চিং চুং

বিপুল দাস

(প্রস্তাবিত উপন্যাসের প্রথম অংশ)


সেবার শীতে সে প্রথম ‘পাবলিসিটি’ শব্দটি শুনেছিল। গতবারের তুলনায় এবার শীত বেশি পড়বে – অনেকের মুখেই সে শুনতে পাচ্ছিল। সে লক্ষ করেছিল ভোরবেলা আর সন্ধেবেলা পুকুরের জল থেকে ধোঁয়া উঠতে শুরু করেছে। রঘুমামার জন্য তারকজ্যাঠার দোকানে দেশলাই কিনতে গিয়ে সে দেখেছিল একটা দুটো শ্যামাপোকা উড়তে শুরু করেছে। ক’দিন ধরেই ভোরের দিকে মনে হচ্ছে একটা পাতলা কাঁথা হলে বেশ হয়। একটু বেলা হতেই ভেজা ঘাস শুকিয়ে যায়। শরীরের চামড়ায় রোদ পড়লে চিটপিট করে জ্বালা ধরে। গরমকালে রোদের ধরণ অন্য রকম। তেজ বেশি থাকে, ঘাম হয়, বিকেল ফুরিয়ে গেলেও সহজে সন্ধে হতে চায় না। এখন রোদের তেজ কম। ঘাম হয় না, কিন্তু বেলার দিকে চামড়ায় রোদ পড়লে মনে হয় যেন পুড়ে যাচ্ছে। বেলা গড়াতে না গড়াতেই অন্ধকার।


দক্ষিণে, প্রাইমারি স্কুলের দিকে সুর্য অনেকটা সরে গেছে। হাত আড়াল করে কখনও সে সূর্য দেখার চেষ্টা করে। এ সময়ে তাদের উঠোনে অনেক রোদ আসে। তার ঠাম্মাকে পাঁজকোলা করে উঠোনে এনে রোদে মেলে দেয় তার বাবা। ঠাম্মাকে এখন একদম বাচ্চা মেয়ে মনে হয়। ঠাম্মা আস্তে আস্তে ছোট হয়ে যাচ্ছে। সকালে বাবাকে দেখলে মনে হয় কত ভালোমানুষ। অথচ প্রায় রাতেই ফিরে এসে মার সঙ্গে তুমুল ঝগড়া শুরু হয়।

গত শনিবার অনেক রাতে বাড়ি ফিরেছে তার বাবা। উঠোনে খেঁজুরতলায় বসে গলা ছেড়ে গান ধরলে সে বিছানা থেকে শুনতে পাচ্ছিল। এবার শীতে বুড়ি আর বাঁচবে না, বাঁচবে না। কীর্তনের সুর স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। গ্যাপে খোলের আওয়াজের মত হেঁচকি তুলে তুলে কান্না। মাগো, আবার কী হবে গো। হবে গো, হবে গো। বাবার গান শুনে তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। মার গলা শুনতে পাচ্ছিল। মা চাপা গলায়, যেন দাঁতে দাঁত ঘষটে কথা বলছে। কিন্তু রাতে অনেক দূরের কথাও স্পষ্ট শোনা যায়।

যেখান থেকে রোজ গিলে আসো, রাতেও সেখানেই থাকলে পারো। রাত দুপুরে পাড়ার লোককে গান শোনাতে বসেছ। বদমাশ কোথাকার।

চোপ, হারামজাদি মাগি। গানের তুই কী বুঝস। পদাবলি গান শুনছস কুনঅ দিন ? কত কিসিমের কীর্তন আছে জানস ? নামকীর্তন, ঢপকীর্তন, মানভঞ্জন, গোষ্ঠলীলা, নৌকাবিলাস। তুই তো একখান কাজলাদিদির গানই জানস।

ঘরে যাবে, নাকি সেদিনের মত চ্যালাকাঠ আনব। ছেলেমেয়েদুটো, পাড়ার লোকজন সব শুনতে পাচ্ছে। ছিঃ, লজ্জা বলে কিচ্ছু নেই। কী আমার কপাল।

কপালের কথা কস ক্যান ? আমার গান শুইন্যাই না পাগল হয়্যা পড়ছিলি। রঘুর বিধবা দিদিরে নিয়া হাসানের পাটখ্যাতের ভিতরে আমার লগে দেখা করস নাই ? আপনে ক্যামন করে অ্যাত সুন্দর গান করেন – আমার শরিলে শরিল দিয়া কস নাই ? ঢলানি মাগি। পোলাপানদুইটার কথা ক’স ? কেডায় জানে কার পোলা। তরে আমি বিশ্বাস করি না। বারোভাতারি। কাকের বাসায় কুন কোকিলে আইস্যা ডিম পারছে, তুই ভালো জানস। বাপ রে ! চুল ছাড় বজ্জাত মাগি। নিশারে, তাতুরে, ব্যাবাকটি আইস্যা দ্যাখ, তর মায়ে আমারে ... উমম্‌

সে বিছানায় আরও কুঁকড়েমুকড়ে যায়। মা এখন বাবার মুখ চেপে ধরে ঠেলে ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। এরপর ঘরে হুড়কো দেবার শব্দ হবে। কোনও দিন ওয়াক ওয়াক করে বাবার বমির শব্দ শোনা যায়। কুয়ো থেকে মা বালতিভর্তি জল নিয়ে আসে। ঝাঁটা দিয়ে বমি পরিষ্কার করে। আবার এ রকমও হয় – বাবা বমি করবে, মা আগেই বুঝতে পারলে ঘাড় ধরে কুয়োর পাড়ে বাথরুমে ঢুকিয়ে দেয়। তারপর বাইরে থেকে শেকল তুলে দেয়। তখন তার ইচ্ছে করে খাটের নীচে লুকিয়ে পড়তে। শুধু তার জন্য একটা গোপন এবং নির্জন জায়গা সে খুঁজতে থাকে। সকালে উঠে বাবাকে দেখে সে বুঝতে পারে না বাবা কি সারারাত বাথরুমেই ছিল, ঘুমিয়ে পড়েছিল, নাকি অনেক রাতে মা শেকল খুলে বাবাকে ঘরে আসতে দিয়েছিল।

সকালে উঠে মা বাবাকে দেখে কিছুই বোঝা যায় না। উঠোন রোদে ভরে গেছে। পুবদিকে খেঁজুরতলায় মা একটা মাদুর পেতে দেয়। ঠাম্মাকে কোলের ভেতর জড়িয়ে নিয়ে রোদে শুইয়ে দেয় বাবা। বয়ামে-জারানো-লেবুর মত ঠাম্মা শুয়ে থাকে। ঠাম্মার মাথার নীচে একটা বালিশও গুঁজে দেয় বাবা।

এ গাছে পাখপাখালি বসে না। অবশ্য শুকনো ডাল খসে পড়ার ভয় থাকে। তবে এ সময়েই প্রত্যেকবার তফিজুল এসে দুটো খেঁজুরগাছ ঝুরে দিয়ে যায়। সাড়ে ন’টা দশটা নাগাদ কাজে বেরনোর আগে আবার ঠাম্মাকে কোলে তুলে ঘরে দিয়ে যায় বাবা। তখন বাবার সঙ্গে ঠাম্মার বেশ কিছুক্ষণ কথা হয়। কী গল্প করে বাবা – সে একদিন শুনবে। ঠাম্মা কি বাবাকে রূপকথা শোনায় ? একপেয়ে পেত্নির সেই গল্পটা, নাকি ঠাম্মাকে একবার সাহেবভূতে ধরেছিল – সেই গল্প ?

ভোর থাকতেই পায়রাগুলো উঠোনে ঘুরে বেড়ায়। পশ্চিমের ভেরেন্ডাগাছে কখনও একটা, কখনও দুটো ঘুঘু এসে বসে। হঠাৎ একটা ডাহুক লম্বা পা ফেলে দৌড়ে পেছনের ডোবার দিকে চলে যায়। সে চোখ কচ্‌লে পিচুটি পরিষ্কার করে। মাথার সামনের জানালা খুলে দিলে দক্ষিণঘেঁষা পুবদিক থেকে আলো এসে ঘর উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ভেরেন্ডাপাতার লম্বা ডাঁটি ভাঙলে এক রকম আঠা-আঠা রস বেরোয়। সেগুলো দিয়ে বুদ্বুদ বানিয়ে বাতাসে ওড়ানোর কায়দা সে সম্প্রতি শিখেছে। ওগুলোর গায়ে রামধনুর মত অনেক রং ঝিলমিল করে। তখন তার শরীর শিরশির করে ওঠে।

শ্যামাপোকা দেখে সে ভাবল এবারও নিশ্চয় রঙিন কাগজ দিয়ে রঘুমামা এরোপ্লেন বানাবে। রঘুমামা লালনীল কাগজ দিয়ে ছ’কোণা বাক্স, পাঁচকোণা তারা, এরোপ্লেন বানায়। ভেতরে চওড়া বাতার ওপর এঁটেল মাটি বসিয়ে দেয়। তার ওপর বেশ বড় একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে বাঁশের মাথায় দড়ি বেঁধে টেনে তোলে।

প্রথমে সে বাঁশের চারপাশে ঘুরে ঘুরে লালনীল আলো দেখতে থাকে। তারপর দৌড়ে অনেক দূরে চলে যায়। সেই স্কুলের মাঠে গিয়ে দেখতে পায় বাঁশের মাথায় লালনীল কাগজের আড়ালে প্রদীপ জ্বলছে। সবাই জানে ওটা হল রঘুনাথ মন্ডলের আকাশপ্রদীপ। তার একটু উত্তেজনা হয়। কাগজ ভাঁজ করে মাঝখানে সুতো দিয়ে যখন কাগজ কাটা হচ্ছিল, তখন সুতোর এক মাথা সে ধরে ছিল – এ কথা সবাইকে ডেকে বলতে ইচ্ছে করে। আশপাশে তাকিয়ে দেখে টিনের চালার স্কুলঘর, অন্ধকারে টিনের লাল রং বোঝা যায় না, সুপুরি গাছের সারি, জোড়া তেঁতুলগাছ। এই উত্তেজনা সে একাই উপভোগ করে। এরোপ্লেন কিংবা পাঁচকোণা তারা বাতাসে দুলে ওঠে। স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়ে সে-ও তার শরীরটাকে ডানদিকে, বাঁ দিকে দোলায়। আপন মনে দুলতে থাকে। যেন বাতাস এসে তাকেও তারার মত দুলিয়ে দিচ্ছে। আর কোথাও কোনও আকাশপ্রদীপ নেই। শুধু রঘুমামাদের উঠোনে পুরো কার্তিকমাস ধরে জ্বলবে। তার খুব সুখ হয়। ডানদিকে, বাঁ দিকে দোল খেতে খেতে অস্ফুটে বলে – প্রজাতন্ত্রদিবস। একটু ভেবে বলে – নাইটফল। তারপর ক্রমাগত দোলে। অন্ধকারে কেউ দেখলে ভাবত স্প্রিং-দেওয়া প্লাস্টিকের সেপাই। ক্রমাগত বলতে থাকে – গান্ডু গান্ডু গান্ডু


কী রে তাতু, ক্লাবের মাঠে পাবলিসিটি হবে, যাবি না ?

পাবলিসিটি কী ?

অবাক হয়ে সে জানতে চেয়েছিল পাবলিসিটি কী ? ঝর্ণার মত হেসেছিল বিজুদি। হাসলে বিজুদির বাঁ দিকে ওপরের একটা উঁচু দাঁত বেরিয়ে পড়ে। অন্য দাঁতগুলোর চেয়ে এ দাঁতটার মাথা বেশি সরু। দেখলেই তার কেমন যেন অস্বস্তি হত। তার ছোড়দিকে ঠ্যালা মেরে বিজুদি বলেছিল – তোর ভাইটা এক নম্বরের ক্যালানে হয়েছে। ক্যালানে শুনে তার রাগ হয়নি। বিজুদিও নিশ্চয় জানে তাকে যখন খুশি, যা খুশি বলা যায়। বন্ধুরা যে তাকে আরও কত নামে ডাকে, সে সব তো বিজুদিকে বলাই যাবে না।

হাঁদারাম, বই দেখাবে। মানিক এসে এইমাত্র বলে গেল গাড়ি এসে গেছে। পর্দা টাঙাচ্ছে। যাবি তো আমাদের সঙ্গে চল।

সে বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিল। বই দেখানোর সঙ্গে পর্দা টাঙানোর কোনও আপাতসম্বন্ধ সে খুঁজে পাচ্ছিল না। গাড়ি এসেছে কেন ? কিন্তু ‘পাবলিসিটি’ শব্দটা তার বেশ পছন্দ হয়। শব্দটা মুখের ভেতরে নিয়ে জিভ দিয়ে নাড়াচাড়া করে। লালায় ভিজে শব্দটা বেশ পিচ্ছিল হয়ে গেলে এক সময় কোঁত করে গিলে ফেলে। পেটের দিকে চালান হয়ে যাওয়ার পর এ রকম আরও অনেক মজার শব্দের সঙ্গে ‘পাবলিসিটি’ও জীর্ণ হয়, রক্ত হয়, তার শরীরজুড়ে ঘুরে বেড়ায়। পাবলিসিটি পাবলিসিটি পাবলিসিটি

এটা তার এক রকম খেলাও বটে। নতুন কোনও শব্দ কানে এলেই সে বেশ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। কিন্তু তাদের এ দিকটায় নতুন শব্দ খুব একটা শোনা যেত না। পুরনো শব্দই সবাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলত। পুরনো শব্দ ব্যবহার করেই সবাই কাজ চালিয়ে নিত। তবু তক্কে তক্কে থাকার জন্য, যেমন বর্ষাকালে ধানখেতে এক হাঁটু জলে সে পলো নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, শোল কিংবা মাগুরের খলবলানি টের পেলে খপ করে পলো চেপে ধরে, তেমনি চোখকান তীক্ষ্ণ রেখে খলবলে নতুন শব্দ সে পেয়েও যায়। সেই শব্দের অর্থ জানার জন্য তার কোনও কৌতূহল হয় না। অচেনা, না-শোনা ধ্বনি শুধু তাকে উত্তেজিত করে। এ ভাবেই তার ছোড়দি আর বিজুদির গল্প আড়াল থেকে শুনে সে শিখেছিল মাকাল, গুলপট্টি, মিনস্‌। হাটচালার পাগল মনসুরের চিৎকার শুনে শিখেছিল – হারামখোর। গভীর রাতে মা আর বাবার ঝগড়া শুনে শিখেছিল – বারোভাতারি। এই শব্দগুলো সে খুব যত্ন করে লুকিয়ে রাখত।

শীত চলে যাবার পর পর দুপুরের দিকে যখন গরম পড়তে শুরু করত, সে সময় তাদের এ অঞ্চলে খুব গরম বাতাসের ঘুর্ণি উঠত। বাতাসি নদীর পার থেকে রাশি রাশি সাদাবালি উড়ে আসত তাদের গ্রামের দিকে। পথঘাট, ঘরবাড়ি, খেতখামার ভরে যেত সাদাবালিতে। ভাত চিবনোর সময় পর্যন্ত মুখের ভেতরে কিচ্‌কিচ্‌ করত। কিন্তু ছোট ছোট বালির দানা আলাদা করা যায় না। ক’টা দিন সবাই কিচ্‌কিচে ভাতই খেয়ে নিত। মরাপচা পোকামাকড় তো নয়, ঘেন্নার কিছু নেই। সে ক’টা দিন মানুষজন দুপুরে ঘরের বাইরে যেত না। নাচার হলে মাথায়-মুখে ভেজা গামছা জড়িয়ে বাইরে বেরোত।

তখন সে চুপি চুপি বেরিয়ে পড়ত ঘর ছেড়ে। কোন খেয়ালে চলে যেত তাদের বাতাসি নদীর পারে। গরম হাওয়ায় তার জিভ, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেত। এক একটা ঘুর্ণি হাওয়া এসে তাকে ঘিরে যখন পাক খেত, তার মনে হত আর একটু জোর বাতাস উঠলে সে-ও শুকনো পাতার মত শূন্যে উড়ে যাবে। কিন্তু সে রকম কোনও দিন হয়নি। রোদজ্বলা ধু ধু মাঠে কোথাও জোর ঘুর্ণিতে একরাশ ধুলো, শুকনো পাতা, ছেঁড়া কাগজ পাক খেতে খেতে শূন্যে উড়ে যাচ্ছে দেখলেই সে দৌড়ে গিয়ে ঘুর্ণির ভেতরে ঢুকে পড়তে চাইত। দেখি না কী হয়। কিন্তু সে ঘুর্ণির ‘চোখ’-এর মাঝে দাঁড়িয়ে যেই বলত – মিনস্‌, অমনি পাকখাওয়া ঘুর্ণি বাতাসের স্রোত তাকে ছেড়ে অন্য দিকে চলে যেত, না হয় ভেঙে পড়ত। তার এলোমেলো চুলে জড়িয়ে যেত সাদা বালি। সে ভাবতে চেষ্টা করত ঘুর্ণির মাঝে অত বাতাসেও সে যখন একটু কম বাতাস পাচ্ছিল, দম নিতে কষ্ট হচ্ছিল, তখন কি সে কোনও অস্পষ্ট শব্দ শুনতে পেয়েছিল। তাদের এ তল্লাটের মানুষ ব্যবহার করে না, এমন কোনও শব্দ। বুঝতে পারত না। মুখের ভেতর বালি কিচকিচ করে উঠলে ঘাসের ওপর থুথু ফেলে অবিকল পাগল মনসুরের মত চিৎকার করে বলত – হারামখোর। তক্ষুনি বালির ওড়াউড়ি বন্ধ হয়ে যেত। নদীর এপারে তার প্রিয় ছাতিমগাছের নীচে দাঁড়িয়ে দেখত ওপারে গাছপালা, ঘরবাড়ি কেমন ভেঙেচুরে যাচ্ছে। কোথাও কোনও গুয়েশালিখ নেই, নদীর অল্পজলে দাঁড়িয়ে থাকা কোঁচবক নেই, রোদেপোড়া ছাইছাই আকাশ আর অদ্ভুত-স্থির-হয়ে-থাকা একটা জমাট ভার ঝুঁকে আছে নদীর ওপর।

এই নিস্তব্ধ জমাটভার পাষাণের মত তার বুকের ওপর চেপে বসত। মনে হত এই নীরবতা তাকে খেয়ে ফেলবে। আবার মনে হয় এই রোদেপোড়া বাতাস, পাখিবিহীন সংসার, গরম বাতাসের ভেতর দিয়ে দেখা ভাঙা ঘরবাড়ি – সেই যে সেবার রঘুমামার বানিয়ে দেওয়া তার ঘুড়ি ভোকাট্টা হয়ে মাঝেরডাঙা পার হয়ে আরও পশ্চিমে চলে যাচ্ছিল, সে তো জানতই ঘুড়িটা আর পাওয়া যাবে না, ঘুড়ির জন্য কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু তার চেয়েও বেশি উত্তেজনা হচ্ছিল এটা ভেবে যে, পশ্চিমের-অজানা-দেশে-ভেসে-যাওয়া-ঘুড়িটা তো আসলে তার-ই, যে পাবে, সে কি বুঝতে পারবে এটা তাতু সরকারের ঘুড়ি, ইস, নাম লিখে দিলে হত, এর পর সব ঘুড়িতে সে নামঠিকানা লিখে রাখবে, ঘুড়ি হারিয়ে যাওয়ার জন্য তার দুঃখ, না কি এক রকম আনন্দ হচ্ছে – সে ঠিক বুঝতে পারছিল না – তেমনই একটা নাম-না-জানা কী যেন ভেসে যায় দুপুরের গরম বাতাসে। আনন্দ কিংবা বিষাদের বাইরে কী যেন একটা হারিয়ে যাচ্ছে ঘুর্ণি হাওয়ায়।

তখন সে মুখের ভেতরে জিভের ডগায় শব্দটা বসিয়ে মন্ত্রের মত উচ্চারণ করত – বারোভাতারি বারোভাতারি ... তারপর শান্ত হয়ে দেখত নদীর ওপারের ভেঙে-যাওয়া ঘরবাড়ি, গাছপালা, সব আবার আগের মত দেখা যাচ্ছে। কোথাও একটা হলুদপাখি ডেকে উঠল। দুটো বক উড়ে গেল ভাটির দিকে।



তো সেবার দেওয়ানসাহেবের মেলায় গিয়ে সে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল। শুনল প্রফেসরের মরণ ঝাঁপের কথা। শুনতে পেল কোথাও ভটভট করে শব্দ হচ্ছে। আসার সময় অজস্র মানুষের ঢল ছিল পথে। তাদের গ্রাম থেকে কাজিপাড়া যাওয়ার পথে লোকজনের খুব একটা চলাচল নেই। বেশির ভাগ লোকজন নদী পার হয়ে বড়দিঘির পাশ দিয়ে কাজিপাড়ায় পৌঁছে যায়। অথচ আজ মানুষের পায়ের ধুলোয় আকাশ ধূসর হয়ে এসেছে। মানুষের স্রোতে গা ভাসিয়ে সেও এগিয়ে যাচ্ছিল। লাল শাড়িপরা একটা বউ তাকে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে গেলে সে অস্ফুটে ‘মিনস্‌’ বলতে গিয়েও থেমে গিয়েছিল। কেন যেন মনে হয়েছিল তার গোপন শব্দাবলি এখানে নিষিদ্ধ। ওগুলো শুধু নির্জনে উচ্চারণ করা যায়।

মনসাতলার মোড়ে এসে সে দেখল লোকজন দু’ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। একদল বাঁ দিকে ঘুরে ক্লাবের মাঠের দিকে যাচ্ছে, অন্য দল একটু ডানদিকে কাজিপাড়ার মেলার মাঠের দিকে হাঁটছে। এদিকের দলটাই ভারি। তার মনে পড়ল ছোড়দি আর বিজুদি ক্লাবের মাঠে যাবে। ওখানে আজ পাবলিসিটি। বই দেখাবে। গাড়ি এসে গেছে। পর্দাটর্দা টাঙানো হয়ে গেছে। সে বুঝতে পারছিল না কোনদিকে যাবে। সেদিন যদি ক্লাবের মাঠের দিকেই সে যেত, তবে তার জীবনটা হয়তো অন্য রকম হত। কিন্তু মরামানুষের কথা বলা ব্যাপারটা তাকে সেদিন বেশি আকর্ষণ করেছিল।


গতসপ্তাহে, শনিবার ছিল সেদিন, ভুটুর সঙ্গে নদীবাঁধের পথ ধরে স্কুল থেকে ফিরছিল। তখনই কাজিপাড়ায় বড়মেলার কথা জানতে পেরেছিল। বেলালের ভ্যানরিকশায় মাইক লাগিয়ে একটা লোক বলছিল প্রফেসরের মরণঝাঁপ, মৃত্যুগুহায় মোটরসাইকেল, শূন্যে ভাসে সুন্দরী, মরামানুষ কথা বলে – এসব আশ্চর্য কথা।

নদীবাঁধের পথটা সমতল নয়। এক সময় ছোটবড় পাথর ফেলা হয়েছিল। সেগুলো সব বসে যায়নি। কোথাও কোথাও উঁচু উঁচু মাথা জেগে আছে। ভুটুর জন্য তার একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। ভুটিয়া তার ডান পায়ের পাতা পুরোপুরি মাটিতে ফেলতে পারে না। পাতাটা ডানদিকে একটু কান্নি খেয়ে ঘুরে থাকে। সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটে ভুটু। নদীর পারে বুনোকুল খাওয়ার জন্য ওরা আজ এপথে এসেছিল। গড়ানে ঢাল বেয়ে নদীর পারে নামার সময় ওরা নদীর পশ্চিম পার থেকে একটা অস্পষ্ট হট্টগোল শুনতে পেল। চোঙা বা বেলালের ভ্যান-রিকশা ওরা প্রথমে দেখতে পায়নি। মনে হচ্ছিল যেন অনেক মানুষ চিৎকার করে কিছু বলছে। আসলে ভ্যানটা ছিল পুবদিক থেকে পশ্চিমমুখো হয়ে, ওরা যাচ্ছিল বাঁ হাতে নদীকে রেখে বাঁধ বরাবর সোজা উত্তর দিকে। চোঙার শব্দ নদীর পারে ধাক্কা খেয়ে ওদের কানে ফিরে এলে ওদের মনে হয়েছিল অনেক দূরে কোথাও অনেক মানুষের জমায়েত থেকে হৈ-হট্টগোল আসছে।

ওরা বাঁধ ছেড়ে নীচে নামার মুখে দাঁড়িয়ে পড়ল। তখনই দেখতে পেল ভ্যানরিকশা। ভুটু তার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় দাঁড়াতে বলল। সে বুঝতে পারল এখানে অপেক্ষা করলেই চলবে। এপথ দিয়ে ভ্যানটাকে যেতে হবে।

মনে হয় বেলালের গাড়ি। ভুটিয়া বলল।

দাঁড়ানোর সময় ভুটিয়া তার ডানপায়ের পাতা আলতো করে মাটিতে রাখে। শরীরের ওজন প্রায় পুরোটাই বাঁ পায়ের ওপর থাকে। ভুটুরা খুব বড়লোক। ওর বাবার পাটগোলা আছে। কিন্তু ভুটু জুতো পরতে পারে না। প্রত্যেকবার পুজোর ছুটির আগে ভুটু বলে যে, ওর বাবা বলেছে এবার কলকাতায় গিয়ে বড় হাসপাতালে পা অপারেশন করিয়ে আনবে। কিছুদিন বাদে সে ইচ্ছে করলে ফুটবলও খেলতে পারবে। কিন্তু তার বল খেলার ইচ্ছে নেই। স্কুলের স্পোর্টস্‌-এ সে রানে নাম দেবে। কিন্তু পুজোর পর স্কুল খুললে ভুটিয়া বিশ্বাস আগের মতই খালি পায়ে স্কুলে আসে। সবাই জানতে পারে যে, এবার পাটের দর সে রকম ওঠেনি বলে তার বাবার মন ভালো ছিল না।

ভ্যানটা যখন সমকোণে বাঁক নিয়ে তাদের মুখোমুখি হল, তখন সব কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। ওদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভুটুর দিকে তাকিয়ে বেলাল একটু হাসল। শীতকাল, তবু বেলালের কপালে ঘাম চিকচিক করছে। ভুটুও হাসল।

বেলালটা বহুত হারামি। যা সব গল্প জানে না ...

অ্যাঁ

মাঝে মইধ্যে আমাগো গোলা থিক্যা মাল নিয়া হাটে যায়। সন্ধেবেলা আইসা হাটের গল্প করে। হারামিটা একদিন আমার এই পায়ের পাতা ভালো কইর‍্যা দেখতে দেখতে পঞ্চানন্দপুরের পিরের কইতেছিল। আল্লার কিরা কাইট্যা কয় এক মাসের মইধ্যে ঠিক হইব। তারপর, শালা পাটগোলার ভিতরে অন্ধকারে বইস্যা আমার দুইপায়ে সুড়সুড়ি দিলে কেমন যেন অবশ অবশ লাগতেছিল। তারপর চুতমারানি আমার প্যান্ট খুলতে গেলে ... একটা লাথি দিয়া দৌড় মারছি। হালায়, পোঙা মারার গোসাঁই।

একটা লোক ভ্যান থেকে হাত বাড়িয়ে হলুদ একটা কাগজ দিয়েছিল ওদের। অচেনা লোক। ভুটু কী যেন বলছিল তাকে, কিন্তু সে ভুটুর কথা শুনতে পাচ্ছিল না। প্রফেসর, মৃত্যুগুহা, মৃতমানুষ – এসব নিয়ে ক্রমশ অন্য জগতের দিকে চলে যাচ্ছিল সে। টের পায়নি তার হাত থেকে হলুদ কাগজ নিয়ে ভুটু তাকে পড়ে শোনাচ্ছে। ভুটুর কোনও কথা সে শুনতে পাচ্ছিল না। মাইকে শোনা কিছু অচেনা শব্দ তার মাথার ভেতর ছড়িয়ে পড়ছিল।

অনেকটা পথ হেঁটে মেলার মাঠে পৌঁছে সে অবাক হয়ে দেখল পথের দু’পাশে অজস্র দোকান বসে গেছে। খাবারের দোকান, মাটির পুতুল, প্লাস্টিকের খেলনা, কাচের চুড়ি, নকল পাথরের গয়না, পাথরের থালাবাটি, দাঁবটি, অ্যালুমিনিয়ামের বাসনপত্র, জামাকাপড়ের দোকান। জীবনে সে প্রথম একসঙ্গে এতগুলো দোকান দেখল। সে টের পাচ্ছিল উত্তেজনায় তার বুকের ভেতরে খুব জোরে শব্দ হচ্ছে। কোথাও তারকজ্যাঠার মত মুদিদোকান বা পান্নালালের মত চুলকাটার দোকান নেই।

লালনীল, হলুদসবুজ কাঠের বেড়া দিয়ে ঘেরা ছিল কয়েকটা জায়গা। ফাঁক দিয়ে সে দেখতে পেল একটা লোহার খুঁটির চারপাশে ছোট ছোট কাঠের ঘোড়া শেকল দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেগুলোর পিঠে চেপে বাচ্চারা ঘুরছে। একটু দাঁড়িয়েই সে চলে যায় কাচের চুড়ির দোকানের দিকে। সেখানে মেয়েবউরা ভিড় জমিয়ে দরদাম করছে। একটা মেয়ে, বিজুদির মত রোগা, লম্বা – কানের পাশে পুঁতিবসানো দুল ধরে পাশের মেয়েটাকে কী যেন বলল। দোকানদার তার হাতে একটা ছোট গোল আয়না দিল। আয়নার দিকে তাকিয়ে ঘাড় কাত করলে সে দেখল অবিকল বিজুদির মত গালে টোল পড়ল মেয়েটার। সামনে কাচের ডালার ভেতর সাজিয়ে রাখা নকল গয়নাগুলো থেকে আলো ঠিকরে আসছে। সে একজন ঘড়িপরা লোকের কাছে ক’টা বাজে জানতে চেয়েছিল। লোকটা বলল –ছ’টা বাজতে পাঁচ। প্রফেসরের মরণঝাঁপ, মই বেয়ে অনেক উঁচুতে উঠে গায়ে আগুন ধরিয়ে নীচে জলভরা চৌবাচ্চায় ঝাঁপিয়ে পড়ার খেলা। বাইরে অনেক বড় ছবি দেখেছে সে। রাত আটটায়।

কাঠের পাটাতন, বাঁশের খুঁটি, হলুদসবুজ পর্দার মাঝখানে একটা মুন্ডু ঝুলে আছে। এটা লাল রং-এ আঁকা। এখানেও কাঠের বেড়া দিয়ে ঘেরা। ছোট্ট একটা তাঁবুঘেরা জায়গা। ভেতরে ঢোকার মুখে ছোট গেট। সেখানে একজন টেবিলে বসে টিকিট বিক্রি করছে। দূর থেকে দেখলেও সে বুঝতে পারছিল কানে-মাফলার-জড়ানো-লোকটার মুখে অনেক পক্সের দাগ রয়েছে। লোকটা ফর্সা, কিন্তু ক্ষতচিহ্নগুলো গভীর হওয়ার জন্য সেখানে ভালোমত আলো পৌঁছয় না। ফলে তার মুখ কালো কালো গর্তেভরা চাঁদের বুড়ির মত মুখ মনে হয়। ধোঁয়া ধোয়া চশমার কাচের জন্য তার চোখ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল না। কথা বলার সময় লোকটার উঁচু দাঁত বেরিয়ে পড়ছে। লোকজন মৃতমানুষের কথা শোনার জন্য টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকছে। তাদের মুখ দেখে মনে হয় তারা আশা করছে খুব এক চোট মজা হবে। দু’একজন জোরে জোরে ফালতু কথা বলছিল। চিন্তিত বা গম্ভীর মুখের মানুষও দু’একজন ছিল।

সে একটু ইতস্তত করল। সামান্য বাঁ দিকে অন্য একটা একই রকম ঘেরা জায়গা। সেখানে সুন্দরীর শূন্যে ভেসে থাকার ছবি। সে বুঝতে পারছিল না কোথায় যাবে। তার কাছে যা টাকা আছে, দুটো টিকিটের দাম হবে না। তাছাড়া, আসার সময় পুতুলের দোকানে একটা মাথা-নাড়ানো কাঠের ঘোড়ায় তার চোখ আটকে গিয়েছিল। সামান্য বাতাস এলেই ঘোড়াটার মাথা দুলে উঠছিল। সেটার কথাও বিবেচনায় আছে। ঠিক একই রকম টেবিলের সামনে বসে সুন্দরীর শূন্যে ভেসে থাকা দেখার জন্য টিকিট বিক্রি করছে যে লোকটা, তার গায়ে ধূসর সোয়েটার। লোকটা খুব দুখি দুখি মুখে টিকিট বিক্রি করছিল। হয়তো সে ভাবছিল এত বেশি লোক কেন সুন্দরীর শূন্যে ভেসে থাকা দেখতে চাইছে। কী দরকার এত লোকের আসার। খুব বেশি লোক এই দৃশ্য দেখলে হয়তো খেলাটার মজা নষ্ট হয়ে যাবে। অনেক বেশি লোকের সামনে সে হয়তো আর শূন্যে ভেসে থাকতে পারবে না।

মৃতমানুষের কথা বলার ব্যাপারটা তাকে খুব কৌতূহলী করে তুলেছিল। কোন ভাষায় কথা বলবে মৃতমানুষ। বেঁচে থাকা মানুষদের মতই কি সে চিরকালের পরিচিত শব্দে কথা বলবে ? কেমন হবে তার ভাষা ? কেমন হয় তাদের কথা ? সে একবার মাফলারের দিকে, একবার ধূসর সোয়েটারের দিকে ভালো করে লক্ষ করল।

মাইকে বারে বারে মরণ-ঝাঁপের কথা শোনা যাচ্ছে। কোথাও চাপা ভটভট করে শব্দ হচ্ছে। চারপাশে অনেক মানুষ। তারা রঙিন চাদর, সোয়েটার, মাফলার এবং বাঁদুরে টুপি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। টুকরো টুকরো কথা সোয়েটারের উলের মত একটার সঙ্গে আর একটা জড়িয়ে অনেক বড় একটা চাদরের মত মেলার মাঠে ঢেউ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু সবই পুরনো কথা।

যেমন তার ঠাম্মার গান। গান শুনতে শুনতে তার ঘুমিয়ে পড়া। কত পুরনো গান।

হ্যাঁচোড়া লো প্যাঁচোড়া চুল তাইতে সবে না লো নোয়াগাড়ার ফুল

নোয়াগাড়ার ফুল লো বেড়ার মাটি এত ফুল জোগাবি কত রাতি

জোগাব জোগাব মাঘঅ মাসে আর জোগাব পুন্নিমার শ্যাষে

গাও তাতুসোনা, আমার লগে কও দেহি ... তার তখন ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসত। গানের কথাগুলো একটার সঙ্গে একটা জড়িয়ে ওম ওম একটা চাদর হয়ে তার শরীরে ঘুম দিত। শ্যাষে বলতে পারত না, ঘুমজড়ানো চোখে বলত – ত্যাসে। ঠাম্মা, ছাতুর গল্প বলো। কোনও একটা পথের মোড়ে দু’পা ফাঁক করে দাঁড়াতে হয়। মাথা নিচু করে পায়ের ফাঁক দিয়ে ছাতু উড়িয়ে দিতে হয়। কও সোনা, আমার লগে কও – ছাতু যায় উইড়্যা, দুশমনবাদী মরে পুইড়্যা। ঠাম্মা বলত।

সাকুল্যে বারো বছর বয়সেই তার মনে হয় এসব যেন সে তার জন্মের আগেই শুনেছিল। মনে হয় না এসব কোনও নতুন কথা। আরও নতুন কথা শোনার জন্য ভবঘুরের মত হাটচালায় ঘুরে বেড়ায়, নদীর পারে গিয়ে একা বসে থাকে, লুকিয়ে মেয়েদের গোপন কথা শোনে। তাকে মনে হয় হাবাগোবা। একবার শুনে কোনও কথারই সে খেই ধরতে পারে না। বন্ধুরা বলে – গান্ডুতাতু। গ্রামের লোকজন বলাবলি করে বনমালীর পোলাডা বাওরা হইব। অর বাপের লাহান। আসলে আরও নতুন শব্দের জন্য, অচেনা পাখির শিস শোনার জন্য, নদীর জলের অন্য সুরে ছলাত্‌, কিংবা তারকজ্যাঠা যেমন বলে ’ঢলতা’, বা বাবার মুখে শোনা ‘গতরের দেমাক’ – পলো নিয়ে সে ঘোলা জলে মাছ ধরে বেড়ায়। ঘুর্ণিবাতাসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রহস্যময় কোনও শব্দ শোনার চেষ্টা করে।

ঠাম্মা

কও তাতাইসোনা

নাগর কারে কয় ? ছেনাল ?

কেডায় কয় ? কুন সুমুন্দির পুত ?

ঠাম্মার মুখে দোক্তার গন্ধ। ঠাম্মার বিছানায়, কাঁথাবালিশে অদ্ভুত একটা গন্ধ জড়িয়ে থাকে। পরিচিত কোনও শব্দ দিয়ে সে এই গন্ধকে শনাক্ত করতে পারে না। কখনও মনে হয় অনেক দিনের ধুলোর গন্ধ, কখনও মনে হয় নারকোলের ভেতরে শাঁস পচে গেলে যেমন একটা তেল তেল গন্ধ হয় – তেমন। আবার ঘরের কোণে ইঁদুর মরে পচে গেলে অনেকদিন পরেও যেমন বাসি, চিমসে গন্ধ থেকে যায়, অথবা, যদিও সে জানত না – বাসি মড়ার গন্ধ বুঝি। কিন্তু নির্দিষ্ট ভাবে এই গন্ধের কী নাম, সে বলতে পারবে না।

ঠাম্মার কোনও দাঁত নেই। মনে পড়ে না কোনও কালে সে তার দাঁতওয়ালা ঠাকুমাকে দেখেছে। হামানদিস্তায় পান ছেঁচে ঠাম্মা মুখে দিত। ঠাম্মার ফর্সা রং, লাল টুকটুকে ঠোঁট, আর শরীরে যেন আমসত্ত্ব, নারকোলের নাড়ু, পাটালির গন্ধ লেগে থাকে। আরও ছোটবেলায় সে যখন বারে বারে একপেয়ে পেত্‌নির গল্পটা শুনতে চাইত – এই পেত্‌নি্টা বিশাল উঁচা তেঁতুলগাছের মগডাল থিক্যা তার একখান পা নামাইয়া দিল, এইবার পেত্‌নিটা জিগাইল – গাঁছের তঁলায় ক্যাঁডা, তুই তখন ক’বি – বোনোমালির ব্যাটা – তখন সে আরও ঘন হয়ে তার ঠাকুরমার কোলের ভেতরে ঢুকে পড়তে চাইত। ঠাম্মা একদিন বলেছিল – দ্যাখ তো, আমার পা একখান, দুইখান ? শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল তার গলা। কথা বলতে পারছিল না। ডরাইছস – ঠাম্মা তার বুকেপিঠে হাত বুলিয়ে দিলে তার ইচ্ছে করছিল হাত বাড়িয়ে একবার দেখবে ঠাম্মার পাদুটো ঠিকঠাক আছে কিনা। তারপর ঠাম্মা তার মুখের ভেতর থেকে একদলা আধ-চেবানো পান তার মুখে গুঁজে দিয়েছিল। ল, গিল্যা ফালাইস না। একটুখানি চিবা। নীচের কৌটায় ফালাইয়া দিস। খবরদার, তর মায়ে য্যান ট্যার না পায়। হ্যায় তো রানী ভেক্টোরিয়া হইছে। বনোরে তখনই কইছিলাম কয়রা চোখের মায়্যা, স্বভাব ভালো হইব না।

পরে যতবার সে কথা মনে পড়েছে, মুখের ভেতরে মিষ্টি লালায় ভরে উঠেছে। অথচ অন্ধ একটা ক্রোধ, ঘেন্নামাখানো পিচ্ছিল একটা দলা তীব্র অভিমান হয়ে বুকের ভেতরে ছড়িয়ে পড়েছে। নির্দিষ্ট কারও ওপরে নয়, সমস্ত পৃথিবীর ওপরেই যেন ঘেন্না হত। থু থু করে চারপাশে থুথু ছেটাত।

সেদিন রাতে সেই পানদোক্তার দলায় একটু মিষ্টি, একটি ঝাঁঝ স্বাদ ছিল। দলাটা মুখে নিয়েই বুঝতে পেরেছিল আসলে ঠাম্মার দুটোই পা। ক’বার চিবিয়ে খাটের পাশে রাখা একটা কৌটোয় ছিবড়ে ফেলে দিয়েছিল। তারপর কখন যেন সেই বিছানাতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। কোনও কোনও রাতে গল্প শুনতে শুনতে সে এখানেই ঘুমিয়ে পড়ে, পরে মা এসে তুলে নিয়ে যায়।

পরদিন সকালে মার চিৎকার শুনে তার ঘুম ভাঙল। বাবা মাঝে মাঝে মিনমিন করে কী যেন বলছে। বাবার কথাগুলো ভালো বোঝা যাচ্ছিল না। রাতে তো বাবার আওয়াজ সাত মাইল দূর থেকে শোনা যায়। কিন্তু মাকে এভাবে কথা বলতে সে কোনও দিন শোনেনি।

ছি ছি, কী ঘেন্না। নিজের নাতির সর্বনাশ কেউ এভাবে করে। শয়তান বুড়ি। আজ আমার একদিন, কি তার একদিন। ঘর থেকে যদি বার না করে দিয়েছি – আর এই যে, দিনরাত তো ছাগলের মত ম্যা ম্যা করে ডাকছ, যাও, একবার গিয়ে শুনে এসো কোন আক্কেলে এই কান্ড করেছে।

কী এমুন মাহাভারত অশুদ্ধ হইছে। অত ফাল পাড়ো ক্যান ?

থামো। মানুষের তো ঘেন্নাপিত্তি বলেও একটা কথা থাকে। মূর্খ হলেও স্বাভাবিক জ্ঞানগম্যি তো থাকবে। ভিমরতি ধরেছে বুড়ির। কাঁথাকানিসুদ্ধ ঝেঁটিয়ে বিদায় করব এবার। মুখের ভেতরের আদ্ধেক-চিবনো পান আদর করে নাতির মুখে গুঁজে দিয়েছেন। তার শরীরের যত রোগব্যাধির জার্ম, মুখের লালা, পানদোক্তার রস ...

তুমি ট্যার পাইলা ক্যামনে ? উড়া কথা কিনা ... মায়ের তো বয়স হইছে, উল্টাপুল্টা কথা কয়।

সেটাই তো বলছি। মাথার গন্ডগোল তো ছিলই, এবার পুরোপুরি গ্যাছে। ওসব পাগলছাগল মানুষ নিয়ে আমি ঘর করতে পারব না। সংসারে শুভ অশুভ, মঙ্গল অমঙ্গল বলে একটা ব্যাপার থাকে। আর, বুঝতে না পারার কী আছে। তাতু তো না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল। রাতে ওঘর থেকে টেনে এনে পিঁড়িতে বসিয়েছে, দেখি ঠোঁট টুকটুকে লাল। তখনই সন্দেহ হয়েছে। মুখে গন্ধ শুঁকে দেখি ভুরভুর করে পানদোক্তার গন্ধ বেরোচ্ছে। ভেবেছিলাম, হয়তো নাতি বায়না ধরেছে, ছোট করে একটা পান বানিয়ে দিয়েছে। ও মা, শয়তান বুড়ি নাকি নিজের মুখের কফথুতুমাখানো পান আমার ছেলের মুখে গুঁজে দিয়েছে। কী ঘেন্না, কী ঘেন্না। অসম্ভব, আজই তুমি আতা ঠাকুরঝির ওখানে পাঠাবার ব্যবস্থা করো।

হঠাৎ তার ঠাকুরমার ঘর থেকে হাউমাউ কান্নার শব্দ শুনে বাবা দৌড়ে গিয়েছিল। হয়তো একা একা এদিকে আসতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়েছে। বাবার পেছনে মা, মার পেছনে সেও গিয়ে ঠাম্মার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল।

বনোরে, আমার শরিলটা য্যান কেমুন করতাছে। অ বউ, তাতুসোনারে আমি পান দেই নাই। মা মনসার কিরা। অয় কইলো পান খাইব, বাটা থিক্যা একছিটা পাতা নিয়া অরে দিছি। অ বনো, তর বউ আমারে খ্যাদাইয়া দিলে আমি কই যামু। অ বনো, অ বনো, কিছু ক’স না ক্যান ? এইবার ঠান্ডাও পড়ছে। পাতার লগে একদানা মশল্লা থাকতেও পারে। অ বউ, রাগ করছ ? বনো যেইদিন তোমারে ঘরে আনল, তোমার লক্ষ্মীর লাহান মুখ দেইখ্যা কত কান্‌ছি। আহা, আইজ যদি তাইনে থাকত। তুমি আমারে ফালাইয়া কই গেলা গো ... অ বউ, বনো রে

কাইন্দ না মা। বনমালী সরকার বাইচ্যা থাকতে কারঅ নুম্বারও ক্ষমতা নাই তোমারে খ্যাদায়। কাইন্দ না জননী। তুমি নিচ্চিন্তে থাকঅ।

তুই যে ক’ছিলি এবার আমারে একটা কম্বল দিবি ?

দিমু না ক্যান ? খাড়াও, থানার কাজটা পাইলেই দিমু। দশখান টিউবল বসানোর কাম পাইছে আমার মালিক। আমি হইলাম জহিরুলের হেডমিস্তিরি। পাইপের কেস-এ লিক আছে কিনা, আমি ছাড়া আর কেউ ধরতেই পারে না। কম্বল তো দিমুই।

সে দেখল মা তার ঠাম্মার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু এখন আর চোখে অতটা রাগ রাগ ভাব নেই। বরং দৃষ্টিটা বেশ নরম হয়ে এসেছে। ঠাম্মার কান্না শুনে হয়তো মায়ের রাগ কমে গেছে। কিন্তু হঠাৎ তার ঠাম্মার ওপর খুব ঘেন্না হল। তাকে মিথ্যেবাদী বানিয়ে নিজে কী সুন্দর সাধু সেজে বসে রইল। আর কী সাহস ঠাম্মার ! কোন সাহসে মা মনসার নামে মিথ্যে মিথ্যে দিব্যি কাটল। একটুও ভয় করল না। সে আর কোনও দিন ঠাম্মার ঘরে যাবে না, কোনও গল্প শুনতে চাইবে না। ঠাম্মার ওপর ঘেন্নাটা ক্রমে বাড়ছিল। পানদোক্তার কথা মনে পড়তেই মুখের ভেতর মিষ্টিমিষ্টি, ঝাঁঝঝাঁঝ একটা স্বাদ টের পেল। মিষ্টি লালায় ভরে যাচ্ছে মুখের ভেতরটা। কিন্তু সেই লালায় মিশে ছিল এক রকম বিরক্তি, রাগ, অভিমান। ইচ্ছে করছিল উঠোনে নেমে থুথু ফেলতে।


হঠাৎ গালের ওপর ঠাস করে চড় পড়তে সে প্রায় মাথা ঘুরে পড়েই যাচ্ছিল। কানের ভেতর দিয়ে নয়, শব্দটা সে যেন সরাসরি মাথার ভেতরে শুনতে পেল। চোখের সামনে কালো কালো বিন্দু পোকার মত উড়ে বেড়াচ্ছে। তার চুলের মুঠি ধরে মা তখন পিঠের ওপর ক্রমাগত কিলচড় মারতে শুরু করেছে। বারান্দার পাশে তার লিকলিকে মাছ ধরার ছিপ বেড়ায় গোঁজা ছিল, হাত বাড়িয়ে সেটা টেনে নিয়ে তার পায়ে, পাছায়, পিঠে সপাসপ মেরে যাচ্ছে মা। ও ঠাম্মা – চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল সে।

ঠাম্মার আলুথালু নোংরা কাপড়, কালো চাদরের বেশির ভাগ মাটিতে গড়াচ্ছে, কুঁজো হয়ে তার বুড়ি ঠাকুরমা বিছানা ছেড়ে উঠে আসছে। তার বাবা মায়ের হাত থেকে কঞ্চি কেড়ে নেবার চেষ্টা করেও পারছে না।

কী কর, মরব তো পোলাটা। অর কী দোষ। কার উপর রাগ দেখাও তুমি। ঝিরে মাইরা বউরে শিক্ষা দিবার চাও।

না, ছেলের কোনও দোষ নেই। তোমার মারও কোনও দোষ নেই। সব দোষ আমার। ছেলের জন্ম দিয়ে তো আমারই ঘাট হয়েছে। ছেলেমেয়ের খোঁজ রাখো ? নিশা দিনরাত পাড়ায় ধিঙিপনা করে বেড়াচ্ছে। কতবার বলেছি ফ্রক পরে এখন আর বাইরে বেরোবি না। আমাকে মানুষ বলে এ সংসারে কেউ মানলে তো। আর এই শয়তান, রাত্তিরবেলা কচিখোকা সেজে গল্প শুনতে যান, দিনের বেলা তার পাখা গজায়। কাঠফাটা রোদ, ঝড়বাদলা, ধুলোর ঝড় – কিচ্ছু মানামানি নেই। কোথায় কোথায় চলে যায়। আয়, তোকে আজ মজা দেখাব।

ঠাম্মা কুঁজো হয়ে মার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ও ঠাম্মা, ও ঠাম্মা – মার হাত ছাড়িয়ে সে তার ঠাম্মার দিকে ঝুঁকে পড়তে চাইছিল। ঠাম্মাকে তার অনেক কালের পুরনো একটা কাছিমের মত মনে হয়। যেন নদীর পারে, বালির গর্তে লুকিয়ে-রাখা ডিমগুলো দেখবে বলে জল ছেড়ে বাইরে উঠে এসেছে। তার মুন্ডু সেভাবে সামনে ঝুঁকে আছে। ঘোলা চোখে জলের বাইরের পৃথিবী দেখার চেষ্টা করছে।

বউ, আমারে যত খুশি মার। অরে আর মারিস না। অহন আর আমি ডরাই না। কীসের ডর ? আমারে খ্যাদাইয়া দিবি ? দে। আতার বাড়ি যামু গিয়া। আমিই অর মুখে পান দিছিলাম। মা মনসার কিরা। আমারে এইবার বিদায় দে বউ।

মা হঠাৎ চোখে আঁচল চাপা দিয়ে দৌড়ে ঘরে ঢুকে গেল। তার সামনে কুঁজো হয়ে ঠাম্মা। শ্যাওলাজড়ানো প্রাচীন কচ্ছপের ঘোলাচোখে রহস্যময় আনন্দ খেলা করছিল। বাবা বারান্দায় একটা খুঁটি ধরে গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। হঠাৎ তার মনে হল সে খুব একা হয়ে গেছে। তার কথা কারও মনে নেই। সেও যেন ভুলে গেল পিঠেপায়েপাছায় ফুলে-ওঠা ব্যথার জায়গাগুলো। ঠাম্মা আবার কুঁজো হয়ে তার ঘরে ফিরে যাচ্ছে। ঠাম্মা কি সত্যি আতাপিসির বাড়ি চলে যাবে ? ও ঠাম্মা – বলতে গিয়েছিল সে, কিন্তু ফুঁপিয়ে বলে উঠল – জার্ম জার্ম জার্ম



আসুন, দেখুন, নিজের কানে শুনুন মৃতমানুষের কথা। বেলালের ভ্যানের সঙ্গে বাঁধা মাইকে এই ঘোষণা শোনার পর থেকে ঘুরেফিরে কথাগুলো তার মনে পড়ছিল। মৃতমানুষের ভাষা কেমন হয় ? তারা কি জীবিত মানুষদের মতই চেনাজানা পুরনো শব্দ ব্যবহার করে ? বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের চেয়ে কৌতূহল ছিল বেশি। দেওয়ানসাহেবের মেলায় গিয়ে সে একবার মাফলারের দিকে, আবার ধূসর সোয়েটারের দিকে তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত দৃঢ় এবং নিশ্চিত পায়ে মাফলারের টেবিলের দিকেই এগিয়ে গিয়েছিল।

টিকিট হাতে নিয়ে সে দেখল তার আগে মাঙ্কিক্যাপপরা যে লোকটা টিকিট কেটেছে, সে গেটের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। সাদালুঙি, খয়েরি পাঞ্জাবির ওপর সবুজ চাদর। লোকটা তার দিকে তাকিয়ে হাসল। মাড়ি দেখা যায়। স্বাভাবিক নয়, পাঁঠার মেটুলির মত কালচে-খয়েরি। এ রকম মাড়ি সে এর আগে কারও দেখেনি।

তোমার সঙ্গে কেউ আসে নাই ? একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছ। মরামানুষের কথা শুনে ভয় করবে না তো ?

না। একটু লজ্জা পেয়ে সে বলেছিল।

অবিশ্যি এর ভেতরে কায়দা আছে। ম্যাজিকের মত। জেনেশুনেই সবাই পয়সা খরচ করে ঠকতে যায়। কিন্তু ফেরেব্‌বাজি হলেও এ লোকটার এলেম আছে। কায়দাকৌশল ভারি চমৎকার। সোনাডাঙার মেলায় লক্ষ্মীকান্তবাবু মেডেল দিইছিল। চল, টাইম হয়ে গেছে।

সে কিছু বোঝার আগেই লোকটা তার হাত প্রকান্ড মুঠোর ভেতর নিয়ে হাঁটতে শুরু করে দিল। সে চেষ্টা করছিল হাত ছাড়িয়ে নিতে, কিন্তু তার হাত বেশ জোরে চেপে ধরেছে লোকটা। দু’পাশে বাঁশ দিয়ে ঘেরা গলিপথ শেষ হলে সামনে একটা চটের পর্দা। পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢোকার পর লোকটা তার হাত ছেড়ে দিল। তার হাত ঘেমে গিয়েছিল। কমিটির লোক তাকে একটা বেঞ্চ দেখিয়ে দিলে তাড়াতাড়ি গিয়ে সে বসে পড়ল। সামনে তাকিয়ে দেখল একটা হলুদসবুজ পর্দা ঝুলছে। পর্দার ওপর লাল রং-এর মানুষের মাথা আঁকা রয়েছে। গলাকাটা। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে।

তার ইচ্ছে করছিল পাশের লোকটার আরও কাছে ঘন হয়ে বসতে। তাকিয়ে দেখল মাঙ্কিক্যাপপরা, কালচেখয়েরি মাড়ির সেই লোকটাই তার পাশে বসেছে। লোকটা যদি আবার তার হাত মুঠোর ভেতর টেনে নেয়, আশপাশের লোক ভাববে সে হয়তো ভয় পেয়ে পাশের লোকের হাত চেপে ধরেছে। ভাবতে পারে মাঙ্কিক্যাপপরা লোকটা বুঝি তার বাবা। বাইরে প্রফেসরের মরণঝাঁপের কথা মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে। কোথাও অস্পষ্ট ভট্‌ভট্‌ শব্দ হচ্ছে। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে সে কোনও চেনা মুখ খুঁজে পেল না। ঘাড় উঁচু করে সামনের লোকজন দেখল। তাদের গ্রামের কেউ নেই। একটু ভয় করছিল। একা মনে হচ্ছিল নিজেকে।

তখনই তার নাকে প্রবলভাবে ঝাঁঝালো পেচ্ছাবের গন্ধ এল। তার বাঁ দিকের চটের পর্দা সরিয়ে লোকজন মাঝে মাঝে আসাযাওয়া করছে। তাদের ক্লাস সিক্সের জানালা দিয়ে, বিশেষ করে টিফিনের পর রোজ যেমন গন্ধটা সবাই পায়, তেমন গন্ধ। খুব চেনা শব্দের মত গন্ধটা। বুক ভরে শ্বাস টানল সে। মাথার ভেতর গন্ধের আওয়াজটা পেল। পাশের লোকটা নাক দিয়ে হুঁত হুঁত শব্দ করছে।



বাজনা থামলে সামনের পর্দা সরে গেল। স্টেজের বাঁ দিকে, চেয়ারে একটা মানুষ বসে আছে। তার হাতপা দেখা যাচ্ছে না। গলা পর্যন্ত কালো কাপড়ে ঢাকা। যেমন একবার তাদের বাড়িতে এক ফকির এসেছিল, গলায় লালনীল পাথরের মালা, পুরো শরীর কালো আলখাল্লায় ঢাকা, কালো কাপড়ে মাথা ঢাকা, তাদের উঠোনে নেচে নেচে গান গেয়েছিল। সে রকম কালো কাপড়ের পোশাকে লোকটার গলা পর্যন্ত ঢাকা রয়েছে। স্টেজের মাঝখানে একটা টেবিল। তার চারটে পায়ার সঙ্গে মশারির খুঁটির মত চারটে লাঠি বাঁধা রয়েছে। আবার বাজনা শুরু হলে তালে তালে একটা মেয়ে এসে নাচের ভঙ্গিতে টেবিলের চারপাশে কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিল।

‘ময়নামতী’ পালার রাজকন্যার মত পোশাক ছিল মেয়েটার শরীরে। মুখ খুব সাদা, দু’পাশের গালে লাল আভা, গাঢ় লাল ঠোঁট, চোখের কাজল অনেকটা টানা। ঠোঁট ফাঁক করে সে এমন ভাবে দাঁত বার করে রেখেছে যে, মনে হয় সব সময় নিঃশব্দে হাসছে। মেয়েটার বুকের দিকে তাকাতে তার অস্বস্তি হচ্ছিল। সোনালো জরির কাজকরা খুব ছোট ব্লাউজ পরেছে মেয়েটা। তার বুকদুটো অসম্ভব তীক্ষ্ণ হয়ে বিপজ্জনক ভাবে সামনে ঝুঁকে এসেছে।

হঠাৎ সে টের পেল পাশের লোকটা তার হাত প্রকান্ড থাবার ভেতর টেনে নিয়ে কচলাচ্ছে। চমকে তাকিয়ে দেখল লোকটা মাঙ্কিক্যাপ খুলে ফেলেছে। কাঁচাপাকা কোঁকড়াচুল ভর্তি তার মাথা। পেছন দিকটা ডিমের মত সরু। তার চোখদুটো খুব বড় দেখাচ্ছে এখন। তার দিকে তাকিয়ে হাসল লোকটা। ভক করে কাঁচা রসুনের গন্ধ এল তার নাকে। কালচেখয়েরি ভাবটা এখন আর অতটা নেই, বরং লাল আভা বেশি বোঝা যাচ্ছে। তার হাত নিয়ে লোকটা হাঁটুর ওপর চেপে ধরেছে। আস্তে আস্তে আরও ভেতরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। স্টেজে মেয়েটা ঘুরে ঘুরে নাচের ভঙ্গিতে বেরিয়ে যাচ্ছে। তার ভারি পেছন আর বিপজ্জনক-ভাবে-সামনে-ঝুঁকে-আসা-বুকদুটো দুলে উঠছিল। অনেকে জোরে শিস দিল। আস্তে আস্তে মিউজিক থেমে আসছিল। লোকটা তার হাত ছেড়ে দিল।

মিউজিক শুরু হল আবার। সে দেখল পেছনের পর্দাও কালো হওয়ার জন্য চেয়ারাবসা লোকটার কালো আলখাল্লা প্রায় বোঝাই যায় না। মনে হয় তার মাথাটা হাওয়ায় ভেসে আছে। তার মুখ ছাঁচের মুখ মনে হয়। ভালো করে লক্ষ করে সে বুঝল তার চোখের পলকও পড়ছে না। এক দৃষ্টিতে একটু ওপর দিকে তাকিয়ে আছে।

একই তালে নাচের ভঙ্গিতে আর একটা লোক স্টেজে ঢুকল। তার কালো কোট, কালো প্যান্ট, সাদা জামা, লাল টাই। লোকটা একটু বেঁটে। তার ঠোঁটদুটো খুব উজ্জ্বল। মনে হয় চকচকে কিছু মেখেছে। মেয়েদের মত কাজল আছে তার চোখে – একটু লক্ষ করলেই বোঝা যায়।

লোকটা স্টেজে ঢুকলে, সবাই স্পষ্ট দেখল, কালো আলখাল্লাপরা লোকটার শরীর একটু কেঁপে উঠল। কিন্তু তার মুখটা একই রকম, ভয়ের কোনও চিহ্ন নেই, পলকহীন চোখে সামান্য ওপরে কিছু দেখছিল যেন। কোটপরা লোকটা এসে চেয়ারের পেছনে দাঁড়ালে তার মনে হল এবার নিশ্চয় সাংঘাতিক কিছু ঘটবে। খুব চুপচাপ ছিল সবাই। শুধু অস্পষ্ট ভট্‌ভট্‌ শব্দ শোনা যাচ্ছিল। কোটপরা লোকটা এবার চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে আলখাল্লা পরা লোকটার ঘাড় টিপতে লাগল। তখন মিউজিক খুব জোরে হচ্ছিল।

পৃথিবীর আচজ্জ ঘটনা। মরামানুষ কথা বলে। বন্ধুগণ, আপনেরা যারা টিকিট কেটে আজ এখেনে সমবেত হয়েছেন, তাদের জানাই জাদুকর তন্ত্রসম্রাট অঘোর সাঁপুই-এর প্রণাম, প্রীতি, নমস্কার ও ভালোবাসা।

ভালোবাসা

সরু গলায় কেউ বলল। কালো আলখাল্লাপরা লোকটার মুন্ডু একটু নড়লে মনে হল ভালোবাসার কথা সেই বলেছে। কিন্তু এ তো কোনও আশ্চর্য ঘটনা নয়। লোকটা মরামানুষ নয়, রীতিমত নড়াচড়া করছে, ভালোবাসার কথা বলতেই পারে।

এই যে আপনেরা দেখছেন আমার সামনে কেমন ভালোমানুষের মত মোহান্ত দাস বসে আছে। এখেনে যদি কেউ থানার স্টাফ থাকেন, ওকে গ্রেপ্তার করুন। আমি ওর হাতপা ভালো করে বেঁধে রেখেছি। আইন আইনের পথে চলবে। হায় বনলতা, আজ তুমি কোথায়। ফিরে এসো বনলতা ... আ

আ – এই টান বেহালার সুরের সঙ্গে আশ্চর্য ভাবে মিশে যায়। ফলে, মনে হয় যেন এই চিকন সুর স্টেজের বাইরের বাতাসে ভেসে যাচ্ছে। অঘোরজাদুকর তার বাঁ হাত রেখেছে মোহান্তর ঘাড়ে, ডানহাত ছড়িয়ে দিয়েছে পাখির ডানার মত। বেহালা প্রায় শোনা যাচ্ছিল না, কিন্তু সূর্য ডুবে গেলে যেমন চাঁদ তার আলোটুকু ধরে রাখে, জাদুকরের ডুবেযাওয়া আকুল শব্দ ধরে রেখেছিল বেহালার চিকন সুর।

আজ আপনেরা দেখবেন মৃতমানুষ কী ভাবে কথা বলে। কাটামুন্ডুর কথা আপনেরা নিজের কানে শুনবেন। মৃতমানুষের সঙ্গে ইচ্ছে করলে কথাও বলতে পারেন। পৃথিবীর আচজ্জ ঘটনা। আপনেদের মনে হতে পারে আমিই হয়তো কোনও কারসাজি করেছি, সাহসী কেউ এসে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। ইহা ব্লাড, মানে অর্জিনাল রক্ত। মোহান্ত, তুমি কি ভয় পাচ্ছ ?

না। ভালোবাসা। মোহান্তর মাথাটা একটু নড়ল। তার গলার আওয়াজ বেশ নরম, অনেকটা মেয়েদের মত। কিন্তু কী যেন একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার আছে তার আওয়াজে।

ওর কাঁধের ওপর এই মাথা আর থাকবে না। কিন্তু ওর মাথা আলাদা হয়ে গেলেও আজ আমি ওকে দিয়ে কথা বলাব। আপনেরা পয়সা দিয়ে টিকিট কেটেছেন। আপনেরাও কথা বলবেন। জিজ্ঞেস করবেন – ক’টা বাজে ? জিজ্ঞেস করবেন – মোহান্ত, বল দেখি তিন সতেরং কত ? কাটামুন্ডু উত্তর দেবে। এখেনে কেউ থানার স্টাফ থাকলে হাত তুলুন। ওকে আপনের হাতে তুলে দেব। আপনেরা হয়তো ভয় পাচ্ছেন, হয়তো ভাবছেন মোহান্ত কী এমন অন্যায় করেছে যে ওকে আমি চরম শাস্তি দিচ্ছি। আজ সব বলব। হায় বনলতা। আচজ্জ ঘটনা।

সেখানে কোনও থানার স্টাফ ছিল না। স ট ফ নিয়ে সে দু’একবার নাড়াচাড়া করেই দেখল চেয়ারেবসা মোহান্ত দাস শরীরে মোচড় দিচ্ছে। কিন্তু, নিশ্চয় হাতপা বাঁধা আছে বলেই খুলে বেরিয়ে আসতে পারছে না। পুলিশের কথা শুনে নিশ্চয় ভয় পেয়েছে, পালিয়ে যেতে চাইছে।

মোহান্ত দাস একজন জঘন্য দাগি অপরাধী। আজ আমি সব খুলে বলব। আমার সর্বনাশ করেছে এই মোহান্ত। ফিরে এসো বনলতা।

বেহালা খুব চড়া এবং করুণ সুরে বাজছিল। সবাই বুঝতে পারছিল সম্ভবত বনলতা আর নেই। সে হয়তো পৃথিবী থেকেই হারিয়ে গেছে। জাদুকর অঘোর পকেট থেকে লালরুমাল বার করে চোখ মুছল।

থানার স্টাফ থাকলে আমি আজ নিজহস্তে এই শয়তানকে শাস্তি দিতাম না। আইন আইনের পথে চলত। শুনুন সমবেত ভদ্রমহোদয়গণ, এই বন্দীর আসল নাম চিং চুং। তিব্বত থেকে কালিম্পং হয়ে আমাদের গ্রামে এসেছিল সুগন্ধী কস্তুরী বিক্কিরি করতে। তারপর রোজ লুকিয়ে আমার বাড়িতে গিয়ে আমার ফেমিলি, মানে বনলতাকে বরফের গল্প বলত। কস্তুরীর লোভ দেখাত। চিং চুং অনেক গুপ্ত মন্ত্রতন্ত্র জানে। সম্ভবত সে চমরিগোরুর লেজের চুলের সঙ্গে জাফরান মিশিয়ে গোপনে বনলতাকে খাইয়ে দিয়েছিল। আমি শুনেছি বনলতা রোজ দশবার করে পুকুরে গিয়ে স্নান করত। বডির হিটে গায়ে কিছু রাখতে পারত না।

একদিন বাড়ি ফিরে দেখলাম বনলতাকে নিয়ে এই চিং চুং পালিয়ে গেছে। তারপর আমি তিব্বত, সিকিম, নেপাল, ভুটান, চন্দননগর, ময়নাগুড়ি – সব দেশ, সমস্ত বনজঙ্গল তন্নতন্ন করে খুঁজে শেষ পর্যন্ত নিউদিল্লির এক কবরখানা থেকে ওকে ধরে এনেছি। কিন্তু সে কিছুতেই স্বীকার করতে চাইছে না আমার বউকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। আপনেরা দেখুন কেমন ভালোমানুষের মত মুখ করে ওপরে তাকিয়ে আছে। ভোল পালটে ফেলেছে। আগে লম্বা মোচ ছিল, অল্প দাড়ি। এখন নাম রেখেছে মোহান্ত দাস।

সারি সারি বেঞ্চে বসেথাকা লোকজন অনেকেই ফিসফাস করছিল। কেউ একজন একটু জোরে হাসল। ঘাসের ওপর ত্রিপল পেতে দেওয়া হয়েছে। তার ওপর বেঞ্চ সাজানো। মাটি সব জায়গায় সমান না হওয়ার জন্য কতগুলো বেঞ্চ কেউ একজন ঝুঁকলেই ঢক্‌ করে সরে যাচ্ছিল। তারা বারে বারে বিচিত্র উপায়ে কমিটির সর্বনাশ করছিল এবং বেঞ্চের চারটে পা যাতে এক তলে থাকে, তার চেষ্টা করছিল। মনে হয় এখন ঠান্ডা একটু বেশি টের পাচ্ছে সবাই। যারা চাদর খুলে রেখেছিল, আবার গায়ে দিয়েছে। সে দেখল তার পাশের লোকটা আবার মাঙ্কিক্যাপ পরেছে, কিন্তু পুরোটা নয়, শুধু মাথা ঢেকে রেখেছে। তার বাঁ দিকের চটের পর্দা মাঝে মাঝে বাতাসে সরে যাচ্ছিল। ঠান্ডা বাতাস আসছিল ওদিক থেকে।

মোহান্ত, তুই তো আসলে চিং চুং। বল, আমার সুন্দরী স্ত্রীকে হরণ করে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস ? বল, সে কোথায় ?

চিং চুং-এর ঘাড়ে হাত রেখেছে জাদুকর অঘোর সাঁপুই। জাদুকর নিচু হলে তার লাল টাই-এর মাথা একবার চিং চুং-এর হলুদ মুখে পড়লে তার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। তার কপাল, মুখে সে একবার হালকা করে হাত বুলিয়ে নিল। ইচ্ছে করছিল খ্যাসখ্যাস করে চুলকে নিতে। লাল টাই-এর তীরের মত মাথাটা চিং চুং–এর মুখোশের মত মুখের ওপর আলতো ভাবে স্পর্শ করে যাচ্ছে। হ্যাঁচ্চো – হাঁচিটা সামলাতে পারল না সে। বাঁ হাতের উলটো পিঠ দিয়ে নাক মুছে পাশের লোকটাকে দেখল একবার।

ভালোবাসা। মাথা নড়ল চিং চুং-এর। নরম আওয়াজ শুনল সবাই।

তোকে মিত্যুদন্ড দিলাম। সাক্ষী এই পাবলিক, সাক্ষী ওই আলো, সাক্ষী এই টেবিল। মিত্যু। ধুম করে ঢোলের আওয়াজ হলে সবাই নড়েচড়ে বসল।

ও মণি, ভয় করছে না তো ?

সে প্রথমে বুঝতে পারেনি পাশের লোকটা তাকেই বলছে। আবার ‘ও খোকা’ বললে তাকিয়ে দেখল লোকটা তার সঙ্গে একদম ঘেঁষে বসেছে। একটু সরে বসল সে। কী রকম যেন অস্বস্তি হচ্ছিল তার। কথা বললেই কাঁচা রসুনের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে।

বেশ ঠান্ডা। শুধু একটা হাফ-সোয়েটার পরেছ। একটা চাদর গায়ে দিলে ভালো করতে। ফেরার সময় আমার বাড়ি হয়ে যেও, একটা চাদর দিয়ে দেব। যাওয়ার পথে গরম জিলেপিও নেব। হাঁচি হচ্ছে, আমার চাদর দেব নাকি ? এক কাজ করলে হয়, আমার কোলে বসতে পারো। ছেলেমানুষ, লজ্জা কীসের।

সে নাক দিয়ে পেচ্ছাপের গন্ধটা খুঁজছিল। কোনও চেনা গন্ধ। লোকটার কথার উত্তর না দিয়ে সে চেষ্টা করছিল শরীরটা সামনে পেছনে দুলিয়ে বেঞ্চটার উঁচুনিচু খেলাটা খেলতে। কিন্তু তাদের বেঞ্চটা একদম ঠিকঠাক বসে যাওয়ার ফলে মাটিতে ঠুকঠাক হচ্ছিল না। কেউ বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকায়নি। পেচ্ছাপের গন্ধ পাচ্ছিল না। বরং এক রকম রাবারের গন্ধ আসছিল নাকে। সেই গন্ধেও একটা পোড়া ঝাঁঝ রয়েছে। পাশের লোকটাকে তার ভালো লাগছিল না। এ লোকটার শরীর থেকেই রাবারপোড়া গন্ধ আসছে কিনা, তার সন্দেহ হচ্ছিল। ইচ্ছে করছে অন্য কোথাও গিয়ে বসতে, কিন্তু কোথাও আর জায়গা খালি নেই। তাকে এখানেই বসে থাকতে হবে।

মৃতমানুষ কথা বলে – স্কুল থেকে ফেরার পথে ওরা শুনতে পেয়েছিল। ভুটিয়া সঙ্গে ছিল। তখনই তারা এ বিষয়ে আলোচনা করেছিল যে, নিশ্চয় এর ভেতরে কোনও কারসাজি আছে। কারসাজির ওপরেই ভুটু জোর দিচ্ছিল। যে কোনও বিষয়েই সন্দেহ করার বাতিক আছে ভুটুর। ভালো করে দেখেশুনে, চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্তে আসে। সে কিন্তু দোনামনা করছিল। পৃথিবীতে অনেক আশ্চর্য কান্ডও তো ঘটে। তাদের গ্রামে হয়তো সব খবর ঠিক মত পৌঁছয় না। তার মাঝেও তো শোনা যায় পতিতপাবন মন্ডলের জমি ফুঁড়ে শিবলিঙ্গের ঊঠে আসার কথা। বাতাসিনদীর ওপারে একটা গাছ আছে, ছুরি দিয়ে সেটার বাকল চেঁছে দিলে টপটপ করে রক্ত পড়ে। আঠাআঠা রক্ত। সরস্বতীপুজোর আগে নারকোলি কুল খেয়ে জগা আর নিমে ফেল করল কিনা। তার বাবা আর মায়ের ধারণা ঠাম্মার মাথায় গোলমাল আছে। উল্টোপাল্টা কথা বলে। কিন্তু ঠাম্মা তো মাঝে মাঝে বলে যে, রাতে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে সেই সাহেবটা তাদের বার-উঠোনের সজনেতলা দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে যাচ্ছে। কোনও কোনও রাতে নাকি ঘোড়া থামিয়ে ঠাম্মাকে ‘কামান বেবি’ বলে ডাক দেয়। সে সব রাতে ঠাম্মা বিছানায় হিসি করে ফেলে। সকালে মা কাঁথা, তোষক, চাদর, সব নিয়ে রোদে মেলে দেয়।

কাইল রাইতেও হারামিটা আবার আইয়া আমারে ডাক দিছে। বুঝলা বউ, হালায় আমার পিছা ছাড়ব না। মরণকালেও আমার চিতার পাশে কালাঘুড়ার পিঠে বইস্যা থাকব। শান্তিতে মরতেও দিব না লুচ্চাটা।

বলুন যে উঠে বাইরে যেতে আলিস্যি লাগছিল। যত সব আজেবাজে কথা। খবরদার, তাতুর কাছে এসব গল্প করবেন না। চাঁদে মানুষ চলে গেল, আর আপনি এখনও উঠোনে ঘোড়ায়চড়া সাহেব দেখছেন।

কী কইলা ? কেডায় কুনহানে গ্যাছে ? চান্দের কথা কী শুনলাম ?

আপনার ছেলেই তো কাল কাজ থেকে ফিরে বলল। বড়স্কুলে পাইপ বসাতে গিয়ে শুনে এসেছে। নিল আর্মস্ট্রং নামে একজন আমেরিকার সাহেব রকেটে করে চাঁদে গেছে।

তখনই বনোরে কইছিলাম আমাগো স্বজাতি, পালটিঘর না হইলে বিয়া করিস না। কুন চান্দের কথা কও তুমি ? আমাগো মাথার উপরে যেইটিরে দেখি ? হঃ, তুমি কইলেই আমি বিশ্বাস যামু ? বনো কইতে পারে, সেইটি অন্য চান্দের কথা। আমার জন্মেরও কত আগের থিক্যা চান্দ উঠতাছে, নামতাছে। মাইনষের কি নুম্বার মত পাখও গজাইছে নাকি যে, ডানা মেইলা দিল, আর ভুস্‌ কইরা চান্দে গিয়া পড়ল। তখনই কইছিলাম টাউনের মায়্যা, কটাচক্ষু – বনো রে, সাবধান। হইল কিনা। কাগো বাড়ির নিলু চান্দে গ্যাছে, আর উনি কাপড় তুইল্যা নাচতে লাগছেন। কেডায় কইল কীসের বাই, আনন্দের আর সীমা নাই। আর আমি কালা ঘুড়ার উপর সাহেবের কথা কইলেই ব্যাবাকটি মিলা আমারে পাগল বানায়।

ঠিক আছে মা, ঠিক আছে। সেটা অন্য চাঁদ। কিন্তু আবার যদি আপনি বিছানা নষ্ট করেন, আমি আর টানতে পারব না। ভেজা বিছানাতেই থাকতে হবে।

কী করুম বউ, ভয় করে। যদি ডাক পাড়ে, যদি আবার টাফি দিবার চায়। অখন তো আর দৌড় দিয়ে পাটখ্যাতের পিছনে যাবার পারুম না। ভয় করে। যদি আবার বেবিকামান কইয়া ঘুড়ায় চড়তে কয়। শুইনা রাখঅ, চন্দ্র হইল গিয়া দ্যাবতা। ঠাকুর কি শুধু কালী, দুর্গা, মনসা, শীতলা ? সূর্যচন্দ্র, নদীসাগর, পাহাড়পর্বতও দ্যাবতা। তাগো নিয়া তামাশা কইরো না।

ঠাম্মা স্পষ্ট শুনতে পায় – কামান বেবি। বিজুদির মায়ের গালের মত কালো কালো ছোপওয়ালা গোল চাঁদে মানুষ পৌঁছে যায়। মৃতমানুষ কথা বলতেও পারে।



জয়সিংহ। জাদুকর জয়সিংহ বলে ডাক দিলে সমস্ত মিউজিক একসঙ্গে বেজে উঠল। রাবারপোড়া গন্ধটা এখন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। ‘ময়নামতী’ পালার রাজকন্যার মত মেয়েটা আবার স্টেজে এসে দাঁড়িয়েছে। সে দু’হাত দিয়ে একটা থালা ধরে রেখেছে। থালার ওপরে একটা ঝকঝকে খাঁড়া। মাকালীর হাতে যেমন খড়্গ থাকে। আর একটা জবাফুলের মালা। তারপর যেমন সব মিউজিক একসঙ্গে বেজে উঠেছিল, তেমনই একসঙ্গে সব থেমে গেল। পর্দার আড়াল থেকে খুব লম্বাচওড়া একটা লোক পা টিপে টিপে স্টেজে ঢুকছে। তখন শুধু ঢুম্‌ ঢুম্‌ করে একটা ঢোল বাজছিল। লোকটার শরীরে লালধুতি, লালফতুয়া, ঘাড় পর্যন্ত কালো বাবড়ি চুল। কপালে লম্বাকরে টানা লালতিলক। গলায় জবাফুলের মালা। জাদুকর অঘোর থালা থেকে মালা নিয়ে চিং চুং-এর গলায় পরিয়ে দিল। কালো আলখাল্লাঢাকা তার শরীর একটু নড়ে উঠল, কিন্তু হলদে আভার ছাঁচের মত মুখ একই রকম। চোখ পলকহীন।

এই যে আপনেরা দেখছেন আমার সামনে চিং চুং ওরফে মোহান্ত দাস বসে আছে। এখনই দেখবেন কী ভাবে চিং চুং-এর কাটামুন্ড কথা বলবে। পৃথিবীর আচজ্জ ঘটনা। মৃতমানুষের সঙ্গে ইচ্ছে করলে আপনেরাও কথা বলতে পারেন। শুধু একটাই অনুরোধ, আপনেদের ভিতরে যাদের হার্ড উইক, মানে চিত্ত দুর্বল, তারা চোখ বন্ধ রাখবেন। না হলে কমিটি দায়ী থাকবে না। চিং চুং, তুমি কি ভয় পাচ্ছ ?

না, ভালোবাসা। তার মাথাটা একটু নড়ল।

বন্ধুগণ, জয়সিংহ এক কোপে এই শয়তানের মুন্ডু উড়িয়ে দেবে। জয়সিংহ আগরতলার লোক। অনেক মহিষ বলি দিয়েছে। চিং চুং ওর কাছে নস্যি। তারপর আচজ্জ ঘটনা, সেই ছিন্নমুন্ডু আপনেদের সামনে কথা বলবে। আপনেরা ওকে জিজ্ঞেস করবেন এটা কী মাস, মাদারের ফুল কী রং-এর হয়, আজাদ হিন্দ ফৌজ কে গঠন করেছিল – সব উত্তর দেবে। আচজ্জ ঘটনা।

জয়সিংহ মাথার ওপর খড়্গ তুলে ধরেছে। জাদুকর চিং চুং-এর ঘাড়ের নীচে হাত রেখে নিশ্চয় খুব জোরে চাপ দিচ্ছে। তার ঘাড় নিচু হয়ে ঝুলে আছে। প্রচন্ড জোরে মিউজিক হচ্ছিল।

স্টেজের ওপর শুকনো পাতা উড়ছে ঘুর্ণি হাওয়ায়। ভেসে-বেড়ানো সাদা বালির ওপর আলো পড়েছে। চিকচিক করছে সেগুলো। ঘুর্ণির কেন্দ্রে কালো আলখাল্লাপরা একটা মানুষ, যার মুখ যেন ছাঁচেঢালা মুখোসের মত, পলকহীন তাকিয়ে থাকে ওপরের দিকে। সে মাটি আঁকড়ে থাকতে চাইছে। কিন্তু একটা জোর বাতাস এসে তাকে এখন শূন্যে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। একটা ভোকাট্টা ঘুড়ির মত সে ভেসে যাবে অনেক দূরে। গরম বাতাসের ভেতর ভেঙেচুরে যাচ্ছে কালো কোট, লাল টাই, ঝকঝকে খাঁড়া, জবাফুলের মালা। এমন কী ময়নামতীর মত মেয়েটার উঁচু উঁচু বুকদুটো পর্যন্ত বেঁকেচুরে যাচ্ছে। কোথাও কোনও পেচ্ছাপের ঝাঁঝালো গন্ধ নেই। পোড়া রাবারের গন্ধও নয়।

বেঞ্চে বসেই ডাইনে বাঁয়ে দুলছিল সে। দুলতে দুলতে তার শরীরে সরল দোলনগতি তৈরি হচ্ছিল। এই গতি সে কন্ট্রোল করতে পারছিল না। বেহালা ও ফ্লুটের তীক্ষ্ণ আওয়াজ, ঢোলের গম্ভীর ধুম্‌ধুম্‌ মনে হয় গরম বাতাসের ঘুর্ণি থেকেই তৈরি হচ্ছিল। পোড়া রেড়ির তেলের গন্ধে বাতাস ভারি।

স্টাফ – সে বলল। বাতাসে পোড়া রেড়ির তেলের গন্ধই রয়েছে। সে বলল – ব্লাড, ছিন্নমুন্ডু, সোয়ামি, সুমুন্দির পুত। পোড়া তেলের গন্ধ রয়ে গেল। সে বলল – বারোভাতারি, শেষে বলল – আজাধিন্দফোজ। তবু কালো আলখাল্লার চারপাশে গরম হাওয়া পাক দিয়ে উঠছে। নিঃশ্বাসে সামান্য কষ্ট হচ্ছিল তার।

জাদুকর অঘোর চিং চুং-এর কাটা মুন্ড নিয়ে পাশের কালোকাপড়ে ঢাকা টেবিলে রেখেছে। লাল তরল, রক্তের মত – ছিটকে উঠেছিল মোহান্ত দাসের গলা থেকে। আলখাল্লাঢাকা তার বডিটা জয়সিংহ আর উঁচুবুক-মেয়েটা ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে গেল।

আচজ্জ ঘটনা। হ্যাঁ, এই যে আপনে আসুন। অর্জিনাল ব্লাড কিনা পরীক্ষা করে দেখুন।

শব্দগুলো কি তাহলে শুধু নির্জনে জেগে ওঠে। বাতাস যখন নদীর পারে গরম হয়ে ওপর দিকে উঠে যায়, সঙ্গে নিয়ে যায় ছেঁড়া কাগজ, শুকনো পাতা, ধুলো; যখন মনে হয় কী একটা অজানা রহস্যময় ভার নদীর ওপর, দিগন্তজোড়া মাঠের ওপর ঝুঁকে আছে; কোঁচবক বা গুয়েশালিখ থাকে না কোথাও, পাষাণের মত নীরবতা তাকে যেন খেয়ে ফেলতে চায় – তখন, শুধু তখন তার শরীরে রক্তের সঙ্গে মিশেথাকা নতুন শব্দ, তার কাছে অর্থহীন, অদ্ভুত উচ্চারণের শব্দগুলো জেগে ওঠে নাকি। যেন আবার শব্দের পৃথিবীতে, পাখপাখালির চলমান সংসারে ফিরিয়ে আনবে বলে দম-বন্ধ-হয়ে-যাওয়া ঘুর্ণির বাইরে এনে স্বাভাবিক বাতাসের জগতে তাকে ফিরিয়ে দেয় বারোভাতারি, মিনস্‌, হারামখোর। ধক্‌ধক্‌ করে শব্দগুলো বাজে। কে জানে কাকে বলে বারোভাতারি, কাকে বলে মিনস্‌। বিজুদির মিনস্‌ ঠিকমত হয় না – সে আড়াল থেকে শুনেছিল। মিনস্‌ -- এই শব্দ কী যে ভালো লাগে। পাগল শামসুল শুধু জানে কাকে বলে হারামখোর। ম্যাজিক দেখায় শব্দগুলো। সে যা চায়, তাই হয়। ধুলোর-ঝড়-ওঠা বাতাসি নদীর পারে, কিংবা সন্ধ্যারাতে সে যখন স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়ে রঘুমামার আকাশপ্রদীপ দেখতে পায় – কার্তিকমাসের রাতে ঠান্ডা হাওয়ায় এরোপ্লেন বা লালনীল তারা দুলে ওঠে, তখন ভয় করে। হাওয়ায় যদি প্রদীপ নিভে যায়। শব্দগুলো তখন কালো ঘোড়ার পিঠে চেপে আসে। ‘কামান বেবি’ বলে তাকে ডাক দিয়েই ঘোড়া ছুটিয়ে দেয়। সেই ডাক তার নাকচোখমুখ দিয়ে শরীরে ঢুকে পড়ে। তার কাছে অর্থহীন, অথচ উচ্চারণের সময় দাঁতের ব্যথার মত সুখ, চেপে ধরলে ব্যথায় চোখ দিয়ে জল গড়ায়, অথচ আরাম – শব্দগুলো কদমচালে ভেঙে দেয় নিস্তব্ধ পৃথিবী। ভেঙেযাওয়া ঘরবাড়ি, গাছপালা আবার ফিরে আসে। হলুদপাখি ডেকে ওঠে কোথাও। নেতাজির আদেশে স্তব্ধ ডেঁয়োপিঁপড়ের সারি এবং আকাশের মেঘ আবার চলতে শুরু করে। রঘুমামাই তো শিখিয়েছিল – নেতাজির আদেশ বাঁ হাত ওপরে তোলো, নেতাজির আদেশ স্ট্যাচু। রঘুমামা এমনভাবে ‘স্ট্যাচু’ বলত যেন শব্দটা পালিয়ে যাবে। ঝপ্‌ করে পলো ফেলত রঘুমামা।

কাপড়ঘেরা টেবিলের বা দিকে চিং চুং-এর ছিন্নশির সাজানো রয়েছে। তার হলদে মুখের ডানদিকটা দেখা যাচ্ছে। ঠিক তার মুখোমুখি বসে আছে জাদুকর অঘোর সাঁপুই। এখন শুধু ফ্লুটে একটা চেনা-চেনা গানের সুর শোনা যাচ্ছে। জাদুকর তার হাতে কাটামুন্ডু তুলে নিল।

বন্ধুগণ, আপনেরা এইমাত্র নিজের চোখে দেখলেন জয়সিংহের এক কোপে কী ভাবে চিং চুং ওরফে মোহান্ত দাসের মাথা আলাদা হয়ে গেল। এই যে ছিন্নশির, আপনেদের কসম, আমার মায়ের কসম, এই ছিন্নশির এখন কথা বলবে। চিং চুং, বল আমার বনলতাকে তুই কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস।

সব মিউজিক বন্ধ হয়ে গেছে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছে সবাই। কাটামুন্ডুর কথা শোনার জন্য সবাই অপেক্ষা করছিল।

ভালোবাসা বনলতা জাফরান কস্তুরি

একটু খ্যাসখেসে, মেয়েদের মত সরু গলায় এই শব্দগুলো সবাই স্পষ্ট শুনতে পেল। সবাই হাততালি দিলে জাদুকর সামনে তার মাথা নিচু করল। তখন লাল টাই নীচে ঝুলে পড়ল। দুলছিল।

আচজ্জ ঘটনা। মৃতমানুষ কথা বলে। চিং চুং, সত্যি করে বল। এখেনে সবাই ভদ্রব্যক্তি, লজ্জা না করে স্বীকার কর তুই বনলতার সর্বনাশ করেছিস। তুই তার সতীত্বনাশ করেছিস। এখেনে সবাই সজ্জন। বল, তুই কেমন করে আমার বনলতাকে বিছানায় নিয়ে গেলি। সব খুলে বলবি, কিচ্ছু বাদ দিবি না।

বনলতা ভালো।

জাদুকর ভুরু কুঁচকে মুখোশের মত হলুদ মুখের দিকে তাকাল। গলার টাই-এর গিঁটটা একবার নাড়াচাড়া করল। দর্শকদের দু’ একজন শব্দ করে হাই তুলল। তারা অন্য কিছু শুনবে বলে আশা করেছিল। একজন চটের পর্দার পাশে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছে। ওপরে ফাঁক দিকে বাইরের কোনও উজ্জ্বল আলোর রেখা অনেকের চোখে পড়লে তারা বিড়িওয়ালাকে বলল পর্দা বন্ধ করে দিতে। বিড়ির ধোঁয়ার জন্য আলো রেখা বল্লমের মত দেখাচ্ছিল।

তিন সতেরং কত ?

বনলতা ভালো। জাফ্‌রান। দর্শকদের কয়েকজন হেসে ঊঠল। স্পষ্টই শুনল সে।

আজ কত তারিখ ? এটা কী মাস চলছে, বল ?

নিল আর্মস্ট্রং কামানবেবি

সবাই নিশ্চয় দেখতে পাচ্ছে জাদুকর কেমন উশখুশ করছে। সে যা শুনতে চাইছে, শোনাতে চাইছে, চিং চুং-এর কাটামুন্ডু সে কথার উত্তর না দিয়ে অন্য কথা বলছে। মৃত মোহান্ত দাসের মুখোশের মত হলুদ মুখ, পলকহীন চোখ আজ জাদুকরের কথা শুনতে চাইছে না। নামতা বলতে চায় না, মাস এবং তারিখ বলতে পারছে না। সে শুনতে পাচ্ছিল দর্শকদের ভেতরে মৃদু গুঞ্জন হচ্ছে। কাটা মাথা যেন চাইছে না আজ কোনও লক্ষ্মীকান্তবাবু জাদুকরের গলায় মেডেল পরিয়ে দিক। সে তার নিজের ইচ্ছে মত কথা বলবে আজ।

গরম বাতাস ঘুরে বেড়াচ্ছে স্টেজের ওপর। মাঙ্কিক্যাপ, চাদর, মাফলারের ভেতর দিয়ে পাক খেয়ে খেয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে হাওয়া। সব উড়ে যাচ্ছে। ক্রমশ শূন্য হতে থাকে মৃতমানুষের কথা বলার আসর। নির্জন হতে থাকলে তার শরীরের ভেতর থেকে রক্তের সঙ্গে মিশেযাওয়া কিছু শব্দ বেরিয়ে আসে।

চিং চুং, বনলতার সঙ্গে তুই যে সব অসভ্য আজ করেছিস, সবাইকে জোরে জোরে শুনিয়ে দে। আমি জানি তুই বনলতার সতীত্বনাশ করেছিস। প্রথমে কী করলি ? বল না, বল। এই যে সবাই টিকিট কেটে বসে আছে তোর কথা শুনবে বলে। ফাঁকা ঘরে ... কস্তুরীর লোভ দেখিয়ে ... প্রথমে শাড়ি খুলে ফেললি ...

হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই কথা হোক। দর্শকদের ভেতর থেকে কেউ বলল। সিটি বাজালো একজন।

হ্যাঁ, বনলতার সঙ্গে আমি সব করেছি। তীক্ষ্ণ কিন্‌কিনে স্বরে কথা বলছিল ছিন্নশির। মানুষের স্বাভাবিক আওয়াজ নয়, এক রকম ধাতব তীক্ষ্ণতা ছিল তার গলায়।

বনলতাকে আমি রোজ পাহাড়ি আপেলের মত কামড়ে, চমরি গোরুর জমাট দুধ দিয়ে তৈরি সুরপির মত চুষে ... না, কস্তুরী মিথ্যে, জাফরান মিথ্যে, ভালোবাসা।

এই ভালোবাসার কথা সে প্রথম শুনেছিল ভুটুর কাছে। ভুটুর একটা পায়ের পাতা ঘোরানোর জন্য জুতো পরতে পারত না। এ বাবদ তার গভীর দুঃখ ছিল। ভুটুর ক্লাস এইট, কিন্তু তাতুর ক্লাস সিক্স হলেও ওরা দু’জন খুব বন্ধু ছিল। তাতু তাকে কোনও দিন ল্যাংড়াভুটিয়া বলেনি। তাছাড়া, পাটের দর কোনও বছর আশাজনক হচ্ছিল না। ফলে তার পায়ের অপারেশন ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছিল। স্কুলের স্পোর্টস্‌-এ রানে নাম দেবার ব্যাপারে ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়ছিল ভুটু।

তার ডান পা খুঁতো হলেও বাঁ পায়ের গড়ন ছিল অত্যন্ত চমৎকার। শালবল্লীর মত পোক্ত। দুটো হাত এবং বুকের খাঁচা ছিল মাদুর্গার পায়ের কাছে অসুরের মত। তার হাতার ভেতর দাঁড়িয়ে কেউ তাকে ল্যাংড়া বলতে সাহস পেত না। কোনও কারণে ঝগড়া হলে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে বলত – শালা ল্যাংড়ার বাচ্চা। তখন সে অশ্রাব্য এবং বিচিত্র সব গালাগালি দিত। তর বুইন রে বলে শুরু করে তার বংশের অনেক ওপরে এবং নীচের আত্মীয়স্বজনদের সর্বনাশ করে ছাড়ত। খ্যা খ্যা করে হাসত সবাই। কারণ, পরিচিত গালাগালির ভান্ডার শেষ হয়ে গেলে ভুটু নিজেই আশ্চর্য সব গালাগালি তৈরি করে নিতে পারত। তার ঠোঁটের দু’পাশের কশে সাদা ফেনা জমে উঠত। সে বলত – তর মায়রে দাড়িয়াবান্ধা। তর গুষ্টিরে করঞ্জাই। তার ধারণা ছিল ‘করঞ্জাই’ চূড়ান্ত খারাপ কথা।

কালীপুজোর আগের দিন সে আর ভুটু বাতাসির ওপারে গিয়েছিল। এপারের বাঁধবরাবর কিছু শিমুল আর অনেক বড় বড় ছাতিমগাছ। নদীতে তখন হাঁটুজল। ওরা নদীর ওপারে গিয়ে অনেকটা বালুচর পেরিয়েছিল। বালির ওপর ভুটিয়ার দেড়খানা করে পায়ের ছাপ পড়ছিল। তার মনে পড়ল ভুটুকে ল্যাংড়া ছাড়া দেড়িয়া নামেও অনেক সময় ডাকা হয়।

বালুচর পার হয়ে আরও এগিয়ে গেলে প্রচুর পলাশগাছ। মাঝে মাঝে বাঁদরলাঠি আর উঁচু উঁচু শিমুলগাছ। ভুটু তাকে প্ররোচিত করেছিল। বলেছিল একটা আশ্চর্য জিনিস দেখাবে। পরে বলেছিল একটা নয়, লাক ভালো থাকলে দু’টো।



বিকেল গড়িয়ে সূর্য যখন পশ্চিমে আরও একটু ঢলে হলদে হতে শুরু করেছে, তখন ওরা একটা ঘনসবুজ পাতাওয়ালা পলাশগাছের নীচে বসল। চর পার হওয়ার সময় ওরা প্রচুর পাকা বুনোকুল জোগাড় করেছিল। তখন ভুটু তাকে কেন যেন কুলগুলো খেতে বারণ করেছিল। এখন গাছের নীচে বসার পর ভুটু পকেট থেকে একটা কাগজের পুরিয়া বার করল।

ল, বাড়ির থিক্যা রেডি কইরা আনছি। তার দিকে পুরিয়াটা ছুঁড়ে দিল ভুটু।

কী আনছিস ? সে ভেবেছিল ভুটু হয়তো বাড়ি থেকে কোনও নিষিদ্ধ জিনিস লুকিয়ে এনেছে। পুরিয়া খুলতে তার একটু ভয় করছিল।

নুন আর মরিচ বাইট্যা নিজের হাতে মশলা বানাইছি। তাতু, তুই সাইকেল চালাইতে পারস ?

চেষ্টা করলে পারব। পাব কোথায় ? রঘুমামার নতুন সাইকেলে কেউ হাতই ছোঁয়াতে পারে না। কাদাটাদা লাগলে দু’একদিন আমাকে ন্যাকড়া দিয়ে মুছতে দিয়েছে। স্পোক, রিং, হ্যান্ডেল, মাটগাট। রোদ্দুর পড়লে চোখ ধাঁধিয়ে যায়।

কার্তিক মাসের শেষ। বিকেল খুব তাড়াতাড়ি মরে আসছিল। ভুটু হঠাৎ তার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরল। তারপর, সে খুব আশ্চর্য হয়ে দেখল যে গাছের নীচে ওরা বসে ছিল, সেটাতেই ভুটু তার একটা খুঁতো পা নিয়েই হাঁচোড়পাচোড় করে উঠে পড়ল। তাকেও ইশারা করল উঠে পড়তে। ঘন সবুজপাতার আড়ালে সেও লুকিয়ে পড়ল। তখন তার কানে এল অনেকগুলো মেয়ে কথা বলতে বলতে এদিকেই আসছে।

একদল কাঠকুড়োনি মেয়ে। বাদামি রুক্ষ চুল, কালো কালো হাতপা। সেই গাছের নীচে এসেই ওরা দাঁড়াল। মাথা থেকে শুকনো কাঠকুটোর বোঝা নামিয়ে সন্ধেবেলার পাখিদের মত খুব কিচিরমিচির করছিল ওরা। সবেই একসঙ্গে কথা বলছে। কী বলছে, কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। দশবারোজন ছিল ওদের দলে। দু’জন করে সামনেপেছনে বসে বাদামি রুক্ষ চুল থেকে উকুন বার করে টিস্‌ টিস্‌ করে মারছিল।

ওদের ভেতর দুটো মেয়ে শাড়ি পরেছে। অন্যদের ছেঁড়া, নোংরা জামা। ধুলো-ধুলো রং-এর শাড়িপরা যে মেয়েটা মাথা সামনে নামিয়ে পেছনে চুলের গোছা খুলে দিয়েছে, সে তার শাড়ি হাঁটুর ওপর তুলে পা দুটো ছড়িয়ে বসেছে। তার পেছনে হাঁটুমুড়ে বসে যে মেয়েটা তার ভাঙা খোঁপার ভেতর থেকে উকুন কিংবা উকুনের ডিম খুঁজে মারছিল, তার পরণে ছিল গামছার মত চৌখুপি নক্‌শার লাল শাড়ি।

একটু পরেই শাড়িপরা মেয়েদুটো উঠে দাঁড়ালে ভুটু তাকে আস্তে চিমটি কাটল। সে বুঝতে না পেরে ভুটুর দিকে তাকালে ভুটু হাসিহাসি মুখে তাকে কী যে ইশারা করল, সে বুঝতেই পারল না। ভুটু আর সে গিরগিটির মত ডালের সঙ্গে লেপ্‌টে রয়েছে। পাতার ফাঁক দিয়ে সে দেখতে পেয়েছিল হাঁটু পর্যন্ত শাড়িগোটানো মেয়েটার বাদামি থাই-এর ওপর শুকনো ক্ষতচিহ্ন। হালকা বাদামি চামড়ার ওপর ঘন খয়েরি গোল একটা বৃত্ত। তার শরীর কেমন যেন শিরশির করে উঠেছিল।

গাছের বাঁ দিকে জলসিঙাড়ার পুকুর। মেয়েদুটো শাড়ি খুলে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে পুকুরে সাঁতার কাটছিল। কচুরিপানা সরিয়ে ডুব দিচ্ছে, ভুস করে পানকৌড়ির মত দূরে গিয়ে মাথা তুলছে। ভুটু একবার ভুরু নাচিয়ে তার দিকে তাকাল, তারপর যেন বিশ্বসংসার ভুলে গেল।

কিন্তু সে প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিল। গাছের তলায় মেয়েরা উকুন বাছাবাছি শেষ করে এক রকম টানা সুরে গান গাইছিল। এই গানের সুর তার চেনাচেনা মনে হয়, কিন্তু স্পষ্ট মনে করতে পারছিল না। ঠাম্মার মত নয়, ওরা সবাই মিলে অন্য রকম ঘুমপাড়ানি গান গাইছিল। নিশীথে ফুলঅমালা দিলাম চান্দের গলে রে, সকালে চান্দ নাই, আমার ভালোবাসার চান্দ রে ...

ভুটু আবার হাত বাড়িয়ে তাকে চিমটি দিলে তার ঘোর ভাঙল। ভুটুর চোখের ইশারায় তাকিয়ে দেখল স্নান সেরে মেয়েদুটো জল ছেড়ে উঠে আসছে। ওদের ভেজা চুল থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। ভেজা শরীরের ওপর পশ্চিমের কমলা আলো এসে পড়েছে। মনে হচ্ছিল মান্নাবাবুদের বাড়ির পুজোর জন্য কুমোর দুটো প্রতিমা গড়ে পুকুরপাড়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। রং হয়ে গেছে। এর পর শাড়ি পরাবে, শোলার সাজ হবে, হাতে অস্ত্র দেবে। ওদের আর জঙ্গলে জঙ্গলে কাঠ কুড়িয়ে বেড়াতে হবে না। ওদের মাথার সব উকুন মরে যাবে। ঠাকুরদেবতার মাথায় কি আর উকুন থাকতে পারে।

কাঠকুড়োনি মেয়েদের দলটা চলে যাওয়ার পরও, চান্দ রে – টানা, বিষাদময় এই সুর পলাশবনের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। ওরা গানটা রেখে গিয়েছিল।

লাক ভালো থাকলে তাকে আরও একটা জিনিস দেখাতে চেয়েছিল ভুটু। সেটাও সেদিন ওরা দেখতে পেয়েছিল। বাঁধের পার ধরে সন্ধেবেলার আলো-আঁধারে ফেরার পথে আবারও ভুটু তাকে ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ করতে ইশারা করেছিল। দেড়খানা পায়ে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তাকে টেনে একটা মোটা ছাতিমগাছের আড়ালে নিয়ে গিয়েছিল।

অস্পষ্ট অন্ধকারে সে চিনতে পেরেছিল মান্নাবাবুর ছোটছেলে কমলদার সাইকেলের সামনে বিজুদি বসে আছে। এটা বিজুদি ঠিক করেনি। মনে মনে সে ভাবল। বাঁধের রাস্তা ভীষণ উঁচুনিচু। নদীবাঁধের পাথর এখানে সেখানে পড়ে আছে। অন্ধকারে দেখা যাবে না। দু’জন মিলে যদি পড়ে যায়। নিশ্চয় কারও হাত কিংবা পা ভাঙবে।

বুজছস, কী বুজলি ?

কী আবার বুঝব। পড়লে ওরাই বুঝবে।

আরে কমলদার লগে তো বিজুদির আছে।

আছে মানে ? কী আছে ?

তুই না সত্যই একটা রামবুদাই। কমলদা বিজুদিরে ভালোবাসে। সক্কলে জানে। আমি আরও একটা জিনিস দেখছি। তুই মাকালীর কিরা কাটলে কমু। হেবি।

ভালোবাসে, তো কী হয়েছে ?

আরে গান্ডু, ভাইবুইনের মত নাকি ? অরা তো প্রেম করে। মান্নাবাবু রাজি হইলেই অরা বিয়া করব। তখন আর লুকাইয়া দেখা করন লাগব না। বিছানায় ... বুজ্জস নি ?

তুই শুধু এসব দেখার তালে ঘুরে বেড়াস, তাই না ?

হ, পলো নিয়া। পাটখ্যাতে, বাঁশবাগানে, পুকুরপারে। আমার চক্ষুতে দুইখান পলো আছে। খপ ধইর‍্যা ফেলি। কেমুন জানি ন্যাশা লাগে। থাকতে পারি না।

তার মনে পড়ল ফেরার সময় নদীর পারে একটা বড় পাথরের ওপর অনেকক্ষণ বসে ছিল ভুটু। ডানপায়ের বাঁকানো গোড়ালিটা সে নদীর জলে ডুবিয়ে রেখেছিল। টলটলে জলের স্রোত তার খুঁতো গোড়ালির ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল। মানুষ যেমন ব্যথা পেলে ঠান্ডা জল ঢালে, যেমন মচকে গেলে গরম চুনহলুদ লাগায়, সেঁকতাপ দেয় – ভুটুও তেমন তার গোড়ালির ওপর দিয়ে বাতাসির জলের ধারাকে বয়ে যেতে দিচ্ছিল। কিন্তু এ তো হঠাৎ ব্যথা পাওয়া নয়, তার তো জন্ম থেকেই দেড়খানা পা। সে হয়তো ভেবেছে সব নদীই তো আসলে মা গঙ্গা। কিংবা হয়তো এতটা হাঁটাহাটি করে সত্যি ব্যথা করছিল। ঠান্ডা জলে আরাম লাগছিল তার।

তাহলে, ভাইবোনের, বন্ধুদের, মাবাবাছেলেমেয়েদের, ঠাম্মার ভালোবাসা ছাড়াও আর এক রকম ভালোবাসা হয়। তখন তারা সাইকেলে চড়ে লুকিয়ে বেড়াতে যায়। পরে তাদের বিয়ে হয়। যদি কোনও কারণে তাদের বিয়ে না হয়, তখন কি সেই ভালোবাসা নষ্ট হয়ে যায় ? ঠিক বুঝতে পারছিল না সে।

চল ভুটু, অন্ধকার হয়ে গেছে।

খাড়া, আরাম লাগতাছে। ঠান্ডা জলটা আমার পায়ের পাতাটা ঘিরা পাক খায়। শরিলটা কেমুন জানি করে। মনে হয় মায়ের প্যাটের থিক্যা পড়ার পর আমারে যদি এই নদীর জলে একবার চুবান দিত, তাইলে এই গোড়ালিটা সবার মত সোজা হইত। রানে আমার লগে কেউ পারত না।

মনে হচ্ছিল ভুটু একা একা নিজের সঙ্গে কথা বলছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর ভুটু উঠে দাঁড়াল। তারপর এপারে আসার পর বাঁধের রাস্তায় ওরা দেখেছিল কমলদার সাইকেলের সামনে বিজুদি। ভালোবাসার কথা বলেছিল ভুটু। অন্য রকম ভালোবাসা। তখন নিশ্চয় রোজ লুকিয়ে দেখা করতে ইচ্ছে করে। কাছাকাছি বসে গল্প করতে ইচ্ছে করে। মনে পড়ল কাঠকুড়োনিদের গানেও ভালোবাসার কথা ছিল। আমার ভালোবাসার চান্দ রে।



তো সেবার দেওয়ানসাহেবের মেলায় মৃতমানুষের কথা বলা শুনতে গিয়ে সে নিজেই প্রায় মরতে বসেছিল। স্টেজের ওপর হাতে একটা হলুদ রং-এর মুখ নিয়ে জাদুকর তাকে দিয়ে কথা বলাচ্ছিল। অবিশ্যি এর ভেতরে কারসাজি আছে – আগেই তাকে বলেছিল তার পাশেবসা মাঙ্কিক্যাপপরা লোকটা। কিন্তু জাদুকর কাটামুন্ডুকে দিয়ে খারাপ কথা বলাতে চাইছিল। বানিয়ে বানিয়ে একটা মিথ্যে গল্প জাদুকর সবাইকে শোনাচ্ছিল।

আস্তে আস্তে তার কেমন যেন ঘোর লাগতে শুরু করেছিল। গরম ঘুর্ণিবাতাস পাক খাচ্ছে স্টেজের ওপর। মিথ্যে গল্পটা সত্যি গল্প হয়ে যাচ্ছিল। কালো আলখাল্লাপরা লোকটা বরফের গল্প জানে। সুপ্‌রি মানে চমরিগোরুর জমানো দুধ। কে জানে, কাকে বলে কস্তুরী। কী সুন্দর শব্দ এই কস্তুরী। লোকটা কস্তুরী উপহার দিতে চেয়েছিল বনলতাকে। চিং চুং নিশ্চয় বনলতাকে খুব ভালোবাসত।

ঘুর্ণিবাতাস প্রবল হয়ে উঠছিল। দমবন্ধ হয়ে আসছিল তার। চটের পর্দার আড়ালে আলোর বল্লম নিয়ে কালো ঘোড়ার পিঠে কেউ দাঁড়িয়েছিল। এই দৃশ্য থেকে বেরিয়ে সে ঝাঁঝালো কোনও গন্ধ খুঁজে মরছিল। ফিসফিস করে কিছু বলছিল। হয়তো হলুদ পাখির ডাক শুনতে পেয়েছিল। ভেঙে দিতে চেয়েছিল জাদুকরের কৌশলী আসর।

ক্রমে বাতাস আরও কমে গেলে সে শুনতে পাচ্ছিল জাদুকর ছিন্নমুন্ডের মত একটা পলকহীন হলুদ মুখোশের মুখ দিয়ে তার বউ আর জীবিতমানুষ চিং চুং-এর অসভ্য কাজের কথা বলাতে চাইছে। কিন্তু সে চাইছিল ওই মুখ ভালোবাসার কথা বলুক।

পাশের লোকটার কোলের ওপর ধপ করে পড়ে গিয়েছিল সে। সেখান থেকে গড়িয়ে নীচে পড়ে যাচ্ছিল। লোকজন ধরাধরি করে বাইরে এনে তার চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিয়েছিল। গরম দুধ খাওয়ানোর প্রস্তাব ওঠে এবং জুতো শোঁকানো হয়। এক মিনিট বাদেই সে চোখ খুলে উঠে বসেছিল। সবাই বুঝতে পেরেছিল বাচ্চা ছেলে, ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে।

ঠান্ডা জলের ঝাপটা লাগতেই তার ঘোর ভেঙে গিয়েছিল। চোখ মেলে চেয়ে দেখেছিল মেলার লোকজন, চেনাজানা শব্দসমূহ, আলো আর অনেক বাতাস। জাদুকরের খেলার কথা মনে পড়তেই সে ঊঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করেছিল।

ও খোকা, ও মণি দাঁড়াও। একা যেও না।

পেছনে তাকিয়ে সে দেখল মাঙ্কিক্যাপ, কালচেখয়েরি মাড়ির সেই লোকটা তার দিকে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসছে। সে দৌড়তে শুরু করেছিল।

ও খোকা, হারিয়ে যাবে। দাঁড়াও, গরম জিলেপি খাবে না।

সে কাচের চুড়ির গলি, তেলেভাজা, দাঁ,বঁটি, ইঁদুরের কলের দোকান, ফুঁ-দিয়ে ফোলানো হলুদ হাতি, পাথরের থালাবাটির গলি পার হয়ে দৌড়চ্ছিল। তার পেছনে মুখে কাঁচা রসুনের তীব্র গন্ধ নিয়ে যে লোকটা ছুটে আসছে, সে তাকে গরম জিলেপি খাওয়াতে চায়। বাড়িতে নিয়ে গরম পোশাক দিতে চায়। সে জানে তারপর লোকটা তার মুন্ডু কেটে তাকে দিয়ে খারাপ কথা বলাবে। প্রাণপণে দৌড়চ্ছিল সে।

আলোঝলমল মেলার মাঠ পার হয়ে খোলামেলা জায়গায় পৌঁছে সে পেছন ফিরে তাকাল। না, কেউ তার পেছনে ছুটে আসছে না। নিশ্চিন্ত হয়ে দাঁড়াল, হাঁপাচ্ছিল সে। আশপাশে তাকিয়ে দেখল এখানেও ছোট ছোট ঝুপড়ির মত ঘর রয়েছে, কিন্তু মেলার মাঠের মত অত উজ্জ্বল আলোর বাহার নেই। টিমটিমে আলো জ্বলছে এখানে ওখানে। একটা দুটো পানসিগারেটের দোকান, তেলেভাজার দোকান রয়েছে। খুব জল তেষ্টা পাচ্ছিল। ভাবল সামনের দোকানে গিয়ে এক গ্লাস জল চাইবে।

মেলার মাঠে কোথাও অন্ধকার ছিল না। কিন্তু এখানে, মেলার মাঠ থেকে সামান্য দূরে টুকরো টুকরো আলো, টুকরো টুকরো অন্ধকার ছড়িয়ে ছিল। একটু বিশ্রাম নেবার পর সে টের পেল এখন বেশ শীত করছে। চোখেমুখে জলের ঝাপটা দেবার পর জ্ঞান ফিরেছিল তার। মুখচোখ, ঘাড়ের কাছে, জামাসোয়েটারের কিছুটা এখনও ভেজা রয়েছে। সেজন্যই বোধহয় শীত করছে। জ্ঞান ফেরার পর উঠে বসেই তার সব মনে পড়েছিল। সঙ্গে সঙ্গেই সে চেয়েছিল মেলার মাঠ ছেড়ে দূরে, নির্জনে কোথাও চলে যেতে। তার ঘাড়ের ওপর রসুনের গন্ধজড়ানো নিঃশ্বাস, বাঘের থাবার মত একটা হাত, কালচেখয়েরি মাড়ি নিয়ে একটা লোক ছুটে আসছে। তখন সে শীত বুঝতে পারেনি।

দোকানের সামনে গিয়ে দেখল সামনে একটা বেঞ্চ পাতা রয়েছে। বেঞ্চের ওপর তিনটে ঝুড়ি। ঝুড়ি ভেতরে চপ, বেগুনি আর পেঁয়াজি। দোকানের ভেতরে একপাশে উনুন জ্বলছে। কড়াই-এ গরম তেল। ঝাঁজরিহাতা দিয়ে একজন গরম পেঁয়াজি ভেজে ঝুড়িতে রাখছে। লোকটার ঠোঁটের এক পাশে জ্বলন্ত বিড়ি। কপালে খুব বড় টিপ, চুড়োখোঁপা চুল, লালশাড়িপরা একটা বউ কাগজে মুড়ে ভেতরে বেঞ্চেবসা লোকদের হাতে সেগুলো দিয়ে আসছে। ভেতরের লোকগুলো খুব জোরে জোরে কথা বলছিল। হঠাৎ শুনলে মনে হয় খুব ঝগড়া হচ্ছে বুঝি, কিন্তু মাঝে মাঝেই হাসি শুনলে বোঝা যায় মজার কোনও গল্প হচ্ছে।

অ্যাই, এখানে কী চাই তোর ? বউটা তাকে দেখেই বিচ্ছিরিভাবে জিজ্ঞেস করল। ভেতরের লোকগুলো চুপ করে গেল। একজন উঁকি মেরে তাকে দেখল।

জল খাব এক গ্লাস।

জল খাওয়ার আর জায়গা নেই। দাঁড়া, ওখানেই দাঁড়া।

নারানি, দেখেশুনে দিস। ভুল করে খোকাবাবুকে গরমজল দিস না আবার। ধক সামলাতে পারবে না।

নারানির জলে আর আগের মত ধক নেই। নারানিরও বয়েস হচ্ছে, ওর জলেরও ধক কমে যাচ্ছে। এদিকে রেট বেড়েই যাচ্ছে। সামনেও মারছে, পেছনেও মারছে।

সবাই একসঙ্গে হেসে উঠল। উনুনের পাশের লোকটা দু’আঙুলে বিড়ির গোড়াটা চেপে ধরে খুব জোরে একটা টান দিল। তারপর সামনে ছুঁড়ে ফেলল। হক্ক হক্ক করে অনেক বার কাশল। একদলা কফ পাশের কাঁচা নর্দমায় নির্ভুল ভাবে ফেলল। সে তাকিয়ে দেখল বিড়িটা নিভে গেছে। কিন্তু লোকগুলোর কথা সে কিছুই বুঝতে পারছিল না।

তো যা না হারামি, যেখানে কচিদোকানি আছে, সেখানে গিয়ে ঝেড়ে আয়। আমার ঘরের মেয়েগুলোর জন্য চাদরে মুখ ঢেকে আসিস কেন। সেখানে গিয়ে গিলে আয়। তারপর হাসপাতালে গিয়ে মর। বেইমান। এই তোর জল খাওয়া হয়নি ? হা করে কী শুনছিস ?

খোকাবাবু, এবার তাহলে বাড়ির দিকে হাঁটো। এখানে বায়ু একটু ওপরে ঘুরছে। আরেট্টু লম্বা হও, তখন এসো। নারানিমাসি তোমাকে কোলে তুলে কত কিছু খেতে দেবে।

জলের গ্লাস নামিয়ে রওনা হতেই সে শুনতে পেয়েছিল ওরা সবাই মিলে খুব হাসছে। তখনই সে শুনতে পেল দোকানের পেছনে খুব জোরে চিৎকার করে একটা মেয়ে কিছু বলছে। ধুপধাপ পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। কারা যেন দৌড়ে আসছে এদিকে।

সে দেখতে পেল একটু দূর থেকে একটা লোক দৌড়ে এসে কাঁচা নর্দমার ওপর পড়ে গেল। তার পেছনে একটা মেয়ে, এই বউটার মতই চুড়োখোঁপা চুল, কিন্তু শুধু ব্লাউজ আর শায়া পরা – লোকটার সামনে এসে জামার কলার খামচে ধরল।

শালা চুতিয়া, বার কর টাকা।

দোকানের ভেতর থেকে একটা লোক বেরিয়ে এল। ঝাঁকড়া চুল, মোচ আছে। সবুজ লুঙি। এই শীতেও গায়ে শুধু একটা জামা। খাকি রং-এর জামায় পুলিশের মত পকেটে ঢাকনা আছে। অল্প আলোতেও বোঝা যায় চোখের মণির রং বেড়ালের মত সবজেটে।

এই আরতি, ঝামেলা করছিস কেন ?

কিসমতভাই, গত সপ্তাহে একটা ছেঁড়া দশটাকার নোট দিয়ে গেছে। ভাবছে আমি বুঝতে পারিনি। হারামিটা ফির আমার ঘরেই ঢুকেছে। এত টেনেছে, শোয়া তো দূরের কথা, কথাই বলতে পারছে না। কেলিয়ে পড়ছে। স্বীকার করতে চাইছে না। আবার হিন্দি মারাচ্ছে। বলছে – নেহি দেগা।

তুই ঘরে যা। ও রকম হয়। পদ্মর ঘরে থানার যে লোকটা মাঝে মাঝে আসে, এক পেগ খেয়েই ইংরেজি বলে।

কোন লোকটা ? হাসলে কালচে মাড়ি বেরিয়ে পড়ে ? আমার ঘরে একদিন বসেছিল। বাবা, মুখে এমন পেঁয়াজরসুনের গন্ধ। আর কী উল্টোপাল্টা শখ। ডবল টাকা দিতে চেয়েছিল। আমি রাজি হইনি।

হুঁ, থানার স্টাফ। খুশি করতে পারলে তোরই লাভ হত। তুই ঘরে যা। এ হারামিটাকে আমি দেখছি।

কিসমতভাই নামের লোকটা নর্দমার ওপর বসেপড়া লোকটার চুলের মুঠি ধরে টেনে দাঁড় করাল। দিগেন, এক বালতি ঠান্ডা জল আন তো – বললে, যে লোকটা ঝাঁঝরিহাতা দিয়ে পেঁয়াজি ভাজছিল, সে উঠে এল। ছোট একটা জলভরা বালতি এনে রাখল কিসমতভাই-এর সামনে। হড়হড় করে এক বালতি ঠান্ডা জল লোকটার মাথায় ঢেলে দিল কিসমতভাই।

কাঁপছে লোকটা। থরথর করে কেঁপে উঠছে। কিসমতভাই লোকটার পেটে একটা লাথি মারলে ‘মা গো’ বলে লোকটা কঁকিয়ে উঠল। সে এই শব্দ চিনতে পারল। তার মা যখন বাথরুমের ভেতরে বাবাকে আটকে রাখে, বা কখনও ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাবাকে ঘরে ঢোকায়, তখন সে এ রকম কান্না শুনেছে।

একটু দূর থেকে সে এই দৃশ্য দেখেছিল। অল্প আলোয় শব্দ এবং দৃশ্যগুলো খুব স্পষ্ট ছিল না। কথাগুলো শুনতে পেলেও মানুষজনের চেহারা সামান্য ঝাপসা দেখাচ্ছিল। ‘মা গো’ বলে লোকটা শুয়ে পড়তে চাইলেও তাকে চুল ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল কিসমতভাই।

আরও স্পষ্ট করে দেখবে বলে একটু এগিয়ে সে দেখল তার বাবার দুটো পা নর্দমায় কাদায় ডুবে থাকলেও শরীরটা সোজা রয়েছে। দুটো হাত পেটচাপা, শরীরটা বেঁকে যেতে চাইলেও চুলে টান থাকায় পারছে না।

সে চিৎকার করে, অনেকটা কান্নার মত, কিছুটা সতর্কীকরণের ভঙ্গিতে ‘বাবা’ বলে ডাক দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সে বোকার মত বলে ফেলেছিল – আচজ্জ ঘটনা।*


লেখক পরিচিতি
বিপুল দাস

জন্ম ১৯৫০ সাল, শিলিগুড়ি।

পেশা : শিক্ষকতা। 
গল্পগ্রন্থ : শঙ্খপুরীর রাজকন্যা
উপন্যাস : সরমার সন্ততি, লাল বল। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ