মঞ্জু আপা,
আমাদের সামাজিকতার নিয়মই এই, অতি বিরূপ মনোভাব মনে গোপন করেই আত্মীয়তার সুরে মানুষকে ডাকতে হয়। আমিও তাই আপা ডাকলাম।
আমার নাম সিরাজুম মুনীরা, আপনি শুনেছি আমার শাশুড়ির মুখে এই নাম শুনে মুখ বাঁকিয়ে বলেছিলেন, “এহ, এই নামে সেলিম ওর বৌকে ডাকবে নাকি? ওর নাম দেয়া হোক নীরা।” আমার নাম হয়ে গেল নীরা।
আমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে এলে দুলে দুলে হারমনিয়ম ধরে আমি গান গেয়েছিলাম-
“হে প্রিয় নবী রাসুল আমার
পরেছি আভরণ নামেরই তোমার
নয়নের কাজলে তব নাম
ললাটে টিপ জ্বলে তব নাম”
হারমনিয়মটা হাসিরানী বৌদির, আমি তাঁর কাছে গান শিখতে যেতাম লুকিয়ে। হাম্দ আর নাত-এ-রাসুল। অবেলায় হাসিবৌদি ঘামের দাগওয়ালা শাদা ব্লাউজ কেচে ছাদের কোণে শুকাতে দিতেন, জামাহীন আদুর গায়ে শাড়ি জড়ানো... আর সে’সময়টা অনেক উচ্ছল থাকতেন, চুলগুলি মাথার সামনে উলটে এনে আঁচড়ে ফুলিয়ে খোঁপা করতেন আর আমাকে দেখাতেন মাথা একটু নোয়ানো অবস্থায় উপরের দিকে তাকালে কেমন শাদা অংশ বেড়ে গিয়ে কাজললতার মতো চওড়া দেখায় চোখ। সেইভাবে তাকাতে হয় পাত্রপক্ষ দেখতে এলে। সে’ভাবে আমি তাকাতে পারতাম না, অপূরণীয় স্বপ্নের ভারে আমার চোখ সজল হয়ে আসতো, কার সাথে আমার বিয়ে হয়ে যাবে সেই ভয়ে আমি জবেহ্ এর জন্যে অপেক্ষমাণ কুঁকড়ার মতন কাঁপতাম। আপনি হয়তো ভাববেন, মনের সাথে মনের মিলন, দেহের সাথে দেহের…এইসবে কাঁপবার মতো কি আছে? আপনার বাড়ি তো হাসনাবাদ কাজীপাড়া না, উঠানে খেলবার অধিকার পর্যন্ত যেসব মেয়েদের লুঠ হয়ে যায়, তাদের জীবনে বিয়ে শরীর-মনের মিলনমেলা হয়ে ওঠে না তো।
আমাকে হয়তো আপনার মনেও নাই, মানে আমি কেমন দেখতে। ফুপাতোভাইয়ের বৌ হিসেবেও মনে থাকবার তেমন কারণ নাই, আমার বিয়ের পরপরই আপনি চলে গিয়েছিলেন ভিনদেশে। আমার বন্ধুরা বলতো, “মুনীরা তুই দেখতে কালোকুলো, পড়াশোনাতেও গোল্লা কিন্তু জব্বর কপাল তোর!” জব্বর কপালই হোক কিংবা সহজাত বুদ্ধির বেড়ে কুলিয়ে উঠতো বলেই হোক, আমি পরীক্ষায় উৎরে যেতাম সহজে। কাজীপাড়ার অন্য মেয়েদের তুলনায় অনায়াসেই। প্রাইমারি বা সেকেন্ডারি বৃত্তি পরীক্ষা আমাকে দেয়ানোর কথা কেউ ভাবতো না, আমিও ভাবতাম না।
আমি আপনাকে দেখেছি জীবনে একবার, বাদলভাইয়ের বিয়ের সময়। পিঠাগাছ শব্দটার কথা কেন মনে পড়ে গিয়েছিল আমার? ফসলের মাঠের মতন গাছের মতন কী যেন সব ছিল সেই শরীরে- সেই রূপে, মানুষকে স্বীয় সৃষ্টিকর্তার কথা মনে পড়িয়ে দেয়ার মতন, আপনা হতে মাথা নুয়ে আসবার মতো। আমি তো কবি নই, কবি হলে অনেক কিছু লিখতাম। এইখানে এতটুকুই লিখলাম। তবে আপনাকে আমার এরপরেও অন্যভাবে বারবার দেখতে হয়েছে- আমার ‘জব্বর কপাল’ আমাকে দেখিয়েছে।
আপা, আপনি আর আমার স্বামী স্কুলজীবন থেকে পেনফ্রেন্ড ছিলেন। চিঠি আর যখন কাগজ-কলম ধরে কেউ লেখে না, তখনো আপনারা লিখতেন একে অপরকে, শুধু খাম খুলে একে অপরের সান্নিধ্য পাওয়ার আশায় আপনারা পরস্পরকে লিখে গেছেন। চিঠিতে আপনার দুঃখদুর্দশার খবর আসতো, আমার ঘরগেরস্থালি মলিন হয়ে উঠতো। চিঠিতে আপনার সুখের সমৃদ্ধির প্রাপ্তির খবর আসতো, আমার স্বামী অপার উদ্যমে সে’দিনই আমাকে আপনার প্রিয় পারফিউম কিনে দিতেন। আমি জানি সেন্ট আপনার খুব প্রিয়, সেন্টের শিশি মাথার উপর ধরে স্প্রে করে সুগন্ধে ধারাস্নান করে আপনি সুবাস মাখতেন।
আচ্ছা আপা, আপনি আমাকে চিঠি লেখেন নাই কেন? কখনো ভুলেও লেখেন নাই। আমি ‘কুবলয়’ মানে জানি না তাই? আপনি তো এই চিঠির এতটুকু পড়ে অবগত হলেন, আমি মোটামুটি ভাল বাংলা শিখেছি। আমাকে আশিস জানায়ে আপনি একটি যূগল-চিঠি লিখেছিলেন আমাদের বিয়ের পর, ‘অগ্নিদেবের স্ত্রী স্বাহা’র প্রসঙ্গ টেনে কী সব যেন লিখেছিলেন আমি তা বুঝতে পারিনি। পরে আমার স্বামী একরাত্রে আমাকে অশেষ স্নেহে স্বাহার গল্প বলেছিলেন, দেবতার ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্যে তার স্ত্রী অন্য সব নারীর বেশ ধরে এসে স্বামীর সাথে মিলিত হয়েছিল। হায়, আমি কেমন করে জানবো হিন্দুশাস্ত্র, আমি তো নবীর নামে গাই, ‘দুলিছে গলে মোর তব নাম মণিহার’। আমি চিঠিতে ৭৮৬ লিখি, ‘কল্যাণমস্তু’র আমি কী জানি? আমি কেমন করে জানবো, আমার কালোকুলো রূপ আর সহজাত বুদ্ধির বেড়ে আমি আমার স্বামীকে আগলে রাখতে পারব না। কিন্তু জব্বর কপালের জোরেই কি না জানি না, আমি থেকে গেলাম, আমার স্বামীও থেকে গেলেন। হাঁড়ি আর জলকান্দার মতন একরকম সম্বন্ধ নিয়ে আমরা পাশাপাশি বেঁচে রইলাম। আমার প্রথম সন্তান জন্মালো, আমার আম্মা নাম রাখলেন উম্মে সুফিয়া, আপনার চিঠিতে নাম এলো ‘সুচয়নী’। সুফিয়া সুচয়নী হলো। মেয়েটির পিঠাপিঠি একটি ছেলে জন্মালো, সেও আপনারই ‘হিন্দোল’ হলো। নিজের ঘরেই একটা দেয়ালের মতন নির্বাক মুখে বেঁচে থাকা কত বড় শাস্তি আপনি হয়তো জানেন না। আপনাকে আল্লাহতালা সেই শাস্তি না দিন।
একদিন সন্ধ্যাবেলা আমি রান্নাঘর সাফসুতরো করে বারান্দায় এসেছি, গোধূলির অন্ধকারে ম্লানমুখে আমার স্বামী আর আপনার বড় বোন বসে ছিলেন। আমার স্বামী কী যেন আকুল হয়ে বলছিলেন, শেষটুকু ছিল, “আর অনেক দৌড়ায়েও তার লাগ পাইলাম না!” কার নাগাল পেলেন না তিনি, কার জন্যে এই বিমর্ষতা তা আমি জানি। জেনে আমার জগত শোকে-বেদনায় বোবা হয়ে একমুহূর্তও থাকে নাই তা বলবো না। কিন্তু আমি স্বীকার করতে সম্মত ছিলাম না। আমার অটুট স্বাস্থ্য, আমার নিটোল যৌবন আর নিরোগ শরীর আমাকে সেইখান থেকে হেরে ফিরতে দিল না। সুস্বাস্থ্যের অহংকার, ব্যাধিহীনতার অহংকার, জরার স্পর্শ না লাগবার অহংকার আমার পায়ে সোনার মলের মতো ঝমঝম বাজছে, কেমন করে ফিরে যাই খালি হাতে?
এরপরের ঘটনাবলী নিতান্ত লজ্জার। বদ্ধদরজার ভিতরে যার নাম শোবার ঘর, সে’খানে একটি একটি করে আমি তেলের বাতি জ্বালালাম। একটি একটি করে সুগন্ধী ধূপ। লুকিয়ে ভাঁটফুল তুলে এনে বিছালাম বিছানা-বালিশে। জুঁইফুলের গন্ধওয়ালা পাউডার ছিটালাম। সুরভিত আলোকিত একটি ঘরে আমার শরীরে শরীর ঘষে যতটুকু আলো জ্বলে, তারই আনন্দসভা করলাম। বাইরে খোলা জানালার ওদিকে চষাক্ষেত জুড়ে জোনাকি জ্বলছে, আকাশ অন্ধকার যেন একপাতিল জোনাকিই উপুড় করে দিয়েছে কেউ আকাশে- আমার স্বামী তেমনি একটা কবিতা পড়লেন।
সংশয়াকুল আমি মনে মনে ভাবলাম, এই বাতিজ্বলা সন্ধ্যা, এইসব রাত্রিকে আমি সার্থক করব। খোদার কসম। অথচ সামান্য সময় চুপ করে থেকে তিনি বললেন, “এই কবিতা মঞ্জুর লেখা।” পুরুষমানুষ প্রিয়ার দেহমনে অপরের ছায়ামাত্র দেখলে আঁতকে ওঠে, সেই পুরুষই এক নারীর গায়ে অনন্ত মোড়কের মতন জড়িয়ে দেয় আরেক নারীকে।
যে গান গেয়ে আমি এই পাত্রকে স্বামী হিসেবে লাভ করেছি, তার দু’টি লাইন ছিল,
“গাঁথা মোর কুন্তলে তব নাম
বাঁধা মোর অঞ্চলে তব নাম।”
তাই যেন আরেকভাবে সত্য হয়ে এলো। মহানবীর নামে না, আপনার নামে। আমি জেনে গেলাম, এই যুদ্ধে আমার স্বামী আমার সহায় হতে পারবেন না, এ আমার একার যুদ্ধ। জয় করবার যুদ্ধ। নোটবুক যোগাড় করে করে পড়তাম, প্রাইভেটে পরীক্ষা দিতাম, বই ঘাঁটতাম আর অভিধানে কঠিন শব্দের অর্থ বের করতে চেষ্টা করতাম। আল্লাহতালা যে কলকব্জা দিয়ে পাঠিয়েছেন, তার অশ্বশক্তি আমি বাড়াবোই এমনি ছিল আমার পণ। আর প্রায়ই ভাবতাম, আপনাকে চিঠি লিখব, আমি সিরাজুম মুনীরা- আমাকে উম্মে সুফিয়া আর ইবনে খালদুনের মা হিসেবে বেঁচে থাকতে দেন। আরো একহাজারটা সিরাজুম মুনীরার মতো হেসেখেলে প্রিয়মানুষের উপহার দেয়া সেন্ট মেখে বাঁচতে দেন। তারপর ভাবতাম, আমি ‘যা আমার’- তা আপনার কাছে চাইব না।
এ’ভাবে বহুদিন গেল। আমি নিজেই স্বাহার কাহিনী পড়ে অশ্রুপাত করতে শিখে গেলাম। অহল্যার কাছে স্বামীর ছদ্মবেশে আসা ইন্দ্রের গল্পে আমি মুচকি হাসতেও শিখলাম। একসময় মনে হলো ‘হিন্দোল’ এবং ‘সুচয়নী’ নাম হিসেবে মোটেই খারাপ নাম নয়। ‘হিন্দোল’ শব্দটার সাথে কাজী নজরুল ইসলামের রচিত অন্ধকার সমুদ্র আছে, ‘সুচয়নী’র সাথে আছেন জসীমউদ্দীন। বদ্ধকপাট ঘরে শুধু তেলের বাতিই তো জ্বলে না, আরো কত উজ্জ্বলতায় সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠে ঘর আর মন, যখন জগতের ভাবুকরা এসে ভাললাগার বাতি জ্বালান সংসারে। যখন সংসারের লেনাদেনায় ঠকে গেলেও বাতি-হীন কামরা হয়ে ওঠে না হৃদয়। আমি যেন আর একা নই, আমার বই আছে, বইয়ের পাতায় সখা আছে।
ছেলেমেয়েদের ডানার হাড়ে জোর হলো, তারা নিজেরাই পাখা মেলে উড়ে গিয়ে পাতার আড়ালের শূককীট বেছে খেতে সক্ষম। শূন্য বাড়িতে আর যৌবনের চকমকি জ্বেলে কোনো ফুলকি জ্বালানো যায় না, জ্বালানীই আর বাকি নেই আঙিনায়। তখন আমার বিগতযৌবন স্বামীর মুখের দিকে একদিন অপলকে তাকালাম। আহা, মানুষকে যে এমন করুণ মর্মান্তিক ভালবাসতে পারে, সে যে কী সুন্দর! সেই ভালবাসার গন্তব্য আমি নাই বা হলাম, সেই যাত্রাই যে কী সুন্দর! চোখের জল আর বাধ মানে না সে’দিন। তখন আর আমার অটুট স্বাস্থ্যের গর্ব নাই, শরীর ঘষে আলোর সভা করবার স্পর্ধাও শরীর সইবে না। অথচ তখন এমন জোছনা ফুটলো যে মনের আকাশে আমি তাকে স্পষ্ট করে দেখতে পেলাম। জীবনে প্রথম। একমাস পর আমার স্বামী এই মরজগত ছেড়ে গেলেন। তাঁর কাঁচাবাজার করে আনা আনাজপাতি ফ্রিজ থেকে ফুরালো। তাঁর নামে চিঠি আসা বন্ধ হলো। তাঁর শখের নেকটাইগুলি ছেলে আর জামাইকে বাটোয়ারা করে দেয়া হলো। শালটা পোকায় কেটেছিল বলে দুধওয়ালা চেয়ে নিয়ে গেল। কাপড় বিলিয়ে দেয়ার পর গন্ধও বিলীন হয়ে গেল। লেপতোশকে খুঁজে পাওয়া যায় কদাচিৎ তার শরীরের সেই মিহি গন্ধ, পাগলের মতো নাক ঘষি, জানি এই গন্ধও একদিন এমন আবছা হয়ে যাবে যে তার স্মৃতিই থাকবে শুধু। জড়জগতের কোথাও ব্যথিত স্ত্রীলোকের প্রাণের ঠাঁই খুঁজে পেলাম না।
মঞ্জু আপা, তখন আমার আপনার কথা মনে পড়লো। আমার জীবদ্দশায় আমার বিদেহী স্বামীর পরশ পাওয়ার একটিই মাধ্যম, সেটা আপনি। বন্ধুও যখন পরিত্যাগ করে, তখন পাশে থাকে কেবল প্রতিযোগী। তাই সই।
আমি তাঁকে ছাড়া তো বাঁচতে পারি না, কেমন করে বাকী জীবনের বন্ধুরতা পাড়ি দেব? তাই আপনি আমাকে চিঠি লিখুন।
ইতি
সিরাজুম মুনীরা
1 মন্তব্যসমূহ
বেশ ভালো গল্প । ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুন