বেহুদা বাচ্চাকাচ্চাগুলো হৈ হৈ করছে। এদের না আছে কাজ, না আছে লেখাপড়া। মাছুমা দুয়ারে পা ছড়িয়ে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে তার রংচটা মেয়েটার। ঝুপরি থেকে টুং টাং বাসনকোসনের শব্দ। বাতাস থেকে সুরসুরিয়ে ইয়াবার গন্ধ আসছে। বস্তির এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে ছালপরা নেড়ি কুকুরটা।
রাস্তার টাইমকলে বসে গায়ে কসকো সাবান মাখছে তৈবরের মেয়ে কাদু। লালু পাশে বসেই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে, গাইছে--সব সখিরে পার করিতে নেব আনায় আনা। গপ্পু ও তার বউ ধুমসে ঝগড়া বাঁধিয়েছে। একটা মরা মুরগী নাম মাত্র মূল্যে কিনে এনেছে স্বপনের বাপ। তাই নিয়ে আহ্লাদ করছে স্বপনের মা। শেফালীদের কড়াইয়ে চড়েছে চিংড়ি-বেগুনের রসা। ঐদিকে উত্তরের লাইনের শেষ ঝুপড়িতে পুতুল খলবল করে কি সব বলে যাচ্ছে।
আম্মা, ও আম্মা
কি?
আজ স্বপ্ন দেখছি কি জানো?
কি?
দেখছি পোলাও মাংস খাইতেছি।
হুম।
ও আম্মা স্বপনের বাপ মরা একটা মুরগী কিনছে। নিজের দেখলে পরের হয়। ঠিক না আম্মাা?
জানিনা
ও আম্মা?
বের বের করিস না। তোর বাপরে গিয়া ক।
মেয়েকে বাপের দিকে পাঠিয়ে দিয়ে ডালিয়া ইদুঁরের গর্তে মাটি পোরে। মেয়ে বাবার শিয়রের কাছে গিয়ে আটোসাঁটো চুলে আঙ্গুল বুলায় আর আহলাদে ডগমগ হয়ে বলতে থাকে।
আব্বা একটা এমন স্বপ্ন দেখলাম আজ। দেখলাম কি......
বাবুল সাড়া দেয়না। মাঝখানে ডালিয়া ডেকে ওঠে। পুতুলের উৎসাহে বালি পড়ে। পোলাও-মাংসের গল্প অসমাপ্ত রেখে সে বেরিয়ে যায়।
কি গো কানে কি শোনা যায় কিছু? পেটে কি আজ কিছু পড়বে পোলাপাইনের?
হু । যাই!
স্বামীর মত চোখ বুজে থাকবার জো নেই ডালিয়ার। রেলের ওপাড়ে বড় রাস্তায় ঢালাইয়ের কাজ চলছে। কুলিদেরকে বলে কটা বালি আর একটু সিমেন্ট চেয়ে এনেছে। নড়বড়ে ঝুঁপড়ি, এই পড়ে তো, ঐই পড়ে অবস্থা। ছেলে মেয়ে নিয়ে পা ছড়িয়ে ঘুমানোর জো নেই। এ পাশের ফেলা নি:শ্বাস ওপাশের নি:শ্বাসে আছড়ে পড়ে। তার মধ্যে ইঁদুর। রান্না করা তরকারি, চালের কৌটো, শূন্য বাসনকোসন, কাপড়ের ট্রাঙ্ক, পুটলি পাটলা সবখানে তাদের আনাগোনা। এইসব দেখবার সময় কোথায় বাবুলের? ভোর সাতটার মধ্যে দুটো খেয়ে দেয়ে গিয়ে লাইনে দাঁড়ায়। কামলা খাটুয়ে জীবনে ঘরে ফেরার কোন নীতি নেই। দুটো মোটা চালের ভাত আর মাস শেষে ঝুঁপড়ি ভাড়া দেয়ার চিন্তাই ঘোরে দিনরাত। ঘুমে-জাগরণে কেবল দুশ্চিন্তা আর দুশ্চিন্তা। ইঁদুর অতি তুচ্ছ বিষয়। তুচ্ছ-ক্ষুদ্র বিষয়ের জন্যে ডালিয়া রয়েছে। সেজন্যেই রাগ-অভিমান-খিদে নিয়েও সে ইঁদুরের পথরোধ করার আয়োজন করছে। হাতের কাজ শেষ হলে সে উঠে আসে। স্বামীর কাছে এসে দাঁড়ায়। স্ত্রীর উপস্থিতিতে বাবুলের কোন ভাবান্তর ঘটে না। ডালিয়া তার ডান হাত স্বামীর কপালে ঠেকিয়ে নিশ্চিত হয় জ্বরটা ফিরে এলো কিনা। সেরকম কোন লক্ষণ না দেখে আওয়াজ বাড়ায়।
বলি, এতক্ষণ ধরে যে বলছি, ঘরে কিছু নাই!
হু, যাই।
এই যাই যাই তো সকাল থেকে শুনছি। আমি মানলাম, বাচ্চারা থাকে কেমনে?
না মানলে ঠাস করে দে কয়টা। এত কিসের খাইখাই? বাজারের খবর জানস?
খাইখাই করবে না কি করবে? কও দুইটারে মাইরা নিজে মরি খাই খাই বন্ধ হয়ে যাক।
বাবুল উঠে বসে। লুঙ্গির কোচা শক্ত করে বাঁধে। এরপর ধীরে ধীরে নেমে যায় বিছানা থেকে। ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে রেললাইন ধরে হাঁটে। জীবন থেকে রেহাই পাওয়া ভার। একজনের আয়ে সংসারের ঘানি টানা কষ্টের। যখন ডালিয়া ছুটা বুয়ার কাজ করতো তখন বেশ চলে যেত। কিন্তু বাবুল সন্দেহ করে, অশান্তি করে। অবশ্য আরো একটি কারণ ছিল। পুতুলের উঠতি বয়স। ঝুপড়িতে নানা রঙের মানুষ আসে। পাঁচজন নিজেদের হলে দশজন আগন্তুক। টুকটাক ঘটনাও ছিল। তাই, বাড়ির কাজ ছেড়ে সুবিধাজনক একটি আয়ের পথ বেছে নিয়েছিল ডালিয়া। মেরা পিঠার সাথে মরিচ ভর্তা বিক্রির কাজ। এতে, মেয়েকে চোখেচোখে রাখা যায়, সংসারের টুকটাক খরচও চলে যায়। নেহাতেই একটানা বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ঢাকার রাস্তা অঁজপাড়া গাঁয়ের চেয়েও দৈন্য অবস্থা। তেজগাঁও রেলবস্তির দশাতো অবর্ণনীয়। স্বামীরও কাজ নেই একনাগাড়ে। পিঠার চাল শেষ। সেই জন্যেই পিঠার ব্যবসাও কয়েকদিন ধরে তার বন্ধ।
চিকুনগুনিয়ায় বাবুলের শরীরও আর শরীর নেই। গত কয়েকদিন বৃষ্টির মধ্যেও বাবুল সারাদিন দাঁড়িয়ে থেকেছে মজুরের হাঁটে। একেএকে সকলকেই নিয়েছে। কেউ গেছে রাস্তা কাটার কাজে, কেউ বাড়ি ঢালাইয়ের কাজে, কেউ গ্যাসের পাইপ সাপ্লাইয়ের কাজে কিন্তু তাকে কেউ নেয়নি। নেবেই বা কেন? এ কয়েকদিনে শরীর কামলা খাটবার অবস্থায় তো নেই।
পনের ষোলদিন জ্বর আর গা ব্যাথায় সব শেষ। গা-জুড়ে রেশ ভরে গেছে। হায়রে মশা! কি দাপট! এতকাল ধারণা ছিল- গরীবের মশাই কি, আর ইঁদুরই কি, সকলেই তো ঘরের সদস্যের মতই। বিচ্ছু মশা, বাবুলের বিশ্বাসে চিড় ধরিয়ে দিল। নিজ লোকের অনিষ্ট করলে ধনীলোকের সাথে পার্থক্যটা রইলো কই! সাংসারিক সম্পর্ক বুঝলে না মশাটা! এখন না আছে গায়ে জোর, না আছে টাকা। এই শরীরে সে কাজই পাবে কই? চাল কেনার পয়সাই বা পাবে কোথায়?
চালের বস্তায় আগুন। সবজির দিকে তাকানোই যায় না। পিয়াজ ৯০ টাকা কেজি, মরিচ ৮০ টাকা, তেল ১২০ কেজি। লবণের সের ৪০ টাকা। বেগুন ৮৫ টাকা কেজি। আলু ৪০ টাকা দর। পনের বিশ টাকার নিচে শাক নেই। বাজারের কোন একটি জিনিস আছে যা বাবুলের মত জনতা সহসাই নিয়ে যেতে পারে ঘরে? ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত হয় বাবুল। কতকিছুর বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়। ভোটের সময় মিছিলের জন্যে ভাড়া খাটানোর দালাল আসে। কই, গরীবেরা যে খেতে পারছে না, তাদের জন্যে তো দালাল আসে না! বলেনা, মাথা গুনা ১০০ টাকা, সকালে নয়টার মধ্যে মিছিল শুরু। ভেবে ভেবে ক্লান্ত হয়ে বাবুল রেলের পাটাতনে ধপ করে বসে যায়।
কোমরের নিচ থেকে পা দুটো টনটন করছে ব্যাথায়। বুঝিবা তার কোমরখানা খসে গেল। বাবুলের চোখ ভিজে যায়। তার অস্ফুট স্বর মা বলে ডেকে ওঠে। মাকে কোনদিন দেখেনি বাবুল। স্মৃতিতে জহিরুদ্দীনের চায়ের দোকানের আগেকার জীবনের কথার ছিটে ফুঁটোও নেই। জহিরউদ্দীন বাবুলকে স্টেশন থেকে কুড়িয়ে পেয়েছিল। ধবধবে গায়ের রং, সুঠাম গড়ন, শুদ্ধ কিন্তু ভাঙ্গাভাঙ্গা ভাষায় কথা বলা সুদর্শণ এক শিশু। ব্যাস এইটুকুই। বেওয়ারিশ হয়েই জীবনটা তার কেটে গেল। কেটে গেল বস্তির ঘিনঘিনে ঝুপড়িতে।
সন্ধ্যা ঘনায়। ডালিয়া চকির নিচে থাকা পুরনো কৌটা ঘাটাঘাটি করে। দেখা মেলে পলিথিনের পুটলিতে বাঁধা আতপ চাল। ঈদের সময় দেশের বাড়ি থেকে আনা। প্রবল আনন্দে তার চোখের মনি দুটো নেচে উঠে। মেয়ের নাম ধরে চিৎকার করে। ঘরে চাল আছে অথচ ছেলেমেয়ে দুটো খিদেয় নেতিয়ে গিয়ে এদিক ওদিক ঘুরছে। অসুস্থ মানুষটা না জানি কোথা থেকে কোথা ঘুরে মরছে। সকালে মেয়েটা কতবার স্বপ্নের কথা বলে মায়ের কাছ থেকে একটা আশ্বাসের জন্যে প্রতীক্ষা করেছে। অথচ!
ডালিয়া সময় নষ্ট করে না। তাড়াহুড়ো করে চুলায় লাকড়ি গুজে। চালের কুড়া ঝাড়ে। চাল ধুইয়ে ভাত চরায়। তরকারীর ঝুড়িতে পরে থাকা কয়টা আলুর দিকে তাকিয়ে ভাবে, একটু আলুর দম করা যেতে পারে। এক কোয়া রসুন আছে। পিঁয়াজ কটায় ছাতনা পড়লেও ধুইয়ে টুইয়ে অল্প বাটা যাবে। কারো ঘর থেকে একটু গরমশলা চাইলেই দিবে। আতপ চালের ভাত আর আলুর দম বেশ পোলাও-মাংসের সুবাসই হবে। ডালিয়া চটপট সব গুছায়, গরমশলার জন্যে পড়শীকে ডাকে।
ভাবী, ও ভাবী, ঘরে নাকি?
হু আছি। কি কও?
গরমশল্লা আছেনি? একটু দিবা?
কি রানবা মাংস?
না, আলুর দম, গরমশল্লা দিলে মাংসের বাসনাই করবে।
আছে, এইদিকে, জানলার ফাঁক দিয়া হাতটা বাড়াও।
রান্না শেষ। ডালিয়া ছেলে-মেয়েকে হাত পা ধুইয়ে আসতে বলে নিজে যায় গা ধুতে। তখনি বাবুল হাতে একটা চালের থলে নিয়ে এসে ঘরে ঢুকে। থলেটা রেখে সে চকিতে বসে জোরে জোরে নি:শ্বাস নেয়। বাবুলের বুকের পাজর ধপধপ ওঠানামা করে। পুতুলের সে দিকে খেয়াল নেই, বাবার পুতুল পাশ ঘেষে ফিসফিসিয়ে চাল পেয়ে যাওয়ার পুরো গল্পটা বলে ফেলে। বলে, মাংস নয় আলুর দম কিন্তু তবুও কেমন মাংসের মত রান্না। কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে বাবুলের এলোপাথাড়ি শ্বাসটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। নাইলনের দড়িতে ঝুলতে থাকা গামছাটা নিয়ে সে চ ল গতিতে বাইরে চলে যায় ।
ডালিয়া কুপিতে আলো জ্বালে। মেয়েকে মাদুর পাততে বলে যায় রান্না ঘরের দিকে। জং ধরা মেলামেইনের চারটে থালায় ভাত বাড়ে। পুতুল ছুটে ছুটে সবাইকে থালা এগিয়ে দেয়। কুসুম গরম ভাতে ক্ষুধার্ত বিড়ালের মত সকলে ঝুঁকে থাকে। অপেক্ষা করে, তরকারীর জন্যে। ডালিয়া ব্যস্ত হয় সুস্বাদু সে আলুর দম ভাতের পাতে তুলে দেওয়ার জন্যে। সুখী সুখী মনে সে কাঠের হাতা নেয়, নেয় অ্যালুমিনিয়ামের একটি বাটি। কুপিটা ঝোলের উপর ঝুঁকায়। হাতাটা ঝোলে ডুবায়। দেখে, বাচ্চা একটা ইঁদুর তরকারীতে হাবুডুবু খাচ্ছে। বুকটা তার দম করে ওঠে। ভিতরের সব গুলিয়ে যায়। টু শব্দটি না করে চট করে ইদুরের লেজটি ধরে জানালার বাইরের অন্ধকারে ছুড়ে ফেলে দেয়। ততক্ষনে পুতুল এসে পিছনে দাঁড়িয়েছে।
আম্মা, তরকারীর বাটি নিয়া যাইতে লাগবে?
গিয়া বস। আমি আইতাছি। তর সয়না!
ডালিয়া হঠাৎই ধমকে ওঠে। বিজয়িনীর হাসিটা মূহুর্তেই উধাও হয়ে যায়। কেও কিচ্ছুটি টের পায় না। পুতুল বকবক করেই যায়।
দেখছোস ভাই আমি যাই স্বপ্ন দেখি তাই হয়। আব্বা তুমি তো সকালে শুনলাই না। কইলাম কত। আম্মা শুনছে। আম্মারে জিগাও। সক্কালে স্বপ্নের কথা কইছি আর বিকালে চাল খুইজা পাইছে। ফোদা আলু দিয়া মাংসের লাহান ঝোল রানছে।
বকবকানি থামা। খা। পুতুলের মা তারাতারি দে কি দিবি। শইলডা কাঁপতাছে খিদায়।
ডালিয়ার হাতটা মূহূর্তেই লোহার মত শক্ত হয়ে যায়। অনেক কষ্টে সে ভাতের থালায় তুলে দেয় আলুর দম। অভুক্ত জিহ্বা চেটেপুটে সব খায়। খেতে খেতে বাবুল জিজ্ঞাসা করে-
কিরে তুই খাইতিনা?
পরে। খাও তোমরা।
আম্মা কি যে মজা হইছে। স্বপ্নে আমি এমন তরকারীই খাইছি। আর একটু ঝোল দিবা?
মেয়ের পাতে ঝোল তুলে দিয়ে ডালিয়া ছুটে ঝুপরীর বাইরে যায়। পেটের সব উগড়ে দেয়ার চেষ্টা করে। বাবুল থালায় হাত ধুতে ধুতে বলে, সারাদিন খাওয়ন নাই পেটে! পুতুল আম্মারে ভাত খাইতে ক।
ঝুপড়ির পাশের ইশা থেকে গপ্পুর বউ স্বর উচিঁয়ে বলে,
কি ভাবী, পেটে কেউ নড়ে নাকি?
1 মন্তব্যসমূহ
valo legese didi
উত্তরমুছুন