আলী নূরের ধারাবাহিক স্মৃতিকথা: তুচ্ছ দিনের গান- পর্ব: ১০-১২



দশ

বিশ্বযুদ্ধের তাণ্ডব তখন বর্মা বর্ডারে। জাপানি আর মিত্রবাহিনীর মধ্যে চলছে তীব্র লড়াই। জাপানিরা চট্টগ্রাম অ্যারোড্রামে বোমাবর্ষণ করল। আমাদের গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে আব্বা থেকে গেলেন চট্টগ্রামে। সঙ্গে মেজভাই আর সেজভাই। দুজনে মুসলিম হাই স্কুলের ছাত্র। বছর খানেকের মধ্যে অবসর নিয়ে পরিবার নিযে বাস করবেন গ্রামে এই ছিল অভিপ্রায়। কিন্তু চট্টগ্রামে জাপানিদের হঠাৎ বোমা ফেলার দরুণ সব ওলট পালট হয়ে গেল। আমরা উঠে গেলাম গ্রামের নতুন বাড়িতে । কয়েক মাসের মধ্যে আব্বা আসলেন কয়েকদিনের ছুটিতে। একদিন আমাকে নিয়ে অনেকদূর গেলেন সামনের ক্ষেতগুলো দেখতে। 
কিছু মরিচ বোনা হয়েছিল। পেকে লাল হয়ে এসেছে। হঠাৎ অকালের বৃষ্টি এলো ভীষণভাবে। কাছাকাছি কোথাও যাবার জায়গা ছিল না। কাক ভেজা হয়ে আমি আর আব্বা বাড়ি ফিরলাম। তখন সন্ধের কাছাকাছি। ভেজা কাপড় ছেড়ে খাওয়া দাওয়া সেরে শুয়ে পড়লাম দুজনেই। রাতের বেলায় কাঁপুনি দিয়ে জ্বর। সবাই ভাবল বৃষ্টিতে ভেজার দরুণ। না, তা নয়। পল্লীগ্রামের চিরসঙ্গী ম্যালেরিয়া। প্রচন্ড জ্বর আর কাঁপুনি। অচেতন অবস্থা। ক্রমে দুজনের অবস্থা খারাপ হতে থাকল। অক্ষয় ডাক্তারকে ডাকা হলো। রক্ত পরীক্ষা করে চিন্তিত হয়ে পড়লেন তিনি- দুজনেরই মারাত্মক ম্যালিগনেন্ট ম্যালেরিয়া। এই জ্বরে বাঁচার আশা কম। ম্যালেরিয়ার একমাত্র ঔষধ কুইনাইনের প্রচণ্ড অভাব। বর্মা বর্ডারে যুদ্ধের কারণে সব চলে যেত মিলিটারির কাছে। বড়ভাই কলকাতা থেকে ম্যাপাক্রিন নামের কুইনাইন নিয়ে চাঁদপুর হয়ে এসে পৌঁছান অনেক কষ্ট করে। আমরা সেরে উঠি কিন্তু আব্বার গলার স্বর নষ্ট হয়।
 
সেজভাইয়ের কথায় মেজ ভাইয়ের অনেক স্মৃতি মনে পড়ে গেল। আমি ছিলাম তাঁর খুব আদরের। মেজভাই,সেজভাই পিঠাপিঠি, দুজনের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব আবার চুলোচুলিরও শেষ নেই। মেজ ভাই শরীরের দিক থেকে একটু বলিষ্ঠ ছিলেন বলে কথায় কথায় জোর খাটাতেন সেজভাইয়ের উপর। আব্বা যখন চাকুরি থেকে অবসর নিয়ে দেশে ফিরে এলেন তখন মেজভাই সেজভাইকেও নিয়ে এলেন মকিমপুরের বাড়িতে। দুজনকে ভর্তি করা হলো পাশের গ্রাম মাধবপুর স্কুলে । গ্রামের বাড়িতে সে অবধি তাদের দুরন্তপনার শেষ নেই। উদার প্রান্তর, অবাধ মাঠ, উন্মুক্ত আকাশ সব মিলে এদের দু’জন একেবারে প্রকৃতির সন্তান হয়ে পড়লেন। দুজনার বায়নারও শেষ নেই। আবদার ধরলেন, ঘোড়া কিনে দিতে হবে। শেষ অবধি কয়েক ক্রোশ দূরের পুটিয়ার হাট থেকে একটি সুন্দর লাল সাদা ছোপ-ছোপ ঘোড়া কিনে আনা হলো। দুজনে মেতে উঠলেন ঘোড়া নিয়ে। ঘোড়ার জিন, গদি, ব্রাশ, দলাই-মলাইর আনুষঙ্গিক অনেককিছু কেনা আরম্ভ হলো। ঘোড়ার যত্নে মেতে থাকলেন দুজনে। শিকেয় উঠল পড়াশুনা। ক’দিনেই অনেক কসরৎ শিখে ফেললেন ঘোড়-সওয়ারিরা। এই ঘোড়াটার প্রতি আমারও অনেক আকর্ষণ। আমি খুব ছোটো। ঘোড়ায় চড়তে পারতাম না। কেউ তুলে দিলে ঘোড়া চালাতে পারতাম। একদিন দুপুরে দক্ষিণ দিকের বাইরের ঘর ঘেঁষে একটা কাঁঠাল গাছে ঘোড়াটা বাঁধা। কাঁঠাল গাছ বেয়ে আমি ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলাম। সবার অজান্তে ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম মিরপুরে মাহতাবদের বাড়ির দিকে। কারো বোধ করি বুঝতে বাকি রইল না, আমি কাউকে না জানিয়েই ঘোড়া নিয়ে বেরিয়েছি। ঘোড়াটাকে কুলোয় করে ধান খাওয়ালেন সবাই। তারপর ওর লাগাম ধরে আস্তে আস্তে আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হলো। আমি আগাগোড়াই ঘোড়ার পিঠে। এই এ্যাডভেঞ্চার সবাই উপভোগ করলেন। আমাকে কোন বকাঝকা করা হলো না। কিন্তু ঘোড়া রোগে আমাকে পেয়ে বসল। প্রতিদিন আমার ঘোড়া চড়তে হবেই। যাই হোক, মেজভাই-সেজভাইয়ের ঘোড়া নিয়ে অতি বাড়াবাড়ির কারণে গোল্লায় যাওয়ার আশঙ্কা দেখলেন অভিভাবকরা। ঠিক হলো ঘোড়া বেচে দেয়া হবে এবং একদিন তাই করা হলো। যারা কিনলেন তাদেরকে ঘোড়া নিতে দেবো না আমি কোনোমতেই। আমাকে বোঝানো হলো ঘোড়ার খুড়ে কালাই করা অর্থাৎ পাত লাগানোর জন্য নেয়া হচ্ছে। আমি শান্ত হলাম। বলা বাহুল্য এই কালাই করা শেষ হয়নি কখনও, ঘোড়াও আর ফেরেনি কোনদিন। অদর্শণে বালক মন কিছুদিনের মধ্যে ভুলে গেল ঘোড়া বিরহের যাতনা। 
 
মেজভাই প্রায়ই সেজভাইয়ের উপর চড়াও হতেন। দুজনের মধ্যে কথায় কথায় মারামারি লেগে যেত। আম্মা ভীষণ আতঙ্কে থাকতেন। মেজভাই একটু বলশালী হওয়ায় সেজভাই মার খেতেন বেশি। কিন্তু সেজভাই তা পুষিয়ে নিতেন তার কথার ধারে। তার তীক্ষ্ণ কথার বাণে মেজভাইর জয়ের আনন্দ ম্লান হয়ে যেত, তাই আরো চটে যেতেন। এসব দেখে মেজ ভাইকে ব্রাহ্মনবাড়িয়া অন্নদাচরণ স্কুলে পাঠানো হলো। সেখানে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেন এবং ১৯৪৬ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। পরীক্ষা শেষে মেজভাই যেবার বাড়ি ফিরলেন আমার মনে পড়ে আমি প্রাইমারি স্কুলের আমতলা থেকে দেখি পাশের খাল দিয়ে মেজভাইয়ের ডিঙি আসছে। নৌকার সামনে একটা মোড়ায় বসা মেজভাই, পাশে শোয়ানো তাঁর শখের রেলী সাইকেল। দেখে গর্বে আমার বুক ফুলে উঠলো। মনে হলো আমার ভাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া নয়, যেন বিলেত থেকে ফিরছেন, এবং পাশের শোওয়ানো বস্তুটা সাইকেল নয়, মোটর গাড়ি। আমি স্কুল ফেলে এক লাফে মেজভাইয়ের নৌকায়।

মেজভাইয়ের কথায় অনেক কথা মনে পড়ে গেল। তখনও স্বদেশী আন্দোলনের উত্তেজনা তরুণদের মনে। পাড়ায় পাড়ায় ব্যায়ামাগার, লাঠি খেলা, পাঠাগার ইত্যাদি খুব দেখা যেত। কুমিল্লা বিষ্ণুপুরে আনুদের বাসার কাছেই এরকম দুয়েকটা ব্যায়ামাগার ছিল। মেজভাই তখন ভিক্টোরিয়া কলেজে আই,এস,সি পড়েন। তাজু ভাইয়েরও এইসবে উৎসাহ ছিল। মেজ ভাই তাজুভাইকে ধরে আলাদা বাইরের ঘর এবং তার সামনে পুরো দস্তুর এক ব্যায়ামাগার প্রতিষ্ঠা করালেন। গাছের ডালে লোহার রিং ঝুলানো হলো। হরিজন্টাল বার বসলো। মুগুর ভাজা বারবেল ইত্যাদির জন্য একটা বালুর বর্গাকার জায়গা তৈরী হলো। মেজভাই এই বাইরের ঘরে থাকেন, আর খুব ভোরে উঠে কিছুক্ষণ নানা কসরৎ করেন। একটা কেরোসিন স্টোভে অনেকক্ষণ পাম্প করে নীল আগুন বেরুলে ওতে দুটো ডিম পোচ করে তাই খেয়ে পড়তে বসতেন। তাঁর অনেক আয়োজন ছিল। আমাকে তাঁর সঙ্গে বাইরের ঘরে থেকে পড়াশোনা করার কথা বলতেই আমি তক্ষুনি রাজি হয়ে গেলাম। পড়াশোনার আগ্রহে নয়, ডিম পোচের লোভে।
 
মেজভাইয়ের গানের শখ ছিল। তখনকার দিনের জনপ্রিয় সব গান তার গলায় এবং খাতায় তোলা ছিল। আমি এসব গানের পাগল ছিলাম তখন থেকেই। এই সময়ের কিছু শিল্পীর কথা মনে পড়ে। পঙ্কজ মল্লিক, সন্তোষ সেনগুপ্ত, সায়গল, কানন দেবী, শচীন দেব বর্মন, কে সি দে এবং আরো পরে, সত্য চৌধুরী, জগন্ময় মিত্র, গৌরীকেদার ভট্টাচার্য। এই সময়ে একটা গান ছিল ‘দিন দুনিয়ার মালিক তোমার দিল কি দয়া হয় না, কাঁটার আঘাত দাও তারে যার ফুলের আঘাত সয়না’। এই বাউল গান এখন আবার ফিরে এসেছে, অবশ্য ভিন্ন সুর, ভিন্ন গায়কীতে। সন্তোষ সেনগুপ্তের 'জীবনে যারে কভু দাওনি মালা মরণে কেন তারে দিতে এলে ফুল', আমাকে খুব ছুঁয়ে যেত। বুবুর খালি গলায় কানন দেবীর গান, ‘ওগো সুন্দর মনের গহনে তোমার মূরতিখানি ভেঙ্গে ভেঙ্গে যায় মুছে যায় বারে বারে’ এবং ‘যদি আপনার মনে মাধুরী মিশায়ে এঁকে থাক কারো ছবি’ এখনো কানে বাজে। শচীন দেবের ‘তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে’ এবং ‘উদয়ের পথে’ সিনেমার গান, ‘গেয়ে যাই গান গেয়ে যাই’ এবং ‘তোমার বাঁধন খুলতে লাগে বেদন কী যে’ খুব গাইত সবাই। আম্মাকে গুনগুন করে গাইতে শুনেছি, ‘পাগলা মনটারে তুই বাঁধ।’ আমাদের একটা সেনোলা গ্রামোফোন ছিল। আর বড়বুবুর ছিল একটা হিজ মাষ্টারস ভয়েস। অনেক গান শুনতাম। অনেক লেবেলে রেকর্ড বেরোত, হিজ মাস্টার্স ভয়েসে ছিল কুকুরের ছবি, নিউ থিয়েটার্সের থাকত শুঁড় উঁচু করা একজোড়া হাতি, হিন্দুস্থান রেকর্ডসে থাকত বাঁশি বাজানো এক রাখালিয়ার ছবি, টুইন রের্কডে থাকত হলুদ রঙের লেবেলের উপর দুই জমজ ভাইের ছবি এবং সেনোলা রের্কডে থাকত চিত্রা হরিণের ছবি। আর কলাম্বিয়া রেকর্ডের ছিল নীল রঙের উপর রুপালি ছাপে ইংরেজি নোটেশনের উপর কলাম্বিয়া লেখা। কলাম্বিয়া রেকর্ডে পঙ্কজ মল্লিকের দুটি গান ছিল, 'আমারে ভালবেসে আমারি লাগিয়া সয়েছ কত ব্যথা’, অন্য পিঠে, 'ও কেন গেল চলে কথাটি নাহি বলে'। পরের গানটি একদিন আমার জীবনে সত্য হয়ে উঠে।



এগারো



মিনুবুবুর বিয়ের পর আমরা যখন দ্বিতীয়বারের মত মকিমপুর আসি তখন বড় ভাই ভাবীকে নিয়ে কিছুদিন ছিলেন এই বাড়িতে। ভাবী শহুরে মানুষ। ভাবীর আব্বা ছিলেন বাগেরহাট শহরে সেইকালের নামী ডাক্তার । খুব শৌখিন লোক। মোটা মোটা চুরুট খেতেন। দেখতে ছিলেন ধীরাজ ভট্টাচার্যের মত। কথায় কথায় সপরিবারে বেড়াতে যেতেন কলিকাতায়। বড়ভাই সেই সময় বাগেরহাটে সিভিল সাপ্লাই এনফোর্সমেন্টে প্রিভেন্টিভ অফিসার ছিলেন। তরুণ, স্মার্ট অফিসার, স্কটিশচার্চের গ্র্যাজুয়েট। ভাবীর আব্বার সঙ্গে আলাপ এবং বাড়ি তে আসা-যাওয়া। সেইসুত্রে ভাবীর সঙ্গে প্রেম এবং শেষ পর্যন্ত বিয়ে। বিয়ে হয় কলকাতায় পার্কসার্কাসে। তখন কলকাতায় ‘৪৬ এর দারুণ দাঙ্গা চলছে। বড়ভাই গ্রামে এসে একেবারে গ্রামের জীবনযাত্রার সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে ফেললেন। সামনের দক্ষিণের ঘরটা যেখানে সেজভাই থাকতেন সেখানটায় থাকতেন বড়ভাই আর ভাবী। গ্রামের রেওয়াজ মতো সারাদিন ভাবী থাকতেন অন্দরে রাতে যেতেন নিজের শোবার ঘরে। সারাদিন বড় ভাইয়ের কাটত মজলিশ ভাইসাবের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে, তামাক খেয়ে। 
 
এই সময়টা কোথাও কোন স্কুলে পড়ছিলাম না। ভিক্টোরিয়া স্কুলে ক্লাস ফাইভের শেষ দিকে চলে এসেছি গ্রামে। তখন থেকেই চিন্তা-ভাবনা চলছিল আমরা ঢাকায় চলে যাব।
 
বড়ভাই বাড়িতেই আমার পড়াশুনার ভার নেন। প্রত্যেক দিন দিন ইংরেজি গ্রামার শেখা আর ট্র্যানশ্লেশন করতে হতো। বড় ভাই এর কাছে ইংরেজি শিক্ষা ভালই চলছিল। একবার অনভ্যাসবশত বৈলা খড়ম থেকে পা পিছলে বড়ভাই সাংঘাতিক জখম হলেন। ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের ফাঁকে খড়মের বৈলা ঢুকে একেবারে চিরে যায় গভীর করে। প্রফুল্ল ডাক্তার আসতেন রোজ ড্রেসিং করতে। অনেকদিন ভুগেছিলেন বড়ভাই। বড়ভাই যখন আর পড়া নিতে পারছেন না আমি মহাসুখে পড়া বন্ধ করে সারাদিন ঘুরে বেড়ানোতে ফিরে গেলাম। দিন বিশেক পর একটু সুস্থ হতেই বড়ভাই পিছনের পড়া ধরলেন। কিছুইতো পড়া নেই। মহা ক্ষেপে গেলেন বড়ভাই। বিছানায় বসেই আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে পিঠের উপর লাগালেন বেশ কয়েক লাথি। এর আগে বড়ভাই কখনও হাত তোলেননি আমার গায়ে। আমি ভীষণ অপমানিত বোধ করলাম। মার খাওয়ার জন্য যতটা নয়, পা দিয়ে মারার জন্য তার অধিক। পা দিয়ে মারার মধ্যে কোথায় একটা অপমানের ব্যাপার ছিল। 
 
ভাবী শহুরে মেয়ে গ্রামে এসে একেবারে গ্রামের মেয়ে হয়ে গেলেন। আসলে ভাবী আমাদের পরিবারের সঙ্গে অতি সহজেই মিশে যেতে পেরেছিলেন। গোসল করেন পুকুরে। কাপড় ছাড়েন পাড়ে শাড়ি দিয়ে একটা ঘেরাটোপ বানিয়ে। ভাবী খুব চা খেতেন। এই নিয়ে গ্রামের মেয়েরা ভারী অবাক হতো। গ্রামের মেয়েদের মধ্যে চা'য়ের চল ছিল না। এই সময় বড়ভাই ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। আর গোলামী নয় , স্বাধীন ব্যবসা। কুটির বাজারে ওমর আলীর সঙ্গে পার্টনারশিপে খুললেন জুতার দোকান। কিছুদিনের মধ্যেই যা হবার তা হলো, অংশীদারী কারবার বন্ধ হলো। ভাগাভাগিতে তাঁর অংশে বড় ভাই পেলেন শ' দুয়েক জোড়া জুতা। এগুলো পশ্চিমের বড় ঘরে সাজিয়ে রাখা হলো। সদু ভাইসাহেব ব্যাঙ্গ করে বলতেন, এগুলো এখন একটা কাঁচি দিয়ে টুকরো টুকরো করে খাও। আসলে, কলকাতার সাহেবী কলেজে পড়া বড়ভাইয়ের গ্রামের গঞ্জে-বাজারে ব্যবসা করাটা কেউ মেনে নিতে পারছিল না। এর আগেও বড় ভাই একবার পরের অধীনে চাকুরি না করার সংকল্প নিয়ে স্বাধীন ব্যবসার লক্ষ্যে বাড়িতে একটা পোল্ট্রি ফার্ম আরম্ভ করেছিলেন, সরল পোল্ট্রিপালন বই সম্বল করে। কিছুদিনের মধ্যে মড়ক লেগে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল খামার। পরবর্তী জীবনে একজন প্রখ্যাত আয়কর আইনজীবি হিসাবে যার যশ-খ্যাতি দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে তাঁর তো এইসব ছোটখাটো ব্যবসায় সফল হলে চলবে না। যাই হোক, এবার এই সব ছেড়ে ঢাকায় গিয়ে ভাগ্য অন্বেষণের সিদ্ধান্ত নিলেন বড় ভাই। আমিও স্বস্তি পেলাম- পড়া ধরার আর কেউ নেই। 
 
গ্রামের এই বাড়িতে থাকার প্রথম দিককার দিনগুলিতে দেখতাম বৎসরের কোনো এক বিশেষ সময়ে আম্মার মুখে আতঙ্ক। সবাই কী একটা নিয়ে অস্ফুট কানাকানি করত। আমি কিছু বুঝতে পারতাম না। শুনতাম পাশের গ্রামগুলিতে কোনো কোনো বাড়িতে ওলাউঠাতে উজাড় হয়ে গেছে এই সব কাহিনী। কল্পকাহিনীতে মানুষের মন আরও শঙ্কিত হয়ে পড়ত। একটা কথা তখন খুব প্রচলিত ছিল, যে গ্রামে ওলাওঠা দেখা দিত তার আগের রাতেই সাদা ফিনফিনে কাপড় পরা একজন মেয়েলোককে দেখা যেত হাওয়ায় ভর করে ঐ গ্রামের দিকে আসতে। পরদিনই শুরু হতো কলেরার তাণ্ডব। ভেদ-বমি আর মৃত্যু। উজাড় হয়ে যেত গ্রাম। কলেরা আসত মহামারী আকারে প্রতি বছর। ম্যালেরিয়া তো লেগে থাকতই সারা বছর।

তখন গ্রামে কোনো টিউবওয়েল ছিলনা। পুকুরে যেখানে সবাই গোসল করা কাপড় কাচা এবং আনুষঙ্গিক কাজকর্ম সারতেন সেখানকার পানিই ছিল সবার খাবার পানি। এখন আশ্চর্য হই কেন পানি সেদ্ধ করে খাওয়ানো হতো না সবাইকে। আমাদের বাড়িতে এরকম ব্যবস্থা না থাকা ছিল অমার্জনীয় । সেবার আমাদের বাড়ির সামনেই মদন ভাইদের বাড়িতে অনেকে মারা গেল। এর পরেও এই বাড়িতে মিলন ও আরো কিছু তরুণ মারা যায়। কিন্তু প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। গ্রামে সেই কালে জ্বালানীর অভাব ছিল না। পাটখড়ি তো সবার ঘরেই জমা করা থাকত সারা বছরের জন্য। আপৎকালে পানি সেদ্ধ করে খাওয়া তেমন কঠিণ কিছু ছিল না। ছিল শিক্ষার অভাব। একথা বলার কেউ ছিল না। অজ্ঞতার কারণে অনেক প্রাণ অকালে ঝরে যেত। আমাদের বাড়ি তে পানি শোধন হত ফিটকারি দিয়ে। বড় বড় মটকায় পুকুর থেকে পানি এনে ভরা হতো। এগুলোতে ফিটকারি দিলে ভারী পরিষ্কার হতো কিন্তু জীবানুমুক্ত হত কতটা বলা চলেনা। আম্মা অধিকতর সাবধানতা হিসাবে তাঁর সুপারি কাটার লোহার যাতিটা পুড়িয়ে ঐ পানিতে ডুবিয়ে তুলতেন। জানিনা এতে কী ফল হতো। যাই হোক আমাদের বাড়ি তে কলেরার প্রকোপ না দেখা দেওয়ায় আম্মার এই ব্যবস্থাকেই অমোঘ বলে মেনে নেয়া হলো। কিন্তু কেউ ভাবল না এই সময়ে আমরা যে কলেরা ইনজেকশান নিতাম তাইতে কলেরা প্রতিরোধ হতো। গ্রামের অনেক পরিবার একজন পীরের মুরিদ ছিলেন। পীর সাহেবের নিষেধ ছিল তাঁর মুরিদরা অসুখে-বিসুখে যেন কোনো ডাক্তারের চিকিৎসা না-নেন। ফলে বিনা চিকিৎসায়, বিশেষ করে মহামারির সময় অনেকে মারা যেত। মদন ভাইসাবদের পুকুর পাড়ের সারিবাঁধা অনেকগুলি কবর তার নীরব সাক্ষী। এমন অনেক কুসংস্কার গ্রামগুলিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রেখেছে এখনও। 
 
এছাড়াও ভূত-প্রেত, জ্বীন-পরীতে বিশ্বাস তো ছেলেবুড়ো সবার মনে বাসা বেঁধে থাকত। একটা ঘটনা তখন খুব আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। আমার ফুফাতো ভাই সাত্তার, সবাই সেতু বলে ডাকত, খুব ভাল বাঁশী বাজাত। যুবা বয়স, ওদের বাড়ি আমাদের পূবে ষাটশলা গ্রামে। অনেক রাতে ওর আঁকুলকরা বাঁশির সুর ভেসে আসতো। বর্ষার দিন, নদী খালবিল পানিতে টইটুম্বুর। এমনি এক জোৎস্নাভরা রাতে নৌকা নিয়ে চলে গেল গ্রামের সীমানার প্রাচীন বটগাছের নিচের নিরিবিলি খালে। বাঁশিতে তুললো পাগল-করা সুর। একসময় বাঁশি থামে কিন্তু ওর আর কোন সাড়া নেই। অনেক রাত পর্যন্ত ঘরে না ফেরায় সবাই উদবিগ্ন হয়ে পড়ে। একটা ছিপ নৌকা নিয়ে পৌঁছে যায় বট গাছের কাছে। দেখে ওর নৌকা দাঁড়বিহীন এলোমেলো ভাসছে আর ও ঘাড় গুঁজে পড়ে আছে পেছনের গলুইর উপর। শোনা গেল, ওর বাাঁশির সুর শুনে একদল সুন্দরী পরী এসে ওর নৌকায় উঠে নাচতে থাকে এবং ওকে ওদের সঙ্গে নিয়ে যেতে চায়। ও রাজী না হওয়াতে ঘাড় মটকে ফেলে রেখে যায়। অনেকদিন পর্যন্ত উদভ্রান্তের মত ছিলেন সেতুভাই। জ্বীন-পরীদের নিয়ে এমন অনেক গল্প শোনা যেত ।
 
আমাদের গ্রামে চিকিৎসার সমস্যা তেমন ছিল না। পাশের কুটির বাজারে বসতেন অক্ষয় ডাক্তার, এলএমএফ। কিন্তু হাতযশ হার মানাত যে কোনো এমবি ডাক্তারকে। আব্বার কঠিন ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া তাঁর চিকিৎসায় সেরে ওঠে । আর ছিলেন বুগুইরের ডাক্তার হাবিবুর রহমান, এলএমএফ। মনে আছে তিনি একটা সুন্দর বাদামী রঙের ঘোড়ায় চেপে রোগী দেখতে যেতেন। তখনকার দিনে নৌকা ঘোড়া আর পাল্কি ছাড়া চলাচলের মত কোনো যানবাহন ছিল না। ছিল শুধু পায়ে হাঁটার ইউনিয়ন বোর্ডের কাঁচা সড়ক ছাড়া। আররেকজন গ্রামের ভেতরেই ছিলেন, প্রফুল্ল ডাক্তার। হাতুড়ে, কিন্তু তাঁরও হাতযশ ছিল খুব। শিখেছিলেন স্বদেশী কালে আন্দামানে কালাপানি খাটবার সময়। ছোটখাট অপারেশনও করতেন স্বচ্ছন্দ্যে। মনুর কানের পেছনের বড় একটা ফোঁড়া কেটে সারিয়ে দিয়েছিলেন শুধু নিয়মিত নিখুঁত ড্রেসিং করে।
 
বারো

আব্বার জন্ম এক সম্পন্ন গৃহস্থ পরিবারে। দাদারা দুই ভাই, ডিডু বক্স ও সাদির বক্স। অভিন্ন পরিবার, অনেক জায়গা-জমির মালিক। দাদা পরিবারের প্রধান। আমার দাদার নাম ডিডু বক্স। আব্বার আগে তাঁর এক ভাই শ্যাম মিঞা বাল্য বয়সে মারা যান। আব্বার দুই বোন, আব্বার বড় মাতুবু’র মা, আর ছোট ষাটশালার অবিদের মা। আব্বা ছিলেন গৌর বর্ণ। নাম রাখা হয়েছিল সোনা মিঞা। দাদা আব্বার শৈশবে মারা যান। আব্বা মানুষ হন তাঁর চাচা সাদির বক্সের হাতে। আব্বার পড়াশুনায় খুব আগ্রহ ছিল। পরলোকগত ভাইয়ের একমাত্র পুত্র সন্তানকে অকৃত্রিম স্নেহে লালন করতে থাকলেন চাচা সাদির বক্স । তার পড়াশুনার ব্যবস্থা করলেন পাঁচ মাইল দূরের কসবা স্কুলে। শুনেছি চাচা কাঁধে করে তাকে নিয়ে যান কসবায়। থাকাখাওয়ার ব্যবস্থা করলেন কসবায় এক অবস্থাপন্ন পরিবারের সঙ্গে। তাঁরা সস্নেহে আব্বাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন তাঁদের পরিবারে।এই পরিবারের লোকজনেরা আমার দাদার পরিবারকে সম্মান করতেন। আব্বার জন্য দুধ, চাঁপা কলা ইত্যাদি নিয়মিত যেত। চাচা সাদির বক্স নিজে এইসব নিয়ে প্রতি সপ্তাহে পৌঁছে যেতেন কসবায়। এখান থেকে আব্বা বৃত্তি লাভ করে মিডল স্কুল পরীক্ষা পাশ করে কুমিল্লা জিলা স্কুলে যান। আব্বা তাঁর বাল্যবন্ধু বড় শালঘরের মফিজউদ্দিন সাহেবকে গ্রামের মাদ্রাসা থেকে ছাড়িয়ে এনে জিলা স্কুলে ভর্তি করে দেন। দুজনে জিলা স্কুল হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেন এবং কৃতিত্বের সঙ্গে এনট্র্যান্স পরীক্ষা পাশ করেন।আম্মার মুখে শুনেছিলাম হোস্টেলে থাকার সময় মফিজ উদ্দিন সাহেবের বসন্তরোগ হলে সবাই হোস্টেল ছেড়ে চলে যায়। আব্বা একলা তাঁর বন্ধুর সেবাযত্ন চালিয়ে যান এই ভীষণ ছোঁয়াচে রোগের মধ্যে । এন্ট্রানস পাশ করে আব্বা ইন্জনিয়ারিং পড়তে যান ঢাকায় তখনকার একমাত্র সদ্য চালু করা আহসানিয়া ইন্জিনিয়ারিং স্কুলে। মফিজুদ্দিন সাহেব হলেন মোরশেদের বাবা। তিনি একজন সফল আইনজীবী এবং পরবর্তী জীবনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রথমে জেল ও পূনর্বাসন মন্ত্রি এবং পরে শিক্ষা মন্ত্রি হন। চাচা করাচিতে প্ল্যানিং কমিশনের মেম্বার থাকাকালীন সময়ে আমি তাঁর বান্দার রোডের বাসায় ছিলাম কিছুদিন। বড় স্নেহ করতেন আমাকে। নিজের বিকেলের ছানার বরাদ্দ থেকে আমার জন্য এক ভাগ রেখে দিতেন। মোরশেদের মেজভাই বলতেন ওঁরা দুভাই, জাহাঙ্গীর ভাই আর মোস্তফা ভাইও নাকি কয়েক মাস ছিলেন আমাদের সংসারে চট্টগ্রামের ডিস্ট্রিক্ট ইঞ্জিনিয়ারের বাংলোয়।
 
আব্বার চাচা সাদির বক্সের চার পুত্র। সবাই মেধাবী, কিন্তু তারা কেউ লেখাপড়ায় আগ্রহী ছিলেন না। আব্বার নিজের ভাই ছিল না, সব চাচাত ভাই। আমার চাচারা হচ্ছেন মকবুল হোসেন (মকবুল চাচা), ময়নাল হোসেন (মলু চাচা), জামশেদের বাবা আর আয়নাল হোসেন (আনু চাচা)। আর সবার ছোট যয়দাল হোসেন, যদুচাচা, অকৃতদার। আনুচাচা খুব গুণী কাঠমিস্ত্রি ছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে কার্পেন্টার হিসাবে যোগ দিয়ে অনেক দেশ ঘুরেছেন। যুদ্ধফেরত যখন গ্রামে ফিরলেন তখন অনেক টিনের খাবার সঙ্গে এনেছিলেন। আনু চাচার বড় ছেলে ফুলু অনেকদিন ছিল আমাদের পরিবারে, তারপর সিলেটে কোথায় গিয়ে বিয়ে করে সংসার করে। ফুলু বেঁচে নেই, অনেকদিন হয় মারা গেছে। ওর অনেক স্মৃতি আমার মনে আছে। আনু চাচার অন্য ছেলে লাল মিঞা। বাপের মতো খুব গুণী মিস্ত্রি। বিমানে চাকরী করত কার্পেন্টার পদে ভালো বেতনে। চাকুরী ছেড়ে ফার্নিচারের দোকান করেছিল কুটির বাজারে। কয়েকবছর আগে মারা যায়।
 
আমার চাচাদের মধ্যে সবার বড় মকবুল চাচা। তিনি দফাদার ছিলেন। খাকি হাফ প্যান্ট, সার্ট ও মাথায় লাল পাগড়ি পরতেন। হাতে থাকত একটা পিতলের বাঁধানো মানানসই লাঠি। আমার দারুণ লাগত। চাচার শরীর খুব বলিষ্ঠ ছিল বলেই বোধ করি এই চাকরি পেয়েছিলেন। তাঁর বড় ছেলে শাফি ভাই প্রথমে বড়ভাইয়ের সঙ্গে সিভিল সার্ভিস এনফোর্সমেন্টে এবং পরে পুলিশে ছিলেন। ইনি টেলিভিশনের মোশাররফের বাবা। আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আমার কবুতরের নেশা দেখে বিভিন্ন জায়গা থেকে সুন্দর সুন্দর সব কবুতর পাঠাতেন। শাফিভাইয়ের হাতে একবার গুরুতর আঘাত পাই আমি। কুমিল্লা জেলখানার পেছন দিকে একটা ড্রেনের মতো আছে। বিঞ্চুপুরের বাসা থেকে শহরের দিকে যেতে শর্টকাটের জন্য সবাই এই ড্রেনটা লাফিয়ে পার হতেন। একদিন শাফি ভাই আমাকে বললেন, চল্ তোকে ওপারে ছুড়ে পৌঁছাই, বলেই আমাকে সত্যিসত্যিই ছুঁড়ে মারলেন ওপারে। আমি খালের ওপাড়ে আছড়ে পড়ে কোমরে ভীষণ ব্যথা পেলাম। ঐ ব্যথা আমাকে অনেকদিন কষ্ট দিয়েছে। শাফিভাই তাঁর ছেলে মোশারফকে নিয়ে আসেন আমার কাছে, তখন পলিটেকনিকে পড়ে। ও ইলেকট্রোনিক্স বিভাগ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করে এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনে ভিডিও এডিটর হিসেবে কাজ করে অনেক সুনাম অর্জন করে। সেজভাইও এই পদে চাকরি করতেন। মোশারফ জাপানে ও অন্যান্য দেশ থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসে। ওর স্ত্রী একজন সুশিক্ষিত, পলিটিক্যাল সায়েন্সে এম,এ পাশ। শাফিভাই থাকতেই বিয়ে করিয়েছিলেন। বরযাত্রী যায় আমার হোল্ডেন গাড়ি করে। মোশারফের মধ্যে প্রতিভা আছে। ও একজন প্রতিষ্ঠিত গীতিকার। ওর অনেক গান টেলিভিশন ও রেডিওতে গাওয়া হয়। ও এখন সিডনিতে একজন সফল ব্যাবসায়ী হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত। শাফীভাইয়ের ছোট আলী হোসেন আমার সমবয়সী। ছেলে বেলায় পুরনো বাড়ি , যেটা এখন আমাদের 'অমৃতসদন', ওখানটায় ওর সঙ্গে আর তারুর সঙ্গে অনেক খেলেছি। ও কুমিল্লা শিল্প ব্যাংকে চাকুরি করত। সেজ ভাইয়ের মৃত্যুর পর গোসল করানো ও অনান্য সব কাজ ও করল। আলী হোসেনের ছেলে সূজন অভিনয়ের সঙ্গে জড়িত । দেখতে ভারি সুন্দর, নায়কোচিত। 
 
এরপরের চাচা হলেন মলু চাচা। শহেদা ওনার বড় মেয়ে। অন্যরা হলো জামশেদ আর হাসিনা। অনেক বয়স পর্যন্ত ওরা দুই ভাই বোন বুলুর কাছে ছিল। জামশেদ সোজা সরল ছেলে। খরমপুর দরগাহর সামনে ডালপুরি, সিংগারা পরোটার দোকান চালায়। সামান্যই পায়, ওতেই সন্তুষ্ট। বুলু্ পা ভেঙ্গে বারডেমে থাকার সময় জামশেদ ওর কাছে ছিল সর্বক্ষণের জন্য। যখনই ঢাকা আসে আমাদের বাসায় এসে ডালপুরি, সিংগারা, গজা ইত্যাদি বানিয়ে দিয়ে যায়। সবার বড় শহেদা কাজ এড়ানোর ওস্তাদ ছিল। একবার চাচা ওকে বললেন, মা শহেদা, একবার তামাকটা দিয়ে যা। ও বলল, আব্বা, আমি ঘুমিয়ে আছি!
 
চাচাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ আমাদের সবার প্রিয় যদু চাচা, জয়দাল হোসেন। বিয়ে করেন নি। আমাদের সঙ্গে কাটিয়ে দিলেন সারাটি জীবন। আম্মার খুব আদরের। বুলু আর আমি ছিলাম তাঁর চোখের মণি। আম্মা তখন কৃষিকাজে হাত দিয়েছেন। বাড়িভর্তি কৃষক-মজুর, গোয়ালভরা গরু, গোলাভরা ধান - এর সব তদারকির ভার যদু চাচার হাতে। ছেলে বেলায় এসেছিলেন আম্মার সংসারে। সারাটি জীবন কাটিয়ে দিলেন আমাদের সংসারে। আমরা ঢাকায় ১৯৪৮ সালে যখন চলে আসি যদু চাচাও এলেন আমাদের সঙ্গে। সুন্দর করে মাদ্রাজিদের মতো করে ধুতি পরতেন। যদুচাচার কোলেপিঠে বুলু আর আমি মানুষ । খুব তামাক খেতেন। গ্রামের সবাই খায়। কিছুদিন যাবত গায়েগায়ে জ্বর, কাশি তো সবসময়ের সঙ্গী ছিলই। এখন কাশির সঙ্গে রক্ত দেখা দিলো। ধরা পড়লো যদু চাচার টিবি। ঐদিনে টিবির কোনো চিকিৎসা ছিল না। আর যদু চাচার টিবি ছিল একেবারেই শেষ অবস্থায়। সবদিক ভেবে তাকে মকিমপুরের পুরানো বাড়িতে পাঠানো ঠিক হলো। কদিন পরেই আমি চাচাকে দেখতে গেলাম আব্বার সঙ্গে। উত্তরের ভিটায় আনুচাচার ঘরে মেঝেতে একটা মাদুর পেতে শোয়া। শরীর শীর্ণ, চোখ কোটরাগত। মনে হলো মৃত্যু তাঁর শিয়রে। দু’জনে অনেক কাঁদলাম। কদিন পরেই যদুচাচা মারা যান। সংসারে তার আর কেউ থাকল না। যদুচাচা খুব সুন্দর বাঁশি বাজাতেন। তার একটা সৌখিন তেল চকচকে বাঁশি ছিল।

(চলবে)


লেখক পরিচিতি:
আলী নূর
পেশায় আইনজীবী।

বই পড়া, গানশোনা, ফুল ফোটানো, নাটক কিংবা ওড়িশি নৃত্য অথবা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, যন্ত্রসঙ্গীত এইসব নিয়েই তাঁর আনন্দযাপন। তাঁর নানা শখের মধ্যে দেশভ্রমণ, ছবি আঁকা, ফটোগ্রাফি এবং সিনেমাটোগ্রাফি অন্যতম। তিনি জীবনযাপন নয় জীবন উদযাপনে বিশ্বাসী।

বৃটিশ-ভারত, পাকিস্তান এবং স্বাধীন বাংলাদেশ এই তিন কাল তিনি দেখেছেন, দেখছেন। তুচ্ছদিনের গান কেবল তাঁর জীবনের গল্প নয় বরং গল্পচ্ছলে ইতিহাসের পরিভ্রমণ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ