রাবিহ আলামেদিন'এর গল্প: জুলাই যুদ্ধ




অনুবাদঃ মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ

(এই গল্পের পটভূমি ২০০৬ এর ইসরাইল- হেজবুল্লাহ যুদ্ধ, যা লেবাননে জুলাই যুদ্ধ নামেও পরিচিত। এই যুদ্ধের শুরু হয়েছিল ১২ জুলাই ২০০৬ তারিখে এবং সমাপ্ত হয়েছিল ১৪ আগস্ট ২০০৬ তারিখে। জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে।)


গ্রীষ্মের সময়টাতে আমাদের পাড়ায় ধাপে ধাপে নির্জনতা নেমে আসে। এই নির্জনতার শুরু মে মাসে। স্কুল এসময়ে উঁচু ক্লাসের সতেরো-আঠারোর ছাত্রদেরকে এক মাসের ছুটি দেয়। স্নাতক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্যে। আমাদের পূর্বপুরুষদের সময় থেকে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা তখন শহরের বাইরের বাসস্থানগুলোতে চলে যায়। এগুলো হলো কাঠের তৈরি নির্জন কুটির ও কেবিন, যেগুলোর অবস্থান ঘনবসতিপূর্ণ লোকালয় থেকে দূরে। পরিযায়ী পাখিরা যেভাবে ফিরে আসে, তেমনি করে ছাত্ররাও জুন মাসে ফিরে আসে। পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্যে। পরীক্ষার পর স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে যায়। পুরো বছরের জন্যে। তখন কয়েকটা পরিবার ভ্রমণের উদ্দেশ্যে চলে যায় বিদেশে। কিছু সংখ্যক পরিবার চলে যায় পর্বতে। একজন বহিরাগতের কাছে এই পরিবর্তন চট করে চোখে পড়বার নয়। কারণ পরিবর্তনটা যথেষ্টই শ্লথগতি সম্পন্ন। তবে তা অবশ্যম্ভাবী। এই পরিবর্তন চলতে থাকে আগস্ট মাস পর্যন্ত; যে সময়ে বৈরুত জ্বলতে থাকে।

জুলাই মাসের প্রথমদিকে আমাদের উঠানের অন্যদিকের মাসরি (Masris) পরিবার পর্বতের উদ্দেশ্যে চলে গেলো। তারা তাদের গ্রীষ্মকালীন বাসস্থান থেকে সেপ্টেম্বরের শেষদিকের আগে (যখন তাপমাত্রা শীতল হতে থাকবে) আর ফিরবে না। সেই গ্রীষ্মেই আমাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছিলো এপার্টমেন্টের কেয়ারটেকার হিসেবে। আমি দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলাম আমার ভাইয়ের কাছ থেকে।মাসরিদের বাড়ির দেখাশুনার কাজটা যেন আমি যত্নের সাথে করি সেকথা বাবা আমাকে পইপই করে বলে দিয়েছিলেন। কারণ, বাবার ধারণা, তেরো বছর বয়সেও আমি বড়দের মতো ভারিক্কি আচরণ করছিলাম না, এবং আমার আরো দায়িত্ববান হবার প্রয়োজন। কাজেই আমাকে দায়িত্ববান করতে গত একমাস ধরেই তিনি হাত-পা নেড়ে নেড়ে গালি ও বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছিলেন।

সকালে গোসলখানায় বাবা বক্সারের শর্ট ও টি-শার্ট পরে ভ্যানিটি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে উপদেশ দিতেন। তার মুখের বরফ-সাদা শেভিং ফোমের মধ্য দিয়ে শব্দগুলো বুদ্বুদের মতো বের হতো। “আমি যখন তোমার বয়সী ছিলাম, তখন আমি সারাদিন তোমার মতো কোনকিছুই না করে অলসভাবে কাটাতাম না,” তিনি বলতেন। “তুমি কি আরো পরিণত বয়সের বন্ধু খুঁজে পাও না? এমন কিছু করতে পারো না যা কাজে আসে? তুমি জানো যে, প্রতিটা কাজেরই একটা প্রতিদান আছে, এবং কোনকিছু না করার প্রতিদান হলো শেষ পর্যন্ত তুমি কিছুই হতে পারবে না।

দুপুরে লাঞ্চের সময়ে আমরা সবাই একটা ওক কাঠের টেবিলের চারপাশে বসতাম। “সোজা হয়ে বস, ওয়াজদির দিকে তাকিয়ে দেখো সে কিভাবে বসে আছে, একজন মানুষের মতো। তোমার এই ছেলেমিপনা অনেক হয়েছে।“

বৈঠকখানায় বসে টেলিভিশন দেখার সময়ে তিনি আগের কথাগুলোরই পুনরাবৃত্তি করতেন। শুধুমাত্র রাতের খাওয়ার পরে ছাড়া। “তোমার চিন্তা করা উচিৎ জীবনে তুমি কি হতে চাও,” তিনি বলতেন। ডান বাহু দিয়ে আমার মাকে ধরে থাকতেন, যেটাকে আমার কাছে সব সময়ে মনে হতো বৈবাহিক আলিঙ্গন। মাও তাকে আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা করতেন। তার কাছে বাবার মুখনিঃসৃত প্রতিটা শব্দকেই একেকটি মুক্তা বলে মনে হতো। ‘পরিণত বয়সের জন্য বসে থাকলে তো চলবে না। আর এখন যা বয়স তোমার ভেবো না যে সে বয়সের তুলনায় আগেভাগে তুমি কিছু করছো। বাবার মুখ চলতেই থাকতো। বাবা বাম হাত নেড়ে নেড়ে প্রশ্ন করতেন, “ তোমার জীবনের উদ্দেশ্য কি? কি করতে চাও তুমি? সমস্যার সমাধান করতে? সেক্ষেত্রে তুমি একজন ইঞ্জিনিয়ার হতে পারো। মানুষকে সাহায্য করতে চাও? তাহলে তুমি এটর্নী হতে পারো। তুমি চাইলেই স্কুলের গ্রেডকেও উন্নত করতে পারো, যদি তুমি পরিশ্রম করো। তোমার উচিৎ ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করা।“

প্রতিবেশীর এপার্টমেন্টের দেখাশুনা করার বিষয়টি আমার কাছে তেমন সমস্যার ছিলো না। কারণ, গ্রীষ্মের সময়ে আরো দায়িত্ববান হবার নিমিত্ত হিসেবে আমাকে খুব কম কাজই করতে হতো। সপ্তাহে একবার জানালাগুলো খুলতে হতো। ঘরের গুমোট বাতাসকে বের করে দেয়ার জন্যে। এর বাইরে আমাকে আরেকটা কাজ করতে হতো। সেটা ছিলো দুটো ক্যানারী পাখিকে খাওয়ানো ও তাদের খাঁচাটিকে পরিষ্কার করা।

আমি ডক্টর মাসরি’র চামড়ার সোফাতে পায়ের উপরে পা তুলে বসে হ্যারল্ড রবিন্স এর একটা পুরনো উপন্যাস পড়ছিলাম। উপন্যাসের যেখানে সকল ঘটনাগুলোই ঘটছিল মধ্যপ্রাচ্যে, এবং আমি একশন দৃশ্য খুবই পছন্দ করতাম। উপন্যাসের সবচেয়ে ভালো অংশটুকু ছিল লায়লা নামের এক শিশু শরণার্থীর বর্ণনা। সে আরব ও ইহুদি উভয় পক্ষ দ্বারাই আতঙ্কগ্রস্ত ছিলো। দৃশ্যটিতে লায়লা একজন সুশ্রী চেহারার এক মোসাদ এজেন্টের সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছিল। তারই প্রেমিকের প্ররোচনায়, যে তাকে প্রণয়ের অভিনয় করে এজেন্টের কাছ থেকে কিছু মূল্যবান তথ্য আদায় করতে বলেছিলো।

আমি যেকোন বইয়ের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে পছন্দ করতাম। কিন্তু আমার ভাই সেটা করতো না। সে শুধু বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো পড়ত। ওয়াজদি ডক্টর মাসরি’র লাইব্রেরী থেকে নতুন কোন ক্লাসিক বই, কলিন্সের বই অথবা রবিন্সের বই নিয়ে আসতো এবং যত্রতত্র বইয়ের ভাঁজ করা অংশগুলো খুলে রাখতো। এই ভাঁজ করা অংশগুলোতে কোন না কোন যৌন দৃশ্যের রগরগে বর্ণনা থাকতো। এগুলো ছিলো সেই অংশ, ডক্টর মাসরিও যেগুলোর একান্ত নিবিষ্ট পাঠক ছিলেন। বই পড়া নিয়ে আমার ভাইয়ের আগ্রহ বছর খানেক আগেই উবে গিয়েছিলো, তার সতেরো বছর বয়সে পদার্পণ করার পর। কারণ, এই সময়ে তার আগ্রহ কল্পনার পরিবর্তে বাস্তব কিছুতে ঘনীভূত হয়।

ডঃ মাসরি’র পুরো লাইব্রেরীটাই বৈঠকখানার একটা আসবাবপত্রের তাকগুলোর ভেতরে স্থাপিত ছিলো। ডাইনিং রুম থেকে সামনে অনেকগুলো ফ্রেমের ভেতরে কাঁচের কভার দেয়া ক্যাবিনেট এনে এটি তৈরী করা হয়েছিলো। কাঁচগুলোর পেছনে পেপারব্যাক কাগজ লাগানো ছিল। প্রতিটি পেপারব্যাক কাগজের উপরে অন্তত একটি করে উত্তেজনাকর যৌনদৃশ্য আঁকা ছিলো। অনেকটা আমার বাবার উপদেশের মতো। যেনো দায়িত্ববান কেয়ারটেকার হওয়াই হলো পুরুষত্বের প্রবেশদ্বার। আমিও তাই ভাবতাম। ওই পেপারব্যাকগুলো ছিলো আমার জন্যে সেইন্ট পিটার।

আমি বইয়ের সেই পৃষ্ঠায় পৌঁছলাম, যেখানে লায়লা একজন টেররিষ্ট হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছিল। ঠিক তখনি দরজার বেল বাজলো। আমি মোসাদের এজেন্টের মতো নিঃশব্দে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। পীপ-হোলের ভেতর দিয়ে তাকানোর আগেই বুঝতে পারলাম যে, ওটা পিপো। আমাকে ধোলাই দেবার জন্যে এসেছে। মাসরি পরিবার পর্বতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার পর পরই খবরটা সে আমাকে জানাতে বলেছিলো।

“তারা চলে যাবার সঙ্গেসঙ্গে যদি তুমি আমাকে না জানাও,” সে আমাকে তিনদিন আগে বলেছিলো,” আমি তোমাকে হাত দিয়ে পুচকে তেলাপোকার মতো পিষে ফেলবো।“ তার উপমার ব্যবহারগুলো সবসময়ে এমন ভুলভাল হতো। সেগুলো শুনে আমি হাসতে হাসতে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যেতাম, যদি না সেগুলো তার অপ্রত্যাশিত কোন কাজ দ্বারা অনুসৃত হতো। সুতরাং মাত্রাতিরিক্ত ওজনের এই দৈত্যটাকে আমি মিথ্যে করে বললাম যে, ওয়াজদি এবছরেও ডঃ মাসরির কেয়ারটেকার হিসেবে নিযুক্ত আছে। কারণ, আমি জানতাম, পিপো ওয়াজদিকে ভয় পায়। পুরো পাড়ার মধ্যে ওয়াজদিই ছিলো একমাত্র বালক যে তার চেয়ে শক্তিশালী ও লম্বা।

পিপোর সবচেয়ে খারাপ অভ্যাস ছিলো শার্টের কলার ধরে আমাকে উপরে টেনে ধরা এবং আমার মুখকে তার মুখের সামনে এনে কথা বলা। এটা সে বন্ধ করেছিলো যখন একদিন আমাকে উপরে টেনে তোলার সময়ে মিথ্যে করে তাকে বলেছিলাম যে, আমি ওয়াজদি’র শার্ট পরে আছি, এবং আমার ভাই খুবই রেগে যাবে যদি সে দেখে তার শার্টের কলারে ভাঁজ পড়েছে।

“আমি জানি তুমি ভেতরেই আছো,” পিপো দরজার ওপার থেকে বললো। তার কন্ঠস্বর অলুক্ষণে ও ফিসফিসি শোনাচ্ছিলো, কারণ সে চিৎকার করতে পারছিলো না, পাছে তার কথা ওয়াজদি অথবা আমার বাবা শুনে ফেলে। সে আবারও বেল বাজিয়ে বললো,”দরজা খোল বলছি।“

আমি দরজা খুলছিলাম না কয়েকটি কারণে। এর মধ্যে একটা কারণ ছিল নৈতিক, আমি মাসরি পরিবারকে পছন্দ করতাম এবং পিপোকে তাদের বাসার দখল দিতে রাজী ছিলাম না। খালি এপার্টমেন্ট নিয়ে সে কি করতে পারে, সে সম্পর্কে আমার ধারণা ছিলো না। তবে আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, কোন ভালো উদ্দেশ্যে সে তা ব্যবহার করতো না। কাজেই সে যা চাচ্ছিলো আমি তা করা থেকে বিরত থাকলাম। কারণ, আমি দরজা খুলি বা না খুলি, সে আমাকে অপদস্ত করতোই। মার খাওয়া যদি নিশ্চিত হয়, তবে সেটাকে বিলম্বিত করতে পারাটাই মন্দের ভালো।

“তুমি যদি দরজা না খোলো,” পিপো বলেছিল,” আমি কার্লের ঠ্যাং ভেঙে দেবো।“

“কি বলছো, তুমি?” আমি আর্দ্রকন্ঠে ফিসফিস করে চিৎকার করে উঠেছিলাম। তারপর দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম এবং উঁকি না দিয়েই নিশ্চিত হতে চাচ্ছিলাম, পিপোর সাথে সেখানে আমার সাবেক প্রিয়তম বন্ধুটা উপস্থিত আছে কিনা। “তুমি আমার পা ভাঙতে পারো না। ওটা করার কোন যুক্তি নেই।“

“ও যদি দরজা না খোলে, তাহলে অবশ্যই আমি তোমার ঠ্যাং ভাঙবো।“

“সে যদি এখানে না থেকে থাকে? ও আমাকে বলেছিলো যে, তার কাছে চাবি আছে, তবে হয়তো সে তার রুমে বসে বই পড়ছে। ও নিজ থেকে দরজা খুলছে না, শুধু এই কারণে তুমি আমাকে আঘাত করতে পারো না।” 

আমি আমার বাবার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। “এই ছেলেরা, তোমরা এখানে কি করছো? মাসরিরা ভেতরে নেই।“ দ্রুত কিছু পায়ের আওয়াজ শোনা গেল এবং কাপুরুষ কার্ল সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলো। পিপো অসঙ্গতিপূর্ণ কিছু একটা উত্তর দিলো। “আমি তোমাকে এখানে দেখতে চাই না, ফিলিপ,” আমার বাবা বললেন।“ তুমি বড় হয়েছো। বড়দের মতো আচরণ করতে শেখো।“

এক সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে সেটা ছিলো কার্লের দ্বিতীয় দফার বিশ্বাসঘাতকতা। গত সোমবারে আমরা একসঙ্গে আমাদের বিল্ডিং এর যে দেয়ালটা রাস্তার দিকে মুখ করা, তার উপরে পা ঝুলিয়ে বসেছিলাম। কার্ল আমার চেয়ে মাত্র কয়েক মাসের বড়, তবে আমার চেয়ে অনেকবেশী স্থূল। একটা গাড়ি দ্রুতগতিতে অতিক্রম করে যাবার সময়ে সে চিৎকার করে গাড়িটি কি গাড়ি ও কোন বছরে তৈরি তা বলল। তার কন্ঠস্বরের ওঠা-নামা থেকে বোঝা যাচ্ছিলো, ও তার প্রিয় নতুন ‘বিএমডব্লিউ’ কথা বলছিলো। সে গাড়িটিকে দেখছিলো। আমি অবাক হয়ে তাকে দেখছিলাম, তার ব্রণে ভরা মুখ। যেনো তাকে প্রথমবার দেখছি। গত কয়েকদিনে একবারও ও তার মাথার চুল আঁচড়ায়নি। “Buick, 1998,” কার্ল ঘোষণা করলো। আমি মৃদু হেসে আমার কাঁধ ওর বাহুতে ঘষলাম। তার শরীর থেকে ডিওডোরেন্ট ও বগলের গন্ধ আসছিলো। “Peugeot, 2006, the latest model”। আমি হাসলাম এবং ওর কাঁধের সাথে আবার ঘষা দিলাম। “Nissan, 2000”। আবার হাসি, আবার ঘষা, আবার হাসি। এই পর্যায়ে আমি থামলাম, কারণ আমি অনুভব করছিলাম যে, রাস্তার ওপারে আমাদের বাসার ব্যালকনি থেকে বাবা আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। সাফারির পশুদের মতো ষষ্ঠ-ইন্দ্রিয় ছিলো আমার। আমি এটা ব্যবহার করে অনেক দূরত্ব থেকে বাবার অস্বীকৃতি বা অসন্তুষ্টি বুঝতে পারতাম।

যে কোন জায়গায় দৃশ্যমান হওয়ার আগেভাগেই পিপোর কণ্ঠস্বর শোনা যেতো। সে গর্জন করতে করতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতো। তার মুখ অবজ্ঞায় জ্বলজ্বল করতে থাকতো। সবসময়েই সে সাদা ও নীল রঙের শার্ট পরতো।

“কি করছো তোমরা এখানে? নিশ্চয়ই কোন বাজে কাজ, ” সে চিৎকার করলো।

কার্ল দেয়ালের উপর থেকে লাফ দিয়ে হুড়মুড়িয়ে নামতে গিয়ে কাঠের তৈরি হেজের মধ্যে উপুড় হয়ে পড়লো। “আমি না, ও,” বলে সে আমার দিকে অঙ্গুল তুলে ইশারা করলো। “ও করেছে।“ পিপো মুখ খিঁচিয়ে রাগীভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কি বাজে কাজ করেছো তুমি ওর সাথে?”

আমার ভেতরে রক্ত বুদ্বুদ হয়ে ফুটছে বলে অনুভব করলাম। দেয়াল থেকে লাফ দিয়ে তার কাছে নেমে বললাম,”সাবধান হয়ে কথা বলো পিপো,” কার্ল ঢোক গিললো, কিন্তু আমি থামলাম না, “ তুমি কি মনে করো যে, আমরা এখনো কিন্ডারগার্টেনে পড়ি?”

অতঃপর আমি ঘুরে দাঁড়ালাম এবং সেখান থেকে চলে গেলাম। আমার বাবা তখনো আমাকে দেখতে পাচ্ছিলেন। তিনি সেখানে থেকে পিপোর ঘুষি আমার পিঠের উপরে পড়তে এবং আমাকে সামনের দিকে পড়ে যেতে দেখেছিলেন। ঘুষি খেয়ে আমি নিমিষে এসফল্টের উপরে মুখ থুবড়ে পড়লাম।

আমার বাবা পিপোকে চিৎকার করে থামতে বললেন। আমি মাটি থেকে উঠলাম এবং ডানে বামে না তাকিয়ে আমাদের বাসার দিকে হাঁটা শুরু করলাম। আমি জানতাম যে, বাবা সেখানে আমার জন্যে একগাদা উপদেশ নিয়ে অপেক্ষা করছেন – কীভাবে মাস্তানির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়। আমি তার কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে আমাদের ব্যালকনির একটা বড় বোগেনভেলিয়ার ঝোপের ম্যাজেন্টা রঙের ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিলাম।

দুপুরের আগে আকাশকে দেখাচ্ছিলো হাড়ের মতো সাদা এবং ছায়াগুলো তখনো বালির উপরে ছোট হচ্ছিলো। সমুদ্র মৃদু গর্জন করছিলো। আমি এক পায়ের উপরে নিজের ভারসাম্যতা রক্ষা করে নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু সক্ষম হচ্ছিলাম না। তারপর অন্য পায়ের উপরে ভর করে ক্রেন পাখির অনুকরণে একই কাজ করার চেষ্টা করছিলাম। আমার পায়ে কোন চপ্পল ছিল না। ওয়াজদি এবং তার নতুন বান্ধবীর উপরে গোয়েন্দাগিরি করার আবেগে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে, বালি কতটা উত্তপ্ত হতে পারে। আমি পায়ের আঙুলের উপরে দাঁড়িয়ে আরও কিছু দেখতে পারার আশা করছিলাম। কিন্তু আমার ভাইয়ের অবস্থান ছিলো অনেকটা দূরে। সুতরাং আমি লাফিয়ে লাফিয়ে বেলাভূমিতে চলে গেলাম।

জলের উষ্ণতা সাঁতারের জন্যে যথেষ্টই উপযোগী ছিলো, কিন্তু আরেকটু শীতল জল চাচ্ছিলাম, যাতে আমার পায়ের তলাকে দ্রুত আরাম দিতে পারি। দিনটি ছিলো খুবই সুন্দর। দেবদূতদের ভেতরে হাসি ও ক্ষমার অনুভূতি সৃষ্টি করার জন্যে। চারদিকে সূর্যস্নানকারীরা নিরুদ্রপভাবে শুয়েছিলো। প্রত্যেকের কাছে একটা করে সানট্যান (suntan) তেল ছিলো।

ওয়াজদি এবং তার নতুন বান্ধবী আমার পাশ দিয়ে হাঁটছিলো। পরস্পর কাছাকাছি। কিন্তু আমি যেমনটা আশা করছিলাম সেভাবে ওরা একে অন্যের হাত ধরে হাঁটছিল না মোটেও। দীর্ঘদিন সাঁতার কাটার কারণে ওয়াজদির শরীরটা ছিপছিপে ও পেশিবহুল। তার বাদামি চুল ইতিমধ্যেই সূর্যের উত্তাপে ব্লিচড হয়ে গিয়েছিলো। ওয়াজদি আমাকে পাত্তা না দিয়ে হাসিমুখে মেয়েটির সাথে কথা বলছিলো। এক সময় তারা পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিলো। ওয়াজদি হাঁটতে হাঁটতে ধীরপায়ে আমার দিকে আসছিলো। আমি তখনো জলের ভেতরেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওয়াজদি তার পায়ের চপ্পল ভেজার আগেই থামলো।

“মেয়েটা আজ তাকে স্পর্শ করতে দিয়েছে,” গর্বিত কণ্ঠে ওয়াজদি ঘোষণা দিলো।

আমি প্রায় ছুটেই ওয়াজদির কাছাকাছি হলাম, “স্পর্শ করেছো তাকে, কোথায় স্পর্শ করেছো?”

“এমন প্রশ্ন শুধু শিশুরাই করতে পারে।“ ওয়াজদি উল্টোদিকে ফিরলো ও চলে গেলো। আমি বকবক করতে করতে তার পেছনে ছুটলাম। তাকে পুরোদস্তুর শহুরে বলে মনে হচ্ছিলো। সিগারেট ধরানোর সময়ে আমি তার লম্বা আঙুলগুলোর প্রশংসা করলাম মনে মনে। ও সোজা হয়ে মাথা উঁচু করে হাঁটছিলো। “‌ও আমাকে বলেছে যে, আমার মোজা না পরার বিষয়টি সে পছন্দ করেছে।“

“মানে কি? আমিও তো মোজা পরিনি।“

“ আমি যে জুতার সাথে মোজা পরি না সেটা তার পছন্দ। আমি আর কখনোই মোজা পরবো না। কখনোই না।“

যুদ্ধের প্রথম রিফিউজি ছিলো আমার বোন নাদিয়া। ইসরাইলীরা বিমান বন্দরে বোমা বর্ষণের পর, সে এবং আমার এক বছর বয়সী ভাগ্নে, ঘুমের কারণে কপোল তখনো ফোলা- এই অবস্থায় তিনটে স্যুটকেস নিয়ে দুজনে আমাদের বাড়িতে আসলো। এর একটাতে ছিলো তার কাপড় ও জিনিষপত্র। দ্বিতীয়টিতে ছিলো তার ছেলের কাপড়চোপড়, এবং তৃতীয়টিতে ছিল ছেলের ডায়াপার। সে আমাদের বাড়ি হতে মাত্র তিন বিল্ডিং দূরে বাস করতো। বিমানবন্দরের একেবারেই ধারেকাছে নয়। কিন্তু আমরা জানতাম যে, আমাদের এখানে আসতে সে কখনোই বিলম্ব করবে না। আমরাও তাকে জিজ্ঞেস করিনি তার স্বামী কোথায়।

“সে যেখানে আছে, সেখানেই থাকতে পারে,” আমার বোন হাঁফাতে হাঁফাতে বললো। “ইসরাইলীদের কাছে সফিস্টিকেটেড অস্ত্র আছে। আমি তার সাথে থাকতে চাই না, যখন মিজাইল তাকে খুঁজে পাবে।“

আমার বোন একজন শিয়াপন্থীকে বিয়ে করেছিলো।

“তোমার এভাবে বলা উচিৎ নয়,” আমার বাবা বললেন। “তোমার স্বামী একজন ভালো মানুষ, একজন খুবই চমৎকার মানুষ।“

আমরা সবাই বোনের স্বামীকে ভালোবাসতাম, কিন্তু নাদিয়ার কাছে তাকে বিরক্তিকর মনে হতো। বিয়ের আগে তার প্রতি সে মোহগ্রস্ত ছিলো, তবে বিয়ের পরে সেটা কেটে যায়। স্বামীর প্রতি তার সারাক্ষণ বিরক্তি আমাকে আসলেই অবাক করতো। ভদ্রলোক একজন বুদ্ধিমান এবং প্রকৃতপক্ষেই নম্র স্বভাবের মানুষ ছিলেন। তবে তার ভেতর স্থিরতা কম ছিলো। বিবাহ কিভাবে তার সম্পর্কে নাদিয়ার ধারণা বদলে দিয়েছিলো, সেটা হঠাত করে ব্যাখ্যা করা কঠিন ছিলো। আমার ধারণা বিবাহ পরবর্তী জীবনের অন্তরঙ্গতা ও দৈনন্দিনতা তাকে বিস্মিত করেছিলো, যা সে কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এটা হয়ত বা আরো খারাপ হয়েছিলো, যেহেতু তার স্বামী বাণিজ্যিক উড়োজাহাজের পাইলট হিসেবে ঘন ঘন এদিক-সেদিক ভ্রমণ করতেন। তারপরেও নাদিয়া অভিযোগ করতো যে, তার আরো বেশী বাইরে থাকা উচিৎ। আমার মা তাকে সাপোর্ট করতেন এই বলে যে, বিবাহিতা হিসেবে তার বয়স খুবই কম এবং সে যথাসময়ে বুঝবান হবে।

আমার বোন তার স্যুটকেস নিয়ে তার পুরোনো কক্ষের ভেতরে ঢুকলো। এই কক্ষের চাবি সে কাউকেই দিয়ে যায়নি। কারণ, বিয়ের পরেও দিনের বেশীরভাগ সময়ই সে আমাদের এপার্টমেন্টে অতিবাহিত করতো। আমি ভাগ্নেকে কোলে নিয়ে তাকে অনুসরণ করলাম এবং বেবিকটে তাকে শুইয়ে দিলাম। আমি বোনের পুরনো খেলনাগুলো সরিয়ে সরিয়ে তার জন্যে আরো জায়গা করলাম। কক্ষের দেয়ালগুলো ছিলো হালকা গোলাপি রঙের। অনেকটা তার নেইল পলিশ ও লিপস্টিকের রঙের। সে গাঢ় রঙ অপছন্দ করতো। তার ধারণা ছিল সেগুলো ব্যবহার করলে ঠোঁট মোটা দেখায়।

“ওকে দেখে রাখো,” নাদিয়া বলল, “আমাকে জিনিষপত্র মজুদের জন্য যেতে হবে।“

“তোমার ভাই তোমার সাথে যেতে পারে,” আমার মা বললেন। ও জিনিষগুলো বয়ে আনতে পারবে। আমি এখানে থাকবো, কিন্তু তোমরা কোনকিছুই ভুলে রেখে এসো না।“

গোটা দেশের লোক তখন পথে বেরিয়ে পড়তো। এটা ঘটতো, প্রতিবার যখন ইসরাইল বৈরুতের উপরে বোমাবর্ষণ করতো। তবে যখন তারা দক্ষিণে বোমা ফেলত তখন এমনটা ঘটতো না। দক্ষিণে তারা অবিরাম বোমাবর্ষণ করতো। ভরা মৌসুমে বিমানবন্দরে বোমাবর্ষণের অর্থই ছিলো সকল ভ্রমণকারীদেরকে শহর, এমনকি দেশ থেকে বের করে দেয়া।

গ্যাস স্টেশনের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময়ে আমার বাবা মানুষের ভিড় দেখে খুবই বিরক্ত হতেন। তিনি স্টিয়ারিং হুইলের উপরে মাথা আছড়াতেন। আমাদেরকে সুপারমার্কেটে নামিয়ে দিয়ে তাকে কয়েকঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে তেলের ট্যাঙ্ক ভর্তি করার জন্যে। ওয়াজদি যে আমার মায়ের কার নিয়ে বেরিয়েছে, সে সম্ভবত কোন স্টেশনে ইতিমধ্যেই আটকে গেছে।

“সহ্য হয় না এসব,’ বাবা চিৎকার করলেন।

“আমরা এগুলো করছি কেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“ইসরাইলীরা থামবে না। ওটা তাদের ধাঁতে নেই। এটা হলো সুবিধাপ্রাপ্তদের অধিকার। এর অর্থ হলো তারা দোজখের শয়তানদের বৃষ্টি ঝরাবে আমাদের উপরে।“ তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ফুসফুসকে ঠাণ্ডা বাতাস দিয়ে পূর্ণ করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু এটা কোন সময়েই কাজ করতো না।“বোমা নিক্ষেপ করে সবাইকে হত্যা কর, সবাইকে ধ্বংস করে দাও। কেউ কি এর দায়িত্ব নেবে? কেউ কি এর জন্যে নিজেকে দোষী ভাববে? তারা নিজেদেরকে ছাড়া অন্য সবাইকে দোষ দেবে।“

কথাগুলো বলে আমার বাবা একটু শান্তি পেলেন। প্রতিবারেই ইসরাইলীরা আমাদেরকে আক্রমণ করলে তিনি রেগে যান। তবে তার রাগ ধ্বংস ও মৃত্যুর জন্যে নয়, তিনি রেগে যান কেউই দায়িত্ব নিচ্ছে না বলে। আমি জানি আজ বাবা অনেকক্ষণ রেগে থাকবেন।

সুপারমার্কেটে যাবার পর আমি ও আমার বোন পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। আমি আনন্দিতভাবে গাড়িতে পানির বোতলের কেস, বাবার জন্যে সিগারেটের কার্টুন, ময়দার বস্তা, গম ও কফি ভরলাম। আমার বোন ভাগ্যবতী হলে সেও তার সবকিছুই পাবে, কারণ মার্কেটটি খুব দ্রুতই খালি হয়ে যাচ্ছিলো। লোকজনেরা গত বিকেল থেকেই জিনিষপত্র মজুদ করা শুরু করে দিয়েছিলো। এ বিষয়ে লেবানীজদের পূর্বভিজ্ঞতা ভালোই ছিলো।

আমি সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলাম কি পরিমাণ চাল আমাকে কিনতে হবে। এই সময়ে আমি দুটো করিডোরের ওপার হতে আমার বোনের চিৎকার শুনতে পেলাম। দ্রুত সেদিকে গেলাম এবং দেখতে পেলাম যে, সে এক প্যাকেট প্যামপারস (Pampers) শক্ত করে ধরে আছে এবং একজন লম্বা মেনিকিউর করা বাদামী রঙের পোষাক পরা মহিলা সেটি তার কাছ হতে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। মহিলা বকবক করতে করতে আমার বোনের ভ্যানগাড়িতে রাখা দুই প্যাকেট তোয়ালের দিকে সদ্য আঁচড়ানো চুল নেড়ে তাকে ধাক্কা দিচ্ছিলেন। তাকে দেখে বাতিকগ্রস্ত বলে মনে হচ্ছিলো। আমার বোনের আঙুল প্লাস্টিকের ভেতরে ঢুকেছিলো। তার কয়েকগাছি চুল টুপির বাইরে চলে এসেছিলো। আশেপাশের ক্রেতারা ফিসফিস করছিলো এবং নিজেদের হাসি চেপে রাখার কোনোই চেষ্টা করছিলো না। মহিলার ফিলিপিনো পরিচারিকা নীল ইউনিফরম পরিহিত অবস্থায় মুখে হাত দিয়ে এই মারামারি দেখছিলো। পরিচারিকা ও তার গৃহকর্তী দুজনের চুলের ফ্যাশন একই ধরণের ছিলো। সম্ভবত তারা দুজনে একই হেয়ারড্রেসারের কাছ থেকে চুলের সাজ নিয়েছিলো। তাদের দুজনের পরনেই একই ধরনের সোয়েটার ছিলো, যা তারা তাদের কাঁধের উপরে বেঁধে রেখেছিলো।

নাদিয়া টানাটানি ও চিৎকার করছিলো। শেষ পর্যন্ত মহিলা তার হাতের বাঁধন খুলে দিলেন। “তোমার তিনটা প্যাকেট আছে,” সে বলল হতাশ কন্ঠে। “আমাকে ওখান হতে এক প্যাকেট দাও।“

আমার বোন অবজ্ঞার সাথে প্যাম্পার্স এর শেষ প্যাকেটটি নিজের ভ্যানগাড়ির ভেতরে রেখে উল্টো ফিরে ভ্যানগাড়ি ঠেলতে ঠেলতে চলে গেলো। “ চল যাই,” সে আমাকে দেখার পর বলল।

মহিলাটি কানে কানে তার পরিচারিকার সাথে কি জানি বললো, সে মাথা নেড়ে আমার বোনের ভ্যানগাড়ির দিকে ছুটলো এবং একটি ডায়াপার প্যাকেট নিয়ে দ্রুত অন্য করিডোরের পেছনে অদৃশ্য হয়ে গেলো। তার নীল সোয়েটার নায়কের টুপির মতো বাতাসে উড়ছিলো। আমার বোন চিৎকার করে তার ভ্যানগাড়ি নিয়ে পরিচারিকার পিছু ধাওয়া করার চেষ্টা করলো। কিন্তু ততক্ষণে অন্য ক্রেতারা তার পথের উপরে এসে দাঁড়িয়েছে। মহিলা হাসলো এবং তার চেহারা দীপ্তিময় হয়ে উঠলো। আমি আশা করেছিলাম যে সে চিৎকার করে বলবে, “সবার মধ্যে সবচেয়ে ফর্সা কে?”

বোমা বর্ষণের সপ্তাহকাল অতিক্রান্ত হলে আমার বাবার রাগ কমে এলো। সেই বিকেলে তিনি কালো প্যান্ট ও সাদা শার্ট পরেছিলেন, যেগুলো তিনি একদিন আগেও পরেছিলেন। এলকোহলের কারণে তার চোখ ছিলো লাল। চার আঙুল দিয়ে গ্লাস ধরে তিনি পান করছিলেন, সেটিকে কাৎ করে ধরে রাখছিলেন কিছুক্ষণ সময়ের জন্যে এবং নিজের তৃষ্ণা মিটাচ্ছিলেন। তার আঙ্গুলগুলো ছিলো লম্বা, ভাঁজ পরা এবং ফোলা। তার ঠোঁট সংকুচিত ও বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। সুতরাং আমি সেটা দেখতে পাচ্ছিলাম না। তিনি জলসিক্ত ছাদের দিকে তাকিয়েছিলেন, মাতাল দৃষ্টিতে।

"কোন কোন সময়ে," তিনি শান্তভাবে বলেন, “আমি খুবই ক্লান্তিবোধ করি।“

“আমি জানি।“

তিনি সিলিঙের দিকে তাকিয়েই আমার সাথে কথা বলে চললেন। মাথা নামালেন না।

“যত দিন যাচ্ছে তোমার মায়ের আগেভাগে ঘুমিয়ে পড়ার প্রবণতা বাড়ছে।”

বাবা কাজে যেতে পারেননি। যখন তিনি কাজ করতে পারেন না, তখন তিনি ক্লান্তিবোধ করেন। এবং যখন তিনি ক্লান্ত হন, তখন তিনি মদ্যপান করেন। এবং যেহেতু তিনি খুব কম সময়েই মদ্যপান করেন, সেহেতু তিনি ক্লান্ত ও বিষন্ন মদ্যপে পরিণত হন।

বোমা বর্ষণের মধ্যে কয়েকদিন বিরতি এলো। ওয়াজদি বাইরে হাঁটতে যেতে চাইলো। অনেকদিন সে বন্দী হয়ে ছিলো। সে এপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে বাইরে গেলো এবং আমি তাকে অনুসরণ করলাম। আমরা আমাদের প্রিয় সৈকতে গেলাম। সেটি একটি দীর্ঘ সাদা বালির সৈকত। ইসরাইলীরা যখন বোমা বর্ষণ শুরু করলো প্রথমে তারা পোর্টের একটা তেলের ডেপোতে আঘাত হানে। ফলে তেল ছড়িয়ে গিয়ে সৈকতকে কালোতে রূপান্তরিত করলো। আমরা সৈকতের কাছে গিয়ে দেখতে পেলাম জলের উপরে মাছেদের মৃতদেহ ভাসছে। যে সমুদ্র এক সময়ে মধুরতার সাথে ফিসফিস করতো, সেটা এখন কুৎসিত শব্দ করছিলো।

ওয়াজদি সৈকতে নামলো কাছ থেকে দেখার জন্যে। “তুমি কি আসবে?” আমি কোন উত্তর দিলাম না। আমি তাকে অনুসরণও করলাম না। পারলাম না অনুসরণ করতে।

দ্বিতীয় পর্যায়ের রিফিউজিরা, যারা ছিলো আসল রিফিউজি, তারা এলো বোমা বর্ষণের দুই সপ্তাহ পরে। ডক্টর তার এপার্টমেন্ট তার দুইজন কর্মচারী ও তাদের পরিবারের জন্যে খুলে দিতে বললেন। এরা দক্ষিণ শহরতলিতে অবিরাম বোমা বর্ষণের কারণে গৃহছাড়া হয়েছিলো। আমাদের পাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো, তবে বর্তমানে তা অপেক্ষাকৃতভাবে নিরাপদ। পাড়ার দিকে যাওয়ার সাঁকোটা উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। দুই রাস্তা পরের লম্বা বিল্ডিং, যেটার উপরে টেলিভিশন এন্টিনা ছিলো, তাকে গুঁড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে আমাদের এলাকা ক্লাস্টার বোমা থেকে বেঁচে গেছে।

কেয়ারটেকার হিসেবে আমি পরিবারগুলোর জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। আমি আশা করেছিলাম তাদের সাথে ছেলেপুলেও থাকবে। কিন্তু ওদের সাথে বারো বছরের ইঁচড়েপাকা এক বালক ছাড়া আর কোন কমবয়সি ছেলেপেলে ছিলো না। কর্মচারীদের দুজনেই দক্ষিণ অঞ্চলে ডঃ মাসরির বাগানে কাজ করে, এবং তাদের আবার ফিরে যাওয়ার তাড়া ছিল। সুতরাং তারা তাদের স্ত্রীদের রেখে ফিরে গেলো।

পরিবার রেখে কাজে ফিরে যাওয়ার স্বপক্ষে দুজন খানিক ভ্যাজর ভ্যাজর করে নিলো।




“যুদ্ধ থামুক বা না থামুক,” বয়স্ক লোকটি বললো, “আমাদের পক্ষে সৃষ্টিকর্তার দান এই বাগানকে অরক্ষিত রেখে অন্য কোথাও থাকা সম্ভব নয়।“ একচোখ ওয়ালা অন্য সহকর্মীটি বললো যে, তারা দুজন পরস্পরের ভাই হলেও, স্ত্রীদের সঙ্গে তাদের বৈপরীত্য লক্ষ্য করার মতো। দুই ভাই দেখতে জীর্ণশীর্ণ হলেও স্ত্রীরা দেখতে খুবই সুন্দরী ও কম বয়সী। ছোট ভাইটি অতিসম্প্রতি বিয়ে করেছে। তার স্ত্রীর চামড়া ফ্যাকাসে ধরনের সাদা। এবং চোখগুলো কিছুটা নির্মীলিত ও হালকা নীলাভ। এবং তার শুভ্র চুলে তিন ধরনের শেইড। পরনে নকল হীরক খচিত কালো টাইটস, যা তার দীর্ঘ টি-শার্টের নীচে হারিয়ে গিয়েছিলো।

আমি দরজা খুলতেই মহিলাদ্বয় এপার্টমেন্টের ভেতরে ঢুকে পায়চারী করতে লাগলো। তাদের চলাচল পরস্পরের সাথে এতোটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিলো যে, মনে হচ্ছিলো তারা সারা জীবন একসাথে বাস করেছে। আমি কক্ষের দরজা বন্ধ করার আগেই অপেক্ষাকৃত বয়স্কা মহিলাটি বললো, “ তুমি কি মোহাম্মদ আলিকে বাসাটা ঘুরে দেখাতে পারবে?”

মোহাম্মদ আলি তার মায়ের পাশেই দাঁড়িয়েছিলো, তার দৃষ্টি ছিল নিজের জুতার দিকে। তাকে বয়সের তুলনায় ছোট্ট মনে হচ্ছিলো। তার চিবুকটি তার অবতল বুকের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলো। তার মাথা দেখে মনে হচ্ছিলো ময়লায় ভর্তি- চুলের গুচ্ছ শিশু সাপের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিলো। যখন সে মার দিকে তাকালো, আমি ভয় পেয়ে গেলাম। তার চোখ দুটো ছিলো ভয়ংকর। যাদুকরদের মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন।

“আমি পারবো না,” আমি উত্তর দিলাম। “সম্ভব হলে পরে ঘুরে দেখাবো।“

পরিবারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে, একদিন সকালে আমার বোন সিদ্ধান্ত নিলো উত্তরের দিকে শপিং করতে যাবে, খুব বেশি হলে ত্রিপলিতে। কারণ, সে ইতিমধ্যেই বৈরুতের মার্কেটগুলো চষে ফেলেছিলো। রাস্তাগুলো যদিও ক্ষতিগ্রস্ত ছিলো, গত দশদিনে ইসরাইলীরা উত্তরের দিকে কোন আক্রমণ করেনি। আমার বাবা মা কেউই বোনের সাথে যেতে রাজী হলো না। ওয়াজদিও অস্বীকার করলো যেতে। সুতরাং সে তার স্বামীকে বাধ্য করলো তার সাথে যেতে। “আমাকে এপার্টমেন্ট থেকে তুলে নেয়ার আগে অবশ্যই নিশ্চিত করবে যে, তুমি তোমার শিয়া জিপিএস লোকেটর বাসায় রেখে আসছো,“ সে তাকে খোঁচা দিলো। সাধারণতঃ আমার মা তাকে খোঁচা দিয়ে থাকেন তার অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহারের জন্যে। তবে এখন মোবাইলই ভরসা কারণ, ইসরাইলীরা সমস্ত ল্যান্ডলাইনগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে।

আগের সপ্তাহে আমি তাকে বলেছিলাম যে, সে অদ্ভুত ধরনের, অস্ত্রপাগল। কিন্তু সে আমার কথায় কোনরকম পাত্তা দেয়নি। আমার মা আমাকে বোঝালেন যে, প্রতিটি মানুষেরই আঘাতজনিত চাপ ((traumatic stress) মোকাবেলা করার পদ্ধতি ভিন্ন এবং বোমাবর্ষণ দেখেনি এমন একজন মানুষের যুদ্ধকালীন আচরণ বুঝতে পারা আসলেই কঠিন। ইসরাইলী মিসাইলগুলো আঘাত করার পর আমার বাবা মদ্যপান করেন, আমার মা রান্না করেন, আমার ভাই চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে যায়, এবং আমার বোন ডায়াপার শপিং করে বেড়ায়। বোমা বর্ষণের আগে সে সম্ভবত অন্য যে কোন লেবানীজের মতো যৌক্তিক আচরণ করতো, কিন্তু প্রতিটা মিসাইল বর্ষণের সাথে সাথে সে অস্থির আচরণ করছে। তার গোলাপী কক্ষটি ডায়াপার দিয়ে ভর্তি ছিলো। সেগুলো মেঝে থেকে ছাঁদ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে গিয়েছিলো। সেখানে আর কিছুই রাখার জায়গা ছিলো না। এমনকি আমার বোন নিজের ও সন্তানের খাটের নীচে অনেকগুলো ডায়াপার রেখে দিয়েছিলো। সন্তানের ছয় বা সাত বছর পর্যন্ত পরার জন্যে যথেষ্ট সংখ্যক ডায়াপার কক্ষটিতে ছিলো। আমি যখন বিষয়টা তাকে বললাম, সে চিৎকার করে বললো, “আমি তো আবার গর্ভবতীও হতে পারি। এভাবে রাখাই যায়।“ 

কিন্তু আজ সকালে আমরা ডিজেল জেনারেটর চালিয়ে টেলিভিশন সংবাদ দেখার সময়ে একজন ঘোষক জানালেন যে, ইসরাইলীরা জনসন এন্ড জনসন ওয়্যারহাউজে গতরাতে বোমাবর্ষণ করে সবকিছুই পুড়িয়ে দিয়েছে।

“কেন?” মা যেন টেলিভিশনকে জিজ্ঞেস করলেন। 

বাবা স্কচের বোতলের দিকে তাকালেন, কিন্তু তখনো বেশ সকাল।

ওয়াজি কফিতে চুমুক দিলো। “আমি নিশ্চিত যে, সন্ত্রাসীরা শ্যাম্পু ও ব্যান্ড-এইডের মধ্যে লুকিয়ে ছিলো। সুতরাং দুঃখ করে লাভ নেই।

আমার বোন উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, মনে হলো, সে চেয়ারে বসেই লম্বা হয়ে গেছে। “ আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম যে, ডায়াপারগুলো শেষ হয়ে যাবে। এরপর তারা Procter & Gamble warehouse এ বোমাবর্ষণ করবে। সে আমাদের সাথে কথা বলছিলো, কিন্তু তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো সে বিশাল অদৃশ্য শ্রোতাদের সাথে কথা বলছে। সে তার ঠোঁট ভাঁজ করে তার নতুন রঙ করা আঙুল দিয়ে শিস্ বাজাতে শুরু করলো।

মোহাম্মদ আলিকে আমার পুরো বাসস্থান ঘুরে দেখাতে হলো। মা এই রুক্ষ ছেলেটার সাথে সময় কাটাতে চাপ দিচ্ছিলেন। ছেলেটা সম্পর্কে মায়ের ভাষ্য হলো, তাকে দেখতে ভূতুড়ে প্রাণী বলে হয় এবং একটা শিশুর যা দেখা উচিৎ, তার চেয়ে এই বয়সে বেশী দেখেছে সে। “সে নিশ্চয়ই খুব একাকী,” মা বললেন। “তার বাসা ধ্বংস হয়ে গেছে এবং তার পরিবার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে। আমাদের উচিৎ তার সাথে সহমর্মী ও প্রতিবেশীসূলভ আচরণ করা।

আমি জানতাম না তাকে কি দেখাতে হবে। ইসরাইলীরা যুদ্ধের ভেতরে একটা বিরতি নিচ্ছিলো। ফলে আমাদেরও আপাতত ঘরবন্দী থাকতে হচ্ছিলো না। কিন্তু মোহাম্মদ আলিকে দেখে মনে হচ্ছিলো না যে, সে তার পরিপার্শ্ব বা পাড়া নিয়ে আদৌ আগ্রহী। চলার সময়ে মাথা নীচু করে থাকা ছাড়া সে আর কিছুই করছিলো না। আমাদের বাসার দিকে মুখ করে থাকা দেয়ালের উপরে আমরা নিশ্চুপভাবে বসেছিলাম। তার পাগুলো আমার পায়ের চেয়ে ছোট ছিলো। আমার দিকে না তাকিয়ে সে সামনের দিকে ঝুঁকে ছিলো। আঙুলের যে অংশ দিয়ে সে দেয়াল ধরেছিলো, সেটাকে সাদা মনে হচ্ছিলো। ছেলেটার দাঁত দিয়ে নখ্ কামড়ানোর বদভ্যাস আছে। আমি আমার আঙুলগুলোর দিকে তাকিয়ে দ্রুত অন্যদিকে তাকালাম। আমার বাবা বলেন, হাতের নখ নিয়ে বিব্রত হওয়াটা পুরুষের মানায় না।

দমবন্ধ নীরবতা আমাকে বিব্রত করছিলো। বাধ্য হলাম কথা বলতে- “তুমি কি একমাত্র ছেলে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“না।“ তার অদ্ভুত বাচনভঙ্গি শুনে সহজে ধরে ফেলা যায় সে দক্ষিণাঞ্চল থেকে আগত। 

আমি এই আশায় অপেক্ষায় থাকলাম যে, সে কথা চালিয়ে যাবে। কিন্তু সে নীরবতাকেই বেছে নিলো। “তোমার ভাই-বোনেরা কোথায়?”

“এখানে নেই।“ 

মনে মনে তাকে ঘুষি মারতে ইচ্ছা করছিল। এর সাথে সময় কাটানোর চেয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রের কোন বই পড়াও আমার জন্যে ভালো।

“তুমি কি চাও আমি তোমাকে একলা থাকতে দেই? বিরক্তি লুকানোর চেষ্টা না করেই কথাটা বললাম তাকে। “অসুবিধা নেই। তুমি থাকলে আমার অসুবিধা হবে না। আমি তোমার সাথে বন্ধুভাবাপন্ন হবার চেষ্টা করছি।“

শেষ পর্যন্ত সে তার মাথা ঘোরালো, তার নীল চোখ দিয়ে আমাকে মাপতে মাপতে। “তুমি আমার বন্ধু হতে চাচ্ছো কেনো?” সে জিজ্ঞেস করলো।

“কারণ আমার মা আমাকে সেরকমই বলেছে।“

সে হাসতেই তার মুখের ভেতরে একটা সোনালি দাঁত দেখা গেলো।

“আমার তিন ভাই ও দুই বোন,” সে বললো।

“অনেক ভাই-বোনই তো তোমরা,” আমি বললাম।

“আমার বড় ভাই নাইজেরিয়াতে থাকে, এবং আমার দুই বোন ও তাদের পরিবারগুলোও সেখানে থাকে। আমার এক ভাই যুদ্ধে শহীদ হয়েছে। বেঁচে থাকলে তার বয়স এখন ষোল হতো।

আমি একটু অপেক্ষা করলাম যাতে সে কথা চালিয়ে যেতে পারে। “ আরও একটা ভাই আছে তোমার,” আমি বললাম।

“ওই ভাই যুদ্ধ করছে।“ সে ইতস্তত করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। “খুব কম বয়স।“

আমি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে নিরুত্তাপ ভাব দেখালাম, ভাবখানা এই যে, যোদ্ধাদের নিয়ে কথা বলা আমার জন্যে কোন ব্যাপারই না। “বয়স কত তার?”

“চৌদ্দ।“

‘তোমার অন্য ভাইও কি যোদ্ধা ছিলো?”

“আমি জানি না।“

“এটা কিভাবে সম্ভব যে, তুমি জানো না?”

“যুদ্ধ না হলে কে যে যোদ্ধা তা কেউই জানে না। আমি জানি যে, আমার সেই ভাই যুদ্ধ করছে, কারণ সে আমাকে বলেছে গত সপ্তাহে। সে আমাকে বলে গেছে মা’কে রক্ষা করতে, কারণ সে শত্রদেরকে মারতে যাচ্ছিলো।“

“ আহ,” আমি বললাম। “যুদ্ধ।“

“তুমি অনেক প্রশ্ন করো,” সে বললো।

“কারণ, তুমি কোনকিছুই জিজ্ঞেস করো না।“

“আমি জিজ্ঞেস করবো,” সে বললো। “তুমি সেই মোটকা ছেলেটার কাছ থেকে লুকিয়ে থাকো কেনো?”

আমি কোন উত্তর দিলাম না। আমি আমাদের ব্যালকনির দিকে তাকালাম দেখার জন্যে যে, সেখানে কেউ আছে কিনা।

“তোমার উচিৎ না তাকে ভয় পাওয়া,” সে বললো।

সেদিন বিকেলে আমি শুনলাম আমার বাবা ব্যালকনির উপরে পাগল হায়েনার মতো হাসছেন। তিনি বিয়ারে চুমুক দিয়ে কোমর-সমান উঁচু কংক্রিট দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে ছিলেন, যেটি মাসরি’দের ব্যালকনিকে আমাদেরটা থেকে পৃথক করেছিলো। বোগেনভেলিয়া ফুলগুলো তার পায়ের কাছে দুমড়ে-মুচড়ে পড়েছিলো। অন্যদিকে নতুন বিবাহিতা মহিলাটি বাবার কথা শুনছিলো, যিনি তাকে শোনাচ্ছিলেন আমার সংগে আমেরিকা এম্বাসেডরের সাক্ষাতের গল্প। এই গল্পটি তিনি প্রায়ই শুনিয়ে থাকেন। আমার বাবা আমাকে ঈশারা করলেন তার পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর জন্যে। তিনি আঙুল দিয়ে আমার মাথার চুল এলোমেলো করে আমাকে খুব কাছে নিয়ে জড়িয়ে ধরলেন এবং তার গল্প বলতে থাকলেন।

সিভিল ওয়ার শেষ হবার কয়েক বছর পর আমি কিন্ডারগার্টেনে পড়তাম। সেই সময়ে আমেরিকান এম্বাসেডর আমাদের স্কুল পরিদর্শন করতে এসেছিলেন। তার সাথে ছিলো প্রতিবেদক ও চামচাদের একটি দল। এম্বাসেডর অনেকগুলো শিশুর সংগে আলাপচারিতা করেছিলেন। কথা শেষ হবার পর আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন,” দুই যোগ দুই কত হয়?” আমি কোনধরনের ইতস্তত না করেই বলেছিলাম, “ আপনি কি কিনছেন, নাকি বিক্রি করছেন?” সেখানে আমি নিজেকে একজন লেবানীজ বলে চিহ্নিত করেছিলাম, যে ভালো লাভের জন্যে নিজেদের আত্মাকেও বিক্রি করবে, যদিও তারা নিজেদেরকে ফোনেশিয়ানদের (Phoenicians) উত্তরাধিকার বলে দাবী করে থাকে। আমি নিজেকে আমার বাবার সন্তান বলেও পরিচয় দিয়েছিলাম, যিনি একজন মানিচেঞ্জারের ব্যবসা করেন।

আমার বাবা গল্পটা শেষ করে পুনরায় হায়েনার মতো হাসিতে ফেটে পড়লেন।

তার হাসিটা শেষ পর্যন্ত কৌতুকময় হেঁচকিতে পরিণত হলো। “তুমি আসলেই একটা মজার ছেলে,” বলতে বলতে তিনি আমার গাল টেনে আদর করলেন।

সকালের রোদে আমি আর মোহাম্মদ আলি আগের দিনের মতো একই দেয়ালের উপরে বসেছিলাম। খুব একটা কথা বলছিলাম না। প্রায় বিশ মিনিট আমরা চুপচাপ বসে থাকার পর সেখানে পিপো এসে উপস্থিত হলো।

“তোমার এই বন্ধুটি কে?”

পালিয়ে যাওয়ার কোন উপায় ছিলো না। মোহাম্মদ আলি তার ক্ষয়ে যাওয়া জুতার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমার হাতের পাতা ঘামছিলো।

“ ও আমার বন্ধু নয়,” আমি বললাম। “ওরা পাশের বাসায় এসেছে, কারণ ওদের বাসায় বোমা ফেলা হয়েছে।“

“সুতরাং তুমি আরেকজন কম বয়সী ছেলে পেয়েছো তোমার সাথে বাজে কাজ করার জন্যে?”

কিছু একটা ছেলেটির ভেতরে অনাবৃত হলো। সে তার মাথা তুলে রাগত দৃষ্টিতে পিপোর দিকে তাকালো।

“আমার দিকে ওভাবে তাকিয়ো না, ছোট্ট----“ পিপোর দৃষ্টি বিস্ফারিত হয়ে গেলো, যখন সে দেখলো মোহাম্মদ আলি একটা সুইস আর্মি ব্লেড দিয়ে তার বাহুতে এলোপাথাড়ি আঘাত করছে।

“তুমি যদি আরেকবার আমার সাথে কথা বলো,” মোহাম্মদ আলি বললো, “আমি তোমাকে খুন করবো।“

পিপো তার হালকা নীল শার্টের উপরে ছেড়া জায়গাটা দেখলো এবং তার ভেতর দিয়ে আঙুল ঢুকিয়ে দিলো। সেখানে কোন রক্ত ছিলো না। “এটা আমার প্রিয় শার্ট,’ সে বললো। “আমার মা আমার জন্যে কিনেছিল এটা।“

“তুমি যদি আবার আমার সাথে কথা বলো...”

‘এইবার পিপোর দিক থেকে বাধা এলো। মোটা দেহের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও সে যথেষ্টই দ্রুত গতি সম্পন্ন ছিলো। সে বাচ্চা ছেলেটার মুখে ঘুষি মারলো এবং তাকে প্রায় উড়িয়ে দেয়ালের উপরে ছুঁড়ে দিলো। সেটাই যথেষ্ট ছিলো না। পিপো তাকে ধাক্কা দিয়ে মাটির উপরে ফেলে দিয়ে তার বুকের উপরে চেপে বসলো এবং তার উপরে আক্রমণ শুরু করে দিলো। ছেলেটির শরীর থেকে রক্ত ফিনকি দিয়ে বের হবার পর এবং তার হাড্ডি ভেঙে দেয়ার পর সে চিৎকার করতে লাগলো, “ কি মনে করেছো তুমি পুচকে একটা ছুরি দিয়ে আমাকে ভয় দেখাবে?”

আমি পিপোকে থামানোর চেষ্টা করলাম, কিন্ত সে আমার উপরে লাফিয়ে পড়লো, যখন আমি তার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। সুবিধা করতে পারলাম না তেমন, ব্যাটা আমার চেয়ে বয়সে বড় শরীরটাও দশাসই। আমি সাহায্যের জন্যে চিৎকার করলাম। ভাবলাম, মোহাম্মদ আলি হয়ত মরেই গেছে। আমি এত জোরে জোরে চিৎকার করছিলাম যে, পুরো পাড়ার সবাই সেখানে জমে গেলো। ওয়াজদি পিপোকে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া আলির উপর থেকে টেনে তুললো।

কেউ একজন এ্যাম্বুলেন্স ডাকলো। অন্য কেউ ছেলেটার মাকে ডাকলো।

পিপো বিড়বিড় করলো,” “ও আমাকে ছুরি দিয়ে মেরেছে। ছুরি মেরেছে। আমি যাচ্ছি বাবাকে বলতে।“

যদিও আমরা তার পরিবারকে ঠিকমতো চিনতাম না, আমার বাবা-মা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্যে সিদ্ধান্ত নিলেন এবং আমাকেও তারা জোর করে নিয়ে গেলেন। হাসপাতালের বিছানায় মেশিন ও তার ভীত সন্ত্রস্ত মা দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে তাকে আর আগের দিনের বালকের মতো মনে হচ্ছিলো না, তার মুখের রেখা ও ছায়াগুলো পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিলো। মনে হচ্ছিলো আমি তাকে একুইরিয়ামের ভেতরে দেখছি। আমি সরাসরি তার মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। আমার বাবা অজ্ঞান হয়ে থাকা মোহাম্মদ আলির দিকে তাকিয়েছিলেন। তিনি মাথা নাড়ছিলেন যেন তার সামনে অভাবনীয় কিছু দৃশ্যমান। তার কাছে মনে হচ্ছিলো যে তার দৃষ্টির বিভ্রম হয়েছে। তিনি চোখ বন্ধ করে আবার খুলছিলেন। আমার মনে হলো তার বাড়ি ফেরা দরকার। এই মূহুর্তে তার মদ্যপান করা প্রয়োজন।

এদিকে আমার মা ছেলেটার মায়ের সাথে হাসপাতালেই থাকতে চাইলেন। কারণ মা পরিবার পরিজন ছেড়ে আসা মোহাম্মদ আলির মায়ের জন্যে আন্তরিকভাবেই দুঃখ অনুভব করছিলেন। আমি বাবাকে অনুরোধ করলাম আমাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে। আমি যখন তাকে অনুসরণ করে গাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম, তখন মোহাম্মদ আলির চাচী, নতুন বিবাহিতা মহিলাটি আমাদের দিকে দৌড়ে এলেন। উৎকট টাইট পোশাক পরা তার শরীরটা চিতাবাঘের মতো নড়ছিল। তিনি আমাদেরকে অনুরোধ করলেন তাকে একটা লিফট দেয়ার জন্যে।

সামনের আসনে বসে মোহাম্মদ আলির চাচী বকবক করতে এবং নার্ভাসভাবে হাসতে লাগলেন। তাকে দেখে মনে হলো না তিনি তার ভাতিজার অবস্থা নিয়ে মোটেও উদ্বিগ্ন। প্রতিটা মানুষই আঘাতজনিত চাপ পৃথকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আমাদের পক্ষে কখনোই যুদ্ধাকালীন আচরণ কি হবে তা বোঝা সম্ভব হয় না।

“পাশের এপার্টমেন্টে যাও এবং মহিলার সঙ্গে অন্তরঙ্গ সময় কাটিয়ে এসো,” বাবা আমাকে নির্দেশ দিলেন; তার কণ্ঠস্বরে কোন রাগ ছিলো না। 

আমাদের এপার্টমেন্টে শুধু বাবা আর আমি ছিলাম। তিনি একটা সাদা সোয়েট স্যুট ( sweat suit) পরেছিলেন। তার মানে হলো তিনি কোথাও বেড়াতে যাবার পরিকল্পনা করছিলেন। তার ব্যাকব্রাশ করে আঁচড়ানো চুল ও দৃষ্টির আতিশয্য থেকে তাকে আমার কাছে পূর্ব ইউরোপিয়ান বলে মনে হচ্ছিলো, যিনি প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন কোন নাইটক্লাবে যাওয়ার। 

ইসরাইলীরা বৈরুতের দক্ষিণ অংশে পুনরায় বোমা ফেলছিলো। এই সময়ে কেউই বাইরে বেড়াতে যাচ্ছিলো না। 

আমি বাবার সামনে স্থিরচিত্রের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। অথচ মনেপ্রাণে সেখান থেকে চলে যেতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু পারছিলাম না। চাচ্ছিলাম সবকিছু থেকে ছুটি নিয়ে বইয়ের ভেতরে ডুবে যেতে। আমার জিভে কেমন ক্যামিকেলের স্বাদ পাচ্ছিলাম। বাবা চাচ্ছিলেন আমি হলওয়ে অতিক্রম করে মাসরিদের এপার্টমেন্টে যাই এবং আমাদের প্রতিবেশিনী অর্থাৎ মোহাম্মদ আলির চাচীর সাথে সময় কাটিয়ে আসি। তিনি চাচ্ছিলেন এ কাজে আমি যেন সময়ক্ষেপন না করি।

“ওয়াজদিকেও নিয়ে যাও তোমার সাথে।“ বাবার কথায় আমার গোটামুখ আরক্ত হয়ে গেলো। কিভাবে কেউ কোন মহিলার সাথে কোনোরকম সম্পর্ক ছাড়াই শারীরিকভাবে ঘনিষ্ট হতে পারে? কি পদ্ধতি অনুসরণ করে তারা? পুরুষ ও নারীর মধ্যে কি কোন গোপন ভাষা আছে (যাকে বয়স্কদের ভাষা বলা যেতে পারে), যা আমি বুঝতে অক্ষম? “ওয়াজদি আমার আগে যাবে,” আমি বললাম। 

“না, তুমি আগে যাও। তুমিই বেশী প্রস্তুত। যাও এবং তার সাথে সময় কাটিয়ে এসো।“ তার চোখের দৃষ্টি আমাকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিলো। মনে হচ্ছিল, সেই মুহূর্তে এই বিষয়টি ছাড়া পৃথিবীর আর কিছুই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। 

“আমি বুঝতে পারছি না কিভাবে অসম্ভব কাজটা আমি করবো? আপনি কিভাবে জানেন যে, মহিলা আমার সাথে অন্তরঙ্গ সময় কাটাতে ইচ্ছুক? আমি আসলেই জানি না কি করা উচিৎ,” আমি প্রায় শিশুর মতো আর্তনাদ করে উঠলাম। বুঝতে পারছি আমি কোণঠাসা হয়ে গেছি।“

“মহিলাই চাচ্ছে ও অপেক্ষায় আছে। আর কেউই সেখানে নেই এবং সে বিড়ালের মতো উত্তাপে মিউমিউ করছে। যাও, এক্ষুনি যাও।“

“তার স্বামীর কি হবে?” 

“সে যা চায়, তা সে তার স্বামীর কাছে থেকে পায় না। তার স্বামী একটা নপুংসক, তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো। যাও।“ 

“আমাকে কি এখনই যেতে হবে? কেনো? আমি কি করে নিশ্চিত হবো যে, এই মুহূর্তেই সে অপেক্ষায় আছে?”

“কেনো না? সে বিড়ালের মতো মিউ মিউ করছে। যাও।“ 

“পারবো না। আজ সকালে আমি দুইবার হস্তমৈথুন করেছি।

বেঁচে গেলাম। 

বাবা বিরক্ত ভঙ্গীতে হাত নেড়ে বের হয়ে চলে গেলেন। একটু পর আমাদের পাশের এপার্টমেন্টটির দরজা বন্ধ হবার শব্দ শুনতে পেলাম। আমি চোখ বন্ধ করে ভাবতে চেষ্টা করলাম। বাবার সাদা সোয়েট স্যুট ক্রমশ কালোতে রূপান্তরিত হয়ে গেলো। 

এক ঘন্টা পর আমি লিভিং রুমে হাতলওয়ালা একটা চেয়ারের উপরে বসেছিলাম। বাবার মুখমণ্ডলের উপরে ঘামের স্বেদ জমেছিলো। তিনি তখনো এডিডাস এর তৈরি সেই সোয়েট স্যুট পরেছিলেন। কিন্তু সেটার সামনের দিকটা উন্মুক্ত ছিলো। ভেতর থেকে তার অন্তর্বাস দেখা যাচ্ছিলো। তার বুকের কিছু খুচরো লোম সেই অন্তর্বাস ভেদ করে বেড়িয়ে ছিলো। তার পেটকে আরও বড় মনে হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো সেটা একটা পুরো পৃথিবীকে গিলে ফেলেছে। তার চুলগুলো কপালের উপরে লেপ্টে ছিলো।

“আমি সাধারণত এমন কাজ করি না।“ তিনি নিচুস্বরে বললেন। 

“কোন কাজ?” জিজ্ঞেস করলাম। দৃশ্যমান কিছুই বিশ্বাস করতে চাচ্ছিলাম না আমি।

“তোমার মা ও আমি যখন এক শহরে থাকি, তখন আমি কখনোই অন্যকারো সঙ্গে অন্তরঙ্গ হই না। তাকে আমি খুবই শ্রদ্ধা করি। কিন্তু আমি তোমাকে দেখাতে চাচ্ছিলাম যে, এই মেয়েটি তোমার সাথে সময় কাটানোর জন্যে প্রস্তুত ছিলো। কিন্তু তুমি আমার কথা শুনলে না। বাবা আসলে আমার কাছ থেকে সহমর্মিতা চাচ্ছিলেন। কিন্তু আমি এতোটাই বিস্মিত ছিলাম যে, তার কথার কোনোই প্রত্যুত্তর করতে পারলাম না। “সে বিড়ালের মতো মিউ মিউ করছিলো, আমি বলেছি তোমাকে। তোমাকে শুধু যা করতে হতো, তা হলো সেখানে যাওয়া। প্রয়োজনটা তারই ছিলো। তুমি চাইলেই তাকে পেতে পারতে। কিন্তু তুমি চাইলে না এবং আমাকে বাধ্য করলে সেটা করতে। অগত্যা আমাকেই তা করতে হলো তোমাকে দেখানোর জন্যে।“ 

গ্রীষ্মের বাতাস ম্যাজেন্টা রঙের ফুলগুলোকে নিয়ে ব্যালকনিতে ঘুর্ণির সৃষ্টি করছিলো। সেগুলোকে দেখতে মনে হচ্ছিলো বলরুমের ভূতুড়ে গাউনের মতো। আমার বাবা আমার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে জানালার দিকে, নাচের দিকে, বৈরুতের দিকে এবং আমাদের শহরের দিকে তাকালেন। সবকিছুই ক্রমশ ভেঙে পড়ছিলো। 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ