কোন উপন্যাস লেখা শেষ করার পরে লেখককে এক ধরনের ভুলে-যাওয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এই ভুলে-যাওয়াটা খুব জরুরী। একটি শিশুর জন্ম দেওয়ার অভিজ্ঞতার মতো, ভুলে যেতেই লাগে; নিজের ভবিষ্যতের জন্যই এটা করা দরকার। আপনি যদি মনে রাখেন, সত্যিই মনে রাখেন, তবে আর একবার এই কাজ আপনি কিছুতেই করবেন না। কিংবা এমন হতে পারে যে উপন্যাস লেখার অভিজ্ঞতা নিজেই এক ধরণের ক্রমাগত ভুলে যেতে থাকার প্রক্রিয়া, একটি নিয়ন্ত্রিত চলমান আত্মবিস্মরণ।
আমার জন বার্জারের একটি লেখার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, অ্যাবাউট লুকিং বই থেকে, ‘সেকার আহমেত এবং অরণ্য’। বার্জার সেই প্রবন্ধে, বারবার আহমেতের ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকের একটি চিত্রকর্মের কথা বলেছেন। ছবিটিতে শিল্পী দৃষ্টিকোণের এক অদ্ভুত গা ছমছম করা কারিকুরিতে একটি অরণ্যকে একইসাথে দু’ভাবে ধরেছেন – একভাবে আমরা অরণ্যটিকে দেখতে পাচ্ছি তার ধ্রুপদী বিস্তারে – একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ বনের দৃশ্য, দূরের দিকে যার প্রান্তসীমাগুলো দেখা যাচ্ছে, অন্যদিকে অরণ্যটি আমাদের কাছে দৃশ্যমান তার সমস্ত অন্ধকার অস্পষ্টতা নিয়ে, তাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি তার বাইরে থেকে নয়, একেবারে ভিতর থেকে, যেমনভাবে দেখছে ঐ কাঠুরেটি যে তার গাধাটির সাথে বনের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলেছে কিংবা বলা যায় এই বনটি যাকে গিলে নিয়েছে। বার্জার লিখেছেন, ‘এই ছবিতে অরণ্যটির আকর্ষণ এবং আতঙ্ক এটাই যে, আপনি একে দেখছেন নিজেকে তার মধ্য বসিয়ে নিয়ে, যেন তিমির পেটে থাকা জোনাহ। অরণ্যটি কোথাও শেষ হয়েছে নিশ্চয়ই, কিন্তু হে দর্শক, আপনার ক্ষেত্রে, এটা আপনাকে ঘিরে রেখেছে। এখন এই যে অভিজ্ঞতা, যা একটি অরণ্যের সাথে পরিচিত যে কারোর হয়েছে, সেটা আপনারও হবে কি না তা নির্ভর করছে আপনি অরণ্যটিকে একই সাথে দুরকম ভাবে দেখতে পারছেন কি পারছেন না তার উপর। আপনি অরণ্যের ভিতর দিয়ে নিজের পথ খুঁজে নিচ্ছেন আবার একই সাথে, বাইরে থেকে সেই নিজেকেই নজর করছেন অরণ্যটি যাকে গিলে নিয়েছে।’
এই ‘দ্বৈত দৃষ্টি’ অবশ্যই কারো নিজের লেখা উপন্যাসের জগতে হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কে একেবারে সঠিক বর্ণনা - পূর্ণ নিমজ্জন এবং একই সাথে সেই নিমজ্জনের সীমানা সম্পর্কে সচেতনতা। আমার টাইডস উপন্যাসটি লেখার সময় আমি প্রায়শই অনুভব করেছি যে উপন্যাসের কাল্পনিক জগতটিকে গুছিয়ে তোলার জন্য দু’রকম মনোযোগেরই একসাথে কাজ করা একান্ত জরুরী – একদিকে, আমি উপন্যাসের একেবারে ভিতরে ডুবে থাকছি, বাক্যগুলো আর তাদের তৈরী পরিমণ্ডল আমায় গ্রাস করে রাখছে, পাশাপাশি উপন্যাসের পুরোপুরি বাইরে দাঁড়িয়ে তার যে মুখটা আমায় গিলে ফেলছে সেটার সম্পর্কেও আমি পূর্ণমাত্রায় সচেতন থাকছি। দুয়ে মিলে সমর্পণ এবং নিয়ন্ত্রণের এক প্রায় অসম্ভব পরিণয় ঘটিয়ে তোলা।
উপন্যাস লেখায় দ্বৈততার প্রক্রিয়াটি, বার্জারের বর্ণনামত যা একই সাথে অসীম এবং তার পরিধির ভিতর সীমাবদ্ধ, আমার কাছে সেই রকমই গুরূত্বপূর্ণ লাগে, যেমনটি লাগে একটি অরণ্যের সাথে পরিচিতদের কাছে সেই অরণ্যের অস্তিত্বের ব্যাপারটি। কিন্তু, প্রথমবারের জন্য অরণ্যে ঢোকা কোন কাঠুরের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কি রকম হবে?
যদিও টাইডস আমার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস, এটি আসলে আমার লেখা প্রথম উপন্যাস নয়। আমার বয়স যখন কুড়ির কোঠার শেষের দিকে, আমি আরেকটি উপন্যাস নিয়ে বছর তিনেক কাজ করেছিলাম। এই গল্পটা নিয়ে, এর সম্ভাবনা নিয়ে আমি ভিতরে ভিতরে খুব আবেগ অনুভব করতাম। কিন্তু প্রতিটি সম্ভাব্য পদক্ষেপে, প্রতিটি নতুন খসড়ার সময়, আমার মনে হত সব দিক থেকে পথ হারিয়ে বসে আছি; আমার চেষ্টাগুলোকে সামাল দেওয়ার পক্ষে আমার সামর্থ্য ছিল খুবই সীমিত। অরণ্যের সাথে কোন পরিচয় না থাকার কারণে এর পরিসীমা সম্পর্কে, এর প্রয়োজনীয় সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিল না। অন্য আর কিভাবে কাজটা করা যেতে পারে সেই নিয়ে কোন জ্ঞান না থাকায়, আমি কাজ করে গেছি, পুরোটাই একেবারে ভিতর থেকে, বাক্য এবং দৃশ্যগুলিকে নিখুঁত করা নিয়ে মেতে থেকেছি, গল্পের মধ্যেকার বিস্তীর্ণ এলাকাটি আমায় গিলে বসেছিল, সামগ্রিক ব্যাপারটা নিয়ে আমার কোন ধারণা ছিল না, আমি আশা করেছিলাম যে আমার খাটাখাটুনির ফলে গল্পকে ধরে রাখার কাঠামোটি আপনিই গড়ে উঠবে। শেষ পর্যন্ত কিন্তু, বইটি, এর একাধিক দৃষ্টিকোণ, তার ঢিলেঢালাভাবে সংযুক্ত বিভিন্ন অংশগুলো একাঙ্গীভূত হয়ে উঠলনা। পরিবর্তে আমার যা জুটল তা হচ্ছে, নিজেদের মাঝখানে যেমন তেমন করে দূরত্ব রেখে তিনটি আলাদা আলাদা গাছের দাঁড়িয়ে থাকা – আদৌ কোন অরণ্য গড়ে ওঠেনি।
খেলাটার অনেক দেরিতে আমি ধরতে পারলাম, রাচেল কাস্ক, তার স্মৃতিকথা আফটারম্যাথ-এ যেটাকে ‘নকশায় ত্রুটি’ বলে জানিয়েছেন। ‘ভুল ভাবে উপন্যাস লেখা’ সম্পর্কে তার নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি লিখেছেন: ‘সমস্যাটি সাধারণত থাকে গল্পের আর সত্যের সম্পর্কের মধ্যে। গল্পের কর্তব্য সত্যকে মেনে চলা, সত্যকে যথাযথভাবে প্রকাশ করা, যেমনভাবে কোন পোশাক একটি শরীরকে প্রকাশ করে। পোশাকের ছাঁট-কাট যত মাপে মাপে হবে, শরীরের রূপ তত খুলবে।’ কাজ করতে করতে আমি এটা বুঝেছি যে এই ‘ছাঁট-কাট’ মানে শুধু গল্পের সাহায্যে সত্যকে ঠিকমত ধরে রাখার ব্যাপারটাই নয়, সেই সাথে এইটাই হচ্ছে গল্পের সেই নিজস্ব রূপটি যা ফুটে ওঠা একান্ত দরকার, এই ‘ছাঁট-কাট’-ই গল্পের কাঠামো গড়ে তোলার অত্যাবশ্যক কৌশল। আমি সরলভাবে ভেবেছিলাম যে আমি যদি সততার সাথে আমার সযত্নে কল্পনা করা চরিত্রগুলি সম্পর্কে লিখে ফেলি তা হলেই আমি উপন্যাসটা দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারব। এ যেন আমার সেই উদ্বেগময় স্বপ্নদের একেবারে সাধারণগুলোর একটির মতো, আমি মঞ্চে পৌঁছেছি, আমার সুচিন্তিত বক্তৃতা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত, নীচের দিকে তাকালাম, আর কেবল তখনই নজরে এল যে আমি জামা-কাপড় পড়তে ভুলে গেছি।
খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। পুরো এক বছর লিখিনি কিছু। ভুলে গেছিলাম।
এবং তারপর, ভুলে গিয়ে, আমি আবার চেষ্টা করলাম। এবারে একটি মাত্র চরিত্র, একটি যথেষ্ট সহজ গল্প, একজন মহিলা যিনি আর ঠিক হবেনা এমন কতগুলো বিচ্ছেদের পরিণতিতে তার অতীত জীবনকে ফেলে রেখে সামনে এগিয়ে যান। অর্থাৎ, একটি ছোট জঙ্গল, যেটায় আমার ধারণা, পুরোপুরি দিশাহীন না হয়েও নিজেকে হারিয়ে ফেলতে পারব। কাজটা ভালোভাবে উৎরেছিল বললে মিথ্যা বলা হবে। তখনও জানতাম না কীভাবে উপন্যাস লিখতে হয়। যে সীমানা আমি তৈরি করেছিলাম সেটি ছিল বানানো সীমা। গল্পটি, তার প্রথম পুনর্লিখনে, একটি পেন্ডুলামের মতো এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে সরে গেছে, অতীত থেকে বর্তমানে, দুদিকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে, কোন কারণ ছাড়াই ----- একটি আকৃতি যা ভিতর থেকে তৈরী হয়ে ওঠেনি, বরং বাইরে থেকে যাকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, ইচ্ছাপূরণের লক্ষ্যে একটি আনাড়ি কাজ। কিন্তু সেকার আহমেদের চিত্রকর্মের যে কাঠুরেটি হয়ে ওঠার আশা ছিল আমার, সেই কাঠুরের অনুগত গাধাটির মত কোন দিকে না তাকিয়ে জোর করে এগিয়ে গেছি আমি। কয়েক মাস পরে, যখন আবার সেই খসড়াটি পড়লাম, বুঝতে পারলাম, এর সমস্ত পৃষ্ঠা মিলিয়ে, সংরক্ষণের যোগ্য বাক্য আছে মাত্রই কয়েকটি। আমি বিধ্বস্ত বোধ করেছিলাম, বা ক্রুদ্ধ - সম্ভবত দুটোই।
ক্ষোভে অস্থির লাগছিল। কিছু আর ভাল লাগছিলনা। হাল ছেড়ে দেওয়ার কথা ভেবেছিলাম আমি।
এবং তা সত্ত্বেও, ঐ লজ্জার অনুভূতি কেটে যাওয়ার পর – অত খাটাখাটনির পর তার যত সামান্য অংশই উদ্ধারযোগ্য মনে হয়ে থাক - আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আমার গল্পের চরিত্রটি দাঁড়িয়ে গেছে। এবং তার থেকেও বড় কথা, কয়েকটি বাক্য পেয়ে গেছি আমি, এক ডজন হবে হয়ত, এত অদ্ভুত লাগছিল আমার, একদম ঠিকঠাক, যেন অন্য কোন লেখকের লেখা, যে লেখক আমি হয়ে উঠতে চাই, সেই লেখকের।
আমি বার বার অ্যানি ডিলার্ডের দ্য রাইটিং লাইফ থেকে পাওয়া সেই নির্দেশের কাছে ফিরে আসি: ‘কিভাবে লিখছেন সেই প্রক্রিয়াটির কোন দাম নেই; পথের রেখা মুছে ফেলুন। পথটা আপনার উদ্দেশ্য নয়। আশা করি আপনার পথ এখন অনেক ছড়িয়ে গিয়েছে। আশা করি, পাখিরা আপনার পথ-চলার চিহ্ন যে রুটির টুকরোগুলো সেগুলোকে খেয়ে ফেলেছে; আশা করছি, রুটির বাকি যে কটা টুকরো আপনার কাছে আছে সেগুলো আপনি ছুঁড়ে ফেলে দেবেন এবং সেগুলোর দিকে আর ফিরে তাকাবেন না।’ আমি ঠিক সেটাই করলাম। আমি নুতন করে একটা লেখা শুরু করলাম, মাথায় রাখলাম শুধু উদ্ধার করে আনা ঐ কটা অদ্ভুত বাক্যকে, তাদের ভিন্নরকমের প্রয়োজনীয়তা, খুব তাড়াতাড়িই একটা অরণ্য, একটা সত্যিকারের বন, আকর্ষণীয় এবং ভয়ংকর, গজিয়ে ঊঠল। এবং তারপরে আরও অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটেছিল: এই অদ্ভুত বাক্যগুলি – যারা আমার, অথচ আমার নয়, যেগুলি তাদের আশ্চর্য নিজস্ব বোঝাপড়ায় নিজেরাই নিজেদের লিখেছে বলে মনে হয়েছিল – তাদের লিখে ফেলার সময় আমি ধরতে পারছিলাম যে আমার লেখার প্রান্তসীমাগুলি রূপ পেতে শুরু করেছে, আমি অনুভব করছিলাম সেই পূর্ণতার বোধকে যা কোন এক আশ্চর্য উপায়ে আমার প্রচেষ্টাকে বাইরে থেকে বেষ্টন করতে করতেই ভিতর থেকে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। গল্পটি শুধু যে তার ভিতরের সত্যকে ধরে রাখার উপযুক্ত একটি কাঠামো খুঁজে পেয়েছে তাই না, গল্পের সত্যটি নিজে ফুটে উঠেছে সেই কাঠামোটি থেকেই, বাক্যগুলির উচ্চারণ এবং শব্দের ছন্দোময় দোলা থেকে, গল্পের পাতায় তাদের নিঃসঙ্গ অবস্থান থেকে। আমি আমার দ্বৈত দৃষ্টিকে খুঁজে পেয়ে গেছি।
শেষ পর্যন্ত, আমি জানতাম না আমি যা লিখেছিলাম সেটা আমার মনোমত ছিল কিনা, তবে আমি জানতাম যে আমি কিছু একটা লিখে ফেলেছি, এমন কিছু যা একদিকে বসবাসযোগ্য, খুব নির্দিষ্ট একটি পরিবেশ আছে তার, ছায়া আর আলোর এক ভয়ংকর নাটক চলছে সেখানে, আবার একইসাথে, বহিরঙ্গে সেটি একটি কঠিন বাস্তব কিছু, অন্তত সেটুকু সামঞ্জস্য পূর্ণ একটা অবয়ব, যেটুকুতে তাকে একটি গল্প বলে চেনা যায়।
আজকাল, আমি একটি নতুন অরণ্যের পরিধির দিকে তাকাচ্ছি, আকৃষ্ট, আতঙ্কিত। এতদিনে, আশা করি, আমি অন্তত ততটা পর্যন্ত ভুলে গেছি, যতটা ভুলে গিয়ে থাকলে আবার কাজটা করার কথা ভাবা যেতে পারে।
এই ‘দ্বৈত দৃষ্টি’ অবশ্যই কারো নিজের লেখা উপন্যাসের জগতে হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কে একেবারে সঠিক বর্ণনা - পূর্ণ নিমজ্জন এবং একই সাথে সেই নিমজ্জনের সীমানা সম্পর্কে সচেতনতা। আমার টাইডস উপন্যাসটি লেখার সময় আমি প্রায়শই অনুভব করেছি যে উপন্যাসের কাল্পনিক জগতটিকে গুছিয়ে তোলার জন্য দু’রকম মনোযোগেরই একসাথে কাজ করা একান্ত জরুরী – একদিকে, আমি উপন্যাসের একেবারে ভিতরে ডুবে থাকছি, বাক্যগুলো আর তাদের তৈরী পরিমণ্ডল আমায় গ্রাস করে রাখছে, পাশাপাশি উপন্যাসের পুরোপুরি বাইরে দাঁড়িয়ে তার যে মুখটা আমায় গিলে ফেলছে সেটার সম্পর্কেও আমি পূর্ণমাত্রায় সচেতন থাকছি। দুয়ে মিলে সমর্পণ এবং নিয়ন্ত্রণের এক প্রায় অসম্ভব পরিণয় ঘটিয়ে তোলা।
উপন্যাস লেখায় দ্বৈততার প্রক্রিয়াটি, বার্জারের বর্ণনামত যা একই সাথে অসীম এবং তার পরিধির ভিতর সীমাবদ্ধ, আমার কাছে সেই রকমই গুরূত্বপূর্ণ লাগে, যেমনটি লাগে একটি অরণ্যের সাথে পরিচিতদের কাছে সেই অরণ্যের অস্তিত্বের ব্যাপারটি। কিন্তু, প্রথমবারের জন্য অরণ্যে ঢোকা কোন কাঠুরের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কি রকম হবে?
যদিও টাইডস আমার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস, এটি আসলে আমার লেখা প্রথম উপন্যাস নয়। আমার বয়স যখন কুড়ির কোঠার শেষের দিকে, আমি আরেকটি উপন্যাস নিয়ে বছর তিনেক কাজ করেছিলাম। এই গল্পটা নিয়ে, এর সম্ভাবনা নিয়ে আমি ভিতরে ভিতরে খুব আবেগ অনুভব করতাম। কিন্তু প্রতিটি সম্ভাব্য পদক্ষেপে, প্রতিটি নতুন খসড়ার সময়, আমার মনে হত সব দিক থেকে পথ হারিয়ে বসে আছি; আমার চেষ্টাগুলোকে সামাল দেওয়ার পক্ষে আমার সামর্থ্য ছিল খুবই সীমিত। অরণ্যের সাথে কোন পরিচয় না থাকার কারণে এর পরিসীমা সম্পর্কে, এর প্রয়োজনীয় সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিল না। অন্য আর কিভাবে কাজটা করা যেতে পারে সেই নিয়ে কোন জ্ঞান না থাকায়, আমি কাজ করে গেছি, পুরোটাই একেবারে ভিতর থেকে, বাক্য এবং দৃশ্যগুলিকে নিখুঁত করা নিয়ে মেতে থেকেছি, গল্পের মধ্যেকার বিস্তীর্ণ এলাকাটি আমায় গিলে বসেছিল, সামগ্রিক ব্যাপারটা নিয়ে আমার কোন ধারণা ছিল না, আমি আশা করেছিলাম যে আমার খাটাখাটুনির ফলে গল্পকে ধরে রাখার কাঠামোটি আপনিই গড়ে উঠবে। শেষ পর্যন্ত কিন্তু, বইটি, এর একাধিক দৃষ্টিকোণ, তার ঢিলেঢালাভাবে সংযুক্ত বিভিন্ন অংশগুলো একাঙ্গীভূত হয়ে উঠলনা। পরিবর্তে আমার যা জুটল তা হচ্ছে, নিজেদের মাঝখানে যেমন তেমন করে দূরত্ব রেখে তিনটি আলাদা আলাদা গাছের দাঁড়িয়ে থাকা – আদৌ কোন অরণ্য গড়ে ওঠেনি।
খেলাটার অনেক দেরিতে আমি ধরতে পারলাম, রাচেল কাস্ক, তার স্মৃতিকথা আফটারম্যাথ-এ যেটাকে ‘নকশায় ত্রুটি’ বলে জানিয়েছেন। ‘ভুল ভাবে উপন্যাস লেখা’ সম্পর্কে তার নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি লিখেছেন: ‘সমস্যাটি সাধারণত থাকে গল্পের আর সত্যের সম্পর্কের মধ্যে। গল্পের কর্তব্য সত্যকে মেনে চলা, সত্যকে যথাযথভাবে প্রকাশ করা, যেমনভাবে কোন পোশাক একটি শরীরকে প্রকাশ করে। পোশাকের ছাঁট-কাট যত মাপে মাপে হবে, শরীরের রূপ তত খুলবে।’ কাজ করতে করতে আমি এটা বুঝেছি যে এই ‘ছাঁট-কাট’ মানে শুধু গল্পের সাহায্যে সত্যকে ঠিকমত ধরে রাখার ব্যাপারটাই নয়, সেই সাথে এইটাই হচ্ছে গল্পের সেই নিজস্ব রূপটি যা ফুটে ওঠা একান্ত দরকার, এই ‘ছাঁট-কাট’-ই গল্পের কাঠামো গড়ে তোলার অত্যাবশ্যক কৌশল। আমি সরলভাবে ভেবেছিলাম যে আমি যদি সততার সাথে আমার সযত্নে কল্পনা করা চরিত্রগুলি সম্পর্কে লিখে ফেলি তা হলেই আমি উপন্যাসটা দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারব। এ যেন আমার সেই উদ্বেগময় স্বপ্নদের একেবারে সাধারণগুলোর একটির মতো, আমি মঞ্চে পৌঁছেছি, আমার সুচিন্তিত বক্তৃতা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত, নীচের দিকে তাকালাম, আর কেবল তখনই নজরে এল যে আমি জামা-কাপড় পড়তে ভুলে গেছি।
খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। পুরো এক বছর লিখিনি কিছু। ভুলে গেছিলাম।
এবং তারপর, ভুলে গিয়ে, আমি আবার চেষ্টা করলাম। এবারে একটি মাত্র চরিত্র, একটি যথেষ্ট সহজ গল্প, একজন মহিলা যিনি আর ঠিক হবেনা এমন কতগুলো বিচ্ছেদের পরিণতিতে তার অতীত জীবনকে ফেলে রেখে সামনে এগিয়ে যান। অর্থাৎ, একটি ছোট জঙ্গল, যেটায় আমার ধারণা, পুরোপুরি দিশাহীন না হয়েও নিজেকে হারিয়ে ফেলতে পারব। কাজটা ভালোভাবে উৎরেছিল বললে মিথ্যা বলা হবে। তখনও জানতাম না কীভাবে উপন্যাস লিখতে হয়। যে সীমানা আমি তৈরি করেছিলাম সেটি ছিল বানানো সীমা। গল্পটি, তার প্রথম পুনর্লিখনে, একটি পেন্ডুলামের মতো এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে সরে গেছে, অতীত থেকে বর্তমানে, দুদিকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে, কোন কারণ ছাড়াই ----- একটি আকৃতি যা ভিতর থেকে তৈরী হয়ে ওঠেনি, বরং বাইরে থেকে যাকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, ইচ্ছাপূরণের লক্ষ্যে একটি আনাড়ি কাজ। কিন্তু সেকার আহমেদের চিত্রকর্মের যে কাঠুরেটি হয়ে ওঠার আশা ছিল আমার, সেই কাঠুরের অনুগত গাধাটির মত কোন দিকে না তাকিয়ে জোর করে এগিয়ে গেছি আমি। কয়েক মাস পরে, যখন আবার সেই খসড়াটি পড়লাম, বুঝতে পারলাম, এর সমস্ত পৃষ্ঠা মিলিয়ে, সংরক্ষণের যোগ্য বাক্য আছে মাত্রই কয়েকটি। আমি বিধ্বস্ত বোধ করেছিলাম, বা ক্রুদ্ধ - সম্ভবত দুটোই।
ক্ষোভে অস্থির লাগছিল। কিছু আর ভাল লাগছিলনা। হাল ছেড়ে দেওয়ার কথা ভেবেছিলাম আমি।
এবং তা সত্ত্বেও, ঐ লজ্জার অনুভূতি কেটে যাওয়ার পর – অত খাটাখাটনির পর তার যত সামান্য অংশই উদ্ধারযোগ্য মনে হয়ে থাক - আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আমার গল্পের চরিত্রটি দাঁড়িয়ে গেছে। এবং তার থেকেও বড় কথা, কয়েকটি বাক্য পেয়ে গেছি আমি, এক ডজন হবে হয়ত, এত অদ্ভুত লাগছিল আমার, একদম ঠিকঠাক, যেন অন্য কোন লেখকের লেখা, যে লেখক আমি হয়ে উঠতে চাই, সেই লেখকের।
আমি বার বার অ্যানি ডিলার্ডের দ্য রাইটিং লাইফ থেকে পাওয়া সেই নির্দেশের কাছে ফিরে আসি: ‘কিভাবে লিখছেন সেই প্রক্রিয়াটির কোন দাম নেই; পথের রেখা মুছে ফেলুন। পথটা আপনার উদ্দেশ্য নয়। আশা করি আপনার পথ এখন অনেক ছড়িয়ে গিয়েছে। আশা করি, পাখিরা আপনার পথ-চলার চিহ্ন যে রুটির টুকরোগুলো সেগুলোকে খেয়ে ফেলেছে; আশা করছি, রুটির বাকি যে কটা টুকরো আপনার কাছে আছে সেগুলো আপনি ছুঁড়ে ফেলে দেবেন এবং সেগুলোর দিকে আর ফিরে তাকাবেন না।’ আমি ঠিক সেটাই করলাম। আমি নুতন করে একটা লেখা শুরু করলাম, মাথায় রাখলাম শুধু উদ্ধার করে আনা ঐ কটা অদ্ভুত বাক্যকে, তাদের ভিন্নরকমের প্রয়োজনীয়তা, খুব তাড়াতাড়িই একটা অরণ্য, একটা সত্যিকারের বন, আকর্ষণীয় এবং ভয়ংকর, গজিয়ে ঊঠল। এবং তারপরে আরও অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটেছিল: এই অদ্ভুত বাক্যগুলি – যারা আমার, অথচ আমার নয়, যেগুলি তাদের আশ্চর্য নিজস্ব বোঝাপড়ায় নিজেরাই নিজেদের লিখেছে বলে মনে হয়েছিল – তাদের লিখে ফেলার সময় আমি ধরতে পারছিলাম যে আমার লেখার প্রান্তসীমাগুলি রূপ পেতে শুরু করেছে, আমি অনুভব করছিলাম সেই পূর্ণতার বোধকে যা কোন এক আশ্চর্য উপায়ে আমার প্রচেষ্টাকে বাইরে থেকে বেষ্টন করতে করতেই ভিতর থেকে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। গল্পটি শুধু যে তার ভিতরের সত্যকে ধরে রাখার উপযুক্ত একটি কাঠামো খুঁজে পেয়েছে তাই না, গল্পের সত্যটি নিজে ফুটে উঠেছে সেই কাঠামোটি থেকেই, বাক্যগুলির উচ্চারণ এবং শব্দের ছন্দোময় দোলা থেকে, গল্পের পাতায় তাদের নিঃসঙ্গ অবস্থান থেকে। আমি আমার দ্বৈত দৃষ্টিকে খুঁজে পেয়ে গেছি।
শেষ পর্যন্ত, আমি জানতাম না আমি যা লিখেছিলাম সেটা আমার মনোমত ছিল কিনা, তবে আমি জানতাম যে আমি কিছু একটা লিখে ফেলেছি, এমন কিছু যা একদিকে বসবাসযোগ্য, খুব নির্দিষ্ট একটি পরিবেশ আছে তার, ছায়া আর আলোর এক ভয়ংকর নাটক চলছে সেখানে, আবার একইসাথে, বহিরঙ্গে সেটি একটি কঠিন বাস্তব কিছু, অন্তত সেটুকু সামঞ্জস্য পূর্ণ একটা অবয়ব, যেটুকুতে তাকে একটি গল্প বলে চেনা যায়।
আজকাল, আমি একটি নতুন অরণ্যের পরিধির দিকে তাকাচ্ছি, আকৃষ্ট, আতঙ্কিত। এতদিনে, আশা করি, আমি অন্তত ততটা পর্যন্ত ভুলে গেছি, যতটা ভুলে গিয়ে থাকলে আবার কাজটা করার কথা ভাবা যেতে পারে।
অমিতাভ চক্রবর্ত্তী
কবি।গল্পকার। অনুবাদক
যুক্তরাষ্ট্রের টেনিসিতে থাকেন।
0 মন্তব্যসমূহ