সাদিক হোসেন : গল্পের কাছে কী চাই


আমার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে আমি গল্পের কাছে কী চাই। সহজ কথা সহজভাবে বলে দেওয়া ভালো। এই মুহুর্তে, আমি এমন বাংলা গল্প পেতে চাই যা দিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রীর মুখে ঠাসিয়ে থাপ্পড় মারা যেতে পারে! 

আমি গল্পের কাছে ঘেন্না চাই। রেগে গিয়ে শুয়োরের বাচ্চা বলবার মতো আরাম চাই। পেঁদিয়ে পোঁদের চামড়া গুটিয়ে নেবার মতো অক্ষরের প্রয়োগ দেখতে চাই। পেনের নিব দিয়ে চোখ গেলে দেবার পর হো-হো করে হাসবার মতো পবিত্র বানান ভুল চাই। 

এমন গল্প হোক যা বদলা নিতে পারে। 
এমন গল্প হোক যা লাথি কষিয়ে কচুবনে ফেলে দিতে পারে। 

তৎসম ও তৎভব শব্দের মধ্যিখানে যেন মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলতে পারি। সেখানে দিনরাত রান্নাবান্না করা হবে। একসঙ্গে সমুদ্রস্নানে যাওয়া হবে। ইস্তেহার দিয়ে সাজান হবে ঘরদোর। রাস্তায় মাইন পোঁতা থাকবে। তারপর রাতেরবেলা চাঁদ উঠলে অভিধানের পাতা খুলে দেখা হবে কোথাও কোন ভুল ছিল কী না। শব্দগুলোকে এধার-ওধার সরিয়ে দেব। তন্ত্রীর পর তন্দুর; তারপর তন্দ্রা। সোচ্চারে বলব – এই বিন্যাস মানি না। পাল্টে দেব শব্দের অবস্থান। আগে তন্দুর লিখব। তার সঙ্গে চলে আসবে বিছানা, বালিশ ও শেষে তন্দ্রা। খুব ঘুম হবে আমাদের। মক্তাঞ্চলকে পাহারা দেবে এক-ফর্মার, দুই-ফর্মার ম্যাগাজিন। প্রতিটা ম্যাগাজিনের হিসেব রাখা হবে। অতি তীব্রতায় ফ্যাসিস্টদের বুকে যেন ঢুকে যেতে পারে প্রথম সুযোগেই। 

একটা সাদা পৃষ্ঠার উপর হত্যাকারীদের লিস্ট বানাব। সেখানে মুতবো। আমি চাই গল্পে সেই মুতের গন্ধ উঠে আসুক। 

মগডালে ঝোলাবার মতো বাক্য চাই।
পেটে গিঁথে দেবার মতো যতিচিহ্ন চাই। 

পাগড়ির ভেতর লুকনো ছুরিকা যেন কোনো রূপক না হয়ে ওঠে। আকাশের চাঁদ যেন শুধু কাস্তের বিবরণ না হয়ে যায়। তাওয়া থেকে নামানো রুটির মতো রক্ত গরম করুক বাংলা গল্প। আমরা ছাই মেখে কুয়াশার ভেতর অপেক্ষা করে আছি। আমাদের পাঠান্তরে যেন সমবেত প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়। 

দিগন্তে আলকাতরা লেপে দেব। 
নাচব। 
গাইব। 
হাইকু পড়ব। 

সারারাত মশাল জ্বেলে দৌড় করাব। কুত্তার মতো হাঁফিয়ে উঠলে মুখের সামনে জলভর্তি কলসী ভেঙে দেব। মরবার আগে দু-বিন্দু জলও দেব না। 

চুড়ান্ত ঢ্যামনামো হবে। 

এই ছাদ থেকে লাফিয়ে ঐ ছাদে ল্যান্ড করব। এই পাঁচিল থেকে ঐ পাঁচিলে পেটো ছুঁড়ব। বিচারসভা বসাব। ক্রোনোলজি বোঝাব। হেভি খিল্লি করব। 

লুকিয়ে লুকিয়ে অফিস যেতে পারবে না। বাস থেকে টেনে নামিয়ে দেব। প্যাঁক দেব। কান মুলে দিয়ে ন'টা-বারো'টার শোএ চলে যাব। 

এমন গল্প হোক যা দিয়ে রান্না করা যাবে। 
এমন গল্প হোক যার সামনে সেজদা দেওয়া যাবে। 
কনভয়ে ঢুকে গিয়ে মোটাভাইকে জিজ্ঞেস করা হবে দেশ কি তোর বাপের? 

ওদের অধিবেশনগুলো ভালো। আরশোলা ভালো। ইঁদুর ভালো। ওরা অধিবেশনের পর চা-কফি খায়। উইগ পরে বক্তৃতা দেয়। ধ্বনিভোটের ন্যাকামু করে। ওদের টয়লেটে কর্পুরের গন্ধ ভাসে। ওদের ছেড়ে দেব? না উবু করে বসিয়ে পিঠে পেস্টিসাইড প্রয়োগ করব? বাংলা গল্পকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সে কী চায়। 

নো কামিনীতলা, নো ঢংবাজ, নো ত্রিকোণ-চতুষ্কোণ সখিসখা প্রেমপিরীতি কাঁঠালের আঠা, নো ভবসাগর দেহতরী চদুমার্কা আদিখ্যেতা। বাংলা গল্প সোচ্চারে জানাক সে কার পাশে দাঁড়াতে চায়। 

ইন্টারোগেশন রুমের মতো গল্প চাই। টানা দুই দিন কপালের উপর ১০০ পাওয়ারের বাল্ব জ্বালিয়ে রাখব। 

বালিভরা কন্ডোম দিয়ে খিচে দেব। 
ন্যাংটো করে বরফে শুইয়ে রাখব। 

এমন গল্প হোক যা দিয়ে শতরঞ্জি বোনা যাবে। রাজপথে শতরঞ্জি বিছিয়ে আমরা বসে থাকব। দিনের পর দিন। রাতের পর রাত। হাজারে হাজারে। লক্ষে লক্ষে। গাড়িঘোরা সব বন্ধ। পার্লামেন্টের গেটে তালা ঝুলছে। লোকসভায় গান ধরেছেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস... 

এখনি তবে গ্রামে গ্রামে জ্বলে উঠল নব নিশান। ঐদিকে পাহাড় থেকে নেমে এল নতুন সূর্য। ঐদিকে শহরে গর্জে উঠল ডোরাকাটা বাঘ। 

স্টীলের মতো সলিড গল্প চাই। 

এমন গল্প হোক যা দিয়ে জলকামান বানানো যাবে। তারপর ঘর থেকে একে একে টেনে নামিয়ে জলকামানের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যাবে। বিচারপতিরাও ভয়ে বারান্দায় উঁকি দিতে পারবে না। মনে করুণ তখন ডিসেম্বর। দিল্লির তাপমাত্রা চার ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। 

প্যালেট গান চাই? পাবেন। 
হ্যান্ড গ্রেনেড চাই? পাবেন। 

শাসকের মাথায় হাতুড়ি পেটানোর শব্দ শুনতে চান? পাবেন। 

হে গাছপালা, বনভূমি, পার্বত্য অঞ্চল, হে নদী, পথঘাট, হে সেতু, পাখিদের কুহু আর ননদীর লণ্ঠন, হে বাজারের থলি, শাকসবজি...এইখানে আমাদের সঙ্গ দাও। এসো গল্পের ভেতর। হাতপাখা ঘোরানোর মতো অনায়াসে সরিয়ে দাও জঞ্জাল। বারান্দায় বাঁকা রোদ এসেছে। চলো ওখানে। ঐখানে খানিক আলাপচারিতা করি। 

সন্ধেবেলা, দূর থেকে দেখা গেল, জঙ্গলে আগুন জ্বলছে। আর তেল চকচকে কালো শরীরগুলো লাঠি হাতে মফস্বলের বাজার পাহারা দিচ্ছে। বাবু গো, সাবধানে থেকো, পাল্টা বাহিনী তৈরি করে নিয়েছে বাংলা গল্প! এমন চেতাবনি যেন শুনতে পাই। 

সুযোগের সন্ধানে থাকুন। নজরে রাখুন ওরা কখন ঘর থেকে বেরচ্ছে, কখন ঘরে ঢুকছে। কতক্ষণ একা থাকছে। 

একা পেলেই কোমরে লোকানো অক্ষরগুলোকে বার করে নিন। 

খ-টাকে দেখুন। যেমন ধারাল, তেমনি প্যাঁচাল। গলার নলিটা কেটে দিলে আর রেহাই নেই। 
প-টা তো হাতুড়ির মতো। মাথার পেছনটায় সপাটে চালিয়ে দিতে হবে। 
চ-এর নিচের অংশটায় আঙুল ঢুকিয়ে সামান্য ঘোরালেই কেল্লাফতে। 

গোপনে বাংলা অক্ষরে শান দিন। 

বাক্যবিন্যাসকে জটিল থেকে জটিলতর করতে থাকুন। যেন ভুলভুলাইয়া। একবার ঢুকলে আর বেরতে পারবে না। 

যে লোকটা প্লাটফর্মে চা বিক্রি করছে। আসলে সে 'দ'। 
যে মেয়েটা আয়ার কাজ করত। এখন কাজ হারিয়েছে। আসলে সে 'ভ'। 
এরকম আরও অনেকে আছে - হ, ত, ফ... 

এঁরা আত্মগোপন করতে পারে। আবার মুহুর্তে সেনাপতি। 
বাংলা গল্প সিদ্ধান্ত নিক সে কোন্ সেনাপতির পেছনে গিয়ে দাঁড়াবে। 


গল্পের কাছে কী চাই? 
হা-হা-হা। 
বদলা চাই। 





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

6 মন্তব্যসমূহ

  1. ঠিকই লিখেছেন তবে একটা স্যাম্পেল পেলে ভালো হতো।

    উত্তরমুছুন
  2. দারুণ দারুণ দারুণ
    ঠিক ঠিক ঠিক

    উত্তরমুছুন
  3. কি সাংঘাতিক কথাবার্তা। 'প্রধানমন্ত্রীর মুখে ঠাসিয়ে থাপ্পড় মারা!!' একেবারে মামলা ঠুসে দেবে যে! গল্প তখন কুয়োয় গিয়ে পড়বে। বলতেই হবে...সাহসী লেখা।

    উত্তরমুছুন