অনুবাদঃ ড. বেগম জাহান আরা
পিটার মর্টন জেগে উঠেই আলো দেখেছিলো। তখন টপ টপ করে বৃষ্টি পড়ছিলো কাঁচের জানালার ওপারে। দিনটা ছিলো জানুয়ারির পাঁচ তারিখ।
সে অন্য বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখলো, টেবিলের ওপরে রাখা রাতের আলো যেনো ডুবে আছে সরোবরে। ফ্রান্সিস মর্টন ঘুমিয়ে আছে তখনও। ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে পিটার আবার শুয়ে পড়লো। ভাইকে দেখতে দেখতে তার কল্পনা করতে ভাল লাগলো যে, এটা তো সেই-ই। সেই চুল, সেই একই রকম চোখ, একই রকম ঠোঁট এবং একই রকম গালের গড়ন। তবে বেশিক্ষণ ভালো লাগলো না চিন্তাটা। মন চলে গেলো বিশেষ দিনের গুরুত্বপূর্ণ পর্বের প্রতি। জানুয়ারির পাঁচ তারিখ ছিলো সেটাও। মিসেস হেনে- ফ্যালকন এই তারিখে ছেলেমেয়েদের জন্য একটা পার্টির আয়োজন করেছিলেন। তার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে যে, এরই মধ্যে একবছর সময় পার হয়ে গেলো!
ফ্রান্সিস হঠাৎ চিৎ হয়ে শুলো। এমন ভাবে একটা হাত রাখলো তার মুখের ওপর, ঢেকে গেলো সারাটা মুখই। কেমন এক অস্বস্তিতে ধুক ধুক করতে লাগলো পিটারের বুক। সে উঠে বসলো এবং টেবিলের এপার থেকে ডাকলো, ‘ এই, উঠে পড়ো এবার'"। ফ্রান্সিসের কাঁধ নড়ে উঠলো এবং চোখবন্ধ রেখেই মুঠিবদ্ধ একটা ঘুঁসি উঁচিয়ে ছুঁড়ে দিলো শূন্যে। পিটার মর্টনের মনে হলো, ঘরটা হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেলো। আর মনে হলো, বিশাল একটা পাখি অর্ধবৃত্তাকারে শোঁ করে নেমে এলো অন্ধকার ঘরের ভেতর। বেশ উচ্চকণ্ঠে সে ডাকলো, "এই , ওঠো না”। রুপালি আলোর ছটা দেখা গেলো আবার। তার সঙ্গে জানালার ওপারে বৃষ্টির ফোঁটাও।
চোখ ঘঁষে ফ্রান্সিস জিজ্ঞাসা করলো, ‘আমাকে ডেকেছিলে'?
- "তুমি একটা খারাপ স্বপ্ন দেখছিলে”, পিটার বলে। কয়েক মিনিটের বড়ো ভাই হিসেবে অভিজ্ঞতা থেকেই সে জানে, কতোটা বলা যায় তাকে। কয়েকবার আলো আসা যাওয়া করলো। ছোটো ভাই অন্ধকারে কষ্ট পাচ্ছে এবং সেটা কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করছে। এটা বুঝতে পেরে পিটারের কেমন এক রকম মায়া হলো ফ্রান্সিসের জন্য। আসলে ভাইটা যে বেশ ভিতু। অনেক কিছুতে ভয় পায়।
- "স্বপ্নে দেখলাম, আমি মরে গেছি”, ফ্রান্সিস বলে।
- "কি বলছো? এটা আবার কি ধরনের স্বপ্ন?” পিটার প্রশ্ন করে।
- “জানি না, বলতে পারবো না,” ফ্রান্সিস বলে।
- “তুমি একটা বিশাল পাখির স্বপ্ন দেখেছো।"
- “ তাই নাকি? সত্যি?”
পরস্পরের দিকে চেয়ে শুয়ে থাকলো দুই ভাই। সেই সবুজ চোখ, সেই একই রকম ঝুঁকে পড়া নাকের আগা, একই রকম চাপা ঠোঁট, একই রকম বালসুলভ অপরিণত চিবুক। পিটারের আবার মনে পড়লো তারিখটা। আজ পাঁচই জানুয়ারি। অলস চিন্তায় মনে ভেসে উঠলো পুরস্কার হিসেবে পাওয়া কেকের কথা। চামচের ওপর ডিম নিয়ে দৌড়ানো, পানির বেসিনে আপেল ছুঁড়ে মারা, অন্ধ সেজে খেলা, এই সব।
হঠাৎ ফ্রান্সিস বলে উঠলো, “ অনুষ্ঠানে যেতে চাইনা আমি। মনে হয়, জয়েস এবং মাবেল ওয়ারেন থাকবে সেখানে।" ওদের দুজনের সঙ্গে এক অনুষ্ঠানে থাকতে ঘেন্না লাগে তার। ওরা তার চেয়ে বয়সে বড়ো। জয়েসের বয়স নয়, মাবেল ওয়ারেনের তেরো। কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করে, লম্বা শুওরের লেজ যেমন দোলে, তেমন লম্বা লম্বা পা ফেলে কেমন পুরুষালি ভঙ্গিতে যেনো ওঁরা হাঁটে। তাদের এই পুরুষ পুরুষ ভাব তার কাছে বিশ্রী লাগে। অপমানকর মনে হয়। শরীরের বিশেষ অঙ্গ নিয়ে কিছু বলার সময় শব্দ বেধে বেধে যায় তার মুখে। সেটা দেখে তারা বিশ্রী নিচু দৃষ্টিতে দেখেছিলো তাকে। আর গতো বছরে ... মনে হওয়াতেই আরক্ত হয়ে ওঠে তার গাল। সে পিটারের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
- “কি হলো তোমার, বিষয়টা কি?” পিটার জানতে চায়।
- “না কিছু না। মনে হয় শরীরটা ভালো না। আমার ঠাণ্ডা লেগেছে। অনুষ্ঠানে যাওয়া আমার উচিত হবে না।"
পিটার একটু হকচকিয়ে গিয়ে বলে, “ ঠাণ্ডা কি বেশি লেগেছে ফ্রান্সিস?”
- “অনুষ্ঠানে গেলে ঠাণ্ডা বেড়ে যেতে পারে। হয়তো বা মরেই যাবো।"
- “তাহলে অবশ্যই যাবে না তুমি।" এই একটা সাধারণ বাক্যেই সব সমস্যার সমাধান করতে চাইলো পিটার। ফ্রান্সিসও সব ঝামেলা পিটারের ওপর ছেড়ে দিয়ে আরামে টান টান হয়ে শুয়ে থাকলো। মনে মনে কৃতজ্ঞ হলেও ভাইয়ের দিকে মুখ ঘুরিয়ে শুলো না। গতো বছরে অন্ধকার বাড়িতে লুকোচুরি খেলার সময়কার সেই লজ্জাজনক স্মৃতির জন্য মুখটা তখনও লাল হয়ে ছিলো। মাবেল ওয়ারেন হঠাৎ যখন তার হাতের ওপর হাত রেখেছিলো, তখন কি ভীষণ চিৎকারটাই না করেছিলো সে। ও যে আসছিলো, তার কোনও শব্দই পাওয়া যায়নি। আসলে মেয়েরা ওই রকমই। তাদের জুতোর খট খট শব্দ হয় না। পায়ের চাপে মাটিতে আওয়াজ ওঠে না। বেড়াল যেমন নরম থাবার ওপর ভর দিয়ে লঘুপায়ে হাঁটে, মেয়েদের হাঁটাও সেই রকম কতকটা।
গরম পানি নিয়ে নার্স ঘরে এলো। ফ্রান্সিস তখনও নিশ্চিন্তে শুয়ে ছিলো পিটারের ওপর সব ছেড়ে দিয়ে। পিটার বললো, “নার্স, ফ্রান্সিসের ঠাণ্ডা লেগেছে।"
লম্বা শক্ত পোক্ত মহিলাটা ঘুরে না দঁড়িয়ে গরম পানির পাত্রের পাশে তোয়ালেটা রেখে বললো, "আগামিকালের আগে আর ধোয়া মোছা করা যাবে না। তুমি বরং তোমার কাছ থেকে ওকে কিছু টিসু পেপার অবশ্যই দিও।"
- “ কিন্তু ফ্রান্সিসের জন্য বিছানায় শুয়ে থাকাটাই কি ভালো হতো না, নার্স?” পিটার বলে।
- “ঠিক আছে, ফ্রান্সিসকে সকালে তাহলে হাঁটার জন্য বাইরে নিয়ে চলো। বাইরের টাটকা বাতাস শরীর থেকে সমস্ত জীবানু ঝেড়ে মুছে উড়িয়ে দেবে।" নার্স তার পেছনের দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলে, " ওঠো তো দেখি, তোমরা দুজনেই উঠে পড়ো এবার।"
পিটার বলে, "তুমি বিছানায় শুয়ে থাকো না কেনো ফ্রান্সিস। আমি মাকে বলবো যে, তোমার শরীর খুব খারাপ, বিছানা থেকে উঠতে পারছো না।"
কিন্তু ভাগ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শক্তি নেই ফান্সিসের। যদি সে শুয়ে থাকে বিছানায়, তাহলে তারা আসবে, বুকে হাত দিয়ে দেখবে, মুখে থার্মোমিটার দেবে, জিব পরীক্ষা করে দেখবে, এবং অবশেষে বুঝতে পারবে যে অসুখ নয়, ভান করছে সে। তবে এটা সত্যি যে, সে অসুস্থ বোধ করছিলো। কেমন যেনো মোচড়াচ্ছিলো পেটের ভেতর এবং বুক ধড়ফড় করছিলো। এর কারণও সে জানে। নানা রকম ভয় থেকে এই রকম হচ্ছিলো তার। যেমন; অনুষ্ঠানে যাওয়ার ভয়, অন্ধকারে লুকোনোর ভয়, পিটারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয়, এবং আলোবর্জিত দীর্ঘ অন্ধকার রাত্রির ভয়, এইসব।
হঠাৎ বেপরোয়াভাবে ফ্রান্সিস বলে উঠলো, “ এখন আমি উঠবো, তবে মিসেস হেনে-ফ্যালকনের অনুষ্ঠানে যাবো না। বাইবেলের শপথ, আমি যাবো না।" মনে মনে ভাবলো, নিশ্চয় এটাই ভালো হবে। ঈশ্বর নিশ্চয় তার পবিত্র শপথ ভাঙাবেন না। একটা পথ তিনি দেখাবেনই। সারাটা সকাল এবং বিকেল চারটা পর্যন্ত সময় তার সামনে পড়ে আছে। চিন্তার কিছু নেই। সকালের শিশির সিক্ত ঘাস এখনও কচকচে তাজা আছে। যে কোনও কিছু ঘটে যেতে পারে। কোথাও কেটে যেতে পারে, পা ভেঙে যেতে পারে, এমন কি বাজে রকম ঠাণ্ডাও লেগে যেতে পারে। ঈশ্বর কোনও না কোনও ভাবে ব্যবস্থা করবেন একটা।
ঈশ্বরের ওপর তার প্রবল আস্থা ছিলো। নাশতার সময় তার মা যখন বললেন, "শুনলাম তোমার ঠাণ্ডা লেগেছে ফ্রান্সিস।" কথাটার তেমন গুরুত্ব দিলো না সে। তার মা বেশ রূঢ়ভাবে বললেন, “ সন্ধে বেলায় অনুষ্ঠান না থাকলে হয়তো আরও বেশি কিছু শুনতাম আমরা।" তার সম্বন্ধে মায়ের সঠিক ধারণা নেই, বুঝতে পেরে ফ্রান্সিস অবাক হলো এবং মনে মনে হাসলো।
ফ্রান্সিসের সুখবোধ আরও কিছুক্ষণ থাকতো, যদি সকালে বেড়ানোর সময় জয়েসের সঙ্গে দেখাটা না হতো। নার্সের সঙ্গে সে ছিলো একাই। পিটার গেছে কাঠ রাখার ঘরে। খরগোশের ঘরটা বানিয়ে শেষ করতে হবে তাকে। সঙ্গে পিটার থাকলে বিষয়টা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাতো না সে। যদিও তার জন্যই নার্সকে রাখা হয়েছে, কারণ তাকে একা বাইরে ঘুরতে দিয়ে নাকি ভরসা রাখা যায় না। তবে পিটারের দেখাশোনাও করে নার্স। অথচ জয়েস তার চেয়ে মাত্র দু বছরের বড়ো। তবু তাকে সব কিছু করতে দেয়া হয় একাই।
ঝুঁটি দোলাতে দোলাতে লম্বা লম্বা আল্লাদি পা ফেলে এগিয়ে এলো সে তাদের দিকে। তারপর ফ্রান্সিসের দিকে কুৎসিতভাবে একঝলক তাকিয়ে ন্যাকা ন্যাকা ভঙ্গিতে নার্সকে বললো, "এই যে শুনছেন নার্স, আজ সন্ধের অনুষ্ঠানে কি আপনি ফ্রান্সিসকে সঙ্গে করে আনবেন? মাবেল এবং আমি আসবো অনুষ্ঠানে।" কথা শেষ করেই সে চলে গেলো মাবেল ওয়ারেনের বাড়ির রাস্তার দিকে। লম্বা নির্জন রাস্তায় অনায়াসে স্বাবলম্বী মনোভাব নিয়ে সে দিব্যি একা একাই যেতে থাকলো।
নার্স বললো, “ কি যে ভালো না মেয়েটা!" কোনোও মন্তব্য করলো না ফ্রান্সিস। অনুভব করতে পারলো তার বুকের ভেতর আবার ধড়ফড়ানি শুরু হয়েছে। বুঝতে পারছে, অনুষ্ঠানের সময় ঘনিয়ে আসছে তাড়াতাড়ি। হায়রে, ঈশ্বর কিছুই করলেন না তার জন্য। এদিকে প্রতি মিনিট সময় তো উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে।
অনুষ্ঠানে না যাওয়ার ব্যাপারে তাড়াতাড়ি কোনও কৌশল বের করাও যাচ্ছে না, কিংবা আসন্ন অগ্নিপরীক্ষার জন্য শক্তও করা যাচ্ছে না তার মনকে। এদিকে সময় তো চলেই যাচ্ছে। প্রবল ভীতি প্রায় গ্রাস করেই ফেলেছে তাকে। সব কিছুই এলোমেলো এখনও। এই অবস্থায় তার মনে হলো যে, দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে সে। ঠাণ্ডা বাতাসে তার কোটের কলার উল্টে যাচ্ছে। নার্সের ইলেকট্রিক টর্চ অন্ধকারে অল্প সময়ের জন্য একটু জ্বলে উঠলো। তার পেছনে হলের বাতি জ্বলছে। মা বাবা খাবেন বলে, কাজের লোক টেবিল পেতে ব্যাবস্থা করছে, শব্দ শোনা যাচ্ছে তার। দৌড়ে বাড়ির ভেতর গিয়ে মাকে ডেকে কথাটা বলার ইচ্ছে তার প্রবল হলো যে, সে অনুষ্ঠানে যাবে না। অনুষ্ঠানে যেতে তার ভয় করছে। তাঁরা এই অনুষ্ঠানে যেতে তাকে বাধ্য করতে পারবেন না। অনুচ্চারিত স্বগতোক্তিগুলো যেনো সে নিজের কানে শুনতে পেলো। সমস্ত ভয় ভীতি ভেঙে মনকে তৈরি করলো সে। মা বাবার ধারণার বাইরে গিয়ে বলেই ফেললো, “ অনুষ্ঠানে যেতে আমি ভয় পাচ্ছি। তাই আমি যাবো না। যাওয়ার সাহস হচ্ছে না আমার। ওরা আমাকে অন্ধকারে লুকিয়ে রাখবে। আর অন্ধকারকেই আমি ভয় পাই। তাহলে আমি কিন্তু চিৎকার করবো এবং ক্রমাগতো চিৎকার করতেই থাকবো।”
মায়ের বিস্ময়বিহ্বল মুখের চেহারা স্পষ্ট দেখতে পেলো সে। বয়সি মহিলা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে রূঢ় ভাষায় ফ্রান্সিসের কথার কঠিন উত্তর দিলেন, “বোকার মতো কথা বলো না বুঝেছো। অবশ্যই অনুষ্ঠানে যাবে তুমি। মিসেস হেনে- ফ্যালকনের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছি আমরা। "
কিন্তু অনুষ্ঠানে যেতে বাধ্য করতে পারেন না তাঁরা। দ্বিধান্বিত হয়ে দরজার গোড়াতে ফ্রান্সিস দাঁড়িয়েই থাকবে। সে জানে, এরপর নার্স শিশির শিক্ত ঘাস মাড়িয়ে গেইটের দিকে আসবে। সে তাকে বলবে, "তুমি বলে দাও,আমি অসুস্থ। আমি যাবো না। অন্ধকারকে আমি ভয় পাই।" তখন তার মা বলবেন, “ নির্বোধের মতো কথা বলছো আবার? তুমি জানো, অন্ধকারে ভয় পাওয়ার মতো কিছু থাকে না।" কিন্তু সে তো জানে, কথাটা সত্যি নয়, এবং এই কথার কোনও যুক্তি নেই। সে এটাও জানে, কেমন করে তাদের শেখানো হয় যে, মৃত্যুও কোনও ভয়ের বিষয় না। অথচ কতো ভয়ের সঙ্গে বিষয়ের ধারণাগুলো এড়িয়ে যান তাঁরা, তাও বোঝে সে। সে যাক, কিন্তু কোনও মতেই অনুষ্ঠানে তাকে নিয়ে যেতে পারবেন না তাঁরা। মনে মনে বলে, "আমি তাহলে চেঁচাবো। ভয়ানক ভাবে চেঁচাবো।"
অল্প আলোতে আবছা হয়ে গেছে লনটা। ঝোঁপ ঝাড় এবং গাছ পালার মধ্য দিয়ে নার্সের টর্চের হলুদ বৃত্তাকার আলো দেখা গেলো। সে শুনতে পেলো নার্স ডাকছে, “ফ্রান্সিস, আমার সঙ্গে এসো।” সে উত্তর দিলো, “ আসছি আমি।" তার শেষ গোপন কথাটা সে বলতে পারেনি। গোপনেই রেখে দিয়েছিলো মায়ের কাছ থেকে। কারণ, এখনও একটা শেষ চেষ্টা বাকি আছে। সেটা হলো, খোদ মিসেস হেনে-ফ্যালকনের কাছে আবেদন করা।
কথাটা ভেবে মনে একটু স্বস্তি পেলো । খুব ধীরে ধীরে হেঁটে ছোটো হলটা পেরিয়ে অস্বাভাবিক বিশাল বপুর মহিলা মিসেস-ফ্যালকনের দিকে এগোতে থাকলো। বুকের ভেতর বেশ ধুকপুকানি শুরু হলো। তখনও কণ্ঠের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিলো তার। কথাটা যে বলতেই কাছে যেতে হবে। খুব সতর্কতার সঙ্গে সুন্দর করে সে বললো, “শুভ সন্ধ্যা, মিসেস হেনে-ফ্যালকন। এই অনুষ্ঠানে আমাকে সদয় আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বলে আমি আনন্দিত।" টান টান উত্তেজনায় উদ্বিঘ্ন মুখে মহিলার ঢাউস বুকের দিকে তাকিয়ে গুছিয়ে কথা বলার ভঙ্গিটা ছিলো বড়োদের মতো। যেমন করে একজন নির্জীব নিষ্প্রাণ বয়সি মানুষ কথা বলে, তেমনই প্রায়।
যমজ বাচ্চার একজন হিসেবে নানা দিক দিয়ে ফ্রান্সিস ছিলো ব্যতিক্রম। আয়নায় প্রতিফলিত তারই প্রতিবিম্বের মতোই পিটার। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম আছে যা তার মতো নয়। তবে কায়মনে পিটারের মতোই হতে চায় সে। ইস, কি ভালো হতো! তাহলে অন্ধকারের অযৌক্তিক ভয়, আগন্তুকদের পায়ের শব্দ, সন্ধের প্রায়ান্ধকারে বাগান ভরা বাদুড়ের ওড়া উড়ি দেখে তার কিছু এসে যেতো না।
অনুষ্ঠানের আয়োজনে ব্যস্ত মিসেস-ফ্যালকন অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, “ কী মিষ্টি বাচ্চাটারে !" কথাটা বলার আগেই তিনি হাত নেড়ে মুরগির বাচ্চাদের খোঁয়াড়ে ঢোকানোর মতো করে ছেলেমেয়েদেরকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন তাঁর নির্ধারিত আনন্দের কর্মসূচীর মধ্যে। সেখানে চামচে ডিম নিয়ে দৌড়, তিন পায়ের দৌড়, বর্শার মতো আপেল ছোঁড়া, ইত্যাদি খেলা হবে। এগুলোর কোনোটাই ফ্রান্সিসের ভালো লাগেনা। বরং জঘন্য লাগে। এই সব খেলায় ঘন ঘন বিরতির সময় যখন কিছুই করার থাকে না তার, তখন মাবেল ওয়ারেনের ঘৃণাপূর্ণ দৃষ্টির আওতা থেকে যতোদূরে সম্ভব গিয়ে একটা কোনায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে সে।
অন্ধকারের ভীতিপূর্ণ খেলার হাত থেকে বাঁচা যায় কি ভাবে, সেটাই ভাবছিলো ফ্রান্সিস সারাক্ষণ। সে জানে, চা-পর্ব শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভয়ের কিছু নেই। এবং কলিন হেনে-ফ্যালকনের জন্মদিন উপলক্ষে কেকের ওপর যে দশটা মোমবাতি জ্বালানো হবে, সেই হলুদ উজ্জ্বল আলোকিত স্থানের পাশে যতোক্ষণ বসে থাকবে, ততোক্ষণও ভয়ের কিছু নেই। অর্থাৎ যার জন্য তার এতো ভয়, সেই আসন্ন অবধারিত অন্ধকারের আতঙ্ক নিয়ে ভাবনার কিছু নেই এখনই।
টেবিলের নিচ থেকে জয়েসের উচ্চকণ্ঠ শোনা গেলো, “ চা-পর্বের পরেই আমরা লুকোচুরি খেলা শুরু করবো অন্ধকারে।"
ফ্রান্সিসের করুণ মুখের দিকে চেয়ে পিটার বললো, “ ওহ, না না। এই খেলা খেলবো না। প্রতি বছরই তো আমরা এই খেলা খেলি।"
- “ কিন্তু এই খেলাটা তো প্রোগ্রামে আছে।” মাবেল ওয়ারেন চেঁচিয়ে বলে, “ মিসেস-ফ্যালকনের কাঁধের ওপর দিয়ে প্রোগ্রামটা আমি নিজের চোখে দেখেছি। পাঁচটায় চা-পর্ব। তারপর পৌনে ছয়টা থেকে সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত অন্ধকারে লুকোচুরি খেলা। সব স্পষ্ট লেখা আছে প্রোগ্রামে।"
পিটার তর্কে গেলো না। মিসেস হেনে-ফ্যালকনের প্রোগ্রামে যদি সব লেখাই থাকে, তাহলে এমন কিছু তার বলার নেই, যার জোরে সেটাকে বাদ দেয়া যাবে। সে আর এক টুকরো কেক চেয়ে নিয়ে চায়ে চুমুক দিতে লাগলো। ভাবে, এই খেলাটা সম্ভবত পনরো মিনিট দেরি করে শুরু হতেও পারে। তাহলে হয়তো কোনও বুদ্ধি বের করার জন্য কিছু সময় পেতে পারে ফ্রান্সিস। কিন্তু তা হলো না। পিটারের পরিকল্পনা বিফলে গেলো। কারণ, ছেলেমেয়েরা ততক্ষণে টেবিল ছেড়ে হই হই করে এক পায়ে খাড়া। বলা যায়, পায়ের পাতার বুড়ো আঙুলের ওপর দাঁড়িয়ে পড়েছে। এটা তার তৃতীয়বারের ব্যর্থতা। আবার সে দেখতে পেলো, বিশাল এক পাখির পাখার ছায়ায় তার ভাইয়ের মুখটা আঁধার হয়ে গেছে। নিজের বোকামির জন্য নিজেকেই দোষ দিলো সে নীরবে। কেকটা শেষ করলো। তারপর বড়োদের মতো করে এই ভেবে উৎসাহিত এবং নিরস্ত হওয়ার চেষ্টা করলো যে, “আসলেই অন্ধকারকে ভয় করার কিছু নেই।" সবার শেষে টেবিলের কাছ থেকে দুই ভাই একসঙ্গে হলের দিকে গেলো। সেখানে মিসেস হেনে-ফ্যালকন তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে, একটু অসহিষ্ণু চোখে অনুষ্ঠানের সব কিছু দেখা শোনা করছিলেন।
তিনি বললেন, “ ছেলেমেয়েরা, এইবার আমরা অন্ধকারে লুকোচুরি খেলবো।"
পিটার ভাইয়ের দিকে তাকালো। শক্ত করে দুই ঠোঁট চেপে রেখেছে সে। পিটার জানে, অনুষ্ঠানের প্রথম থেকেই ফ্রান্সিস এই সময়টার জন্য আতঙ্কে ছিলো। এবার সাহস সঞ্চয় করে সে এগিয়ে গেলো। খেলাটা এড়িয়ে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিলো। মনে মনে সে নিশ্চয় 'এই খেলাটা' না হোক, সেই প্রার্থনা করেছিলো। কিন্তু কিছুই হলো না। ছেলেমেয়েদের উত্তেজিত এবং উল্লসিত চেঁচামেচিতে সে নেমে পড়লো খেলায়। কেউ বললো, “ঠিক আছে চলো"; কেউ বললো, " আমরা অবশ্যই একটা ধারের দিকে চলে যাবো"; কেউ বললো, “বাড়ির সীমার বাইরে আর কোথাও যাওয়া যাবে কি না"; কেউ বললো,” কোথায় শেষ হবে গিয়ে খেলাটা"; ইত্যাদি নানা কথায় সরগরম হয়ে উঠলো পরিবেশ।
মিসেস হেনে-ফ্যালকনের বিশাল বুকের দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সিস বলে উঠলো, “ মনে হয়, আমার খেলার কোনও প্রয়োজন নেই। নার্স আমাকে ডাকতে আসবে এখনই।"
মিসেস হেনে-ফ্যালকন বললেন, “কিন্তু ফ্রান্সিস, নার্স তো অপেক্ষা করতে পারে তোমার জন্য"। দুই হাতে তালি বাজিয়ে তিনি কিছু ছেলেমেয়েদেরকে তার দিকে আসতে নির্দেশ দিলেন। ওপর তলায় যাওয়ার প্রশস্ত সিঁড়ি ঘরের আসে পাশে ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে ছিলো ওরা। তিনি বললেন, "নার্স দেরি করলে তোমার মা কিছুই মনে করবেন না বাছা।"
ফ্রান্সিসের শেষ কৌশলও কোনো কাজ করলো না। সে ভাবতেই পারেনি, এমন সুন্দর যুক্তিও এইভাবে মাঠে মারা যাবে একেবারে। অন্য ছেলেমেয়েরা কিছু মনে করতে পারে জেনেও দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সে উচ্চারণ করলো, “মনে হয়, না খেলাই ভালো আমার জন্য।" যদিও মনে মনে ভয় পাচ্ছিলো, তবু সে কাঠের মতো শক্ত এবং অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
পিটার তার ভাইয়ের আতঙ্ক সম্বন্ধে জানে খুব ভালো করে। অন্ধকারকে যে কি পরিমান ভয় পায় ফ্রান্সিস, সেই চিন্তাটা আকুল করে তুললো তাকে। মুহুর্তের জন্য পিটার মর্টন আলো নিভে যাওয়ার ভয়ে বিকট চিৎকার দিতে পারে এমন ভাবে, যেনো মনে হয় অন্ধকার নিরালা দ্বীপে রেখে গেছে কেউ তাকে। যেখানে চারদিকে শুধুই বহু অদ্ভুত পায়ের মৃদু শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। তখনই মনে হলো তার যে, ভয়টা তার নয়, তার ভাইয়ের। খুব উদ্যমের সঙ্গে মিসেস হেনে-ফ্যালকনকে সে বললো, “ দয়া করে আমার কথা শোনেন, মনে হয় ফ্রান্সিসের খেলা উচিত হবে না। অন্ধকারে সে খুব উত্তেজিত এবং ভীত হয়।" শব্দগুলো হয়তো বা ঐ পরিস্থিতিতে ঠিক ছিলো না। পিটারের কথা শেষ হতেই ছয়জন ছেলেমেয়ে সন্ত্রস্ত বিবর্ণ ফ্রান্সিসকে ঘিরে সুর করে গান ধরলো, “ ভী--তু, ভীতু--র দলা, ভীতু--র ডিম, " ইত্যাদি বলে।
ভাইয়ের দিকে না তাকিয়েই ফ্রান্সিস বলে উঠলো, “অবশ্যই আমি খেলবো। ভীতু নই আমি। আমি শুধু চিন্তা করছিলাম, খেলবো কি না।" ওদের কথার যন্ত্রণায় ভয় ভীতির প্রসঙ্গ ভুলেই গেলো সে। ছেলেমেয়েরা এলেবেলে ভাবে মিসেস হেনে-ফ্যালকনকে ঘিরে ধরেছে। চিৎকার করে করে সবাই প্রশ্ন করছে এবং পরামর্শ নিচ্ছে তাঁর কাছ থেকে।
মিসেস হেনে-ফ্যালকন তাদের বলছেন, “ হ্যাঁ শোনো, বাড়ির যে কোনও জায়গায় তোমরা যেতে পারো। সমস্ত আলো আমরা নিভিয়ে দেবো। কাবার্ডের ভেতরেও লুকোতে পারো তোমরা। যতোক্ষণ পারো, ততোক্ষণ অবশ্যই লুকিয়ে থাকবে। অন্য কোথাও না, এই বাড়ি ছাড়া। ঠিক আছে?"
পিটার দাঁড়িয়ে ছিলো একটু দূরে। উলটো পালটা কথা বলে ভাইকে সাহায্য করার বিষয়টা লজ্জা দিচ্ছিলো তাকে। খচ খচ করছিলো মনের ভেতর। আসলে ফ্রান্সিসের জন্যই তো সে এই সব করেছে। সে যে কিছুতেই খেলতে চাচ্ছিলো না এই খেলাটা।
কিছু ছেলেমেয়ে দৌড়ে উঠে গেলো ওপর তলায়। সমস্ত আলো নিভে গেলো ওপর তলার তখনই। বাদুড়ের পাখার মতো অন্ধকার জেঁকে বসলো নিচের তলার সমস্ত এলাকায়। ছেলেমেয়েরা ঝাড়বাতির আলোর কেন্দ্রে এসে সমবেত হওয়ার পর অন্যেরা হলের আসে পাশের আলোগুলো নিভিয়ে দিলো। বাদুড়েরা চুপে চুপে এসে অন্ধকারের ছাতার মতো পাখার নিচে গুটিশুটি মেরে বসলো তখন। অপেক্ষা করতে লাগলো সেই বিশেষ কাজের জন্য, যা তারা শেষ করে যেতে চায়।
একটা লম্বা মেয়ে এসে বললো, “পিটার, তুমি আর ফ্রান্সিস আড়ালেই আছো”। তারপরই চলে গেলো আলো। দারুণ নিকষ আঁধার। তার পায়ের নিচের কার্পেট থেকে ঘস ঘস খস খস আওয়াজ ভেসে এলো। মনে হলো ঠাণ্ডা কিছুকে গড়িয়ে ঘঁষে ঘঁষে টেনে নেয়া হচ্ছে কোনার দিকে।
“ফ্রান্সিস কোথায়?” আশ্চর্য হলো সে। ভাবলো,” আমি যদি তার সঙ্গে থাকতে পারতাম, তাহলে এইসব উদ্ভট আওয়াজে বেশি ভয় পেতো না সে।" আওয়াজগুলো ছিলোঃ ঢিলে ঢালা কোনও বোর্ড নাড়াচাড়া করার শব্দ, সাবধানে কাবার্ডের পাল্লা খোলার চাপা চাপা শব্দ, মসৃণ কাঠের ওপর আঙুলের ঘর্ষণের কিচ কিচ ধ্বনি, এইসব। নিস্তব্ধ গাঢ় থকথকে অন্ধকার এই নগন্য শব্দগুলোকেই করে তুলেছিলো ভৌতিক।
অন্ধকারে শূন্য মেঝের মধ্যখানে দাঁড়িয়েছিলো পিঁটার। শব্দগুলো কানে যাচ্ছিলো না তার। ভাইটা কোথায় কি করছে, শুধু এই চিন্তাটাই ঘুরছে মাথায়। ওদিকে ফ্রান্সিস কানের ভেতর আঙুল দিয়ে চেপে ধরে গুটিশুটি মেরে আছে। অন্ধকার থাকা সত্বেও অনর্থক বন্ধ করে রেখেছে চোখ। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। শুধু বিশ্রি অন্ধকারের একটা চাপ অনুভব করছে সে। একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেলো, “আসছি"। হঠাৎ এই রকম শব্দে ফ্রান্সিসের সাহস অস্তিত্ব ভেঙে গুঁড়িয়ে গেলো। ভয়ে লাফ দিয়ে উঠলো পিটার মর্টন। এটা তার নিজের ভয়ের জন্য নয়। ফ্রান্সিসের মনের তীব্র আতঙ্ক তার মনেও সঞ্চারিত হয়েছিলো। সেখান থেকে সে বের হতে পারছিলো না। আবার শোনা গেলো, “ কোথায় তুমি? আমি যদি ফ্রান্সিস হতাম, তাহলে কি লুকোতাম?” জেনে বুঝেই তার যমজ ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলেছিলো সে কথাগুলো। ত্বরিত উত্তর এলো, “স্টাডি-রুমের দরজার বাম দিকে ওক কাঠের বুক কেইস এবং চামড়া দিয়ে মোড়ানো লম্বা বেঞ্চের মাঝখানে।" যমজদের মধ্যে কিছু বোঝা বা জানার জন্য বিশেষ ভাষার প্রয়োজন হয় না। মাতৃজঠরে তারা ছিলো একই সঙ্গে। থাকবেও একসঙ্গে। কখনও আলাদা হতে পারে না তারা।
পায়ের পাতায় ভর দিয়ে ফ্রান্সিসের লুকোনোর জায়গার দিকে যেতে লাগলো পিটার। মাঝে মাঝেই বাধা পাচ্ছিলো এটা ওটার সঙ্গে। সবসময় তার ভয় হচ্ছিলো, অন্ধকারে কেউ আবার তাকে ধরে না ফেলে। সে ঝুঁকে পড়ে জুতোর ফিতে খুলে ফেললো। ফিতের মুখে মোড়ানো ধাতুর অংশটা ছিটকে পড়লো মেঝের ওপর। মৃদু ধাতব একটা শব্দ মাত্র। মনে হলো খুব সতর্ক পায়ে কেউ যেনো তার দিকে এগিয়ে আসছে। তার পায়ে তখন শুধু মোজা। দুর! খামোখাই ভয় পেয়েছে সে। মনে মনে হাসে। আসলে শব্দটা কারও পায়ের নয়। তার খুলে ফেলা জুতোটার সঙ্গে হোঁচটও খায়নি কেউ, যার শব্দে তার বুকে তিড়িং বিড়িং কাঁপুনি উঠেছিলো। এরপর এগিয়ে যেতে আর কোনো বাধা পায়নি পিটার।
মোজা পরা পায়ে খুব সন্তর্পনে এবং নির্ভুলভাবে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো সে। সহজাত অনুভূতি তাকে বলে দিলো, দেয়ালের কাছেই এসে পড়েছে। হাতটা বাড়িয়ে দিলো পিটার। আঙুলের ছোঁয়া লাগলো ফ্রান্সিসের মুখের ওপর।
ফ্রান্সিস কেঁদে ওঠেনি। কিন্তু তার বুকের দারুণ কাঁপুনি অনুভব করে পিটার বুঝতে পারলো যে, কি অসম্ভব পরিমান ভয় পেয়েছে সে। ফিস ফিস করে বললো,
“ সব ঠিক আছে, আর ভয় নেই।" মুঠিবদ্ধ হাতটা ধরে সে বুঝতে পারলো, গুটি শুটি মেরে আছে ফ্রান্সিস। বলে, "আর কোনও ভয় নেই ভাই, এই যে আমি এসে গেছি। তোমার সঙ্গেই থাকবো আমি।" ভাইকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে স্রোতের মতো প্রবল উচ্ছ্বাসে একটানা অনেক কথা বলে যাচ্ছিলো সে।
পিটার তার মাথার কাছের বুককেইস স্পর্শ করলো। বেশ বুঝতে পারলো, তার উপস্থিতি সত্বেও ফ্রান্সিসের আতঙ্ক যায়নি। সে আশা করলো, যদিও ভয়টা থেকে গেছে, তবু কাটিয়ে উঠবে ফ্রান্সিস। সব ঠিক হয়ে যাবে। পিটার জানতো, এটা তার ভাইয়ের ভয়, তার নয়। তার কাছে, অন্ধকার কিছুই নয়, আলোহীন একটা অবস্থা শুধু। পরিচিত শিশুর কোনো কিছু হাতড়ে বেড়ানো হাতের মতো। ধৈর্য ধরে সে অপেক্ষা করতে লাগলো খেলাটার সমাপ্তির জন্য।
তারপর পিটার আর কথা বলেনি। ফ্রান্সিসের সঙ্গে তার এমন অন্তরঙ্গ সম্পর্ক যে, বেশি কথার দরকার হয় না। তারা যেভাবে দুজন দুজনের হাত ধরে আছে, তাতে কথার চেয়ে চিন্তাই কাজ করে বেশি দ্রুত। সে তার ভাইয়ের মনের অবস্থাটা খুব ভালো করে বুঝতে পারছিলো। প্রবল আতঙ্ক থেকে ভয়টা তার বুকের ভেতর ঢুকে গেছে। নাড়ির অনিয়মিত স্পন্দনই বলে দিচ্ছে তা। নিয়মিত বুকের ধুকপুকানি থেমে থেমে যাচ্ছে বার বার। পিটার খুব গভীরভাবে চিন্তা করছিলো, "আমি তো আছি এখানে। ফ্রান্সিসের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আবার আলো জ্বলে উঠবে তাড়াতাড়ি। সামান্য শব্দ, সামান্য নড়াচড়ায় ভয়ের কি আছে? শুধু জয়েস এবং মাবেল ওয়ারেন? ফুহ! ওদেরকেই বা ভয়ের কি আছে?” ভাইকে অভয় দেয়ার জন্য এক মনে কথাগুলো বলেই গেছে পিটার। তবে খুব ভালো ভাবেই সে বুঝতে পারছে, ফ্রান্সিসের ভয়টা যায়নি। এবার বলে শুনছো, "ওরা নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করে কথা বলছে। আমাদের খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হয়ে গেছে সবাই। খুব তাড়াতাড়ি জ্বলে উঠবে আলো। শোনো, আমরাই জিতবো। একেবারে ভয় পেয়ো না আর। কে যেনো সিঁড়ির ওপরে দাঁড়িয়েছে। মনে হয়, মিসেস হেনে-ফ্যালকন। শুনছো, তারাও আলো জ্বালানোর কথা বলছে।"
কার্পেটের ওপর অনেক পায়ের শব্দ পাওয়া গেলো। শোনা গেলো দেয়ালে হাত ঘঁষার শব্দ, পর্দাটা টেনে সরানোর আওয়াজ, হ্যান্ডেল ঘুরানোর শব্দ, এবং কাবার্ডের দরজা খোলার শব্দও। তাদের মাথার ওপরের বুক কেইসে ঝুলে থাকা একটা বইয়ে ছুঁয়ে গেলো তাদের মাথা। "আহা, শুধু জয়েস, শুধু মাবেল ওয়ারেন, শুধু মিসেস হেনে-ফ্যালকন!" এমন সময় দপ করে জ্বলে উঠলো ঝাড়বাতি। ফলবান বৃক্ষের অজস্র কলি হঠাৎ যেনো একযোগে প্রস্ফুটিত হলো। আলোর বন্যায় ভেসে গেলো চারদিক।
আলো জ্বলার সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেলো ছেলেমেয়েদের উচ্চ তীক্ষ্ণ কণ্ঠের কলরোল। হই হই করে তারা বললো, " পিটার কোথায়?” "ওপরতলায় দেখেছো?” "ফ্রান্সিস কোথায়?”
হঠাৎ মিসেস হেনে-ফ্যালকনের তীক্ষ্ণ চিৎকারে এক মুহূর্তের মধ্যে সকলের আনন্দ উল্লাসের উচ্চকিত ধ্বনি স্তব্ধ গেলো। দেয়ালের গায়ে ভাইয়ের হাত ধরে দাঁড়ানো ফ্রান্সিস মর্টনের প্রানহীন দেহ দেখতে পেলেন তিনি।
শুকনো বেদনার্ত হতভম্ব মুখে ভাইয়ের মুঠি করা হাতের আঙুল ধরে তখন দাঁড়িয়ে ছিলো পিটার। এটা শুধু এমন ঘটনা নয় যে, তার ভাই মারা গেছে। এতো ছোটো বয়সে এমন অবিশ্বাস্য মৃত্যু সম্বন্ধে কোনও বাস্তব ধারণাই ছিলো না তার। অজ্ঞতার জন্য নিজের ওপর করুণা হলো পিটারের। সে বুঝতেই পারলো না, কেনো তার ভাইয়ের ভীত নাড়ির স্পন্দন বারবার চলে গিয়েছিলো?
আহা ফ্রান্সিস! সে এখন যেখানে গেছে, সেই জায়গা সম্বন্ধে তাকে বলা হয়েছে বার বার। বলা হয়েছে, সেই ভুবনে কোনো ভয় নেই। কোনও আঁধারও নেই।
লেখক পরিচিতিঃ
পুরো নাম, হেনরি গ্রাহাম গ্রিন। জন্মঃ ২ অক্টোবর, ১৯০৪ ; মৃত্যুঃ ৩ এপ্রিল, ১৯৯১ । জন্মস্থানঃ হার্টফোর্ডশায়ারের বার্ক হ্যামস্টেড-এ ।
বিশ শতকের ইংরেজি সাহিত্যে খ্যাতমান গদ্য সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম প্রধান লেখক। গ্রাজুয়েশনের আগে থেকেই লেখালেখি শুরু করেছেন। পেশায় ছিলেন সাংবাদিক। ২৫ টা উপন্যাস সহ লেখেছেন ছোটোগল্প, নাটক এবং প্রবন্ধ। ধর্মভাবাপন্ন ছিলেন। তাঁকে বলা হতো, 'রোমান ক্যাথলিক লেখক"। নিজের সম্বন্ধে বলতেন, তিনি একজন "ক্যাথলিক অ্যাগনস্টিক" ( agnosticism: no knowledge beyond material phenomenon is possible ).
অনুবাদক পরিচিতি
বেগম জাহান আরা
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ভাষাতত্ত্ববিদ। প্রবন্ধকার।
কথাসাহিত্যিক। অনুবাদক।
ভাষাতত্ত্ববিদ। প্রবন্ধকার।
কথাসাহিত্যিক। অনুবাদক।
বর্তমানে জার্মানীতে থাকেন।
3 মন্তব্যসমূহ
কষ্টের গল্পটির চমতকার অনুবাদ!
উত্তরমুছুনকষ্টের গল্পটির চমতকার অনুবাদ!
উত্তরমুছুনকষ্টের গল্পটির চমতকার অনুবাদ!
উত্তরমুছুন