রমাপদ চৌধুরী'এর গল্প: লেখকের মৃত্যু

পাঠকের জন্ম সেই বয়সে। যে বয়সে ওদের সাদা জীনের হাফ প্যাণ্টের নীচে দুটো পুরুষ্টু হাঁটু রাতারাতি ফেঁপে উঠছে। যে বয়সে ওদের গলার স্বর হঠাৎ গাঢ় হয়ে উঠছে। মুখগুলো কৈশোর-পারহওয়া ঘাম-ঘাম ভরাট। ওরা হাতে হকি স্টিক নিয়ে সিমেন্ট-বাঁধানো বড় নালাটার নড়বড়ে পুলের ওপর দিয়ে ছুটতো খেলার মাঠের দিকে। ছুটতে ছুটতে কনভেন্টের পাশের মেহেদি-বেড়ায় ঘেরা মাঠের ধারে মিনিট কয়েকের জন্য থামতো। মেহেদি-বেড়ার সেই ভলি গ্রাউণ্ড। যেটাকে এতকাল সবাই উপেক্ষা করে এসেছে, কিন্তু তারপর হঠাৎ কখন থেকে ওরা উপেক্ষা করতে পারেনি।

 
যেখানে ওরা সবাই একবার থামতো। লাল স্কার্ট পরা, খাটো লাল স্কার্ট পরা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়েগুলো। তার মধ্যে একজন পাঞ্জাবী, আর একজন বাঙালী, সেই যে মিনি না কি নাম। লেডিজ সাইকেলে সাঁ-সাঁ করে উড়ে যেতে যেতে বজ্জাত ছেলেদের মুখে দু আঙুল পুরে দেওয়া শিস শুনে সে ইংরিজীতে গালাগাল দিতো, ওরা সকলে কনভেন্টের মাঠে ভলিবল নিয়ে দাপাদাপি করতো । পর পর অনেকগুলি ক্লাস ওদের দিকে নাক বেঁকিয়ে চলে যেতে যেতে যেদিন মৈনুন, আফত আর রণেন হকিস্টিকে ঠেস দিয়ে কনভেণ্টের মেয়েদের ঝাঁপাঝঁপি দেখতে শুরু করলো, সেদিন আমিও সঙ্গে ছিলাম।
 
সাদা ধবধবে ব্লাউজ, একটু ফাঁপা-ফাঁপা, আর লাল, টকটকে লাল স্কার্ট, তার নীচে ফর্সা ধপধপে হাঁটু; আর পা আর পায়ের পাতা, বিনুনি করা চুল, ছটফটে চুলের বিনুনি, আড়চোখের চাউনি, ঠোঁট-টেপা হাঁসি, খেলার ফাঁকেই কানে কানে ফিসফিস...সব দেখতে দেখতে বুকের ভিতরটা আমার, আর মৈনূনের, আর আফতের, আর রণেনের কেমন যেন কেমন-কেমন করে উঠতো । 

অথচ, তার আগে আমরা জানতামই না, মৈনুন কিংবা আফত কিংবা রণেন কিংবা ফার্স্ট বয় অলোক অথবা সেকেন্ড মাস্টার বিলাসবাবু ছাড়া পৃথিবীতে আর-এক জাতের মানুষ আছে।
 
কনভেন্টের মেয়েদের খেলা দেখতে দেখতে সেদিন জানলাম, আছে, আরেক রকমের মানুষ আছে। সেদিন আরেকটা জিনিস আবিষ্কার করলাম । লাল ইটের ইনস্টিটিউট-বাড়িটার পাশে জালে-ঘেরা টেনিস কোর্টের ওপাশে যে সার সার কোয়ার্টার, তার একটা দেয়ালে নম্বর মারা আছে ৭১/৭৪৪ বাই ডবলু বি।
 
ডবলু আর বি দুটোর সঙ্গেই ইংরেজী বর্ণপরিচয়ের মাধ্যমে পরিচয় ছিলো, কিন্তু একটা বাড়ির দেয়ালে তার কি সঙ্কেত, কিসের তা জানার ইচ্ছেও হয়নি। একাত্তর আর সাতশো চুয়াল্লিশ বা কেন, তাও জানতে চাইবো কেন।

কিন্তু ওই বাড়িটার দিকে তখন বারবার চোখ যেতো । আর সাহেববাজারে কিছু কিনতে যাবার সময় কেন জানি না ৭১/৭৪৪ নম্বরের সামনে দিয়ে যে লাল কাঁকরের সরু রাস্তাটা গেছে সেটাকেই শর্ট কাট মনে হতো ।
 
তার কারণ বোধ হয় ওই পেঁয়াজি রঙের শাড়ি পরা শালিক পাখিটা । রোগা-রোগা পাখিটা তখন পাখির মতোই ফুড়ুক ফুড়ুক করে উড়তো, বসতো কখনও জানালায়, কখনও পাশের বাগানের পেঁপেগাছের ধারে, সামনের রাস্তায় কিংবা কাছের কালভার্টে। একদিন ভোরবেলায় নরেশদার ক্লাবে মুগুর ভাজতে যাচ্ছি, ঈশ্বরপ্রসাদের দোকানে তখন বড় কড়াইটায় জিলেপী ভাজা হচ্ছে, দেখি কি সেই শালিক পাখিটা সবুজ শাড়ি পরেছে, হাতে শালপাতায় মোড়া গরম জিলেপী কিনে নিয়ে যাচ্ছে। 

পাখি দেখতেই শুধু আমার ভালো লাগতো না। তার সঙ্গে তার মতো কিচিরমিচির করে কথা বলতেও ইচ্ছে হতো ।
 
তাই ভাবলাম, এর চেয়ে ভালো সুযোগ তো আর পাবো না। 
পাখি না ফুল, নৈনীতাল আলু না ওল, মুখটা কিসের মতো করে তার দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম জানি না। 
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একটা অঘটন ঘটে গেল। আমি গলাটাকে কোকিলের মতো মিষ্টি করে ডাকতে গিয়েছিলাম, গলাটার বদলে মুখটাই কোকিলের মতো হয়ে গেল। কারণ সেই মুহূর্তে একটা বাজখাঁই চিল কোত্থেকে সোঁ করে নেমে এসে পাখির হাতের ঠোঙায় ছোঁ মারলো। 
পাখির হাত ছড়ে গেল, ঠোঙা থেকে গরম জিলেপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো মাটিতে।
পাখির মুখ সাদা হয়ে গেল, পাখি ভয় পেলো, পাখি লজ্জায় তাকাতে পারলো না। আর ওর দু চোখের কোণে দু ফোঁটা জল চিকচিক করলো। 
তারপর সে আমার দিকে ক্রুদ্ধ দুটি চোখ তুলে তাকালো। বেশ বুঝতে পারলাম, আমাকে ‌এগিয়ে আসতে দেখে ও অস্বস্তি বোধ করেছিলো, কিংবা ভয়, আর তাই অসতর্ক হয়ে পড়েছিলো।
 
আমি আর কোনো কথা না বলে নরেশদার ক্লাবে চলে গেলাম। কিন্তু মন থেকে পাখির মুখটা, ভোরবেলায় ঘুম ভাঙা ঘুম-জড়ানো চোখ, চোখের পাতা, এলোমেলো চুলের বিনুনি, ফোলা-ফোলা মুখ-কিছু ভুলতে পারলাম না।

কেবল মনে হতে লাগলো বাবার পকেট মেরে একটা রুপোর টাকা, কি খুচরো কয়েক আনা পয়সা যদি রাখতে পারতাম, তাহলে পাখিকে আবার জিলেপী কিনে দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতাম। নরেশদা দু-চার দিন হয়তো লক্ষ করেছিলেন। তাই মুগুর ভাঁজলেই তিনি খুশি হতেন না। প্রায়ই বলতেন, শরীরচর্চা করলেই তো হবে না, মনের চর্চাও দরকার। ভালো ভালো বই পড়ো।
 
বিবেকানন্দের বই পড়তে বলতেন।
 
মৈনুন আর আফত আর রণেন তা দেখে হাসাহাসি করতো । মুগুর ভাঁজা আর কর্মযোগ পড়া ওদের একদম পছন্দ ছিলো না। রণেন গর্ব করে বলতো, আমি যখন গোল দিলাম ডোরা হাততাল দিয়েছে।
 
পাখি খেলা দেখতে যেতো না। পাখি বাড়ির পাশের পেঁপেগাছের নীচে একটা চেয়ার পেতে বই পড়তো । আর আমাকে দেখতে পেলেই ওর মুখটা বইয়ের উপর আরো নীচু হয়ে ঝুঁকে পড়তো। তবু ইনস্টিটিউট লাইব্রেরিতে রোজ বই বদল করতে যেতাম। না গেলে পাখির বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার কোনো অজুহাত খুঁজে পেতাম না।
 
একদিন হয়েছে কি, ইনস্টিটিউটে গিয়েছি বই বদলাতে, হাতে ছিলো একটা ধর্মগ্রন্থ। ব্রজেনদা লাইব্রেরিয়ান, তাঁকে পানের দোকানের ভিড়ের মতো আমরা সবাই বই বদলে দিতে বলছি, হঠাৎ পিছন থেকে ঝাঁঝালো গলা ।- -আজ না দিলে ব্রজেনদা, গলাটা কচ্ করে কেটে দেবো ।
 
মেয়েলী গলা শুনে ব্রজেনদা তাকালেন, হাসলেন। বললেন, রেখেছি, রেখেছি, এইমাত্র ফেরত এলো ।

পাশের ভিড় সরে গেল, আর এগিয়ে আসতেই আমি পাখিকে দেখলাম। পাখি আমাকে দেখলো। তারপর সপ্রতিভভাবে টেবিলে-রাখা বইটা টেনে নিয়ে নামটা দেখেই ও ফিক করে হেসে ফেললো । আর আমার মনে হলো ঠাস করে ওর গালে একটা চড় বসিয়ে দেই । হাসবার কি আছে? নরেশদা তো বলেন এগুলোই ভালো বই। ধর্মগ্রন্থ কি লোকে পড়ে না? তবে ছাপা হয় কেন! 
ভাগ্যিস চড়-মারা চোখে তার দিকে তাকাইনি। কারণ পরের দিনই আবার দেখা হলো । দেখা হবারই কথা, কারণ আমি আধ ঘণ্টা ধরে ইনস্টিটিউটের সামনে পায়চারি করেছিলাম। আর দূর থেকে পেঁয়াজি রঙের শাড়িটা দেখে ভিতরে ঢুকেছিলাম। 
আমার পাশে দাঁড়িয়ে পাখি বললো, ব্রজেনদা, অ্যাদ্দিনে একটা ভালো বই পড়ালেন, ব্রিলিয়েন্ট।
 
সঙ্গে সঙ্গে আমি সেই চিলটার মতো আমি বইটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিলাম।- -ব্রজেনদা, আমাকে এটা দিন।

পাখি আড়চোখে তাকালো, হাসলো । 
আর আমার মনে হলো বৃষ্টিতে-ভেজা রোগা শালিকটার বুকের পালক তিরতির করে কাঁপছে, কেঁপে কেঁপে নতুন হয়ে উঠছে তার সারা শরীর। 

মৈনুন আর আফত আর রণেন তখনো হাকি স্টিক হাতে ফিক্সড হুইল সাইকেল চালিয়ে মিনি আর ডোরার গল্প বলে। আর আমি ভাবি, ওরা কি বোকা, কি বোকা! কারণ তখন পাখি পাখিই, আমি চিল হয়ে গেছি।
 
আমি কোনো ভালো বই পড়লে ওকে না পড়িয়ে আনন্দ নেই। পাখির ভালো লাগা বই আমার তেমন ভালো না লাগলে ও জ্বরো রুগীর মতো মুখ করে। দুঃখ পায়। ইনস্টিটিউটে একই সময়ে বই বদলাতে দুজনে আসি, কথা বলি, তারপর বিলিয়ার্ড রুমে গিয়ে বিলিয়ার্ড খেলা দেখি। গ্যালারির মতো দু সারি বেঞ্চ, আমি নিচেরটায় বসি, ও ওপরের বেঞ্চে, ঠিক পিছনে । কখনো কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে কিছ বলে, কখনো কাউকে ঢুকতে দেখে সোজা হয়ে বসে। তারপর একসময় চিমটি কাটে।
 
ইনস্টিটিউটের সামনে অনেকখানি সবুজ ঘাসের লন, মৌসুমী ফুল, ফোয়ারা । আর নীল নীল আলো । মাঝে মাঝে দু-একটা গ্যাসের আলো। 
কোনো-কোনো দিন দুঃসাহসে ভর করে ফোয়ারার আবছা অন্ধকারে এসে বসি দুজনে । কিন্তু আলোচনা সেই বই আর বই। 
আর এই সময়েই ব্রজেনদা চাকরি থেকে অবসর নিলেন। নতুন যিনি এলেন তাঁকে আমরা উৎপলদা বলতে পারলাম না। যদিও তিনি ব্রজেনদার চেয়ে অনেক ছোট। 
তাঁর চোখে চশমা ছিলো, চুলে তেল দিতেন না, দেখতে সুন্দর ছিলেন, গরদের পাঞ্জাবি পরতেন। 
তিনি শুধু বই দিতেন না, উপদেশও দিতেন। বইটা ফেরত দেওয়ার সময় জিগ্যেস করতেন। আর এইভাবে কখন থেকে তিনি যেন আমাদের দুজনের কাছেই হিরো হয়ে গেলেন।

আমি বলতাম, উৎপলবাবু ব্রজেনদার মতো নন। উনি ভালোমন্দ বোঝেন, বোঝাতে পারেন।
 
তখন দুজনেই আমরা উপন্যাস পড়ার নেশায় ডুবে গেছি। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজের লাইব্রেরিতেও ছাড়পত্র মিলেছে। বই ভালো লাগলেই পাখিকেও না পড়িয়ে শান্তি নেই। 
মৈনুন আর আফত ইতিমধ্যে কারখানায় অ্যাপ্রেন্টিস। রণেন আর আমি সাইকেলে সাত  মাইল পার হই, কাঁসাই নদী পার হই ফেরিতে, কলেজ করি। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে। 
ইনস্টিটিউটে এসে পাখির সঙ্গে দেখা । তারপর বাড়ি। 
সেদিন কলেজ লাইব্রেরি থেকে নেওয়া বইখানা হাতে নিয়ে ইনস্টিটিউটের লনে বসে অপেক্ষা করছি। মনের মধ্যে পাখি পাখি পাখি। 
না, পাখি এলো না। রণেনও চলে গেল। তবু অপেক্ষা করতে করতে কখন যে বইটা নাড়াচাড়া করতে শুরু করেছি কে জানে।
 
ঘাসের লন ছেড়ে আলোর নীচে একটা বেঞ্চে বসে বইটার পাতা খুললাম। শব্দের পর শব্দ, লাইনের পর লাইন পড়ে চলেছি। আর কি আশ্চর্য, সমস্ত মন কেমন আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে, সমস্ত শরীরে অদ্ভূত একটা অনুরণন। ভালো লাগছে, ভালো লাগছে। বিস্ময় আর আনন্দ, আগ্রহ আর পুলক। নেশার ঘোরে যেন আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বইটা । তেজী ঘোড়ার মতো টগবাগিয়ে ছুটে চলেছি। তেজী ঘোড়ার পিঠে ছুটে চলেছে পেশোয়ারী মেয়ে ফিরোজা । আনারের দানার মতো তার গাল, নীল নীল চোখ।
 
একটু একটু করে যখন সব নিস্তব্ধ হয়ে গেছে, সব আলো নিবে গেছে, শুধু উপন্যাসের নায়িকার সেই নীল নীল চোখ দুটি দেখতে পাচ্ছি। 
রুদ্ধশ্বাসে সেই স্বল্পালোকিত বেঞ্চটাতে বসে পড়ে চলেছি। সমস্ত শরীরে অদ্ভূত এক পুলক। মনে হচ্ছে এমন আনন্দ বুঝি কখনো পাইনি। এমন বই বুঝি বা কখনো লেখা হয়নি। মনে মনে লেখকের পায়ে কয়েকটি শ্বেতপদ্ম রেখে প্রণাম করতে ইচ্ছে হচ্ছে। 
কনভেন্টের মিনি আর ডোরা, ৭১/৭৪৪ নম্বরের পাখি-সব মুছে গেছে। গোটা পৃথিবী চুপ করে গেছে।
 
জেগে আছে শুধু একটি নায়িকা । ফিরোজা, ফিরোজা ।
 
শেষ পৃষ্ঠা শেষ করে আচ্ছন্নের মতো বসে রইলাম অনেকক্ষণ, অনেকক্ষণ। স্বার্থপরের মতো সমস্ত আনন্দটুকু বুকের গভীরে নিশ্বাসের মতো টেনে নিতে চাইলাম। 
তারপর, তারপর হঠাৎ আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গেল। চমকে চারদিকে তাকালাম ।
 
না, কেউ কোথাও নেই। সমস্ত লন ফাঁকা হয়ে গেছে, ইনস্টিটিউটে কেউ নেই। বিলিযার্ড রুমের নুয়ে-পড়া উজ্জল আলোগুলো কখন নিবে গেছে। 
বইটা বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। হয়তো ফিরোজার দুঃখে । তারপর লক্ষ করলাম, খাকী কোট পরা নাইট গার্ড খটখট্‌ বুট পায়ে এগিয়ে আসছে। 
তার দিকে তাকিয়ে বোকার মতো হাসলাম, তারপর সাইকেলের প্যাডেলে পা দিলাম।
 
কিন্তু অসহ্য একটা যন্ত্রণা তখন বুকের মধ্যে। পৃথিবীর প্রতিটা মানুষকে ডেকে ডেকে বইটা পড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে, পৃথিবীর সকলে আমার সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলে উঠুক, অপূর্ব, অপূর্ব !
 
পাখির কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছে হলো। যেন এখনই এই স্বর্গের স্বাদ না দিতে পারলে শান্তি নেই, শান্তি নেই। পাখি, পাখি, পাখি, মনের মধ্যে আবিরাম ডেকে চলেছি।
 
পরের দিনই পাখির সঙ্গে দেখা । বললাম, পাখি, এ বইটা পড়ো। আজই, আজই পড়ে ফেলো। মনে মনে বললাম, পাখি, তোমাকে এক টুকরো স্বর্গ দিলাম। অনেক, অনেক বড়, বিশাল একটা আকাশ দিলাম। 
 নেড়ে-চেড়ে দেখলো পাখি। -- ভালো?
 
বললাম, হয়তো এর চেয়ে ভালো বই আর নেই। আর নেই। 
পরের দিনই উত্তেজনায় ছটফট করতে করতে এলো পাখি। কথা বলতে গিয়ে ওর চোখ-মুখ কেঁপে উঠছে। গলার স্বর গাঢ় হয়ে আসছে।--পড়িনি, পড়িনি অতুলদা, এমন বই আমি কখনো পড়িনি।
--আমিও না।
 
পাখি বললো, আমি ঘুমোতে পারিনি। সারা রাত পড়েছি, আর ভেবেছি।
 
বললাম, আমিও।
 
তারপর, তারপর আমরা দুজনাই হঠাৎ উৎপলবাবু আর ব্রজেনদার ওপর চটে গেলাম । পৃথিবীতে এমন বই থাকতে ওরা যেন আমাদের বঞ্চনা করে এসেছেন, আমাদের সময়, জীবন, আগ্রহ নষ্ট করেছেন । নিজেদের মনে হলো আমরা এতকাল ঠকে গেছি। উৎপলবাবু, আমাদের ঠকিয়েছেন।
 
আমি আর পাখি ইনস্টিটিউটে ঢুকলাম।

উৎপলবাবু বই দিচ্ছেন। জন তিন-চার লোক দাঁড়িয়ে আছে। পাখি বইখানা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল। --কি বাজে বাজে বই দেন উৎপলবাবু, একটাও তো ভালো বই দেন না।

উৎপলবাবু চোখ তুলে তাকালেন। 
পাখি হাসলো। হাতের বইখানা তুলে দেখালো। --এসব বই নেই আপনার ? ব্রিলিয়েন্ট, ব্রিলিয়েন্ট, ভাবতে পারবেন না কি সুন্দর। 
আমি বললাম, এর চেয়ে ভালো বই আমি পড়িনি।

উৎপলবাবু বইটা নিলেন, মলাট উলটে নাম দেখলেন। লেখকের নাম। 

তারপর তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন, এ তো বটতলা । রাবিশ, এসব বই পড়ছো ? 
বলে হেসে উঠলেন। আশেপাশে যারা ছিলো তারাও । 

মনে মনে আমি চুপসে গেলাম। বটতলা ? আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হলো না। পাখির মুখ সাদা হয়ে গেল। ও কোনো কথা বললো না। 
সমস্ত শ্রদ্ধা, সমস্ত ভালোলাগা পলকের মধ্যে মন থেকে মুছে গেল। অপরাধীর মতো আমরা আমাদের ভালো লাগা গোপন করতে চাইলাম । মনকে বোঝাতে চাইলাম, ভুল করেছ, ভুল করেছ। যে লেখককে উত্তেজনায় আনন্দ শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিলাম সেই মুহূর্তে সে টলে পড়লো । তার মৃত্যু হলো। 

আর পাঠকের? সেই মুহূর্তে তার জন্ম হলো, না মৃত্যু, আজও জানি না, আজও জানি না।
 
 
 

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ