হামিরউদ্দিন মিদ্যা'র গল্প : উড়োকাক



"চম্পক নগরে বৈসে চাঁদ সদাগর
মনসা সহিত বাদ করে নিরন্তর।।"


শিবরাত্রি উপলক্ষে প্রতিবছর মেলা বসে কসবায়। কসবার প্রাচীন নাম চম্পক নগর। কথিত আছে ওটাই সেই চাঁদ সগাগরের প্রাচীন রাজত্ব। মেলার দিনে দূরদূরান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ এসে ভিড় করে। বাবার থানে পুজো দিয়ে যায়। দামোদর নদী লাগোয়া একটি বিশাল মাঠজুড়ে মেলা। মাঠের দক্ষিণ-পূর্ব পাশে ঝোপঝাড়ের ভেতরে চিরতরে শুয়ে আছে একটা মরা খাল। এলাকার মানুষের বিশ্বাস ওই মিলিয়ে যাওয়া মরা খালটিই গাঙুর নদী। বেহুলা মৃত স্বামী লখীন্দরের দেহ নিয়ে কলার ভেলায় ভেসেছিল গাঙুরে। সদাগরের সপ্তডিঙা নদীপথ ধরে বানিজ্যে যেত। এখন অবশ্য কিছুই অবশিষ্ট নেই। সপ্তডিঙাও ডুবেছে,চাঁদ সদাগরের রাজত্বও ঘুঁচেছে। শুধু মাঠের এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে কিছু পুরনো মন্দির-ধ্বংসাবশেষ। শিবদাস কসবার অনেক নাম শুনেছে, কিন্তু কখনো সেখানে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। শুনেছে বেহুলা-লখীন্দরের লোহার বাসরঘরটি এখনো গেলে দেখতে পাওয়া যায়।

এবছর প্রথম ব্যবসায় নেমেছে শিবদাস।আগে ভিনরাজ্যে রাজমিস্ত্রীর লেবার খাটতে গেছিল।বিয়ের পর আর বাইরে বাইরে কাটাতে ভালো লাগেনি।এদিকে গাঁ-ঘরে কাজের অভাব।সবদিন কাজ জোটে না।ঘরে বসে বসে তো আর পেট চলে না।মাস চারেক পেরনোর পর পাড়ার ছেলেদের সাথে আবার কেরলায় কাজে যাওয়ার মনস্থির করে।

দু-তিন দিন ধরেই শিবদাস লক্ষ্য করছে বউয়ের মন খারাপ।রাত্রে বিছানায় শুলেও মুখ ঘুরিয়ে শুচ্ছে আদুরী।অভিমানের কারণটা বুঝতে পেরে শিবদাস স্বান্তনা দিয়েছিল,এত চিন্তা করো না আদুরী।তুমি যদি এমন মন খারাপ করে থাকো,তাহলে আমি কী করে যায় বলো?এই কয়েকদিন অন্তত হাসি মুখে থাকো।

আদুরী বলেছিল,এতদূরে কাজে না গেলেই তোমার চলছে না?

— কি করব বলো!এখানে পাঁচদিন কাজ হলে সাতদিন বসে থাকতে হচ্ছে।বাপুতি জমিজমাও তো এক ছটাক নাই।তোমাদের তো খাওয়াতে-পরাতে হবে নাকি!

খেঁকিয়ে উঠেছিল আদুরী,শুধু খাওয়া-পরার কথায় ভাবলে?একজন মেয়ে নিজের গ্রাম ছেড়ে,বাপ-মা,ভাই-বোন ছেড়ে বউ হয়ে স্বামীর ঘরে আসে,শুধু কি খাওয়া-পরার জন্য?

শিবদাস আর কোনো কথা খুঁজে পাইনি।কিছুক্ষণ চূপ করে থেকে বলেছিল,আমি দিশাহারা হয়ে পড়েছি আদুরী,কী করব কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না।

তখন আদুরীই যুক্তিটা দিয়েছিল শিবদাসকে,এতদিন বাইরে বাইরে খাটলে,নিশ্চয়ই কিছু তো জমিয়েছ।তা দিয়েই একটা কোনো ব্যবসা শুরু করো না।লোকের দুয়ারে গোরু-মোষের মতো খাটার থেকে, ব্যবসা অনেক স্বাধীন।

গ্রামের বেশ কয়েকজন মেলায় মেলায় দোকান দেয়।বড় দোকান ছাড়াও কিছু পাতুনি ব্যবসাদারও আছে।শিবদাসের কাছে যা জমানো টাকা ছিল,তা দিয়েই নেমে পড়ল ব্যবসায়।পৌষসংক্রান্তি থেকে বিভিন্ন মেলায় মেলায় বাচ্চাদের খেলনার সামগ্রী নিয়ে পেতে বিক্রি করে সে।

গ্রামের পাতুনি ব্যবসাদার যে কয়েকজন আছে,তারা কেউই পাত্তা দেয় না। কেউ চায় না নিজের ভাতে ধূলো পড়ুক।শিবদাস নিজের চেষ্টাতেই এলাকার বিভিন্ন মেলাগুলোর সন্ধান করেছে।কিন্তু সবচেয়ে দূরের মেলা যাচ্ছে,এই প্রথম।কসবার মেলায় নাকি প্রচন্ড বেচাকেনা হয়।যারা যায়,সব জিনিস নাকি শেষ করে বাড়ি ফেরে।সেই আশাতেই ভোর ভোর সাইকেলে বোঝ চাপিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছে শিবদাস।নদীর ওপারের পথঘাট তেমন চেনেও না।খেয়া পেরিয়ে লোকজনকে শুধিয়ে সাধিয়ে যখন মেলায় পৌঁছাল,সূর্য তখন গাছপালার গায়ে লেপটে থাকা ফাল্গুনের কুয়াশার চাদর সরিয়ে রোদ্দুরের নরম বিছানা পাততে শুরু করেছে।


।।দুই।।

মেলায় ঢুকে কোনো কূলকিনারা খুঁজে পেল না শিবদাস। এতবড় মেলা সে বাপের জন্মেও দেখেনি।বড় স্টলই প্রায় শ'তিনেক।খাবার-দাবার,মনোহারী,খেলনা,লোহালক্কড়, কাঠের আসবাব সামগ্রী থেকে শুরু করে বিনোদনের জন্য সার্কাস,ম্যাজিক,নাইটসো,নাগরদোলা—কী নেই!বড় দোকান যেমন বসেছে,বিভিন্ন এলাকা থেকে পাতুনি ব্যবসাদাররাও হাজির হয়েছে।সাইকেলটা একজায়গায় ঠেঁসিয়ে দিয়ে বসার জায়গা খুঁজতে লাগল শিবদাস।

এতবড় মাঠের মধ্যে কোথাও একচিলতে বসার জায়গা পেল না সে।দিগভ্রান্ত হয়ে এদিক-ওদিক তাকাই।চেনাজানা কোনো ব্যবসাদারের মুখও চোখে পড়ে না।অনেক খোঁজাখুঁজির পর মেলার মাঠের শেষ মাথায়,মঞ্চের সামনে হাজির হল শিবদাস।বাঁশের ব্যারিকেডের ধারে একটা ফাঁকামতো জায়গায় তিরপল পেতে থলেগুলো নামিয়ে জায়গাটা আগলে রাখল।

এখানেও যে কেউ বসেনি তা নয়,শিবদাসের বাঁ-ধারেই কয়েকটি ফুঁচকার ভ্যান দাঁড়িয়ে।আর সামনের সারিয়ে কয়েকজন পাতুনি ব্যবসাদার।বিভিন্ন চটিবই,ফুলদানি নামিয়েছে দু-জন।ওই লোকদুটির পাশে একজন দাড়িওয়ালা বয়স্ক লোক কাঠের স্ট্যান্ড দেওয়া পাটাতনের ওপর বিভিন্ন রকম ধাতুর আঙটি সাজিয়ে রেখেছে।

ওদের মধ্যে থেকেই বইওয়ালা বলল,তোমার বাড়ি কোথায় ভাই?

শিবদাস বলল,নদীর ওপারে,নবীনডাঙা।

—বাপরে!এতদূর থেকে সাইকেল চালিয়ে এসেছ?তুমিই তো উন্নতি করবে।

দাড়িওয়ালা লোকটা বলল,ওখানে বসেছিস ঠিক কথা,কিন্তু কমিটির লোক আপত্তি করতে পারে ভাইপো।যদি পোগ্রাম না থাকে,তাহলে কোনো অসুবিধা নেই।

পাশের ফুচকার ভ্যানওয়ালা ফোড়ন কাটল,আগেরবার এখানেই বসেছিলাম আমরা।শেষের দিনে তো পোগ্রাম থাকে না।

সেই কোন ভোরবেলা ঘর থেকে বেরিয়েছে শিবদাস।পেটে কিছু খাবারও তখন পড়েনি।সুজাতা মুড়ি বেঁধে দিয়েছে।পাশের ফুচকাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে একটা চা-চপের দোকানের সন্ধান পেল সে।

খাবারের দোকানগুলো যেখানে শেষ হচ্ছে,সেখানেই একটা তেলেভাজার দোকান।কাঠের বেঞ্চে পা ঝুলিয়ে কয়েকজন মুড়ি খাচ্ছে।দোকানের কিছুটা দূরত্বে একটি বিশাল অশ্বত্থ গাছ। তার নীচেই শিবের মন্দির।চাঁদ সদাগর ছিল শিবের একনিষ্ঠ পূজারী,এদিকে মনসা চাঁদের হাতে পূজা পাওয়ার জন্য মরিয়া—

"চান্দর কোপ দেখি পদ্মার ভয় অতিশয়।
যোড় হাতে কহে দেবী করিয়া বিনয়।।
মোর তরে কোপ এড় সাধুর কুমার।
মোর তরে ফুল দেও একবার।।"

শিবের প্রসাদপ্রাপ্ত চাঁদ ব্রাহ্মণ্য সমাজ বহির্ভূত অন্য কোনও লোক দেবতাকে স্বীকার না করে,ভৎর্সনা করে পূজা প্রত্যাক্ষাণ করে—

"যেই হাতে পূজি আমি শঙ্কর ভবানী।
সেই হাতে পূজা খাইতে চাহু দুষ্টু কানী।

অনেক চেষ্টার পর শেষমেশ মনসা বাঁ-হাতে পূজো পেয়েছিল চাঁদের কাছে।এই কাহিনী তো শিবদাস ছোটো থেকেই শুনে এসেছে।এরকম একটা স্থানে দাঁড়িয়ে আছে জেনে ভেতরে ভেতরে শিহরিত হয় সে।

মন্দিরের ভেতরে একটি বড় শিবলিঙ্গ।চাঁদ সদাগরের নিজ হাতে প্রতিষ্ঠিত।যার নাকি কোনো তল নেই।মেয়েরা সকাল সকাল স্নান সেরে নতুন শাড়ি পরে মন্দিরে উঠছে সিড়ি দিয়ে।মেলার মাঠের পুবকোনে একটা ঢিবির ওপর মনসা মন্দির।সেখানেও অনেক মানুষের ভিড়।শিবদাস জানতে পারল,ওই ঢিবির নীচেই নাকি বেহুলা-লখীন্দরের লোহার বাসরঘরটি আছে।সুরঙ্গ দিয়ে উঁকি মারলে কিছুটা অংশ দেখা যায়।একবার উঁকি দিয়ে দেখে আসার খুব ইচ্ছে হল।কিন্তু যা ভিড় সেখানে,চান্স পাওয়ায় মুশকিল।

চপমুড়ি খেয়ে এসে শিবদাস ব্যবসার সামগ্রীগুলো একে একে থলে থেকে বের করে তিরপলের ওপর পাততে লাগল।বাঁশের ব্যারিকেডের সঙ্গে দড়ি বেঁধে কিছু আইটেম খদ্দেরের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সেফটেফিন গেঁথে ঝুলিয়ে দিল।

বেলা বারোটার সময় মেলা জমতে শুরু করেছে সবে।টুকটাক বেচাকেনাও হচ্ছে।এমন সময় কমিটির একদল ছেলে ছোকরা এসে জানাল,মঞ্চের সামনে থেকে উঠে যাও সব।এখানে বসা চলবে না।

শিবদাসের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল।বলল,উঠে যাব মানে!

—মাল গুটিয়ে অন্য জায়গা দেখো গে।আজ পোগ্রাম আছে এখানে।

ফুচকাওয়ালারদের একজন জানাল,আগের বার তো দাদা এখানেই বসেছিলাম।শেষের দিনে তো পোগ্রাম থাকে না।

—আজ মেলা শেষ কে বলেছে তোমাদের?রাত বারোটার পর অমাবস্যা লাগছে।পাঁজির হিসাব অনুযায়ী দু-দিনই পুজো দেওয়া যাবে।

দলের মধ্যে পাঞ্জাবি পাজামা পরা একজন ম্যানেজার গোছের লোক আছে।পকেটে কলম গোজা, হাতে দামি ঘড়ি।লোকটা আয়েসি ঢঙে দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ।এবার সে কথা বলল সরাসরি,এখানে বসার পারমিশন তোমাদের কে দিয়েছে?

কী জবাব দেবে শিবদাস কোনো কথা খুঁজে পেল না।কাঁচুমাচু মুখ করে তাকিয়ে থাকে।তারপর বলে,দেখুন, না জেনে বসে গেছি যখন,আজকের দিনটা থাকি।এখন তো আর কিছুই করার নেই।

—কিছুই করার নেই মানে!মাথাটা কি ঢিলে আছে নাকি হে! সন্ধে থেকে ড্যান্স হাঙ্গামা হবে।দর্শকরা মদ খেয়ে নাচাকোঁদা করবে। পা দিয়ে জিনিসপত্র সব ভেঙে দিলে,তখন কে দায়িত্ব নেবে?

—সকালে তো আপনাদের টিকিটিরও দেখা পেলাম না।তখন এলে কি এখানে বসতাম! শিবদাস কাকুতিমিনতি করে।

সঙ্গে সঙ্গে দলের একজন খেঁকিয়ে উঠল, এই যে ভাই,খুব যে চ্যাটাং চ্যাটাং করে কথা বলছ।কতদিন ব্যবসায় নেমেছ?অফিসঘরে একবার যেতে কি পেছনে বাজছিল?

একজন চ্যাংড়া ছেলে অনেকক্ষণ ধরেই ম্যানেজার গোছের লোকটিকে কী যেন বলতে চাইছিল।সুযোগ পেয়ে বলল,এই উড়োকাকগুলোকে নিয়ে হয়েছে যত জ্বালা!প্রতিবছর এসে খালি গ্যাঞ্জাম করবে এখানে!এবারে সব পাতুনি ব্যবসাদারদের বারণ করে দাও কর্তা।বড় স্টল করলে আসুক,নাহলে আসার দরকার নাই।

ম্যানেজার গোছের লোকটা ধমকে থামিয়ে দিল ছেলেটিকে,আহ!তুই চুপ করবি!তারপর শিবদাসের দিকে ঘুরে বলল,শোনো ভাই।তোমরা আসো বলেই তো আমাদের মেলা।কিন্তু ব্যপারটা বোঝার একটু চেষ্টা করো।

তর্কাতর্কি শুনে বেশ কয়েকজন জড়ো হয়ে গেল।শিবদাসের দিকে সবাই এমনভাবে তাকাচ্ছে,যেন সে চুরি করে ধরা পড়েছে।পাশের ফুচকাওয়ালারাও দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ।তাদের তো কোনো সমস্যা নেই।ভ্যানগুলো ঠেলে কোনো এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া সোজা।কিন্তু শিবদাসের দোকান তিরপলের ওপর পাতা।এক-একটা করে জিনিস গুটিয়ে সব থলেতে ভরে,আবার কোনো জায়গায় নিয়ে যাওয়া অনেক হ্যাপার কাজ।আর উঠে যেতে হলেও মানসম্মানের ব্যাপার।এইরকম সমস্যায় পাতুনি ব্যবসাদারদের অনেক জায়গাতেই পড়তে হয়।না আছে তাদের বড় স্টল করার মুরোদ,না পারবে ব্যবসা ছেড়ে দিতে।যতদিন না বড় স্টল করতে পারছে,ততদিন পরতে পরতে লড়াই করে যেতে হয় তাদের।

সামনের দাড়িওয়ালা লোকটা এবার এগিয়ে এল।তারপর ম্যানেজার গোছের লোকটিকে বলল,ঠিক আছে দাদা,ও উঠে যাবে।বহুদূর থেকে এসেছে বেচারি। ওকে একটা বসার জায়গা অন্তত করে দিন।


।।তিন।।

রাত বারোটা পেরিয়ে গেল,এখনো তেমন বিক্রি-বাট্টা করতে পারেনি শিবদাস।সার্কাসের তাবুর পাশে একটা নীচু মাঠে বসার জায়গা পেয়েছে।জায়গাটা মেলার একপাশে।সন্ধ্যার আগেই কমিটির লাইটম্যানকে একটা বালব টাঙানোর জন্য বলেছিল শিবদাস।লাইটম্যান বলেছে,এখানে তো ভাই তার খাটানো হয়নি।আর এতদূর থেকে কারেন্ট আনাও মুশকিল!তাবুর বালবের আলোটা তো মোটামুটি আসছে,ওতেই একটু কষ্ট করে চালিয়ে নাও না।

এখানে কোনো পাতুনি ব্যবসাদার বসেনি।তাবুর কাছ ঘেঁষে শিবদাসের মতো হতভাগ্য একজন রয়েছে।লোকটা সুতোই বেঁধে খেলনার গ্যাস বেলুন বিক্রি করছে।তাবুর কাছে বলে ও আলোটা ভালো পাচ্ছে।দুপুরে আরও চারটি মুড়ি খেয়ে নিয়েছিল শিবদাস।আর কিছু খাবার পেটে দেওয়ার সূযোগ হয়নি।চেনা পরিচিত বিশ্বাসযোগ্য কেউ পাশে নেই,যাকে দোকানটা একবার ছেড়ে দিয়ে কোথাও খেয়ে আসবে।ভাগ্যিস বাড়তি দুটো চপ কিনে রেখেছিল!

দিনের বেলা তাহলেও টুকটাক করে খদ্দের আসছিল।সন্ধের পর থেকে আর কেউ মাটির দিকে তাকায়নি।আলো ঝলমলে বাহারী স্টলগুলির প্রতি ছেলে-মেয়েদের আকর্ষণ বেশি।না কিনলেও দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।পাঁচরকম পাঁচটা জিনিস নেড়েচেড়ে দেখে।শোকেসের ওপর আলো পড়ে জিনিসগুলি এত রঙচঙে দেখায়,যে কিনতে বাধ্য।

বেলুনওয়ালা লোকটি এসেছে পানাগড়ের কাছের এক গ্রাম থেকে।অনেকক্ষণ ধরেই লোকটা করুণভাবে খদ্দেরের আশায় পথের দিকে চেয়ে বসেছিল।একটি খোঁচাওয়ালা বাঁশ মাটিতে পুঁতে তাতে বেলুনগুলি ফুলিয়ে সুতো দিয়ে বেঁধেছে।শিবদাস লোকটার চোখাচোখি হয়ে বলল,কই গো কাকা,এখনো যে খরচাটাই উঠল না!কত নাম শুনেছি এই মেলার।

লোকটাও যেন মনের ভাব প্রকাশ করার মতো একজন মানুষ পেয়ে গেল।বলল,এরকম তো কখনও হয় না বাপু।তিনবছর ধরে আসছি এখানে,এমন খারাপ বাজার কখনও হয়নি।

শিবদাস বলল,আমার শালা আজ সকাল থেকেই ভাগ্যটা খারাপ।বসেছিলাম একজায়গায়,কমিটির লোক উঠিয়ে দিল।এটা তো মেলার আউট সাইড।নীচু মাঠ।খদ্দের সেভাবে নামছেই না।আর একটা লাইটও পেলাম না।

—জায়গার দোষ নয় বাপ।হবার হলে সবখানেই হবে।আমি তো এখানেই বসি প্রতিবছর,তাহলে!

—একদিনের মেলাটা হলে মনে হয় কিছু হত।আজ তো সবাই কিনবে না।একটু থেমে শিবদাস জিজ্ঞেস করে, তুমি কি কাল অবধি থাকবে?

—ধুর!আজ মেন দিনটাতেই কিছু হল না।কাল আর থেকে কী হবে!আর খানিক দেখি,তারপর গুটিয়ে নেব।

—তাই তো গো কাকা!এতদূরের পথ,আমি যে কী করি!

—কেন?তোমার সঙ্গে কেউ আসেনি?

—আমি তো একলাই এসেছি।

মঞ্চের পোগ্রাম শেষ হতেই মেলার ভিড় কমতে শুরু করল।ফাঁকা মাঠ।মাথার ওপর কোনো ছাউনি নেই।শিশির পড়ছে পিটপিট করে।

শিবদাস যেখানে বসেছে,তার পেছনে অন্ধকার মাঠটাতে অনেকে পেচ্ছাব করে যাচ্ছে।দোকানদার থেকে শুরু করে মেলা দেখতে আসা দর্শক,কেউ বাদ নেই।হঠাৎ দেখল সেই দাঁড়িওয়ালা আঙটি বিক্রেতা।শিবদাসকে দেখে লোকটা নিজের থেকেই সামনে এসে দাঁড়াল।বলল,এবার গোটা ভাইপো!আর কিছু নেই।শিশির খেয়ে ঠান্ডা লাগাবি নাকি!

—তোমরা সবাই রাতারাতি চলে যাচ্ছ?

—তো কী করব!এখানে শেয়াল-কুকুরের মতো পড়ে পড়ে মশার কামড় খাওয়ার কোনো মানে হয় না।আর মেলাও তো বিশাল!এমন বিক্রি-বাট্টা বাপের জন্মেও দেখিনি।কমিটির তলা,লাইট ভাড়া,খাওয়া-দাওয়া সব মিলিয়ে যা খরচ,লাভের গুড় পিঁপড়েতেই খেয়ে শেষ করে দেবে।

—তোমরা তো তাহলেও কিছু করেছ।আমি এধারে কিছুই করতে পারিনি।

—হতাশ হোস না বাপ।ব্যবসা হচ্ছে নসিবের ব্যাপার। ধৈর্য্য ধরে লেগে থাক।কখনো হবে,কখনো হবে না।একটু থেমে বলল,তুই কী থাকবি ভাবছিস?

—কি করব,সেটাই তো বুঝতে পারছি না।

—যদি যাবি,তো আমাদের সাথেই বেরিয়ে চ'। জায়গাটা ভালো নয় বাপ।একলা মানুষ, জিনিসপত্তর নিয়ে থাকার রিস্ক নিস না।মোষের মতো ভঙভঙ করে ঘুমিয়ে পড়বি,সকালে উঠে দেখবি সব মাল হাপিস!

শিবদাস খুব চিন্তায় পড়ে গেল।রাতারাতি বাড়ি ফিরতে হবে জানলে সে আসতই না।ভেবেছিল সকাল পর্যন্ত যেহেতু কেনাকাটা হয়,রাতটা জেগেই পার করে দেবে।তারপর না-হয় সকালে টুকটুক করে প্যাডেলে পা দেবে।

শিবদাসকে মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখে লোকটা বলল,এতবড় জোয়ান মরদ চিন্তা কিসের রে!আমাদের সঙ্গে খেয়াঘাট পর্যন্ত তো যেতে পাবি।আজ সারারাত খেয়া পারাপার হবে।


।।চার।।

মেলাটাকে পেছনে ফেলে পাতুনি ব্যবসাদারদের সাইকেলগুলো লাইন ধরে চলেছে পিচের রাস্তা দিয়ে।অন্ধকার রাত।দশহাত দূরের কোনো কিছুই দেখা যাচ্ছে না। প্রত্যেকের হাতে টর্চ আছে।দূর থেকে দেখলে মনে হবে একটা আলোর মালা হেলেদুলে এগিয়ে যাচ্ছে।

দাড়িওয়ালা লোকটার নাম নুরুমদ্দিন।বাড়ি জামালপুর।সঙ্গের বইবিক্রেতা ও ফুলদানিওয়ালা তাদের গ্রামেরই।শুধু ওরাই নয়,এপারের বেশ কয়েকটি গ্রামের পাতুনি ব্যবসাদারই মেলা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে।প্রত্যেকের মনে সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেও নেহ্য উপার্জন না করতে পারার হাহুতাশ।ওরা যাচ্ছে নিজেদের সুখ-দুঃখ আর জীবনের নানান ঘাত-প্রতিঘাতের গল্প করতে করতে।কারও ছেলে-বউ বাপকে দেখে না,বুড়ো বাপকে ব্যবসায় নামতে হয়েছে।কেউ মেয়ের বিয়ের পনের টাকা জোগাড় করতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে।কারও জমি বন্ধক পড়েছে,তা ফেরানোর জন্য মরিয়া।ওদের কথাবার্তা বাতাসে ভাসতে ভাসতে মিলিয়ে যাচ্ছে।কোনো গ্রামের গৃহস্থের বাড়ির কুকুর ডেকে উঠছে রাতের নিঃস্তব্ধতাকে খান খান করে ভেঙে দিয়ে।সেই পৌষসংক্রান্তি থেকে মেলা শুরু হয়েছে।শেষ হবে চৈত্রমাসের গাজনে।এই কয়েকমাস পাতুনি ব্যবসাদারদের ঘরের মেয়েদের চোখেও ঘুম থাকে না। রাত জেগে না খেয়ে বসে থাকে ঘরের মানুষটির ফেরার অপেক্ষায়।সাইকেলের ঝনঝন শব্দ শুনলেই বাড়ির দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়।গভীর রাতে চলে খাওয়া-দাওয়া।ততক্ষণে পাড়াপড়শি ঘুমে কাদা।পাশের ঘর থেকে হয়তো বুড়ো বাপ,বা বুড়ি মা জেগে উঠে হাঁক পাড়ে,খোকা এলি?

একটা বাঁকের কাছে এসে কয়েকজন পাতুনি ব্যবসাদার ঘুরে গেল।শিবদাস চলল জামালপুরের নুরুমদ্দিনদের সাথে।

খেয়াঘাটের রাস্তাটা মেন রোড থেকে নেমে গেছে নদীর দিকে।শিবদাস এবার চলে যাবে।বিদায় মূহুর্তে পাতুনি ব্যবসাদাররা সাইকেল থেকে নেমে বিড়ি ধরাল।শিবদাসও নিল একটা।

নুরুমদ্দিন বিড়িতে টান দিয়ে বলল,এবছর মন্দা চলছে রে বাপ!সারা দেশ জুড়ে মন্দা।কোনও মেলাতেই ভালো রোজগার হচ্ছে না।

শিবদাস বলল,কত আশা করে ব্যবসায় নামলাম কাকা।এভাবে চললে তো ঘরসংসার চালানো খুব মুশকিল গো!

বইবিক্রেতা ছেলেটি বলল,কিছুই করার নাই ভাই।মানুষ এখন পেটের ভাত-কাপড় জোগাড় করতেই হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে।বাড়তি টাকাপয়সা হাতে না জমলে শখ-সাধ মেটাবে কী করে!আর দিনকে দিন জিনিসপত্রের দাম যা বাড়ছে!

নুরুমদ্দিন সায় দিল লোকটার কথাতে,তুই ঠিকই বলেছিস বাপ।পরশু মাল তুলে আনলাম,দাম শুনে চমকে গেছি।পৌষ মাসে মেলা শুরুর সময় যে আঙটি দশ টাকায় কিনেছি,এই ফাল্গুনেই তার দাম তের-চৌদ্দ টাকা পড়ে যাচ্ছে।আবার বলছে নাকি কিছুদিন পর সব আইটেম টাকা দিয়েও মিলবে না।নুরুমদ্দিনের বুক ঠেলে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

ফুলদানিওয়ালা বলল,আসলে চায়না মাল তো আর আমাদের দেশে ঢুকছে না।এখন দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক খুবই খারাপ।যুদ্ধ লেগে গেলে আরও মুশকিল হবে।আবার শুনছি নাকি ওদেশে কী যেন এক ভাইরাস উঠেছে।মাল আমদানি করা খুব রিস্কও বটে।

নুরুমদ্দিনের বিড়িটা পুড়তে পুড়তে আগুনটা সুতোর কাছে এসে ঠেকেছে।শেষ টানটা বোধহয় একটু রেগেই দিল।ঠোঁটের ডগায় লাল বিন্দুটা প্রচন্ড শক্তি পেয়ে একবার দপ করে জেগে উঠেই ঘুমিয়ে পড়ল।ছোবলমারা সাপের মতো ফোঁস করে উঠল সে,—যুদ্ধ করবেক শালারা,আর না খেয়ে মরব আমরা!

বইবিক্রেতা বলল,এটা তো চাচা বরাবরের নিয়ম।যুদ্ধ করে রাজায় রাজায়,উলুখাগড়া প্রাণ হারায়...।

একটা কথার খেই ধরে আরও কত বিষয় এসে পড়ে।পাতুনি ব্যাবসারদের এমন কত অজানা অচেনা মানুষের সাথে ক্ষণিকের আলাপ-পরিচয় হয়।জামালপুরের ব্যবসাদাররা এবার প্যাডেলে পা রাখল।বিদায় জানাল শিবদাসকে।সাবধানে যাও গো।বেঁচে থাকলে আবার কখনো দেখা হবে।

নদীর ঘাটে এসে দাঁড়াল শিবদাস।ঘুটঘুটে অন্ধকার।চারপাশ শুনশান।এপারে নৌকা নেই।নিশ্চয়ই যাত্রী নিয়ে ওপারে গেছে।ওটাই যদি শেষ খেয়া হয়?তাহলে কী করবে সে!এই অন্ধকারেই বসে বসে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবে?সাইকেলটা ঘাটের বেদি বাধানো বটের গায়ে ঠেসিয়ে দিল শিবদাস।টর্চটা জ্বালল ওপারের দিকে।আলোটা পৌঁছাচ্ছে না।অন্ধকারটা কেলে সাপের মতো গ্রাস করে নিচ্ছে।নদীর বুক থেকে ভেসে আসছে জলো হাওয়া।হিমশীতল।তিরের মতো গায়ে বিঁধছে।

মাঝি জেগে থাকলে টর্চের আলো দেখেই বুঝতে পারবে এপারে যাত্রী অপেক্ষা করছে খেয়ার জন্য।পকেট থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখল শিবদাস।রাত দেড়টা বাজছে।একটা রাত পেরিয়ে আরও একটা দিনের সূচনা হচ্ছে।দশটার সময় ফোন করে আদুরীকে জানিয়ে দিয়েছিল শিবদাস,যে সে আজ ফিরবে না।না জানালে সারারাত না খেয়ে জেগে বসে থাকবে তার জন্য।এখন যে বাড়ি যাচ্ছে শিবদাস,সে কথা আদুরী জানে না।একবার কী তাকে ফোন করে দেখবে?কী করছে এখন!নিশ্চয়ই মনখারাপ করে ঘুমিয়ে পড়েছে।ফোন করতে গিয়েও আঙুলটা সরিয়ে নিল শিবদাস।মনে হল,না থাক।প্রতিদিন তো রাত জেগে বসে থাকে বেচারি।একটা দিন অন্তত সুখ করে ঘুমোক।

নদীর দিকে চেয়ে অন্ধকারে বসে খেয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল শিবদাস।যদি ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে আসে একবিন্দু আলো।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ