ষষ্ঠ পাণ্ডব'এর গল্প: মৃতভোজী


শিখাদের বাড়িটা আনন্দবাজার লঞ্চঘাটের কাছে। বাড়ির সামনে পানের বরজ, তার পাশ দিয়ে রিক্‌শা-ভ্যান চলার হালট। হালটে উঠে দাঁড়ালে ঘাটের দোকানগুলোর ফাঁক দিয়ে লঞ্চ থেকে কে উঠছে, কে নামছে দেখতে পাওয়া যায়। ‘লঞ্চঘাট’ বললে যেমনটা বোঝানোর কথা ঘাটটা আসলে তেমন কিছু নয়। যেমন নামে ‘বাজার’ থাকলেও আনন্দবাজারের বাজারটি পাতে তোলার মতো কিছু নয়।
 
লঞ্চঘাটটিতে না আছে টার্মিনাল, না আছে কোন পন্টুন। কিছু ইট ফেলে, কিছু কাঠের থাম আর বাঁশ পুঁতে রাখা আছে। সেখানে শ্যালো ইঞ্জিনের নৌকা ছাড়া দিনে দুইবার একটা ছোট লঞ্চ এসে থামে। লঞ্চ যখন ঘাটের কাছে আসে তখন একটা মোটা কাছি ছুঁড়ে মারা হয়, পাড় থেকে একজন সেটা ধরে কাঠের থামে বাঁধে। একটা সরু কাঠের সিঁড়ি লঞ্চ থেকে নামিয়ে দিয়ে তার একপাশে একটা বাঁশ ধরে রাখা হয় যেন যাত্রীরা সেই বাঁশ ধরে, সিঁড়ি বেয়ে লঞ্চে ওঠা-নামা করতে পারেন। বর্ষাকালে নদীর বুক পাড়ের প্রায় সমতলে চলে এলে অনেকে লঞ্চ থেকে লাফ দিয়ে পাড়ে নেমে পড়েন। শীতে নদী শুকিয়ে এলে লঞ্চের তলা আটকে যেতে পারে বলে মাঝ নদীতে লঞ্চ দাঁড় করিয়ে নৌকায় করে যাত্রী ওঠা-নামা করানো হয়। এখানকার বাজারটি লঞ্চঘাটেই খানবিশেক দোকানের সমষ্টি মাত্র। দরকারী প্রায় কিছুই সেখানে মেলে না। তাই কারো ঠিকমতো বাজার করার দরকার হলে হাঁটাপথে পশ্চিমের কুচাইপট্টি অথবা উত্তরের জয়ন্তী নদী পেরিয়ে কোদালপুরের হাটে যেতে হয়। লঞ্চ চলে শঙ্করপাশা থেকে হিজলা হয়ে আনন্দবাজার-কোদালপুর-বালুচর-জালালপুর-নতুন বাজার-গরীবের চর হয়ে তারাবুনিয়া পর্যন্ত। সে লঞ্চে যাত্রী না যত ওঠে তারচেয়ে বেশি ওঠে ধান, সব্‌জি, পান বা কাঁচামরিচ।
 
ঢাকা বা নারায়ণগঞ্জ থেকে ছাড়া দক্ষিণবঙ্গগামী লঞ্চ-স্টীমারগুলোর কোন কোনটা হিজলাতে থামে। যাত্রীদের মধ্যে যাদের এই এলাকার আশেপাশের কোথাও যেতে হয় তারা হিজলা থেকে ছোট লঞ্চ ধরে গন্তব্যে যান। ঢাকা থেকে আসা পণ্যের সরবরাহও এভাবে এই দিকের ছোট বাজারগুলোতে পৌঁছে। হিজলা থেকে যে লঞ্চটা তারাবুনিয়ার দিকে যাবার জন্য সকাল দশটায় আনন্দবাজারে পৌঁছায়, বিকেল চারটায় সেটাই আবার তারাবুনিয়া থেকে হিজলার দিকে যাবার জন্য ফিরে আসে। বাড়িতে বা ক্ষেতে যতো কাজ থাকুক না কেন শিখা এই দুই সময় কোন কাজ করে না। এক দৌড়ে হালটে উঠে লঞ্চ থেকে নামা যাত্রীদের খেয়াল করে। যাত্রীদের বেশির ভাগ তার পরিচিতজন, তাই দূর থেকে দেখলেই তাঁদেরকে চেনা যায়। অচেনা কেউ নামলে ঘাট পেরিয়ে হালট ধরে কাছে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। কিছু অপরিচিত যাত্রী আবার ঘাটে নেমেই চা-নাশ্‌তা খাবার জন্য কোন খাবার দোকানে ঢুকে পড়েন, তখন শিখার ভারি রাগ হয়। শিখা তার এগারো বছর বয়স থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিদিন এই কাজ করে যাচ্ছে। তার বয়স এখন তেইশ চলছে। এই বয়সী মেয়ে লঞ্চ থেকে নামা লোক দেখার জন্য রাস্তায় ছোটার কথা না। আগে মা এটা নিয়ে বকাবকি করতেন, এখন আর কিছু বলেন না। পঁচিশ বছর বয়সী বড় বোন সুমি কখনো একটু উষ্মা প্রকাশ করে বটে তবে শিখা সেসব গায়ে মাখে না।
 
শিখাদের বাড়িটা বানানো হয়েছিল মিঠাপানের বরজ আর তার পাশের ফরিদপুরী ঝাল মরিচের দোফসলা ক্ষেত পাহারা দেবার জন্য। শ্যালো নৌকায় করে চালান হয়ে যাবার আগে পান বা কাঁচামরিচ জমিয়ে রাখা, বাছাই করার ব্যবস্থাও বাড়িটাতে আছে। ক্ষেত থেকে কাঁচামরিচ তোলা, বাছাই করা অথবা বরজে লতা নামানো, পান কাটা, বীড়া বাঁধার কাজ শিখার মা তাঁর দুই মেয়ে নিয়ে করেন। পান ও কাঁচামরিচ চাষের যাবতীয় পরিচর্যা, পানি-সার-কীটনাশক দেবার কাজটাও তারা করেন। ফসল তোলার পর ঘাটে কাশেম হাওলাদারের গদিতে খবর দিলে কয়ালের সাথে কামলারা এসে মাথায় করে কাঁচামরিচ বা পানের বোঝা নিয়ে লঞ্চে তুলে দিয়ে আসে। কত তারিখে ঠিক কী পরিমাণ মাল গেলো সে হিসাব রাখার দায়িত্ব কয়ালের তো বটেই সাথে সাথে মায়েরও। ক্রেতার সাথে মালের দরদাম ঠিক করার বা দাম আদায়পত্রের দায়িত্ব এই দুজনের না, এই দায়িত্ব ঢাকার শ্যামবাজারে থাকা শিখার বড় মামার যিনি এই বাড়ি, কাঁচামরিচ ক্ষেত আর পানের বরজের মালিক। ফসলের চারা, সার, কীটনাশক তিনিই কিনে পাঠান। দুই মাস পর পর তিনি এসে শিখাদের খোঁজ-খবর নেন, ফসলের হিসেব নেন, মা-মেয়েদের শাড়ী-কাপড়-স্যান্ডেল-তেল-সাবান-ঔষধ দেন আর কিছু নগদ টাকা দিয়ে যান। বড় মামা যে টাকা দিয়ে যান তাতে শিখাদের প্রতিদিনের অন্ন জোটার কথা না। এই সত্যটা তিনি নিজেও জানেন, তবু এরচেয়ে বেশি দিতে তিনি অপারগ। বোনকে এরচেয়ে বেশি টাকা দিলে সেটা তাঁর স্ত্রীর কানে পৌঁছাতে পারে, তখন যে প্রলয়কাণ্ড হবে সেটা তিনি ভয় পান। শিখার মা সংসার চালানোর জন্য কখনো-সখনো কুচাইপট্টি বা কোদালপুরের হাটগামীদের কাছে পান বা কাঁচামরিচ বেচে দেন সে খবর তিনি রাখেন। তবে বোনের চুরির সীমা এবং চুরির আবশ্যকতা জানা থাকায় এই ব্যাপারে তিনি উদাসীন থাকেন। বাড়ির আশেপাশে শাকসব্‌জীর চাষ, একটা মেনা গাই আর ডজনখানেক ডেগি মুরগী থাকায় শিখার মা কায়ক্লেশে সংসার চালিয়ে নিতে পারেন। চাল-ডাল-আটা-তেল-শুকনো মশলা-লবন-কেরোসিন ছাড়া খুব কম জিনিস তাদের কেনার দরকার পরে। তার মানে এই না যে বাকি অন্যসব জিনিস তাদের অফুরান আছে। আসলে বাকি অন্যসব জিনিসগুলো যে কী সেটা শিখারা অনেকদিন হয় ভুলতে বসেছে।
 
আনন্দবাজার গ্রামটা লঞ্চঘাট থেকে একটু দূরে। নদী এখানে কিছুটা ভাঙনপ্রবণ বলে সবাই একটু ভেতর দিকে বাড়ি করেন। শিখাদের বাড়িটা তাই একটু একলা পড়ে গেছে। এদিকে পানের বরজ পাহারা দেবার ঘর আরো কয়েকটা আছে, তবে সেগুলো একটু দূরে দূরে। এমন বাড়িতে দু-দুটি সোমত্ত মেয়েকে নিয়ে থাকাটা স্বস্তির ব্যাপার নয়। তবে শিখার বড় মামার শ্বশুরবাড়ি এই এলাকার প্রভাবশালী পরিবার বিধায় তাদেরকে বড় কোন ঝামেলায় পড়তে হবে না বলে আশা করা যায়। তারমানে এই না যে সুযোগের অপেক্ষায় থাকা শেয়ালের দল থাবা বসানোর চেষ্টা করে না। রাতে চালের উপর কয়েকটা ঢিল ছোঁড়া, পানের বরজের পাশে শীস্‌ বাজিয়ে চটুল গান গাওয়া, দিনের বেলা পথ চলতিতে একটু ধাক্কা দিয়ে যাওয়া, কখনো কখনো দু’একটা লাউ-কুমড়া-মুরগী হারিয়ে যাওয়া এমন আরো অনেক বিষয় আছে যেগুলোকে সাধারণ, স্বাভাবিক, নিয়মিত বলে মেনে নিতে হয়। এগুলো নিয়ে হৈচৈ, চিৎকার করার বা বিচার-সালিশ ডাকার কিছু নেই। শিখারা তাই চুপচাপ থাকে। দিনের বেলা কাজের নাম করে সাথে লম্বা বগাকাঁচি আর রাতের বেলা বিছানার পাশে খাটো হাতার দা রাখতে হয়। সেগুলো কখনো ব্যবহার করতে হয়নি, তবে তাদের উপস্থিতি অনেক ঝামেলা কমিয়ে দিয়েছে।
 
আনন্দবাজারে আসার পর প্রথম প্রথম শিখা-সুমির দিন কাটতে চাইতো না। এ কেমন জায়গা! যেখানে লাইট-ফ্যান নেই, টেলিভিশন নেই, গম্‌ গম্‌ করা দোকানপাট নেই, বাঁধানো রাস্তা নেই, গাড়ি-ঘোড়া নেই, পরিচিত মানুষজন নেই! সন্ধ্যা হতে না হতে ভূতুড়ে অন্ধকার। এমন বিরান ভূমিতে নির্বাসিত হয়ে শিখা কয়েকদিন লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছে। সুমিকেও কাঁদতে দেখা গেছে। মাও হয়তো কেঁদেছেন তবে সেটা তারা দেখতে পায়নি। সবচে বেশি মন খারাপ হয়েছে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায়। ধারেকাছে একটা হতশ্রী মাদ্রাসা আছে বটে, তবে সেটা শুধু ছেলেদের জন্য। মেয়েরাও পড়তে পারে এমন স্কুলের মধ্যে সবচে কাছেরটা কোদালপুরে। একে তো সেটা দূরের পথ, তার ওপর নদী পারাপারের হ্যাপা আছে। স্কুলের খরচ জোটানো ছাড়া প্রতিদিনকার গুদারা পার হবার খরচটাও আছে। খরচ আর পথের নিরাপত্তার কথা ভেবে মা আর এই ব্যাপারে আগাননি। স্কুলে যাওয়া নিয়ে শিখা দুয়েক দিন একটু অনুযোগ করে তারপর আর কিছু বলেনি। তবু কখনো কোন মেয়েকে বুকে চেপে বা কাঁখে বই নিয়ে যেতে দেখলে শিখার মনটা হু হু করে ওঠে। শিখার তখন আফসানার কথা মনে হয়।
 
আফসানা তার প্রিয় বান্ধবী ছিলনা, তবে তাদের সম্পর্কটা নেহাত খারাপও ছিলনা। ক্লাসে প্রথম হওয়া নিয়ে আফসানার সাথে তার একটা লড়াই ছিল। স্কুলের স্যার-আপারা সেই লড়াইতে দুজনকেই তাল দিতেন। ওরা দুজনও প্রতিযোগিতাটি উপভোগ করতো। আজ এত বছর পর আফসানা কোথায় আছে কে জানে! এতদিনে হয়তো সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। হয়তো লেখাপড়ার পাট শেষ করে, বিয়ে করে সংসার করছে। সুমির তো বটেই, শিখারও বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। এটা নিয়ে মা কয়েকবার বড় মামাকে অনুরোধ করেছিলেন কিন্তু মামা পাত্তা দেননি। সুমি-শিখার বিয়ে হয়ে গেলে প্রায় বিনে পয়সায় কামলা খাটানোর লোক যে কমে যাবে সেটা দুই পক্ষই বোঝে। সহসা বিয়ে হবার সম্ভাবনা না থাকলেও সুমি আজকাল বিয়ের কথাই বেশি ভাবে। মুখ ফুটে শিখাকে সেটা জানায়ও। শিখা জানে সুমি কেন বিয়ের জন্য উতলা হয়েছে। তারা দুজনেই জানে একমাত্র বিয়ে ছাড়া এই চারদিক খোলা জেলখানা থেকে বের হবার আর কোন উপায় নেই।
 
লেসফিতাওয়ালা তালেব আলী, ছিটকাপড়ওয়ালা রশীদ বা গাওয়াল কামরুল জানেন যে শিখারা কিছু কিনবে না। ওদের কিছু কেনার সামর্থ্য নেই। তবু যাবার পথে তাঁরা একবার হাঁক দিয়ে যান। কেউ কেউ বসে একটু জিরিয়ে যান, এক গ্লাস পানি খান। একবার কেবল তালেব আলীর কাছ থেকে দুই বোনের জন্য দুই জোড়া প্লাস্টিকের বালা আর টিনের ক্লিপ কেনা হয়েছিল। তবু তালেব আলী তাদেরকে সব জিনিস খুলে খুলে দেখান। কখনো ইচ্ছে হলে হাতের এক আঙুলের নখে একটু নেলপলিশ লাগিয়ে দেন। রশীদের কাছে কয়েকবার ব্লাউজের কাপড়ের দরদাম করা হয়েছে কেবল কিন্তু কখনো কিছু কেনা হয়নি। তবু রশীদ মায়ের সাথে বসে তার বাড়িঘরের গল্প করেন, পীর-ফকিরদের গল্প করেন। দূরের কোন এক মাজার থেকে শিরনী এনে একবার খাইয়েও ছিলেন। কামরুলের কাছে আশেপাশের পাঁচ গাঁয়ের তো বটেই দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়েও গল্প শোনা যায়। তাঁর কাছে একটা এক ব্যান্ডের রেডিও আছে। সে আসলে তার কলা, বেল, পানিফল, জাম, কাউ, ডেউয়া, চালতা, জাম্বুরা বা সফেদার কোন কিছু না কেনা হলেও কিছুক্ষণ সিনেমার গান বা বিজ্ঞাপন শোনা যায়। এই লোকগুলো তাদের মতোই হতদরিদ্র, হয়তো এজন্যই তাঁরা সহমর্মী। তাঁরা বোঝেন এই তিন নারী আসলে এখানে নির্বাসিত। তাই তাঁরা শিখাদের কাছে বাইরের পৃথিবীকে স্পর্শ করার জানালা হয়ে আসেন।
 
শিখারা তিন বেলাই ভাত খায়, কখনো গরম, কখনো পান্তা। তার সাথে ব্যঞ্জন হিসেবে থাকে বাড়ির চারপাশে ফলানো শাকসব্‌জি। বড় মামা আসলে দোকান থেকে আটা আর ডিম কেনা হয়। ঐ দুইদিন সকালে রুটি, দুপুরে ডিম-আলুর ঝোল খাওয়া হয়। বড় মামা এক-আধবার হাতে করে একটা মুরগী নিয়ে আসেন। তখন মুরগীর মাথা-গলা-পা-ডানা-গিলা-কলিজা-চামড়া খাওয়া হয়, মুরগীর রান আর বুকের মাংস বড় মামার জন্য বরাদ্দ। কোরবানীর ঈদ আসলে গ্রামের পঞ্চায়েত থেকে কেজিখানেক গরুর মাংস পাওয়া যায়। এছাড়া সারা বছর সাধারণত কোন আমিষ জোটে না। শীতকালে বুনোহাঁসের ঝাঁক নামলে অনেকে ফাঁদ পেতে বা বিষটোপ দিয়ে পাখি ধরেন। ওভাবে ফাঁদ দিয়ে সুমি একবার একটা অচেনা পাখি ধরেছিল। গরম মশলা ছাড়া রান্না করায় অচেনা পাখির মাংসে বিকট গন্ধ পাওয়া গিয়েছিল। এরপর থেকে সুমি সেই চেষ্টা আর করেনি। মেঘনার তীরে বাস করেও শিখারা ছোট-বড় কোন মাছই খায় না। অথচ সকালের দিকে লঞ্চঘাটে গেলে সস্তায় ছোট মাছ তো বটেই, লোকে খেতে চায় না এমন মাছ বিনা পয়সায়ও পাওয়া যায়। তবু শিখারা মাছ কেনে না, খায় না। যেবার জালালপুরের কাছে কেমিক্যাল বোঝাই লঞ্চ ডুবে ছোট-বড় সব মাছ মরে ভেসে উঠেছিল, সেবার সবাই ঠেলাজাল বা ওছা দিয়ে এমনকি খালি হাতে মাছ ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তখনও শিখারা সেসব মাছ ধরার কোন চেষ্টা করেনি। মাছ খাওয়া তো দূরে থাক, মাছ দেখলে তাদের তিনজনেরই তীব্র বিবমিষা হয়।
 
এখন শিখারা মাছ অপছন্দ করলেও এক কালে মাছ তাদের তিন জনেরই খুব প্রিয় ছিল। শিখার পছন্দ ছিল কৈ মাছ, সুমির ইলিশ আর মায়ের বোয়াল মাছ। মটরশুঁটি আর টমেটো দিয়ে মা চমৎকার কই মাছের মাখা মাখা ঝোল করতেন। ইলিশ মাছের ঝোল করতেন আলু-বেগুন দিয়ে আর বোয়াল মাছেরটা আলু-ফুলকপি দিয়ে। আবার সব মাছই কীভাবে যেন পেঁয়াজ-ধনেপাতা-কাঁচামরিচ দিয়ে দোপেঁয়াজা করতে পারতেন। এসব সেসময়ের কথা যখন শিখাদের বাবা কালীর বাজার থেকে তাদের পছন্দের মাছ আনতেন আর তাদের মা কপট রাগ দেখিয়ে সেসব রান্না করতেন। মায়ের রাগের কারণ বাবার বেশি পছন্দ কোন মাছ নয় বরং আলু দিয়ে দেশী মুরগীর ঝাল ঝোল। তবু বাবা তাদের পছন্দের কথা ভেবে মাছই আনতেন। আর খাবার সময় গল্প করতেন কী করে মাছওয়ালার সাথে দরাদরি করে আজ সস্তায় মাছ কিনেছেন। বাবা কাজ করতেন নিতাইগঞ্জে দীপক সাহার পাটের আড়তে। পাটচাষী, পাটের মহাজন আর মোকামগুলো থেকে পাট কিনে মিল গেটে বিক্রি করা ছিল তাঁর কাজ। ওরা ভাড়া থাকতো উত্তর মাসদাইর মাজার রোডে মিন্নত আলী হাজীর বাড়িতে। স্কুল ছিল হাঁটা দূরত্বে, পছন্দের বন্ধুবান্ধবেরাও কাছাকাছি থাকতো। বিকেলে খেলার অবারিত সুযোগ ছিল, রাত ন’টা থেকে টেলিভিশন দেখার অনুমতি ছিল।
 
শিখা যখন পঞ্চম শ্রেণীতে আরে সুমি সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে, তখন ফাল্গুন মাসের শুরুর দিকের এক সকালে মতলব-হাইমচর-নীলকমলের পাটচাষীদের দাদন দেবার জন্য বাবা নারায়ণগঞ্জ লঞ্চ টার্মিনাল থেকে হাইমচর যাবার লঞ্চ এম, ভি, বোগদাদিয়া’য় ওঠেন। ফাল্গুনে নদী অপেক্ষাকৃত শান্ত, ঝড়-বৃষ্টির ভয় নেই তাই বাবার যাত্রা নিয়ে তাদের মনে কোন শঙ্কা ছিলনা। কিন্তু এম, ভি, বোগদাদিয়া ষাটনলের কাছে পৌঁছালে কীকরে যেন সিমেন্টের ক্লিংকার বোঝাই একটা কার্গো তাকে মাঝ বরাবর ধাক্কা মেরে বসে। অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই কাঠের বডির এম, ভি, বোগদাদিয়া আর অতিরিক্ত ক্লিংকার বোঝাই কার্গো দু’টিই কয়েক মিনিটের মধ্যে মেঘনার গভীরে তলিয়ে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় হোক আর বেশি লোকের ভীড়ের কারণে হোক এম, ভি, বোগদাদিয়ার আড়াইশ যাত্রীর মধ্যে মাত্র শ’খানেক জন কোনক্রমে তীরে উঠতে পারে। বাকি দেড়শ যাত্রীর খোঁজে তাদের পরিবার-পরিজনেরা মেঘনার দুই পাড়ে ভীড় জমায়।
 
শিখার মা যখন ষাটনল পৌঁছান নারায়ণগঞ্জ থেকে আগত উদ্ধারকারী জাহাজ ‘হামজা’ আর ‘রুস্তম’ ততক্ষণে ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেছে। ষাটনলের কাছে নদীর গভীরতা অনেক। অত গভীর থেকে জাহাজ তোলা হামজা বা রুস্তমের জন্য দুরূহ। তাছাড়া উদ্ধারকারী জাহাজ দুটিই বয়সের ভারে নুব্জ। একসময় লঞ্চ তোলার আশা বাদ দিয়ে ফায়ার সার্ভিস আর নৌবাহিনীর ডুবুরী নামিয়ে লাশ তোলার চেষ্টা শুরু হয়। কিছু লাশ এর মধ্যেই ভেসে উঠ্‌ছিল। ডুবে যাওয়া দুই লঞ্চের মালিক পক্ষ তারও আগে ভাড়াটে ডুবুরী দিয়ে লাশ উদ্ধার শুরু করেছিল। শিখার মা তাঁর মেয়ে দুটোকে খালি বাড়িতে রেখে পাঁচটি দিন মেঘনার পাড়ে ছিলেন। লাশের সন্ধানে তিনি নদীর পাড় ধরে মোহনপুর, এখলাসপুর, ফরাজিকান্দি, বিষ্ণুপুর, কল্যাণপুর হয়ে চাঁদপুর পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন। ভেসে যাওয়া লাশের মাঝে স্বামীর সন্ধান না পেয়ে তিনি আবার ষাটনল ফিরে এসেছিলেন; যদি লঞ্চের কাঠামোতে আটকে থাকা লাশের মধ্যে খোঁজ পাওয়া যায় সেই আশায়, কিন্তু কোন খবরই পাওয়া যায়নি।
 
ঐ পাঁচটা দিন শিখা আর সুমি কী যে আতঙ্ক-উৎকণ্ঠা, আশা-নিরাশায় কাটিয়েছে সেটা কাউকে বোঝানো যাবে না। বাড়িওয়ালার ছেলের বউ আদর করে দুইবেলা তাদের ডেকে খাইয়েছেন। আরো কিছু প্রতিবেশী নারী-পুরুষ সান্ত্বনা আর অভয় দিয়ে গেছেন। এই সুযোগে সুমির পেছনে ঘুরঘুর করা, মাজারের চ্যাংড়া খাদেম আমীর হোসেনও সান্ত্বনা দিতে এসেছিল। সুমি ঝাঁটা হাতে তাকে, “এই জাগাত্থে যা পিছামারা! না গেলে পিছা দিয়া বাইরায়া তরে খ্যাদামু” বল্‌লে আমীর হোসেন আর দাঁড়ানোর সাহস পায়নি। পাঁচদিন পর মা দু’পায়ে হেঁটে ফিরে এলেও তার দেহে কোন প্রাণ ছিল বলে মনে হয়নি। মাকে দু’হাতে ধরার পর শিখার গলা দিয়ে একটা শব্দও বের হয়নি, মা নিঃশব্দে তার গায়ে ঢলে পড়েছিলেন।
 
বাবার জন্য শিখা আর কোনদিনই সশব্দে কাঁদেনি। উত্তর মাসদাইরের বাসা থেকে বড় মামা যেদিন তাদেরকে আনন্দবাজারের এই বিরান বাড়িটিতে এনে তুলেছিলেন সেদিন থেকে শিখা ভাবতে চায় বাবা হয়তো একদিন তাদের খুঁজতে খুঁজতে আনন্দবাজারে এসে হাজির হবেন। তাই সকাল-বিকাল ঘাটে লঞ্চ ভিড়লেই সে ছুটে যায় কারা কারা এসেছে সেটা দেখতে। তার এই ভাবনার যে কোন ভিত্তি নেই সেটা সে জানে। বাবার লাশ পাওয়া না গেলেও বাবা যে জীবিত নেই এই সত্যটাও সে বোঝে। তবু লঞ্চের সময় হলে সে ছুটে না গিয়ে পারে না।
 
পাঁচদিনেও যখন শিখার বাবার লাশ ভেসে ওঠেনি তখন চাঁদপুর থেকে ষাটনল ফেরত শিখার মা নদীর পাড়ে জমায়েত লোকদের কাছে এক বীভৎস গল্প শোনেন। লঞ্চ মালিকদের ভাড়াটে ডুবুরীরা নাকি পানির নিচে ধারালো ছুরি দিয়ে লাশের পেট কেটে নাড়িভুঁড়ি চিরে দিয়ে আসে। এতে লাশ পঁচে পেটের ভেতর গ্যাস জমতে পারে না, ফলে লাশ ফুলে ভেসে উঠতে না পেরে নদীর গভীরে তলিয়ে গিয়ে মাছের খাবার হয়। এতে লাশের সংখ্যা কম দেখানোর যায়, অনেককে আর ক্ষতিপূরণ দিতে হয় না। পাঁচদিনেও শিখার বাবার লাশ না পাবার যৌক্তিক ব্যাখ্যা এভাবে মিলে যায়।
 
নদীতে তলিয়ে যাক আর ভেসেই উঠুক, নদীতে লাশ থাকলে তা মাছের খাবার হবেই। নদীর বুকে ভাসলে তা চেলি-দাঁড়কিনা’র মতো ছোট মাছেও খায়, আর তলিয়ে নদীর গভীরে গেলে গজার-বোয়ালেরাও ছেড়ে কথা কয় না। এসব খেয়ে তেল চক্‌চকে হয়ে ওঠা মেঘনার মাছেরা যখন নিউমার্কেট-হাতিরপুল-কাওরানবাজারের মতো বড় বাজারগুলোতে ওঠে তখন মৎস্যরসিকেরা চড়া দামে সেসব মাছ কিনে নেন। নিজেরা খান, বন্ধু-বান্ধবদের ডেকে খাওয়ান, আয়েশ করে পাঁচজনের কাছে মাছের পেটি-মুড়োর গল্প করেন। মেঘনার সেই মাছ শিখা-সুমি বা তাদের মা কী করে মুখে তুলবেন!



লেখক পরিচিতি:
ষষ্ঠ পাণ্ডব
গল্পকার। অনুবাদক। প্রাবন্ধিক
ঢাকায় থাকেন।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. দুঃখের গল্প, বেদনার গল্প। আবহমানের গল্প। অচেনা নয়, তবুও পাঠক এ গল্পের সঙ্গী হয়ে গল্পের সাথে এগিয়ে চলেন। অত্যন্ত সহজ ভঙ্গীতে চলতে চলতে গল্পটি যখন শেষ হয়, গল্পের শিরোনাম তখন গল্পকে ছাড়িয়ে পাঠকের জীবনে ঢুকে এসেছে, অধিকার করে নিয়েছে তাকে।

    উত্তরমুছুন