বই নিয়ে আলাপ : বিপুল দাসের উপন্যাস-- সরমার সন্ততি

কুহকজড়ানো এক শব্দধারা 
অশ্রুকুমার সিকদার


উপন্যাসের ন্যারেটর তিনজন—একজন সবজান্তা কথক, দ্বিতীয়জন নায়ক রূপলাল, তৃতীয়জন রূপলালের বাবা পরমানন্দ সিংহ, যিনি ভাণ্ডি সিং বলেই বেশি পরিচিত। এই ভান্ডি সিং শুধু নিজের নামে চিহ্নিত ভান্ডি সিং জোতের মালিক নয়, দাপটে সে সব জোতদারের বাপ। আগে বাদামি ঘোড়ার পিঠে চড়ে দাপিয়ে বেড়াত, পরে সর্পাঘাতে ঘোড়া মারা গেলে সাইকেলে চরকি মারে। এই দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজবংশী, জোতদারের ইচ্ছে করে সবার জোতজমি দখল করে নিতে এবং এই ভোগী পুরুষ বহু নারী সম্ভোগ করে জীবনে। জমির সিলিং হয়ে যাওয়ায় তার জোত ছোটো হয়ে গেছে, তবু বেনামে তার অনেক জমি। শহরে তার ওষুধের দোকান। জব্বর আওয়াজ এই মানুষের। এই উপন্যাস একদিকে ভান্ডি সিং-এর উত্থানপতনের কাহিনি, আর সেই কাহিনির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে তার পুত্র রূপলালের গল্প।

ভান্ডি সিং-এর জোতে নতুন জনপদ গড়ে উঠেছে। এই উপন্যাস সেই জনপদ গড়ে ওঠারও গল্প। এই গল্প আমরা নানান দেশের সাহিত্যে অনেকবার পড়ার সুযোগ পেয়েছি। মাত্র দুটোর কথা এখানে উল্লেখ করছি। যেমন অমিয় চক্রবর্তীর ‘ইতিহাস’ কবিতা। ‘নেবুরঙা শার্ট পরা একটি মানুষ’ আরও দুজনকে ডেকে আনে, গ্রামের পত্তন হয়। এক ফ্যাক্টরিকে কেন্দ্র করে পরে গ্রাম আরও বড় হয়। আরও অনেক পরে নদীতে বাঁধ দিলে ইটবাঁধা বহু গ্রাম একত্র শহরে গেঁথে থাকবে বহু লোক। এই গ্রাম/তাহলে উঠে যাবে। আবার বসনিয়ার সাড়ে তিন শতাব্দীর এক ক্রনিক উপন্যাস লিখেছেন ইভো আনদ্রি দিনা নদীর ওপরের এক সেতুকে অবলম্বন করে। এক মহা-উজিরের উদ্যোগে ও খরচে পাঁচ বছর ধরে এই সেতু নির্মিত হয়েছিল। সাড়ে তিনশ বছর পরে প্রথম মহাযুদ্ধের সময় এই সেতুকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় যেন। শত্রুসৈন্যবাহিনী যাতে অগ্রসর হতে না পারে, তাই ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হল সেতু। মধ্যবর্তী সময়ের দ্রিনানদীর দু’পারের জনপদের কাহিনি নিয়ে এই উপন্যাস। ভান্ডি সিং জোতেও গড়ে উঠেছে শহর, দেশভাগের পর উদ্বাস্তু মানুষেরা এসে নানা প্রান্তের জন এসে বাড়িঘর করতে শুরু করেছে। তার আলো বর্শার মতো বিদ্ধ করে নতুন শহরের মাঝে এক টুকরো পুরনো ভান্ডি সিং জোতকে। পাশের ক্রমবর্ধমান প্রফুল্লনগর এই শহরের সঙ্গে মিলে গিয়েছে। শহর আক্রমণ করে হলুদ সর্ষেখেত, ডাউকিনদীর টলটলে জল। নতুন শহরের বর্জ নদী দিয়ে বয়ে গিয়ে নদীকে ক্রমাগত দূষিত করে। ভাণ্ডি সিং-এর উত্তরাধিকারী তার ছেলে রূপলালের বসতবাড়ি কিনে নিতে চায় ছোটোবেলার বন্ধু বিজনলাল। 

বিজনলাল হরিদেব চক্রবর্তীর ছেলে। হরিদেব পূর্ব-পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এখানে এসে অস্তিত্বের লড়াই করছে। ব্রাহ্মণ্য-অহংকারে গর্বিত হরিদেব জানায়, যারা কোনও দিন চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলত না, সেই শেখেরা যখন বারান্দায় উঠে মোড়ায় বসে, তখন অস্তিত্ব টলে যায়। কিন্তু এতেও শিক্ষা হয়নি হরিদেবের, এখানে এসেও সে ঘৃণা করে রাজবংশীদের, প্রতিটি কথায় বিদ্রুপে জর্জরিত করে। যখন সে দেশে ফেলে আসা ধানের ছড়ার ’সরসর শব্দ’, তার সুগন্ধের স্মৃতি রোমন্থন করে, তখন তার জন্য মায়া হয়, কিন্তু যখন সে রাজবংশীদের মানুষ বলেই গণ্য করে না, তখন স্বভাবতই রূপলালের ঘৃণা তার প্রাপ্য হয়। উধাসুর বাজনা শুনতে শুনতে হরিদেবের পাগল পাগল লাগে, মনে জাগে দেশে শোনা লোকগানের স্মৃতি। কিন্তু সেই স্মৃতি এই অহংকারী মানুষকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। সে উধাসুর সারিন্দা ভেঙে দেয়। হরিদেব রূপলালকে ইংরেজিতে প্রশ্ন করে—‘রূপলাল, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?' সে জানে না রূপলাল এক প্রাচীন সভ্যতার ধারাবাহিকতায় আবির্ভূত। রূপলাল তার উৎস জানতে চেয়ে রাত জেগে কত ইতিহাস-বুরুঞ্জি পড়েছে, সে জেনেছে চিন-বার্মা হয়ে জলপাইগুড়ি-কোচবিহারের এক মঙ্গোলয়েড ধারায় তার জন্ম। হরিদেবের প্রতি সঞ্চিত ঘৃণায় সে তার জোতদার বাপের বন্দুক নিয়ে হরিদেবকে হত্যা করতে যায়। বন্দুকসহ ধরা পড়ে রূপলাল সশস্ত্র পুলিশবাহিনীর হাতে। এই বাহিনী পেট্রো-উৎসবে মুখর প্রফুল্পনগরে প্রেরিত হয়েছিল নক্শালপন্থীদের দমনের জন্য। জোতদার ভান্ডি সিং-এর ‘ছোয়া’ বলে রূপলালের মনের গভীরে লজ্জা ছিল। মায়ের প্রতি বাবার ব্যবহারে, দুর্দান্ত বাবার নানা অপকর্মে তার মনে গ্লানি ছিল। সেই গ্লানি তাড়নায় রূপলাল ভিড়েছিল নকশালপন্থীদের দলে। গিরিবালার সন্তান সুরেশ্বরী। গিরিবালা ছিল তার মায়ের দেশের লোক, খাস-পরিচারিকা। রূপলাল তাকে মাসি বলে ডাকত। কে জানে, সুরেশ্বরী ভান্ডি সিং-এর ঔরসজাত রূপলালের বৈমাত্রেয় বোন, অথবা নয় সুরেশ্বরী বোন যেন প্রণয়িনী। সেই সুরেশ্বরী খুন হয়ে যায়। ভান্ডি সিং জোত বলে পৃথিবীতে আর কিছু থাকে না। ডাউকিনদী দূষিত হয়ে যায়। সর্বস্বহারা রূপলাল। 

বিনাশের মারণ-বীজ সর্বত্র বিরাজমান। কানিবুড়ির সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া নিয়ে গল্পের শুরু। এই কানিবুড়ির ভান্ডি সিং-এর জনৈক প্রাক্তন যৌনসঙ্গিনী। সে আসলে বুড়ি নয়, অন্ধ। যেন কানি মনসা সে। তার অলৌকিক শক্তি। সে উড়তে পারে। একপাল সরমার সন্ততি, সবচেয়ে তার আজ্ঞাবহ দাস। হিংস্র কালো একদল কুকুর। কানিবুড়ি ‘যেন লক্ষকোটি কালো কুকুরদের শাসনের অধিকার নিয়ে কালিদহ থেকে উঠে এসেছে।’ যে কানিবুড়ি বিষ ঢালে, সে মনসা বলেই এই উপন্যাসে বিষহরির গান, চন্দ্রধরের গান ধ্বনিত হয়। নিয়তি একটা ছিদ্র রেখে দেয়। সেই বস্তু দিয়ে মৃত্যু, বিনাশ প্রবেশ করে। সেই মৃত্যুর কথা, বিনাশের 

অবশ্যম্ভাবিতার কথা লিখিত হয় এই চমৎকার উপন্যাসে। অন্যদিকে প্রাণের লাবণ্যও খেলা করে। আবার সেই লাবণ্যকে আক্রমণ করে মৃত্যু, অন্তর্ঘাত ঘটায়। দুর্দান্ত ভান্ডি সিং-এর পিত্তথলির দিকে সন্তর্পণে কাল এগিয়ে আসে, সরমার সন্ততিরা এগিয়ে আসে। প্রাণ ফুটে উঠছে, ভাইটাল ফোর্সের তীব্রতা, অন্যদিকে ভান্ডির ঘরের ফুটো দিয়ে কালসর্প ঢুকছে, তার মাথার ওপর কালপক্ষীর ছায়া। কিন্তু তা সত্ত্বেও ‘লীলাময় মুদ্রায় প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছে জীবনকমল’। 

নৈসর্গিক-অলৌকিককে জড়ানো এই উপন্যাস নিতান্ত বাস্তবতার স্তরকে ছাড়িয়ে যায়। বৈকুণ্ঠপুর অরণ্য থেকে ঝাঁকেঝাঁকে টিয়া উড়ে আসে। গাঢ় সবুজগন্ধ ইন্দ্রিয়ময়তায় বিহ্বল করে দেয়। একদিকে বহমান নদী, চর, অরণ্য, ফলেভরা খেতের সুষমা, অন্যদিকে অলৌকিকের কুহক এই গল্প -প্রতিমাকে তার চালচিত্রের বিরল সৌন্দর্যে মণ্ডিত করে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ