ওয়াসি আহমেদ'এর গল্প : নখদর্পণ



অনেকক্ষণ পর গলার আভাস পাওয়া গেল, তাও গানের গলা-- ‘দেখতি পাচ্ছ? পাচ্ছ না?’ কথার মধ্যে গান নেই তবু গান উঠে এল। যাকে বলা সে ভয় পেল, নিজের চোখকে ভয়, কী দেখতে কী দেখবে! সে সামনে তাকাল, বছর আট-নয়ের মায়ামাখা মুখ, চোখের তারা দুরুদুরু, সেখানে পরিষ্কার ভয়। সমানে তাকিয়ে সে আরো ভয় পেল, অনেকগুলো মাথা নাক মুখ চোখ, কার কোনটা আলাদা করা যাচ্ছে না। পাশে বসা লোকটা এবার অভয় দিল, আর সেই গানের গলায় সত্যি সত্যি গান ধরল :

পরথমে দেখো চন্দ্র-সূর্য, আসমানের তারা

মাটি বিরিক্ষ দেখো
পতঙ্গের লীলা--
দুধাল গরুর বাঁট দেখো
মায়ের মুখের হাসি দেখো
জনম দেখো মরণ দেখো
তারপর মানুষের মন।

উঠানের কোণে জটলা এতক্ষণে জমজমাট। একটু আগেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। শোরগোল উঠছিল, একেক মুখে একেক কথা। তারওপর কুঁচোকাঁচার চেঁচামেচি, দৌড়াদৌড়ি। গোয়াল থেকে দামড়াটা পর্যন্ত গলা মেলাচ্ছিল। কুকুরটা এত লোক দেখে তৎপরতা দেখাতে ব্যস্ত। সব মিলিয়ে মহা ক্যাঁচম্যাচ।

দুম করে অবস্থা বদলে গেল। প্রথমে কথা ছিল কাজ হবে ঘরের দাওয়ায়। অতি আগ্রহে হুটহাট কয়েকটা পিঁড়ি এসে জুটল দাওয়ায়। লোকটা রাজি হলো না, কেন হলো না সে জানে। তারপর ঠিক হলো মাঝউঠানে-- নিকানো, খোলামেলা, আলো আছে, হাওয়া আছে। লোকটা বাধ সাধল, না হবে না, রোদে কাজ চলবে না। কথা ঠিক, বেলা দশটা হবে কি না, কিন্তু রোদ তো বোঝে না, কিলবিলিয়ে নাচছে উঠান বরাবর। লোকটা --ঢ্যাঙ্গা শরীর, জটপাকানো লম্বা চুল--কাঁধের ঝোলায় হাত ঢোকায় আর বের করে, মনস্থির করতে পারছে না। দাওয়া ছেড়ে মাঝউঠানে নেমে এল, সেখান থেকে পা গুনে গুনে ডানে গেল, বাঁয়ে গেল, চক্কর কাটল। তারপর এই জায়গাটা পছন্দ হলো, হলো তো হলো মহাপছন্দ। মাথার ওপর বাতাবিলেবু গাছের ছায়া বলে না, সূর্যটা আড়ালে বলেও না। সে বলল-- দৃষ্টি চাইরে মন, দৃষ্টি চাই।

এতক্ষণে সে দৃষ্টির পরীক্ষা নিচ্ছে। পাশাপাশি পিঁড়িতে বসা ছেলেটা-- আট-ন বছর বয়স, মায়াভরা মুখ, চোখের তারায় দুরুদুরু। কী দেখতে কী দেখবে! চারপাশে ঘিরে বসা জনাকুড়ির জটলা, গায়ে গা ঘেঁষাঘেঁষি কালো মাথাগুলোর সামান্য ওপর-নিচ বাদ দিলে গোলগাল কাছিমের খোল। বসার ভঙ্গি বলে আলাদা কিছু নেই, আছে যা মদ্যিখানে ছেলেটার। জোড়হাঁটুর ওপর মুঠিবদ্ধ ডান হাত, বুড়োআঙুলটা অল্প উঁচানো, তাতে তেলতেলে নখটা তার চোখের ঠিক নিচে। লোকটার কথা মতো চোখ দুটো সে গেঁথে আছে ওখানে, নখদর্পণে।

‘দেখতি পাও?’

ছেলেটা দেখে না; দৃষ্টির ক্ষীণতায়, ব্যর্থতায় মুখ কাঁচুমাচু করে। লোকটা রাগ করে না। সে যা বলে দেখা-অদেখা মনের টানে, মন বাঁধো দেখতে পাবে। চন্দ্র, সূর্য, পাতালের বালি, মানুষের মন।

মঙ্গল সাউ মুখ কালো করে বসে আছে। গেলরাতে গোয়াল ফাঁক করে ধলী গাইটা চুরি গেছে, সঙ্গে পাঁচ দিনের বকনা। সাউ কঞ্জুস মানুষ, তবে হালের বলদ হোক, দুধেল গাই হোক, গোয়ালে তার বড় কদর। বড় মেয়ের ঘরে নাতনির জন্মের পর ছ’মাসের বকনা উপহার দিয়েছিল সাউ। সেই বকনা সাউয়ের গোয়ালে আদর পেল, যত্ন পেল, গায়েগতরে বড় হলো, বাচ্চা বিয়োলো, সবে আজ পাঁচ দিন। খবর পেয়ে মেয়ে এল, নাতনি এল। আর এদিকে? চোর হারামজাদার নজর যদি দামড়াটার ওপরও পড়ত! তা সকালবেলা এই লোকটা এসে হাজির, এ এক রহস্য। নাম তার কবিরাজ, লোকে ভুল করে ভাবে ওষুধের কারবারি, আসলে বাপের দেওয়া নাম। বাপ ছিল নামকরা গুণিন। সাপে কাটা মড়া পর্যন্ত জ্যান্ত করে তুলত। ছেলের ঝোঁক অন্যদিকে, সাপ-খোপের কারবারে নেই। সে দেখে; নিজে দেখে অন্যকে দেখায়। এই যেমন এখন। মঙ্গল সাউয়ের শেষ বয়সের ছেলে বাবলুর হাতের বুড়োআঙুলের নখটাই মস্ত দর্পণ।

সকালবেলা কবিরাজকে পেয়ে সাড়া পড়ে গেল। দর্পণ ধরো কবিরাজ, দর্পণ ধরো। সাউয়ের নিজের যে খুব আগ্রহ তা-না, তবে বড় ছেলে গগন, মেজো ছেলে রতন রীতিমতো হইচই বাঁধিয়ে বসল। সঙ্গে আরেকজন আছে-- মুখচোরা, এ বাড়িতে যার আগ্রহের মূল্য অনেক, মঙ্গল সাউয়ের মেয়েজামাই। আশপাশ থেকে, এবাড়ি ওবাড়ি থেকে লোক জুটল। ঝাঁকড়ামাথা তালগাছের শরীর কবিরাজের, মনে হলো গন্ধ শুঁকেই হাজির হয়েছে। বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ, চেহারাটা মানানসই, চোঙের মতো ঘাড়ের ওপর বিশাল মাথা, সরু কপাল, কুতকুতে চোখ, থ্যাবড়া নাকের দুই পাশে উঁচু চোয়ালের তলায় বাঘে খাওয়া বড়সড়ো গর্ত।

হেঁটে হেঁটে নানাভাবে জরিপ করল কবিরাজ। প্রথমে ঘরের দাওয়া, দাওয়া থেকে উঠান, তারপর উঠানের এই কোণ। জায়গা পছন্দ হলো কবিরাজের, তারপর সাউয়ের ছোট ছেলে বাবলুকে ধরে বসানো হলো পিঁড়িতে, নিজে বসল পাশে অন্য পিঁড়িতে। বাবলুকে কেন পছন্দ করল, সে জানে। ফুটফুটে নাদুসনুদুস বাবলু হ্যাঁ না কিছু বলল না, তবে বসামাত্র ছত্রখান ভিড় চারদিক থেকে চেপে ধরতে ঘাবড়ে গেল।

কবিরাজ ধমক দিচ্ছে, অভয় দিচ্ছে আবার তাড়া দিয়ে ছড়া কাটছে:

দৃষ্টি দেও ও মন, দৃষ্টি দেও
খুলে যাবে অন্তর দুয়ার
আন্ধার ঘরে চান্দের আলো, চোক্ষের তারায় ভবের লীলা
দৃষ্টি দেও ও মন ...

মঙ্গল সাউয়ের মেয়েজামাই জয়গোপাল বসেছে কবিরাজ আর বাবলুর ঠিক মুখোমুখি। উৎসাহে চোখের পলক পড়ে না। প্রতিমুহূর্তে সে বাবলুর চোখমুখের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করছে। বাবলুর চেহারা ধীরে ধীরে কেমন যেন ভাবান্তরহীন হয়ে যাচ্ছে। প্রথমদিকের ভয়-জড়তায় কাঠকাঠ ভাব নেই, সেই সাথে উৎসাহ, কৌতূহলও নেই। মুঠিবদ্ধ হাতটা জোড়হাঁটু থেকে এপাশে ওপাশে হিলছে। কবিরাজের কড়া নজর, বারবার হাতটা ঠিক করে দিচ্ছে। পায়ের কাছে কাঁসার ছোট বাটিতে ইঞ্চি পরিমাণ সর্ষের তেল। কঞ্চির চিকন কাঠি বাটির তেলে ঘুরিয়ে কবিরাজ কাঠিটা ধরেছে বাবলুর মুঠো করা হাতের বুড়োআঙুলের নখে। ছড়া কাটার ফাঁকে ফাঁকে যত্ন করে একই কায়দায় কাঠিটা ধরছে, সোনা-ঝলমল তেলের ফোঁটা পড়া মাত্র বাবলুর নখ তা খেয়ে ফেলছে। আপাতত এইটুকু দেখে জয়গোপাল ভেতরে উত্তেজনা অনুভব করে। তবু মনটা তার খারাপ হয়ে থাকে, সে কিছু দেখতে পাবে না, যা দেখার দেখবে বাবলু। সেরকমই কথা। কবিরাজের মুখের দিকে চোখ ফেরায় সে। লোকটা বিড়বিড় করছে আর একমনে কাঠি নাড়ছে। ঘূর্ণি-কাটা গাঢ় সোনালি তেলে দৃষ্টি ফেলতে চোখ দুটো মোহে পড়ে।

‘দেখতি পাচ্ছ না?’ কবিরাজের গলার স্বর আশ্চর্য কোমল। চোখ তুলে বাবলুর দিকে তাকাতে জয়গোপাল অভিভূত হয়ে যায়। মাথা দোলাচ্ছে বাবলু: হ্যাঁ, এতক্ষণে দেখতে পাচ্ছে। চোখজোড়া নিবিষ্ট, মণিটা আঠার মতো গেঁথে আছে দর্পণে।

‘দেখতি পাচ্ছ এক জোড়া হাত।’

বাবলু মাথা দোলায়, বলে, ‘দেখি এক জোড়া হাত।’

‘হাতের কী পরিচয়?’

বাবলু চুপ করে থাকে, যেন মন দিয়ে দর্পণে হাতের পরিচয় খুঁজছে। কবিরাজ দর্পণে ঝুঁকে পড়ে বলে, ‘দুইয়ে দুইয়ে চার হয়, দিন গেলে রাত হয়, দশ আঙুলে হাত হয়, কয় আঙুল?’

বাবলু যেন এতক্ষণ গোনাগুনতির ফাঁপরে ছিল, চোখ না তুলে বলে, ‘দেখি দশ আঙুল।’

কবিরাজ গলায় মিনতি ঝরায়, ‘মন খুইলে দেখো। মনের আড়াল কিছু নাই। দশ না এগারো? ডান হাতে ছয় আঙুল দেখা যায় পরিষ্কার। বলো কী পরিচয়?’

বাবলু বিড়বিড় করে বলে, ‘এগারো। ডান হাতে ছয় আঙুল দেখা যায় পরিষ্কার।’

জেঁকে-বসা ভিড়ে মুহূর্তে একটা চাপা শোরগোল উঠে দমকা হাওয়ার মতো মিলিয়ে যায়। শোরগোল ওঠার সাথে সাথে কবিরাজ তার ডান হাতের তর্জনী তুলে ধরে মাথার ওপর। কবিরাজ যা বলতে চায় তা যেন এই-- মাত্র হাতের পরিচয়ে চোর শনাক্ত করবে এমন কাঁচা কাজ কবিরাজ করে না। মুশকিল কেবল বাবলুকে নিয়ে, এরই মধ্যে চোখ জড়িয়ে আসছে, গলা খাদে বসে গেছে। কতক্ষণ পারবে সেটাই সমস্যা।

ভিড়ের আয়তন বাড়ে। চক্রাকার জটলাটা মাঝউঠান পর্যন্ত সীমানা ছড়ায়। রাখঢাক ফেলে কোলের বাচ্চাসহ মেয়েরাও নিঃশব্দে বসে পড়ছে। মঙ্গল সাউ দাওয়ায় বসে থাকে। শূন্য গোয়ালের এক কোণে দামড়াটা অনবরত লেজ নাড়ছে।

দাগি চোর বলতে গ্রামে দুইজন। ছিঁচকে চুরিচামারিতে এ দুজনের নাম আসে আগে। একজন বদলু, অন্যজন কৈবর্তপাড়ার ধনা। চোর হিসেবে বদলু, ধনা দুজনই পুরোনো। গ্রামে নাম-ডাক হয়ে যাওয়ায় তারা বাইরে যায়, গ্রামে সুবিধা করতে পারে না। ইদানীং নতুন মুখ এসেছে, মতি লাঠিয়েলের ছেলে হাসর। মাথার ওপর দাগি দুজন থাকায় হাসর বেশ নিরিবিলিতে কাজ চালিয়ে আসছিল। ধরা পড়ল প্রথম নসু হালদারের মুরগির খোঁয়াড় ভাঙতে গিয়ে। তবে গরু আর মুরগি এক না। একটা গরু সামাল দিতে কম করে হলেও রাতের মধ্যে দশ মাইল পথ হাঁটতে হয়।

একটু আগেও হাসরের কথা কারো মাথায় আসেনি। পাঁচ দিনের বকনাসহ ধলী কাজটা বড়, বড় কাজের দায়িত্ব চাপাতে মন সায় দেয়নি। কিন্তু এখন কী উপায়? ডান হাতে ছয় আঙুল দেখা যায় পরিষ্কার। হাসর ছাড়া কে?

জয়গোপাল দেখে আর দেখে। ভিড়ের গায়ে উত্তেজনা এঁকেবেঁকে ঢেউ খেলে। তার নজর সেদিকে নেই, সে তাকিয়ে আছে বউয়ের এক রত্তি ছোট ভাইয়ের মুঠিবন্ধ হাতে তেলেতেলে দর্পণটা সামনে, কিন্তু কিছু দেখা যাচ্ছে না। দেখার যা, দেখছে বাবলু। চোখমুখ বিকারশূন্য, কিছুটা ফ্যাকাশেও। বাবলু কথা বলছে জড়ানো গলায় যেন ঘুমিয়ে পড়েছে, পাশ থেকে কবিরাজ মাঝে মাঝে উসকে দিচ্ছে।

হাতের বর্ণনা শেষে বাবলুর মুখে এবার চেহারার বর্ণনা। কবিরাজ ছড়া কাটে:

চোখ দেখো মুখ দেখো
বাবরি চুলের বাহার দেখো
বটগাছের ঝুরি দেখো
অন্তরের পাপ দেখো

সাপ দেখো...

যন্ত্রচালিতের মতো বাবলু বিড়বিড় করে, পাশ থেকে কবিরাজ ধুয়া তোলে। বটগাছের ঝুরি দেখছে বাবলু। কবিরাজ বলে বাবরি চুল। মৌমাছির চাক। কবিরাজ বলে মুখভরতি গুটির দাগ। চেপে থাকা উত্তেজনা এবার সরব হয়ে ওঠে। কবিরাজ আপত্তি করে না। মঙ্গল সাউয়ের বড় ছেলে গগন বসা থেকে লাফিয়ে ওঠে, দেখাদেখি আরো কয়েকজন। তাদের চোখমুখে রাগ, প্রতিহিংসা। এমনকি ছোটরাও যারা হাসরকে দেখেনি, তারা পর্যন্ত নিশ্চিত হয়ে যায় দর্পণে হাসরের মুখ। গুটি-খাওয়া মুখ, বাবরি চুল, ডান হাতে ছয় আঙুল। উত্তেজনার তোড়ে জটলা ভেঙে পড়ে।

কবিরাজের কোলে বাবলুর মাথা, চোখজোড়া বোজা। হাত পা শরীর কিছুই নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। এক বাটি পানি আসে কোথা থেকে। চোখেমুখে ঝাপটা দিতে বাবলু চোখ মেলে। ঘরের ভেতর বাবলুকে শুইয়ে ফিরে এসে জয়গোপাল দেখে কবিরাজ দাঁড়িয়ে মাঝউঠানে, দূরে গাছপালার দিকে চোখ, ডান হাতটা কাঁধের ঝোলায়। চোর শনাক্ত করার পর মনটা এ জায়গায় নেই।

উঠানের পুব মাথায় ভাড়ার ঘরের লাগোয়া একচালায় কবিরাজকে এনে বসায় জয়গোপাল। ভেতরে বড় রকমের দ্বিধাদ্বন্দ্ব, পরনের ফুলহাতা শার্টের বুকপকেটে কুড়ি টাকার দুটো নোটা আর কিছু খুচরা। সম্মানী কম হয়ে গেলে? ভাবতে ভাবতে সে সিগারেট-দেশলাই বের করে। সামনে বাড়িয়ে ধরতে লোকটা জোড়হাতে আপত্তি জানায়।

‘মানা আছে?’

‘খালি পান-সিগারেট? গুড়-মুড়ি, চা-বিস্কুট, পানি পর্যন্ত না, ভাত ছোঁয়া যাবে সন্ধ্যার পর।’

জয়গোপাল বাড়িয়ে ধরা হাতটা গুটিয়ে স্টার সিগারেটের প্যাকেটটা রাখে কবিরাজের পাশে, চার-পাঁচটা হবে ভেতরে। বলে, ‘তালি সন্ধ্যায় খাবেন।’

প্যাকেটটা কবিরাজ ঝোলায় ভরে সামনের মানুষটার অভিভূত মুখ দেখে। আন্দাজে ধরতে পারে মঙ্গল সাউয়ের মেয়েজামাই। তবু বলে, ‘জনাবের পরিচয়?’

কথাটা কানে যেতে ধাক্কা খায় জয়গোপাল, লোকটা মুসলমান! সে মুখটা হাসিহাসি করে, মুখচোরা মুখ লজ্জায় বেঁকে যায়। লোকটার মুখ থেকে চোখ সরিয়ে বলে, ‘ভুসিমালের কারবার, রাহাগঞ্জ বাজারে দোকান, আর আপনেগো গেরামে হইল আত্মীয়, আপনেগো সাউবাবু আমার...

‘আর বলতি হবে না। কী কাণ্ড দ্যাখেন তো, এ্যামন সুময় আসলেন, ছানা-দধি খাবেন! যাক, বেশি দূর যাতি পারবে না, আইজ রাতের মদ্যি ধরা পড়বে। শালার ব্যাটা, যাবি কোয়ানে!’

পকেট থেকে নোট দুটো বের করে সামনে বাড়াতে হাতের আঙুল জড়তায় কুঁকড়ে আসে। যদি কম হয়? কবিরাজ দেখেও দেখে না, যেন তার জানা আছে। মুঠোর ভেতর থেকে ভাঁজ করা নোট দুটো ডানা মেলে তার হাতে চলে আসতে সে আনমনে ঝোলায় ভরে। জয়গোপাল করে। কবিরাজ উঠতে যাবে, জয়গোপাল আচানক কথা বলে, ‘দীক্ষা নিতে খরচা কেমন? ধরেন কেউ যদি দীক্ষা চায়।’

এক মুহূর্ত উঠানের ঝলমল রোদের দিকে চোখ ফেলে কবিরাজ। গরমের মধ্যে ভেতরে একট শিরশির অনুভূতি হয়। লোকটাকে প্রথম দেখায়ই ভালো লেগেছে। মনটা সরল, প্যাঁচগোচ নেই, দর্পণের মতো। সে বলে, ‘সব জিনিস কী শেখানো যায়! নিজে নিজে শিখতি হয়। আমার বিদ্যা আমার নিজের, কেউ শেখায়নি। নয়ান খোলা রাখেন, সব দেখতি পাবেন।’ বলতে গিয়ে গলা তার খাদে নেমে আসে। শেষ কথাটা তার বড় প্রিয়। একেকটা কথা মনে এমনভাবে গেঁথে যায়, হাজারবার বললেও পুরোনো হয় না। কবিরাজ দেখল কথাটা মেয়েজামাইকে ধরেছে। সে যেন চমকে উঠে বলল, ‘আমারে শেখান, খরচাপাতি যা লাগে...।’ ঝোলায় হাত ঢুকিয়ে কবিরাজ উঠে পড়ে। মনটা বিষণ্ন, যা হওয়ার না।

# #

সন্ধ্যার আবছায়ায় তরজার বেড়ায় ভাগাভাগি ঘরের কোণে কবিরাজ আনমনে বসে। ঘরের ভেতর টিমটিম আলো আর বাইরে সদ্যফোটা কামিনী ঝাড়ে আধভাঙা চাঁদ। বেড়ার ওপাশে কবিরাজের সাত বছরের ছেলে সুর তুলে নামতা পড়ে, দুই এক্কে দুই, দুই দুগুণে চার...। দর্পণ ধরার বড় লোভ। কবিরাজ ছেলের কথায় হ্যাঁ না কিছুই বলে না, তবে ছেলের মা, কবিরাজের দ্বিতীয়পক্ষ তেড়ে আসে, খবরদার, ঘরের মদ্যি বুজরুকি চলবি না।

মারকাট্টা বউটাই সন্ধ্যাবেলা স্বামীর নজর কাড়তে নরম করে হাসল, গা ঘেঁষে বসে চুপিচুপি সংবাদ দিল মঙ্গল সাউয়ের গরু পাওয়া গেছে। চোরটা হাসর না কী যেন নাম, মার খেয়ে বেহুঁশ।

রত্তি-রত্তি ফুলে গলে পড়া মোমজ্যোৎস্নায় রাত জমে ওঠে। ওপাশে ছেলেটার গলা থেমে গেছে, একটু আগেও ঘুম জড়ানো গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। কবিরাজ জায়গা ছেড়ে ওঠে, নাকেমুখে ফুল-জ্যোৎস্নার মাতাল ঘ্রাণ। দুই পা বাড়িয়ে পাশের ঘরে সদ্য ঘুমনিথর ছেলের গায়ে হাত ছোঁয়াতে সে নিজই চমকায়। দুহাতে টেনে কোলে তুলে নিতে ভেতরটা চনমন করে ওঠে, গা জুড়ে শিরশির। ছেলে ঘুমঘোরে নড়ে মাত্র।

ছেলেকে ডাকে কবিরাজ। মমতার ডাকে নিজের গলা নিজের কানেই অচেনা। একবার দুইবার বারবার ডাকে। চোখে খুলতে মস্ত ধাঁধা। বাপ বলে, ‘দর্পণ ধরবি? দর্পণ?’ যেন কানে কানে বহু দূর থেকে কথা বলে কবিরাজ।

নিশুতি রাতে ঝাঁকামাথা কামিনীগাছের পাশে দুধ-জ্যোৎস্নায় কবিরাজ দর্পণ ধরে আছে ছেলের চোখে। ছেলে বসে আছে, ধ্যানী চোখ নিবিষ্ট মুঠিবদ্ধ নখে। ঘুম নেই। জ্যোৎস্না খলবলিয়ে নেচে বেড়ায় মাথার ওপর। ছেলে অপেক্ষা করে আছে চাঁদ আসবে নখে, দর্পণ হবে চাঁদ, মুখ দেখবে দর্পণে।

কবিরাজের মুখে কথা নেই। ছড়া কাটে না, গান ধরে না। নিকানো সাদা মাটিতে স্রোতের মতো জ্যোৎস্নায় চোখমুখ অবশ। বাতাসে হিমকাঁটা। ছেলের একাগ্রতা ঝুঁকে আছে অনড় দর্পণে। ঝুঁকে-পড়া মাথার নিচে ছায়াচ্ছন্ন দর্পণে আলোর চিহ্ন নেই, চাঁদ কোথায়?

রাত বাড়ে। কবিরাজ বিড়বিড় করে। আদিগন্ত নৈঃশব্দ্যের ঝিঁঝিঁ চেপে বসে শরীর-মনে। সাত বছরের অসামান্য প্রতিপক্ষ, কিন্তু দৃষ্টি এত অন্ধ, কবিরাজ বিস্মিত না হয়ে পারে না। কানের কাছে মুখ এনে ব্যর্থ হয় কবিরাজ। ছেলে শোনে কি শোনে না। সাড়া নেই, বোধশক্তি পর্যন্ত নেই। অসহিষ্ণুতা পেয়ে বসে, বিরক্তি। বারবার তাড়া দেয় কবিরাজ।

‘দেখতি পাস না?’ চাপা গলার শাসানিতে এতক্ষণে ছেলেটা চমকে ঘাড় তোলে। মুখোমুখি রহস্যঘোর মুখটা তাকে ভীতিবিহ্বল করে তোলে। কিন্তু এক অপার্থিব চাঁদ-দর্পণ তাকে ঘোরে ফেলে, বেপরোয়া করে তোলে। দর্পণ ভেঙে সোজা আকাশের চাঁদের মুখে মুখ করে সে প্রায় চিৎকার করে, ‘না’। মাত্র একটি কথা শূন্যতায় পাক খেয়ে স্তব্ধতাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়। ভাঙা দর্পণের ঝনঝন শব্দ কবিরাজের কানে। কয়েক মুহূর্ত সে কাঠকাঠ হয়ে থাকে। দৃষ্টি অন্ধ, সে কিছু দেখে না। ছেলের গলার স্বর আবার ফাঁপা শূন্যতায় প্রতিধ্বনিময় হয়ে উঠতে সে তীব্র যন্ত্রণায় দৃষ্টিহীন জ্যোৎস্নায় ছেলের টুঁটি লক্ষ করে হাত বাড়ায়। কিন্তু অল্প প্রতিরোধেই হার মানে। এইটুকু ছেলে, ছটফট করতেই সে ছেড়ে দেয়।

জ্যোৎস্না-ধোয়া মাটি ছেড়ে ঢ্যাঙ্গা শরীর ঝাঁকড়া মাথা নিয়ে কবিরাজ উঠে দাঁড়ায়। ফকফকে সাদা মাটিতে ছায়াটা ভূতের মতো দোল খায়। মাথার ওপর বিপন্নতার সাক্ষী চাঁদের দিকে তাকিয়ে বুক ঝেড়ে কবিরাজ লম্বা শ্বাস ফেলে। এক ফুঁ-তে চাঁদটাকে নিভিয়ে দেবে সে শক্তি কোথায়!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ