রিপন হালদারের গল্পঃ এখানে অমল নামে কেউ থাকে না



দুপুরের রোদে চক চক করছে দাটা। বাঁশের চটার উপর বালি রেখে ধার দিচ্ছিল মজিদ মিঞা। মাঝে মাঝে ছিটকে উঠছে ফুলকি।

কয়েকজন নারী পুরুষ এই সময় এক ঝলক ময়লার মত এসে হাজির। দলটিকে যে নিয়ে এসেছে সেই পাঞ্জাবী আর চেক লুঙ্গি পরা মাঝ বয়সী লোকটা একটু দূর থেকে মিনতির সুরে ডাকল।

-“মজিদ মিঞা! ও মজিদ মিঞা!”

মজিদ মিঞা তার কাজে ব্যস্ত। যেন শুনতে পায়নি।

-“ও মজিদ মিঞা!”

এইবার মজিদ মিঞা মাথা তুললেন বিরক্তির ভঙ্গিতে।

-“কী! কী! এরা কারা?”

-“এগো জন্যেই তো আইছি”।

-“কও!”

-“এইখানে না। একটু ভিতরে চলেন!”

-“আবার ভিতরে!” বলে দা'টা বারান্দার মাটির মেঝের উপর ধপ করে ছুঁড়ে ফেলে মজিদ মিঞা মোছলেমকে নিয়ে অনিচ্ছুকভাবে ঘরের ভিতরে গেলেন।

বাইরে বারান্দার উপর ততক্ষণে মজিদ মিঞার লম্বা ঘোমটা টানা বৌ মাদুর বিছিয়ে দিয়েছে আগন্তুকদের জন্য। সাত জনের এই দলের মধ্যে একটি শিশু, তিন জন স্ত্রী লোক আর তিন জন পুরুষ। মনেহয় এখানে দুটি পরিবার। মাদুরে এরা দুই প্রান্তে দুই ভাগে বসেছে। এক প্রান্তে বসেছে শিশু সমেত অল্প বয়স্ক স্ত্রীলোক আর একজন যুবক। অন্য প্রান্তে চার জন। অল্প বয়স্ক নারী পুরুষ দুজন আর এক জোড়া বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। এরা ফিসফিস করে কথা বলছে। অন্যরা চুপ। উঠোনের বাঁ পাশে চাপকলের নিচে জমে থাকা অল্প জলে দুই তিনটি পাতি হাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে। শিশুটির চোখ ঐ দিকে।

কিছুক্ষণ পর ঘরে উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শোনা যায়। মজিদ মিঞা গজরাতে গজরাতে বাইরে আসেন। পিছনে বিনীত মোছলেম।

-“তুমি তো জানো মোছলেম! এইসব কাম আমি আর করি না।“

-“তাও একবার ভাইব্যা দ্যাখেন! আমি এগো লইয়া এখন যাই কই!”

-“তুমি কই যাবা হেইডা কি আমি জানি!”

-“আরে চটতাছেন ক্যান? এগো লগে রাস্তায় আমার দ্যাহা। কয় ইসমাইল নাকি আপনের কাছে পাঠাইছে। আমারে কইলো আপনের বাড়ি চিনাইয়া দিতে”। একটু বুঝি গলা কাঁপল মোছলেমের।

-“আর তুমি ড্যাং ড্যাং কইর‍্যা লইয়া আইলা? তুমি জানো না কিছু?”

-“কী মুসিবত কন দেখি! অখন আমি কী করি!” একটু ভাবার অভিনয় করে বলে- “ইসমাইলের বাড়ি দিয়া আসমু?”

-“যাত্রা দলে নাম লিখাও মোছলেম! আমি কি জানি না যে, এরমধ্যে তোমারো বখরা আছে! তুমি আর ইসমাইল মিল্লা আমারে জেলের ভাত খাওয়ারবার চাও, না?”

-“তা মিঞা কি একবারো হেইখানের ভাত খান নাই কইতাছেন?” মুচকি হাসে মোছলেম।

মজিদ মিঞা নরম হন। -“হেইডা ঠিক। জেল আমি কয়েকবার খাটছি। কিন্তু কাগো লাইগ্যা! বি এস এফ, বি ডি আর-এর লাঠির বারি আমার পিঠে অথচ তোমাগো পাত্তা নাই। ভাগ লইয়া সইরা থাকছো!”

-“পুরান কথা বাদ দেন না!”

-“না। ঐ কামে আমি আর নাই। আর এখন ফায়দাও নাই। লাভের গুড় পিঁপড়া খায়”।

“তাই কি এখন গরু ধরছেন?”

-“মোছলেম শোনো, গরু কখনো বেইমানি করে না। অগো বেইমানি করার অতো বুদ্ধিও নাই। ঘাস খায় তো! কিন্তু বুদ্ধিমান মাইনসের চাইয়া অরা অনেক বেশি নিরাপদ!”

এই সময় দলের বৃদ্ধ সদস্যটি হাত জোড় করে বলে ওঠেন-“ভাই সাব! কিছুই কি করা যায় না? আমরা অনেক দূর থিকা অনেক আশা লইয়া আইছি”।

তার দিকে মুখ ফিরিয়ে মজিদ মিঞা বলে ওঠেন-“আচ্ছা ভাই! একটা কথা বলেন তো! এই দ্যাশে এমন কি অসুবিধা আপনাদের! পত্যেকদিন দলে দলে ইন্ডিয়া যাইতাছেন! সেই সাত চল্লিশ সন থিকা শুরু হইছে। আজো চলতাছে। কোন দ্যাশে না ঝামেলা আছে কন তো? এইভাবে বাপ-দাদার ভিটা ছাইড়া যাইতে আপনাগো কষ্ট লাগে না?”

একথায় কোন উত্তর পাওয়া যায় না। বৃদ্ধটি পাঞ্জাবির খুঁট তুলে শুধু চোখ মোছেন। কালোফ্রেম চশমার ওপারে দুটি ক্লান্ত বেদনার্ত চোখ। তাতে ভাসমান তার ছেড়ে আসা ঘর বাড়ির ছবি। বারে বারে জলে ভিজে যাছে।

ইতিমধ্যে শিশুটি ঘুমিয়ে পড়েছে মায়ের কোলে। মোছলেম অধৈর্য হয়ে বলে-“মজিদ মিঞা! এই কথা দিলাম। আর কোন দিন কাউরে আপনার বাড়ি চিনাইতে আসুম না। আল্লার কিরা। এই শ্যাস বার”।

-“বুজ্জি। তুমি দফা হও এই বার। আর যদি কাউরে লইয়া আসো তইলে তো বোঝো! আমাগো তিন পুরুষ ডাকাত বইল্লা সুখ্যাতি আছিল। মনে রাইখ্যো! দলে দলে খালি মানুষ ধইরা আনে! আমি যে কী কইরা নদী সমুদ্র কুমির ডিঙ্গাইয়া এগো সীমান্ত পার করি, আমিই জানি! যাও যাও এইবেলা। এই কিন্তু শ্যাস বার!”

ততক্ষণে মোছলেম উধাও। চারটি চকচকে একশ টাকার নোট মোছলেমের পাঞ্জাবির পকেটে দুপুর থেকে ঘুমাচ্ছে। একবার ডান হাতটা অল্প ফোলা পকেটের উপর রেখে হালকা চাপ দেয়। বড় মেয়ের আজ সম্বন্ধ আসার কথা। বাজারের দিকে পা বাড়ায় সে। সন্ধ্যার মধ্যে নানা জায়গায় গিয়ে ফন্দিফিকির করে বড় অঙ্কের টাকা যোগার করতে হবে। মেয়ে পছন্দ হলে ছেলে পক্ষ নাকি দেরি করবে না।

“কই গো তহমিনার মা! মেহমানদের জন্য বাতাসা-পানি আনো! আমি একটু আসি। দেইখ্যো, বাইরের লোক য্যান অখন বাড়ির মইধ্যে না ঢুকে!” বলে মজিদ মিঞা হনহন করে কথায় যেন উধাও হয়ে গেলেন।

এরমধ্যে সাতজনের এই দলটি বারান্দার ঐ মাদুরেই জল বাতাসা মুড়ি চিড়া আর সবরী কলা সহযোগে আহার সেরে বিশ্রামে মগ্ন।

সন্ধ্যায় ফিরলেন মজিদ মিঞা। হাতে কয়েকটা কাগজ। দলের পুরুষ সদস্যদের ডেকে আলাদা করে আস্তে আস্তে বোঝাতে থাকেন।

-“শোনেন, সব ব্যবস্থা পাকা। রাইত বারোটার পর আমরা বাইরামু। কিন্তু একটা কথা, বি.ডি.আর কিংবা বি.এস.এফ ধইরলে কিন্তু আমার নাম কইবেন না! কইবেন- আপনারা এই গ্রামেরই বাসিন্দা। পাশের গ্রামে অনুষ্ঠান বাড়ি গেছিলেন। আর লগে কোন পোটলা পুটলি রাখবেন না। অতে অরা সন্দেহ করবো”।

-“আইচ্ছা ঠিক আছে। আপনে যেমন কন!” বৃদ্ধটি উত্তর দেন। “ও আরেকটা কথা! সীমান্তরক্ষীরা যদি আপনাগো নাম জিগায় তইলে কিন্তু ভুলেও হিন্দু নাম কইবেন না। এইডা পুরাই মুসলিম এলাকা। আপনেরা ঠিক কইরা লন কে কী মুসলিম নাম রাখবেন”।

এই বলে একটু দম নেন মজিদ মিঞা। তারপর সটান জিজ্ঞাসা করেন-“সঙ্গে টাহা পয়সা কী আছে?”

একথায় পুরুষদের মধ্যে চাপা চাঞ্চল্য দেখা যায়। পরে বৃদ্ধটির সতর্ক উত্তর-“আছে, অল্প পরিমান”।

-“ও!” বিষণ্ণ মজিদ মিঞা। -“যা আছে তা জামার পকেটে রাখা যাইবে না। একটু পর আমি বুঝাইয়া দিমু কোথায় কীভাবে রাইখতে হবে। আর সোনা-দানা কিছু আছে নাকি লগে?” চোখে কৌতূহল ঝিলিক দিচ্ছে মজিদ মিঞার।

-“তেমন কিছু না। মেয়েদের হাতে কানে... সামান্য কিছু। ঐ যেটুকু দেখা যাইতাছে আর কি!” বৃদ্ধের স্বর খাদে।

মহিলাদের দিকে তাকিয়ে কিন্তু মজিদ মিঞা বিদ্রূপে ঝলসে ওঠেন –“এরে সামান্য কন? এতো দেহি বিয়ার সাজ! ঐগুলা এতক্ষণ সঙ্গে রইলো কী কইরা! ইসমাইল মোসলেম দ্যাখে নাই?” --“না তো! হ্যারা তো কিছু কয় নাই!”

-“বাদ দ্যান! অখোন শোনেন, এইসব লইয়া বডার পার হওয়া যাইবে না। সইলের গোপন জায়গায় এইগুলা লুকাইয়া ফ্যালেন!”

এইবার দলের যুবক সদস্যদের একজন প্রথম মুখ খোলে। ইতস্তত করে জানতে চায় –“চাচা! আপনাকে মজুরি কত দিতে হবে?”

একটু বিরক্তভাবে তার দিকে তাকিয়ে মজিদ উত্তর দেন- “ইসমাইল, মোছলেম কিছু কয় নাই?”

-“না তো!”

-“এইগুলান কোনো কামের না! যাউগ্যা। শোনেন, জোন পতি আমার পাওনা এক হাজার টাকা”।

থমকে যান দলপতি। তারপর দ্বিধাগ্রস্তভাবে বলেন –“মজিদ সাহেব! একটা আবেদন রাখবেন!”

-“কী?”

-“টাকার পরিমান কি একটু বিবেচনা করা যায় না? আমরা বড়ই গরিব রিফুজি মানুষ”।

-“এইডা কী কন? এই কামে কী পরিমান ঝুঁকি তা জানেন? “তারপর অন্যদিকে চেয়ে বলেন–“এই জন্যই আমি মানুষ পাচার ছাড়ান দিছি। খালি দরদাম করে”।

শেষে ঠিক হয় জনপ্রতি মজিদ মিঞাকে দিতে হবে নয়শ টাকা। রাত বারোটার আগে পর্যন্ত সবাইকে ঘুমানোর নির্দেশ দিয়ে হঠাৎ অতি শান্ত স্বরে তিনি কয়েকটি নিরীহ শব্দ উচ্চারণ করেন। -“আমারে অখন দুইখান হেলিকপ্টার যোগাড় করতি হবে!”

পুরুষ তিনজনের ছয়টি চোখে হঠাৎ বিদ্যুতের ঝিলিক খেলে যায়। হেলিকপ্টার! মজিদ মিঞা কী তুচ্ছভাবে শব্দটি ছুঁড়ে দিয়ে গেলেন অনাথ বোমার মত। সীমান্ত লাগোয়া এই প্রত্যন্ত গ্রামে হেলিকপ্টার! তাও আবার দুইখান! পুলক, চমক, সন্দেহ, বিশ্বাস, আকাঙ্ক্ষা, বিদ্রূপ- সব যেন দলা পাকাতে থাকল। কখনো সাসপেন্সে বাঁচতে মানুষের আরামও লাগে। কিন্তু এই মানুষগুলো হয়ত এই আরামের জন্য প্রস্তুত ছিলনা।

আরাম স্থায়ী হয় না। গয়না টাকা যেটুকু আছে সব এক্ষুনি সরিয়ে রাখতে হবে নিরাপদ জায়গায়। ঠিক হয় বাচ্চাটির কাঁথা দুই ভাঁজ করে তার মধ্যে ওগুলো রেখে চারদিক সেলাই করে নেওয়া হবে। পরে ঠিক হয় পুরুষদের কোমরে খুতির মধ্যে ওগুলো লম্বা করে রেখে বেল্টের মত বেঁধে রাখা হবে।

রাত দশটার মধ্যে ভোলা মাছের ঝোলের সঙ্গে বালাম চালের ভাত খেয়ে এই সাতটি মানুষ দেশান্তরী হবার শেষ প্রস্তুতিটুকু সেরে নেয়। দলের বৃদ্ধাটি বৃদ্ধর কানে কিছু বলতেই বৃদ্ধটি উঠোনে নামেন এবং একটু মাটি নিয়ে ধুতির খুঁটে বাঁধেন।

এই বৃদ্ধের সাথে একজোড়া নারী-পুরুষের ঘনিষ্ঠতা দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত এদের ছেলে আর ছেলে-বৌ। অন্য দলে একজোড়া নারী-পুরুষ আর তাদের একমাত্র শিশু পুত্র। শিশুটিকে একবার ‘অমল’ বলে ডেকে ওঠে তার যুবক বাবা।

বৃদ্ধটি এবার আরেক সমস্যায় পড়েন। যদিও সমস্যা তত গুরুতর না। দলের সবার মুসলিম নাম রাখতে হবে। একেক জনের একেক মত। ছেলেদের আগে শেখ বসে কিনা বসে না। মেয়েদের নামের সঙ্গে কখন বিবি বসে, কখন বসে খাতুন, এই নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। একটা অদ্ভুত বিষয় এই যে, এতো বছর এরা মুসলিমদের পাশে বসবাস করলেও একে অন্যের সংস্কৃতি বিষয়ে অজ্ঞ।

মজিদ মিঞা এই সমস্যা সমাধান করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তো গেছেন ‘হেলিকপ্টার’ আনতে। আর তাঁর স্ত্রীকেও আসেপাশে দেখা যাচ্ছে না। কেউ যখন কাছে নেই তখন এই গল্পের কথক এদের মুসলিম নামকরণটি সারলেন। বৃদ্ধের নাম রহমত আলি। তাঁর স্ত্রী খাদেজা বিবি। বৃদ্ধের ছেলের নাম সাব্বির শেখ। তার স্ত্রী সাবানা বিবি। অন্য দলের পুরুষটির নাম রাখা হলো শোয়েব মন্ডল। তার স্ত্রী আয়েষা বিবি। শিশুওটির নাম কী প্রয়োজন হবে! হলে ডাকা হবে আলম বলে। অমলের সঙ্গে আলমের কী অদ্ভুত মিল!

একুটু পর বাইরে সাইকেলের বেলের শব্দ শোনা যায়। উঠোনের উপর দুটি ছেলে এসে দাঁড়াল। মজিদ মিঞা তাড়া দেন।

-“আপনেরা সবাই তৈরি তো?”

-“হ!” বৃদ্ধ উত্তর দেন।

-“জিনিস-পত্র ঠিক জায়গায় রাখছেন তো?”

-“হ হ! সব গোছানো আছে”।

বৃদ্ধটি ভেবে শঙ্কিত হন- শেষ পর্যন্ত ওগুলো ইন্ডিয়ায় পৌছবে কিনা। যেভাবে মজিদ সাহেব ঘন ঘন ওগুলোর খোঁজ খবর রাখছেন, কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে।

মজিদ মিঞা ঘরে গেলে দলের এক যুবক সদস্য অর্থাৎ অমলের বাবার ঠোঁট ফিস ফিস করে বৃদ্ধের কানে- “কাকা! ওগুলো কোথায় রাখা আছে তা যেন আবার বিশ্বাস কইরা মজিদ মিঞারে কইয়া দেবেন না! এই সীমান্ত এলাকায় কিন্তু কাউরে বিশ্বাস করোন যায় না!”

-“না না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকবা। আমি এইসব জানি। হুনলা না, হ্যারা তিন পুরুষে নাকি ডাকাত আছিল!”

-“আচ্ছা কাকা! একটা কথা তো বুঝতাছি না। এইহানে হেলিকপ্টার আইব এইডা কীরম ব্যাপার?”

-“বাবা। এইডা তো আমার কাছেও রহস্য। দেখা যাউক শেষে কী আহে! এহন চুপ যাও! মজিদ মিঞা আইতাছে”।

মজিদ মিঞার গা থেকে আতরের গন্ধ বেরিয়ে এই আধ-খাওয়া চাঁদের আলোকিত রাতকে মোহনীয় করে তুলেছে।

-“আপনারা কেউ পায়খানা পসাব করতি চাইলে কইরা লন। সারা রাইত হাঁটতি হইব। তহন কিন্তু কারো লাইগ্যা দেরী করা যাইব না!”

এর আগেই অবশ্য মজিদের স্ত্রী দলের মহিলাদের পুকুর পাড় থেকে ঘুরিয়ে এনেছেন। পুরুষদের আর এই বিষয়ে চিন্তা কী! আসলে মজিদ মিঞা এই আবেদনটা মহিলাদের উদ্দেশ্যেই রেখেছেন।

এরপর দুই ভাগে দুটো সাইকেল চালিয়ে এদের প্রায় চার-পাঁচ কিমি পশ্চিম দিকে নিয়ে আসা হয়। টিন আর দরমার বেড়ায় তৈরি অল্প কয়েকটা ঘর নিয়ে একটা ছোট্ট লোকালয়। চাঁদের আবছা আলোয় এইটুকুই বোঝা গেল। আলো বলতে কেরোসিনের কুপি।

মজিদ মিঞা ছোট এক ঝুড়িতে মুড়ি-বাতাসা নিয়ে হাজির। -“এইগুলান বাইন্ধা লন তাড়াতাড়ি! রাস্তায় খাইবেন! বিহানে কোথায় গিয়ে উঠবেন ঠিকানা কী!”

আপত্তি সত্ত্বেও ওরা দেশের এই শেষ খাদ্যটুকু গামছায় বেঁধে নিল। এই প্রথম মজিদ মিঞার প্রতি বৃদ্ধ কৃতজ্ঞতায় আর্দ্র হয়ে উঠলেন।

-“শোনেন! এইখান থিকা আমাগো তিনটা নদী পার হইতে হইব। প্রথম দুইটা ছোট। শ্যাষেরটা বড়। তারপরই ইন্ডিয়া। ক্যানিং বডার। পার হইতে পারলেই কেল্লা ফতে!” মজিদ মিঞা বেশ উত্তেজিত।

-“কোনো ভয়-ডরের ব্যাপার নাই তো?” বৃদ্ধটি কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন।

-“দ্যাহেন! আমি হেই ছোট্ট বেলা থিকা এই কাম করতাছি। দুই-তিন বার ধরাও খাইছি। বি.ডি.আর, বি.এস.এফের রুলের বারি খাইছি। সবার সাথে তো আর হাত করোন যায় না! হগলডিই ট্যাহা খায়। বখরা কম পড়লি ধরায়া দ্যায়। একবার ঐ হালা মোছলেম আর ইসমাইলের গাফিলতির জইন্য ধরা খাইয়া গেলাম। কী মাইর না খাইলাম! বছর পাঁচেক আগে হইব। অনেক তাহা পয়সা আর তদবিরের পর খালাস পাইলাম। হেইদিন থিকা আর মানুষ পাচার করি না। গরু ধরছি। এই ব্যাবসায় ঝুঁকি কম, ফায়দা বেশি। তবে আল্লার রহম থাকলে আপনাগো কোন তকলিফ হইব না”।

-“তাই যেন হয়। শ্রী হরি সহায়”। বৃদ্ধকে কিছুটা চিন্তিত দেখায়। অন্য পুরুষ সদস্যরা তার দিকে চেয়ে থাকে। তিনজন মহিলার ঘোমটা আরো লম্বা হয়।

তারপর সাপ-জোঁক-মশা, ধাতব অস্ত্রধারীদের ভয় আর জলা-জঙ্গল পেরিয়ে এই সাতটি প্রাণী শেষ বড় নদীটির পাড়ে পৌঁছল। রাত তখন তিনটা বেজে গেছে। শিশুটি ঘুমোচ্ছে নিশ্চিন্তে। ও মনেহয় ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই ছেড়ে যাবে ওর জন্মভূমি! বৃদ্ধটি বলে ওঠেন -“অরে একটু জাগাও বৌমা! শ্যষবারের মত দ্যশটারে দেইখ্যা লউক!”

-“তাড়াতড়ি পা চালান!” মজিদ মিঞা হাঁক পাড়েন। -“সামনের নদীটাই আসল। এই নদীই বাংলাদেশ ইন্ডিয়ার সীমানা। চড়ের এই দিকটায় সীমান্তরক্ষীরা খুব একটা থাকে না। দুই এক জনের লগে হাত করা আছে। তাও কওয়া যায় না। কখন কী মতি গতি পাল্টাইয়া যায়!”

চঞ্চল জলের উপর দিয়ে অন্য পাড়ে এগিয়ে চলেছে একটা কালো নৌকা। ভয়ার্ত মনে জ্যোৎস্নার আলো-জ্বলা নদীর জলকেও মনে হয় বিষ মাখানো।

-“ঐ দ্যাখেন ওপাড়ে বাস! ঐতে কইরাই আপনেরা যাইবেন!” নিশ্চিন্ত স্বর মজিদ মিঞার।

নৌকা এখন মাঝ নদীতে। বিরাট বড় অন্ধকার পর্দার উপর যেন আলোকিত একটা বাস দাঁড়িয়ে। অনির্দিষ্ট অনিশ্চিত গন্তব্যের সওয়ারি নিয়ে ভোরের প্রথম বাস একটু পরেই ছুটে চলবে। আগন্তুকরা আশা-আশঙ্কায় তাকিয়ে থাকে বাসটার দিকে।

-“তবে গরুর থিকা মানুষ পাচার কইরা বেশি আরাম”। আপন মনে বলে ওঠেন মজিদ মিঞা, -“নাহ্‌। কোন গুনাহ্‌ নাই!”

-“ঠিকই বলছেন”। বৃদ্ধটি সায় দেন। নৌকা তখন প্রায় ওপাড়ের কাছাকাছি।

নদীর জলে বৃদ্ধটি মুখ ধুয়ে নেন। তারপর মাথার চুলেও লেপে দেন ভেজা দুই হাত। ভোর চারটের কাছাকাছি এরা পা রাখেন ইন্ডিয়ার মাটিতে। নিরাপদেই। মজিদ মিঞা একটু দূরে তৃপ্তির ভঙ্গিতে কয়েকজন লোকের সঙ্গে কথা বলছেন। কথার ফাঁকে ফাঁকে ওঠানামা করছে বিড়ির আগুন।

পাড়ে চারজনের একটি ছোট দল। তিনজন একসঙ্গে একজন আলাদা। এই আলাদা যুবকটি অনেকক্ষণ ধরে আগত সাত জনের দলটার দিকে তাকিয়ে আছে। এদের আসা দেখছে। চোখে মুখে আনন্দ, বিস্ময়।

মজিদ হাঁক পাড়লেন এপাড়ের চারজনকে তাড়াতাড়ি নৌকায় উঠে যেতে। বৃদ্ধটি মজিদ মিঞাকে একপাশে ডেকে নেন। সাতজনের নয়শ টাকা করে মোট ছয় হাজার তিনশ টাকা খুতি থেকে বের করে গুনে মজিদ মিঞার হাতে গুঁজে দেন।

-“পুরো সাত জনের টাকাই আছে। গুইন্যা লন!”

-“বাচ্চার টাকা লাগবো না”।

-“না না। রাখেন!” অনুনয় বৃদ্ধের।

-“আরে, লাগবো না। কইলাম তো!” বলে মজিদ মিঞা নয়শ টাকা গুনে বৃদ্ধের হাতে ফিরিয়ে দিলেন। তারপর বলেন-“যান! আপনাগো নতুন দ্যাশে! আল্লা সহায়!”

-“ঠাকুর আপনারেও ভালো রাখুক!” বলে বৃদ্ধটি মজিদের হাত দুটির উপর কয়েক মুহূর্ত মাথাটা নীচু করে রাখেন। তারপর পাড়ের উপর দিকে উঠে তারা নৌকাটির ফিরে যাওয়া দেখে।

একটা চায়ের দোকানে তখন উনুনে ধোঁয়া উড়ছে। বাসে ওঠার অপেক্ষা। ফরসা হচ্ছে চারদিক। একটা বিষয় মজিদ মিঞাকে জিজ্ঞাসা করা হয় নি। হেলিকপ্টার তো এলো না! অবশ্য সময়ও পাওয়া যায় নি।

এদের কী যায় আসে এটা না জানলে যে, এই অঞ্চলে সাইকেলকেও হেলিকপ্টার বলে! হেলিকপ্টারের মতোই তো এরা মাটির সব বন্ধন ছিঁড়ে এই পরবাসে! একে আপনবাস করতে করতে দলের বৃদ্ধ বৃদ্ধা নৈহাটির এক ভাড়ার ঘরে জীবনের মায়া ত্যাগ করবেন। তার ছেলে, ছেলে-বৌ হবে প্রৌঢ়। ছেলে হয়ত পাট কলে কাজ পাবে। হাতের একটা আঙুল যন্ত্রকে উৎসর্গ করে যোগাড় করবে একমাত্র মেয়ের বিয়ের টাকা।

দলের অন্য অংশের যুবকটি মাঝ বয়সে পৌছেও হয়ত বিড়িই বাঁধবে। তবে পাতার। আগের দেশে অবশ্য বাঁধত কাগজের বিড়ি। প্রথম প্রথম অসুবিধা হবে। তারপর ঠিক হয়ে যাবে। সময়ে সব ঠিক হয়ে যায়।

আর অমল! বালক অবস্থায় সল্টলেকের করুনাময়ীর এক নির্মীয়মাণ ফ্ল্যাটের চার তলায় হাফ প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে তার রোগা ফর্সা মা মাথায় এক বোঝা লাল ইঁট নিয়ে বহু কষ্টে একটা একটা করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসছে। আর উপর দিয়ে গর্জন করে উড়ে যাচ্ছে এরোপ্লেন।

পাতার বিড়ির সঙ্গে আজকাল ইঁটের তেমন একটা সম্পর্ক নেই।




দুপুর প্রায় একটা নাগাদ বছর পঞ্চাশের লোকটি বাস থেকে নেমে এদিক ওদিক তাকাতে থাকেন। টেরিকটের জামার পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করে কী যেন পড়ে নিলেন। বাস স্টপিজের পাশে একমাত্র পান বিড়ির দোকান তাঁর চোখে পড়ে।

-“একটা ছোট সিলকাট দাও তো!”

-“এই যে!” প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট আগন্তুকের হাতের দিকে এগিয়ে দেয় কিশোর দোকানদার।

-“এই রইল তিন টাকা!” বলে তিনটি আধুলি আগুন্তুক পান রাখার ঢালু পাথরটার উপর রাখেন।

-“আরো পঞ্চাশ পয়সা! দাম বেড়ে গেছে!”

-“ও দিচ্ছি!” বলে আরো এক টাকার একটা আধুলি আগন্তুক এগিয়ে দেন।

বাটি হাতরে কিশোর পঞ্চাশ পয়সার আধুলি খুঁজে পায়না।

-“খুচড়ো নেই। একটা লজেন্স দেই কাকু!”

-“হ্যাঁ। দিতে পারো”।

লজেন্সটা পকেটে রেখে আগুন্তুক সিগারেট ধরাতে ধরাতে কিশোরকে প্রশ্ন করেন।

-“আচ্ছা। এখান থেকে মিলনপুর কীভাবে যাব বলতে পারবে?”

-“ঐ যে সামনের রাস্তার বাঁ দিকে অটো দাঁড়িয়ে আছে। বললেই নিয়ে যাবে”।
 

অটো থেকে নেমে নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌছে যান আগুন্তুক কাগজ মিলিয়ে মিলিয়ে।

-“আচ্ছা। এটা কি স্বপন পালের বাড়ি?”

-“হ্যাঁ। কী দরকার?”

-“এখানে অমল নামে কেউ থাকে?”

-“না তো! আপনি কে?” বৃদ্ধ বাড়িওয়ালা পালটা প্রশ্ন করেন।

-“আমি... ওর এক আত্মীয়। ওরা এখানে নেই?” বিস্ময় আর হতাশা আগুন্তুকের চোখে মুখে।

-“না। এই নামে এখানে কেউ থাকেনা”।

-“কিন্তু, আমাকে যে বলা হলো ওরা এখানেই থাকে! তাহলে কী মিথ্যা বলল!”

-“হবে হয়ত”। বাড়িওয়ালার কথায় অধৈর্য।

-“আচ্ছা, সঙ্গে ওর মা ছিল। রোগা মত ফর্সা। অমলও ফর্সা তবে খুব রোগা। ওর বাঁ কানের পাশে একটা জুড়ুল আছে”।

-“হ্যাঁ। সবই ঠিক আছে। কিন্তু ওর নাম তো অমল নয়, বিমল। খুব ভালো ছেলে!”

বাড়িওয়ালার কথায় আশ্বস্ত হন আগুন্তুক।

-“হতে পারে। হ্যাঁ। হ্যাঁ। নামটা বিমলই হবে হয়ত। তা কোথায় আছে ওরা বলতে পারবেন? খুব উপকার হয়”।

-“দেখুন নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারব না। তবে শুনেছি নিউ ব্যারাকপুর অথবা মধ্যমগ্রামের ওদিকে ওরা এখন থাকে। বিমল চাকরি করে ওখানকার কোন হাই স্কুলে”।

-“ঠিকানা বা কোন কন্টাক্ট নম্বর কিছু আছে?”

-“না না। ওসব বলতে পারব না”।

-“অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে”। দুই হাত জোড় করেন আগুন্তুক। গেটটা আটকে ফেরার পথে রওনা দেন।


পরদিন সকাল এগারোটা নাগাদ মধ্যমগ্রাম হাই স্কুলের ওয়েটিং রুমে সেই আগুন্তুককে বসে থাকতে দেখা যায়। চেহারায় উদ্বেগ আর উত্তেজনা।

পিওন এসে কিছু বলতেই তিনি প্রধান শিক্ষকের ঘরে প্রবেশ করেন। বিমলের প্রসঙ্গ উঠতে শিক্ষক জানান।

-“ও তো এক মাসের লিভ নিয়েছে!”

-“তাই! কেনো?”

-“ওর তো মা মারা গেছে!”

একথায় স্তব্ধ হয়ে যান আগুন্তুক। দুই হাতের উপর মাথা রেখে টেবিলের উপর আস্তে আস্তে ঝুঁকে পড়েন।

-“আপনার কী অস্বস্তি হচ্ছে, জল খাবেন?”

টেবিলের উপর গ্লাসটা নামিয়ে রেখে আর্দ্র কন্ঠে আগুন্তুক জানতে চান।

-“কবে?”

-“দিন পাঁচেক হলো”।

-“ও!”

-“আপনি ওর কে হন?”

-“আত্মীয়। দূর সম্পর্কের। আচ্ছা, বিমলের বাড়ির ঠিকানাটা কি দেওয়া যাবে?”

-“নিশ্চয়। কথাও বলে নিতে পারেন! ফোন নম্বরও আছে!”

-“না থাক। শুধু ঠিকানাটাই দিন”।

ঠিকানা লেখা চিরকুটটা পকেটে নিয়ে হেডস্যারকে নমস্কার জানিয়ে আগন্তুক আবার বের হলেন রাস্তায়। রোদের তাপে বয়স্ক মুখ ঝলসে যাচ্ছে। সাইড ব্যাগে একটা ছাতা অবশ্য আছে। কিন্তু বের করেন না। অনেকক্ষণ হাঁটার পর তাঁকে দেখা যায় মধ্যমগ্রাম রেল স্টেশনে বসে থাকতে। এখন তিনি কোন দিকে যাবেন আমরা তা বলতে পারছি না। যদিও হাতে চারকোনা একটা টিকিট রয়েছে। এবং গন্তব্য স্টেশনের নামও নিশ্চয় লেখা আছে। কিন্তু ঘাম আর চোখের জলের দু-একটি ফোঁটা টিকিটের কাগজটাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে।

কিছুদিন পর এই ব্যক্তিকে দেখা যায় বিমলদের বাড়ির বসার ঘরে। বাড়ির সর্বত্র শোকের চেহারা। তার সামনে এক সেট সাদা কাপ-প্লেট। সামনের চেয়ারে বসে আছেন তারই বয়সী আরেকজন মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি। আলাপে মগ্ন।

-“বিমল তাহলে এখন নেই বলছেন! কতদিন দেখিনা ওকে!”

-“দুটো দিন আগে আসলেই দেখা হত”।

-“সেটাই... কবে গেছে বললেন যেন!”

-“গত পরশু। ভোরের ফার্স্ট ট্রেনে”।

-“কী জন্য কিছু বলেছে?”

-“না। তবে অনেকদিন থেকেই বলছিল জন্ম-ভিটা দেখতে যাবে বাংলাদেশে। তা ওর মা মারা যাবার পর আর কোন কথাই শুনল না। হঠাৎ বেরিয়ে গেল”।

-“ঠিকই করেছে। জন্ম ভিটার টান কী সহজে ছেঁড়ে!” বলে চায়ের কাপটা নিচে নামিয়ে রাখেন আগন্তুক।

-“এই বাড়িতে এখন ওর কে কে আছে?”

-“একটু আগে কল পাড়ে যাকে দেখলেন সে ওর স্ত্রী। দুই ছেলে মেয়ে। আর... আমি। ওর মা চলে যেতেই বাড়িটা যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে! বাচ্চা দুটো ভীষণ ন্যাওটা ছিল ওর! সব শেষ...”

এরপর একটু থমকে যান আগন্তুক। তারপর বিমলের বাবাই শুরু করেন।

-“আপনার দেশের বাড়ি তো বললেন চাঁদপুর, না?”

-“হ্যাঁ। বিমলের মামাবাড়ির ঠিক পাশেই। আপনার?”

-“আমার মৈমনসিংহ। তা বিমলের জন্ম তো চাঁদপুরেই। মামাবাড়িতে। তারপর কী যে হল সব! ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল... আপনি যেন এখন কোথায় থাকেন বললেন?”

-“ছত্তিসগড়। ওখানে পুনর্বসতি পেলাম। চলে গেলাম। এদিকে আর আসা হয় না। কলকাতায় একটা কাজে এসেছিলাম। তাই ভাবলাম একবার দেখা করে যাই”।

-“তা এসে ভালই করেছেন। বউ ছেলে মেয়ে?”

-“আছে। ওখানেই”।

-“ও! তা বিমলকে এতদিন পর মনে পড়ল? ওর ছোট বেলায় নাকি কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন?” মৃদু বিদ্রূপ বিমলের বাবার কন্ঠে।

-“ঐ যে বললেন সব ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল?”

-“খেতে আসুন আপনারা!” বিমলের স্ত্রী ডেকে ওঠে।

-“ওহ ভু্লে গেছিলাম!” বলে আগন্তুক ব্যাগ থেকে বের করে একটা মিস্টির প্যাকেট বিমলের স্ত্রীর হাতে তুলে দেন।

-“ছেলেমেয়েদের দিও! তা ওরা এখন কোথায়?”

-“ওরা তো স্কুলে! বিকেলে ফিরবে”।

-“বাহ বাহ। খুব ভালো! কোন ক্লাশে ওরা?”

-“ছেলে ফোরে আর মেয়ে ওয়ানে। চারটের মধ্যেই এসে পড়বে। আপনি এখন খেয়ে দেয়ে একটু বিশ্রাম করুন!”

আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে বিমলের স্ত্রী রান্নাঘরের দিকে এগোয়।

টেবিলে মুখোমুখি দুই মধ্যবয়স্ক পুরুষ। ডাল মাছ আর ঝিঙে চচ্চড়ি, তিনটি পদ ছোট ছোট বাটিতে সাজানো। পরিবেশন করছে বিমলের স্ত্রী। শ্যামলা চেহারায় টানা টানা দুটো চোখ। মায়া ভরা। সুস্বাদু এইসব খাবারের চেয়ে অনেক বেশি প্রিয় তা আগন্তুকের কাছে। একটু দূরে টিভির উপর যে বড় বাঁধানো ছবিটা টাঙানো বুঝতে অসুবিধা হয়না, এই চমৎকার মেয়েটির পাশেই রয়েছে বিমল। স্বাস্থ্যবান, চশমা চোখে আপাত-গম্ভীর চেহারা।

-“চিনতে পারছেন বিমলকে?” বিমলের বাবা মৃদু হাসেন।

-“অনেক মোটা হয়ে গেছে। নাক মুখ তো একি রকম! তবে একটু গাম্ভীর্য এসেছে চেহারায়”।

-“স্কুল টিচার তো! ছেলেমেয়েরা নাহলে মানবে কেন! তোমার খাওয়া হলে তোমাদের বিয়ের সিডিটা একটু চালিয়ে দিও তো বউমা?”

-“না না থাক। আমাকে বেরতে হবে। রাতে ট্রেন”।

-“সেকি! কোথায় যাবেন? থাকুন দু-চার দিন! বিমলকে দেখে যান! দু-এক দিনের মধ্যেই এসে পড়বে!”

-“না না। আবার আসব। বিমল ফিরলে আমাকে একটা খবর দেবেন দয়া করে”।

যদিও শেষ পর্যন্ত ঠিকানা বা ফোন নম্বর দিতে ভুলে যান আগন্তুক। হয়ত ইচ্ছে করেই।

এদিক ওদিক মুখ ফিরিয়ে আরো একটা বড় ছবি দেখেন। না, এটা বিমলের নয়, ওর মায়ের। সদ্য প্রয়াত জ্যোৎস্না পালের। মনে মনে নামটা আওড়ালেন আগন্তুক। তবে পাল তো এখন, আগে ছিল অধিকারী।

সন্ধ্যার মধ্যমগ্রাম স্টেশন। ডাউন ট্রেনের এখনো ঘোষণা হয়নি। সিমেন্টের চেয়ারে ওরা দুইজন।

-“আপনার ঋণ শোধ হবার নয়। আমার কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই। হয়ত অধিকারও নেই”। আগন্তুকের কথা ভেঙে দিয়ে আপ ট্রেন ছুটে গেল।

-“জ্যোৎস্নাকে আমি প্রথম দেখি আমার কাজের জায়গায়। দেখতাম বোঝা মাথায় নিয়ে সারাদিন বিল্ডিং-এ ওঠা নামা করছে। কেমন যেন মায়া হলো। তারপর আলাপ। জানলাম সব। একদিন ছেলেকে নিয়ে এলো। তখন ওকে অমল নামে ডাকত। অদ্ভুত এক ঘোরে পেয়ে বসল আমায়। বিয়ের প্রস্তাব দিলাম। ও প্রথমে রাজি হয়নি। মাস দুই পর প্রস্তাবে সাড়া দিল। আমার পরিবারের সবাই আপত্তি করল। শুনিনি। গ্রামের বাড়ি ছেড়ে এখানে এলাম। অমলের নাম পালটে বিমল রাখল জ্যোৎস্না। পুরনো সব পরিচয় মুছে ফেলতে চাইল...”

একটু থেমে মৃদু ভাবে বলেন-“আপনার অত্যাচারের কথাও জানলাম। সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়া গোপন জায়গাগুলোও দেখলাম। যাক, কী হবে আর পুরনো কথা বলে! ছেলেকে দেখতে এসেছেন ভালো কথা। তবে বড্ড দেরী করে ফেললেন!” শ্রোতার দিকে না তাকিয়ে বলে চললেন বিমলের বর্তমান বাবা।

-“কিচ্ছু না। বিমলকে একবার শুধু দেখতে এসেছিলাম। জানি কোন অধিকারই নেই। তবু...। জ্যোৎস্না আমার বাড়ি থেকে চলে যাবার পর অনেক খুঁজেছিলাম কিন্তু পাইনি। ভালই হয়েছে না পেয়ে। নাহলে ও সুখী হত না। আপনার মত ভালো মানুষও ওর জীবনে আসত না। সম্ভব হলে আমাকে ক্ষমা করে দেবেন”।

-“আমি কে ক্ষমা করার! ক্ষমা যে করতে পারত সে তো আর নেই!”

মাইকের ক্রমাগত এনাউন্সমেন্ট, যাত্রীদের চেঁচামেচ, ট্রেন আসা যাওয়ার শব্দের মধ্যে কথাগুলো দ্রবীভূত হতে থাকে।

একটু পর ডাউন ট্রেনের ঘোষণা হলো। দাঁড়িয়ে উঠে বিদায় নেবার মুহূর্তে বিমলের বাবার হাতদুটো শেষ সম্বলের মত জড়িয়ে ধরেন আগন্তুক। আস্তে আস্তে মাথা নিচু হয়ে আসে তাঁর।


দৃশ্যটা আস্তে আস্তে মিশে যেতে থাকে বহু বছর আগের একটা দৃশ্যের সাথে। ক্যানিং বর্ডারে মজিদ মিঞার হাত ধরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা এক বৃদ্ধের সাথে।

ভোর প্রায় পাঁচটা। ক্যানিং বর্ডার। নিজের জন্মভূমিতে পাসপোর্ট ভিসা করে যেতে রাজি নয় বিমল। ও জানে এই পথ দিয়েই ওরা এদেশে এসেছে। তাই এই চোরাপথ দিয়েই ও বাংলাদেশে যাওয়া মনস্থির করে। আজ ওর স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। দাঁড়িয়ে আছে নৌকার জন্য।

সামনে নদী। নৌকাটা ভেসে আসছে। পাঁচ-সাত জনের একটা দল নিয়ে। পাড়ে নামল সবাই। বছর দুয়েকের একটা শিশু নিয়ে ওর মাও। শিশুটি ঘুমাচ্ছে। আর ওর মা ওকে জাগানোর চেষ্টা করছে আর বলছে, “ওঠো অমল সোনা! শ্যাষবারের মত জন্মভূমিরে একবার দেইখ্যা লও! একবার চোখ খোলো বাবা আমার! ওঠো ওঠো!”

-“আরে ওঠেন ওঠেন! খাড়াইয়া ক্যান্‌? জলদি জলদি নৌকায় উইঠ্যা পড়েন!” সাদা পাঞ্জাবী আর চেক লুঙ্গি পরা এক ব্যক্তি বিমলকে তাড়া দেয়।






একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ