ওই জামগাছটা পর্যন্তই আপনার।
ঋত্বিকের তর্জনী একলপ্তে উনিশ একর জমি নাড়ায়।
গাঙ্গুলি দেখছে, পার্থেনিয়াম ঝোপ, তাতে গোছা গোছা সাদা নির্দোষ ফুল, তার তলায় একদার সুফলাং মৌজা; নামতে নামতে কিছুটা বোহাল, ফুস্ করে উঠেই কিছুটা কানালি, কিছুটা বাইদ, তারপর হাত-পা ছড়িয়ে পুরুলিয়া যতটা সমতল হয় সমতল, তারপরই লতাড়িবিতাড়ি ডাংডহর। ডুংরি।
ঋত্বিকের তর্জনী একলপ্তে উনিশ একর জমি নাড়ায়।
গাঙ্গুলি দেখছে, পার্থেনিয়াম ঝোপ, তাতে গোছা গোছা সাদা নির্দোষ ফুল, তার তলায় একদার সুফলাং মৌজা; নামতে নামতে কিছুটা বোহাল, ফুস্ করে উঠেই কিছুটা কানালি, কিছুটা বাইদ, তারপর হাত-পা ছড়িয়ে পুরুলিয়া যতটা সমতল হয় সমতল, তারপরই লতাড়িবিতাড়ি ডাংডহর। ডুংরি।
ঋত্বিকের হাতে ধরা কাগজে গাঙ্গুলির পিতৃপুরুষ-প্রদত্ত খিল রাজপাট; তাতেই কতকালের বাতাস, এমন ঢেউ খেলে যায় হরিৎক্ষেত্র, হলুদ ধানে নুয়ে পড়া মাঠকে মাঠ মা লক্ষ্মীর আটং, ম্যুঠ ডেনি-বিড়া....
গাঙ্গুলির অক্ষর ঋত্বিক পড়ে নিয়েছে :
---দাদা, এখন আর সবার দ্বারা চাষ হবে না। কৃষি ব্যাপারটা এখন ইন্ডাস্ট্রি।
পৌষের ধিকিধিকি-আলো ঋত্বিকের মুখে।
---খুব খরচ সাপেক্ষ ব্যাপার-স্যাপার চাষবাস। বহুত ইনভেস্ট করতে হয়। সুপার শ্যামলী ধানবীজ ১৫০ টাকা কিলো। ৮০ টাকা স্বর্ণ। তারপর সার কীটনাশক...খড়ের দাম ধরুন পাবেন না... বছর বছর দামের গ্রাফ চড়ছে সার বীজের।
---চাষা বীজ আবার কবে কিনেছে?
--- ভুলে যান সে জমানা। ঘরের বীজে চাষ হয় না এখন।
শহুরেবাবু কি একটা কোম্পানি খুলে ছ-বিঘের জমিতে সরসে লাগিয়ে চাষ শেখাচ্ছে চাষার ব্যাটা গাঙ্গুলিকে! গাঙ্গুলি চেষ্টা করেও লুকোতে পারছে না বিরক্তি।
---এতকাল চাষবাস কিচ্ছু হয়নি তবে? এখনই প্রথম চাষ হচ্ছে?
---একরকম তাই ধরে নিন।
কী কনফিডেন্স ঋত্বিকের শরীরে। এদিকে তখন গাঙ্গুলির কপালে লাঙ্গল চলছে, শুকনো মাটিতে দড়দড়ে ফালের দাগ, জল খুঁজছে রুখামাটি। তিরিশ বছরেই যুগ বদলে গেল, তা বলে এত?
---শনির দশা চলে তিরিশ বছর।
ঋত্বিক অর্থপূর্ণ চোখে গণ্ডাখানেক আংটিশুদ্ধু গাঙ্গুলির হাত দ্যাখে।
---দাদা, আপনারা লাঙল চালাতেন?
---বামুনে হালের বোঁটা ধরেনা। নিষিদ্ধ। অনাবৃষ্টি হয়।
---তাহলে আপনারা মধ্যসত্ত্বভোগী।
ঠিক যৌবনে পা দিয়ে সফলতা, যাকে বলে চাকরি পাওয়া, বাবা যেটা মনেপ্রাণে চাইছিলেন, পেয়ে, ক্রমশ ক্রমশ সব গেঁয়োরা যেমন গাঁ-কে ভুলতে ভুলতে শহুরে হয়ে যায়, গাঙ্গুলিও; কুলগাছটি আর কুয়োতলাটি, এরকম জীবন টানতে তার বাপেরও ঘোরতর আপত্তি : চাষেবাসে বাঁচতে পারা মুশকিল ব্যাটা। কেউ চায় না চাষার জীবন। খড়েবড়ের জীবন থেকে শুকনো টাকা ভালো; গাঁয়ের মুক্ত বাতাসের চেয়ে শহরের ধুলোবালি ভালো; যথাবিহিত শ্বশুরের ভিটের থেকে কোয়াটার ভালো; চাষের চালের চেয়ে মিনিকিট ভালো। বৌ প্রাকটিক্যালি ৫০০ দিনও শ্বশুরের ভিটেয় থাকেনি, ছেলের এসবে ইন্টারেস্ট নেই---তাহলে এসব জামগাছ মনে থাকে? সুপার শ্যামলী, স্বর্ণ-ফর্ণ বোঝে? যদিও বুঝতো, বামফ্রন্টের বর্গা অপারেশন; লাফিয়ে ওঠা মজুরি, টিএমসির কৃষিবিহীন রাজ্যশাসন; একশো দিনের নারেগা, উচ্চমূল্য ধানবীজ-সার-কীটনাশক, মাঝখানে বাবার দেহত্যাগ, হেনতেনো সমূহ কারণ সক্রিয় থাকলে আর মধ্যসত্ত্বভোগী জমিদার হওয়া যায়? জমি মাটি হয়ে ঘাস বিয়োচ্ছে। ঋত্বিকের আবির্ভাবে, আগ্রহে ও চাপে কত বছর পর জমিতে দাঁড়িয়ে গাঙ্গুলি বুঝছে, শহর কৃষিতে মজেছে। লে করা বর্গা সিপিএম! কর কৃষক সমিতি! কর খেতমজুর আন্দোলন না লড়াই কি একটা? জমিই থাকবে না চাষার হাতে!
জ্বলন্ত বিড়ি দাঁতে চেপে ঋত্বিক কাগজে, চোখ বুলিয়ে বললো, বাঁ দিকে পরপর চারটে ক্ষেত, ওই বড়ো আলটা, ব্যাস, আপনার রাজ্যের শেষ সীমা। মাঠে হাঁটার দরুণ গাঙ্গুলির প্যান্টে বিজবিজে চোরকাঁটা। ঋত্বিক হাপপ্যান্ট, বারমুন্ডা না কি বলে পরেছে, জানতো বুঝি চোরকাঁটার দৌরাত্ম্য? ক বছরেই গাঙ্গুলি এত শহুরে? জমির ছলাকলা প্রেম পিরিতি সওব ভুলে মেরে দিয়েছে!
একটিমাত্র ন্যাড়া পলাশ গাছ, গাঙ্গুলির স্মৃতি বলছে, সেদিনও ছিল, ঠিক পাশটিতেই এখন; নিচে পড়ে থাকতো ঝরা ফুল , তাহাতেই দোল। ফাগুন-চৈত মানেই পাতায় পাতায় ফুলে ফুলে বসন্ত, তার ইংরাজি নাম পক্স। পক্স হোত তখন খুব। তারও কপালে দুটো পক্সজনিত গর্ত, গাঙ্গুলি সে গর্তে আঙুল দিয়ে স্মৃতি হাতড়ায়।
পাখপাখুড়িবিহীন পৃথিবীর আকাশে এখন পড়ন্ত দ্বিপ্রহর; বাতাস-তাড়ানো হিলমিলে সূর্য, এখনই মুশমুশে ঠাণ্ডা, ঠিক মাঝখানে নির্ভীক ফড়িং, সাপব্যাঙমশাজংলীজানোয়ারখিদে ও খিদের সুরাহা করতে করতে ২০২১-এ এসে পৌঁছনো ভারতবর্ষ। তার চতুর্দিকে ব্যারিকেড, কৃষি ও মুনাফা, প্লটকে প্লট জমি।
---বুঝলে ঋত্বিক...
আলপথ ধরে পা ফেলে এগিয়ে যায় গাঙ্গুলি। পেছনে ঋত্বিকের চলনে ট্রাকটার।
গাঙ্গুলির তখন অনেক ধুঁধলা নজর; অনেক কাদামাটিখামারমরাইআঁউড়িবাঁউড়ি, অনেক আলপনা উলুধ্বনি শাঁখে ফুঁ, ধানের ধুুুুলোয় রুখা হাওয়া তার চতুর্দিকে।
---এই জমিটা থেকেই ম্যুঠ উঠতো... মা জলভর্তি ঘটি নিয়ে দরজায়, পেছনে সারি সারি লক্ষ্মীর পা, তারপর বেতাহাসা হুলুধ্বনি, শাঁখ...লক্ষ্মী ঝুমুর ঝুমুর ঘরে ঢুকতো।
বাতাস-পাওয়া ঝরাপাতার মতো লাট খেয়ে খেয়ে উড়ে চলে গাঙ্গুলি।
---গাঙুলিদা-আ-আ, ধুর মাইরি! সাপখোপের জায়গা, একা ফেলে দৌড়বেন না!
একদা মাঠময় ঘুরে বেড়ানোর প্রাকৃত অভিজ্ঞতা জেগে উঠছে গাঙ্গুলির। মুসমুস পা ফ্যালে। মানুষ ছাড়া আর কোনো জীব পৃথিবীতে থাকতে পারবে না জানান দিয়ে, স্টেপে স্টেপে গঙ্গাফড়িং ঝাঁপায়।
---সাপকে দুশমন ভাবছো কেন?
--- খল বলেই তো জানি।
---খল, মানুষ।
সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে গাঙ্গুলি, পেছনে সাপুই বাতাস,
---আমাদের ঘরে সাপ চরে বেড়াতো। ধনকুঁদরা সাআপ। চালপুড়া ধানপুড়া মরাইয়ে হামারে-এ...
গাঙ্গুলি থামবে কী করে? যত দৌড়য়, জামগাছটাও যে ততই এগোয়, মাঝখানে ঝরে ঝরে পড়ে অনন্ত ছায়ার মতো সিপিয়া ও ফ্যাকাশে বালকবেলা। দুদস্যি যৌবন। এখন না হয় হিংস্র সিংহের ঠোঁটেমুখে মাছি, তবুও তো সিংহই! কেশর ঝাঁকিয়ে গাঙ্গুলি ভাবছে, অত দুদস্যি বাল্যকাল ছিল!? ছিল ? ছিল? দুদস্যি যৌবন? তাহার?
যেমন রোজ পাখপাখালি, পাড়াপড়োশি, চায়ের দোকান, মদভাটি, কয়লা খাদান, গৃহিণী সূর্য ওঠার আগেই দিন নামায়, মেঘ ছিঁড়ে যেমন ফুড়ুৎ করে চাঁদনি বসে উঠোনে, তদ্রূপ এক একটি দিসব ও রজনী; এপাশে ওসিপি ওপাশে ওসিপি মধ্যিখানে ওভার বার্ডেনের ঢিপি, তার ওপর টাঙানো আশমান, তার ওপর ঢলঢল ধোঁয়া, তার ওপর ছোপ ছোপ মেঘ, সন্ধেবেলায় গাছপালাকে পাত্তা না দিয়ে চাঁদ বাঁকা চায়, তারারা মিটিমিটি, জাঁকিয়ে অন্ধকার বসে ডানা গুটিয়ে, ননিয়া নদী এইসময় একটু হড়হড়ায়, দুএকটা শিয়াল ডাকে, লোকাল ট্রেন আশমানের কিনারা দিয়ে লাইন দাবড়ায়, সকালের রোদ হামায়, দুপুরে রোদ রোদ্দুর হয়, ঝড়বাদলে আকাশটা টাঙানো ত্রিপলের মতো কাঁপে---এমন একটি ল্যান্ডস্ক্যাপে গাঙ্গুলির তিরিশ বছরের বসবাস, কে জানত যুুগসন্ধিক্ষণ? মাটিকে জানাতে আবির্ভাব হবে যুগবতারের?
সে এক সকালবেলা, গাঙ্গুলির কানে আসে, কেউ যেন, গলাটি অচেনা, বলছে, অখিলবাবুর বাসা কোনটা?
কলোনির কোনো শালা জানে না, গাঙ্গুলির নাম অখিল।
আগন্তুক ভদ্রলোকটি বৌ- এর পিছুপিছু এসে, নাম বললো, ঋত্বিক, একেবারে আনকোরা বলে নমস্কারও জানায়। সেই ঋত্বিকের প্রথম পদার্পণ।
---আপনাদের কলোনিটা খুব সুন্দর। কত পাখি!
গাঙ্গুলি ট্যারা চোখে তাকায়, তার ভূগোলকে কেউ সুন্দর বললে, সন্দেহ হবেনা?
---ব্যাস?
মানিব্যাগে টাকাপয়সার ভেতর থেকে এক টুকরো কাগজ বার করে গাঙ্গুলিকে দেয়; তাহাতে লেখা : '...লোকটি সৎ
--- ইতি প্রণত
ভাইপো অসীম'
কত বছরের জানাশোনা উভয়ের?
---কত গাছপালার ভিড়! কত পাখি!
--- মাতাল? কয়লা পোড়ার ধোঁয়া? খিস্তি-গালিগুফতা, নজরে পড়েনি?
---ধোঁয়া নিয়েই আবহমন্ডল। কোথাও ধোঁয়া বেশি কোথাও ধোঁয়া কমের তারতম্যে পৃথিবীর হাওয়া বাতাস। পৃথিবীর আবর্তনের সাথে...
গাঙ্গুলির চোখেমুখে সন্দেহজনক রেখাসমূহ। ঋত্বিক সম্ভ্রমে পাণ্ডিত্য থামায়,
---ভদ্রলোকরাও খিস্তি দেয়। খারাপ জিনিসের ভেতরে বাস করে খারাপ জিনিসকে ডিসলাইক করতে করতে ভদ্রলোকের মতো থাকে।
---আর কিছু বলবেন?
বড়ো ভারি কিছু বলে ফেললো বুঝি। ঋত্বিক বিড়ি ধরায়।
---ধরাচ্ছি?
ধোঁয়া মুখরিত সোনামুখে যতটা গাম্ভীর্য আঁটে, ততোধিক নিয়ে ঋত্বিকনাম্নী যুবকটি ব্যাগের অনেক কাগজ হাটকে একটা কাগজ বের করে মেলে ধরলো পাতা তক্তায়, তাতে 'এন' উপরে, তাতে 'এস' নিচে, সারা মাঝে জ্যামিতিক ফিগার। তর্জনী ছুঁইয়ে মার্ক করে একটিতে,
---এইটা আপনাদের পুকুর।
পুকুর!
আয়তাকার জ্যামিতির ওপর ফড়ফড় করে পাড় ভর্তি অর্জুন গাছ, হাওয়ায় পাতার কাঁপন, শুনছে গাঙ্গুলি। পাড়ের কাশফুলে দোলা, জলে শুকনো পাতা তিরিবিরি, ছোটো ছোটো মাছ খেলছে, বেতাহাসা হাওয়ায় থিরকূলহারা মেঠো খেপলুট বাতাস; দেখছে গাঙ্গুলি। ঘরের মধ্যেই গাঙ্গুলির চুল ওড়ে, ঘোলাটে জলে আরো ঘোলাটে তার ছায়া ঢেউয়ে ঢেউয়ে এপাড়-ওপাড়। ডুব সাঁতারে প্রৌঢ় গাঙ্গুলি হাঁপ ছাড়ে যুবক গাঙ্গুলির মতো নাক ফুলিয়ে।
---এর নিচেই আপনার উনিশ একর। এক লপ্তে। এই যে দেখুন...
ঋত্বিক আঙুলের নখ ডোবায় ম্যাপে, তার নখে মাটি। গাঙ্গুলিও পুকুর থেকে মাঠে ঢোকে :
জাবট ক্ষেতে জল ছিটিয়ে কাদা করছে বলদ।
টুপটুপ আফর পোঁতে একদল কামিন।
বাতাস কেমন ঢেউ খেলে যায় এমন অনন্ত অসীম হরিৎক্ষেত্র।
সোনায় ঢাকা ভরভরন্ত প্লটের পর প্লট।
ঝমরঝমর পাকা ধানের ঘুঙুর।
পথে পথে গরুর গাড়ির চাকার দাগ।
মিহি ধুলোয় ক্ষেতের আলে নতুন আঁট।
পৌষের চালগুঁড়ি করছে মা ঢেঁকিতে।
ঠাকুমা ধান সেদ্ধ করছে তিনমুখো উনুনে।
বাবার হাতে বেগুন চারায় নরম রোমশ কাঁটা।
ভেজা ফ্রকে কলসিকাঁখের দিদি ।
ধানের গোলার মতো পৃথিবী অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশে বাঁধা।
প্রৌঢ় গাঙ্গুলি মুঁ-বাড়িয়ে মাটি ও মাটির আশ্চর্য সত্য দেখছে, ফ্রেমেবন্দী সিপিয়া সিপিয়া তাহার বালকবেলা ও যৌবন।
---ছ বিঘা, প্লটটা কিনলাম দাদা। আপনার জমির পাশেই।
---অ?
---তিরিশ করে দর নিল। রেজেস্ট্রি খরচা মিলে ধরুন...
---তিরিশ! হাজার?
ঋত্বিক ঘাড় দুমড়ায়।
ছোটো বোনের বিয়েতে, সে চল্লিশ বছর হবে, আগে, গাঙ্গুলি তখনো বেকার, বোহাল জমি, বাবা কতদিন জমিটার দুঃখে খাবার খেতো না, ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকতো নিদ্রাহীন অন্ধকারে, বিচতে হল। পাক্কা এক বিঘা, দর উঠেছিল মাত্র চার হাজার, বাবা প্রায় পায়ে পড়ে ৫০০ টাকা ভিক্ষে চেয়েছিল। গ্রহীতা দুঃখ করছিল, দ্যুট্ তুমি রেট বাড়ালে ঠাকুর!
কাঁদাকাটার দাম দিয়েছিল সে-ব্যাটা মাত্র ২০০ টাকা।
---দামটা একটু বেশি হল না ?
---কাঠা না দাদা, বিঘা।
---গ্রামে কাঠা দিয়ে জমি বিক্রি হয় না।
৫০৯৬০০০০০ স্কয়ের কিলোমিটার ভূখণ্ডে ঋত্বিকের নিজ অধিকারে, সদ্য-ক্রিত জমি সহ শিয়ালডাঙা আসানসোল মিলিয়ে মাত্র ছ বিঘা দেড় কাঠার আশমান, তলাটা সরকারের, যদি খনিজগর্ভা হয় সে মাটি। উনিশ একর জ্যোৎস্নারোদ্দুর,ঝড়জলবৃষ্টিবাদলা ঘাসপাত পোকামাকড় ধুলোবালিছাইয়ের ভূস্বামীর মুখোমুখি বসে ঋত্বিক অনুভব করে, মাটিই স্থাবর, জীবিত কিম্বা মৃতের।
---চাষ করবে?
---ইচ্ছে তো তাই।
---করেছো কখনো, আগে?
--- সরসে লাগিয়েছি। আপনার জমিটা পেলেই পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দেব।
---পাঁচিল ঘিরে বাগানবাড়ি হয়। ফসল আলোবাতাস খোঁজে।
---বড় উৎপাত দাদা। ছাগল গরু... মানুষ...
---চাষ কি কেবল চাষারই? ইঁদুর বাঁদর হাঁস পাখপাখুড়ি ভাটভিখিরি সবার। সবাইকে দিয়েথুয়ে চাষার। চাষা চাষ করে সবার জন্য।
---উৎপাদনের পুরোটা ঘরে তুলতে না পারলে লস খেতে হবে যে দাদা! গাছিতে গাছিতে ইনভেস্ট।
---তাই!
---কোন খাবারটি মানুষ খাবে ঠিক করে দেবে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি। চাষ হবে সেই মোতাবেক।
ঋত্বিক উত্তেজিত, আপনি কি জানেন, ভারতে ৪২০০০ রকমের ধান ছিল? দশ হাজার বছর ধরে কৃষক বুনো ধানকে ধীরে ধীরে চাষযোগ্য করে তুলেছিল? কোন শালা মনসেন্টো ফুৎকারে উড়িয়ে দিলো, যাঃ, ভ্যানিস করে দিলুম তোর দশ হাজার বছরের জ্ঞান, হয়?একবার যদি কৃষক তার জানা বীজ হারিয়ে ফেলে তা হলেই সে কোম্পানির দাস হয়ে গেল। আমি দাসত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে জমি চাইছি।
মাস্টারদা, ক্ষুদিরাম বসু, নেতাজির পাশে ঋত্বিককের ছবি জ্বলজ্বল করছে গাঙ্গুলি ইতিহাস পাতায় দেখছে।
---আমাকে জমি দিন দাদা।
---ওইটুকু জমি দিয়ে কী যুদ্ধ হবে?
---বীজ তো বুনি।
---জলশেচের কি ব্যবস্থা করবে? পুরুলিয়া রুক্ষ। বৃষ্টিপাত কিন্তু কম। ধরে নাও পড়েই না।
---কেন দাদা, পুকুরটা। পাম্প করে জল তুলে নেব।
---পুকুরটি কিন্তু আমার একার নয়। অনেক ভাগিদার।
---আপনার ভাগের জল তো নিতে পারি।
---পুকুরের জল তো আর জমি নয়, আমার ভাগটা নেবে? জল সামাজিক সম্পত্তি। যে পুঁটি মাছটি ভাগে পায়, সে-ই আপত্তি করবে বেশি। বলবে, মাছ মরে যাবে। তারপর তো গাঁয়ের আপত্তি আসবেই। চান করবে কোথায়? কাড়াগরু ধোয়াবে কোথায়? চাষের জল তুমি পাবে না।
---তাহলে কুয়ো খুঁড়বো। স্যালো...
---জল পাবে?
---পুকুরের নিচে, জল পাবো না? পাবোই।
---পাবে না। পুরুলিয়ার জমি বিষয়ে তুমি অজ্ঞ। আমার কুয়োয় ধর সমদম জল, ঠিক পাশেই তোমার, একবুঁদ জল পাবে না। তলায় পাথর চাটান। ঠিক মতো হাল চলেনা, চাষ! কি ভাবছো, ওখানে আখরোট পেস্তা ফলাবে? কিচ্ছু হবেনা।
---দাদা, আধুনিক চাষে মাটি কোনো ফ্যাক্টার নয়। চাইলে সব কিছু ফলানো যাবে।
---ত ফলাও। হলেই ভালো।
---সরসে চাষ করবো। তিল চাষ করবো।
---কোদো কুদরুং লাগাও, জল লাগেনা।
---ঋত্বিক দীর্ঘশ্বাস ফ্যালে, একা সোয়াবিন তেল সরসে তিল বাদাম সবাইকে খেয়ে দিয়েছে। আমাদের পুরনো রীতিতে ফিরে যেতে হবে।
---বেশ।
গাঙ্গুলি রোমান্টিক যুবকটির পরত পরত স্বপ্ন পড়ে; কোদালে-কোদালে চোখ, তাতে সরসেখেত পেরেনো হলুদের হলুদ। ঋত্বিক সন্দেহ নিয়ে মেলে ধরা কাগজটির দিকে চেয়ে,
---দাদা?
--- বলছি, এখুনি জমি কিনে পুঁজি ফাঁসাবে কেন? বিক্রি করতে চাইলেও কিন্তু ক্রেতা পাবেনা পরে। এমনিই চাষ কর। দাও কাগজ, লিখে দিচ্ছি। লিজে নাও। এক দু বছর চাষ করে দেখো...
---আমি দাদা জমি দেখিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে লোন নেবো। ট্রাক্টার কিনবো। স্যালো বসাবো...
--- এক দু বছর চাষ করে দেখো। পারবে কিনা।
কখন বউ এসে দাঁড়িয়েছে। তার চোখে পূর্বাপর সব কথার ঝিকিমিকি।
---পারবে না কেন? বলে, চেষ্টায় পাথর ক্ষয়ে যায়! উনি পারবেন।
সরাসরি ঋত্বিককেই বললো, বলুন তো, ভাইয়ের জিম্মায় চাষ হয়? যেটুকু হয় ওরাই খায়। চাইতে গেলে বলবে, এবছর ধান হয় নি। আমি গিয়ে বললাম, আমার জমি খিল থাক, চাষের দরকার নেই!
ইশারায় গাঙ্গুলিকে জানালো, খদ্দের পেয়েছ, নিংড়ে নাও।
মনোবিকার অথবা কামনায় টৈটুম্বুর স্ত্রীজাতীয় একটি মাংসপিন্ড গাঙ্গুলির সম্মুখে ভার্টিক্যাল। পিচ্ছিল সে চূড়ায় ওঠা অসম্ভব জেনেও গাঙ্গুলি আরোহী,
---পৈতৃক সম্পত্তি কি ভাই মেরে দিতে পারে?
---ভাইকেই মেরে দিতে পারে, জমি তো জড় পদার্থ।
দ্বিপাক্ষিক মন্ত্রণাসভায় বউ ইতিমধ্যে কতবার এল-গেল, জল দেবার অছিলায়, চা দিতে, আরো কিছু লাগবে কিনা ভদ্রতায়, সৌজন্যে। অছিলা ছাড়াই এখন দরজায়। গাঙ্গুলি সাদরে আহ্বান করে, এসো, বসো। বসেই শোনো, কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে? দাঁড়ালো না গৃহিণী, গাঙ্গুলি যে চাইছে না তাকে, লহমায় বুঝে, চলে গেল বিরক্তি উড়িয়ে।
দরজার ওপারে নিশ্চিত কান পেতে পঁয়ত্রিশ বছরের পুরোনো গৃহিণী, গাঙ্গুলি জানে অবজ্ঞার মানে; ইভলিবার্টি না জেনেও ইভটির ইভবোধ কত উঁচু, জানে; সকালকে দুপুর-করে উঠে যাওয়া ঋত্বিককে, খেতে পর্যন্ত বললো না, সে হিন্দু ঘরণী। অপমানে উত্তেজনায় গৃহিণী বহুদিন পর কাঁদবে। কাঁদলো।
মেয়েমানুষ সন্তুষ্ট হয়, বলতে পারতো যৌক্তিক অযৌক্তিক কত কিছু দাম্পত্যের প্রোটোকলে, গাঙ্গুলি কিন্তু নীরব। বড়ো বড়ো বাদুলেচোখে দেখে গেল স্বামীবিজিতা জয় মানে সবসময় জয় নয়।
কতো বড়ো চাষী, হাতেনাতে প্রমাণ দিতে গাঙ্গুলিকে বিঘে খানেক সরসে ক্ষেতের মাথায় টেনে আনলোই ঋত্বিক, তার পরদিনই।
চারদিকে রুক্ষ মাঠের মাঝে বিঘা পাঁচেক জমিতে সরসের হলুদ। দোল দোল দোলুনি সরসে ক্ষেতের দিকে বড়ো মনোরম দৃষ্টির ঋত্বিক, নিজের সন্তানের দিকে মা-বাপ ওই দৃষ্টিতে তাকায়। সে-ই হলুদ রিবন বেঁধে দিয়েছে প্রতিটি ফুলের চুলে, উড়ন্ত সেই হলুদের দিকে তাকিয়ে ঋত্বিক বললো, ভ্যান গখের মতো লাগছে না দাদা?
---ভারতে প্রতি বারো মিনিটে একজন করে কৃষক মরছে নাকি?
---স্বাধীনতার পর থেকেই কৃষক মরছে। এখন রেটটা বেড়েছে।
---এদ্দিনে তো কৃষকশূন্য হয়ে যাওয়ার কথা তাহলে? গাঙ্গুলি ঋত্বিকের চোখে চোখ রাখে :
---তোমার পালা কখন?
---মানে?
---ওই মরার। তুমিও তো কৃষক।
হো হো করে হাসলো ঋত্বিক, প্রকৃত কৃষক মরে না, মারে। কৃষি এখন প্রফিটেবল ইনভেস্টমেন্ট।
---তাহলে তোমাকে জমি দেব কেন? নিজে করব।
ঋত্বিক থম্ মেরে গেল, ভালো তো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ১৯০০০ রকমের ধান ছিল বেঙ্গলে, জানেন? হারিয়ে গেল। আমার মিশন সেই হারিয়ে যাওয়া ধানের চাষ করে ফিরিয়ে আনা।
---আমাদের বাড়িতে ধান চাষ হতো দু-প্রকারের; খাবার জন্য কলমকাঠি, বেচবার জন্য আশ্বিনলয়া, মালতু, রঘুশাল। ঠাকুর সেবার জন্য বিঘে দশেক জমিতে চাষ হতো গোবিন্দভোগ, বাদশাভোগ। ছোটো ছোটো চাল। ঢেঁকিতে ভানার সময়ই ম-ম করতো তার গন্ধ।
---এখনকার ধানগাছগুলো তো গর্ভবতী হবার জন্যই জন্মেছে। তারা যে সৌন্দর্য ছিল, তারা যে প্রজাতি ছিল, তাদের মে বৈচিত্র্য ছিল---আমাদের ভুলিয়ে দিয়েছে। আমি তো বাদশাভোগ গোবিন্দভোগ ধানেরই চাষ করবো। বিদেশে এক্সপোর্ট হবে। খুব ডিমান্ড ইয়োরোপ আমেরিকায়। পুরো ফার্মিংটা হবে বায়ো টেকনোলজিতে। হেক্সিন থাকলে ইয়োরোপ নেবে না।
ভারতীয় হাসি হেসে ঋত্বিক বললো, পৃথিবীতে কীভাবে বাঁচতে হবে ওরা জানে। সুস্থ, নিছক বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে ৪.৭৫ ডলার খরচ করতে হবে। থার্ড ওয়ার্ল্ডের জন্য 'হু'-এর হিসাব, মিনিমাম ১.৯০ ডলার খরচ, প্রতিদিন।
---মাত্র? এমন কিছু বেশি না।
---এক ডলার মানে জানেন?
---এটুকু খরচ করতে না পারলে বেঁচে থাকার দরকার নেই। ভূভার একটু কম হওয়াও দরকার।
---মানুষকে বাঁচাবার দায়িত্ব তো কাকেও নিতে হবে দাদা?
---তুমি তো বিদেশের মানুষের কথা চিন্তা করছো? নিজের বাজার উপচে উঠলে তবে ত রপ্তানি? নাকি দেশকে উপোষি রেখে টাকা কামাবে?
---ফরেন মানি তো শেষে দেশেরই সেবায় লাগবে।
গাঙ্গুলির কাঁধে পটপট মাথা গজাচ্ছে, উপচে ওঠা মেধার ধারা নতুন নতুন গজিয়ে ওঠা মাথায় গদগদ করে পড়ছে।
টুপির নিচে হাস্যময় মুখ-ওলা কার একটা ছবির মতো ঋত্বিক, ছবিটা অনেক ছেলেমেয়ের গেঞ্জিতে দেখেছে গাঙ্গুলি, সিনেমার গরম কোনো হিরোর হবে, জানেনা; সেদিন দেখলো, সিপিএম ওই ছবিটির ঝান্ডা নিয়ে বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক করলো, ---এমন হিরো কে, যাকে বিজেপি টিএমসি পর্যন্ত সহ্য করে? গাঙ্গুলি কেন, কত কত বিদ্বান বুদ্ধিজীবীও ভালো করেই জানে, মার্কসবাদে বেশি উপকৃত ধনতন্ত্র; গাঙ্গুলি তো চিন্তা ছাড়াই দিব্যি বেঁচে কাটিয়ে দিলো সাড়ে ছ'টি দশক ধনতন্ত্রে-সমাজতন্ত্রে।
ঋত্বিকের চবনায় কাটতে অবসর-না-পাওয়া শহুরে লোকের দাড়ি, মুখময় শীত-রোদ্দুরের প্রলেপ, জ্যাকেটটায় চিমটি দিলে ময়লা বেরবে, সবকিছুই গভীর গভীরতর চিন্তাপ্রসূত বিপ্লবী ঔদাসীন্য। বিপ্লব বলে কিছু কি রেখেছে সিপিএম চৌত্রিশ বছরের লাগাতার প্রচেষ্টায়? তবুও ঋত্বিক, বিপ্লবের বার্তা ঝাড়ে, কিসের ধান্দায়?---গাঙ্গুলি হ্যান্ডসাম বিপ্লবীটিকে ঠিকঠাক গ্রহণ করতে পারছে না।
---আমাদের বড়ো শত্রু, এই মুহূর্তে, স্যুডো হারবাল প্রোডাক্ট। কেমিক্যালকে হারবাল দিয়ে পর্যূদস্ত করতে হবে দাদা।
আবার বাতেলা! গাঙ্গুলি তাচ্ছিল্য আর লুকলো না :
---এইটুকু জমির সরসেতে কত লোককে হারবাল তেল খাওয়াবে?
---একটা অঞ্চল। একটা ব্লক। একটা জেলা।... এটা একটা বিপ্লব দাদা। বিপ্লব ছোটো স্পেস দিয়ে করতে হবে। ভাবুন তো, একটা ছোট্ট সরসে দানার ভেতর কত্ত হলুদ!
দেশের গৌরবময় ইতিহাস-জানা লোকের মুখ যেমন হয়, ঋত্বিক স্মৃতিপীড়িত :
ভাবতে পারেন, ভারত এক সময় তেলবীজ উৎপাদনে এক নম্বর ছিল ওয়ার্ল্ডে? রেপসিড সোয়া তেল সব গড়বড় করে দিল। তিল সরসে সূর্যমুখী বাদাম মার্কেট পেলনা। ক্যাশ নেক্সাসই হল বুর্জোয়া সমাজের একমাত্র নেক্সাস।
হঠাৎ গাঙ্গুলির হাত ধরে ঋত্বিক, দাদা, আপনার তো পুঁজি আছে, জমি আছে; আসুন, আপনিও বিপ্লবে সামীল হোন।
--- অত নৃশংস হতে বলোনা।
---মানবজাতি নৃশংস?
---নৃশংসতাই মানবজাতির ইতিহাস।
হঠাৎ, হঠাৎই, কেন যে গাঙ্গুলি উত্তেজিত,
---তোমার রং ছ বিঘেতে আঁটছে না?
---আমি আদিগন্ত রং ছড়িয়ে দিতে চাই দাদা!
---ত, এশিয়ান পেইন্টসের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করো।কতটা বিপ্লব করে বসে আছে ঋত্বিক, গাঙ্গুলি জানবে কীকরে, প্রথম সাক্ষাতে? যা রং ছড়ানোর সে ছড়িয়েছে। এমন আন্ডেল লোক দুচারজন এলে যাত্রাপার্টির সব নারীচরিত্রে ফিমেল আনা যাবে, লাইটিং হবে চিৎপুরিয়া অপেরার মতো, গাঁয়ের লোক কিন্তু মহাখুশি। ঋত্বিকও সন্ধ্যেবেলায় যাত্রাপার্টির সঙ্গে আড্ডা মারে। অভিনয়ের আগ্রহ দেখায়। হুবহু ঋত্বিক ঘটকের মদ খাওয়া স্টাইলে সংলাপ বলে। শেষ হলে বাকবদ্ধরা পটপট হাততালি মারে, ঋত্বিক নগদ ৫০০ টাকার একটি নোট দিল, চাঁদা। পাঁচ শো-ও-ও! যাত্রা পার্টি খচখচাং রসিদ কাটলো। মনে হল, এই প্রথম যাত্রাপাটির রসিদে ৫০০ টাকা কাটা হল। সেক্রেটারি খুব যত্ন নিয়ে ঋত্বিকের নামটি লিখে ৫০০-টায় দুতিন বার কলম ঘসে।
সকলে উদীয়মান জমিদারকে দ্যাখে। ঋত্বিককে বলল, তুমি যাও, দেখা কর অখিলদার সঙ্গে। আসানসোলেই থাকে। ওনার জমিগুলো বছর বছর জল খাচ্ছে, দিয়ে দেবেন। হাঁই লাও অ্যাড্রেশ, রসিদটার উল্টো পিঠে লিখে দিল, কালিপাহাড়ি এজেন্ট অফিস কলোনি।
ত, সেই ঋত্বিক, গাঙ্গুলির কোয়াটারে, প্রথম, সেই যুগসন্ধিক্ষণে; খানিক বসে চায়ে লম্বা চুমুক দিয়ে একটি আঃ ছাড়লো।
---বুদতাল্লেন, চাষে আনন্দ আর অর্থ দুটিই আছে।
---তোমার কোনটি, আনন্দ না অর্থ?
---মানব কল্যাণে দুটিই চাই।
এক পোঁয়ে সমস্ত চা-টা শেষ করে বলল,
---আপনাদের গ্রামটি কিন্তু ভালো।
---খোঁজ পেলে কি করে সকল-দেশের-রাণির?
---আপনার গ্রাম আমাকে কিন্তু সরল করে দিচ্ছে স্যার!
ঋত্বিক যাত্রার রিহারসেলে যায়, সুতা পার করা বিড়ি টেনে মন্দিরের দেয়ালে নেভায়, বাবলা দাঁতনে দাঁত মাজে, দল বেঁধে মাঠে হাগতে হাগতে ভারতবর্ষ সহ পৃথিবী নামায়।
ঋত্বিকও জানে, এটিও পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ নামক একটি পৃথিবীর দেশ, এটিও গ্লোবাল ভিলেজ। ছেলেরা রস্কিঝোলা হাপ প্যান্ট পরছে, বারমুন্ডা, মেয়েরা লেগিস, বউরা ব্রেসিয়ারের উপর নাইটি পরে আধুনিকতা মারায়। শিমুল ফুটেছে আগের মতোই লালে, পলাশ ফুটেছে অমনি থোকা থোকা। পাখি, যতটা শুনতে চাইছে ঋত্বিক, শোনে তার চেয়ে কমই কাকলী। বাতাস হালকা হালকা মোটা। নদীর মরা জলে গেঁড়িগুগলি কম, পুকুরে আমেরিকান রুই তড়বড় বাড়ে। কাতলা মৃগেলের বাড় কম। ছোটো আঁটির খড় বলে ঘরের চালে অ্যাসবেশটাস। প্রধানমন্ত্রির হয়ে গরিবের পাকা ঘর বানিয়ে দিচ্ছে টিএমসির গ্রাম পঞ্চায়েত। জলখাবার হয় ম্যাগি দিয়ে। মেশিন ফড়ফড় মুড়ি ভাজে। প্যাকেটে ভুট্টাখই আসে কোম্পানির নামসাঁটা পলিপ্যাকে। এ গাঁ-ও জানে মমতা ব্যানার্জিই একমাত্র বাংলার গর্ব। সিপিএমের বিপ্লব দীর্ঘজীবী। কংগ্রেস বলে কোনো দল ইতিহাসে ছিল। মোদিই একমাত্র আচ্ছে-দিন আনেওলা।
---মমতার চেয়ে মোদি, ততোধিক ফ্যাসিস্ট ছিল সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। ফ্যাসিস্ট কাহাকে বলে রিহার্সাল বন্ধ রেখে শোনে সর্বজন।
কর্পোরেট প্রথমে সংস্কৃতিকেই বদলায়।
যে কোনো প্রগতিশীল ভাবনাকে দেশদ্রোহী আখ্যা দেয়।
নদীগুলো এলোমেলো করে দিয়ে সর্বনাশের পথটি পাকা করে দিয়ে গেছে সবুজবিপ্লব।
নরসিমা রাওয়ের মুক্ত বাজার অর্থনীতির কফিনে মোদি শেষ পেরেকটি মারছেন।
প্রতিদিন ২০০০ কৃষক কৃষিকাজ ছেড়ে দিয়ে শ্রমিক হচ্ছে।
কৃষক আত্মহত্যায় ভারত প্রথম।
প্রতিদিন দশটা ফুটবল ময়দানের সম পরিমাণ বনভূমি উজাড় হচ্ছে।
ভুখা মানুষের পেটে ভাত দেবার নাম করে শিল্পায়িত কৃষি আমাদের মাটি জীববৈচিত্র্য পরিবেশ নষ্ট করছে।
শিল্প-মডেল-কৃষি হাজার বছরের অর্জিত কৃষকের জ্ঞানকে লুপ্ত করছে।
তিনটি কৃষিআইন-বিরোধী আন্দোলন আসলে কর্পোরেট ও কর্পোরেটের দোসরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম।
পার্লামেন্ট বাদ দিয়ে মোদি সবকিছু বিক্রি করে দিচ্ছে কর্পোরেটের কাছে।
সবচেয়ে ক্যামিকেল প্রোডাক্টগুলোই এখন বিশুদ্ধ হারবাল ...
যদি, এসব, সত্যি বলে থাকে ঋত্বিক, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল। শূন্য মাঠে একাই খেলছে--- গাঙ্গুলির মুখে চোখে অস্বস্তির হিজিবিজি। ঋত্বিক থামে।
---আপনি বিশ্বাস করছেন না?
অবিশ্বাস্য বলে মরজগতে কিছু হয় না।
গাঙ্গুলিও কিছু কম কর্পোরেট নয়, তারও রাষ্ট্রের মদত লাগে, মার্ক্স-ল্যাস্কি-কেইনস-গান্ধি লাগে, মমতামোদিকংগ্রেসসিপিএম পর্যন্ত লাগে।
চাকরি থাকতে থাকতেই, গিন্নি সুদে টাকা ধার দিতো মহল্লায়। গান গেয়ে তরী বেয়ে ততোদিনে যতটা পেরেছে সোনার ধানে ভরিয়ে দিয়েছে ছোটো সে-তরী, এখন দাঁড়েপালে নৌবহর; গাঙ্গুলি সাগরে ফেলেছে মধুকর, তাহার ঝান্ডায় দেশপ্রেম। মাফিয়া, ইসিএল অফিসার, সেন্ট্রাল-পুলিশ, রাজু, কালে সিং, লাখো লাখো টাকার লুটমারির সঙ্গে যে জনতার জিন্দেগিতে রিস্তা নাই--এইসব প্রকৃত জনগণ ও স্বদেশ এবং দেশসেবার উৎকৃষ্ট উপাদান গাঙ্গুলির। এমন লোকেশনে জানালায় জ্যোৎস্না, সমুন্নত দুটি ভয়ানক উঁকি দিচ্ছে, কোলিয়ারির পরিভাষায় যাকে বলে ওভারবার্ডেন। তার আড়াল থেকে কোনোমতে চাঁদের উঁকিঝুঁকি।
অমন চাঁদেড়ু রাতেও কিন্তু স্বামিস্ত্রী কখনো পরস্পরের শ্রোতা হল না, আত্মার আত্মীয়ও না---যৌনমিলন ছাড়া দাম্পত্যে সব মিলনই বৃথা জেনে জেনে জেনে পঁয়ত্রিশ বছর অতিবাহিত! যাবতীয় অতীত ও পাস্টকে লাগাতার মর্টারে-মাইনে ধ্বংস করে, স্বামীকে অপদার্থ প্রমাণে গরিয়সী পত্নী মা সারদার মতো পা ছড়িয়ে এখন নিশ্চিন্তে পালঙ্কে, পারদর্শিনী ফুঁসে ওঠে এইবার:
---তুমি জীবনে শোচেবুঝে একটা কাজও করলে? কোনোদিন?
বিবাহ বড়ো অনৈতিক ও অশ্লীল প্রেমবন্ধন, বিবাহের পর থেকেই গাঙ্গুলি জানে, এবং প্রতিদিন ভোলে। গৃহিণী অপরিমিত গাঢ়তা ঢেলে বলে, জমিগুলো বেচেই দাও। নগদ টাকাটা সুদে খাটলে অমন কত জমি হবে, হবেনা? একটা ফ্লাট কিনে নেবো, বুড়ো বয়সে একটু সুখে থাকবো!
---কেন, এখানে অসুখটাই বা কোথায়?
---মনে কর, আমাদের কোয়ার্টারটা যদি ধসে, তলায় তো কিছু নেই, ফপরা, ধসবেই, কোথাও না কোথাও ধসছে তো। দুজনই তো চাপা পড়ব। ধর, সবাই মরে গেল, ধর, আমরা দুজন না মরে বেঁচে গেলাম, এমন ত ঘটে কখনো!
---ঘটে। হাত-পা খোড়া হয়ে বেঁচে গেলাম, হতেই পারে।
শিউরে ওঠে গা-গতরে মিসেস। বৌ গাঙ্গুলিকে ছুঁলো গভীরভাবে, পরম চক্রান্তের ফিসফিসানি : দুজনে একসঙ্গে মরা যায় না?
---যায়। বিষ খেয়ে, রেলে মাথা দিয়ে, দড়িতে...
---আত্মহত্যা মহাপাপ।
---লোকে তাও আত্মহত্যা করে।
---পাপ কাজে আমি নাই।
---বল, তোমার সাহস নাই। পাপ,অপরাধ, ধর্ম, দুষ্কর্ম দেশভেদে পৃথক। স্বতঃসিদ্ধ পাপ বলে কিছু হয় না। স্বতঃসিদ্ধ জনসেবা বলেও কিছু হয় না।
---তা ছাড়া মরবই কেন?
বেঁচে থাকার বিজ্ঞাপনসম্মত যাবতীয় উপকরণের কেন্দ্রে তারা ধার্মিক, আপাতত পাপ অদৃষ্টপূর্ব, তাদের মৃত্যু ছাড়া সব আছে পাইবার। অমন মানব জমিনে মৃত্যু-অধিক চাষ দেখেছে দম্পতি।
গাঙ্গুলি কবিতা পড়লে বলতো, জীবনের প্রচুর-টচুর ভাঁড়ার শূন্য করে চলে যাবো।
এমনই ব্রাহ্মক্ষণে বউকে আর পায় কে! কতযুগ পরে, শ্বশুরের সিমেট্রিতে, ঠেলেগুঁজে পাঠালো : বেচে দাও। বেচে দাও!
বেচতে এসেছে গাঙ্গুলি।
ঋত্বিক নির্দেশিত সীমান্তের দিকে চেয়ে গাঙ্গুলির মনে হল সীমানা এক অলৌকিক ধারণা। মালিকানা ততোধিক। পৃথিবীকে এভাবে বিভক্ত করা যায়?
পড়ে আসা আলো জমির অনন্তে, যেন সমস্ত জমির মালিক এখন গাঙুলিই, এমন একটা বনেদি পায়ের দাপে বহুত লম্বা পা ফ্যালে, মাথায় মেঘমুকুট, আশমানী চন্দ্রাতপ, কতদূর পর্যন্ত ফিকে হতে থাকা ছায়া, হাওয়া ও রোদ্র কম্পমান।
ঋত্বিক বিড়িটা ফেলে দিয়ে ততক্ষণে গাঙুলির কাছে,
---ও দাদা, আর একটু এগোন। প্লট দাগ নং খতিয়ান অনুসারে আরও একটু বেশিই আপনার। জামগাছটা আপনার সীমানার শেষ।
যতদূর গাছ পেছবে, ততদূরই মানুষের টেরিটরি, গাঙ্গুলি কি জানে না? এই মাঠটা একদা অরণ্য ছিল, তার অবশেষ ধরেই তো গাঙ্গুলি এগোচ্ছে। জামগাছটা এগোতে থাকলে গাঙ্গুলি থামবে কি করে?
---আর একটু...
---এই জমিতে আমার বাপঠাকুর্দা চৌদ্দ পুরুষের পায়ের দাগ। প্রণাম্য।
গাঙ্গুলি বুকে মাথায় হাত ঠেকায়। ঋত্বিকও প্রণাম করে দেখাদেখি, মাটিতে মাথা নামিয়ে প্রকৃতপ্রস্তাবে প্রণতি জানায় মাটিকে।
---জানেন, বেদে মাটিকে বলেছে মৃত্যুহীন। নিরন্তর দুগ্ধবতী গাভী।
জঙ্গলেঘাসেপাতেপাথরেবৃক্ষে বিগ্রহ, যেমন ভগবতীর লোমে লোমে শালগ্রামশিলা। সমাপতনই বটে, ঋত্বিক আবিষ্কার করে প্রায় ক্ষয়ে যাওয়া একটি পায়ের ছাপ; বুড়ো আঙুল পায়ের স্বাভাবিক সীমা ছাড়িয়েছড়িয়ে, একটু অতিমানবিক। গাঙুলির ঘরের দেয়ালেও এমনি বুড়ো আঙুল বের হওয়া জোড়া পায়ের আলতা ছাপ, কাচেবাঁধাই। ঋত্বিক অসীম কৌতুহল-জাগানো অযথা জিজ্ঞাসায় জেনেছিল, তিনি গাঙ্গুলির স্বর্গত পিতৃদেব। ক্ষয়াটে পদচিহ্ন একটু নিবিড় পরীক্ষণে, ঋত্বিক, প্রকৃতপ্রস্তাবে গাঙ্গুলিকে কনভিন্স করতেই বললো, আপনার বাবারই পদচিহ্ন।
বিশেষজ্ঞের হাসি তার ঠোঁটে,
---সম্ভবত সব সিমেট্রিগুলোই জীবিতের ইচ্ছানির্মাণ, নিজেই নিজের সমাধি নির্মাণ করছে, কেমন আশ্চর্য না? পায়ের ছাপ তাহলে বেঁচে থাকতেই দিয়ে দেওয়া ভালো, সেই ত দিতেই হয়। মরা পায়ের ছাপ জ্যান্ত পায়ের মতো ওঠেনা, যতই আলতা ঢালুন। একটু অ্যাবস্ট্রাক্ট অ্যাবস্ট্রাক্ট হয়।
---পিতৃপিতামহরা কেবল পদচিহ্নটুকুই রেখে যায়। গাঙ্গুলি যথাবিহিত গম্ভীর এবং চিন্তাশীল :
---আমাদের কাজ তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করা।
--- প্রগতি পূর্বসূরিদের অস্বীকার করে। পদাঙ্ক ছাড়িয়ে যেতে হয়। গান্ধিজির পদাঙ্কে কংগ্রেস চলে নি, লেনিনের পদাঙ্কে স্টালিন, মাওয়ের পদাঙ্কে চিন। ঋত্বিক আরো উদাহরণ টানতো হয়তো, গাঙ্গুলির মন নেই, পড়ে আছে, ততক্ষণে, পদচিহ্নে।
---বাবার চরণ একটু ক্ষুদ্র ছিল। অবশ্য পদচিহ্ন সর্বদাই বৃহৎ।
---ক্ষুদ্র থেকে বৃহতে উত্তরণ। ঋত্বিক ফুক্ করে হাসে : পা বলতেই জানেন, এক শালা বামনের বাত মনে পড়ে।
---বলি রাজার গপ্পো তো?
---শালা ত্রিপাদ জমি চেয়ে সবটা মেরে দিল! পৃথিবী অন্তরীক্ষ সমুদ্র...
বিড়ি ধরায় ঋত্বিক। বামনের তৃতীয় পা-টিই আমাদের উত্তরাধিকার।
---ভালই ত।
---ওই তৃতীয় পা-টাই ডেঞ্জারাস। জীবজগতে ত্রিপদ জীব নাই। ত্রিপদ আর পদহীন জীবরাই খল। দুষ্টু।
---একপদীরাও ডেঞ্জারাস।
---একপদী প্রাণী হয় না।
---হয়। মানুষ একপদী প্রাণী। পদ কথাটায় নজর দ্যান। ধরুন দিল্লিতে কৃষক আন্দোলন চলছে। সেখানেও ওই তিনটি পদক্ষেপ। তিনটি ছোট পরমং পদম্। মধুসন্দ্যী। ওই ক্ষুদ্র 'তিন' ত্রিংশ সহস্রাধিক আকৃতি নেবে আকাশ পৃথিবী সমুদ্র জুড়ে। কোনো লুলুপুতু না দাদা, সিধা ট্রাকটার নিয়ে দিল্লি।
---দিল্লিতেই চাষ করবে নাকি? গাঙ্গুলি খবর পড়া শোনা দেখা ছেড়ে দিয়েছে বহুকাল। ত, তিনটি পা...
---কর্পোরেট কর্পোরেট কর্পোরেট।
রোদেলু বাতাসে জ্ঞান ও দেশচর্চা গাঙ্গুলির ভালই লাগছিলো। সেইসময়, প্রায়শই যা ঘটে, তার পেছনের অহেতুক কিন্তু অনিবার্য অলৌকিক জন্মসূত্রে প্রাপ্ত হ্যলোটি জাগ্রত হয়, উড়তে ইচ্ছে হয়, তার তো জন্মসূত্রেই একজোড়া পাখা আছে পিঠে :
---জানো, আমাদের বংশের আদিপুরুষ কিন্তু আকাশে উড়ে বেড়াতেন। সিদ্ধ পুরুষ....
---আপনার বংশ লৌকিক। উড়ানই আমাদের শিক্ষাক্রম। উড়ানই আমাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা।
গাঙ্গুলি না চড়লেও লৌকিক-ঋত্বিক বহুবার পুষ্পকরথে উড়েছে। পৃথিবীকে মুঠোবৎ দেখতে চাইলে দিব্যদৃষ্টিবিহনে আকাশমার্গই একমাত্র মার্গ।
দুপুরে, খেতে খেতে ঋত্বিক, বললো, আপনার সেই আদিপুরুষের উড়ে বেড়ানোর গল্পটা...
গাঙ্গুলি টং করে উঠলো, কে বলল, গল্প? যদি গল্প হয়, জমিগুলোও তবে গল্প! ওগুলো এলো কোত্থেকে? গাঙ্গুলি হাতের গ্রাস থালায় ফ্যালে। থালায় অলৌকিক আলো।
--- যে কোনো জমিই ইতিহাস, পুরাণ। দুটো আলের মাঝখানে এক একটি অষ্টাদশ দিবসের বিচিত্র বিচিত্র যুদ্ধ আছে।...আমাদের বংশের আদিপুরুষ, দীনমনি আচার্য, যোগসিদ্ধ; প্রতিদিন আকাশে উড়ে নিত্যপূজার পদ্মফুল আনতেন ছাতনার রাজপুকুর থেকে।...
ঋত্বিক অমনোযোগী দেখে গাঙ্গুলি হারিয়ে ফেলছে গল্প বলার তেজ,
---থাক। তুমি বিশ্বাস করবে না।
---অবিশ্বাস্য বলে কিছু নেই। বলুন।
গাঙ্গুলি মুখে ভাত তোলে, বিশ্বাস দেবার জন্যই বললো,
---গাঁয়ের মাথায় ভাঙা একটা দালান আছে, এখন অবশ্য মাটি-লেভেল, ওটাই পঞ্চমুণ্ডির আসন, দীনমনির যোগাসন। ওখান থেকে ছাতনা পর্যন্ত আমাদের টেরিটরি।
---দেখতে হবে তো।
---আগে শোনো।
বংশগৌরবগাথা পিতৃপিতামহ পরম্পরায় গাঙ্গুলি কতবার শুনেছে, কতবার বলেছে, তৎসম শব্দগুচ্ছ কোনখানে হ্যলোর ফোকাস মারে, সেটিও তার বংশগতভাবেই রপ্ত :
--- রাজা বললেন,...
প্রাসাদের প্রতিধ্বনি রাজকীয় গাঙ্গুলির কন্ঠে, ঋত্বিকের মনে হল কোনো ঐতিহাসিক যাত্রাপালার অনুকরণ।
---হে দেবোপম সাধক, অনুগ্রহ করে দর্শন দেন। জটাজুটধারী এক দিব্যপুরুষ তখন আকাশপটে ফুটে উঠেছে; বিশালকায়, এক দিগন্ত থেকে অপর দিগন্তে বিস্তৃত তাঁর পা। সেই পায়ের নিচে যুক্তকর রাজা, কম্পমান ওষ্ঠ, চক্ষু বিষ্ফারিত।
---অনুগ্রহপূর্বক মাটিতে পদস্থাপন করুন প্রভু, যথাযোগ্য উপাচারে বন্দনা করি।
---একটি পদ আমার যোগাসনে, অপরটি পদ্মপত্রে। অপরের অধিকারে আমি পদস্থাপন করি না। এক আকাশে সৃষ্ট কন্ঠস্বর মিলিয়ে গেল আরেক আকাশে, যেমন বিচ্ছুরণের পরও গুমগুম করে বজ্রধ্বনি।
---দুই পদের মধ্যবর্তী ভূখণ্ড আপনারই প্রভু, আপনি পদস্থাপন করুন।
তারপর...
---তাঁর, সেই পা জোড়ার, আলতা ছাপ রাখেন নি? কোনো স্মৃতিচিহ্ন?
--- আমরাই দীনমণির জ্বাজল্যমান সিমেট্রি। পদচিহ্ন। আমার উনিশ একর কি চিহ্ন নয়?
---তা বটে! আফগানিস্তান থেকে ব্রহ্মদেশ পর্যন্তই ভারতবর্ষ। ইতিহাসে চিহ্ন আছে।
---অধুনা বাংলাদেশও তো ভারতবর্ষই?
ঋত্বিক ভাত খেতে ভোলেনি এবং খাচ্ছে না, কেবল ভাবছে, ভারতবর্ষ এমন একটি মন্দিরের গর্ভগৃহ, জাগ্রত বেদীটি আছে, বিগ্রহটি নেই। রামকৃষ্ণের পুত্রপৌত্রাদি থাকলে কী তারাও এক একটি অখিলচন্দ্র গাঙ্গুলি হোতো? মুখ তো তাহার ঈশ্বরের চেয়েও বেশি। হাতের সংখ্যা তো অগণনন, কেবল ওড়াওড়ির পাগুলোই নেই!
ভরা পেটে ঋত্বিক বিড়ি ধরায় সরসে ক্ষেতের মাঝে, হলুদ জমিতে ধোঁয়ার নকশা। পৌষের পড়ন্ত রোদ্দুর হাঁপায়। ছ বিঘের হলুদে ডুবে যেতে যেতে গাঙ্গুলি ফুস ফুস নিঃশ্বাস নেয় । ১৯৬২-তে mass hunger and starvation বাঁচার দাওয়াই দিয়েছিল ১২০ বছরের মধ্যে ৮ গুণ বাড়াতে হবে কৃষি উৎপাদন। আমাদের দেশ নাকি ১০ গুণ বাড়িয়েছে। জন্ম নিয়ন্ত্রণও হয়ে গেছে। গাঙ্গুলিরা দশ ভাইবোন।... গাঙ্গুলি ভেবেছিল জন্ম নিয়ন্ত্রণ বিধি যখন টো-টো মেনেছে দেশ, কৃষি উৎপাদনও নিশ্চিত আট গুণ বাড়িয়েছে! কোথায় কি? সন্দেহ নিয়ে গাঙ্গুলি তাকায় ঋত্বিকের দিকে :
---সরসে তো বুঝলাম, তেল বানাবে কোথায়?
গাঙ্গুলির মনে পড়ে গেল, ঝাঁটিপাহাড়িতে মিল আছে। রক্ষিতদের। শিবদুর্গার ছবি সাঁটা তেলটিন,পেছনে দুদস্যি হিমালয়। শিবশঙ্কর ওয়েল মিল।
---আমরা ঘানিতে পিষে সরষের তেল দেব, দেশি। পরীক্ষা প্রার্থনীয় তেল।
---লোকাল, ন্যাশন্যাল, কত কত তেলমিল---ইঞ্জিন, ফরচুন, ধারা... তারপর ধর, রামদেব বাবার হিন্দু তেল... সবগুলোই তো কাচ্চি ঘানি!
মিটিমিটি হাসে ঋত্বিক।
---দীনমণি অয়েল নাম দিলে আপত্তি করবেন?
---তা পারো, মানুষ ধর্মপ্রাণ, নেবে। বিজেপি ধর্ম প্রতিষ্ঠায় নেমেছে, সুবিধা পাবে।...
---আজকাল আর নিরুপদ্রবে সমাজসেবারও স্কোপ নাই।
---যথার্থ বলেছো। সিপিএমও পঁদে লাগবে, টিএমসিও পঁদে লাগবে। বিজেপি যদি আসে, পঁদ বলে কিছু রাখবেই না, খাল করে দেবে।
ঋত্বিকের মিটিমিটি হাসি উজালা হয়,
---এ তো ব্রিটিশ পিরিয়ড না, জাহাজ ভিড়ালেন আর উপনিবেশ শুরু?
---গাঁয়ের লোকদের ত হাত করেছ ভালোই, আদানি-আম্বানি স্টাইলে।
---আমার মিশন ওদের মিশন পৃথক, আমার প্রতিপক্ষ।
গাঙ্গুলি কি জবাব দিতো গাঙ্গুলিই জানে, ঋত্বিকের জানার দরকারটাই বা কি? ঋত্বিক এখন প্রফেট, ঋষিতুল্য মনীষায় বলে, চাষ না করে জমি ফেলে রাখা মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়া। তারচে বেচে দেওয়াই পুন্যের।... আপনার জমি অচষা পড়ে থাকতে পারেনা, থাকবে না। কর্পোরেট আইন বানিয়ে বিক্রি করতে বাধ্য করবে। তারচে...
একাদিক্রমে পঁয়ত্রিশ বছর বিছানায়-ঘরে-বাতচিতে জানপহচানের অর্ধাঙ্গিনীও, ঋত্বিক বিদায় নিলে সেদিন থেকেই, একই কথা বলেছে : নিজে চাষ যদি না করবে, বেচে দেওয়াটাও পুন্যের, বুঝলে?
গাঙ্গুলি জিজ্ঞাসা করেছিল, ধর, আমি যদি চাষ করতে গাঁয়ে চলে যাই, এদিকের কারবার, কে সামাল দেবে?
---আমি। আমি সামলে নেব।
---সেই ত...
---কে শুরু করেছিল? আমিই তো? শেষটাও আমিই টানবো।
হঠাৎ যোগ্যতা প্রমাণে গৃহিণী জ্বাজল্য উদাহরণে :
ইন্দিরা গান্ধি পারেনি? বোরখা পরে, ঘোমটা খুলে মমতা পারছে না?... মেয়েরা সব পারে!
গৃহিণী আর কোনো মহামায়ার নাম জানেনা, বাঙালি শেখ হাসিনা পর্যন্ত তার অজানা, থ্যাচার বন্দরনায়েক বেনজির সুকি তো সাংঘাতিক নাম! গাঙ্গুলি বলতে গিয়ে থেমে গেল, স্ত্রীর হাতে বেশি মারনাস্ত্র দিতে নাই।
---বুদতাল্লে... জয়ধ্বনি আকাশ আর পৃথিবীতে যতক্ষণ ফড়ফড় করে, ততক্ষণই পুরুষের পৌরুষ। শুধু শুতে জানলেই পুরুষ হয় না! গর্ভবতী কীটপতঙ্গও করতে জানে। বাৎস্যায়নের আগে থেকেই করতে জানে। পর্নো না দেখেও করতে জানে। এখন তো পুরুষেরই দরকার নেই!
পঁয়ত্রিশ বছরের নিবিড় তুমুল দাম্পত্য, গোপনে-গহনে-বিজনে-নির্জনে ক্ষয়ে গেছে, ঋত্বিক তো কেবল ইন্ধন; যেমন আল ভেঙে যায় হড়পা বানে, বালি যেমন সরে যায় নদী থেকে নদীতেই, গেরিলা কায়দায় যেমন আক্রান্ত হয় নিজভূম, মনোলিথিক-তৃণভূম প্রেইরি যেমন করে মনোলিথিক-গমভূমি হয়ে যায়, গৃহিণীও গৃহিণী থেকে সরে গিয়ে কেবল দাম্পত্যের জলাভূমি, পিচ্ছিল কর্দমাক্ত স্যাঁতস্যাতে। একটি সাক্ষাৎকার, মাত্র একটি সাক্ষাৎকারেই আগুনে-শিখা নেচে উঠছে? ওহো অগ্নি!
---দেশে দৈনিক ডিমের দরকার প্রায় এক কোটি। বেঙ্গলে ডিম উৎপাদন হয় মাত্র কিছু লক্ষ। মিড-ডে মিলে ডিম লাগে প্রচুর, স্কোপটা নেবে না? হাঁস পালন কর। সামান্য জায়গায় খুব লাভ। খরচ কম। ডেথ রেট কম। ওদের ইম্যুনিটি পাওয়ার বেশি। যতগুলো হাঁস পুষবে ততগুলোই ডিম, পুরুষ হাঁস রাখার দরকার নেই।
প্রকৃত বিপ্লবীর তেজে গৃহিণী তখনই ফিউরিয়াস, এখন, তলোয়ারাধিক তীক্ষ্ণ; এ্যাটমাধিক বিষ্ফোরক। তার এখন কোনো পুরুষের দরকার নেই।
ঋত্বিকও জানতে চেয়েছিল,
---হাঁস চরতে, মানে, আপনাদের ওই পুঁটি মাছের ভাগিদার আপত্তি করবে না নিশ্চয়ই?
---করতেও পারে। হাঁস ছোটমাছ খায়।
---ক্যাম্বেল হাঁসে জল লাগেনা। লাগলেও সামান্য। গৃহিণীও হাঁস পালন লিখলো কোথায়, কবে, কখন?
--- আমরা ছাগল পালনও করতে পারি। ভালো জাতের বীজে দিশি পাঁঠা। লাভে লাভ!
---এক বছরেই আট ন কেজি।
---ভারত ক্যাটেলে ফাস্ট। ঋত্বিক দেশের গর্বে গর্বিত। আমরা ডেয়ারি করতে পারি...
গাঙ্গুলির কান বুঁজে এসেছিল তখন থেকে 'আমরা' 'আমরা' শুনে। এত বহুবচনের, এত প্ররোচনার সেও অংশীদার? অত ভালো ভালো সুমহান আদর্শ কপচালে ছায়ার মতোন বেড়ে ওঠে সন্দেহ।
যেটুকু মন স্থির ছিল, নড়বড়ে হয়ে গেল গাঙ্গুলির, সে-রাতেই ফোনে বললো,
---ঋত্বিক, কটা দিন সময় দাও। বাপের সম্পত্তি বিকবো বললে বেচা যায় না এত জলদি, আবেগ পিতৃস্মৃতি বাল্যকাল বহুকিছু বিক্রি করতে হবে তো?
---বেশি সময় নেবেন না দাদা। সামনের মরসুমেই নেমে পড়তে চাই।
গৃহিণী সব শুনেছে, ঝনাৎ করে বেজে ওঠে : ভারি পিতৃস্মৃতি! অত ভাবলে কখনোও জমিজমা লেনদেন হতো না! রেজেস্ট্রি অফিস উঠে যেতো,বুঝলে?
প্রায় আসবাবশূন্য ঘরে দৈববাণীতুল্য গৃহিণীর কন্ঠস্বর, তুমি রাজি! কালই ওকে আসতে বলো!
ছায়াআবছায়া ঘরের দেয়ালে ঋত্বিকের ক্রমবর্ধমান পায়ের নিচে সরু ফিতের মতো কাঁপছে এক-মাঠ হলুদ রিবন, হলুদে হলুদে বালিকার উচ্ছ্বসে শাড়ি উড়িয়ে গৃহিণীও, পেছনে তার উড়ানের ধুলো, ঝরাপাতা, পাথরের চেয়ে প্রাচীন ইচ্ছা। মাটি, নারী, হলুদ উড়ে যাচ্ছে, উড়ানের হাওয়া গাঙ্গুলির চোখেমুখেচুলে, পোশাকেও, ঘরটাও লি লি করে কাঁপছে ...
পরের সন্ধ্যায় ঋত্বিক আবার ফোন করলে আবার কাঁপন, আবার ঝড় আবার ওড়াওড়ি, তচনছে ঘরবার।
---কী দাদা, স্মৃতির পীড়া কাটলো? ওসব রোগ নিরাময়হীন, জানেন তো, কাটে না। পীড়া নিয়েই সব করতে হবে।... বুঝলেন দাদা, আজ না হোক, একদিন তো ভূমিতেই ফিরতে হবে, মানুষ তো আর টাকা খাবেনা। এখন মানুষ জমিতে ইটভাটা করবে, সেই গাছই লাগাবে যা দ্রুত লগ্নি ফিরিয়ে দেয়, ইঁট আর ধোঁয়াই তো সভ্যতা। এর বিপরীতে আমি একটা যুদ্ধ রেখে যেতে চাই।...যুদ্ধ তো একা হয় না, কত কত সৈনিক, অশ্বারোহী গজারোহী, পদাতিক...যদিও ইতিহাসে নায়ক, তো নায়ক আপনিই হোন, আমি পদাতিক সৈনিক...
মাথার উপর দিয়ে অনেক সন্ধ্যার কাক, আকাশের চেয়ে বড়ো রাত নামছে মেঘের তলায়। তার নিচে ঋত্বিকের সুভাষণ, গাঙ্গুলি চিৎকার করে ওঠে,
--- জমি একা কোনো মানুষেরই নয় ঋত্বিক, জমি মানবজাতির। জমি জীবজগতের। তাতে ঘাস হবে, বৃক্ষ হবে, গুল্ম হবে,শষ্য হবে...
---আমি, আমরাও তো জীবকুলেরই অংশ দাদা?
গাঙ্গুলি এবার স্পষ্ট বলে, না, ঋত্বিক, আমি জমি বিক্রি করতে পারবো না। ঠিক হবেনা। জমিগুলো বিক্রি করে দিলে বাপ বলে যে কিছু একটা ছিল ভুলে যাব!
পরদিন সক্কালেই ঋত্বিক গাঙ্গুলির বসার ঘরে, একমুখ জল মুছতে মুছতে গাঙ্গুলি ঢোকে আর এত রঙিন শাড়ি, গাঙ্গুলি দেখে নি তো আগে, শাড়িরগৃহিণী, সরে গেল। ঋত্বিক খালি কাপ নামিয়ে লম্বা দৃষ্টি ফ্যালে :
---তাহলে আমার তেল পোড়ানোটাই বেকার গেল দাদা!
আসা যাওয়ায় দু লিটার।
গাঙ্গুলি দু-শ টাকার নোট বাড়ায়, লাও ডেমারেজ। তেলের কিমত।
ঋত্বিকও রাগ দেখায়,
---আপনি না দেন, আরও কেউ দেবে। অর্থাৎ জমি।
আজকাল চাষবাসে কারও ইন্টারেস্ট নেই, উড়া খই কিষ্টায় নমঃ করে জমি একবার বেচে দিতে পারলে সকলেই বাঁচে!
---জিন্দেগিতে চাষ না করে তুমি যদি চাষা হতে পার, আমি পারবোনা? আমি নিজেই চাষ করবো নিজের জমি।
---করুন তবে!
দিগন্তরেখার ঘেরে তখন আকাশ, তার-ওপারে নির্লিপ্ত নিস্তব্ধ মহাকাশ, তাতে তেজঃপুঞ্জ, তাতে হাওয়ামেঘবিদ্যুৎবৃষ্টি, লক্ষ লক্ষ বছর ধরে হয়ে ওঠা মাটিতে কৃষকের ঘর্মাক্ত সাত-রং, সত্তর-ফসল; পৃথিবীং যচ্ছ, পৃথিবীং দৃংহ, পৃথিবীং মা হিংসী; তার ওপর দিয়ে ঢেউএ ঢেউএ খেলে যাওয়া বাতাস। এতো বাতাস এখনো আছে পৃথিবীতে? ছিল? কোথায়?
ঋত্বিকের স্টার্ট দেওয়া বাইকের পাশে গৃহিণী, চলে যাওয়ার আওয়াজ মিলিয়ে যেতে পদশব্দে ঘর জাগে, চোখে তার ব্যর্থতার কালি, ধমকে ওঠে,
---চাষ বাপের কালে করেছো? চাষ করবেন! কী আমার চাষা রে! যাও, কালই মাপঝোক করে আসবে। ঋত্বিককে বলেছি, জমি তুমি ওকে দেবে! দিতে হবে! কাল গাড়ি নিয়েই আসবে ও।
গাঙ্গুলি এখন প্রস্তরমূর্তি, ঢোক গেলে। চোখে তার ঢেউহীন দৃষ্টি।
---বলছিলে না, তুমি ঠিক সামলে নেবে কারবার? আমি গাঁয়ে যাচ্ছি। চাষ করবো। জমিগুলোর য্যুৎ-বরাত ফিরানো দরকার। কত বছর চাষ হয় নাই!
---আমি কথা দিয়েছি জমি তুমি দেবে। আমার সম্মান রাখবে না?
---বিবাহের শর্তে সব কিছু করা যায়? যায়? বিবাহ কী এমন বন্ধন?
গৃহিণী গাঙ্গুলিকে ওঠ বললে উঠিয়েছে, এ গাঙ্গুলি সে গাঙ্গুলি নয়; এ অবাধ্য গোঁয়ার বিবাহের প্রোটোকলরহিত অনাধুনিক একটি দুপেয়ে জীব।
---বয়স থাকলে তোমার মুখে মুতে দিয়ে চলে যেতাম, বুঝলে?
যেন সত্যিই মুতেছে, গাঙ্গুলি মুখ মোছে দুহাতের পাতায়। গৃহিণীকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে প্রতিবিম্বে সকালের রোদ উঠোনে বিষণ্ণ একটা পাখিও নেই জীবজগতের ইশারা দিতে টিভিতে কেউ নাচছে উদ্দাম গানে গানে ফ্রিজ ফোঁস করে শ্বাস টানে নীরব সেকেন্ডের কাঁটারও টিকটিকানি আছড়ে পড়ে দেয়ালে দেয়ালে রাস্তায় বাসের হর্ন রেললাইনে হড়হড়ে ট্রেন...
পৃথিবীটা ঠিকই চলছে তবে সহজ সিধা চলনে, গাঙ্গুলিও তো চলছিল, ঋত্বিক না দেখালে জীবনটা স্ট্রেট একটা সরলরেখার মতো তড়তড় করে কুহকে শেষ হয়ে যেতো না অখিলবাবু?
"দেখা", মে, ২০২১.
0 মন্তব্যসমূহ