রেমন্ড কারভারের গল্প : আন্তন চেকভের শেষ কটা দিন


সমকালীন আমেরিকান গল্প
অনুবাদ : বিপ্লব বিশ্বাস

চেকভ। ১৮৯৭ সালের ২২শে মার্চ সন্ধ্যায় মস্কো শহরে ডিনার সারতে গেলেন অন্তরঙ্গ বন্ধু অ্যালেক্সি সুভোরিনের সঙ্গে। এই সুভোরিন এক ধনী সংবাদপত্র ও পুস্তক প্রকাশক, একজন প্রতিক্রিয়াশীল, স্বকৃত মানুষ যার বাবা ছিলেন বোরোদিনোর যুদ্ধে এক সাধারণ সৈনিক। চেকভের মতো সেও ছিল এক ক্রীতদাস কৃষকের( সার্ফ) নাতি। এটাই ছিল তাদের মধ্যে মিল: উভয়ের শিরাতেই কৃষকের রক্ত। অন্যথায় রাজনীতি তথা মেজাজগতভাবে তাদের মধ্যে বিস্তর ফারাক। তা সত্ত্বেও সুভোরিন চেকভের গুটিকয় ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের অন্যতম। তিনি তার সঙ্গ উপভোগও করতেন।
 
স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা শহরের শ্রেষ্ঠ রেস্তোরাঁয় গেলেন, ' হারমিটেজ ' নামের এক বাসভবন যেখানে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেওয়া যায়, দশ পদের খাবার শেষ করতে মাঝ রাত্রি হয়ে যায়, সঙ্গে কয়েক রকমের মদ, মিষ্টি - কড়া সুরা আর কফি। বরাবরের মতো নিঁখুত পোশাকে সেজেছেন চেকভ - কালো স্যুট, ওয়েস্টকোট আর চোখে ডান্ডিছাড়া স্প্রিংজোড়া চশমা। সেই সময়ে তাঁর যে সব ফোটো নেওয়া হয়েছিল সেই রাত্রে তেমনই দেখাচ্ছিলেন তিনি। খুব ফুরফুরে, ভারমুক্ত ছিলেন। হোটেল ম্যানেজারের সঙ্গে করমর্দন করলেন, এক ঝলক তাকিয়ে বিশাল ডাইনিং হলে ঢুকলেন। ঝাড়বাতির উজ্জ্বল আলোয় সুসজ্জিত, টেবিলগুলোর দখল নিয়েছে সম্ভ্রান্ত পোশাকের নারী -পুরুষ। ওয়েটারদের অবিরাম আনাগোনা চলছে। সবেমাত্র তিনি টেবিলে সুভোরিনের উলটোদিকে বসেছেন যখন হঠাৎ করে বিপদসংকেত ছাড়াই তাঁর মুখ দিয়ে হড়হড়িয়ে রক্ত বেরোতে লাগল। সুভোরিন দুজন ওয়েটারের সাহায্যে তাকে সম্ভ্রান্তজনেদের জন্য রক্ষিত ঘরে নিয়ে গেলেন, সেখানে আইসপ্যাক দিয়ে রক্তের ঝলক আটকাতে চেষ্টা করলেন। সুভোরিন চেকভকে তাঁর নিজের হোটেলে নিয়ে গিয়ে, স্যুইটের একটা ঘরে বিছানা করে শুইয়ে দিলেন। আর একবার রক্তক্ষরণের পর চেকভকে তাঁর ইচ্ছানুসারে একটা ক্লিনিকে স্থানান্তরিত করা হল যেখানে টিবি ও সংশ্লিষ্ট শ্বাস-সংক্রান্ত সংক্রমণের বিশেষ চিকিৎসা হয়। পরে সুভোরিন সেখানে তাঁকে দেখতে গেলে তিনরাত্রি আগে রেস্তোরাঁয় যে ' কলঙ্কজনক ঘটনা ' ঘটেছিল তার জন্য তিনি ক্ষমা চাইলেন কিন্তু বারবার বলতে লাগলেন, তেমন মারাত্মক কিছু হয়নি তাঁর। ' তিনি বরাবরের মতো হাসিঠাট্টার মেজাজেই ছিলেন ', সুভোরিন তার ডাইরিতে লিখেছিলেন, ' যখন এক বিশাল পাত্রে রক্তমাখা থুতু ফেলছিলেন। '
 
তাঁর ছোটো বোন মারিয়া চেকভ মার্চ মাসের শেষের দিকে দাদাকে দেখতে ক্লিনিকে গিয়েছিল। বাজে আবহাওয়া ; ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে শিলাবৃষ্টি আর সর্বত্র তুষার জমে পাহাড়। তার পক্ষে হাত নেড়ে গাড়ি থামিয়ে ক্লিনিকে পৌঁছনো দুষ্কর হয়ে পড়ল। যখন পৌঁছুল তার সর্বাঙ্গে ভয় আর উৎকণ্ঠা।
 
' আন্তন পাভলোভিচ বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন ', মারিয়া তার স্মৃতিকথায় লিখেছে, ' তাঁকে কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে না। তাঁকে সম্ভাষণ জানিয়ে আমি টেবিলের ওধারে গেলাম, আবেগ লুকোতে। ' সেখানে শ্যাম্পেনের বোতলের মাঝে সামুদ্রিক মাছের ডিমভর্তি বয়াম, হিতাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকে পাওয়া ফুলের তোড়া আর তার মধ্যেই এমন কিছু তার নজরে আসে যা তাকে ভয় পাইয়ে দেয় : একটা হাতে আঁকা স্কেচ হয়তো দাদা চেকভের ফুসফুসের বিষয়ে। এই ধরনের স্কেচ ডাক্তারবাবু তার রোগীকে দেখানোর জন্য তৈরি করেন যা ঘটছে তা বোঝানোর জন্য। ফুসফুসের চারদিকটা নীল কালিতে আঁকা কিন্তু ওপরের অংশটা লাল রঙে ভর্তি। ' বুঝতে পারলাম ওই অংশটা আক্রান্ত ', মারিয়া লিখেছে।
 
লিয়ো টলস্টয়ও তাঁকে দেখতে এসেছিলেন। হাসপাতাল কর্মীরা তাদের মাঝে দেশের মহত্তম লেখককে দেখে শ্রদ্ধামিশ্রিত বিস্ময়ে নুইয়ে পড়ে। রাশিয়ার বিখ্যাততম ব্যক্তি! তারা অবশ্যই চেকভকে দেখানোর জন্য তাঁকে নিয়ে গেল এমনকি যদিও ' গৌণ ' সাক্ষাৎপ্রার্থীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। নার্স এবং রেসিডেন্ট ডাক্তারদের তরফে যথেষ্ট অভিনন্দিত হয়ে সেই দাড়িওয়ালা হিংস্র চেহারার বৃদ্ধ চেকভের ঘরে গেলেন। নাটককার হিসেবে চেকভের সামর্থ্য সম্পর্কে নিম্নমানের মতামত সত্ত্বেও ( টলস্টয় মনে করতেন চেকভের নাটক সব স্থবির ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিবর্জিত। ' তোমার সৃষ্ট চরিত্রগুলো তোমাকে কোন দিশা দেখায়? ' চেকভকে এক সময় তিনি এই প্রশ্নই করেছিলেন, ' সোফা থেকে আবর্জনা রাখার ঘর অব্দি আবার সেখান থেকে সোফায় ') টলস্টয় চেকভের ছোটোগল্প খুবই পছন্দ করতেন। তা ছাড়া সরলভাবে তিনি মানুষটিকে ভালোবাসতেন। তিনি গোর্কিকে বলেছিলেন, ' কী সুন্দর চমৎকার মানুষ : বিনয়ী, শান্ত, ঠিক কোনও মেয়ের মতো। এমনকি তার হাঁটাটাও মেয়েলি। সহজভাবে বলতে গেলে সে এক বিস্ময়কর মানুষ!' টলস্টয় তাঁর জার্নালে লিখেছিলেন, 
( সেকালে প্রত্যেকেই জার্নাল বা ডাইরি লিখতেন) ' চেকভকে ভালোবাসতে পেরে আমি খুশি। '
 
টলস্টয় তাঁর উলের স্কার্ফ আর ভালুকের চামড়ার কোটটি খুলে চেকভের বেডের পাশে নিচু হয়ে একটা চেয়ারে বসলেন। চেকভ যে শুধু ওষুধের ওপর আছেন এবং তাঁর কথা বলা বারণ এমনকি আলাপচারিতাও - সে বিষয়টি মাথায় রাখলেনই না টলস্টয়। কাউন্ট মহোদয় যখন আত্মার অমরত্ব বিষয়ে তাঁর যুক্তিতর্কের থিয়োরি শোনাতে লাগলেন, অবাক হয়ে,চেকভকে তা শুনতে হল। এই পরিদর্শন বিষয়ে পরে চেখভ লিখেছিলেন, ' টলস্টয়ের ধারণা যে আমরা সকলেই 
( মানুষ ও প্রাণীকুল সব) একটা নীতি ধারণ করে বাঁচব ( যেমন যুক্তি বা প্রেম) যার নির্যাস তথা লক্ষ্য আমাদের কাছে রহস্যময়... সেই জাতীয় অমরত্বে আমার কোনও দরকার নেই। আমি এটা বুঝি না আর লেভ নিকোলাইভিচ আমার এই নেতিবাচকতায় যারপরনাই অবাক হয়েছিলেন। '
 
তা হলেও তাঁকে দেখতে আসার পিছনে টলস্টয়ের একান্ত উৎকণ্ঠা চেকভকে নাড়া দিয়েছিল। কিন্তু টলস্টয়ের মতো চেকভ পরজন্মে বিশ্বাস করেননি এবং কখনোই তাঁর সে রকম আস্থা ছিল না। তাঁর পঞ্চেন্দ্রিয়ের একটি বা একাধিক ইন্দ্রিয়ের কাছে বোধ্য হবে না, এমন কিছু তিনি বিশ্বাস করতেন না; এবং জীবন ও লেখালিখি বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিকোণ বোঝাতে গিয়ে একবার তিনি কাউকে বলেছিলেন, ' রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও দার্শনিক জগৎ সম্পর্কে আমার কোনও মতবাদ নেই। প্রতি মাসেই আমার ক্ষেত্রে এগুলি বদলে যায়, তাই আমার বীর নায়কেরা কীভাবে ভালোবাসে, বিয়েথা করে, সন্তানের জন্ম দেয়, মারা যায় এবং কীভাবে তারা কথা বলে - সেইসব বর্ণনাতেই আমি নিজেকে সীমায়িত রাখি। '

তাঁর টিবি ধরা পড়ার আগে চেকভ মন্তব্য করেছিলেন, ' যখন কোনও চাষির ক্ষয়রোগ হয় সে বলে, তার কিছুই করার নেই। সামনের বসন্তে বরফ গলার সঙ্গে সঙ্গে আমিও শেষ হয়ে যাব। '( চেকভ গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের দিনে মারা গিয়েছিলেন) কিন্তু একবার যখন নিজের ক্ষয়রোগ ধরা পড়ল, তিনি মধ্যেমাঝেই তাঁর অবস্থার ভয়াবহতা কমাতে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। বাহ্যত যতদূর মনে হত, তিনি যেন অনুভব করতেন শেষ অব্দি, বিলম্বিত শ্লেষ্মার ক্ষেত্রে যেমনটি, তিনি তাঁর এই রোগটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে সক্ষম হবেন। যতই শেষের দিনগুলো এগিয়ে আসতে লাগল, তিনি শারীরিক উন্নতির সম্ভাবনা বিষয়ে মনে হয় দৃঢ়তার সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন। কার্যত মারা যাওয়ার আগে বোনকে লেখা এক ছোট্ট চিঠিতে তিনি এমনও লিখেছিলেন যে তিনি ' মোটা ' হয়ে যাচ্ছেন এবং যেহেতু এখন তিনি ব্যাডেনউইলারে আছেন, তিনি অনেকটাই সুস্থ বোধ করছেন।
 
ব্যাডেনউইলার এক স্পা ও রিজর্ট শহর, ব্ল্যাক ফরেস্টের পশ্চিমে, ব্যাসেল থেকে খুব দূরে নয়। শহরের যে কোনও জায়গা থেকে ফ্রান্সের ভোস( Vosges) পর্বতমালা দেখা যায় এবং তখনকার দিনে সেখানকার বায়ু ছিল খাঁটি ও তেজোদ্দীপক। রুশিরা যেখানে বছরের পর বছর যেত উষ্ণ খনিজ প্রস্রবণে গা ডোবাতে আর উদ্যানবীথিতে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতে। ১৯০৪ সালের জুন মাসে চেকভ সেখানে গিয়েছিলেন, মৃত্যুকে বরণ করতে।
 
সেই মাসের প্রথম দিকে মস্কো থেকে বার্লিন পর্যন্ত এক কষ্টসাধ্য যাত্রা করতে হয়েছিল তাঁকে। সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী অভিনেত্রী ওলগা নিপার যার সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা ১৮৯৮ সালে ' দ্য সিগাল ' নাটকের মহলার সময়। মহিলার সমসাময়িক অভিনেতাদের মতে তিনি এক অসাধারণ অভিনেত্রী ছিলেন। প্রতিভাময়ী, সুন্দরী এবং নাটককারের চাইতে প্রায় দশ বছরের ছোটো। চেকভ তৎক্ষনাৎ তার প্রেমে পড়ে যান কিন্তু তাঁর মনোভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ধীরগামী। সব সময় যা হত, তিনি বিয়ের আগে প্রেমের ভান (ফ্লার্ট) করতে পছন্দ করতেন। শেষ পর্যন্ত তিন বছরের প্রেম নিবেদন, বারকয়েকের ছাড়াছাড়ি, চিঠি চালাচালি এবং অবধারিত ভুল বোঝাবুঝি অন্তে তাঁরা বিয়ে করেন, ১৯০১ সালের ২৫শে মে, মস্কোয় এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানের মাঝ দিয়ে। চেকভ তো দারুণ খুশি। ওলগাকে তিনি তাঁর ' টাট্টু ', এবং কখনও ' কুত্তা ' বা ' পাপি ' বলে আদুরে ঢঙে ডাকতেন। আবার কখনও ভালোবেসে তাকে ' ছোট্ট টার্কি ' বা শুধুই ' আমার আনন্দ ' বলে সম্বোধন করতেন।
 
বার্লিনে চেকভ এক বিখ্যাত যক্ষারোগবিশেষজ্ঞ ড.কার্ল ইভাল্ডকে দেখালেন কিন্তু এক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুযায়ী ডাক্তার তাঁকে দেখার পর হাতদুটো ওপরে তুলে কোনও কথা না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। চেকভ সাহায্যের জন্য অনেক দূর গেলেন : এই ডাক্তার ইভাল্ড অসুস্থ চেকভের জন্য অলৌকিক কিছু করতে না পারায় নিজের প্রতিই ক্ষুব্ধ হলেন।
 
এক রুশ সাংবাদিক ঘটনাচক্রে সস্ত্রীক চেকভের সঙ্গে হোটেলে দেখা করেছিলেন এবং কাগজের সম্পাদককে দ্রুত লিখে পাঠিয়েছিলেন, ' চেকভের দিন ঘনিয়ে এসেছে। তিনি অত্যন্ত অসুস্থ, খুবই শীর্ণ, সারাক্ষণ কাশছেন, একটু নড়াচড়াতেই হাঁপিয়ে উঠছেন এবং তাঁর জ্বরের মাত্রাও তীব্র। ' সস্ত্রীক চেকভ যখন ব্যাডেনউইলারের উদ্দেশে পৎসড্যাম স্টেশনে ট্রেন ধরেছিলেন তখন এই একই সাংবাদিকের সঙ্গে তাঁদের দেখা হয়েছিল। তার বিবরণ অনুযায়ী, ' স্টেশনের ছোট্ট হাতলওয়ালা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে চেকভের খুব কষ্ট হচ্ছিল। শ্বাস নেবার জন্য মিনিটকয় বসতে হয়েছিল। ' আসলে চেকভের পক্ষে হাঁটাচলাই যন্ত্রণাদায়ক মনে হচ্ছিল : থেকে থেকে তাঁর পায়ে খুব ব্যথা হচ্ছিল এবং ভিতরে ভিতরে তিনি আঘাত পাচ্ছিলেন। রোগ তাঁর অন্ত্র ও মেরুদণ্ডকে আক্রমণ করেছে। এই অবস্থায় হয়তো এক মাসও সময় নেই তাঁর। এখন যখন তিনি তাঁর অবস্থা সম্পর্কে বলছেন তা ওলগার মতে, ' বেপরোয়া উদাসীনতার প্রকাশ '।
 
ব্যাডেনউইলারের চিকিৎসকদের অন্যতম হলেন ড. শোয়েগার যিনি নানান ব্যাধি উপশমের জন্য সেখানকার স্পাতে আসা সচ্ছল রোগীদের চিকিৎসা করে ভালোই কামিয়েছেন। তার কয়েকটি রোগী ছিল বেশ রুগ্ন, বাকিরা সাধারণভাবে বৃদ্ধ ও স্নায়ুরোগে উদ্বিগ্ন। কিন্তু চেকভ ছিলেন বিশেষ রোগী : তাঁর শেষের দিনগুলোতে কোনও চিকিৎসাই কাজ দিচ্ছে না। আবার তিনি একজন প্রখ্যাত ব্যক্তি। এমনকি ড. শোয়েগারও তাঁর নাম জানতেন : জার্মান ম্যাগাজিনে চেকভের কিছু গল্প তিনি পড়েছিলেন। জুন মাসের প্রথম দিকে লেখককে পরীক্ষা করার সময় চেকভের লেখালিখি সম্পর্কে অনেক প্রশংসা করলেন তিনি; কিন্তু ডাক্তারি মতামত নিজের মধ্যেই রেখে দিলেন। পরিবর্তে তিনি তাঁকে কোকো, মাখনমেশানো ওট ও স্ট্রবেরি- চা খাওয়ার পরামর্শ দিলেন। এই শেষের পদটি পান করে সম্ভবত চেকভের রাত্রির ঘুম ভালো হবে। জুন মাসের তেরো তারিখে, তাঁর মৃত্যুর তিন সপ্তাহ কম সময়ের আগে, চেকভ মাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন যেখানে তিনি বলেছিলেন তাঁর স্বাস্থ্য সেরে উঠছে। আরও বলেছিলেন, ' হয়তো এক সপ্তাহের মধ্যে আমি পুরো সুস্থ হয়ে উঠব। ' কে জানে, কেন এমন বলেছিলেন! কী ভেবে বলেছিলেন! তিনি নিজে একজন ডাক্তার এবং সবকিছু অন্যের চেয়ে ভালোই জানতেন। তিনি যে মুমূর্ষু তা পরিষ্কার ও অপ্রতিরোধ্য। তা সত্ত্বেও তিনি হোটেলের ব্যালকনিতে বসে রেলওয়ে টাইমটেবল দেখছিলেন। ওডেসা থেকে মার্সেই যাওয়ার নৌকাযাত্রার খোঁজখবর নিয়েছিলেন। তিনি কিন্তু জানতেন। অসুখের সেই পর্যায়ে এটা তাঁর জানার কথা। তবুও তাঁর বোনকে লেখা শেষ চিঠিগুলোর একটিতে তিনি লিখেছিলেন, দিনকে দিন তাঁর শরীরে জোর ফিরে আসছে।
 
লেখালিখির ব্যাপারে তাঁর আর কোনও আগ্রহ ছিল না এবং দীর্ঘ সময় তিনি কিছু লেখেননি। কার্যত মৃত্যুর আগের বছর তাঁর শেষ নাটক ' দ্য চেরি অর্চার্ড ' যেন শেষই হতে চায় না। উক্ত নাটকটি লেখা ছিল তাঁর জীবনের কঠিনতম কাজ। শেষের দিকে তিনি সারাদিনে কোনওমতে ছয় সাত লাইন লিখতে পারতেন। ' আমার উৎসাহে তখন ভাটা পড়তে শুরু করেছে ', তিনি ওলগাকে লিখেছিলেন। ' মনে হতে লাগল আমার দ্বারা আর কিচ্ছুটি হবে না। ' তবুও তিনি কলম থামাননি। ১৯০৩ সালের অক্টোবরে তিনি নাটকটি শেষ করেন। এই তাঁর শেষ লেখা, শুধুমাত্র চিঠিপত্র আর ডাইরিতে কিছু লেখা ছাড়া।
 
১৯০৪ সালের দোসরা জুলাই মাঝরাত্রি ছাড়ালে ওলগা ড.শোয়েগারকে ডেকে আনার জন্য একজনকে পাঠাল। খুবই জরুরি : চেকভ প্রলাপ বকতে শুরু করেছেন। তাদের সংলগ্ন ঘরেই ছিল ছুটি কাটাতে আসা দুজন রুশ যুবক ; ওলগা তাড়াতাড়ি গিয়ে তাদের সব বুঝিয়ে বললেন। দুজনের একজন বিছানায় ঘুমন্ত অবস্থায়, অন্যজন তখনও জেগে, ধূমপান আর পড়াশোনা করছিল। সে হোটেল থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেল ড.শোয়েগারকে খুঁজে পেতে। ' জুলাই মাসের সেই দম আটকানো রাত্রে নীরবতা ভেঙে তাঁর জুতোর নিচের নুড়িপাথরের আওয়াজ এখনও শুনতে পাই', ওলগা পরে তার স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন। চেকভ অলীক অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, নাবিকদের বিষয়ে কথা বলছেন, জাপানিদের বিষয়ে কোনও টুকরা তাঁর মাথায় খেলছিল। ' খালি পেটের ওপর বরফ চেপে ধরবে না ' ওলগা যখন তাঁর বুকের ওপর আইসপ্যাক দিতে চেষ্টা করছিলেন তখনই এ কথা বলেছিলেন চেকভ।
 
ড.শোয়েগার সেখানে পৌঁছে তার ব্যাগপত্র খুললেন যখন তার পুরো দৃষ্টি ছিল চেকভের ওপর যিনি বিছানায় শুয়ে হাঁপাচ্ছিলেন। অসুস্থ মানুষটির চোখের মণি বড় করা হল, কপালজুড়ে ঘাম জমে চকচক করছিল। ড. শোয়েগারের মুখ জুড়ে সেসবের কোনও ছাপ পড়ছিল না। তিনি মোটেও আবেগপ্রবণ নন, কিন্তু তিনি জানতেন চেকভের দিন ঘনিয়ে এসেছে। তবু্ও তিনি একজন ডাক্তার, রোগীকে বাঁচানোর চেষ্টায় শেষ দেখবেন বলে শপথ নিয়েছিলেন আর চেকভও অণুমাত্র হলেও তখনও জীবনের সুতো আঁকড়ে আছেন। তাই ড.শোয়েগার সূঁচ - সিরিঞ্জ ঠিক করে চেকভকে কর্পূরযুক্ত ইঞ্জেকশন দিলেন যাতে করে হার্টের গতি ত্বরান্বিত হয়। কিন্তু সেই ইঞ্জেকশনে কোনও কাজ হল না - অবশ্য কিছুতেই কিছু হল না। তা সত্ত্বেও ডাক্তারবাবু ওলগাকে অক্সিজেন আনার কথা বললেন। হঠাৎই চেকভ জেগে উঠে শান্তভাবে স্পষ্ট বললেন, ' কী হবে ওসব এনে? অক্সিজেন আসার আগেই আমি শব হয়ে যাব।'
 
ড. শোয়েগার তার বিশাল গোঁফে আঙুল বুলিয়ে চেকভের দিকে একদৃষ্টে তাকালেন। লেখকের গাল তুবড়ে শাদাটে হয়ে গেছে, চেহারা কেমন মোমের মতো সুভেদ্য ; শ্বাস - প্রশ্বাস কেমন খরখরে, কানে লাগে। ড. শোয়েগার জানতেন লেখকের অন্তিমকাল এখন মিনিটের হিসেবে গোনা যায়। কোনও কথা না বলে, ওলগার সঙ্গে কোনও পরামর্শ না করে তিনি দেওয়ালের চোর-কুঠুরিতে থাকা টেলিফোনের দিকে এগিয়ে গেলেন। তা ব্যবহার করার নির্দেশাবলি পড়লেন। একটা বোতামে আঙুল টিপে সক্রিয় করে ফোনের পাশের হাতল ঘোরালেই হোটেলের নিচে রসুইখানার সঙ্গে কথা বলতে পারবেন। এই নির্দেশ অনুসারে তিনি রিসিভার তুলে কানে ঠেকালেন আর ওপার থেকে যা যা বলছে সেইমতো কাজ সারলেন। শেষ অব্দি একজনকে হোটেলের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট শ্যাম্পেইনের একটি বোতল আনতে বললেন। ' গ্লাস কটা? ' তার কাছে জানতে চাওয়া হলে বললেন, ' তিনটি।' টেলিফোনে মুখ রেখে চেঁচিয়ে এ কথা বললেন। ' তাড়াতাড়ি নিয়ে এস, শুনতে পাচ্ছ? ' অনুপ্রেরণার এ এমন এক দুর্লভ মুহূর্ত যা পরে যথেষ্ট এড়িয়ে যাওয়া গেলেও এখন এই কাজটি পুরোপুরি এতটাই যথাযথ যে তা অনিবার্যই ছিল মনে হয়।
 
শ্যাম্পেইনের বোতল নিয়ে যে দরজায় হাজির হল সে এক ক্লান্ত চেহারার যুবক যার মাথার খাড়া চুলগুলো ঈষৎ সোনালি। তার হোটেল ইউনিফর্মের ট্রাউজার কোঁচকান, পাটহীন এবং তাড়াহুড়োয় জ্যাকেটের বোতাম লাগাতে গিয়ে একটা ঘাটই ছেড়ে গেছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন বিশ্রাম নিচ্ছিল ( ধপ করে চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছিল) যখন খানিক দূরে অত সকালে টেলিফোন ঝনঝনিয়ে ওঠায় - হায় ভগবান! - এবং পরপরই হয় কোনও সিনিয়র কেউ তাকে ঝাঁকিয়ে তুলে ২১১ নং রুমে এক বোতল মোয়েট কোং-র শ্যাম্পেইন দিয়ে আসতে বলে। ' তাড়াতাড়ি যা, শুনতে পাচ্ছিস?'
 
রুপোর আইস- বাকেটে এক বোতল শ্যাম্পেইন আর একটা রুপোর ট্রেতে তিনটে স্বচ্ছ খাসগেলাস নিয়ে যুবকটা ঘরে ঢুকল। টেবিলে সেগুলো রাখার একটা জায়গা খুঁজে বের করল সে, অন্য ঘরে যেখানে কেউ একজন ভয়ানক শ্বাসকষ্টে ভুগছে তা দেখার জন্য সব সময় সারসের মতো সে গলা বাড়িয়ে আছে। এক তীব্র যন্ত্রণাদায়ক শব্দ আর প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টের ঘড়ঘড় আওয়াজ যা শুনে যুবকটা কলারের মধ্যে চিবুক গুঁজে ঘুরে গেল। নিজের কথা ভুলে গিয়ে সে খোলা জানলা ফুঁড়ে বাইরের অন্ধকার শহরের দিকে তাকাল। তারপর সেই মোটা গোঁফওয়ালা ভারিক্কি মানুষটা তার হাতে কিছু কয়েন ঠুঁসে দিলেন - এক মোটাসোটা বকশিশ, অন্তত হাতের আন্দাজে যা মালুম হয়, - আর হঠাৎই সেই যুবক দেখল দরজাটা খোলা। কয়েক পা এগিয়ে সে ল্যান্ডিং-এ দাঁড়াল আর হাতের মুঠো খুলে অবাক বিস্ময়ে কয়েনগুলির দিকে তাকাল।

নিয়মমাফিক তার কাজ শেষ হলে ডাক্তারবাবু শ্যাম্পেইনের বোতল থেকে ছিপিটা খুলতে লাগলেন। এমন সতর্কতায় কাজটি সারলেন যাতে করে, যতটা সম্ভব, উল্লাসের বিকট আওয়াজ অনেকটাই কম হয়। তিনি তিনটি গ্লাসে শ্যাম্পেইন ঢেলে অভ্যাসমতো ছিপিটা বোতলের মুখে টিপে দিলেন। তারপর গ্লাসগুলো হাতে করে রোগীর বেডের পাশে গেলেন। ওলগা তৎক্ষনাৎ চেকভের ধরা হাতটি ছেড়ে দিলেন - সেই হাত, তিনি পরে বলেছিলেন, যা তার আঙুলে জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছিল। চেকভের মাথার নিচে তিনি আর একটা বালিশ গুঁজে দিলেন। তারপর ঠান্ডা শ্যাম্পেইনের গ্লাসটা চেকভের হাতের তালুতে ঠেসে দিলেন এবং নিশ্চিত হতে চাইলেন তাঁর আঙুলগুলো গ্লাসটিকে জড়িয়ে ধরেছে কি না। চেকভ, ওলগা, শোয়েগার - তিনজনই একে অপরের দিকে তাকালেন। তারা তখনও গ্লাস ছোঁয়াননি। কার স্বাস্থ্যকামনায় মদ্যপান করবেন! এ পৃথিবীতে কে এমন আছে, কী এমন আছে! মৃত্যু! দেহের অবশিষ্ট তাকত জুটিয়ে চেকভ বললেন, ' বহুদিন আগে এমন শ্যাম্পেইন পান করেছিলাম। ' ঠোঁটের ডগায় গ্লাসটি ধরে তিনি পান করলেন। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ওলগা তাঁর হাত থেকে খালি গ্লাসটা নিয়ে নাইটস্ট্যান্ডের ওপর রাখলেন। চেকভ ঘুরে শুলেন। চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মিনিটখানিক পর তাঁর শ্বাস থেমে গেল। বিছানার চাদরের ওপর পড়ে থাকা চেকভের হাতটি তুলে নিলেন ড. শোয়েগার। নাড়ী দেখার ভঙ্গিতে আঙুল চাপলেন, ফতুয়ার পকেট থেকে একটি সোনার ঘড়ি বের করে যেমনটি করে থাকেন, ঢাকনাটা খুললেন। ঘড়ির দ্বিতীয় কাঁটা আস্তে ঘুরছে, খুবই আস্তে। তিনবার সেটা ঘুরিয়ে নাড়ীর শব্দ শোনার অপেক্ষা করতে লাগলেন তিনি। ঘড়িতে তখন রাত তিনটে, ঘরে চরম গুমোট। বহু বছর ব্যাডেনউইলারে এমন বাজে ভ্যাপসা গরম পড়েনি। দুটো ঘরেরই জানলা হাট করে খোলা কিন্তু বিন্দুমাত্র হাওয়া নেই। এক বিরাট কালো ডানাওয়ালা মথ একটা জানলা দিয়ে ঢুকে ইলেকট্রিক ল্যাম্পের গায়ে জোর বাড়ি খেল। ড. শোয়েগার চেকভের কবজি ছেড়ে দিয়ে উচ্চারণ করলেন, ' সব শেষ। ' ঘড়ির ঢাকনা বন্ধ করে ফতুয়ার পকেটে ঢুকিয়ে দিলেন।
 
তখনই ওলগা চোখ মুছে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলেন। আসার জন্য ডাক্তারবাবুকে ধন্যবাদ জানালেন। ডাক্তার জানতে চাইলেন তার কোনও ওষুধ লাগবে কি না - লাউডানাম অথবা কয়েক ফোঁটা ভ্যালেরিয়ান। তিনি না- বাচক মাথা নাড়লেন। যদিও ডাক্তারবাবুকে একটি অনুরোধ করলেন : কর্তৃপক্ষ জানার আগে আর খবর - কাগজের নজরে আসার আগে যখন চেকভ আর তার হেফাজতে থাকবেন না, তিনি তাঁর সঙ্গে খানিকক্ষণ একা থাকতে চান। ডাক্তারবাবু কি এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য করতে পারবেন? এইমাত্র যা ঘটে গেল সেই দুঃসংবাদ কি কোনওপ্রকারে চেপে রাখতে পারবেন?
আঙুলের উলটো দিক দিয়ে গোঁফে টোকা মেরে তিনি ভাবলেন, কেন নয়? মোটের ওপর এই দুর্ঘটনার কথা এখনই জানানো আর ঘন্টাকয়েক পরে জানানোর মধ্যে তেমন কী ফারাক? বাকি যা থাকছে তা হল ডেথ সার্টিফিকেট লেখা যা তার অফিসে সকালেও করা যেতে পারে, কয়েক ঘন্টা ঘুমোনোর পর। এই সব ভেবে ড.শোয়েগার রাজি হয়ে বিদায় নেবার তোড়জোড় করতে লাগলেন। তিনি বিড়বিড় করে শোকপ্রকাশ করলেন। ওলগা মাথা ঝোঁকালেন। ড.শোয়েগার বললেন, ' আমি সম্মানিত। ' তিনি তাঁর ব্যাগটি নিয়ে ঘর থেকে বেরোলেন ; ইতিহাস হয়ে রইল সেই ক্ষণটা।
 
ঠিক তক্ষুনি শ্যাম্পেইন বোতলের ছিপিটা ফট শব্দে ছিটকে গেল ; টেবিলের ওপর ফেনা উপচে পড়ল। ওলগা চেকভের বেডের পাশে ফিরে গেলেন। একটা ছোট্ট টুলে বসে চেকভের হাতটি ধরে মধ্যেমাঝে স্বামীর মুখে টোকা দিতে লাগলেন। ' কোনও মানুষের গলা পাওয়া গেল না, রোজকার নানান শব্দও শোনা যাচ্ছে না আর ', ওলগা লিখেছিলেন, ' সেখানে শুধুই মৃত্যুর মহনীয়তা, শান্তি ও সৌন্দর্য। '
 
দিনের আলো ফোটা অব্দি তিনি চেকভের সঙ্গেই থাকলেন, নিচের বাগানে তখন শ্যামা( Thrush) পাখির কলতান। তারপর নিচ থেকে চেয়ার - টেবিল সরানোর আওয়াজ। খানিক পরেই কারও গলার স্বর নিচ থেকে ওপরে আসতে লাগল। তারপর দরজায় টোকা। তার মনে হল অবশ্যই আধিকারিক গোছের কেউ - চিকিৎসক বা পুলিশের কেউ যারা তাকে কিছু প্রশ্ন করবেন বা ফর্ম পূরণ করতে বলবেন হয়তো, হয়তোবা ; ড. শোয়েগারও হতে পারেন, একজন অন্ত্যেষ্টিকারককে সঙ্গে নিয়ে আসছেন যিনি চেকভের শবদেহকে সুগন্ধি দিয়ে সুবাসিত করে তা রাশিয়ায় ফেরত পাঠানোর কাজে সাহায্য করবেন। কিন্তু না, তার পরিবর্তে এল সেই সোনালি চুলের যুবক, কয়েক ঘন্টা আগে যে শ্যাম্পেইন দিয়ে গিয়েছিল। এবারে, যাই হোক, তার ট্রাউজার বেশ ইস্তিরিপাট করা, সামনের ভাঁজ বেশ টানটান, সবুজ রঙের ছিমছাম জ্যাকেটটি শরীরের সঙ্গে আঁটোসাটো হয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে, অন্য কেউ। সে শুধু পুরোপুরি সতর্কই নয়, তার গোলগাল গালটিও এক্কেবারে পরিষ্কার, দাড়িবিহীন, চুল নিপাট আর সে অতিথিকে সন্তুষ্ট করতে উদগ্রীব যেন। হাতে একটি চীনামাটির ফুলদানি যার মধ্যে তিনটি লম্বা ডাঁটিসহ হলদে গোলাপ। জুতোয় খটাখট আওয়াজ তুলে সে ফুলদানিটি ওলগার হাতে দিতে গেল। ওলগা পিছিয়ে গিয়ে তাকে ঘরে ঢুকতে সাহায্য করলেন। হ্যাঁ, সে মদের গ্লাস, আইস বাকেট আর ট্রে নিতে এসেছে। কিন্তু সে আরও বলতে চাইছিল যে প্রচণ্ড গরমের কারণে সেই সকালের ব্রেকফাস্ট বাগানেই দেওয়া হবে। তার আশা, সেখানে আবহাওয়া এতটা বিরক্তিকর হবে না। এই ব্যবস্থার কারণে সে ক্ষমাও চাইল।

মহিলাকে বিক্ষিপ্ত মনে হল। যখন কথা বলছিলেন তার দৃষ্টি ছিল নিচে কার্পেটের ওপর কোনও বস্তুর দিকে। আড়াআড়ি হাতদুটো মুড়ে তিনি তার কনুইদুটো ধরলেন। এরমধ্যে ফুলদানিটি হাতে ইশারার অপেক্ষায় থাকা যুবক ঘরটা নিঁখুতভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল। জানলা দিয়ে ঝকঝকে রোদ ঢোকায় ঘরটা ঝলমল করছে। পরিষ্কার ঘর, দেখে মনে হয় প্রায় অব্যবহৃত, কিছুই ছোঁয়া হয়নি যেন। চেয়ারের মাথায় কোনও কাপড়চোপড় নেই ; নেই কোনও জুতো - মোজা, ফিতে বা মেয়েদের কোনও অন্তর্বাস ; কোনও খোলা স্যুটকেসও নেই। সংক্ষেপে নেই কোনও বিশৃঙ্খলা, সাধারণ হোটেল রুমের ভারী কিছু আসবাব ছাড়া। তারপর মহিলা যেহেতু তখনও নিচপানে তাকিয়ে, যুবকও নিচে তাকাল, এবং তৎক্ষনাৎ তার জুতোর ডগার কাছে একটা ছিপি আবিষ্কার করল। মহিলা সেটা দেখেননি - তিনি অন্যত্র তাকিয়ে ছিলেন। যুবক নিচু হয়ে ছিপিটা তুলে নিতে চাইল কিন্তু তার হাতে তখনও ধরা আছে গোলাপের ফুলদানি আর সে অনধিকার প্রবেশ করে নিজেকে আরও বেশি মনোযোগের কেন্দ্রে নিয়ে যেতে ভয় পাচ্ছিল। ইচ্ছে না থাকলেও ছিপিটা যেমন আছে তেমনই রেখে সে চোখ তুলে দাঁড়াল। সবই ঠিকঠাক ছিল, শুধু ছোট্ট টেবিলটার ওপর দুটো স্বচ্ছ খাসগেলাসের পাশে ছিপিখোলা অর্ধেক খালি শ্যাম্পেইনের বোতলটা ছাড়া। সে আর একবার সে দিকে তাকাল। একটা খোলা দরজা দিয়ে সে তৃতীয় গ্লাসটা দেখতে পেল, নাইটস্ট্যান্ডের ওপর। কিন্তু তখনও বিছানায় কেউ শুয়ে। সে মুখটা দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু ঢাকনার নিচে কেউ একজন টানটান নিশ্চল শান্ততায় পড়ে আছে। সেই মানবমূর্তিকে নজরে রেখে সে অন্যত্র তাকাল। তারপর কেন কে জানে তার অস্বস্তিবোধ হতে লাগল। গলা খাঁকারির সঙ্গে সে অন্য পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল। মহিলা তখনও চোখ তুলে তাকাননি। বলেননি কথাও। যুবক বুঝতে পারল তার গাল লাল হয়ে আসছে। তার মনে হল, তেমন ভাবনাচিন্তা না করেই বাগানের পরিবর্তে অন্য কোথাও ব্রেকফাস্ট করার প্রস্তাব দেওয়া উচিত তার। মহিলার মনোযোগ আকর্ষণের জন্য সে কেশে উঠল কিন্তু মহিলা তার পানে তাকালেন না। সে বলল, বিশিষ্ট বিদেশি অতিথিরা চাইলে তাদের ব্রেকফাস্ট ঘরে বসেই পেতে পারেন। সেই যুবক (তার নাম টিকে থাকেনি এবং সম্ভবত বিশ্বযুদ্ধে সে নিহত হয়েছে) বলল, ঘরে একটি ব্রেকফাস্টের ট্রে আনতে পারলে সে খুশিই হবে। বেডরুমের দিকে অনিশ্চিতভাবে আর একবার তাকিয়ে সে আরও বলল, দুটি ট্রে।

চুপ মেরে জামার কলারের ভেতর আঙুল চালিয়ে দিল সে। কিছু বুঝতে পারছিল না। নিশ্চিত হতে পারছে না, মহিলা তার কথা শুনছেন কি না। এবার কী করবে, ঠিকও করতে পারছে না। তখনও ফুলদানিটা তার হাতে। নাকফুটো দিয়ে গোলাপের সুগন্ধ ঢুকছে এবং কেমন যেন আক্ষেপের যন্ত্রণা বোধ করছে সে। তার অপেক্ষার এই পুরো সময় জুড়ে সে দেখছে মহিলা কী এক ভাবনায় মগ্ন। মনে হচ্ছে যেন যতক্ষণ সে দাঁড়িয়ে আছে, কথা বলছে, পা পালটে দেহের ওজনের ভারসাম্য রাখছে, হাতে ফুলদানি ধরে আছে, মহিলা যেন ততক্ষণই অন্যত্র,অন্য কোনওখানে - ব্যাডেনউইলার থেকে বহুদূরে। এরপর তিনি ধাতস্থ হলেন, তখন তার চোখমুখে অন্য ভাব। তিনি চোখ তুলে যুবককে দেখে মাথা নাড়লেন। মাথা ঘামিয়েও তিনি বুঝতে পারছেন না, এই যুবক ফুলদানিতে তিনটে হলদে গোলাপ নিয়ে তার ঘরে কী করছে! ফুল? তিনি তো কাউকে ফুলের অর্ডার দেননি!
 
মুহূর্তখানেক পেরিয়ে গেল। হাতব্যাগ হাতড়ে তিনি কয়েকটি কয়েন তুলে আনলেন। কিছু টাকাও বের করলেন। যুবক জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল : মনে হচ্ছে আবার এক বড় মাপের বকশিশ। কিন্তু কেন? মহিলা তাকে দিয়ে কী করাতে চাইছেন? এর আগে এমন অতিথিদের কখনও খিদমত করেনি সে। সে আর একবার গলা খাঁকারি দিল।

ব্রেকফাস্ট চাই না, মহিলা বললেন। কোনওমতেই নয়। আজকের সকালে ব্রেকফাস্ট গুরুত্ববহ নয়। তার অন্য কিছু চাই। তিনি চাইছেন যুবক বাইরে বেরিয়ে একজন অন্ত্যেষ্টিকারককে নিয়ে আসুক। সে কি তার কথা বুঝতে পারছে? তার চেকভ আর নেই, বুঝতে পেরেছ? যুবক, তুমি কি আনতে পারবে? খোলাখুলি বলো। আন্তন চেকভ আর বেঁচে নেই। এখন মন দিয়ে শোনো, তিনি বললেন। তিনি চাইছেন যুবক নিচতলায় গিয়ে সামনের ডেস্ক থেকে কারও কাছে জেনে নেয়, শহরের কোথায় একজন মান্য অন্ত্যেষ্টিকারকের দেখা মিলবে। বিশ্বাসযোগ্য একজন যিনি কষ্ট করে তার কাজ সম্পন্ন করেন আর যার আচরণ হবে যথাযথ গাম্ভীর্যপূর্ণ। মোদ্দা কথা, একজন মহান শিল্পীর উপযুক্ত অন্ত্যেষ্টিকারক। এই পর্যন্ত বলে তিনি যুবকের হাতে টাকাটা গুঁজে দিলেন। নিচতলায় গিয়ে বলো, আমি তোমাকে নির্দিষ্টভাবে অনুরোধ করেছি আমার হয়ে এই কাজটি করার জন্য। তুমি শুনছ তো? যা বলছি, বুঝতে পারছ?
 
যুবক হাতড়াতে থাকে, মহিলার কথা বোঝার জন্য। সে ওই বিশেষ ঘরটার দিকে আর তাকাতে চায় না। সে বুঝতে পেরেছে, কিছু যেন ঠিক নেই, গোলমাল হয়েছে কোথাও। জ্যাকেটের নিচে তার হার্টের শব্দ দ্রুতগতিতে ধাক্কা দিচ্ছে, আর সে অনুভব করছে তার কপালজুড়ে ঘাম জমছে। কোনদিকে তাকাবে, বুঝে উঠতে পারছে না। ফুলদানিটা কোথাও রাখতে চাইছে সে।
প্লিজ, আমার জন্য এই কাজটি করে দাও, মহিলা বললেন। কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তোমাকে মনে রাখব। নিচে গিয়ে বলো, আমি তোমাকে পীড়াপীড়ি করেছি। গিয়ে বলো। কিন্তু নিজের বা এই ঘটনার প্রতি কোনও অপ্রয়োজনীয় মনোযোগ যেন না পড়ে। শুধু এটুকুই বলো, এটা প্রয়োজনীয় কাজ, আমি যে জন্য তোমাকে অনুরোধ করেছি - ব্যস। এইটুকুই। শুনতে পাচ্ছ তুমি? বুঝে থাকলে, মাথা নাড়ো। মোটের ওপর কোনও হইহল্লা কোরো না। আর যা থাকল, বাকিটা, হইচই - শীঘ্রই এসে ভিড় করবে। খারাপ যা হবার, হয়ে গেছে। আমরা কি একে অপরকে বুঝতে পারছি?
 
যুবকের মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। ফুলদানিটা আঁকড়ে সে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। কোনওমতে ' হ্যাঁ ' সূচক মাথা নাড়ল। বাইরে যাওয়ার জন্য হোটেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে অন্ত্যেষ্টিকারকের খোঁজে তাকে শান্ত অথচ অটল পায়ে এগোতে হবে,কোনও অহেতুক তাড়াহুড়ো ছাড়াই। তাকে এমন ভাব দেখাতে হবে যেন বিশেষ গুরুত্ববহ কোনও কাজের ভার দিয়ে তাকে পাঠানো হয়েছে, তার বেশি নয়। তিনি বলেছিলেন, খুব জরুরি একটি কাজ দিয়ে তাকে পাঠানো হল। এবং এটা যদি তার গতিবিধিকে উদ্দেশ্যমূলক করতে সাহায্য করে তাহলে নিজের সম্পর্কে সে ভাববে সে এমন একজন যে হাতে করে চীনামাটির গোলাপভর্তি ফুলদানিটা নিয়ে পাশের পথ ধরে ব্যস্তসমস্ত হেঁটে চলেছে যা কোনও বিশেষ ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দিতে হবে। (মহিলা শান্তভাবে কথা বলছিলেন প্রায় গোপনীয় ঢঙে যেন কোনও আত্মীয় বা বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছেন) যুবকটি এমনকি মনে মনে এটাও বলতে পারে যাঁর সঙ্গে সে দেখা করতে যাচ্ছে তিনি তার অপেক্ষায় বসে আছেন আর হয়তো ফুলসহ দেরিতে পৌঁছনোর কারণে তিনি অধৈর্য হয়ে উঠছেন। তৎসত্ত্বেও যুবকের উচিত হবে না উত্তেজিত হয়ে দৌড়ে যাওয়া নতুবা সে পড়ে যেতে পারে। হাতের ফুলদানির কথা তাকে মাথায় রাখতে হবে! আবার যতটা সম্ভব মানানসই সম্ভ্রান্ত ঢঙে চটপট হাঁটতেও হবে। অন্ত্যেষ্টিকারকের বাড়ির দরজায় না পৌঁছনো পর্যন্ত তাকে বিরামহীন হেঁটে যেতে হবে। তারপর সে দরজার কড়া একবার, দুবার, তিনবার ঠকঠক করে নাড়বে। মিনিটখানেকের মধ্যে অন্ত্যেষ্টিকারক নিজেই সাড়া দেবেন।
 
এই ব্যক্তির বয়স চল্লিশের কোঠায় হতে পারে, সন্দেহ নেই, কিংবা পঞ্চাশের শুরুর দিকে - টাকমাথা, শক্তপোক্ত, চোখে স্টিলফ্রেমের চশমা যা নাকের ওপর নামানো। তিনি হয়তো বিনয়ী, এতটুকু নিজেকে জাহির করেন না এবং সরাসরি দরকারি প্রশ্ন করবেন মাত্র। একটা অ্যাপ্রন। পরনে তাঁর সম্ভবত একটা অ্যাপ্রন থাকবে। হয়তো আগন্তুকের কথা শুনতে শুনতে তিনি একটা কালো তোয়ালেতে হাত মুছবেন। তাঁর পোশাকে সামান্য হলেও ফর্মালডিহাইডের গন্ধ ছড়িয়ে থাকবে। এ সব ঠিকই আছে, যুবকের এ নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই। তার যথেষ্ট বয়স হয়েছে, এ সবে তার ভীত বা বিব্রত হওয়ার কিছু নেই। অন্ত্যেষ্টিকারক মন দিয়ে সব শুনবেন। তিনি খুব সংযত আচরণের মানুষ যিনি এই রকম পরিস্থিতিতে মানুষের ভয়ের উপশম ঘটান, তা বাড়িয়ে দেন না। বহু আগেই মৃত্যুর ভয়াল চেহারা তিনি দেখেছেন ; মৃত্যু তাঁর কাছে আর কোনও বিস্ময়ের ব্যাপার নয়, নয় গোপনীয় কিছু। আজ সকালে এই মানুষটির সাহায্যই বড্ড প্রয়োজন।
 
অন্ত্যেষ্টিকারক যুবকের হাত থেকে গোলাপদানিটা নিলেন। যুবকটি কথা বলার সময় মাত্র একবার অণুমাত্র আগ্রহ দেখিয়ে তিনি ইঙ্গিতে বললেন যে তিনি অসাধারণ কিছু শুনেছেন। কিন্তু যুবক যখন মৃতের নামটি উল্লেখ করল, অন্ত্যেষ্টিকারকের চোখ কপালে উঠে গেল। কী নাম বললে,চেকভ? এক মিনিট দাঁড়াও, আমি তোমার সঙ্গে যাব।
 
যা বলছি, বুঝতে পারছ? ওলগা যুবককে বললেন। গ্লাসগুলো এখানে রাখো। ওগুলো নিয়ে ভেবো না। স্বচ্ছ খাসগেলাস সব ভুলে যাও আর ওইরকম যা কিছু। ঘর যেমন আছে তেমনই থাক। সব প্রস্তুত। আমরা প্রস্তুত। তুমি কি যাবে?

কিন্তু সেই মুহূর্তে যুবকটি তার জুতোর ডগার সামনে পড়ে থাকা ছিপিটার কথা ভাবছিল। ওটাকে তুলতে তাকে নিচু হতে হবে আবার ফুলদানিটাও ধরে রাখতে হবে। সে তাই করবে। সে ঝুঁকল। নিচে না তাকিয়ে ছিপিটা নাগালে পেয়ে হাতের মুঠোয় আটকে নিল।
 


অনুবাদক পরিচিতি:
বিপ্লব বিশ্বাস
গল্পকার। অনুবাদক। প্রাবন্ধিক
কলকাতায় থাকেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ