ভ্লাদিমির নবোকভ'এর গল্প : প্রতীক ও চিহ্ন



অনুবাদ: মোস্তাক শরীফ


চার বছরে এই চতুর্থবারের মতো সমস্যাটার মুখোমুখি হলো তারা- নিরাময়ের আশাহীন অপ্রকৃতিস্থ এক তরুণের জন্য জন্মদিনের উপহার বাছাই করা।

চাওয়া বলতে কিছুই নেই তার। মানুষের তৈরি যেকোনো কিছুই তার কাছে হয় অশুভের মধুকোষ- প্রতিনিয়ত যাতে ঘটে চলেছে জঘন্য সব ব্যাপার যা কেবল তার চোখেই ধরা পড়ে- নয়তো নেহাতই বিলাস দ্রব্য, তার বিমূর্ত দুনিয়ায় যার কোনো উপযোগিতা নেই। তার অনুভূতিকে আহত করতে পারে বা তাকে ভয় পাইয়ে দিতে পারে এমন সব বস্তু (যেমন, যন্ত্রপাতি ধরনের কিছুই চলবে না) বাদ দেয়ার পর সাদামাটা কিন্তু সুন্দর একটা জিনিস বেছে নিল তার বাবা মা- দশটি ছোট বয়ামে দশ রকমের ফলের জেলিভর্তি একটা বাক্স। তাদের বিয়ের অনেক পর ছেলের জন্ম, সেওতো অনেক আগের কথা, দুজনেই রীতিমতো বৃদ্ধ এখন। মায়ের নিষ্প্রভ ধুসর চুল হেলাফেলায় বাঁধা। সস্তা কালো পোশাক পরনে। একই বয়সের অন্য সব মহিলার (পাশের বাড়ির মিসেস সল যেমন, রঙ মেখে সং সেজে থাকা মুখটা সবসময় গোলাপী-বেগুনি, আর টুপিটা যেন নদীতীরে ফুটে থাকা একগোছা ফুল) মতো নন তিনি। বসন্তের খুঁতখুঁতে বাতাসে বড় বেশি নিরাভরণ আর সাদা তার চেহারাটা। তার স্বামী, অর্থাৎ ছেলের বাবা, মোটামুটি সফল ব্যবসায়ী ছিল দেশে থাকতে। নিউ ইয়র্কে এসে ভাই আইজাকের ওপর পুরোপুরিই নির্ভরশীল। আইজাক প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এখানে, পুরোপুরিই আমেরিকান বনে গেছে। তাদের সঙ্গে অবশ্য বলতে গেলে দেখাই হয় না, ‘যুবরাজ’ নামে তাকে ডাকে তারা।

সেই শুক্রবার, ছেলের যেদিন জন্মদিন, সবকিছুই ঘটতে লাগল উল্টোপাল্টা। সাবওয়ে ট্রেনটা দুটো স্টেশনের মাঝখানে ফেঁসে গেল এবং পনের মিনিট ধরে নিজেদের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক আর পত্রিকার খসখস শব্দ ছাড়া কিছুই কানে এল না তাদের। ট্রেন থেকে যে বাসে ওঠার কথা সেটাও এল দেরি করে, অগত্যা রাস্তার কোনায় লম্বা সময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। শেষমেষ এল বাস, বকবক করতে থাকা একদল স্কুলের বাচ্চায় ভর্তি হয়ে। বাস থেকে নেমে স্বাস্থ্যনিবাসের বাদামি রাস্তা ধরে যেই হাঁটতে শুরু করেছে, ঝেঁপে বৃষ্টি এল। কোনোমতে স্বাস্থ্যনিবাসে পৌঁছে ফের অপেক্ষার শুরু। দীর্ঘ অপেক্ষার পর বিষন্ন, হতচকিত চেহারা আর খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর ব্রণে ভরা মুখ নিয়ে পা টেনে টেনে ঢুকল (যে ভঙ্গিতে সবসময় ঢোকে সে)-না, তাদের ছেলে নয়, এক নার্স, যাকে তারা চেনে এবং মোটেই পছন্দ করে না। ঢুকেই ঝলমলে চেহারায় ঘোষণা করল, তাদের ছেলে ফের আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। ভালোই আছে এখন, তবে বাবা-মাকে দেখলে বেশিক্ষণ ভালো নাও থাকতে পারে, সে কথা জানাতেও ভুলল না। স্বাস্থ্যনিবাসটায় কর্মী একেবারেই হাতেগোনা। তার ওপর জিনিসপত্র এত বেশি হারায় বা ভুলভাল জায়গায় চলে যায় যে উপহারটা রেখে না গিয়ে বরং পরেরবার আসার সময় নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিল স্বামী-স্ত্রী। বেরিয়ে এল বাইরে। স্বামীর ছাতা খোলার জন্য অপেক্ষা করল ছেলের মা, তারপর আঁকড়ে ধরল তার হাত। স্বামী খুক খুক করে গলা পরিষ্কার করছে বারবার, মন খারাপ হলে যা করে। রাস্তার ওপাশে বাসস্টপের ছাউনির নিচে পৌঁছে ছাতা বন্ধ করল সে। খানিক দূরে, বৃষ্টিতে চুপচুপে ভেজা আর বাতাসে কাঁপতে থাকা একটা গাছের নিচে ছোট্ট আর নিষ্পাপ দেখতে একটা পাখির ছানা জলভর্তি গর্তের মধ্যে থিরথির করে কাঁপছিল অসহায়ের মতো।

সাবওয়ে স্টেশনমুখী দীর্ঘ পথে একটা কথাও হলো না দুজনের মধ্যে। ছাতা আঁকড়ে ধরা স্বামীর জরাগ্রস্ত দুই হাত, ফুলে থাকা শিরা আর বাদামী ছোপওয়ালা চামড়া যতবার চোখে পড়ল, ভেতর থেকে ঠেলে আসা উদগ্র অশ্রুকে চাপা দেয়ার চেষ্টা করল স্ত্রী। মনটাকে অন্য কিছুতে ব্যস্ত রাখার চেষ্টায় এদিক ওদিক তাকাতেই ধাক্কা খেল একটা, মায়া আর বিস্ময়ের মিশেলে অদ্ভুত একটা অনুভূতি জাগল মনে। কারণটা হচ্ছে একটা মেয়ে, বয়স্ক এক নারীর কাঁধে মাথা রেখে কাঁদছে। কালো চুল মেয়েটার, পায়ের নখ ময়লা আর লালচে। মহিলাটার চেহারা কার মতো যেন? হ্যাঁ, রেবেকা বরিসোভনা! বহু বছর আগে যার মেয়ের বিয়ে হয়েছিল মিন্স্ক শহরের সোলোভেইচিকদের পরিবারে।

শেষবার যখন তাদের ছেলে চেষ্টা করেছিল এ কাজটি করার, তার পদ্ধতিটি ছিল- ডাক্তারের কথায়- উদ্ভাবনশীলতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সফলও হয়ে যাচ্ছিল প্রায়, ঈর্ষাকাতর আরেক রোগী শেষ মুহূর্তে বাধ সাধায় পারেনি। ঐ রোগী ভেবেছিল পাখির মতো ওড়ার চেষ্টা করছে সে!

আসলে সে যা করতে চাচ্ছিল তা হচ্ছে এই দুনিয়ায় একটা ছিদ্র করে সেখান দিয়ে পালিয়ে বাঁচা। যে পদ্ধতিতে কাজটা করতে চাচ্ছিল তার ওপর একটি বিজ্ঞান সাময়িকীতে বড় একটা প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল পরে। স্বাস্থ্যনিবাসের ডাক্তার পড়তে দিয়েছিল সেটি তাদের। তবে তারও বহু আগে তারা স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে সমাধান করেছিল রহস্যটি। প্রবন্ধে এটাকে বলা হয়েছিল ‘নির্দেশক বাতিক’; খুব দুর্লভ একটা রোগ। এ রোগে আক্রান্ত মানুষ কল্পনা করে- তার চারপাশে যা ঘটছে সবকিছুর লক্ষ্য তার ব্যক্তিত্ব এবং অস্তিত্ব। রক্তমাংসের আর সব মানুষ এ ষড়যন্ত্রের বাইরে- এমনটাই মনে করে সে। কারণ একটাই। বাকি সবার চেয়ে সে অনেক বেশি বুদ্ধিমান। যেখানেই যায়, তাকে অনুসরণ করে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রকৃতি। আকাশে জমে থাকা মেঘগুলো চিহ্নের মাধ্যমে একে অন্যের কাছে তার ব্যাপারে বার্তা পাঠায়, বার্তাগুলো অবিশ্বাস্যরকমের বিশদ। তার মনের গভীর গোপন ভাবনাগুলো নিয়ে দিনশেষে হাত পা নেড়ে নিজেদের মধ্যে তাদের নিজেদের ভাষায় আলাপ করে গাছেরা। নুড়িপাথর, মাটির দাগ আর সূর্যরশ্মি আঁকিবুকি কেটে ভয়ঙ্কর পদ্ধতিতে এমন সব বার্তা দেয় যার পাঠোদ্ধার তাকে করতেই হবে। সবই হচ্ছে সংকেত আর সব সংকেতের সে-ই অভীষ্টবস্তু। গুপ্তচরেরা ঘিরে আছে তার চারপাশ। তাদের কেউ কেউ স্রেফ পর্যবেক্ষক, যেমন কাচের উপরিতল আর স্থির জলাশয়। অন্যরা, যেমন দোকানে ঝোলানো কোট, হচ্ছে পক্ষপাতদুষ্ট সাক্ষী। উদ্দেশ্য একটাই, তার ক্ষতি করা। বাকিরা (জলের ধারা, ঝড়)- রীতিমতো উন্মাদ, তার সম্বন্ধে জঘন্য ধারণা তাদের, ওঁৎ পেতে আছে তার সব কাজে ভুল বের করার জন্য। অতএব চরম সতর্ক থাকতে হয় তাকে। প্রতিটি মুহূর্ত, জীবনের প্রতিটি অংশকে ব্যয় করতে হয় তরঙ্গিত সব ঘটনাপ্রবাহের অর্থ উদ্ধারে। তার নিঃশ্বাসের সঙ্গে যে বাতাস নির্গত হয় সেটিকেও তালিকাভুক্ত করে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে। যদি তার আশেপাশেই কেবল আটকে থাকত এই নীলনকশা তাও না হয় হতো। তার পরিপার্শ্ব থেকে দূরত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিষম এই কেলেঙ্কারির পরিমাণ আর মাত্রাও লাগামছাড়া হয়ে যায়। তার রক্তকণিকার প্রতিচ্ছায়া শত সহস্র গুণ বর্ধিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিশাল এলাকা জুড়ে। বহুদূরে, দিগন্তে অনড় দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু পর্বত যেন গ্র্যানাইট পাথর আর গোঙাতে থাকা বৃক্ষের মাপে তার অস্তিত্বের সারসত্যকে জরিপ করতে থাকে।

তারা যখন সাবওয়ের কান ফাটানো শব্দ আর দুর্গন্ধে ভরা বাতাসের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এল, দিনের শেষ তলানি তখন সড়কবাতির আলোতে মিশে যাচ্ছে। রাতের খাবারের জন্য মাছ কেনার ইচ্ছে ছিল স্ত্রীর, স্বামীর হাতে জেলির পাত্রটা ধরিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে বলল তাকে। সুবোধ বালকের মতো নিজেদের ফ্ল্যাটবাড়িতে ফিরে গেল স্বামী। উঠেও এল তিনতলার ল্যান্ডিংয়ে, তারপরই মনে পড়ল, ঘরের চাবি সেদিন সকালেই স্ত্রীকে দিয়ে দিয়েছে। অগত্যা চুপচাপ সিঁড়িতে বসে পড়ল। মিনিট দশেক পর শরীরটাকে টানতে টানতে স্ত্রীকে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসতে দেখে উঠে দাঁড়াল নিঃশব্দে। ম্লান হাসি ফুটল স্ত্রীর মুখে। মাথা দোলাল নিজের বোকামিতে। দুই কক্ষের ফ্ল্যাটটাতে একসঙ্গে ঢুকল দুজন। সটান আয়নার কাছে চলে গেল স্বামী। দু’ হাতের বুড়ো আঙ্গুলে গালদুটোকে দু’পাশে টেনে চেহারাটাকে বিতিকিচ্ছিরি, ভ্যাঙচি কাটা একটা মুখোশ বানিয়ে নতুন আর বিরক্তিকর আলগা দাঁতের সারিটা বের করল মুখ থেকে। টেবিল সাজানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়ল স্ত্রী, সে মন দিল রুশ ভাষার দৈনিকটি পড়ায়। পড়তে পড়তেই বিবর্ণ খাবারগুলো মুখে পুরতে লাগল, যেগুলো খেতে দাঁত লাগে না। স্বামীর মেজাজের সঙ্গে ভালোই পরিচয় আছে স্ত্রীর, কাজেই চুপ থাকল সে।

খাবার শেষে স্বামী বিছানায় যাওয়ার পরও স্ত্রী থেকে গেল বসার ঘরে। সামনে অতি ব্যবহারে তারেস স্তূপ আর পুরনো ছবির অ্যালবাম। এক চিলতে উঠানটার ওপারে, ঘনঘোর অন্ধকারে ছাইদানি বা কিছু একটাতে বৃষ্টির একটানা আঘাত হানার শব্দ ভেসে আসছে। ওদিকে কয়েকটা জানালায় আলো জ্বলছে। তার একটাতে কালো পাজামা পরা একটা লোককে দেখা যাচ্ছে অগোছালো বিছানায় নিঃসাড় পড়ে থাকতে। দুই হাত মাথার পেছনে, উঁচু হয়ে আছে কনুইদুটো। জানালার পর্দা নামিয়ে ছেলের ছবিগুলো জরিপ করতে লাগল সে। ছোটবেলার ছবি, অন্য বাচ্চাদের চেয়ে চেহারায় বিস্ময়ের ছাপ বেশি। লিপজিগে থাকতে জার্মান একটা পরিচারিকা ছিল তাদের। হোঁৎকামুখো প্রেমিকের সাথে সেই পরিচারিকার একটা ছবি অ্যালবামের কোনো একটা ভাঁজ থেকে বেরিয়ে এল। একের পর এক পাতা উল্টে গেল সে। মিন্স্ক, বিপ্লব, লিপজিগ, বার্লিন, আবার লিপজিগ, একটা বাড়ির ঘোলাটে, বাঁকাত্যাড়া সামনের অংশ। ছেলের ছবি, বয়স যখন চার। কোনো একটা পার্কে, গম্ভীর চেহারা, কপালে ভাঁজ। মুখ ফিরিয়ে আছে কৌতূহলী চেহারার একটা কাঠবিড়ালীর দিক থেকে, অচেনা কাউকে দেখলে যেমনটা করত। রোসা আন্টি, কাঠখোট্টা চেহারার খ্যাপাটে চোখের বুড়ো মহিলাটি, একটার পর একটা খারাপ খবর নিয়ে জীবন কাটাতে হয়েছে যাকে। দেউলিয়া হওয়া, ট্রেন দুর্ঘটনা, ক্যান্সার এবং অবশেষে যেসব মানুষকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করে সারা জীবন কাটাল তাদেরকে সহ জার্মানদের হাতে ভবলীলা সাঙ্গ হওয়া। আবারও তাদের ছেলে, বয়স যখন ছয়। এটা সেই সময় যখন সে মানুষের হাত-পা’অলা চমৎকার সব পাখি আঁকত আর বয়স্কদের মতোই ভুগত অনিদ্রায়। তার চাচাত ভাই, এখন যে বিখ্যাত দাবাড়ু–। আবারও ছেলে, বছরআটেক বয়স, এরই মধ্যে কঠিন হয়ে উঠেছিল যাকে বোঝা। বারান্দার ওয়ালপেপার আর বইয়ের বিশেষ একটা ছবিকে ভয় পেত। অথচ তেমন কিছু নয় ছবিটা। মনোরম একটা প্রাকৃতিক দৃশ্য- পাহাড়ের ধারে কয়েকটা পাথর, পুরনো একটা ঘোড়ার গাড়ির চাকা, ঝুলে আছে বিশীর্ণ একটা গাছের ডাল থেকে। তারপর, বয়স যখন তার দশ, যে বছর ইউরোপ ছেড়েছিল তারা। দুঃসহ সেই ভ্রমণের লজ্জা, করুণা আর অপমান মনের মধ্যে দাগ কেটে আছে এখনও। আমেরিকায় পৌঁছানোর পর বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন বাচ্চাদের যে স্কুলে তাকে ভর্তি করা হয়েছিল সেখানকার কুচ্ছিত, জঘন্য আর সেকেলে বাচ্চাগুলো। তারপর, নিউমোনিয়া থেকে সেরে ওঠার লম্বা সময়ের সঙ্গে যখন জোট বাঁধল আরেক দুঃসময়। ছেলের ছোটখাট ভয়গুলো- তারা দুজন যেগুলোকে ভীষণ মেধাবী এক শিশুর অদ্ভুতুড়ে আচরণ বলেই মনে করত- ধীরে ধীরে জমাট বাঁধতে লাগল এবং রূপ নিল যুক্তির সুতায় পরস্পর-আবদ্ধ ভীষণ এক বিভ্রমের জটাজালে- সাধারণ চিন্তার কোনো মানুষের যেখানে প্রবেশাধিকার নেই।

মেনে নিয়েছে সে, এটি এবং অনেক কিছুই, কারণ বহু আগেই বুঝে নিয়েছে, বেঁচে থাকা মানেই হচ্ছে একটার পর একটা আনন্দকে বিসর্জন দেয়া; ঠিক আনন্দও নয়, পরিস্থিতির সামান্যতম উন্নতির সম্ভাবনা। একের পর এক ধেয়ে আসা যন্ত্রণাগুলোকে নিয়ে ভাবল সে, মুখ বুঁজে যেগুলো সহ্য করতে হয়েছে তাদের দুজনকে। অদৃশ্য সেই দানবগুলোর কথা ভাবল, অকল্পনীয় কোনো উপায়ে যারা কষ্ট দিয়েছে তার ছেলেকে। ভাবল পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা অপরিমেয় মমতা এবং সে মমতার দুর্ভাগা নিয়তির কথা-হয় ধ্বংস নয় অপচয় নয়তো উন্মাদনায় যার শেষ। ধুলো জমা কোনাকানাচে নিজের সঙ্গে গুনগুন করতে থাকা অবহেলিত শিশুগুলোর কথা ভাবল, ভাবল সুন্দর সেই আগাছাগুলোর কথা, কৃষকের চোখ যারা কিছুতেই এড়াতে পারে না।

বসার ঘর থেকে স্বামীর গোঙানির শব্দ যখন ভেসে এল তখন প্রায় মধ্যরাত। খানিক পরই টলমল পায়ে এসে ঢুকল সে, শোবার পোশাকের ওপর আস্ট্রাখান কলারযুক্ত পুরনো ওভারকোটটা পরে আছে, নিজের সুন্দর নীল বাথরোবের চেয়ে অনেক বেশি পছন্দ যেটি তার।

‘ঘুমাতে পারছি না!’ কঁকিয়ে উঠল সে।

‘কেন?’ জিজ্ঞেস করল স্ত্রী। ‘কেমন ক্লান্ত দেখাচ্ছিল তোমাকে!’

‘ঘুমাতে পারছি না, কারণ মারা যাচ্ছি আমি।’ কাউচের ওপর শুয়ে পড়ল সে।

‘পেটে সমস্যা? ডাক্তার সলোভকে ডাকব?’

‘ডাক্তার না,’ গুঙিয়ে উঠল সে, ‘নিকুচি করি ডাক্তারের! জলদি ওকে বের করে আনতে হবে ওখান থেকে। নইলে আমরা দায়ী হবো, দায়ী!’ তড়াক করে উঠে বসল সে, পা দুটো মেঝে ছুঁয়ে আছে। মুষ্টিবদ্ধ হাতে আঘাত করতে লাগল কপালে।

‘ঠিক আছে,’ শান্তগলায় বলল স্ত্রী। ‘কাল সকালেই ওকে বাড়িতে নিয়ে আসব আমরা।’

‘একটু চা পেলে হতো,’ কথাটা বলে বাথরুমের দিকে গেল স্বামী।

কষ্টেসৃষ্টে কোমর বাঁকা করে মেঝেতে পড়ে যাওয়া কয়েকটা তাস আর ছবি তুলল স্ত্রী- হরতনের গোলাম, ইস্কাপনের নয়, ইস্কাপনের টেক্কা, এলসা আর তার বর্বর চেহারার প্রেমিক। বাথরুম থেকে খোশমেজাজে ফিরে এল স্বামী, গলা উঁচিয়ে বলল, ‘ঠিক করে ফেলেছি সব। শোবার ঘরটা ছেড়ে দেব ওকে। আমরা দুজন পালা করে রাতের একটা অংশ ওর কাছে আর বাকি সময়টা কাউচে কাটাব। সপ্তাহে অন্তত দু’বার ডাক্তার এসে দেখে যাবে। যুবরাজের কথায় পাত্তা দেয়া যাবে না। কিছু বলবে বলেও মনে হয় না, খরচ বরং এতেই কম পড়বে।’

টেলিফোনটা বেজে উঠল, ফোন বাজার জন্য খুবই অস্বাভাবিক একটা সময়। ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে স্বামী, পা থেকে ছুটে যাওয়া একটা স্যান্ডেল খোঁজার চেষ্টা করতে করতে ফোকলা মুখে, বাচ্চাদের মতো চেহারা করে স্ত্রীর দিকে তাকাল। ইংরেজিটা তার চেয়ে স্ত্রী বেশি জানে, এজন্য টেলিফোন ধরার কাজটাও সে-ই করে।

‘আমি কি চার্লির সঙ্গে কথা বলতে পারি?’ একটা মেয়ের সাদামাটা, অনুচ্চ গলা ভেসে এল ওপাশ থেকে।

‘তুমি কোন নাম্বার চাচ্ছ? ... উঁহু, ভুল নম্বরে ফোন করেছ।’

আস্তেধীরে ফোনটা নামিয়ে বুকে হাত রাখল সে। ‘ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।’

স্বামীর মুখে হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠল, ফের নিজের স্বগতোক্তিতে ফিরে গেল সে। দিনের আলো ফুটলেই ছেলেকে নিয়ে আসবে। যাতে বিপদ না ঘটায় সেজন্য সবগুলো ছুরি একটা ড্রয়ারে তালা মেরে রাখা হবে। অবশ্য সবচেয়ে খারাপ অবস্থাতেও কখনো অন্যদের জন্য বিপদ হয়ে ওঠেনি ছেলে।

দ্বিতীয়বারের মতো বেজে উঠল ফোনটা।

সেই একই, নিস্তেজ আর উদ্বিগ্ন গলায় চার্লিকে চাইল মেয়েটা।

‘তোমার নম্বরটা ভুল। ভুলটা কোথায় করেছ বলছি। শূন্য ঘোরাতে গিয়ে ‘ও’অক্ষরটাকে ঘোরাচ্ছ।’ বলে ফোনটা রেখে দিল স্ত্রী।

মধ্যরাতের অপ্রত্যাশিত, আনন্দময় চায়ের আসরে বসল তারা। শব্দ করে চা খেল স্বামী, চেহারায় উত্তেজনার ভাব। খানিক পরপর চায়ের গেলাসসহ হাতটা উপরে তুলে চক্রাকারে ঘোরাচ্ছে, চিনিটা যাতে চায়ের সাথে পুরোপুরি মেশে। টেকোমাথার একপাশের শিরা স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, গালে খোঁচা খোঁচা রূপালি দাড়ি। ছেলের জন্মদিনের উপহারটা টেবিলের ওপর রাখা। স্ত্রী আরেক কাপ চা ঢেলে দিচ্ছে, এই ফাঁকে চোখে চশমা লাগিয়ে উজ্জ্বল হলুদ, সবুজ আর লাল বয়ামগুলোকে জরিপ করল খোশমেজাজে। তার বদখত, পুরুষ্ট দুই ঠোঁট জারের গায়ে লাগানো লেবেলগুলো পড়তে আরম্ভ করল- খোবানি, আঙ্গুর, আলুবোখারা, নাশপাতি। পড়তে পড়তে আপেল পর্যন্ত গেছে, এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল আবার।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

5 মন্তব্যসমূহ

  1. অনবদ্য গল্প। সুপাঠ্য অনুবাদ। ধন্যবাদ। মূল গল্পটির নাম জানতে আগ্রহী।

    উত্তরমুছুন
  2. Signs and Symbols. যদিও দ্য নিউ ইয়র্কার পত্রিকায় প্রথম যখন (১৯৪৮) ছাপা হয়েছিল তখন নাম ছিল Symbols and Signs. নবোকভ পরে পাল্টে Signs and Symbols করেন।

    উত্তরমুছুন
  3. সাবলীল এবং পরিচ্ছন্ন অনুবাদ। মনেই হলো না মূল গল্প পড়ছি না। অনুবাদককে অভিনন্দন।

    উত্তরমুছুন
  4. অসাধারণ গল্প, দারুণ সুখপাঠ্য অনুবাদ।

    উত্তরমুছুন
  5. বুদ্ধিমতী মহিলা। মধ্যরাতে ছেলের মৃত্যুর খবর উদ্বিগ্ন স্বামী শুনলে যে বিপদ হবে তা অনুধাবন করতে পারে স্ত্রী সে খবর এড়িয়ে যায়। মায়েরা অন্তঃকরণে দুঃখ রেখে স্বাভাবিকতার ভান ধরে পরিস্থিতির প্রয়োজনে। আমরা মায়েদের জন্য ধন্য । চার্লি সাহেবরও ধন্য হওয়ার সুযোগ রয়েছে তার স্ত্রীর জন্য ।

    উত্তরমুছুন