কোথায় এক রাণী ছিলেন, প্রত্যহ ব্যাজারমুখে দুইশত মাছের মুড়া রাঁধিতেন, মুড়া ছাড়া রাজা গ্রাস তুলিবেন না, পরলোকগত পিতার হুকুম। তাহার কথা দক্ষিণারঞ্জনবাবু বলিতে পারিবেন। আমাদের রাণী তেমন নহেন। রাজা ভালবাসিয়া খাইবেন শুনিলে রাণী হেন ব্যঞ্জন নাই রাঁধিতে দ্বিধা করিবেন। রাজ্যে বড় সুখ। রাজা রাণীকে চক্ষে হারান।
কুলোকে বলে, তন্ডুলনাস্তি গৃহস্থের কন্যাকে আনিয়া রাজা বিবাহ করিয়াছিলেন, নহিলে রাজগৃহে এমন পতিসেবা কে করিবে। দুষ্টলোকের রটনা এও শোনা যায়, নাকি একদা মৃগয়াক্লান্ত রাজা গভীর বনের প্রান্তে ঋষির আশ্রয়ে আসিয়া দেখিলেন, ভাঙা কুটিরে বসিয়া ঋষির স্ত্রী আকুলনয়নে কাঁদিতেছেন- তাঁহার রূপার কাজললতার মতন চোখ, বাঁধুলিফুলের মতন ঠোঁট, তিলফুলের মতন নাক, পুষ্পমঞ্জরীশোভিত কূচকূম্ভ, রম্ভার মতন উরু, স্থলকমলের মতন পায়ের পাতা। ঋষি তাঁহাকে বলিয়া গিয়াছেন, “এই কুটির হইতে কোথাও যাইও না,” অথচ নিজে বৎসরকাল হয় গিয়াছেন আর ফিরিয়া আসেননাই। রাজা একবেলা সেই পর্ণকুটিরে সামান্য আহার করিলেন। ঋষির মরিচজবা আর শ্বেতদ্রোণফুলের কুঞ্জের আশ্রয়ে শ্রান্ত দেহে ভূমিশয্যা লইলেন। সন্ধ্যা নামিলে অরণ্যের বন্য জন্তুসকল ডাকিয়া উঠিল।রাজার মনে অসূর জাগিয়া উঠিল, সেই অসূর রাজাকে এবং রাজা ঋষিপত্নীকে একই কথা বুঝাইলেন, ঋষি আর আসিবেন না এবং রাজা এই রমণীরত্নকে না পাইলে তাঁহার প্রাণবিয়োগ হইবে। রাজা সেই চকোরলোচনাকে পাতার কুটির হইতে আনিয়া রাজ্যমাঝে প্রতিষ্ঠিত করিলেন- অষ্ট অলংকার পরাইলেন- অগ্নিপাটের শাড়ি পরাইলেন। রাণীর ভূবনমোহিনী রূপ দেখিয়া প্রজাসকল বলিল, এ রাক্ষসী না হইয়া যায় না। রাজকার্য্য মন্ত্রীর হাতে দিয়া রাজা দিবাভাগেও রাণীর মহলে পড়িয়া থাকেন, নিবিড়কুন্তলা রাণীর কুন্তল লইয়া মেঘুয়া খেলিয়া দিন কাটান। রাণীর প্রেম সূর্য্যকন্যা তপতীর প্রেমকেও হার মানায়।
ঋষিপত্নীকে হরণ করিয়া আনিবার সময় রাজা রাজ্যে অমঙ্গল বহিয়া আনিয়াছেন কি না তাহা দেখিবার জন্য প্রজাচিত্ত উৎকর্ণ হইয়া রহিল। সেই বৎসর এবং তাহার পরের বৎসর সীতাশাল- ঝিঙেশাল ধান্যের বান ডাকিল। মকরসংক্রান্তিতে পিঠার ভোগ শেয়ালে খাইয়া শেষ করিতে পারিল না। রাণী রূপতরাসীর মতন রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে উঠিয়া হাতিশালের হাতি খাইলেন না, ঘোড়াশালের ঘোড়া খাইলেন না- কাহারও মাস কাটিয়া আলতা পরিলেন না- প্রজারা হতাশ হইয়া ধান ভানিতে গেল, মুড়ি ভাজিতে গেল, চিঁড়া কুটিতে গেল। রাজা রাণীকে ভালবাসিয়া প্রাসাদপ্রান্তে একটি পাতার কুটির গড়িয়া দিলেন, কুটিরের পার্শ্বে পদ্মসরোবর কাটিয়া দিলেন, রাণী কুটিরে জল তুলিয়া উঠান নিকাইয়া শাকান্ন রাঁধিয়া রাজার মন ভুলাইতেন। রাজা হিজলগাছের ছায়ায় সরল গৃহস্থ হইয়া খেলা করিতেন, কলাপাতে নির্জলা ক্ষীর আর মর্তমান কলা খাইতে খাইতে আড়চোখে দেখিতেন রাণী ঋষির স্মরণে দীর্ঘশ্বাস গোপন করিলেন কি না। দীঘির পারে কামটুঙ্গীতে সারারাত্রি রাজারাণী গল্প করিয়া কাটাইতেন, রাণীর কেশের সর্ষপতৈলের গন্ধে রাজার হৃদয়ে সূতাশঙ্খের মতন সরু পাপবোধ জাগিত কি না, তাহা শতবর্ষপরের কথক বলিবে, রাজা কিছু লিখিয়া যান নাই, তৎকালে রাণীও কিছু বুঝিতে পারেন নাই।
তৃতীয়বর্ষে এমনি একদিন গৃহস্থকুটিরের লীলা চলিতেছে, রাজার মনে পুত্রবাসনার উদয় হইলো, উদয় হইবামাত্র তিনি রাণীকে ডাকিয়া সেই কথা বলিলেন। রাজ্যে প্রজারা তাঁহাকে আটকুঁড় ডাকিতেছে। রাণীরও মনে ছিল এই, কতআরপাতাবাহারচিরনিদিয়াতুলিয়াচুলবাঁধিবেন, ঝামাঘষিয়াআলতাপরিবেন, হলুদমাখিয়াস্নানকরিয়াপুষ্করিনীরজলকটুকরিবেন। সেই বৎসর খরায় ক্ষেতময় ধান্য পুড়িয়া খাক হইতে লাগিল। আকাশ ভাঙিয়া বৃষ্টি নামিল না। ভেক ডাকিয়া উঠিল না। রাজ্যে হায়-হায় রব পড়িয়া গেল, রাণীকে রাজদাসী আসিয়া বিমনাভাব করিয়া আত্মত্যাগিনী রাণী কমলার পূণ্যকথা শুনাইয়া গেল, কেমন করিয়া প্রজাদের রক্ষা করিতে রাণী কমলা সরোবরে ডুবিলেন, রাণী কিছু শুনিলেন, কিছু ভুলিয়া গেলেন। রাণীর হাতে ছুঁচ বিঁধিল, রাণী সেলাই রাখিয়া উঠিয়া গেলেন। সলিলসমাধি হইয়া গেলে কি রাজাকে আর দেখিবেন? রাজার সন্তানকে গর্ভে ধরিবেন? গার্হপত্যের তৃষ্ণালুব্ধ রাণী, প্রজা তাঁহার তত প্রিয় নহে।
পরের দুই বৎসর খরায় আবার সকলি পুড়িল। রাণী আর কতপ্রতিবৎসরবসিয়াবসিয়াশিশুরপায়েরমলআরকোমরেরগোটগড়াইবেন!আহারনিদ্রাবিলুপ্তপ্রায়রাণীবিগ্রহকেসোনারতুলসীপত্রউপহারদিয়াপূজাদিতেন,চন্দনঘষিতেন।বেতনভূকপূজারীব্রাহ্মণআসিয়াপূজাকরিত।রাণী ভক্তিভরে চরণামৃতলহিতেন,নৈবেদ্যেরচিনি-কলাগ্রহণকরিতেন।একদিন সন্ধ্যাকালে খরার আকাশ জ্যোৎস্নায় জ্বলিতেছে, শুভ্রনীরা পদ্মসরোবর শুকাইয়া গিয়া পাঁক দেখা দিয়াছে বলিয়া রাজারাণী আর সরোবরে নৌকা ভাসাইয়া রাত্রির শোভা দেখিতে যান না, রাণী তাঁহার প্রাসাদের অলিন্দে দাঁড়াইয়া দেখিলেন- যতদূর দৃষ্টিক্ষেপ করা যায় কোথাও একটু শ্যামলিমা নাই। প্রজার ঘরে ঘরে শিশুর ক্রন্দনধ্বনি শুনিয়া রাণীর বুক কাঁপিয়া উঠিল, রাণী অদৃশ্য ঈশ্বরকে হাতজোড় করিয়া বলিলেন, “হে রাজাধিরাজ, আমার বুকের একটি হাহাকারের বিনিময়ে তুমি প্রজাসকলের হাহাকার মোচন করিয়া দাও।” অমঙ্গলাশঙ্কায় কোথা হইতে একটি গৃধ্র আকাশ চিরিয়া আর্তরব করিয়া উঠিল।সরলা রাণী মনে ভাবিলেন, আমার তো রাজা থাকিবেন, সন্তানসম্ভাবনাহীনার হৃদয়ের হাহাকার স্থায়ী হউক, সন্তানবতীরা সন্তান লইয়া বাঁচুক। গভীর রাত্রে মেঘপূঞ্জের সংঘর্ষ হইবার ধ্বনিতে প্রজারা আকুল হইয়া ঘরের বাহির হইয়া আসিল। বৃষ্টি নামিল। শুষ্ক নদীবক্ষ হইতে শোঁ শোঁ শব্দ উঠিল। ভেকের দল প্রগাঢ় প্রীতিকোলাহলে সমবেত সঙ্গীত শুরু করিল। তিনদিন ক্রমাগত বৃষ্টি হইলো। রাণী মেঘডম্বর শাড়ি পরিয়া সখীসংকাশে প্রাসাদশিখরে বৃষ্টিতে ভিজিয়া আনন্দগান করিলেন, বৃষ্টিধারার সাথে সন্তানহীনার শোকবারি মিশিয়া গেল।
কিছুকাল পরে রাণী বুঝিলেন, পরমেশ্বর তাঁহার জন্য একখানি নূতন হাহাকার ধার্য্য করিয়াছেন। রাজা ঘোড়া ছুটাইয়া আরেক রাজ্যে গিয়াছেন, ফিরিবার সময় রাজকুমারী সরযূকে বিবাহ করিয়া আনিয়াছেন। নূতন রাণী নিতান্ত বালিকা। অল্পবয়সহইতেসরযুদেখিল, রাজারঘরেতাহারবিবাহহইয়াছে, স্বামীতাহারবশ, মুখহইতেবাক্যখসিবারআগেগুপীদাসীতাহাকে বেসম মাখিয়ানাওয়াইয়াদেয়, সরোদাসী চন্দনতিলকেসাজাইয়াদেয়, ক্ষেমাদাসীহীরামোতিরবেলকুঁড়িদিয়াখোঁপাগাঁথিয়াদেয়, চাইনাবলিয়াখেলেনাছুঁড়িয়াদিবারঅপেক্ষামাত্র- নতুনখেলারপুতুলজুটিয়াযায়।সেরাজাকেলইয়াখেলিল, খেলিয়াক্লান্তহইয়াদুয়ারদিয়াদিল।রাজাদোরহইতেফিরিয়াগেলেন- তাঁহারকতটাপরিতাপহইয়াছিলবলাযায়না, কারণ তিনি প্রতিবার প্রত্যাখ্যাত হইয়াও ফিরিয়া আসিতেন। সরযূ এবং তাহার বাপের বাড়ি হইতে আনা স্যাঙাতনী তাহাতে দারূণ আমোদ পাইলো। রাণী মর্মপীড়ায় প্রাসাদ ছাড়িয়া তাঁহার পর্ণকুটিরে আশ্রয় লইলেন, কেহ তাঁহার অভাব বোধ করিল না। প্রজারা বলাবলি করিতে লাগিল, এইবার যথার্থ সুলক্ষণা রাণী আসিয়াছেন, রাজবংশ এইবার রক্ষা হইবে।
রাণীর সহিত ঈশ্বরের কথোপকথনের কোনো সাক্ষ্য তো নাই, রাণীর সহিত তাঁহার কী বিনিময়ের কথা হইয়াছিল- তাহাও আর কেহ শোনেনাই। রাণী ফিরিলেন বটে, ভূমে আর পা ফেলিতে পারেন না, শিশুসন্তানকামনায়যত গোট গড়াইয়াছিলেন আর যত সোনার মল- তাহাদের অদৃশ্য দানায় মাটি ভরিয়া আছে, রাণীর স্থলকমলের মতন পায়ে তাহা বারংবার বিঁধে, রক্তপাত হয়। রাণী চিরকাল দেবতাকে বড় ভালবাসিতেন, কোথায় রহিল সুবর্ণবিগ্রহ, কে তাহার যত্ন করে, কে তাহাকে পূজা দেয়। রাণীর হৃদয়ের খরার তাপে বিগ্রহের দশা পুড়িয়া যাওয়া ধানক্ষেতের মতন হইলো।
সরযূ রাজার বংশরক্ষা করিতে পারিল না, রাজার আর সহিল না, পরের বৎসর রাজা ইরাবতী নাম্নী এক রাজকন্যাকে বিবাহ করিয়া আনিলেন। বিবাহের পর প্রকাশ পাইলো রাজকন্যার মূর্চ্ছাব্যারাম আছে, রাজভীষক মাথা নাড়িয়া রাজাকে কি কি বলিলেন কেহ জানিতে পাইলো না। খাসদাসীসহ সোনার পাল্কিতে রাজকন্যা ইরাবতী ফিরিয়া গেলেন। রাজ অন্তঃপুর শূন্য রহিল না, আবার পূরিয়া উঠিল। রাজার প্রমোদমহলও উৎকট আমোদে ভাস্বর হইতে লাগিল। একদারাজনর্তকীদের কক্ষে তামসিকতায় ডুবিয়া থাকিয়া রাজার মনে হইলো- ঋষি এইভাবে তাহা হইলে প্রতিশোধ লইলেন। রাণী কোথায় আছেন? রাণীর গায়ে স্বর্গমাধুরীর সৌরভ স্ফূরিত হইতো- অতিশয় সাধু আত্মা ছাড়া এই সৌরভ দেহে তৈয়ার হয় না। রাজা তাঁহার কেশরাশির সমুদ্রে বরুণদেবতার মতন শয্যা লইতেন, সেই কেশের স্পর্শের সহিত ধূপের সুরভি মিশ্রিত থাকিত। ঋষি কিংবা রাণী কাহার প্রতি রাজা হাতজোড় করিয়া ক্ষমা চাহিলেন, তাহা রাজনর্তকীরা বুঝিতে পারিল না। রাজা মত্তাবস্থায় লোক পাঠাইয়া রাণীকে জানাইলেন, তিনি আসিবেন।
ছয়মাসের মড়া যেন খাড়া হইয়া উঠিল, জীয়ন্ত রাণী পিঠালীতে ডুবাইয়া খামা কচুর ডাগুর ভাজিলেন, তারামিরার ফুল ভাজিলেন, খয়রামাছের ডিম ভাজিলেন। রাজা বহুকাল হয় খাইয়া পরিতোষলাভ করিয়াছিলেন বলিয়া রাণী কাঁদিয়া হাসিয়া গাভথোড়ের ছেঁচকী রাঁধিলেন, শালুকফুলের নাল কুটিয়া ঘন্ট রাঁধিলেন, কচি কুমুড়া দিয়া সারঙ্গ পুঁটীর লাল ঝোল রাঁধিলেন। রাজার কথা ভাবিতে ভাবিতে কটাহের ভর্জিত দ্রব্য চিমড়া হইতে লাগিল, সারঙ্গ পুঁটী অথৈ ঝোলসমুদ্রে ডুবিল ভাসিল। রাজা সেই পূন্যদিবসে রাণীর ভাঙা মহলায় আসিতে ভুলিলেন। ভুলিলেন বলা ঠিক হইবে না, রাজা মনে ভাবিলেন- এমন কত দিন আসিবে, এমনি কত দ্বিপ্রহর সুখাদ্যের ঘ্রাণে আইঢাই করিয়া কাটিবে। রাজা অবিদ্যার ক্রোড়ে নিদ্রা গেলেন।
একদিন রাজা স্নান করিয়া সুবেশ পরিয়া রাণীর মহলায় ভোজ খাইতে আসিলেন- ডাক দিলেন, 'তিলফুল বাঁধুলিফুল'! আঙিনার গাছগুলির তলা কেহ ঝাঁট দেয়নাই। রাণীর বাগান ময়নাকাঁটা ছাইয়া ফেলিয়াছে। রাণীর কটাহে ভাসা তেলে পাটভাজা পাথর হইয়া গিয়াছে- কেহ নাই। রাণী চলিয়া গিয়াছেন। কেহ বলিল রাণী সরোবরে জলে ডুবিয়া নালফুল হইয়া ফুটিয়া আছেন, জলটুঙ্গী হইতে মধ্যরাত্রে রাণীর দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনিয়া লোকে সাশ্রুনেত্র রাণীকে স্মরণ করিয়া থাকে। কেহ বলে রাণী সরোবরে নামিতেই সরোবরের জল মুক্তাস্বচ্ছ হইতে শুরু করিয়াছিল, তাহাতে স্ফটিকের সিঁড়ি, সেই সিঁড়ি নামিয়া গিয়াছে পাতালের বাগিচায়, সেই বাগিচার নাম 'দিলতোড় বাগ'।
কুলোকে বলে, তন্ডুলনাস্তি গৃহস্থের কন্যাকে আনিয়া রাজা বিবাহ করিয়াছিলেন, নহিলে রাজগৃহে এমন পতিসেবা কে করিবে। দুষ্টলোকের রটনা এও শোনা যায়, নাকি একদা মৃগয়াক্লান্ত রাজা গভীর বনের প্রান্তে ঋষির আশ্রয়ে আসিয়া দেখিলেন, ভাঙা কুটিরে বসিয়া ঋষির স্ত্রী আকুলনয়নে কাঁদিতেছেন- তাঁহার রূপার কাজললতার মতন চোখ, বাঁধুলিফুলের মতন ঠোঁট, তিলফুলের মতন নাক, পুষ্পমঞ্জরীশোভিত কূচকূম্ভ, রম্ভার মতন উরু, স্থলকমলের মতন পায়ের পাতা। ঋষি তাঁহাকে বলিয়া গিয়াছেন, “এই কুটির হইতে কোথাও যাইও না,” অথচ নিজে বৎসরকাল হয় গিয়াছেন আর ফিরিয়া আসেননাই। রাজা একবেলা সেই পর্ণকুটিরে সামান্য আহার করিলেন। ঋষির মরিচজবা আর শ্বেতদ্রোণফুলের কুঞ্জের আশ্রয়ে শ্রান্ত দেহে ভূমিশয্যা লইলেন। সন্ধ্যা নামিলে অরণ্যের বন্য জন্তুসকল ডাকিয়া উঠিল।রাজার মনে অসূর জাগিয়া উঠিল, সেই অসূর রাজাকে এবং রাজা ঋষিপত্নীকে একই কথা বুঝাইলেন, ঋষি আর আসিবেন না এবং রাজা এই রমণীরত্নকে না পাইলে তাঁহার প্রাণবিয়োগ হইবে। রাজা সেই চকোরলোচনাকে পাতার কুটির হইতে আনিয়া রাজ্যমাঝে প্রতিষ্ঠিত করিলেন- অষ্ট অলংকার পরাইলেন- অগ্নিপাটের শাড়ি পরাইলেন। রাণীর ভূবনমোহিনী রূপ দেখিয়া প্রজাসকল বলিল, এ রাক্ষসী না হইয়া যায় না। রাজকার্য্য মন্ত্রীর হাতে দিয়া রাজা দিবাভাগেও রাণীর মহলে পড়িয়া থাকেন, নিবিড়কুন্তলা রাণীর কুন্তল লইয়া মেঘুয়া খেলিয়া দিন কাটান। রাণীর প্রেম সূর্য্যকন্যা তপতীর প্রেমকেও হার মানায়।
ঋষিপত্নীকে হরণ করিয়া আনিবার সময় রাজা রাজ্যে অমঙ্গল বহিয়া আনিয়াছেন কি না তাহা দেখিবার জন্য প্রজাচিত্ত উৎকর্ণ হইয়া রহিল। সেই বৎসর এবং তাহার পরের বৎসর সীতাশাল- ঝিঙেশাল ধান্যের বান ডাকিল। মকরসংক্রান্তিতে পিঠার ভোগ শেয়ালে খাইয়া শেষ করিতে পারিল না। রাণী রূপতরাসীর মতন রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে উঠিয়া হাতিশালের হাতি খাইলেন না, ঘোড়াশালের ঘোড়া খাইলেন না- কাহারও মাস কাটিয়া আলতা পরিলেন না- প্রজারা হতাশ হইয়া ধান ভানিতে গেল, মুড়ি ভাজিতে গেল, চিঁড়া কুটিতে গেল। রাজা রাণীকে ভালবাসিয়া প্রাসাদপ্রান্তে একটি পাতার কুটির গড়িয়া দিলেন, কুটিরের পার্শ্বে পদ্মসরোবর কাটিয়া দিলেন, রাণী কুটিরে জল তুলিয়া উঠান নিকাইয়া শাকান্ন রাঁধিয়া রাজার মন ভুলাইতেন। রাজা হিজলগাছের ছায়ায় সরল গৃহস্থ হইয়া খেলা করিতেন, কলাপাতে নির্জলা ক্ষীর আর মর্তমান কলা খাইতে খাইতে আড়চোখে দেখিতেন রাণী ঋষির স্মরণে দীর্ঘশ্বাস গোপন করিলেন কি না। দীঘির পারে কামটুঙ্গীতে সারারাত্রি রাজারাণী গল্প করিয়া কাটাইতেন, রাণীর কেশের সর্ষপতৈলের গন্ধে রাজার হৃদয়ে সূতাশঙ্খের মতন সরু পাপবোধ জাগিত কি না, তাহা শতবর্ষপরের কথক বলিবে, রাজা কিছু লিখিয়া যান নাই, তৎকালে রাণীও কিছু বুঝিতে পারেন নাই।
তৃতীয়বর্ষে এমনি একদিন গৃহস্থকুটিরের লীলা চলিতেছে, রাজার মনে পুত্রবাসনার উদয় হইলো, উদয় হইবামাত্র তিনি রাণীকে ডাকিয়া সেই কথা বলিলেন। রাজ্যে প্রজারা তাঁহাকে আটকুঁড় ডাকিতেছে। রাণীরও মনে ছিল এই, কতআরপাতাবাহারচিরনিদিয়াতুলিয়াচুলবাঁধিবেন, ঝামাঘষিয়াআলতাপরিবেন, হলুদমাখিয়াস্নানকরিয়াপুষ্করিনীরজলকটুকরিবেন। সেই বৎসর খরায় ক্ষেতময় ধান্য পুড়িয়া খাক হইতে লাগিল। আকাশ ভাঙিয়া বৃষ্টি নামিল না। ভেক ডাকিয়া উঠিল না। রাজ্যে হায়-হায় রব পড়িয়া গেল, রাণীকে রাজদাসী আসিয়া বিমনাভাব করিয়া আত্মত্যাগিনী রাণী কমলার পূণ্যকথা শুনাইয়া গেল, কেমন করিয়া প্রজাদের রক্ষা করিতে রাণী কমলা সরোবরে ডুবিলেন, রাণী কিছু শুনিলেন, কিছু ভুলিয়া গেলেন। রাণীর হাতে ছুঁচ বিঁধিল, রাণী সেলাই রাখিয়া উঠিয়া গেলেন। সলিলসমাধি হইয়া গেলে কি রাজাকে আর দেখিবেন? রাজার সন্তানকে গর্ভে ধরিবেন? গার্হপত্যের তৃষ্ণালুব্ধ রাণী, প্রজা তাঁহার তত প্রিয় নহে।
পরের দুই বৎসর খরায় আবার সকলি পুড়িল। রাণী আর কতপ্রতিবৎসরবসিয়াবসিয়াশিশুরপায়েরমলআরকোমরেরগোটগড়াইবেন!আহারনিদ্রাবিলুপ্তপ্রায়রাণীবিগ্রহকেসোনারতুলসীপত্রউপহারদিয়াপূজাদিতেন,চন্দনঘষিতেন।বেতনভূকপূজারীব্রাহ্মণআসিয়াপূজাকরিত।রাণী ভক্তিভরে চরণামৃতলহিতেন,নৈবেদ্যেরচিনি-কলাগ্রহণকরিতেন।একদিন সন্ধ্যাকালে খরার আকাশ জ্যোৎস্নায় জ্বলিতেছে, শুভ্রনীরা পদ্মসরোবর শুকাইয়া গিয়া পাঁক দেখা দিয়াছে বলিয়া রাজারাণী আর সরোবরে নৌকা ভাসাইয়া রাত্রির শোভা দেখিতে যান না, রাণী তাঁহার প্রাসাদের অলিন্দে দাঁড়াইয়া দেখিলেন- যতদূর দৃষ্টিক্ষেপ করা যায় কোথাও একটু শ্যামলিমা নাই। প্রজার ঘরে ঘরে শিশুর ক্রন্দনধ্বনি শুনিয়া রাণীর বুক কাঁপিয়া উঠিল, রাণী অদৃশ্য ঈশ্বরকে হাতজোড় করিয়া বলিলেন, “হে রাজাধিরাজ, আমার বুকের একটি হাহাকারের বিনিময়ে তুমি প্রজাসকলের হাহাকার মোচন করিয়া দাও।” অমঙ্গলাশঙ্কায় কোথা হইতে একটি গৃধ্র আকাশ চিরিয়া আর্তরব করিয়া উঠিল।সরলা রাণী মনে ভাবিলেন, আমার তো রাজা থাকিবেন, সন্তানসম্ভাবনাহীনার হৃদয়ের হাহাকার স্থায়ী হউক, সন্তানবতীরা সন্তান লইয়া বাঁচুক। গভীর রাত্রে মেঘপূঞ্জের সংঘর্ষ হইবার ধ্বনিতে প্রজারা আকুল হইয়া ঘরের বাহির হইয়া আসিল। বৃষ্টি নামিল। শুষ্ক নদীবক্ষ হইতে শোঁ শোঁ শব্দ উঠিল। ভেকের দল প্রগাঢ় প্রীতিকোলাহলে সমবেত সঙ্গীত শুরু করিল। তিনদিন ক্রমাগত বৃষ্টি হইলো। রাণী মেঘডম্বর শাড়ি পরিয়া সখীসংকাশে প্রাসাদশিখরে বৃষ্টিতে ভিজিয়া আনন্দগান করিলেন, বৃষ্টিধারার সাথে সন্তানহীনার শোকবারি মিশিয়া গেল।
কিছুকাল পরে রাণী বুঝিলেন, পরমেশ্বর তাঁহার জন্য একখানি নূতন হাহাকার ধার্য্য করিয়াছেন। রাজা ঘোড়া ছুটাইয়া আরেক রাজ্যে গিয়াছেন, ফিরিবার সময় রাজকুমারী সরযূকে বিবাহ করিয়া আনিয়াছেন। নূতন রাণী নিতান্ত বালিকা। অল্পবয়সহইতেসরযুদেখিল, রাজারঘরেতাহারবিবাহহইয়াছে, স্বামীতাহারবশ, মুখহইতেবাক্যখসিবারআগেগুপীদাসীতাহাকে বেসম মাখিয়ানাওয়াইয়াদেয়, সরোদাসী চন্দনতিলকেসাজাইয়াদেয়, ক্ষেমাদাসীহীরামোতিরবেলকুঁড়িদিয়াখোঁপাগাঁথিয়াদেয়, চাইনাবলিয়াখেলেনাছুঁড়িয়াদিবারঅপেক্ষামাত্র- নতুনখেলারপুতুলজুটিয়াযায়।সেরাজাকেলইয়াখেলিল, খেলিয়াক্লান্তহইয়াদুয়ারদিয়াদিল।রাজাদোরহইতেফিরিয়াগেলেন- তাঁহারকতটাপরিতাপহইয়াছিলবলাযায়না, কারণ তিনি প্রতিবার প্রত্যাখ্যাত হইয়াও ফিরিয়া আসিতেন। সরযূ এবং তাহার বাপের বাড়ি হইতে আনা স্যাঙাতনী তাহাতে দারূণ আমোদ পাইলো। রাণী মর্মপীড়ায় প্রাসাদ ছাড়িয়া তাঁহার পর্ণকুটিরে আশ্রয় লইলেন, কেহ তাঁহার অভাব বোধ করিল না। প্রজারা বলাবলি করিতে লাগিল, এইবার যথার্থ সুলক্ষণা রাণী আসিয়াছেন, রাজবংশ এইবার রক্ষা হইবে।
রাণীর সহিত ঈশ্বরের কথোপকথনের কোনো সাক্ষ্য তো নাই, রাণীর সহিত তাঁহার কী বিনিময়ের কথা হইয়াছিল- তাহাও আর কেহ শোনেনাই। রাণী ফিরিলেন বটে, ভূমে আর পা ফেলিতে পারেন না, শিশুসন্তানকামনায়যত গোট গড়াইয়াছিলেন আর যত সোনার মল- তাহাদের অদৃশ্য দানায় মাটি ভরিয়া আছে, রাণীর স্থলকমলের মতন পায়ে তাহা বারংবার বিঁধে, রক্তপাত হয়। রাণী চিরকাল দেবতাকে বড় ভালবাসিতেন, কোথায় রহিল সুবর্ণবিগ্রহ, কে তাহার যত্ন করে, কে তাহাকে পূজা দেয়। রাণীর হৃদয়ের খরার তাপে বিগ্রহের দশা পুড়িয়া যাওয়া ধানক্ষেতের মতন হইলো।
সরযূ রাজার বংশরক্ষা করিতে পারিল না, রাজার আর সহিল না, পরের বৎসর রাজা ইরাবতী নাম্নী এক রাজকন্যাকে বিবাহ করিয়া আনিলেন। বিবাহের পর প্রকাশ পাইলো রাজকন্যার মূর্চ্ছাব্যারাম আছে, রাজভীষক মাথা নাড়িয়া রাজাকে কি কি বলিলেন কেহ জানিতে পাইলো না। খাসদাসীসহ সোনার পাল্কিতে রাজকন্যা ইরাবতী ফিরিয়া গেলেন। রাজ অন্তঃপুর শূন্য রহিল না, আবার পূরিয়া উঠিল। রাজার প্রমোদমহলও উৎকট আমোদে ভাস্বর হইতে লাগিল। একদারাজনর্তকীদের কক্ষে তামসিকতায় ডুবিয়া থাকিয়া রাজার মনে হইলো- ঋষি এইভাবে তাহা হইলে প্রতিশোধ লইলেন। রাণী কোথায় আছেন? রাণীর গায়ে স্বর্গমাধুরীর সৌরভ স্ফূরিত হইতো- অতিশয় সাধু আত্মা ছাড়া এই সৌরভ দেহে তৈয়ার হয় না। রাজা তাঁহার কেশরাশির সমুদ্রে বরুণদেবতার মতন শয্যা লইতেন, সেই কেশের স্পর্শের সহিত ধূপের সুরভি মিশ্রিত থাকিত। ঋষি কিংবা রাণী কাহার প্রতি রাজা হাতজোড় করিয়া ক্ষমা চাহিলেন, তাহা রাজনর্তকীরা বুঝিতে পারিল না। রাজা মত্তাবস্থায় লোক পাঠাইয়া রাণীকে জানাইলেন, তিনি আসিবেন।
ছয়মাসের মড়া যেন খাড়া হইয়া উঠিল, জীয়ন্ত রাণী পিঠালীতে ডুবাইয়া খামা কচুর ডাগুর ভাজিলেন, তারামিরার ফুল ভাজিলেন, খয়রামাছের ডিম ভাজিলেন। রাজা বহুকাল হয় খাইয়া পরিতোষলাভ করিয়াছিলেন বলিয়া রাণী কাঁদিয়া হাসিয়া গাভথোড়ের ছেঁচকী রাঁধিলেন, শালুকফুলের নাল কুটিয়া ঘন্ট রাঁধিলেন, কচি কুমুড়া দিয়া সারঙ্গ পুঁটীর লাল ঝোল রাঁধিলেন। রাজার কথা ভাবিতে ভাবিতে কটাহের ভর্জিত দ্রব্য চিমড়া হইতে লাগিল, সারঙ্গ পুঁটী অথৈ ঝোলসমুদ্রে ডুবিল ভাসিল। রাজা সেই পূন্যদিবসে রাণীর ভাঙা মহলায় আসিতে ভুলিলেন। ভুলিলেন বলা ঠিক হইবে না, রাজা মনে ভাবিলেন- এমন কত দিন আসিবে, এমনি কত দ্বিপ্রহর সুখাদ্যের ঘ্রাণে আইঢাই করিয়া কাটিবে। রাজা অবিদ্যার ক্রোড়ে নিদ্রা গেলেন।
একদিন রাজা স্নান করিয়া সুবেশ পরিয়া রাণীর মহলায় ভোজ খাইতে আসিলেন- ডাক দিলেন, 'তিলফুল বাঁধুলিফুল'! আঙিনার গাছগুলির তলা কেহ ঝাঁট দেয়নাই। রাণীর বাগান ময়নাকাঁটা ছাইয়া ফেলিয়াছে। রাণীর কটাহে ভাসা তেলে পাটভাজা পাথর হইয়া গিয়াছে- কেহ নাই। রাণী চলিয়া গিয়াছেন। কেহ বলিল রাণী সরোবরে জলে ডুবিয়া নালফুল হইয়া ফুটিয়া আছেন, জলটুঙ্গী হইতে মধ্যরাত্রে রাণীর দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনিয়া লোকে সাশ্রুনেত্র রাণীকে স্মরণ করিয়া থাকে। কেহ বলে রাণী সরোবরে নামিতেই সরোবরের জল মুক্তাস্বচ্ছ হইতে শুরু করিয়াছিল, তাহাতে স্ফটিকের সিঁড়ি, সেই সিঁড়ি নামিয়া গিয়াছে পাতালের বাগিচায়, সেই বাগিচার নাম 'দিলতোড় বাগ'।
0 মন্তব্যসমূহ