আকাশে আগুন, বাতাসে ভাপ। তাপের শিশা পড়ছে গলে। হাসফাস করছে পশুপাখি। অথচ ঠান্ডা-ঠান্ডা লাগছে রহমালির। জ্বর এল নাকি? সে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়, খেজুর গাছের নিচে। ঘর বরাবর এই গাছটাতেই খেজুর ধরেছে বেশি। কাঁদিগুলোর রঙ চড়েছে। কাঁচা সবুজ থেকে সেগুলো এখন উজ্জ্বল কমলা। দিনে দিনে খয়েরি হয়ে উঠবে ওরা। নিখাঁদ খয়েরিগুলো হবে মিষ্টির একশেষ। কিন্তু সদেব আর সদর যেভাবে শকুনের চোখে তাকায়, তাতে গাছে পাকার সুযোগ খেজুরগুলো পাবে না। তার আগেই কেটে নিয়ে জাগ দিতে হবে গোইল ঘরের আড়ায়। সকাল ভোরে ঝাঁকুনি দিলেই তখন অমৃত পড়বে টুপটাপ। ঘোর ঘোর চোখে সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে রহম হিসেব কষছিল কবে নাগাদ কাটলে খেজুরগুলো সবচেয়ে ভালোভাবে পাকবে। তখনই মায়ের ডাক শোনা গেল। শুনতেই ছুট লাগাল সে।
মা বসে আছেন খড়ি জ্বালানির
আড়ালে অন্ধকার হয়ে থাকা রান্নাঘরে। চুলোর আগুনে রাঙা হয়ে আছে মেছতা পড়া মুখ। চোখের
নিচে জমে ওঠা ঘাম; অথবা গড়িয়ে পড়া কান্না; কিংবা দুটোই। সামনে দুটো থালা। একটায় মুরগির
গোশত ভূনা, আরটায় মাছঝোল। বড় দুটো দাগা ভেসে উঠেছে ঘন ঝোলের ওপর। ‘করমের দিয়ে আয়
তো বাপ। বড় মাচের ঝোল খাতি চেয়েচে। কুঁকড়োর রান আর দিলডাও ওর জন্যি দিলাম, যাতি
যাতি আবার খায়ে নিসনে য্যানো! ধাক্করে যা, ও কলাম আর বেশিক্ষণ নেই।’
তা ‘ধাক্কর’ যাওয়ার উপায় কি আর
রহমের আছে!
বাতের ব্যথার শেষ নেই। তারওপর
ভ্যাপসা গরম। ঘুম হয়নি সারারাত। এপাশ ওপাশ করতে করতেই রাত কাবার। আজানের একটু আগ
দিয়ে, আরামদায়ক ঠান্ডায়, চোখ দুটো লেগেছে কি লাগেনি, এমন সময় এভাবেই দেখা দিলেন
মা। চিরকালের মতো দুখী দুখী মুখ। চেহারায় গভীর চিন্তার ছাপ- একদম সেই আগের মতো।
আহা, কতদিন পর! সেবার যখন মসজিদের জন্য জমি দেবেন বলে ঠিক করলেন রহমালি, মা নিষেধ
করেছিলেন। ‘মজ্জিদি তো সবাই দ্যায়। তারচে জমিডা তুই ইস্কুলি দে, নাই হাসপাতাল
বানা। মানষির উপগার হবে।’ মা-ন্যাওটা ছেলে রহম; এতটুকুন থেকে এই থুত্থুড়ে বুড়ো,
অবাধ্য হননি। সেবারও হতেন না। কিন্তু সমাজ বলেও তো একটা কথা আছে। সবার সামনে কথা
দিয়ে কি তার খেলাপ করা যায়? জমিটা তাই ওদেরই দিলেন। দিয়েই ক্ষতিটা হলো। মাস যায়
বছর যায় মায়ের দেখা নেই। বোধহয় রাগ করেছেন। হুজুরের কাছে শুনে কত কী আমল করে
ঘুমিয়েছেন, কাজ হয়নি। আজ হঠাৎ মাকে দেখে তাই স্বপ্নের ভেতরেও খুশি লাগে তার। খুশি
লাগে নিজেকে কিশোর দেখতেও। কী দারুণ দৌড়ে বেড়াচ্ছেন তিনি, সবল সুবল গা-হাত-পা,
মবিল দেয়া বিয়ারিংয়ের মতো সচল হাঁটু, পানির ফোঁটার মতো টলটলে পরিষ্কার চোখ, আহা!
হাতে যখন বাটিটা দেন মা, রহমালির খুশিটা বাড়ে আরো। কাউকে কোনো খাবার দিতে গেলে
যাওয়ার পথেই অর্ধেক সাবাড় করে দিত ছোট্ট রহম।
তবে সেই সুযোগ এবার আর পেলেন না
তিনি, আজান তাকে থামিয়ে দিলো মাঝপথে।
ঘুম ভাঙতেই হাকডাক করেছেন।
হুড়মুড়িয়ে ছুটে এসেছে ছেলেরা বউরা। ঘটনা শুনে অবশ্য তাল পড়ার শব্দে দৌড়ে এসে তিল
দেখার মতো ভাব তাদের। ‘কী যে করো না আব্বা তুমি, বিয়েনবেলার ঘুম এরাম করে নষ্ট করে
কেউ!’ খুব করে বুঝিয়েছেন তিনি তাদের। মামুলি কোনো স্বপ্ন এটা না। মা যা বলেন সব খেটে
যায়। কত বিপদই না এভাবে এড়িয়ে গেছেন তিনি। বাড়ির কত ভালোই না ঘটেছে মায়ের
স্বপ্নাদেশে। তবু পাত্তা দিল না কেউ। তাদের কাজ আছে সকালে, ঘুমোতে হবে।
তখন থেকে উশখুশ করেই কেটেছে
তার। সকালে যখন ভাত দিতে এসেছে মেজোবউ, পাশে বসিয়ে তাকে আবার বলেছেন। একাকার
করেছেন আল্লার দোহাই, মাথার দিব্যি, আর কুরানের কিরে।
তা ভাগ্য ভালো, বউটা বুঝেছে।
‘চিন্তা কোরোনে আব্বা, আজগেরে তো বিষ্যুদবারের হাট। খুকারে পাটায়ে দুবানে। বড় দেকে
এ্যাটটা পোল্টি নিতি বলব, সঙ্গে দুডো মাচ। নে আসলি রানতি আর কতখন? তুমি চিন্তা
কোরোনে।’
না, না, পোল্ট্রির কী খায়!
রাঁধতে হবে ঘরের মুরগি। আর ধরতে হবে দীঘির মাছ।
‘ছিপ ফেলে বিলিত্তে দীগিত্তে
মাচ ধরে আনতো করম। কড়া করে ভেজে মা করত ঝোল। আর ছুঁচোর মতো সারাদিন তা-ই খেতো ও।
আমারও দিত না, জানো! খাতি চালি ও দীগির মাচই খাতি চায়েচে নিচ্চয়।’
সমস্যা সেখানেই। দীঘিটা আর আগের
মতো নেই। চাইলেই ঝাঁপিয়ে পড়া যায় না। ভয়ানক এক ঘটনাও ঘটেছে পরশু রাতে। স্যান করতে
নেমেছিল ময়নার বউ। ‘লাবলি তো সাতরানো আমার অব্যেস। গা হাত পা এটটু ডলে নিয়ে
সাঁতরাতি লাগলাম। ওমা, এটটু দুরি যাতিই দেকি নড়তি পাচ্চিনে আর। শক্তপোক্ত দুডো হাত
যেন আঁকড়ে ধরেচে হাত-পা। কী যে কষ্ট তকন। নাকদে মুকদে পানি উটে যাচ্চে, বেরুয়ে
যাচ্ছে দম। মনে হচ্চে মরে যাচ্চি। তাও বা যা হাচড় পাচড় করে ড্যাঙায় উটলাম, দেকি ও
লোক ভেসে রয়েচ পানিত।’
এরপর আর ওতে নামার সাহস হওয়ার
কথা না কারো। তাছাড়া ছেলেরা ব্যস্ত সবাই। কারো অফিস, কারো আড়ত, কারো মাঠ। পোতা পুতনিদের
স্কুল কলেজ। অগত্যা হাবুকে ধরতে হয়েছে। সেও কি আপছে রাজি হয়? কত বাহানা ফিকির দেন
দরবারের পরেই না নামল!
লাঠিতে ভর দিয়ে তখন পায়ে পায়ে
দীঘির পারে এসে বসলেন রহমালি। ভেতরে ভীষণ ভয়। কখন কোন দিক থেকে কে দেখে ফেলে।
স্যান করাই নিষেধ যেখানে, সেখানে তিনি জাল ফেলাচ্ছেন, ‘জলঘোলা’ না হয়ে যায়ই না।
চিন্তা তো আছেই, চাপ বাড়াচ্ছে তাপও। রোদ তো রোদ না, যেন কাঁঠাল কাঠের আগুন। তায়
বাতাস নেই। গুমোট ভাপ আর তাপ মিলে একদম সিদ্ধ করে ছাড়ছে তাকে। তবু তার ভালো লাগছে
এই বসে থাকা।
কতদিন পর খোলা আকাশ দেখছেন,
কতদিন পর সবুজ ঘাস!
বুড়ো হয়ে গেলে মানুষকে কি আর
মানুষ ভাবে লোকে? তিনবেলা খাওয়া আর পরা দিয়েই শেষ। না আছে গল্প করার কেউ, না আছে
দুঃখ জানানোর। একলা ঘরে শুয়ে বসে কতক্ষণ আর সুস্থ থাকা যায়। বাড়িভর্তি লোক। অথচ
দশজনকে ডাকলে একজন শোনে। যা-ই তিনি বলেন, হেসে উড়িয়ে দেয়। যেন তিনি পাগল, যেন ভাঁড়।
বড় উটকো মনে হয় নিজেকে। কান্না পায়।
কান্না পেল এতদিন পর দীঘিটার
কাছে এসেও।
গা গতরে ভরভরন্তি নেই, তবে
দীঘিটা শুকিয়েও যায়নি একেবারে। খটখটে এই রোদের মরশুমেও তাই রসবতী সে। ছোটবেলায়
রহমেরা ভাবতেন পাতাল থেকে পানি ওঠে বলেই এ শুকোয় না কোনোদিন। সেটাই হয়তো ঠিক। নইলে
যাও, দেখে আসো, জেলার সবচে’ বড় নদীটাও খাবি খাচ্ছে। চেহারায় সে এখন পুরোদস্তুর
নালা। লাফিয়ে পার হয় শেয়াল কুকুর ছাগল। বুক তার পুড়ে যায় পিপাসায়, জুড়োবার পানি
নেই। বর্ষায় যা একটু জমে, বুক বুজে গেছে বলে তা ছাপিয়ে যায় কুল, ছড়িয়ে পড়ে বন্যার
গ্রাস। অথচ এই দীঘি সেই ছেলেবেলায় যেমন ছিল, তেমনই আছে প্রায়। দীঘির পাশে
বাঁশবাগানও আগের মতোই। আগের মতোই তার পাকা পাকা চুল উড়ে এসে জুড়ে বসে দীঘির বুকে।
পানির ওপর কুঁচো শ্যাওলার সবুজ সরের ওপর ঘিয়ারঙের নকশা আঁকে। পার্থক্য শুধু এই,
তাতে ঢেউ তুলে সাঁতরায় না তরুণ তরুণ হাতপা। কাটাগাছের গোড়া ফেলে ঘাট বানিয়ে কাপড়
কাচে না বউ ঝি। কিংবা গোঁড়ালি ভিজিয়ে গা ডলতে ডলতে গল্পের হাট বসায় না কেউ। বোকা
দীঘিটা তাই পড়ে থাকে একা।
শ’খানেক হাত দূরের ঘরটায় তেমন
করেই পড়ে থাকেন রহম। বাইরে কামড়াকামড়ি। এ ওর সে তার লেগেই আছে পিছে। হাউকাউ
কান্নাকাটি ঝগড়াঝাটি। না যায় কান কাড়া, না যায় মন পাড়া। নইলে মনটাকে একটা পাটির
মতো পেড়ে তার ওপর বসে থাকতেন তিনি। জাদুর পাটিটা তাকে উড়িয়ে নিয়ে যেত। ঘুরিয়ে
ঘুরিয়ে দেখাত নিজেরই ফেলে আসা দিন, জ্বেলে আসা রাত।
মাছের জন্য অপেক্ষা করতে করতে
আজ সেই সুযোগই তিনি পেলেন। দীঘির বুকজুড়ে ভেসে থাকা শৈশবটাকে তাই দেখে নিলেন
বুকভরে। দাপিয়ে বেড়ালেন ঝাঁপিয়ে বেড়ালেন। একে একে সামনে এসে দাঁড়াল দুরন্ত দুপুর
কাটেন কুট আর চীৎসাঁতারের প্রতিযোগিরা। দলবেধে এল টেক টেক আর বল খেলার সহযোগিরা।
করম নাদের সদেব আর বাসু।
ওই তো পাড়জুড়ে গাম্বুলগাছের
সারি। গাম্বুল সব পড়ছে টুপটাপ। টপাটপ ওগুলো কুড়িয়ে নিচ্ছে ছেলেরা মেয়েরা। ছুড়ে
মারছে একজন আরেকজনকে। মারতে মারতেই বৃষ্টি। তার বড় বড় ফোঁটা যেন হুল ফোটাচ্ছে
মাথায়। দীঘির পানিতে বৃষ্টিফোঁটার ফুল। চারপাশে বৃষ্টির ঘোলাটে আড়াল। সামনেই করম,
অথচ দেখা যাচ্ছে না ওকে। বাজ পড়ছে। ধনুকের ছিলার মতো বেঁকে যাচ্ছে পাড়ের নারকেল
গাছগুলো। বাঁশেরা তো একেবারে নুয়েই পড়ছে পানিতে, জোর বাতাসে শপাং শপাং আঘাত। শপাং
শব্দেই মনে পড়ল চাচা আজ কাজে যায়নি। এই ঝড়ঝঞ্ঝায় করমকে নিয়ে বাইরে থাকার ফল ভালো
হবে না। ভয়ে ভয়ে উঠে আসেন যখন, চোখগুলো ফুলে তখন ঢ্যাপ। লাল টুকটুক ঢ্যাপগুলোর
সামনে যা পড়ে, ঝাপসা সব। তবু স্পষ্ট দেখা যায় চাচার হাতে লাঠি। এমনিতেই হুটহাট
রেগে যান, তারওপর তাদের এই ভূতসাজ। রাগটা বাড়ারই কথা। মোটা মোটা দাগ হয়ে তা বসে
গেল রহমালির পিঠে।
বাপ মারা যাওয়ার পর চাচার বউ
হয়েছে মা। তাদের ঘরের করম একদিক থেকে চাচাত ভাই। আবার মায়ের পেটের ভাই বলে ভাইও।
একের ভেতর দুই; না, আসলে তিন। সবচেয়ে ভালো বন্ধুও তো রহম করম। তা যা হোক, মারের
চোটে অথবা ভেজার ফলে সেদিন বিকেলেই জ্বরে পড়ল রহম। সে কি যে সে জ্বর? দুনিয়ার তাপ
গায়ে, গরম যেন চুলো। ঘোরে ঘোরে ভুল বকে রহম, আর আবোল তাবোল গায়। মাথায় পানি দিতে
দিতে মা ফেটে পড়েন রাগে। শ্বশুরের কথা শোনাটাই ভুল হয়েছে। সম্পত্তি টিকিয়ে রাখার
জন্য এভাবে কেউ দেওরকে বিয়ে করে? সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একবারও কি বুড়ো ভাবেনি
সম্পদের চেয়ে জীবন বড়? সম্মান বড়? বিটারবউ না হয়ে নিজের মেয়ে হলে কি তার জীবনটা
এমন করে নষ্ট করতে পারত সে?
তুমুল ঝগড়া সেদিন। মা বলেন,
তিনি আলাদা থাকবেন। না হলে কথা দিতে হবে চাচা অপ্রয়োজনে রহমের গায়ে হাত তুলবে না।
আর প্রয়োজন হলে করমের গায়েও তুলবে। যত দোষ সব নন্দ ঘোষকে চাপিয়ে বাপমরা ছেলেটার
ওপর এই অত্যাচার সহ্য হয় না তার। চাচাও ছিলেন রাগী। ‘যা মাগি, তুই তোর ছেলে নিয়ে
থাক। আমার ঘরেত্তে বের হ’।
এই অপমান সহ্য করার মানুষ মা
না। বললেন, ‘দুডোই আমার ছেলে, যাতি হলি দুডো নিয়েই যাব।’
কিন্তু চাচা তা শুনবেন কেন?
মাও বসলেন বেঁকে। এ সংসারে তার
অধিকার আছে, তার ছেলের অধিকার আছে। চাচা চুপ থাকলেন কিছুক্ষণ। অধিকার বুঝিয়ে দিয়েই
তারপর তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন বাপের বাড়ি। বাড়িটা গ্রামেই। তবে নানার বাড়ি উঠলেন না
মা, ঘর করলেন দীঘির পাড়ঘেঁষে। ঘাট বাঁধালেন ওপারের মতো করেই। সকাল বিকেল ঠিকই তার
করম ছুটে আসবে তার কাছে। রহম করম আবার খেলবে আবার সাঁতরাবে। মারামারি করবে, আবার
ঘুমোবে জড়াজড়ি। রাগ পড়লে চাচা তাকে ঘরে টেনে নেবেন, এই প্রত্যাশাও হয়তো করছিলেন।
কিন্তু রাগ অভিমান আর ক্ষোভ
মাঝরাতের ঘনত্ব পেরিয়ে যখন হালকা ভোরের মতো হালকা হতে শুরু করেছে, দুটো উঠোন এক
উজ্জ্বল হওয়ার ঠিক আগে আগে, তখনই কাঁটাতার পড়ল। ক’ফুট বেড়ার কোপে ভাগ হয়ে গেল
আকাশ। আর সংসার। আর এই দীঘি। এপারে তার এক ঠিকানা, ওপার জুড়ে আর এক। দুপার থেকে
দুটো ধর্ম তারপর বারবার তাড়া করেছে একে অন্যকে। মা গিয়ে তাই হাতে পায়ে ধরেছিল
চাচার। ‘এদিকি থাকা তুমার জন্যি এ্যাকন নিরাপদ না। আমাগের দিকি চলো। যা হওয়ার তা
তো হয়েচেই, আর কত? চলো সবাই এক হয়ে থাকি।’ যুদ্ধের সময় আবার উল্টোটা। মা তখন নেই,
চাচা এসে ধরল রহমকে। ‘চলো, আমাদের সাথে থাকবা। সব ঠান্ডা হলি তারপর আবার না হয় চলে
এসেনে।’ কিন্তু মাকে একা ফেলে কী করে যেতেন রহমালি? দু’ভাইয়ের মিল তা’বলে কমেনি।
সুযোগ সময় হলেই চলে আসত গাধাটা। গরুটাও ছুটে যেত ফাঁক পেলেই। ভাইকে রহম ভালোও বাসত
খুব। টানটা আজো অটুট। কলিজার টুকরো সেই করম আজ মরার পথে। তার শেষ ইচ্ছেটা কি রহমের
যে মূল্যেই হোক পূরণ করার উচিৎ না?
ঘণ্টাখানেক জাল বেয়ে গেল হাবু।
রুই মিরগেল চুনোপুঁটি ভুরিভুরি- মাছের অভাব নেই। কিন্তু যে মাছই ওঠে ‘ছেড়ে দে ভাই,
ছেড়ে দে। আমাগের লাগবে কাতলা। স্বপ্নে আমি কাতলাই দেকিচি।’ বলে মাথা খেয়ে ফেলছে
বুড়ো। কেন রে ভাই, জাল ফেলতে কষ্ট হয় না বুঝি? কাতলা লাগবে ভালো কথা, কিন্তু না
পেলে অন্যগুলো তো নেওয়া যায়। তা না, বুড়ো আছে তার গোয়ার্তুমি নিয়ে।
বিরক্তিটা হাবু গোপনও করছে না।
রহমালিরও মনে হচ্ছে মাছগুলো নিয়ে নিলে ক্ষতি কী? এমনিতেই বাড়িতে কেউ মান্যগন্য করে
না। তার উদ্যোগে কিছু পেলে নিশ্চয় খুশি হবে তারা। আবার ভাবেন, এই বয়সে চুরির দায়
নেবেন? কিন্তু ঠিক-ভুল ঠিক করতে না পেরে তিনি এড়িয়ে যান কথা। ‘অধৈজ্জ্য হোসনে ভাই।
আর এটটু বা, সবুরি দেকবি ঠিকই মেওয়া ফলবেনে।’
মেওয়ার অপেক্ষায়ই বসে আছেন
তিনি। বসে আছেন ওপারের বাড়িটায় চোখ ফেলে।
চোখে আর আগের জোর নেই। দূরের
জিনিস খুব ক্ষীণ আর ঝাপসা। না হলে ঠিকই বলে দিতে পারতেন উঠোনে কে কাপড় নেড়ে দিয়ে
গেল। আর কে কী করে বেড়াচ্ছে। তাতে করে ঠিক বোঝাও যেত করমের অবস্থা। আচ্ছা, ওর
ছেলেমেয়ে কি আসতে পেরেছে? বড় বড় চাকরি তাদের, বড় বড় দায়িত্ব। হিল্লি দিল্লী বাস।
চাইলেই কি আসা যায় হুট করে? ছোটখোকা তো ঢাকা থেকেই আসতে পারে না। তাদের অফিসের কাজ
টানে, বউ-বাচ্চা টানে; বাপ-মা টানে না। বুড়ো বাপ বুড়ি মা তো খালি বোতল, ভেতরের তরল
খাওয়া শেষ, এখন ফেলে দেওয়াই দস্তুর। তাই বলে এই শেষ সময়েও কি পাথর হয়ে থাকবে তারা?
নিশ্চয়ই না। খোঁজ নেওয়ার জন্য দু’তিনটে হাক অবশ্য রহম দিয়েছেন। সাড়া দেয়নি কেউ।
গলা বাড়ালেই হাঁপানি। কাশতে কাশতে রক্ত। উঠলে আর থামে না। কষ্ট তো আছেই, ছেলে
ছেলেবউদের মুখ ঝামটাও বাড়ে। হানেফ ডাক্তার ডাকাত বড়, বিল বেশি নেয়। তারচেয়ে বরং
থাক, ডাকাডাকি আর না করুন। মাছটা ধরতে পারলে বিকেলে তো যাচ্ছেনই দেখতে।
তা এই যাওয়া নিয়েও দুশ্চিন্তা
আছে। কী হয় না হয় বলা মুশকিল।
এমনিতে কড়াকড়ি ছিল না, পরশু
মহরম মরেই পাকিয়ে গেছে ঝামেলা।
ডাক্তার কবিরাজ এক করে গুলে
খেয়েও বাচ্চা হয়নি। লোকে বলছিল, ‘দেশের ডাক্তাররা চিকিসসা কত্তি পারে? ইন্ডিয়া নে
যাও, দেক্যানে সব ঠিক হয়ে যাবেনে।’ মহরমকে নিয়ে ময়না তাই পার হয়ে গিয়েছিল দীঘিটা।
ওষুধপত্র নিয়ে ফিরছিল পরদিন রাতে। ঘাটে নামতেই ওপার থেকে দৌড়ে এসেছে গুলির ঝাঁক।
কপাল ভালো, ময়নার লাগেনি; তবে বর উঠেছে ভেসে। বিজিবির ভয়ে এখন মেছোভূতে পা টানার
গল্প ফেঁদেছে। আর পেপারে লিখেছে ‘গোসল করতে গিয়ে জীবন গেল কৃষকের।’ তা অবশ্য
মিথ্যে কিছু না। কৃষকই হোক বা গরু, পারাপারের সময় চোখে পড়লে গুলি তো ওরা করেই।
কতজনকেই তো মরে থাকতে দেখলেন রহমালি এই জীবনে। কত যে হিস্টরি সেসব! নদীরা এদেশ
বিদেশ ঘোরে, তার সাথে ঘুরতে যায় ঘটনাও। গিয়ে কিছু হারিয়ে যায়, কিছু আবার কমে বেড়ে
ফেরে। কিন্তু দীঘি তো ঘরোয়া, তার ইতিহাস আটকে থাকে চারপাড়ের মধ্যেই। দীঘির বুক তাই
ভার থাকে বেশি। করমকে দেখতে গিয়ে, আল্লা না করুক, তিনিও যদি নুইয়ে পড়েন সেই ভারে!
তার সম্ভাবনা অবশ্য কম। রহমালি যাবেন বিকেলে। ফিরেও আসবেন বেলা থাকতে থাকতে। ওই
সময় সাধারণত গুলি করে না ওরা।
‘তোর কতাডাই ঠিক রে বুড়ো, কাতলা
মনে হয় পাইচি এবারা!’ চীৎকার করে উঠল হাবু। আর স্থির বিশ্বাসে নড়েচড়ে বসলেন
রহমালি। ‘শিরদাঁড়াখান দেকেই বুজচি শালা ইয়াব্বড় মাল! চিন্তা করিসনে, ধরে ফেলচি
দাঁড়া।’ মাছটা ভাসছে মাঝপুকুরে। খুব ধীর তার নড়াচড়া। যেন আঘাত পেয়েছে, বা অসুস্থ,
বা মরতে বসেছে। জাল না গেলেও, একডুবে ওটুকু যাওয়ার সামর্থ্য হাবুর আছে। ধরতে
পারলেই দফারফা। সে তাই নেমে পড়ারই সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু কাছা মারতে মারতেই দেখা
যায় ওপারের আমবাগানে একপাল বিএসএফ।
দেখেই চমকে ওঠে ছেলেটা। এখন কী
হবে, যদি দেখে ফেলে ওরা? যদি গুলি করে! কাঁপতে থাকে ভয়ে। কাঁপুনি আরও বাড়ে যখন
দেখে তাদের কাঁঠালবাগানে বিজিবি। ওরে আল্লা! যুদ্ধ লাগবে নাকি? তা কেন? ভারত না
আমাদের বন্ধু? অবশ্য রাজ-রাজড়ার ব্যাপার, কিছু বলাও তো যায় না। আজ যে কারণে বন্ধু
কেউ, কাল হয়তো সে কারণেই শত্রু সে। ফলে যুদ্ধ যে একটা হতেও পারে, সেটা অন্তত
অবিশ্বাস হয় না হাবুর। মুক্তিযুদ্ধের যত গল্প শুনেছে, যুদ্ধের যত বই দেখেছে, সব
এসে ভীড় করে অস্থির দু’চোখে। দু’পারের বন্দুকের মাঝে পড়ার শঙ্কায় তাই উঠে আসে
পড়িমরি। জাল লুকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে হুঁশিয়ারি দেয়। ‘ধরতি যদি আসে বুড়ো, তুমাক
দেকায় দোবো। বলে দোবো সব তুমার কাজ।’ রহম আলীরও ভয় করে। বুড়ো বয়সে অপদস্ত হতে হবে।
তবে তেমন কিছু হয় না। জায়গা
খুঁজে কয়েকটা তাঁবু খাটায় বিজিবি বিএসএফ। আর কয়েকজন এসে নেমে যায় পানিতে। হাবু বলে
‘ওগের হাতে যেই জাল দেখচিস না, ওরেই কয় কারেন্টের জাল।’
‘কী বলিস, মাছ ধরবে নাকি?’
‘তা না তো কী, পানির মদ্যি জাল
দিয়ে কি লোকে মুরগি ধরে?’
তা যা-ই ধরুক, ওপার যাওয়াই তো
আটকে যাবে তার! সন্ত্রস্ত হন রহম। হাবুর অবশ্য স্বস্তি লাগে। যাক, বাঁচা গেল। বড়
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়তে গিয়েই আবার আটকে যায় মাঝপথে। এগিয়ে আসছে এক বিজিবি। এই
রে!
দ্রুতপায়ে তখন এগিয়ে আসে জওয়ান
কামরুল। সব শুনে সে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে ‘চিন্তা করিও না চাচা। ইংকা
মাছ পালি তুমারে দিব এ্যালা। এইবেলা দুরি যায়ি বসো। ছার আসি তুমারে একেনে দেকনু
রাগি যাবো এ্যালা।’ ছেলেটাকে ভালোই লাগে রহমালির। কথায় কথায় বৃত্তান্ত জানতে চান।
কী কারণে তাঁবু, কেনই বা এই কারেন্ট জাল। কখন তারা যাবে।
বিস্তারিত বলার সময় নেই, তার
অনেক কাজ। তবু যতটুকু বলা যায়, সংক্ষেপে বলে কামরুল।
মহরম মরার পর হুলস্থূল পড়ে
গেছে। এবারও ভারত দোষ দিচ্ছে বিজিবিকে। তাদের চোখ গলে ভারতে ঢোকে কী করে
চোরাকারবারিরা? আর বরাবরের মতো ফুঁসে উঠেছে এদেশও। কথায় কথায় এত গুলি ছোড়ে কেন
বিএসএফ? দুদিন না যেতেই লাশ। কেন? বড় বড় অপরাধী সন্ত্রাসী মাদকওয়ালা হলে ধরবি ধর,
বিচার কর, সাজা দে। তা না, খেটে খাওয়া সাধারণ এসব নিরীহ মানুষ মেরে তারা কী উদ্ধার
করতে চায়? সবমিলে বেশ একটা গুমোট ভাব।
বিএসএফের আঞ্চলিক কমান্ডার সিবি
পানোয়ারের বার্তা এসেছে। ক্ষমা প্রার্থনা করেছে তারা। পরবর্তীতে এমন ঘটনা যেন আর
না ঘটে সেক্ষেত্রে সচেষ্ট থাকবে তার বাহিনী। ‘ভ্রাতৃপ্রতিম দুই বন্ধুদেশের মধ্যে
এমন ছোটখাট ব্যাপারে মনোমালিন্য বড় ঝামেলার কারণ’ বলে তিনি মনে করেন। সীমান্তের এই
দিকটা তুলনামূলক কম সুরক্ষিত বলেই যত ঝামেলা। তাই দীঘিটার মাঝখান দিয়েও কাঁটাতার
লাগানো হবে। এদিকের কোনো মাছও যেন ওদিকে যেতে না পারে আর। সে জন্য দীঘির পানি
নিষ্কাশনের দরকার। দুই পক্ষের উপস্থিতিতেই করা হবে সেটা। কাজ শুরু হবে কাল। আজ
পতাকা বৈঠক। এবং সৌজন্য বনভোজন। দীঘি থেকে মাছ ধরে দীঘির পাড়েই রান্না। আহা!
আয়োজনের হইহল্লায় নিশ্চয় মিটে যাবে বিরোধও।
পানোয়ার সাহেব এসে গেছেন।
বিজিবি অধিনায়ক আসহাব আলীও এসে পড়বেন শিগগিরই। শুনেই দৌড় লাগায় হাবু। বিজিবির গাড়ি
ঢুকতেই ভীড় করেছিল গ্রামবাসী। তারাও কেউ কেউ যায়। কেউ কেউ ঘরের আড়ালে গাছের ওপাশে
বেড়ার পেছনে দেহ লুকিয়ে মুখটুকু বের করে রাখে। যেন বিএসএফ বিজিবি দেখাও একটা
বিনোদন।
বসে বসে তখন টলতে থাকেন রহমালি।
কান্না লাগে তার। সারাটাজীবন এমন আপসোস করেই গেল।
সবকিছুতেই তার আয়োজনের বাহার।
আটঘাট বেঁধে কেজি-বাটখারা ভেঙে বসতে বসতে দেখা যায় হাটের সময় শেষ। মাছ মাছ না করে
যদি সকালেই চলে যেতেন, চোখের দেখাটা তো অন্তত দেখা হতো। রাগ হয় নিজের ওপর, রাগ হয়
ছেলেদের ওপরও। নিজেদের দরকার হতো, শালা-শালী-শ্বশুরের দরকার হতো, লাফাতে লাফাতে
ঠিকই ব্যবস্থা করে দিত সব। শালার নিজের জামাইটা আবার উল্টো, অকম্মার ঢেঁকি একখান।
একে তাকে ধরে যাও বা একটু উপায় তিনি করলেন, এখন মনে হয় তাও গেল বিফলে। মায়ের কথা
রাখতে পারলেন না। করমকে দেখাও বোধহয় আর হলো না। এজন্যই লোকে বলে, ভাগ্যে না থাকলে
জিবের জলও গলায় না ঢুকে বাইরে পড়ে। তাই বলে এভাবে! ভাবতেই মোচড় দিল বুকে। আহারে,
কতদিন সোনাভাইটাকে দেখেন না!
দোষটা তারই। বেশ কিছুদিন ধরে
খবর পাঠাচ্ছে করম। শরীর খারাপ না হলে সে-ই আসত। কিন্তু যাননি রহমালি।
শেষবার যখন গিয়েছিলেন, করমের
মেজো ছেলেটা তখন বাড়ি। বড় বড় শহরে কায়কারবার, পেলেনে গাড়িতে চড়ে। কোটিপতি হিন্দু শ্বশুর।
টাকার থলকুল নেই। কী দেমাগ তার! রহমালিকে তো পাত্তাই দিল না। যা দু’একটা কথা বলল,
হিন্দীতে সব। এই হয়েছে এখনকার পুলাপানের সমস্যা। ‘গ্রাম পেরুতেই শউরে, ইস্তিরি কয়
বউরে।’ বাড়ি এসে তার ছোটখোকাও এমন করে কথা কয়, যেন ভাষণ দিচ্ছে টিভিতে। এরকম
আজগুবি ভদ্রলোকি চাল খুব অপছন্দ তার, করম জানে। ছেলেকে তাই শাসাচ্ছিল বারবার। কাজ
হয়নি। আবার ওদের সরকারও নাকি ওদের বের করে দেবে, শোনা যাচ্ছে। এখানে-সেখানে পিটিয়ে
পুড়িয়ে খুঁচিয়ে মানুষ মারার খবর আসছে। খুব আতঙ্কে ছিল করম। চৌদ্দপুরুষ ধরে তাদের
বাস ওই গ্রামে, হঠাৎ কী এমন হলো যে সে আর থাকতে পারবে না? সবমিলে কেমন কাটে করমের
দিন তার একটা ধারণা তাই সেবারই পেয়েছেন। দীঘি যখন এক, এপার বলো ওপার বলো, পানিও তো
তার একই। পানির ওপর সেই এক কুঁচো শ্যাওলারই ছবি। তা মেখে ওই যে রহম ফিরলেন, সেই
থেকেই পড়ুটে, হাঁটাচলা দায়। তাও যে ইচ্ছে করলে যেতে পারতেন না একবার, তা না। কেন
যে গেলেন না! এখন এই যন্ত্রণা।
মা মরার দিনও এমন হয়েছিল।
পঁয়ষট্টির যুদ্ধ চলছে তখন,
কড়াকড়ি খুব, আসতে পারেনি করম।
মাকে যখন নামানো হচ্ছিল কবরে,
মনে আছে, এপারে কাঁদছিল রহম। গলা ছেড়ে ওপারে কাঁদছিল করমও। চাচা বসে ছিলেন থম
মেরে। তার ক’বছর পর, তখন বাংলাদেশ হয়েছে, মারা গেলেন চাচা। তখন থেকেই মনে হতো এক
হয়ে যাক সব, এপারে চলে আসুক করম। করমও তা-ই বলত, ওপারে চলে যাক রহম। কিন্তু বাপকে
ছেড়ে মা কে ছেড়ে কেউ নড়তে চায়নি।
আজ অবশ্য চেয়েও লাভ হচ্ছে না।
লাভের কোনো লক্ষণ পানোয়ার
সাহেবও দেখছেন না। যে উদ্দেশ্যে বনভোজন, তার সিকিভাগও অর্জন হবে কি না সন্দেহ। এই
হচ্ছে বাঙালি, দু’পাতা কাজ তো চারপাতা বিশ্রাম লাগে এদের। সবমিলে এই ঢিমে তেতলা
কাজের গতিতে তিনি বিরক্ত। তবে সেটা প্রকাশ করছেন না, লুকিয়ে রেখেছেন মোটা গোঁফের
আড়ালে। আবার খানিক হাসিও ঝুলিয়ে রেখেছেন চওড়া দুটো ঠোঁটে।
হাসতে হাসতেই আসহাব আলীকে
বললেন, বসে থাকতে থাকতে ঘুম ধরে গেছে। দীঘির চারপাশটা তাই বেড়িয়ে নিতে চান তিনি।
একটু হাঁটাও হবে, রেকি করাও হবে।
পূর্বপশ্চিম দীঘি। উত্তর
পাড়জুড়ে বাঁশঝাড়। বাঁশেরা অবুঝ। বোঝে না যে তারা দুই দেশের নাগরিক। আপনজনের মতো
নিজেদের জড়িয়ে ধরে নিবিড় আড়াল গড়ে। সে আড়ালে অনায়াসে এদেশি লোক ঢুকে ওদেশি, আর
ওদেশি ঢুকে এদেশি হয়ে বের হয়। হাঁটাপথটা স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। মালপত্র নিয়ে একবার
ঢুকতে পারলেই সোজা ওপার। পানোয়ারি ভাবেন, দীঘিটার সাথে সাথে এই বাঁশবনের পিন্ডি
চটকাতে হবে। ওই যে বিপরীত পাশে দুটো বাগান- আমের আর কাঁঠালের, ফল আলাদা হলেও আড়াল
তো তাদের একই। মাদক থেকে শুরু করে মানুষ পর্যন্ত- কী না পাচার হতো ওই পথে? তিনিই
বুদ্ধি করে থামিয়েছেন সব। ভালোই চলছিল, ঝামেলা পাকিয়ে গেল ওই শুয়োরটা, মহরম না কি
যেন নাম। হারামিটার জন্য কত রঙের কালিই না গায়ে লাগল কাল থেকে। এর শেষ না দেখে তার
কাজ নেই আর।
হাঁটতে হাঁটতে বাঁশবন পেরিয়ে
আসেন তারা। আর কাছাকাছি হতেই হাওমাও করে কেঁদে ওঠেন রহমালি। আর্তি শুনে রাগ হয়
পানোয়ার সাহেবের। আইনকানুন কিছু মানে না এরা। দুটো আলাদা দেশ, ভিসা আছে পাসপোর্ট
আছে, যাতায়াত করবি আইন মেনে কর। তা না। উঠল বাই, চল দিদি বৃন্দাবন যাই। যেন এপাড়া
ওপাড়া! সবুজ ঘাসের মসলিনবুকে বুটের দাগে বিরক্তি মাখিয়ে এগিয়ে যান তিনি। লোকজন
ডেকে আয়োজনের কথা জিজ্ঞেস করেন। খিদে পেয়েছে, একটা মিটিংও আছে সন্ধ্যায়। ব্যক্তিগত
বাবুর্চ্চি সিন্ধিকে তাড়া লাগান। তারপর ঢুকে পড়েন তাঁবুতে ।
এদিকে আসহাব আলীর মন খারাপ।
চোখভরা মায়া নিয়ে তিনি তাকিয়ে থাকেন রহমালির দিকে। কিন্তু কিছু করারও তো নেই।
তাকে একা দেখেই এসে দাঁড়ায়
কামরুল। একথা সেকথা বলে, অগ্রগতি জানায়। তারপর তোলে বুড়োর কথা। একটা কাতলা মাছের
অপেক্ষায় বসে আছে সে। ‘কী বলো! আমাকে তো বলল ওপারে যাবে ছোটভাইয়ের কাছে! কী যে
ছ্যাঁচড়া এরা, এদের জন্য মান সম্মানও থাকে না।’ রাগে গজরাতে গজরাতে চলে যান তার
তাঁবুতে। কথাটা ভেঙে বলার সুযোগ তাই আর হয় না কামরুলের।
অন্য রান্না সবই প্রায় শেষ;
মাছের জন্যই অপেক্ষা এখন তার।
কয়েকজন মহিলা এসেছে। বিয়েবাড়ির
মতো বড় বড় দা বটি নিয়ে মাছ কুটছে তারা। কুটা বাছা হলেই রান্না চড়বে। একটা পান মুখে
নিয়ে চিবুচ্ছে কামরুল। চিবুতে চিবুতে পোলাওয়ের চুলোয় জাল ঠিক করে দিচ্ছে; রেজালার
হাঁড়ির ঢাকনার ওপর জ¦লন্ত কয়লা সাজাচ্ছে। আর ফাঁকে ফাঁকে তাকাচ্ছে রহমালির দিকে।
আগের মতোই বসে আছে বৃদ্ধটা। মাথার
ওপর থেকে সরে গেছে ছায়া। তিনিও যে একটু সরে বসবেন, হুঁশ নেই। একমনে তাকিয়ে আছেন
ওপারে। আহারে! লোকটার জন্য কিছুই কি করতে পারবে না সে? আগের স্যারের কথা মনে হয়।
তিনি থাকলে গিয়ে শুধু বলতে হতো ঘটনাটা। এতক্ষণ কখন ব্যবস্থা করে ফেলতেন সব! নিয়মের
চেয়ে পরিস্থিতি আর বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিতেন তিনি। আসহাব স্যার তেমন না। তার কাছে
আইনই সব। আর এত কাঠখোট্টা, গায়ে সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে দিলে মনে হয় রক্ত না বের হবে আঠা।
ভাবতেই পেছনে বুটের শব্দ। স্যার! কামরুলের ভাবনাও যেন বা পড়ে ফেলেছে লোকটা, ভেবে
চুপসে থাকে সে।
আসহাব যদিও বলেন না কিছু। শান্ত
চোখে তাকিয়ে থাকেন দীঘির দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। ‘তেমন হলে একটা মাছ দিয়ে দিও
বুড়োকে।’ বলে চলে যান আবার। অমনি মন ভালো হয়ে যায় কামরুলের। তখনই ঘাটতে থাকে মাছের
ড্রাম। এটা সেটা মাছ প্রচুর রকমের, কিন্তু কাতল নেই একটাও। বড়সড় একটা রুইয়ের পিঠে
কিসের যেন ক্ষত। উল্টেপাল্টে সেটাই দিয়ে পাঠায় সে, তবে নিলেন না রহমালি। রুই নিয়ে
তার কাজ নেই।
কিন্তু কামরুলের তো আছে। সে
ব্যস্ত হয়ে পড়ল তেল-কড়াইয়ের হিসেব নিয়ে।
মাছের শেষ পদটা রাঁধতে রাঁধতেই
কামরুলের কানে এলো কান্নার রোল। শুনতে শুনতেই চুলোয় পেকে উঠল ঝোল। তারপর পাত পড়ল
খাওয়ার।
জওয়ানরা বসেছে মুখোমুখি।
কর্তারা বসেছেন পাশাপাশি। পাশাপাশি দু’দেশ। পারস্পরিক সম্পর্কের এ এক দারুণ
মাইলফলক। দুই দেশের সাংবাদিকরা এসেছে। বৈঠকের খবর গুরুত্ব দিয়ে ছাপতে হবে। ছাপতে
হবে বনভোজনের ছবি। তবে আপাতত খাওয়া নিয়েই ব্যস্ত সবাই। ব্যস্ত ভীষণ ক্যামেরাগুলোও।
একচোখা দৈত্যের মতো তারা স্থির তাকিয়ে আছে দুই দেশের দু’পেয়ে জন্তুদের দিকে।
কাশ্মির থেকে আনা সুগন্ধী চালের
পোলাও। সঙ্গে কড়া করে ভাজা মাছ। খাসির রেজালা। মাছভূনা। ম ম করছে সুবাস। সবাইকে
খাবার বুঝিয়ে দিয়ে বের হলো কামরুল। হাতে একটা থালা। থালায় দুটো বাটি। একটায় খাসি,
আরেকটায় মাছভূনা। রুইমাছের একটা মাথা একটা লেজ আর একটা দাগা তাকিয়ে আছে। সেগুলোকে
কাতলের অংশ মনে হতেই বুকটায় আবার মোচড় দিলো রহমালির।
দীঘিটা ভাগ হবে কাঁটাতারে-
কামরুলের মুখে শোনার পর থেকেই এলোমেলো লাগছে। সেই যে তার কিশোরচোখের সামনেই ভাগ
হয়ে গেল সব, ভাগ হয়ে গেল এমনকি পোষা টিয়েটাও, তার ক্ষতই তো দগদগে এখনও। যদিও
কাঁটাতারের কেরামতি শুরুতে বোঝেনি সে। কদিন তো মনেই হতো সব আগের মতোই আছে। বিছানার
ওপাশে হাত দিলেই পাওয়া যাবে করমকে। খেতে বসে ‘ওই দ্যাক দ্যাক’ বলতেই বাইরে তাকাবে
করম আর ওর পাতের মাছটা গোশটা ডিমটা, কখনো পুরো থালাটাই, নিয়ে লুকিয়ে রাখবে রহমালি।
মা পর্যন্ত করমের গালে ভাত দিয়েই পরের নলাটা এগিয়ে দিতেন তার ডানে বাঁয়ে, যেন পাশে
বসেই খাচ্ছে করম। টিয়েপাখির আদার নিয়ে কতবার যে রহম ছুটে গেছে বারান্দায়! গিয়ে
দেখেছে আগের মতোই আছে সব, তবু আর কিছুই নেই আগের মতো। দুজনের মাঝে সবুজাভ কাচের
দীঘি। তবু তো সেটা দীঘিই ছিল, আজ থেকে সেটা হবে সমুদ্রপায়। ভাবতেই মনে হচ্ছে জংধরা
কাঁটাতার দিয়ে যেন তার কলজেটা বাঁধছে কেউ।
যন্ত্রণার ছানিপড়া টলমল চোখে
তিনি কামরুলের চোখের দিকে তাকালেন। সোজা, অপলক। তাকিয়েই থাকলেন। টুল থেকে পড়ে গেলেন
তারপর। হুমড়ি খেলেন পায়ে। ‘বাছা আমার, বাপ আমার, মাচ লাগবে না। ওপারে যাতি দ্যাও
এটটু, দয়া করো। ভাইডারে শেষ দ্যাকাডা দ্যাকতাম।’
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল কামরুল।
ছোট্ট দীর্ঘশ্বাসটা গোপন করল। তারপর ফিরে গেল টুলের পাশে প্লেটটা রেখে। গিয়ে আবার
হাত লাগাল খাদিমদারিতে।
দুই কর্তার পাতে বড় বড় দাগা আর
পেটি। যে যুগে হা করলেও মুখে ফরমালিন ঢোকে, সে যুগে এমন করে রান্না টাটকা তাজা
মাছ। আর কী অসম্ভব ভালো রান্নার হাত সিন্ধি ব্যাটার! প্লেটের একটা পেটি আসহাব
আলীকে তুলে দিলেন পানোয়ার সাহেব- খেয়ে দেখুক বাঙালি, রান্না কাকে বলে। সাথে একটু
আন্তরিকতাও দেখানো গেল। উল্টো দিক থেকেও এমন করে চলে আসা দাগাটা দেখে অবশ্য
বিরক্তই হলেন। সিনিয়র মানুষ তিনি, ভালোবেসে মাছটা দিয়েছেন। তাই বলে মি. আসহাবের কি
উচিৎ হয়েছে তার পাতেও এভাবে মাছ তুলে দেওয়া? পাততোলা খাবার তিনি খান না, তবে আজ তো
সব সম্পর্কের সুতোয় বাঁধা। মাছটা মুখে দিতেই যদিও বুঝলেন, যে স্বাদ, এটা না খাওয়া
ভুল হবে। আরেকটু ভেঙে নিলেন তাই। নিতেই টাং করে একটা শব্দ হলো প্লেটে। কিছু একটা
খসে পড়েছে দাগাটার গা থেকে। সবাই মজা করে খাচ্ছে, গমগম করছে জায়গাটা। তবু শব্দটা
তার কান এড়াল না। ব্যাপার কী? খেয়াল করতেই দেখা গেল চকচকে ধাতব বুলেট। মাছের মাংসে
বুলেট! এ কী দেখছেন! অবশ্য বুদ্ধিমান মানুষ তিনি, বুঝতে সময় লাগল না। তবে ঠিক করতে
পারলেন না করণীয়। না পারলেন মুখের মাছটুকু ফেলতে, না পারলেন গিলতে। পাতের মাছটাও
ফেলা গেল না তাককরা ক্যামেরা আর তাকিয়ে থাকা সাংবাদিকদের সামনে। এত এত চোখের সামনে
থেকে বুলেটটা সরানোও ঝামেলা হয়ে দাঁড়ালো। ভেতর ভেতর ঘামতে লাগলেন তিনি।
এই যখন পরিস্থিতি, তখনই সবচে’
বড় রোলটা উঠল ও বাড়িতে। উঠতেই থমকে গেল চিবুতে থাকা মুখগুলো। কিছুক্ষণ পর আবার
শুরু হলো খাওয়া। দীঘির পানিতে হঠাৎ একটা ঝুপ আওয়াজ শোনা গেল তখন। আতঙ্কিত চোখে
রহমালির দিতে তাকালেন আসহাব আলী আর কামরুল।
না, রহমালি বসেই আছেন টুলে।
তার মনে হলো ওই নারকেলটার মতোই
যদি ঝাঁপ দিতে পারতেন দীঘিতে। সাঁতরানোর ক্ষমতা নেই, কিন্তু ডুবতে তো পারতেন। লোকে
বলত একই সাথে মরেছে দুই ভাই। বুকটা খা খা করছে তার। ইশ, একবার যদি যেতে পারতেন
কোনোভাবে। মুখে ফুঁ দিয়ে শ্বাস আনার ব্যবস্থা শিখেছিলেন ছোটবেলায়। কিন্তু এপারের
শ্বাসে কি আর ওপারের প্রাণ জাগে? উত্তরহীন অশেষ এই প্রশ্ন হয়েই পুকুরটা পড়ে থাকলো
মেঘলামুখে। মাছের লাফানো ঝাপটানো নেই। নেই অবিরাম নকশাকাটা পোকারাও। পানি তাই নিশ্চল,
পাথর। পাথর যেন রহমালির বুকও। ওপারের দেবদারু গাছটার ছায়া এসে পড়েছে এপারে।
অনেকক্ষণ হলো সেটা ছুুঁয়ে আছে তার পা। দেখা হলেই করম যেমন ছুঁতো।
আহারে সোনাভাইটা! চিরকালের
জন্যই আজ ওপারে চলে গেল।
তিনিও যাবেন। ভাবতেই আবার ভালো লাগা শুরু হলো তার। ব্যাবধান না ঘুচলেও দূরত্ব তো তাদের কমেছে! হ্যাঁ, তাই তো; একদীঘি হয়ে একদেশ দূরত্ব ছিল এতদিন, এখন আছে একনিঃশ্বাস।
0 মন্তব্যসমূহ