শাহাব আহমেদের গল্প - পেদ্রো পারামো’র পৃথিবী




“Your lips are wet with dews, Susana”

অর্নব তখনও পেদ্রো পারামো পড়েনি, ওর মগজের কোন কুঠুরিতেই সুসানা নামে কোন নারীর অস্তিত্ব ছিলো না। অথচ যখন এলেনাকে সে প্রথম দেখে, তার ঠোঁটগুলোর দিকে তাকিয়ে অর্নবের ঠিক এমনটাই মনে হয়েছিল।

"তোমার ঠোঁটগুলো কি শিশির দিয়ে ধোয়া?"

সে ফিক করে হেসে ফেলেঃ “মেয়েদের সাথে কি তুমি এভাবেই কথা শুরু কর?”

“না, সব সময় নয়, মাঝে মাঝে।”

“আজ খুব ইচ্ছে হল, তাই তো?”

“হ্যাঁ, তোমার ঠোঁটগুলো দেখে মাথায় কী যে হলো, মনে হলো, একটু কি চেখে দেখা যায়?”

“বাব্বা, শুধু দেখেই সন্তুষ্ট নয়! আমার ঠোঁটের ঝাল সইতে পারবে?”

পারবোনা মানে- ইস্সিও কাক্!

রুশ ভাষায় কোন কিছু খুব ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পারার আত্মবিশ্বাসী বড়াই ওই শব্দগুলো ব্যবহার করেই করা হয়।

“তুমি দেখি মস্ত হুলিগান”

স্থান বিশেষে ওদের ভাষায় হুলিগান শব্দটা ঢোরা সাপের মত নির্বিষ দুষ্ট বোঝাতেও ব্যবহার করা হয়।

“১৮ বছরের নীচে কোন মেয়েকে স্পর্শ করলে বাবা-মা পুলিশে দিতে পারে, জানো?”

“নাতো! চলো তাহলে বাবা-মা’র থেকে একটু দূরেই যাই।”

সে হি হি করে হাসে।

প্যাথোফিজিওলজির শিক্ষক ও অর্নবের পিএইচডি থিসিসের মেন্টর ইভান ফিওদরোভিচের ৫০তম জন্মদিনে এলেনার সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল। অর্নব ল্যাবেই মগ্ন হয়ে কাজ করে, নারী নয়, গিনিপিগ ছিল তার গবেষণার প্রাণি।কিভাবে দিন গড়িয়ে রাত হয়ে যেতো টের পেত না।শরত গিয়ে শীত, শীত গিয়ে বসন্তও পার হয়ে যেতো ব্যতিক্রমহীন। কিন্তু কখনও কখনও তার বাসায় ফোন করতে হতো।এলেনা ফোন ধরেছে বহুবার।ওর কণ্ঠ মিষ্টি ও কথা বলায় স্থৈর্য রয়েছে।তাই কণ্ঠটি প্রথম দিনই মনে গেথে গিয়েছিল অর্নবের। যদিও কথা কখনই হয়নি, ইথারের অন্যপ্রান্তে কে, তা সহজেই চিনতে পারত। সে ছিল একাচোরা গোছের।কাজ শেষ হয়ে গেলে, রাত নেমে এলে বা আকাশে চাঁদ দেখা দিলে কোন মেয়ে যে কল্পনায় উঁকি মারতো না, তা নয়, কিন্তু মেয়েদের সামনে গেলে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যেত। গিনিপিগই ছিল তার সবচেয়ে আপনজন। ওদের সাথেই কথা বলত মন খুলে।

ইভান ফিওদরোভিচের জন্মদিনে অনেক খাদ্য ছিল, পানীয়ও ছিল পর্যাপ্ত। এলেনার মা ছিল সুন্দর এবং বয়সে ওর বাবার চেয়ে অনেক কম, হয়তো মধ্য তিরিশের সীমারেখায়।সে ব্যালে নাচতো। দেহে এমন একটা কম্রতা ছিল যে, তাকে এলেনার বড় বোনের চেয়ে বড় কিছু মনে হতো না।যদিও এলেনার বড় বা ছোট কোন ভাই-বোন ছিলোনা। যে নারীকে এই বয়সেও এত আকর্ষণীয় লাগে, তার ১৭ বছরের মেয়ে আগুনের মত হবে এটাই স্বাভাবিক।

গানবাজনা নাচ ও হৈ হুল্লোর চলছিল বেশ। সবাই ব্যস্ত।

এলেনাও হাসছিল খিলখিল ও নাচছিল দ্রুত। অনুষ্ঠানে সে ছিল সবচেয়ে ছোটদের একজন, প্রাণবন্ত ও গ্লাডিওলাস ফুলের পাপড়ির মত সতেজ ও সুন্দর।

তুমি পান করেছ?

বয়েস ১৭,পান করা নিষেধ, জানোনা বুঝি? রহস্যময় হাসি ওর মুখে।

জানি, কিন্তু তুমি পান করেছো ?

প্রশ্নটা সে চোখ দিয়ে ওর হালকা ফিরোজা চোখে গেথে দেয় দৃষ্টি না সড়িয়ে।

ওর চোখদুটি যেন দুটো শ্যাম্পেনের গ্লাস!

সে চোখ না সড়িয়ে বলে, একটু কম্পত, তার সাথে ওয়াক থু..একটু..ভ...

তারপরে বাঁধভাঙা হাসির প্লাবন।

ফলের পাতলা পাতলা শুকনা স্লাইস জলে সিদ্ধ করে তার সাথে চিনি মিশিয়ে যে ড্রিন্ক তৈরি করা হয়, তাকে বলা হয় কম্পত। গ্লাসে ঢেলে পান করা হয়, গ্লাসের তলায় জমে থাকে শুকনো সিদ্ধ ফলের টুকরাগুলো। কম্পত পান করার পরে সেগুলোও খাওয়া যায়। খুবই সুস্বাদু।এলেনা সেই কম্পতে কিছুটা ভদকা মিশিয়েছিল। ভদকা রাশিয়ান মেয়েদের ড্রিন্কস নয়, শিশুদের তো নয়ই।এবার অর্নব হো হো করে হেসে উঠে, এলেনা হাসে আরও জোরে। ক্লাসিক কোনো গানের আবহে মন্থর যুগল নাচের সময় সে বলেছিল, বাবা বলে, তুমি নাকি খুব মেধাবি।

তাই নাকি, তুমি কি বল?

যে প্রথম পরিচয়েই মেয়েদের ঠোঁটের বর্ণনা দেয় সে মেধাবি কিনা জানিনা, তবে খুব রোমান্টিক।

চাইলে কল্পনা করে আমি তোমার বুকের বর্ণনাও দিতে পারি.. চট করে বলে ফেলে। মুখে কিছুই থামেনা, চিরকালের ভীতু সে যেন নিজেকেই চিনতে পারেনা।টের পায় ভদকা তারও মগছে সিঁদ কেটেছে। এলেনার মুখে এক ঝলক আবির ছড়িয়ে পড়ে গোধূলির পশ্চিম আকাশের রংয়ের মত।

বিশ্বাসই হয়না ওর বয়েস ১৭। হলফ করে বলা যায় দেখতে সে ছিল ১৭র বেশি। একহারা সাইপ্রেস শরীর অথচ বুকের স্ফুটনে কটাল। উজ্জ্বল আফিম মাখা চোখ। উন্মুক্ত সংক্ষিপ্ত চুল উড়ে এসে কখনও কখনও গাল মুখ ঢেকে দিয়ে যেন এক আলো-আঁধারি অনুভূতির জন্ম দেয়।


নেচে ক্লান্তি আসে।

বলে, চল বাইরে হাওয়া খেয়ে আসি। এবং ওরা হাওয়া খেতে যায়। মে মাস শেষ হয়ে এসেছে। অবশিষ্ট রাতগুলোর কোনো একটি। মে মাসের রাত বড় সুন্দর হয়। ফুলে ফুলে ভরা থাকে শহর। নানান রংয়ের লাইলাক ফোটে এবং তার ঘ্রাণ ওড়ে ফেরোমনে মাখামাখি করে।সে রাতে শীত ছিলনা বলা চলে। হাওয়া ছিল ফুরফুরে। পাতলা বুকখোলা সোয়েটারে ঢাকাছিল ওর পিঠ আর কাঁধ। হাল্কা মেঠো ফুলের ছাপার সান্ধ্য ড্রেসের নীচটা উড়ছিল কপোতির পাখার মত। খুব অপ্রত্যাশিত ভাবেই অস্বাভাবিক এক চাঁদের চাকতি ছিল আকাশে।

ওর মুখ, গাল, গলা, ‘ভি’ আকারে উন্মুক্ত বুকের অসম্ভব মসৃন ত্বকে চাঁদের আলো মাখনের মত লাগে। বস্তুত চাঁদ ছিল তারই সৌন্দর্যের সমান্তরাল অথবা সে চাঁদের। কলে আটকা ইঁদুরের মত অর্নবের মধ্যে কিছু একটা তীব্র ইচ্ছা উন্মুক্ত হতে চায় কিন্তু সে খাঁচা খুলতে পারে না।

চল ফিরি, মা-বাবা চিন্তা করবে।

এমন রাত, এমন চাঁদ, এবং এমন যৌবন, আরও কিছুক্ষণ হাওয়া খাওয়া চলে নিঃসন্দেহে, কিন্তু এলেনা দীর্ঘক্ষণ বাইরে থেকে পিতা-মাতার প্রেসার বাড়াতে চায়নি। পান-গান- বাজনা- নাচ তখনও চলছে, তখনও আলো নিভানো এবং ওরা হাওয়া না খেয়ে একে অন্যকে “দো দ্না” পান করে এলেও কারো চোখে পড়তো কিনা সন্দেহ।

জুলাই মাস।ওদের দেশে পরিবর্তন শুরু হয়েছে, আগের কঠোর বিধিনিষেধে শিথিলতা এসেছে। লেনিনগ্রাদ শহরের বাইরে এখন টুকিটাকি যাওয়া যায়। অভাব, অপরাধ, দুর্ভিক্ষের কালো ডাইনীরা তখনও ডানা উন্মুক্ত করেনি। তখনও কেউ জানতো না কী আসছে সামনে। সে অর্নবকে গ্রামে নিয়ে গিয়েছিল। ১৭ ও ১৮র মধ্যবর্তী পরিখা অতিক্রম করে ইতিমধ্যেই সে বৈধভাবে পান করার বয়সে উত্তির্ণ হয়েছে। ছোট্ট রাশিয়ান গ্রীষ্ম কটেজ, ওরা বলে দাচা, বেশ কিছুটা জমি নিয়ে। অনেক শাক-সব্জি ফলেছে এবং সহজেই চোখে পড়ার মত কয়েকটি ফ্লাওয়ার বেডে বিভিন্ন ধরনের অজস্র ফুল ফুটেছে। কারনেশন, পিওনি, হাইড্রানজিয়া, জিনিয়া, কানা ও গ্লাডিওলাস ইত্যাদি কয়েকটি ফুল সে চিনতে পারে, কিন্তু কয়েকটি ফুল তার অচেনা।

কে লাগিয়েছে?

মা, সে ফুল-অন্ত- প্রাণ। বাবাও সাহায্য করে বাগানে। বসন্ত এলে তাদের আর শহরে ধরে রাখা যায়না। মুক্ত হাওয়া ও রৌদ্রের জন্য যেন উন্মুখ হয়ে থাকে সারাটা শীতকাল। শরৎকালেও অনেক সময় এখানে কাটে। অনেক ধরনের আপেল হয়, কিছু পাকতে শুরু করে জুলাই মাসেই, কিছু পাকে শরতে, যখন গাছ লাল করে রাইবিনা পাকে।

কয়েকটি আপেল গাছ নুয়ে আছে ফলে ফলে। টসটসে দুটো আপেল ছিড়ে একটা অর্নবের দিকে এগিয়ে দেয়, এটা “বেলিই নালিভ”, খেয়ে দেখ।

এলেনার গালের মত মসৃন স্কিন, ঘ্রাণ অতুলনীয়, অদ্ভুত সুস্বাদু আপেলটি। রূপার ঝলক দেয়া চিকন চিকন পাতার একটি গাছে পাতা প্রায় ঢেকে ফেলেছে অজস্র পাকা পাকা হলুদ গোটা। একটা মিষ্টি গন্ধে ভরে আছে চারিদিক।

মৌমাছি উড়ছে।

কী গাছ?

অব্লিপিখা। আমার দাদি প্রতিবছর চিনি দিয়ে ‘ভারেনিয়ে’ বানায়।আমরা সারা শীতভরে খাই। কী যে মজা!

ব্যাগ-ট্যাগ ঘরে রেখে বেরিয়ে পড়ে ওরা। এলেনাই টেনে নিয়ে যায় স্তারায়া লাদোগা দুর্গ দেখাতে। একসময় এখানে একটি প্রাচীন শহর ছিল। রাশিয়ার প্রথম রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভাইকিং কিং রিউরিক নরওয়ে থেকে এসে এই মাটিতেই পা রেখেছিল প্রথম। রুশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার সন গণনা করা হয় রিউরিকের আগমণের সন থেকেই। তার মা ছিল রুশ রাজকুমারি।

মাতামহ গস্তামিসল এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিলেন যে,তার মেয়ে উর্মিলার গর্ভ থেকে বট বৃক্ষের মত বিশাল এক মহীরুহ গজিয়ে চারিদিক ঢেকে দিয়েছে।স্বপ্নটির ব্যাখা বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে করে। কিন্তু গস্তামিসল বুঝতে পারেন, একটা অস্বাভাবিক কিছু ঘটবে। মৃত্যুর পূর্বে তিনি গোত্রপ্রধানদের বলে যান, নরওয়ের প্রিন্সের ঔরসে তার মেয়ের যে সন্তান হবে, তাকে যেন সসন্মানে ডেকে আনা হয় রুশ শাসন করার জন্য। পরবর্তীকালে যে বিশাল রুশ সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে তাই ছিল গস্তামিসলের স্বপ্নের মহীরুহ, রিউরিক যার বীজ বপন করেছিল এই শহর থেকে।কিন্তু দীর্ঘদিন রাজ্যশাসন করা তার ভাগ্যে ছিলনা। বিশ্বস্থ সহচর আলেগ রিউরিক বংশের ক্ষমতা শুধু সংহতই করেনি, বরং বিশাল এক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করে। কিয়েভ তার রাজধানী হলেও “স্তারায়া লাদোগা” কয়েক শতাব্দী ধরে হয় পূর্ব ইওরোপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্য কেন্দ্র। বাল্টিক সাগরের বিশাল জাহাজগুলো লাদোগা হ্রদ অতিক্রম করে ভলখভ নদীপথে এখানে এসে পৌঁছাতো। তাদের পোতাশ্রয় ছিল ভলখভ ও লাদোঝকা নদীর সংবেশ। ছোট ছোট জাহাজ যেত ভেলিকি নভগরদ শহরে, তারপরে ইলমেন হ্রদে ভেসে চলে যেত কনস্টান্টিনোপল, কাস্পিয়ান সাগর বা গ্রিসে। বাগদাদের বাজারে ভলখভ নদীপথে আসা পন্যের চাহিদা ছিল প্রচুর এবং উত্তরের দেশ সমূহে বাগদাদের যত দিনার ছিল তার প্রায় সবটাই এসেছে এই পথ দিয়ে।

এলেনা ও অর্নব ঘুরে ঘুরে দেখে। সময়ের দীর্ঘশ্বাস গিলে মোটা হয়ে ওঠা দেয়াল দিয়ে ঘেরা দুর্গের ভেতরে প্রাচীন একটি গির্জা দাঁড়িয়ে আছে।তার দেয়ালে ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে মিলেনিয়া প্রাচীন ফ্রেস্কো; টগবগে ছুটন্ত ধবল অশ্বে সওয়ার সন্ত ‘গিওর্গি দ্যা ভিক্টোরিয়াস’, যিনি অন্যায়কে পরাজিত করার প্রতীক। অন্যায়ের পরাজয় যে সাময়িক তা বোঝার বয়েস না-এলেনা, না-অর্নব কারুরই হয়নি!

ওরা সম্পূর্ণ কাঠ দিয়ে তৈরি আরও একটি প্রাচীন গির্জা ঘুরে দুর্গের অদূরে কালের কুলু কুলু শান্ত বহমান ভলখভ নদী-তীরে একটি উঁচু টিলার সবুজ ঘাসে শুয়ে আছে পাশাপাশি। উপরে আকাশে ত্বরাহীন ছাড়া ছাড়া সাদা মেঘ। পিঠের নীচে ও সারা মাঠ জুড়ে অজস্র সাদা সাদা ঘাসফুল, মাঝে মাঝে কিছু লাল। জুলাই মাসের অপরাহ্ন। রৌদ্রের তাপ কমতে শুরু করেছে। এমনিতেও পোড়ানো গরম এখানে পড়েনা, নদী থেকে বাতাস আসছে মৃদু-মন্দ। চিকন কেয়ার মত ২-৩ ফুট লম্বা কিছু ঘাসের ফুলগুলো দুলছে। দূরে ছোট নৌকায় বসে বড়শি বাইছে কেউ। প্রশস্ত নদীর বুক কাঁপছে।

পাশে আরও কয়েকটি উঁচু টিলা, সবুজের চাদর বিছানো। এরা বলে কুর্গান। এগুলো নাকি প্রাচীন কালের সমাধি স্তম্ভ। খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ মারা গেলে, তার সমাধিতে বিশাল স্তুপ তৈরি করা হতো।

এখানেই কোথাও সমাহিত আছে রিউরিক, অন্য কোনো কুর্গানে তারই বিশ্বস্ত আলেগ। রাশিয়ার জন্মলগ্নের বিপুল ক্ষমতাধর ২ জন মহীরুহ। হয়তো ওদের পিঠের নীচেই শুয়ে আছে কেউ।

তার মানে তুমি আর আমি কবরস্থানে শুয়ে আছি?

হ্যাঁ, পৃথিবীর কোন্ জমিতে কারো না কারো অস্থি নেই, বলতে পারো? আমার শৈশব এখানে কেঁটেছে।এই কুর্গানগুলোতে আমরা ছুটোছুটি করেছি, কানামাছি খেলেছি। আমার কাছে এরচেয়ে সুন্দর জায়গা আর নেই। ওই যে ছোট নদীটি দেখছো, যে ভলখভে এসে পড়েছে, জানো ওই নদীর নাম কি?

এলেনা।

ঠাট্টা করছো?

হাসে, চোখে চিক চিক করে রোদ।

পশ্চিম দিক থেকে আসা পড়ন্ত রোদ, উষ্ণ ও কোমল। ভলখভ যেন অপার্থিব এক নদী।

সাপের খোলসের মত কতগুলো ভরা চাঁদ অপূর্ণ করে গেছে দেহ তারপরে? কত নারীর সৌন্দর্য ক্ষীণ হয়েছে? কতটি ভরাট নদী জল হারিয়ে জীর্ণ হয়ে গেছে? ছোট লাদোঝকা নদীতে একসময় বিশাল বিশাল সমুদ্র জাহাজ থামতো, এখন সেখানে একটা কুকুরেরও পা ভেজেনা। এই নদীটির নাম সত্যিই এলেনা, অর্নব সেদিন বিশ্বাস করেনি।

রুলফোর পেদ্রো পারামো পড়ছে সে। কুয়াশা, শিশির, স্বপ্ন ও মিস্টিসিজমের জগত। বাস্তবের যে জগতে পেদ্রো পারামোর মত দুর্বৃত্তরা অপরাজেয় ও অমর, তার চেয়ে কম কষ্ট, কম অশ্রু সেখানে নেই। এই মাত্র সুসানা মারা গেল, যার ঠোঁটগুলো ছিল শিশির দিয়ে ভেজা।

জানালায় তাকিয়ে আছে সে।

মগজে কল্পনাগুলো ফসিল হয়ে আছে। অথবা বাস্তব হয়েছে কল্পনায় কেলাসিত স্ফটিক। এলেনার সাথে কি তার সত্যিই দেখা হয়েছিল কোনদিন? সত্য ছিল পরিচয়ের প্রথম দিনের ওইসব প্রগলভ সংলাপ? স্তারায়া লাদোগার ফুল ও ফলে পূর্ণ দাচা ও ভলখভ নদীতীরের কুর্গানে শুয়ে আকাশ দেখা? সে ছিল নার্ড, হয়তো এসব কিছুই ঘটেনি তার জীবনে। এমন কি সে কোনদিন এলেনাকে প্রতিশ্রুতি দেয়নি যে, সে ফিরে আসবে, বট-অশথ্থের মত জড়াজড়ি করে হবে তাদের জীবন। হয়তো সবটাই তার কল্পনা, এমনকি যা কল্পনা নয়, তা-ও।

অথচ এলেনার সাথে তার দেখা হয়েছিল। দেখা হয়েছিল অনেক বছর পরে, আমেরিকায়, খুব কাকতালীয়ভাবে। তার বাবা মারা গেছে। সোভিয়েত দেশ ভেঙে গেছে। আগের সেই নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ জীবন আর ছিলনা। চাকরি ছিল দুর্লভ। নিঃস্ব, ক্ষুধার্ত মানুষের ভীড়, দুর্বৃত্ত ও অপরাধের মহামারী, বিশ্বব্যাপী পণ্যের মত রুশ নারীর বেচা-কেনা।

এলেনার সেই সতেজ ভাবটা আর নেই।চোখের নীচে কালি জমেছে। স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পরে ৭ বছরের ছেলেকে মায়ের কাছ রেখে সে ভাগ্যের সন্ধানে ঝাঁপ দিয়েছিল অজানায়। এজেন্সির মাধ্যমে এক মধ্যবয়সী আমেরিকানকে বিয়ে করে চলে এসেছে। ইংরেজি জানে সামান্যই। ড্রাইভিং জানেনা, প্রায় গৃহবন্দী। স্বামী সন্দেহপ্রবণ। ভাষা কোর্সে ইংরেজি শিখতে চেয়েছিল, কিন্ত অনুমতি পায়নি। ড্রাইভিং শিখতে চেয়েছিল, বলা হয়েছে, আমিই তো আছি, তোমার ড্রাইভিং শেখার দরকার কী? তবুও অনুরোধ করেছিল। তুমি তো একটা প্রস্টিটিউট, স্বাধীনতা দিলে উড়ে যাবে না, তার নিশ্চয়তা কী?

এলেনা দেহ বিক্রি করেনি, শুধু সুখী হবার স্বপ্ন দেখেছিল। ছেলেকে স্পন্সর করে আনার অর্থ তার নেই। ওর বয়েস এখন ১২, অভিমানে মায়ের ফোন ধরেনা। স্বামী উটকো ঝামেলা কাঁধে নিতে নারাজ।

আমার ছেলেটাকে স্পন্সর করতে পারবে?

প্লিজ!

যে চোখে আফিম-মাখা উজ্জ্বলতা ছিল একদিন, সেখানে নেড়ি কুকুরের চাহনি!

পেদ্রো পারামোর পৃথিবী!
যেন একটি প্রাচীন গিনিপিগ তাকিয়ে আছে অর্নবের দিকে। তার চোখে চিক্ চিক্ করছে মুক্তাদানা।


------------------
মে ২২, ২০২০



পাদটিকা :

● পেদ্রো পারামো- মেক্সিকোর লেখক হুয়ান রুলফের বিশ্ব বিখ্যাত উপন্যাস, যার মূল চরিত্র পেদ্রো পারামো ছিল তার শহরের সবচেয়ে ক্ষমতাবান, ক্ষমাহীন, নিপীড়ক, ভূমিদস্যু ও অত্যাচারী শোষক।

● ভারেনিয়ে- যেকোন বেরি চিনি দিয়ে জ্বাল দিয়ে এক ধরনের জ্যাম তৈরি করা হয়।

● “দো দ্না”- তলানি পর্যন্ত।

● কম্পত- শুকনো ফল দিয়ে তৈরি পানীয়।

● ইস্সিও কাক্- পারবোনা মানে, অবশ্যই পারবো।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ