কৃষির মেয়ের নাম ইমলি। জোত জমি ছিল না। কিন্তু বসত বাড়ির উঠোনে বাগানে সবজি, ফুলের বাগানের শখ ছিল সুরেশবাবুর। ‘মন রে কৃষি কাজ জান না’ সুর ভাঁজতেন। শেষ বয়সে স্ত্রীর শেষ ফলনের নাম রাখলেন কৃষি। আরো ত্রিশ বছর পর, সুরেশবাবু তখন নেই। কৃষির দাদা ভাগ্নির নাম রাখলেন ইমলি। কংক্রীটের ফ্ল্যাট হয়ে যাওয়া পাড়ার মাঠে কোনও গাছ নেই। গাছ কেটে কলোনি হবার আগে মাঠে ছিল বিরাট এক তেঁতুল গাছ। ডালে পাতায় ফলে আলো অন্ধকারে ছমছমে গাছটার শরীর ঘিরে কত গল্প। কৃষির মেয়ের নামে সেই গাছটা রইলো।
গল্প হারিয়ে গেছে পৃথিবীর। রকে বসে ভ্যাটানোর শিল্প লুপ্ত। কৃষি লুপ্ত। শিল্প লুপ্ত। সিসি টিভি লাগানো পৃথিবীতে কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়। তো সেই দৃশ্য এমন একঘেয়ে- তিন রাউণ্ড গুলি চালিয়ে মাত্র তিনটি লাশ। এক নাগাড়ে আঠারো ঘন্টা চাবকিয়ে মুখে রাম নামের রক্ত তুলে মৃত্যু। এর চেয়ে স্মার্ট কিছু হয় না! দশ সেকেন্ডের ফিল্ম বানায় নতুন পরিচালকরা- কী ঝকঝকে সব ছবি। অশ্বিৎসের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের মতো স্মার্ট- লাইন করে চেম্বারে ঢোকাও। ধোঁওয়া ছাড়ো। মারো।
তবে ধোঁওয়া টোওয়ায় পলিউশন, দূষণ হয়। সেটা তো পরিবেশের পক্ষে খারাপ, না? একবিংশের গ্রীণ ওয়ার্ল্ড মিশনের সঙ্গে সেটা যায় না। একটা স্পীচ বা সুর থেরাপি- হলে কেমন হয়? সুরের থাকবে মাদকতা, গরল সম। মানে বিষের মতো সুর, যে শুনবে ঢলে পড়বে… ইষ্ট নাম বাজিয়েও কাজটা সারা যায়। তাতে মৃত্যুও হল। মোক্ষও হল। না। না। সেখানে চয়েস থাকবে। হেঁদু হেঁদুর গানই শুনবে। কীর্তনের মর্ডাণ সুর শুনতে চাইছে না? তো সাবেকী সুরটাই পাবে। সেই ভুবনেশ্বরী যে সুরে গাইতেন- ‘মরিব মরিব সখী নিশ্চয়ই মরিব…’
‘আহা’!
হ্যাঁ, মরতে চেয়ে ‘আহা’... শব্দটি কানে লেগে আছে যেন! মৃত্যুর মোকাবিলায় পদাবলীর কী গভীর ব্যঞ্জনা। মৃত্যুকে ডাইলিউট করার সুর ভাবছিল কৃষি। মুসলমানরাও ইষ্ট নাম শুনতে শুনতে মরবেন। আজানের গিটকিরি সুর ভালো লাগছে না। সুফী গান, কী কালোয়াতী সবই চলতে পারে। খ্রীস্টানরা সেই চার্চের ক্যারল গাইবে- বাংলা সুরের ‘মঙ্গল দীপ জ্বেলে’র বাইরে অন্য কিছু। ‘গড সেভ দ্য কিং’ এর টিউনও চাইতে পারে। যেমন চাইবে কাস্টমার। মৃত্যুর আবার কাস্টমার কী! তো ভালো একটা শব্দ খোঁজো। ক্রেতা-বিক্রেতার বাইরে কোনও সম্পর্ক হয় নাকী! যাঃ! আসলে এগুলো সবই বকওয়াস। একটু রয়ে সয়ে মৃত্যুকে সইয়ে নেওয়া। মৃত্যু মানে ফটাস এবং শেষ- এতটা সহ্য হয় না। মাঝামাঝি একটা কিছু। জীবন আর মৃত্যুর মাঝামাঝি একটা টুরিস্ট স্পট। হোম স্টে! লামাহাট্টার মতো কিছু একটা। চারিদিকে স্কোয়াশ আর সানতারা, কমলা লেবু… কুয়াশা আর পাখির ডাক। ঝর্ণার শব্দ। নদী দেখা যাচ্ছে না… তবে আছে। আছে কি? মমতার চমৎকার রান্না আর দাজুর ঘরোয়া পানীয়। তবু সত্যি নদী ছিল না। ব্যারেজের দাপে তিস্তা মৃত।
বিপদভঞ্জন রুনুঝুনুর বাবা কৃষির সেজদা এখন সেই হোম স্টেতে। তাঁকে নিয়ে সবাই খুব ভাবনায়। সারাদিন কী সব ছবি দেখছে। কার গলা শুনতে পাচ্ছে। ছোটোরা মজা পাচ্ছে। বড়রা চিন্তিত। সেজদা বোধহয় দৌড়াতে দৌড়াতে মাঠের শেষে চলে এসেছে। মাঠের শেষে ইমলি গাছ। তারপর পদ্মা নদী। ওপারে মা বাবা জ্যেঠুকাকু বড়মা সব্বাই সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। সেজদা চলে যাবে।
দিদি, বৌদির সাথে কৃষি যাচ্ছে কথা শুনতে। কথা শোনা ব্যাপারটা কী সু্ন্দর না! তার প্রথমে ছিল টিভি-নেশা। পরে ফেবু- মগ্নতা। কত কত ছবি। গান। খাদ্য। বিলাস ব্যসন। কত রকমের প্রেম। পুরুষ। যৌনতা। দেখতে দেখতে দেখতে দেখতে।
শুনতে শুনতে শুনতে শুনতে। কৃষি কথা ভুলে গেল। কথা জুড়ে জুড়ে ছবি আঁকা ভুলে গেল। কল্পনা বলে আশ্চর্য একটা শক্তি হারিয়ে গেল। সেজদা কথা বলছে অনর্গল। কি কথা- কি কথা? ‘ইমলি’ নামটা সেজদার দেওয়া। সেই গাছের কথা তো খুব শোনাও হয়নি। কোনওদিন। সেজদা শোনাবে?
সেজদা, ইমলিতলার ধারে কাছে গেল না। বলল, ইমলি হিন্দী শব্দ। আমরা বলি তেঁতুল।
কৃষি খোঁচায়- বাঃ! তুমিই তো রেখেছিলে! পাত্তাই দিল না সে কথায়- কত বড় গাছ জানিস! একদিনও ঢিল ছুঁড়ে গাছের মাথা টপকাতে পারিনি। ওইসব গাছ নিয়ে গুজব করতে নেই।
আসলে নিজের কথা বলবে। খুবই টেনসড দেখায় তাকে। বলে - শুয়ে থাকলেই কথা শুনি। কে যে বলে দেখতে পাইনা। কী চমৎকার গলার স্বর…
-কী বলে?
-কত কি যে বলে। ঐ যে সিধু বোস- ওর একটা অবৈধ সম্পর্ক ছিল না? ক্লার্ক মেয়েটি, ঐ যে পেছনে থাকত…
-লবদের বাড়ি?
-না। না। রামদের বাড়ি… সিধু বোসকে বলল- যাও, বউয়ের সঙ্গে ঝামেলা মিটিয়ে নাও। সেই সব কবেকার কথা!
কৃষি দেখল তাদের চোতেকাপ ঘরের পাশে টানা টিনের বারান্দা। বারান্দার পাশে দুটো আমগাছ আর কাঁঠালগাছ। গাছের গা ঘেঁষে বেড়া। আর বেড়ার ওপাশে সিধু কাকুর ঘর। ঘর একটু পেছনের দিকে হওয়ায়, সামনের মাঠ অনেকটা। বোসদের মূল বাড়ি থেকে একটু বিচ্ছিন্ন। সেই ছয়ের দশকে স্বামী-স্ত্রীর আলাদা সংসারের একটা অস্পষ্ট জলছবি। ঘরটি পরিপাটি করে সাজানো। টেবিলে ক্রুশের টেবিল ক্লথ্। বুকভরা মধু, বঙ্গের বধুর ছাঁদে সিধু কাকুর বউ বাবলি কাকীমা। বরের দাপটে একদম সিঁটিয়ে থাকতেন। সিধু কাকুর ঠাকুমা, ভালো মানুষ। ছেলে তাকে মান্যি করে খুউব। কিন্তু মায়ের কথায়, বউয়ের ওপর নরম হবে, এমন বান্দা নয়। ষণ্ডা গণ্ডা বদ মেজাজী সিধু কাকুর পাশে শালিখ পাখির মতো বাবলি কাকীমা… কাকুর যে প্রেমিকা ছিল, এই প্রথম শুনলো কৃষি।
আর এই যে পাড়ার কেচ্ছা। সেজদা এসব শোনে জেনে অবাকও হল খুব। তীক্ষ্ণ নাক আর ফালা ফালা চোখ নিয়ে যৌবনে চমৎকার চেহারা ছিল সেজদার। আড্ডা, তাসখেলা, ঘুরে ঘুরে সমস্ত মাঠের খেলা দেখতো সে। রসিক দর্শক। আর ছিল মড়া পোড়ানোর শখ। জন্ম বোহেমিয়ান। খাওয়ার সময়টুকু ছাড়া অন্য সময় টিকি দেখা যেত না বিপদভঞ্জনের। নাকটা অত্যন্ত খাড়া দেখাচ্ছে, মুখের চামড়া শুকিয়ে যাবার জন্য। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। তবু সে যে একটা সুন্দর কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছে।
সেই আনন্দে তার মুখ উদ্ভাসিত। হোক না সে কণ্ঠ কেচ্ছা গল্প বলে, কিন্তু কী সুন্দর কণ্ঠ।
কৃষি, হ্যাঁ করে দেখতে থাকে সেজদাকে। বলে তারপর?
সেজদা, দু-একবার এ্যাঁ- এ্যাঁ করে। কানে কম শোনে আজকাল। আমার প্রশ্নটা - তারপর কী হল, তারপর কী হয় বলে রিলে করে বড়দি। তখন শুনতে পায়। আর হাত উল্টে বলে- তারপর আর কি? কিছু না!
-আর কিছু বলে না।
-বলে তো। গলা শুনলে প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। অন্য কথা বলে...
-কি কথা?
-ওই সেদিন। হাজী সাহেবের গল্প বলল। তার আগে হাঁস শেয়ালের গল্প, আর একদিন সাতাশ ঘড়ার গল্প… এমন কত কী!
-কে হাজী সাহেব।
-এই যে বক্ষটুলির। ইজ্জৎ মাংস দিত না? ওর নানা। জেলে আছে। রাজামশায় জিজ্ঞাসা করে কী খাও- বলে, মাংস ভাত। এই রকম রোজ রোজ বলে। শুনে শুনে রাজা নিজে একদিন দেখতে গেল। গিয়ে তো দেখে হাজী খাচ্ছে ডাল আর ভাত। তবে যে বলে- মাংস ভাত। তবেই দেখেন। ওরাও তো আপনাদের তাই বলে। দেখেন কী খাই…
কৃষি আর সবাই হাসে খুব। মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প চালিয়ে দিচ্ছে সেজদা। এরপর করুণ চোখে তাকিয়ে হাত নাড়িয়ে বলে
-বুধা বোসের ছেলের কথাও বলে।
- কে সে?
-ওই যে কংগ্রেসের নেতা বুধা, তার ছেলে জিতের বন্ধু ছিল না! ললিত মোহন স্কুলের কাছে বাড়ি। দোকান ছিল একটা, ওইখানে জিৎ যেত তো, ওখানেই কী গণ্ডগোল হল- বুধার ছেলেই কার সঙ্গে সাট করে মারল ওকে…
এই গল্পটার জন্য তারা কেউ প্রস্তুত ছিল না। দমবন্ধ করে মেরে জিৎকে কলেজের পুকুরে ফেলে দেয় কে বা কারা। জিৎ ভেসে ওঠে কিন্তু খুনিদের নাম তো জলের তলায় ডুবে থাকা ভালো। বড় বৌদি ধমক দেয় সেজদাকে- কী আবোল তাবোল বলছো। এসব কথা বলবে না। তোমার অন্য সব ছেলেরা আছে। যা নেই, তাকে নিয়ে কী বল!
না। না। আমি কী বলেছি। ওই যে কে যেন, চমৎকার গলা, কত কী বলে। ওই তপন দত্তর বাড়ির কথাও বলল।
-বাড়ি তো ফ্ল্যাট হচ্ছে।
-হ্যাঁ। সেই তো। ওই যে তপনের শালা মন্ত্রী রূপক ফৌজদার, তার জোরেই তো ঘোষদের দোতলাটা মাত্র চার লাখ টাকায়
কিনেছিল তপন। এখন কত টাকা পাচ্ছে জানিস? বাপ ছেলের দুটো ফ্ল্যাট আর চল্লিশ লক্ষ টাকা, ভাবা যায়? কত টাকা…
-তোমার ওই সুন্দর কণ্ঠস্বর তপনদার ফ্ল্যাটের কথাও জানে?
-হ্যাঁ, সেটাই আশ্চর্য, সব জানে। আর মিলির বড় ছেলে আর ছোটো ছেলের বাড়ি নিয়ে গণ্ডগোল। বাড়ি ভাগ নিয়ে-সেটাও বলল।
-দুই ছেলেই তো খুব ছোট, ওদের বাড়ির ভাগ কেন?
-কী জানি কেন! দুই ছেলের বাড়ি নিয়ে কী যে গণ্ডগোল!
বড়বৌদি ধমক খেয়ে জিতের কথা চাপা দিতেই কী সেজদা তপনদার ফ্ল্যাটের কথা আনলো, মিলির ছেলেদের কথা আনলো। জিৎ বেঁচে থাকলে আরো একটা ফ্ল্যাট পেতো সেজদা। এই কথাটা সত্যি, কিন্তু যে নেই, তার জন্য ফ্ল্যাট কীভাবে চাইবে। মিলির দুই ছেলে। বড়টা ১৪, ছোটটা ৭… বড় হলে তাদের ফ্ল্যাট নিয়ে কাজিয়া হবে তো, হবে না!
সুন্দর কণ্ঠস্বর ভবিষ্যতের সেই সত্যিটা বলে। ওরা যখন বড় হবে নিশ্চিত সেজদা থাকবে না তখন।
-ইট পেতে রাখতাম, জানিস তো আবার কথা বলতে শুরু করেছে সেজদা।
-কোথায়?
-আরে ওই তেঁতুল গাছ। মনে নেই তোর। তার পাশে সেই বিরাট পুকুর। মাছ ধরার জন্য সারাদিন টানা বসে থাকা। হাগু মুতু করতে গেলে যদি দখল হয়ে যায়… আর দখল হয়ে গেলে। ফিরে পাওয়ার উপায় নাই। আইন আদালত করবি। হাঁসরা নাকি শেয়ালদের সাথে! সেই হাঁস আর শেয়ালের গল্পটাও তো বলল, সেই সুন্দর গলা।
গল্পটা কেউ ধরতে পারে না।
-সেটা কোন গল্প?
-ওই যে পুকুরে একটা হাঁসকে স্নান করতে দেখে শেয়ালের জিভ লকলক করছিল। কেন তুই এখানে স্নান করছিস। তোর ঘাড় মটকাবো। হাড় চুষে খাবো।
হাঁস প্রতিবাদী। কোর্টে গেল। তা কিছু কি হল! হাঁস কি বাঁচল? মোটেও না। কোর্টের উকিল, মোক্তার, জজ জুরি সব্বাই তো শেয়াল। সব্বাই যেখানে একই দলের, তখন সেই কোর্টে না যাওয়ায় বুদ্ধিমানের কাজ, না?
তেঁতুল গাছের গল্প শুনেছে কৃষি। দেখেনি। ইট পেতে মাছ ধরার জায়গা ধরে রাখা- সেটাও নতুন। পুকুরও দেখেনি সে।
ওখানে কি পুকুর ছিল? পুকুর ছিল কলেজের। আর পুকুর ছিল সিমেট্টি রোডে, জেলা স্কুলের পাশে। বিবির পুকুর।
কলেজের পুকুরটা কৃষি ভুলতে চায়। সেজদাও নিশ্চয়ই চায়।
-তোমার ওই কণ্ঠ, এসব গল্প বলে?
-বলে তো। কী সুন্দর গলা। টলটলে জলের মতো।
-দেখোও নাকি! কেমন দেখতে?
-না না, দেখি না। দেখলে তো সব শেষ। শুনে শুনেই কেমন দেখি...অনেকক্ষণ ধরে কথা বলে হাঁপিয়ে যায় সেজদা।
-জল খাবি?
বয়াম খুলে একটা লজেন্স বের করে দেয় রুনুর বউ। বলে পিসি, এটা দাও বাবা লজেন্স ভালো খায়। লজেন্স মুখে নিয়ে সেজদা একটু টেনে টেনে বলে ইট পেতে রাখলে দখল হয় না। কিন্তু ইটই তো নাই...
শীলা ফিস ফিস করে বলে- দাদা থাকলে একটা ফ্ল্যাট পেতো। বাবা ভুলতে পারে না। আসলে আমাদের সবারই দুটো করে ছেলে তো। অসুবিধা না?
মিলি- ছোড়দার মেয়ে। ছোটো বৌদি একই কন্যা। ছোড়দা শ্বশুরবাড়ি পেয়েছে। বসত বাটিতে ফ্ল্যাট পেয়েছে। মিলির দুই ছেলে- বড় হয়ে এবাড়ি ওবাড়ি- এসব নিয়ে গণ্ডগোল হবে না? মিলির দুই ছেলের বয়স আর সবে চোদ্দ- তাতে কী! সেজদা গণ্ডগোলটা শুনতে পায়। কিন্তু শেয়ালের কোর্টে আবেদন রেখে লাভ কী! চুষে চুষে লজেন্স খাওয়া শেষ হয়। জলও খায় এক ঢোক। বড় বৌদি রগড় করে-
-বচনের কচুরি চলবে নাকি? এক পিস্
-রুনুঝুনু বৌমারা- কেউ খেতেই দেবে না।
-হ্যাঁ। খেয়ে বিছানায় শুয়ে হাগো আর কি, দয়া দেখবে তো!
দয়া, সেজদার বউ। নিজের ফ্ল্যাটে ছোটো ছেলে কানুর ঘরে ছাপা ম্যাক্সি পরে পদ্মফুলের মতো সেজদার সুন্দর বউ বসে বসে টিভি দেখছে। ফেরার পথে কোর্ট থেকে কানু চিকেন রোল আর কাঁচা সন্দেশ নিয়ে আসবে। স্বামী বাউন্ডুলে। চার চারটে ছেলে হয়েছে যদিও। দয়া ভাত দেয় না। বিপদ খাইখরচ বাবদ ৬ হাজার টাকা দেয় বউকে। ওতে হয়। ভাগ্যিস কানুটা ছিল। আর বউ! সেজদার নাকটা তিরতির করে। ভয়ডরহীন চিরদিনের বোহেমিয়ান মানুষটির ছিল মাছ ধরার নেশা। তাসের নেশা। ছায়াদির দেওর আমগাছে ফাঁসি দিয়েছিল। লাশ নামাবার লোক নাই। বিপদ ভরসা। এই নিয়ে খুব রগড় হত। বিপদভঞ্জন নাম হলেও, সবাই বিপদ বলে। বিপদ উদ্ধারে বিপদই ভরসা। সেই এক জন্মজন্মান্তরের বিয়ে। সারা জীবন গলায় বড়শি নিয়ে বিপদ আঁকুপাঁকু ডোবে দয়াময়ী সরোবরে।
সবাই আরো কিছু শুনতে চাইছিল। আরো গল্প। অলৌকিক কণ্ঠস্বরের কিসস্যা। কিন্তু সে স্বর তো সবাই শুনতে পাবে না। জীবন আর মৃত্যুর মাঝামাঝি একটা টুরিস্ট স্পট। হোম স্টে। সেখানে এলেই সেই কণ্ঠস্বর শোনা যায়। দৌড়াতে দৌড়াতে সেজদা সেখানে চলে এসেছে। মাঠের শেষে তেঁতুল গাছ। তারপর পুকুর না নদী? ওপারে মা বাবা জ্যেঠু কাকু বড়মার সাথে জিতও দাঁড়িয়ে আছে। সেজদা চলে যাবে। তারই প্রস্তুতি। অনেকক্ষণ কথা বলার ক্লান্তিতে বন্ধ চোখ। চোখ বন্ধ করেও হয়ত কথা শুনছে বিপদভঞ্জন। যেন গল্প নয়। কথা। ছড়া। সুন্দর কণ্ঠটি ছেলে ভোলানো ছড়া বলছে। সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে কৃষি। নামতে নামতে মনে পড়ছে কাল পয়লা ভাদ্র। পয়লা ভাদ্র থেকে ভাদ্র সংক্রান্তি অব্দি বসতো গল্প বলার আসর। কোথায়? পাকুয়াহাটের গৌড়নন্দন বাটি, চন্দন বাটিতে। সে আসর কি আছে এখনও। সেজদা কী জানতো সে আসরের কথা! তুমুল বৃষ্টিতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন পৃথিবীতে এইসব কথকতা গত জন্মের মান্দাস যেন।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কৃষি ভাবছিল, কাল একবার যেতে হবে।
সেজদা থাকবে তো!
0 মন্তব্যসমূহ