাগান। একটু একটু কাঁপছে শিলু। বহুদিন পর এমন রোমাঞ্চকর সঙ্গ এলো জীবনে ওর। আর দু’কদম এগোলেই প্রেমে পড়ে যাবে ও। মনের ভেতর বাইরাম বাইরাম ঘন মেঘের ডাক। শিলু কি ঠোঁট এগিয়ে দেবে! নাহ! কি দেবে? ইচ্ছে করছে তো! হুড়মুড় করে শরীরে অনেকগুলো ইচ্ছের দৌড় শুরু হয়ে গেছে।

-​ইস আপনার ক্যামেরাটা আনলে বেশ হতো। ওই দেখুন ওপাশে বৃষ্টি থেমে কেমন রঙধনু উঠেছে।

শিলু আসলে কিছুই শুনছে না, দেখছেনা, ওর ঠোঁট জোড়া সমস্ত অবদমিত প্রশ্নের কোন্দল হতে বেড় হয়ে বৃষ্টি ভেজা অপর দুটি ঠোঁট আঁকড়ে ধরলো। দু’একটা ব্যাঙ ডাকলো কি ডাকলো না। দূরে মালীর বাড়ি হতে মোরগের ডাক ভেসে এলো। ভেজা আর বড্ড আদুরে মাটি হতে ঘাসের গন্ধ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে বাতাসে। হাফিজুর রহমান একটু শিথিল হলেন। শিলুর কম্পমান বাহুমূল ধরে দাঁড় করালেন সামনে। চমৎকার করে হাসলেন। শিলু দেখতে পেলো - তাঁর চোখের মণি হালকা তামাটে। সেখানে স্থির দৃষ্টি। গম্ভীর স্বরে বললেন,

-​ইউ আর অলরাইট। বাট আই অ্যাম স্যরি। আই হ্যাভ অ্যা বয়ফ্রেন্ড।

বৃষ্টি থেমে গেছে পুরোদমে। মাটির শরীর জুড়ে এখন কেঁচোর যাতায়ত।





লেখক পরিচিতি
মুর্শিদা জামান
গল্পকার। কবি। চলচ্চিত্রকার।
ঢাকায় থাকেন। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ