কাজল সেন : গল্পের কাছে কী চাই



মানুষ তার জন্মগত স্বভাবদোষে সবকিছুরই পরিণতি আশা করে। তা সে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধার্মিক, শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্য-শিক্ষা, ব্যক্তিগত ও সামগ্রীক জীবনযাপন, যাইহোক না কেন। অন্যদিকে প্রকৃতি তার সৃষ্টিগত স্বভাবগুণে কোনো পরিণতির ধার ধারে না। প্রতিনিয়ত সে ব্যস্ত থাকে তার সৃষ্টির নিত্যনতুন লীলাখেলায়। কোনো নির্দিষ্ট পরিণতিতে পৌঁছনো মানেই তো সেই সৃষ্টির সম্পূর্ণতা! আর সম্পূর্ণতা মানেই স্থবিরতা। কিন্তু প্রকৃতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট তা নয়। আর এখানেই আসল দ্বন্দ্ব মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির বা সৃষ্টির। এবং বিশ্ব সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতেও একই কথা প্রযোজ্য। বিশেষত কথা সাহিত্যের ক্ষেত্রে সাধারণ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে, গল্প বা উপন্যাস অথবা উপন্যাসিকা পাঠের পেছনে যে চাহিদাগুলো মূলত সক্রিয় থাকে, তারমধ্যে প্রধান চাহিদা হলো, তারা পাঠশেষে একটা নির্দিষ্ট পরিণতি আশা করে। গল্পের নটে গাছটি না মুড়োনো পর্যন্ত যেন তাদের মন পরিতৃপ্ত হয় না, বরং রসভঙ্গ ঘটে। আর তাই অধিকাংশ লেখকদের তাঁদের পাঠক-পাঠিকাদের এই চাহিদার কথা মাথায় রেখে, গল্পের বৃত্ত রচনায় মনোযোগী হন। এবং সেই বৃত্তরচনা অর্থাৎ গল্পের উপক্রমণিকা থেকে উপসংহার যে গল্পকার যত নিখুঁত ও নিপুণভাবে সম্পন্ন করতে পারেন, তিনি তত পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠেন। কিন্তু গল্প যেহেতু গণিত নয়, তাই কোনো নির্দিষ্ট উত্তর বা পরিণতি তার থাকতে পারে না। সচেতন গল্পকাররা একথা জানেন ও বোঝেন। কিন্তু জনপ্রিয়তা লাভের আশায় অথবা জনপ্রিয়তা হ্রাসের আশঙ্কায় তাঁরা পাঠকদের চাহিদাকে অগ্রাহ্য করার সাহস দেখাতে দ্বিধাগ্রস্ত হন। আসলে সাহিত্যের প্রবাহমান ধারায় গা ভাসানো যতটা নিরাপদ, স্রোতের ধারা অন্যকোনো অভিমুখে বা ‘ডাইমেনশনে’ ঘুরিয়ে দেওয়া ততটাই বিপজ্জনক। এবং সেই প্রয়াস যদি যথার্থই দক্ষতার সঙ্গে যাঁরা করেন বা করেছেন, সমকালীন পাঠক-পাঠিকা তাঁদের বরণ করার জন্য আগ্রহী না হলেও ভবিষ্যতের পাঠক-পাঠিকা যে উন্মুখ থাকবেন, একথা নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে। 

আলোচনার প্রাসঙ্গিকতায় আমি একটা ঘটনা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। উদাহরণটা অবশ্য সাহিত্যের গল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও, মূলত চলচ্চিত্রের গল্পের সঙ্গে বেশি সম্পর্কিত। সাহিত্যিক অমলেন্দু চক্রবর্তীর একটি গল্প ‘একদিন প্রতিদিন’ অবলম্বনে মৃণাল সেন পরিচালনা করেছিলেন ‘একদিন প্রতিদিন’ চলচ্চিত্র। সেই গল্পে ও চলচ্চিত্রে একটি মেয়ের গল্প বলা হয়েছে, যে মেয়েটি হঠাৎই একদিন প্রতিদিনের মতো অফিস থেকে সন্ধ্যেবেলায় ঘরে ফিরে আসে না। যখন ফিরে আসে, তখন রাত অতিক্রান্ত হয়ে ভোর হয়ে এসেছে। ‘একদিন প্রতিদিন’এর প্রিমিয়ার শো হয়েছিল কলকাতার মেট্রো সিনেমাহলে। মৃণাল সেনের মুখ থেকে শুনেছি, তিনি নিজেও সেদিন মেট্রোতে উপস্থিত ছিলেন। ছবির প্রদর্শন শেষ হতে মেট্রোর লাউঞ্জে একদল দর্শক ঘিরে দাঁড়ান তাঁকে। তাঁর কাছে তাঁদের আবদার ছিল, এভাবে ছবির গল্পটা শেষ কেন হয়েছে? আমরা জানতে চাই, সারারাত মেয়েটি কোথায় ছিল? কী করছিল? উত্তরে মৃণাল সেন বলেছিলেন, মেয়েটি সারারাত কোথায় ছিল, কী করছিল, তা আমিও জানিনা। জানার দরকারও নেই। ছবিতে শুধু দেখাতে চেয়েছি, কোনো মেয়ে রাতে ঘরে না ফিরলে তার পরিবারে ও পাড়ায় কী বিপত্তি ঘটে। গল্পটা শুধুমাত্র এইটুকুই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ