মৌসুমী কাদের এর গল্প ­­­খোঁড়া লিয়াকতের সুন্দরী




সেই সকাল থেকে দক্ষিণা ভিলার ছাদের উপর হাত পা মেলে উদাস মনে শুয়ে ছিল সুন্দরী। পিঠের নিচে টাইলসের গুতো লাগছিল বটে, কিন্ত তারপরও পায়ের উপর পা তুলে আকাশ দেখার কোন তুলনাই হয় না। আহা! কি স্বাধীন ফুরফুরে একটা দিন। কিন্তু খিদেয় পেট এমন চোঁ চোঁ করছিল যেন সূর্যটাকে হাতের মুঠোয় পেলে কত্‌ করে গিলে ফেলা যেত। কিন্তু সেতো আর হবার নয়!

নিচে রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা মাংসের খুশবু ঘ্রাণ উসখুস্‌ করে দিচ্ছিল মনটাকে। কিন্তু হঠাৎই ঠাকুমার চিৎকারে খিদে চৌচির হল সাত আসমানের উপর। বুড়িটা চিৎকার করে কাকে যেন ডাকছে, কিন্তু কেউ উত্তর দিচ্ছে না। ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত দুটোই হতে পারে। সুন্দরী বাড়ির পেছনে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে দেখে ছোট্ট তিনটি মেয়ে পেয়ারা গাছের সাথে দড়ি বাঁধা দোলনায় পালা করে দুলছে। মনে হচ্ছে তিন বোন। বুড়ি ঠাম্মার চিৎকার শুনেও ওরা না শোনার ভান করছে। পুকুরের সবুজ জলের উপর টুপটুপ করে ডুমুর ফল পড়ছে। ডুমুরগুলো ভাসতে ভাসতে কলমীলতার ভেতর লুকিয়ে পড়ছে। দোল খেতে খেতে পা ঝুলিয়ে আঙুল দিয়ে ফলগুলোকে কাছে টানতে পারাটাই ওদের খেলা। সুন্দরী কি বুঝল যে ওঁদের কোন ভাই নেই?

ঠাকুমা সারাক্ষণ তিন কন্যাকে পাহাড়ায় রাখছে। এতে যে ওঁদের খুব একটা আসছে যাচ্ছে তাও নয়। নরম পায়ে উড়ে উড়ে ওরা হাঁটছে আর দোলনায় দোল খাচ্ছে। মাঝে মাঝে চাপা স্বরে হাসছেও। মেজোটার পায়ের আঙ্গুলে ডুমুর ফল যখন ধরব ধরব করছে ঠিক তখুনি ঠাকুমার চিৎকার...'কী...রে, তোদের শাক তোলা হলো?' আকাশ ভেঙে পড়ল যেন! সজ্‌নে পাড়ার কথা, হেলাঞ্চ শাক তোলার কথা, কিছুই হয়নি...সবুজ ছায়াচ্ছন্ন মায়ার জগতে ডুবে থাকার অপরাধে কি শাস্তি হতে পারে ভেবে বিষন্ন হয়ে উঠল মেয়েগুলো।

উঠোনে একটা বড়সড় নীল মোরগ হাঁটাহাঁটি করছিল। নীলের মধ্যে কিছু পাখা গোলাপী। যেন ছোট্ট একটা ময়ূর বুক টান করে হাঁটছে। মোরগটা নিশ্চয়ই ঐ মেয়েগুলোর হাতেই ডিম ফুটে বড় হয়েছে। বাড়িতে অতিথি এলে দুটো ভাল-মন্দ খেতে দিতে হয়। সেই উছিলায় এখনও যে ঐ মোরগের বিদায়ের ঘন্টা বাজেনি তাতেই মেয়েরা খুশী। সময় মত শাক-সবজি নিয়ে ফিরে না গেলে নীল মোরগের কল্লা কাটা যেতে পারে। সেই ভেবে মেজোটা বড়টাকে জিজ্ঞেস করল;

- ঠাম্মা কি মোরগটাকে কেটে ফেলবে দিদি?

নিথর চোখে বড় মেয়েটা উত্তর দিল;

-জানি না...

-ক’টা সজনে হলো, দিদি?

-দশটা

-ওতে ঠাম্মা খুশী হবে?

- না হলে কি করব? কাঁদব? চল্‌...বলে হন্‌ হন্‌ করে হাঁটা দিল সে। ছোটগুলো বড়টাকে অনুসরণ করে হাঁটতে থাকল।
বিকেল গড়িয়ে ঘনান্ত সন্ধ্যা প্রায়। সুন্দরী মাথা ঘুরিয়ে দূর থেকে লক্ষ করল, ইংরজী অক্ষর ‘এল’ আকৃতির দালানের দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে একজন নারী। হালকা গড়ন, শাড়ি পরা, দূর থেকে শরীরটা দেখা যাচ্ছে। চেহারাটা স্পষ্ট নয়। সুন্দরী টের পেল তাঁর দিকেই তাকাচ্ছে সে বারবার। হঠাৎই হাতের দুই তালু জোর করে প্রণামের ভঙ্গিতে মন্ত্র পড়তে লাগল সে।

মন্ত্রের শব্দগুলো মিনমিন করছিল তার ঠোঁটদুটোতে …...

‘ওঁ মনোজবং মারুততুল্যবেগং । জিতেন্দ্রিয়ং বুদ্ধিমতাং বরিষ্ঠম্ ।

বাতাত্মজং বানরযূথমুখ্যং । শ্রীরামদূতং শিরসা নমামি ।’

(যিনি মন ও বায়ূর ন্যায় দ্রুতগামী, বুদ্ধিমান, ব্যাক্তিদিগের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং বানর বাহিনীর অধিনায়ক, সেই শ্রীরামের দূত, জিতেন্দ্রিয় পবন নন্দনকে অবনত মস্তকে নমস্কার করি ।



খোঁড়া লিয়াকত বানরটির নাম দিয়েছিল ‘সুন্দরী’। বানরটাকে সে সারাদিন সুপারী গাছের সাথে আঁটকে রাখত। প্রতি রাতে গ্যারেজের ভ্যাপসা গরমে তাকে টেনে নিয়ে যেত। সকালে যখন স্থান বদল হতো তখনই ছাড়া পাবার ভাবনাটা পাগল করে তুলছিল সুন্দরীকে। কিন্তু খোঁড়া লিয়াকত মহা পাজি। বদমাশ একটা। তক্কে তক্কে রাখছিল সারাক্ষণ। পালিয়ে যাওয়াটা একেবারেই সহজ হচ্ছিল না। তার উপর সে কিপ্‌টের হাড্ডি। রোজই টিপে টিপে খেতে দিত। মনে মনে পালিয়ে যাবার ফন্দি আঁটলেও কিছুতেই সেটা কাজে লাগাতে পারছিল না সুন্দরী। সুযোগও মিলছিল না তেমন একটা। ছ’মাস আগে লিয়াকত কাঁধে চড়িয়ে বাজারে নিয়ে গেছিল ওকে। তখনও গলায় শিকল বাঁধা ছিল। লোকজন ছুঁড়ে ছুঁড়ে বিস্কুট, কলা, রুটি এসব খেতে দিচ্ছিল। খোঁড়া লিয়াকত ক্ষেপে গিয়ে দোকানীদের বলেছিল, ‘তোমরা জানো? এই কলা মানুষ খায়, বানর না। বুনো কলা আছে? থাকলে সেইটা দাও। ঐ খেলেতো আমার সুন্দরীর দাঁত পড়ে যাবে! এমনকি শরীরে সুগারও বেড়ে যেতে পারে। ডায়াবেটিস চেনো? ডায়াবেটিস হবে।’ লোকজন হা করে খোঁড়া লিয়াকতের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল, লোকটার মাথা ঠিক আছে তো? বাচ্চারাও তখন ঢিল ছুঁড়েছিল। বানরকেতো মারাই যায়। কিন্তু তারপরও সে দিনটি ছিল মনে রাখার মত। সুন্দরী প্রায়ই ভাবত খোঁড়া লিয়াকতের চুল কাটার সময় হলে নিশ্চয়ই সে তাকে বাজারে নিয়ে যাবে। কিন্তু উল্টো হলো। খোঁড়া নিজেই চুল কামিয়ে টাকলু হলো। বাজারে যাওয়াতো দূরের কথা, চার দেয়ালের বাইরে যাবার আকাঙ্ক্ষাটারও প্রায় শেষ অবস্থা। তাছাড়া লিয়াকতের মেজাজ মর্জিও ভাল যাচ্ছিল না। জমি-জমা সামলাতে ইনসাফ কবিরাজকে কাজে নিয়েছিল। তাকে নিয়েও বেশ ঝামেলা চলছে। সে ঠিকঠাক মত চাষ-বাস করছিল না। তার উপর চার বউ নিয়ে মহা হাঙ্গামায় জড়িয়ে আছে।

জন্ম থেকেই একটা পা একটু ছোট ছিল বলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটত লিয়াকত। সেই থেকে তাঁর নাম হয়ে গেল খোঁড়া লিয়াকত। চেহারা ভাল নয় বলে যৌতুক দিয়ে বিয়ে করেছিল। কিন্তু সেই বউ নিউমোনিয়ায় মারা গেল। সময় কাটানোর জন্য তাই বানরটাকে কিনে এনেছিল সে আরেক মহাজনের কাছ থেকে। হাত-পা গুলো শুকনো, নখগুলো কালো লম্বা লম্বা। ভারী ঝোলা পেট দেখে মাতৃত্বের চিহ্ন বোঝা যায়। শখ করে লিয়াকত বানরটার নাম রেখেছিল ‘সুন্দরী’। কিন্তু সুন্দরী বানরের মুখ জুড়ে ছিল কালো অন্ধকার। বেঁধে রেখে পোষ মানানো কি এত সহজ? ভালোবাসলে যে নূন্যতম খোরপোশটা দিতে হয় এই বোধটাইতো লিয়াকতের নেই। তাছাড়া মানুষের সাথে যে বানরের রক্তের মিল আছে, ওঁদেরও যে সর্দি কাশি হয়, ওরা যে মানুষের সংকেত বুঝতে পারে এসব থোড়াই কেয়ার করে সে। বানরতো একটা জানোয়ারই বটে। নইলে মাঝরাতে হঠাৎ সেদিন সুন্দরীর গায়ের উপর পুরুষাঙ্গের ঐ স্পর্শটা এমন বিচ্ছিরীভাবে প্রকাশ পেত না। যেদিন প্রথম ঘটনাটি ঘটেছিল সুন্দরী ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিল না যে ঘটনাটি সত্যিই ঘটছিল। দাঁত খিঁচিয়ে চিৎকার করে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। লজ্জ্বায় কুঁকড়ে ছিল। অনশন করেছিল দুদিন। কিচ্ছু কাজে লাগেনি। মনে মনে খিঁচখিঁচ করে বলেছে, ‘নিজের ঠ্যাং সোজা নেই আবার মাল ঝরাবার শখ!!’

ঐ ঘটনার পর প্রায় রাতেই সুন্দরী গা চুলকাতে চুলকাতে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে ভাবত, হাতের কাছে ছুরি, লোহার রড বা পাথর পেলে লিয়াকতের মাথাটা একেবারে থেতলে দেবে। অথবা গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঘাসের উপর ফেলে নিজের গা থেকে উঁকুন ছেড়ে দেবে খোঁড়ার সদ্য গজা মাথার চুলে। এমনকি ওঁর গায়ে যেখানে যেখানে পশম আছে সবখানে উঁকুন ছেড়ে দেবে। ঐ জায়গাটাতেও। উঁকুনের কামড়ে যখন লিয়াকত ছটফট করতে থাকবে তখন ঠাস করে গালে কয়েকটা চড় বসিয়ে দেবে। এমন সব উদ্ভট চিন্তা যখন মাথায় ঘুরছিল, ঠিক সেদিনই গ্যারেজ থেকে সুপারী তলায় নিয়ে যাওয়ার সময় সুন্দরী লক্ষ করল, বেখেয়ালে লিয়াকত সুন্দরীর গলার শেকলটা একটু খুলে ফেলেছে। হালকাভাবে ঝুলছিল সেটা। সুন্দরী মাথা নিচু রেখে টু-মাত্র টের পেতে দিল না সেটা। লিয়াকত যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল সুযোগ বুঝে এক ঝটকা টানে শেকলটা খুলে দিল দৌড়। প্রথমেই ঘাসের উপর দুতিনটা ডিগবাজী খেয়ে বাড়ির রান্না ঘরে হানা দিল। খাবার টাবার খুঁজে না পেয়ে বেরিয়ে পড়ল বাইরে। লিয়াকতের বাড়ির পেছনের জঙ্গল পেরিয়ে ইনসাফ কবিরাজের বাড়ি, তারপর জমি, মাঠ ছাড়িয়ে এসে পড়ল সাহা পাড়া লেনের ‘দক্ষিনা ভিলায়’।

ঠাকুমা রাতের বেলা দালান বাড়িতে ঘুমালেও দিনের বেলায় টিনের ঘরের শেষকোণার রান্নাঘরটাতেই বেশী সময় কাটান। ঘরটা বেশ বড়। উঠোন থেকে মুরগী, কুকুর, বিড়াল হাঁটতে হাঁটতে অনায়াসে ঢুকে পড়ে রান্নাঘরে। ঠাকুমা খেপে গিয়ে তার হা্তের কাছে রাখা মোটা লাঠিটা দিয়ে সারাক্ষণ হুস্‌ হুস্‌ করে ওদের খেদাতে থাকেন। আর নিজের মনেই ক্যাট ক্যাট করে কি কথা বলেন কে জানে। তবে সুযোগ পেলেই তিন বোনের গুষ্টি উদ্ধার করেন। ঠাকুমার মন পাওয়ার জন্য বড় মেয়েটা ছোট দু বোনকে সামলে রাখে। হাঁস-মুরগীগুলোকে ভোর বেলা খোয়াড় থেকে ছাড়ায়। সন্ধ্যা নামলে আবার সেগুলোকে খোয়াড়ে ঢুকায়। স্কুলে যাওয়ার আগে আর পরে নিয়ম করে উঠোন ঝাঁড় দেয়, ভিজে কাপড় মেলে দেয়, আরও কত কাজ, বলে শেষ করা যাবে না। মাঝে মাঝে মন ছুটে গেলেই কেবল বাড়ির পেছনে জঙ্গলে বোনদের নিয়ে দোল খেতে যায়। আজ সে রকম একটা দিন ছিল। পুকুরের জল তিরতির করে কাঁপছিল আর ওঁদের মনে হচ্ছিল জলের নিচে কেউ বুঝি ডুব দিয়ে বসে আছে, উঠছে না। ওঁরা তিন বোন মিলে জলের শব্দ শুনছিল।

‘সুন্দরী’ চালের উপর থেকে ওদের কথোপকথন বোঝার চেষ্টা করছিল। বড় মেয়েটা একটু হেয়ালী করে মেজোটাকে বলছে;

- আজ ছ’দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে অথচ দ্যাখ্‌ আকাশটা দেখলে কেউ টের পেল না।

মেজো মেয়েটা কথাটা শুনে খুব বোকা বনে গেল। বলল,

- বৃষ্টি কই দিদি? এতো ধা ধা রোদ!

- তুই একটা গাধা! দেখিসনি মা প্রতিদিন কাঁদছে।

মেজোটা আবার না বুঝেই বলল,

- মা সবসময়ইতো কাঁদে। এ আর নতুন কি?

- প্রতিবারই হয়ত নতুন কিছু ঘটে, আমরা টের পাই না। ঠাম্মা নিশ্চয়ই আবার কিছু বলেছেন।

- মা কি বাবার জন্য কাঁদে, দিদি?

- হয়ত। আমি সেটা কীভাবে জানব? মা ’কে জিজ্ঞেস করতে পারিস্‌ না?

- ওমা! তুমি জানবে না তো কে জানবে? তুমিই না বলেছ, মনে কোন প্রশ্ন এলে তোমাকেই আগে জিজ্ঞেস করতে? বাবা মরে গেল বলেই তো আমাদের এবাড়িতে থাকতে হলো, তাই না দিদি? বাবার কি অনেক বড় অসুখ হয়েছিল, দিদি?

- হ্যাঁ। অনেক বড় অসুখই হবে। তোর কি এবাড়িতে থাকতে ভাল্লাগে না? বলতে বলতেই বড় বোনটা দোল খাওয়া শেষ করে পেয়ারা গাছে তরতর করে উঠে গেল। তারপর পাশের ডুমুর গাছ থেকে ফল পাড়তে পাড়তে উপরের দিকে তাকিয়েই ভীষণ জোরে চিৎকার করে উঠল......! ই......ই...ই...। ছোট বোনদুটো্র বুক ধক্‌ফক্‌ করে উঠল। বড় বোনটা আঙুল দিয়ে ঘরের চালের দিকে ইশারা করে বলে উঠল, ‘দ্যাখ দ্যাখ্‌...বানর!

একেবারে ছোটটা খুব চঞ্চল। সে ভোঁ দৌড়ে বাড়ির ভেতরে গিয়ে রটিয়ে দিল যে বাড়ির ছাদে বানর এসেছে। সবাই যার যার কাজ ফেলে সার্কাস দেখার মত করে উঠোনে জড় হতে লাগল। মনে মনে গজ্‌ গজ্‌ করতে করতে তিন বোনের দিকে তাকিয়ে জিভ বের করে ভেংচি কাটল সুন্দরী। শান্তিতে আর রোদ পোহানো গেল না। হাড় বজ্জাৎ পুঁচকে মেয়েগুলো। খুব রাগ হলো তাঁর।


উঠোনটা বাড়ির ঠিক মাঝখানে। আর তার দুদিকে দুটো বাড়ি। বাম দিকের দালান বাড়িটা ইংরেজী ‘এল’ অক্ষরের মতন দেখতে। আর ডান দিকে গোলাকার একটা টালি বাড়ি। এই টালি বাড়িতেই মেয়েগুলো মায়ের সাথে থাকে। ওঁদের মাকে এক ঝলক দেখা গেল উঠোনে, কাপড় মেলছিল। পরনে সাদা শাড়ি। টালি ঘরের ডান কোণায় ঠাকুমার রান্নাঘর। তারপর কিছুটা দূরত্বে কাজের লোকদের ঘর। সুন্দরী তাকিয়ে তাকিয়ে পুরো বাড়িটা দেখল। সেই সকালে একবার খেতে দিয়েছিল খোঁড়া লিয়াকত। দুপুর গড়িয়ে গেছে। বারবার রান্নাঘরের দিকেই নজর যাচ্ছে তাঁর। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে ছটফট করছিল সে। উঠোনের দুই দিকে দুটো পেয়ারা গাছ। একটা দালানের দিকে আর আরেকটা টালিঘরের রান্নাঘরের দিকে। মাঝখানে ডালিম আর সুপারী গাছ। বড় গাছ গুলোর নিচে রঙ্গন, হাসনাহেনা আরও হাবিজাবি সব নাম না জানা ফুল গাছ। ঠাম্মা সকালেই মেয়েদেরকে ডেকে বলছিলেন, ‘জল দে, শুকিয়ে যাচ্ছেতো সব রোদে... ওগুলো দাতরাংগা, এমনি এমনি ফোটে, সুরভি ছড়ায় না, তাতে কি, বাগানের শোভাতো বাড়ায়! যাহ্‌ ...এখুনি জল দে!’


বাড়ির পরিবেশটা বেশ মনোরম। ছোট ছোট মেয়েগুলোর কথাবার্তা শুনতে খুব ভাল লাগছিল সুন্দরীর। কিন্তু কথায়তো আর চিড়ে ভিজবে না। ভাবতে থাকে সে। সেই সকালে খোঁড়া লিয়াকত একটা কলা খেতে দিয়েছিল। তারপর সারাদিন সার্কাসের ক্ষুধাশিল্পী হয়েই থাকল। ঘরের চালের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত দৌড়েছে কেবল। আর তাতেই ‘দক্ষিণা ভিলার’ মানুষ গুলো কী যে মজা পাচ্ছে কে জানে। বাড়ির পেছনের জলাশয় থেকে জল গিলে কিছুটা শান্ত রেখেছিল নিজেকে। আর পারা যাচ্ছে না।

জলাশয়ের পেছনে পুরোটাই গাছপালায় ভরা। বেল, কাঁঠাল, জাম, আরও নাম না জানা অচেনা সব বড় বড় গাছ। সেই গাছগুলোর ডাল বেয়ে বেয়েই আজ সে এখানে। জঙ্গলের পরেই লাগোয়া ইনসাফ কবিরাজের জমি। কবিরাজের নিজের কোন জমি জমা না থাকায় খোঁড়া লিয়াকতের জমিতে বর্গা চাষ করে। তাঁর জমিতেই আশ্রিত সে। চার চারটা বিয়ে করায় লোকজন ক্ষেপে গিয়ে গ্রাম থেকে উৎখাত করেছিল তাকে। লিয়াকতের দয়াতেই এই জমিতে ঠায় পেয়েছে। চার বউয়ের সাথে কখনও সে একসাথে থাকে না। একেক বউ একেক সময়ে ঘরে আসে। ওরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো অজানা কারণে নিজ থেকে সেধে সেধে লিয়াকতের বাড়িতে এসে সুন্দরীকে খেতে দিত। গত কয়েকমাস ধরে অজানা কারণে ওঁদের কেউ আসেনি। ইনসাফ কবিরাজ বউদের ধরে ধরে পিটাত। দূর থেকে সেই কন্ঠস্বর শুনে সুন্দরী টের পেয়ে যেত কোন্‌ বউটা কোন্ দিন মার খাচ্ছে। দক্ষিণা ভিলা থেকেও সেই কান্নার সুর শোনা যেত। দুই জঙ্গল দূরত্বে হলেও কান্নার আওয়াজে সীমান্ত ছাড়ানো শক্তি ছিল, প্রচন্ড হাহাকার ছিল। সুন্দরী যেদিন শিকল খুলে গাছ বেয়ে বেয়ে এবাড়িতে আস্তানা গাড়ল সেদিন থেকেই অজানা কারণে সেই কান্না থেমে গেল।

পেয়ারা গাছের নিচে বড় জেঠিমার রান্না ঘর। জেঠিমা মহা জাঁদরেল। উঠোনে সে মোটা একটা লাঠি লুকিয়ে রাখত। বানরের দল বাড়ির আশেপাশে ঘুরেটুরে মানুষজনের মনের হাওয়া বুঝে টুঝে চলে যেত। শুধুমাত্র সুন্দরীর ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম হলো। সে গাছের মগ ডাল থেকে তরতর করে নেমে এসে রান্নাঘরে ঢুকে হলুদের ডিব্বা, লবনের বয়াম, উলটে দিতে শুরু করল, রান্নার সরঞ্জাম এলোমেলো করে খাবারের খোঁজে একটু পর পর উৎপাত করতেই থাকল। সুন্দরীর জ্বালাতনে বাড়ির সকলেই তক্কে তক্কে থাকত। যখন তখন উঠোনে শুকোতে দেয়া আঁচার, আমসত্ব থেকে শুরু করে যা পেত তাই নিয়ে সে ভোঁ দৌড় দিত। ওসব কিছুই সে খেত না। সবই এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সবার নজর কাড়ার চেষ্টা করত। জেঠিমা এসব কীর্তিকান্ডে ভীষণ বিরক্ত হচ্ছিল আর সারাক্ষণ ঝাঁটা নিয়ে ছেই ছেই করছিল। কন্যারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও জেঠিমার নির্দেশে লাঠি নিয়ে গাছের তলায় বসে থাকতে লাগল। জেঠিমার যেন শান্তিতে রান্না করারও জো নেই। বাড়ির একদল পারলে বানরটাকে লাঠিয়ে খেদায়। আবার আরেক দল কৌতুহলী হয়ে একরকম প্রশ্রয়ই দেয়।

একদিন তাড়া খেয়ে সুন্দরী পেয়ারা গাছ বেয়ে দোতলার কার্নিশে উঠে জানালায় উঁকি দিয়ে দেখে সেজো কাকীমা রান্না করছে। সেজো কাকীমারা পাকা বাড়ির দোতলাতে থা্কে। সুন্দরী যখন কার্ণিশে, সেজ কাকীমা তখন রুটি বেলছিল। হঠাৎ কার্নিশে সুন্দরী্কে দেখে একই সঙ্গে তার বিস্ময় আর মায়া উথলে পড়ল। কাকীমা বুঝতে পারল বানরটি ক্ষুধার্ত। রুটি বেলতে বেলতে সে একটা গোল রুটি সেঁকে সুন্দরীকে খেতে দিল। সুন্দরী তাতে মহাখুশী। এই প্রথম এবাড়ির কেউ ওকে আদর করে খেতে দিয়েছে। টানা দুদিন রুটি খাওয়া চলল। মনের আনন্দে সে সেজ কাকীমার দোতলার কার্নিশে লাফ দিয়ে ঝুলে ঝুলে রুটি খেয়ে আবার পেয়ারা গাছে দোল খেতে খেতে টাইলসের ছাদে গিয়ে ঘুমোতে লাগল।

প্রথম দু-দিন তেমন কিছু না ঘটলেও তৃতীয় দিনে একটা বিরাট নাটক হলো। আশপাশের জঙ্গল থেকে পশুপাখিদের উঠোনে চলে আসাটা বন্ধ করার জন্য সবাই যখন কথাবার্তা বলছে, বড় জেঠিমা তখন ভাড়ার থেকে একটা নিডো দুধের কৌটা বের করে চা বানাতে বসেছিল। কৌটৌটা চুলোর পাশেই রাখা ছিল। হঠাৎ সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে চোখের নিমেষে গাছ থেকে নেমে এসে ছোঁ মেরে কৌটাটা ছিনিয়ে নিল সুন্দরী। তারপর কেউ ঠিক ঠিক বুঝে ওঠার আগেই তরতর করে গাছের মগ ডালে উঠে গেল সে। বড় জেঠিমা এদিকে অর্ধেক চা বানিয়ে বসে আছে। দুধের কৌটৌটা যখন নিতে যাবে ঠিক তক্ষুনি এই কান্ড!


জেঠিমা দৌড়ে গেল পেয়ারা গাছের নিচে। উপরে সুন্দরীর দিকে তাকিয়ে বলল,

- ঐ বান্দর, দুধের টিন দে! দে বলতিসি!

সুন্দরী জেঠির দিকে দুষ্টু চোখে তাকিয়ে হাসতে লাগল। উত্তর দিল; খ্যাক, খ্যাক্‌, খ্যাক্‌ খ্যাক্‌…… তাঁর কিন্নর কন্ঠের সেই বিদ্রুপাত্মক হাসিটা দূরের বিল পর্যন্ত শোনা গেল...

বড় জেঠিমার চিৎকার শুনে বাড়ির আশপাশের লোকজনও ঘর থেকে বেরিয়ে এসে গাছতলায় জড় হলো। দু’চারজন সুন্দরীর দিকে তাকিয়ে ঢিল ছুঁড়তে লাগল যাতে সে কৌটোটা ফেরত দেয়। কিন্তু লোকের সমাগম দেখে সুন্দরী আরও অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করল। সে এক ডাল থেকে অন্য ডালে ঝুলে ঝুলে রীতিমত উড়তে লাগল। নিচে জেঠিমার দিকে তাকিয়ে জিভ বের করে ভেংচি কাটল। কিন্তু বগলের নিচে নিডো দুধের কৌটাতো আর নড়ে না। কিছুতেই সে কৌটা ফেরত দেবে না। পেয়ারা গাছ বেয়ে একটু নিচে নেমে এসে এমন একটা ভাব করে যেন এক্ষুনি কৌটাটা সে ফেরত দিচ্ছে। কিন্তু আসলে দেয় না। এমন ফাজিল টাইপ উৎপেতে বানর এ পাড়াতে আগে কেউ দেখেনি।

চতুর্থ দিনে সেজো কাকীমার প্রশ্রয়ে দালান বাড়ির দোতলার ঘরে ঢুকল সুন্দরী। সেজো কাকীমা নিঃসন্তান এবং দেবতা ভক্ত। তার ইচ্ছে ছিল একটা বানর পুষবেন। কিন্তু এ বাড়ির লোকেদের এতটাই শুচিবাই যে একথা মুখে উচ্চারণ করার সাহসই হয়নি তাঁর।। এরা তিনটা মুরগী পালেতো দশবার উঠোন ঝাড়ু দেয়। তাই সুন্দরীকে পোষার ইচ্ছেটা তক্ষুনি মাথা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। কাকীমার আপ্যায়নে যখন রুটি আর চা খাচ্ছিল সুন্দরী, নিচে তখন সবার কি দুশ্চিন্তা। কাকীমার কি মাথা নষ্ট হয়ে গেছে যে ঘরে বানর ঢুকিয়েছে? না জানি কি হালুম-হুলুম করছে বানরটা। রীতিমত টেনশন চারদিকে। সেজো কাকীমা জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখল সকলেই ভীড় করে আছে। সবাইকে নিশ্চিত করে কাকীমা চিৎকার করে জানালো; ‘সব ঠিক আছে, ও বিছানায় বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে রুটি আর চা খাচ্ছে।’ শুনেতো সবাই থ! ঠাম্মা রীতিমত বিরক্ত! বানরকে খাটে বসিয়ে রুটি আর চা খাওয়ানো হচ্ছে?? বাড়ির বউয়ের এ কেমন ভক্তি! ক্ষেপে গিয়ে তিনি সেজো কাকীমাকে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘এই সোনালী, তুমি এক্ষুনি ওটাকে ঝেটিয়ে বিদেয় করোতো। আর বিছানার চাদর পাল্টাও। আর শোন মেয়ে, ঘরবাড়ি সব মোছ, পূজো হবে না নইলে…সব নোংরা হয়ে গেল...রে। এই বান্দরতো বনে জংগলে হাগু করে বেড়ায়। ওকি পোষা বানর? ছুঁচু করে মানুষের মত?

সুন্দরী যখন রুটি খাচ্ছিল সেই ফাঁকে সেজো কাকীমা চট করে দুধের কৌটোটা সরিয়ে ফেলেছিল। সুন্দরী সেটা টের পেল না। চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে খ্যাক খ্যাক করে আবার চা চাইল। কাকীমা আবার তাকে চা দিল। সুন্দরী চা রুটি শেষ করে ভরা পেটে ভদ্রভাবে দালানের কার্নিশ আর পেয়ারা গাছের ডাল বেয়ে টাইলসের ছাদে গিয়ে শুয়ে পড়ল। ততক্ষণে পাড়ার লোকজনের কাছে খবর রটে গেছে। উঠোন জুড়ে লোকজন হৈ হৈ শুরু করেছে। সবাই মিলে ছাদের উপর তাকিয়ে বানরটাকে দেখছে। কেউ কেউ বলাবলি করছিল উপজেলা বন কর্মকর্তার মাধ্যমে বানরটিকে উদ্ধার করে জঙ্গলে ছেড়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হোক। এত মানুষ ওঁর দিকে এমন মারমুখী চোখে তাকিয়ে আছে দেখে ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল সুন্দরীর। হঠাৎ দেখা গেল হাঁপাতে হাঁপাতে খোঁড়া লিয়াকত দক্ষিণা ভিলার উঠোনে এসে হাজির। তার পেছনে ইনসাফ কবিরাজ। খোঁড়া লিয়াকত দূর থেকে সুন্দরীর চোখের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘আই পোলাপান যাহ...যাহ! সর্‌! সর্‌!’ ......কেউ ঢিল ছুঁড়বি না, এইটা আমার বান্দর, আমার বান্দর।’

খোঁড়া লিয়াকত আর ইনসাফ কবিরাজকে দেখে সুন্দরী হঠাৎই ভীষণ ক্ষিপ্র হয়ে উঠল। মনে পড়ে গেল তাঁর, খোঁড়া লিয়াকত মাঝে মাঝেই ইনসাফের বানানো কবিরাজি অসুধ গেলাতো তাকে। কি ভয়ংকর তেতো ছিল সেই অসুধ! ঘুমে জড়িয়ে আসত চোখ, কিন্তু ঘুম হতো না।

মুখে গড় গড় আওয়াজ তুলে দাঁত খিঁচ্‌তে থাকল সুন্দরী। তারপর খুব ঠান্ডা মাথায় ধীরে ধীরে গাছ বেয়ে বেয়ে নিচে নেমে এলো সে। কেউ কিছু টের পাওয়ার আগেই ঝপাৎ করে ঝাপিয়ে পড়্ল খোঁড়া লিয়াকতের উপর। ধাঁরাল দাঁতগুলো বসিয়ে দিল পুরুষাঙ্গ বরাবর। রক্তে ভিজে গেল খোঁড়া লিয়াকতের কাপড়-চোপড়। মাটিতে পড়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলো সে। লোকজন ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। দূরে সরে গেল কেউ কেউ। কেউ আবার ভয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল বাড়ির বাইরে। কিন্তু কাউকেই বানরটাকে বাঁধা দিতে দেখা গেল না। খোঁড়া লিয়াকত মাটিতে গড়াতে গড়াতে গলা ফাটিয়ে কাঁদতে লাগল; ‘আমারে মাপ কইরা দে সুন্দরী। মাপ কইরা দে!’


সুন্দরী কোনো দিকেই আর তাকাল না। ভীড়ের মধ্যেই দামিনী স্বভাবে হেঁটে চলে গেল সদর দরজার দিকে…


ঠাম্মা থরথর করে কাঁপছিলেন। চোখ বুঁজতেই দেখতে পেলেন সেই নগ্ন শরীর। এরকম একটা বানরই রাজাকারটার টুঁটি চেপে ধরেছিল সেদিন।

---------------------------------------------
লেখক পরিচিতিঃ
মৌসুমী কাদের
কথাসাহিত্যিক। অনুবাদক।
কানাডায় থাকেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4 মন্তব্যসমূহ

  1. খুব সুন্দর থিম। নিবিড় গদ্যশৈলী। খুব ভাল লাগল।

    উত্তরমুছুন
  2. বাহ - কি গতিশীল, পট পরিবর্তনের কাহিনী। অনেক নতুন ধারনা, মৌলিক জিনিস এসেছে। অভিনন্দন, মৌসুমী
    - দীপেন ভট্টাচার্য

    উত্তরমুছুন