অনুবাদঃ মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
“সংসারের কাজ করার বয়স হয়েছে তোমার,” মা বলল। তারপর পকেট থেকে একটা রূপার আধুলি বের করে দিয়ে বলল,” যাও, কিছু মটরশুঁটি কিনে নিয়ে এসো। রাস্তায় গিয়ে আবার খেলতে চলে যেয়ো না। আর গাড়ি থেকে দূরে থেকো।
আমি থালা নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। চপ্পল পরে। গুনগুণ করতে করতে। মটরশুঁটির দোকানের সামনে ভিড়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। তারপর ভিড়ের ফাঁক দিয়ে মার্বেল কাউন্টারের কাছে পৌঁছে গেলাম।
“আমাকে এই আধুলির পরিমাণে মটরশুঁটি দাও,” আমি চিকন কণ্ঠে চিৎকার করলাম।
“শুধুই মটরশুঁটি? তেল, বাটার এগুলো নেবে না?”
আমি কোনো উত্তর করলাম না। রাগত স্বরে দোকানদার বলল,” সরে যাও। অন্যদেরকে নিতে দাও।“
আমি কোনো উত্তর করলাম না। রাগত স্বরে দোকানদার বলল,” সরে যাও। অন্যদেরকে নিতে দাও।“
আমি সরে এলাম। অপ্রস্তুতভাব ঝেড়ে ফেলে মায়ের কাছে ফিরে এলাম। পরাজিত হয়ে।
“খালি থালা নিয়ে ফিরে এসেছ?” মা চিৎকার করে বললেন।
“কী করেছ? মটরশুঁটিগুলো ফেলে দিয়েছ, নাকি আধুলিটা হারিয়েছ, দুষ্ট ছেলে?”
“তুমি তো আমাকে বলোনি যে, শুধু মটরশুঁটি আনতে হবে, নাকি রান্নার তেল ও বাটারও আনতে হবে,” আমি প্রতিবাদ করলাম।
“গাধা ছেলে! প্রতিদিন সকালে তুমি কী খাও?”
“আমি জানি না।“
“অপদার্থ। যাও, গিয়ে দোকানদারকে মটরশুঁটি ও তেল দিতে বলো।“
ফিরে গেলাম। দোকানীকে বললাম, “এই আধুলি দিয়ে আমাকে মটরশুঁটি ও তেল দাও।“
অসহিষ্ণুভাবে সে জিজ্ঞেস করল,”তিসির তেল, সয়াবিন তেল, নাকি অলিভ তেল?”
আমি ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম। আবার কোনো উত্তর করতে পারলাম না।
“সরে গিয়ে অন্যজনকে জায়গা দাও,” সে আমাকে লক্ষ্য করে চিৎকার করল।
আমি রাগান্বিত হয়ে মায়ের কাছে ফিরে এলাম। তিনি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,”তুমি আবার খালিহাতে ফিরে এসেছ?”
“তিসির তেল, নাকি সয়াবিন তেল, নাকি অলিভ তেল?” আমাকে এগুলো কিছুই বলে দাওনি। আমি রেগে গিয়ে বললাম।
“মটরশুঁটির সাথে তেল মানেই হলো তিসির তেল।“
“আমি কীভাবে জানব?”
“তোমাকে দিয়ে আসলেই কিছু হবে না। দোকানদার সেই লোকটিও দেখি খুবই ত্যান্দোড়। যাও, তাকে গিয়ে বলো মটরশুঁটির সাথে যে তিসির তেল ব্যবহার করে, তুমি সেটাই চাও।“
আমি দ্রুত চলে গেলাম। দোকান থেকে কয় গজ দূরে থাকতেই বললাম, “মটরশুঁটির সাথে ব্যবহার করার তিসির তেল।“
“আধুলিটা কাউন্টারে রাখো,” দোকানী মটরশুঁটির পাত্রে হাতা ঢুকাতে ঢুকাতে বলল।
আমি আমার পকেটে হাত দিলাম। কিন্তু আধুলিটা পেলাম না। অস্থিরভাবে খুঁজলাম। পকেটকে উল্টো করে ভেতরের দিকটা বাইরে নিয়ে এলাম। কিন্ত সেটার কোনো খোঁজই পাওয়া গেল না। লোকটি হাতা উঠিয়ে নিয়ে প্রবল বিতৃষ্ণার সাথে বলল,”আধুলিটি তুমি নিশ্চয়ই হারিয়ে ফেলেছ। তোমার মতো অর্বাচীন বালকের ওপরে নির্ভর করা উচিৎ হয়নি।“
“আমি ওটা হারাইনি,” পায়ের নীচে ও চারদিকে তাকাতে তাকাতে বললাম। “ওটা সারাক্ষণ আমার পকেটেই ছিল।“
“অন্যজনকে আসতে দাও। আমাকে আর বিরক্ত করো না।“
মায়ের কাছে আবার খালি থালা নিয়ে ফিরে গেলাম।
“হায় আল্লাহ, তুমি তো দেখছি আসলেই একটা হাবাগোবা!”
“ আধুলিটা ...”
“আধুলিটা কী?”
“সেটি আমার পকেটে নেই।“
“কেনো? তুমি কি ওটা দিয়ে চকোলেট কিনে খেয়েছ?”
“কসম, আমি চকোলেট কিনিনি।“
“ তাহলে কীভাবে তুমি ওটা হারালে?”
“আমি জানি না।“
“তুমি কি কোরান ছুঁয়ে বলতে পারবে যে, ওটা দিয়ে তুমি কিছুই কেনোনি?”
“আমি কোরানের শপথ করে বলছি।“
“তোমার পকেটে কি কোনো ছিদ্র আছে?”
“না।“
“হয়ত তুমি লোকটিকে প্রথম বা দ্বিতীয়বার আধুলিটি দিয়েছ।“
“হতে পারে।“
“তুমি কি কোনোকিছুই নিশ্চিত করে বলতে পারো না?”
“আমার খুব ক্ষিধে পেয়েছে।“
মা দুই হাতের তালু বাজাল। হতাশার প্রতীক হিসেবে।
“ঠিক আছে, আমি তোমাকে আরেকটা আধুলি দিচ্ছি। তোমার টাকার ব্যাংক থেতে। এবার যদি তুমি খালি থালা নিয়ে ফিরে আসো, তবে আমি তোমার মাথা ভাঙব।“
আমি দ্রুত ছুটে গেলাম। সুস্বাদু নাশতার স্বপ্ন দেখতে দেখতে। গলিপথের মোড়ে যেখানে মটরশুঁটির দোকানী ছিল, সেখানে আমি বাচ্চাকাচ্চাদের ভিড় দেখতে পেলাম। তাদের আনন্দিত চেঁচামেচি শুনতে পেলাম। তাদের দিকে আমার মন আকর্ষিত হলে, পা দুটোও সেদিকে আমাকে টেনে নিয়ে গেল। আমি চাচ্ছিলাম মুহূর্তের জন্যে হলেও ওখানে কী ঘটছে তা দেখতে। তাদের ভিড়ে মিশে গেলাম। দেখতে পেলাম এক জাদুকর জাদু দেখাচ্ছে। আমি কাছে যেতেই সে আমার দিকে সোজা তাকাল। বোকামীপূর্ণ আনন্দ আমাকে পেয়ে বসল। আমি সমস্ত সত্তা দিয়ে তার খরগোশ ও ডিম এবং সাপ ও দড়ির খেলা দেখায় মেতে উঠলাম। লোকটি যখন টাকা সংগ্রহের জন্যে আমার দিকে এগিয়ে এলো, আমি তখন পিছু হটতে হটতে বললাম, “আমার কাছে কোনো টাকা নেই।“ সে বন্যভাবে আমার দিকে ছুটে এলো। আমি খুব কষ্টের সাথে তার কাছ থেকে পালালাম। তার প্রচন্ড ঘুষিতে আমার পিঠের মেরুদণ্ড প্রায় ভেঙে যাচ্ছিল। কিন্তু তারপরেও আমি খুশি হলাম একারণে যে, আমি সেখান থেকে দৌড়ে মটরশুঁটির দোকানীর কাছে আসতে পেরেছিলাম।
“এই আধুলি নিয়ে আমাকে মটরশুঁটি ও তিসির তেল দাও,” আমি বললাম।
সে আমার দিকে তাকাল, কিন্তু নড়ল না। আমি পুনরায় তাকে অনুরোধ করলাম।
“আমাকে থালাটা দাও,” সে রাগত স্বরে চাইল।
থালা! কোথায় থালা? আমি কি দৌড়ানোর সময়ে ফেলে দিয়েছি? নাকি যাদুকর ওটা নিয়ে চলে গেছে?
“এই ছেলে, তোমার দেখি কাজকর্মে একেবারেই মনোযোগ নেই!”
আমি আগের পথে ফিরে গেলাম। হারিয়ে যাওয়া থালা খুঁজতে খুঁজতে। যে জায়গায় জাদুকর ছিল, সেখানটা খালি। তবে শিশুদের কণ্ঠস্বর অনুসরণ করে আমি পাশের গলিতে গেলাম। আমি গলিমুখের বৃত্তের চারপাশ দিয়ে ঘুরছিলাম। এই সময়ে জাদুকর আমাকে দেখতে পেল। চিৎকার করে সে আমাকে বলল,”টাকা দাও অথবা ভেগে যাও এখান থেকে।“
“থালা!” আমি হতাশাভরা গলায় চিৎকার করে বললাম।
“কিসের থালা, শয়তান ছেলে?”
“আমার থালা ফেরত দাও।“
“ভাগো এখান থেকে। নইলে তোমাকে আমি সাপের খাবার বানাব।“
আমি নিশ্চিত সেই আমার থালা চুরি করেছে। তারপরেও ভীত হয়ে আমি তার সামনে থেকে চলে এলাম এবং পথের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদতে শুরু করলাম। যখনি কোনো পথচারী আমাকে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করল, তাকেই বললাম,” জাদুকর আমার থালা চুরি করেছে।“
এই বিপদের সময়ে একজন এসে আমাকে বলল,” আমার সাথে এসো। পীপ শো (peep show) দেখবে।“
পেছন ফিরতেই দেখতে পেলাম সেখানে একটি বায়োস্কোপ দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমি প্রায় এক ডজন শিশুকে সেদিকে দৌড়ে যেতে দেখলাম। তারা সবাই পীপহোলের পেছনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াচ্ছিল। এবং লোকটি ছবিগুলোর ওপর উত্তেজনাপূর্ণ বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছিল।
“এখন তোমাদের সামনে দেখতে পাচ্ছ একজন সাহসী যোদ্ধা এবং আরবের সবচেয়ে সুন্দরী নারী জয়নাত আল বানাত’কে।"
আমার চোখের অশ্রু শুকিয়ে গেল। মুগ্ধ হয়ে বাক্সটির দিকে তাকালাম। যাদুকর ও থালার কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেলাম। লোভ সামলাতে না পেরে আধুলিটি তাকে দিয়ে একটি পীপহোলের সামনে তাকালাম। আমার পাশের পীপহোলটির সামনে একটি মেয়ে ছিল। জাদুময় ছবি-গল্পগুলো আমাদের দুজনের চোখের সামনে দিয়ে প্রবাহিত হতে লাগল।
আমি যখন বাস্তব পৃথিবীতে ফিরে এলাম, তখন বুঝতে পারলাম যে, আমার আধুলি ও থালা দুটোই গেছে। জাদুকরকেও কোথাও দেখা যাচ্ছে না। যাই হোক, বায়োস্কোপে দেখা বীরত্ব, ভালোবাসা ও সাহসিকতা এতটাই মুগ্ধতা সৃষ্টি করেছিল আমার ভেতরে যে, তুচ্ছ কোনো বিষয় নিয়ে কোনো ভাবনাই আমার মাথার ভেতরে কাজ করল না। কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে আমি একটা প্রাচীন দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম। দেয়ালটি ছিল এই শহরের এক সময়কার প্রধান বিচারক ও রাজস্ব কর্মকর্তার অফিস। বর্তমানে পরিত্যাক্ত। অনেক সময় ধরে আমি শৌর্যবীর্য, জয়নাত আল বানাত ও পিশাচ নিয়ে দিবাস্বপ্নে মেতে উঠলাম। স্বপ্নের মধ্যে চিৎকার করে কথা বললাম। অঙ্গভঙ্গি করলাম, নিজের কথাগুলোকে অর্থ দেওয়ার জন্যে। তারপর একটা কাল্পনিক বর্শা নিয়ে পিশাচের হৃদপিণ্ডের দিকে ছুঁড়ে মারলাম। বললাম, “মরো, তুমি!” পিশাচ জায়নাত আল বানাতকে ঘোড়ার পিঠে তুলে পেছনে বসিয়ে আমার কাছে এলো। নরম স্বরে কথা বলল আমার সাথে।
ডানে তাকাতেই সেই মেয়েটিকে দেখতে পেলাম যে, আমার পাশের পীপহোলে ছবি দেখছিল। সে একটা ময়লা জামা ও রঙিন চপ্পল পরেছিল। একহাতে সে তার লম্বা চুলের বেণী ধরে খেলছিল। অন্য হাত দিয়ে সে লাল ও সাদা রঙের একটা চকলেট চুষছিল। আমি চকোলেটটি চিনি। এর নাম ‘লেডিস ফ্লিস’ (Lady’s Fleas)। আমরা পরস্পরের সাথে দৃষ্টিবিনিময় করলাম। এবং পরের মুহূর্তেই আমি তার প্রেমে পড়ে গেলাম।
“এসো আমরা বসে গল্প করি,” আমি তাকে প্রস্তাব দিলাম।
মনে হলো যে, আমার প্রস্তাব তার পছন্দ হয়েছে। সুতরাং তাকে বাহুতে জড়িয়ে আমি প্রাচীন দেয়ালের দরজার অন্যদিকে চলে গেলাম। সেখানে একটি সিঁড়িপথের গোঁড়ায় গিয়ে বসলাম। সিঁড়িপথটি সোজা ওপরের দিকে চলে গিয়েছিল এবং একটি প্ল্যাটফর্মে শেষ হয়েছিল। প্ল্যাটফর্মটির পেছনে নীল আকাশ ও একটা বিশাল মিনার দেখা যাচ্ছিল। আমরা নীরবে সেখানে পাশাপাশি বসে থাকলাম। আমি তার হাতে চাপ দিলাম। দুজনের কেউই বুঝে উঠতে পারছিলাম না কী বলা উচিৎ আমাদের। নতুন ধরণের অনুভূতির মুখোমুখি হলাম আমি। অদ্ভুত ও অস্পষ্ট অনুভূতি। মেয়েটির মুখের কাছে মুখ নিয়ে আমি তার চুলের গন্ধ শুঁকলাম। সেগুলোতে ধূলার গন্ধের সাথে তার নিঃশ্বাস ও মিষ্টির গন্ধ মিশেছিল। আমি তার ঠোঁটে চুমো দিলাম। তারপর নিজের লালা গিলে ফেললাম। এতে ‘লেডিস ফ্লিস’ চকোলেটের মিষ্টি গন্ধ লেগেছিল। আর কোনো কথা না বলে দুই বাহু দিয়ে আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম। গালে ও ঠোঁটে চুমু খেলাম। তার ঠোঁট স্থির হয়ে আমার চুমু গ্রহণ করল। এবং আবার চকোলেট চুষতে লাগল। অবশেষে সে চলে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়াল। আমি অস্থিরভাবে তার হাত চেপে ধরলাম। বললাম,”বসো।“
“আমি চলে যাচ্ছি।“ সে সহজভাবে উত্তর দিলো।
“কোথায় যাবে?” আমি মনখারাপ করে বললাম।
“ধাত্রী উমা আলি’র বাড়িতে,” বলে সে একটা বাড়ির দিকে আঙুল দিয়ে দেখাল। বাড়ির নীচতলায় একটা ছোটো কাপড় ইস্ত্রির দোকান ছিল।
“কেনো?”
“বাড়িতে আমার মা ব্যথায় কাঁদছে। সে আমাকে বলেছে উম আলীকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে।“
“তাকে তোমার মায়ের কাছে রেখে কি তুমি এখানে ফিরে আসবে?”
সে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল এবং চলে গেল। তার মায়ের কথায় আমাকে নিজের মায়ের কথা মনে করিয়ে দিলো। এবং মুহূর্তের জন্যে আমার হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেল। প্রচীন সিঁড়ি থেকে উঠে আমি বাড়ির দিকে যাওয়া শুরু করলাম। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে। শুধু এভাবেই আমি নিজেকে রক্ষা করতে পারি।
আশা করেছিলাম যে, গিয়েই মায়ের সাথে দেখা হবে। কিন্তু তাকে দেখতে পেলাম না। রান্নাঘর থেকে শোবার ঘর পর্যন্ত খুঁজলাম। কিন্তু কোথাও তার চিহ্নও দেখতে পেলাম না। মা কোথায় গিয়েছে? কখন ফিরে আসবে? খালি ঘরে অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। এই পর্যায়ে একটা পরিকল্পনা এলো মাথার ভেতরে। রান্নাঘর থেকে আরেকটি থালা এবং আমার বাঁচানো টাকা থেকে আরেকটি আধুলি নিলাম। দ্রুত মটরশুঁটির দোকানে গেলাম। দোকানীকে দেখতে পেলাম দোকানের বাইরে একটি বেঞ্চের ওপরে ঘুমিয়ে আছে। মুখের ওপরে হাত দিয়ে। মটরশুঁটির পাত্রটা সেখানে নেই। তেলের বোতলটা তাকের ওপরে রাখা। মার্বেলের কাউন্টারটিকেও ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়েছে।
আমি ফিসফিস করে তাকে ডাকলাম। কিন্তু সে কিছুই শুধু শুনল না। শুধু নাক ডাকতে থাকল। আমি তার কাঁধ স্পর্শ করলাম। সে হতচকিত হয়ে ভয়ে তার হাত তুলল। এবং লাল হয়ে যাওয়া চোখে আমার দিকে তাকাল।
“শুনছ?“
“কী চাও তুমি?” রাগতস্বরে সে জিজ্ঞেস করল। আমাকে সে চিনতে পেরেছে।
“এক আধুলি পরিমান মটরশুঁটি, সাথে তিসির তেল।“
“হুম”
“আমি আধুলি আর থালা নিয়ে এসেছি।“
“শয়তান ছেলে,” সে চিৎকার করে বলল,” ভাগো এখান থেকে। নতুবা তোমার মাথা ভাঙব।“
আমি না নড়লে সে আমাকে জোরে ধাক্কা দিলো। এত জোরে যে, আমি পিঠের ওপরে ডিগবাজী খেলাম। প্রবল ব্যথা নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ঠোঁট চেপে কান্না থামানোর চেষ্টা করলাম। একহাতে থালা ও অন্যহাতে আধুলি ধরে রাখলাম। শক্ত করে। তার দিকে রেগে তাকালাম। তারপর নিরাশ হয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার চিন্তা করলাম। কিন্তু স্বপ্নের বীরত্ব ও সাহস আমার পরিকল্পনাকে বদলে দিলো। মন শক্ত করে আমি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলাম। তার দিকে থালা ছুঁড়ে দিলাম। বাতাসের ভেতর দিয়ে উড়ে গিয়ে সেটা তার মাথায় আঘাত করল। আমি পালিয়ে এলাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে আমি তাকে হত্যা করেছি। বীর যোদ্ধারা যেভাবে পিশাচকে হত্যা করে, সেভাবে। প্রাচীন দেয়ালের কাছ পর্যন্ত আসার আগে আমি থামলাম না। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে পেছনে তাকালাম। কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলাম না আমাকে অনুসরণ করতে। শ্বাস নেওয়ার জন্যে থামলাম। তারপর নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম দ্বিতীয় থালা হারানোর পর আমার কী করা উচিৎ। কিছু একটা আমাকে সতর্ক করল সরাসরি বাড়িতে না ফিরতে। এখন বাড়ি ফেরার অর্থ হবে শাস্তি পাওয়া। সিদ্ধান্ত নিলাম ফিরে যাওয়ার পর আমি অভিনয় করব যে, আমি কোনো ভুল করেছি কিনা, সেটাও ভুলে গেছি। তার আগে ভালো হবে যদি আমি আরো কিছুটা মজা করে নিতে পারি। কিন্তু জাদুকর কোথায়? কোথায় বায়োস্কোপ দেখানো হচ্ছে? সবখানে খুঁজলাম। কিন্তু কোথাও তাদেরকে পেলাম না।
ব্যর্থ অনুসন্ধান শেষে আমি প্রাচীন দেয়ালের ওপারের সিঁড়ির কাছে ফিরে গেলাম। মেয়েটির সাথে দেখা করার জন্যে। বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কল্পনা করতে লাগলাম সাক্ষাতের। আমি তাকে আরেকবার চুমু খেতে চাচ্ছিলাম। মিষ্টির সুগন্ধিময়। অনুভব করলাম যে, ছোট্ট মেয়েটি আমাকে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশী আনন্দাভূতি দিয়েছিল। আমি সতর্কভাবে সিঁড়ি দিয়ে উঠে উপরের প্লাটফর্মে পৌঁছলাম। পিঠের উপরে চিত হয়ে শুলাম। দেখার জন্যে সে তারপরে কী আছে। দেখলাম কিছু ধ্বংসাবশেষ উঁচু দেয়ালটিকে ঘিরে আছে। সবশেষে আছে প্রধান বিচারক ও রাজস্ব কর্মকর্তার অফিসের ধ্বংসাবশেষ। আরো দেখতে পেলাম সিঁড়ির ঠিক নীচে বসে আছে একজন পুরুষ ও নারী। তাদের দিক থেকে কিছু ফিসফিস শব্দ ভেসে আসছিল। লোকটাকে দেখে মনে হলো একজন ভবঘুরে। মেয়েটিকে মনে হলো জিপসি মেয়ে। ভেড়া প্রতিপালন করে। আমার ভেতর থেকে একটা সন্দেহজনক কণ্ঠস্বর আমাকে বলল যে, তাদের এই সাক্ষাতকারটা কিছুক্ষণ আগের আমার আর ছোট্ট মেয়েটির সাক্ষাৎকারের মতো। তাদের ঠোঁট ও চোখের দৃষ্টিও তাই বলছিল। কিন্তু তারা তাদের কল্পনাতীত কাজে আশ্চর্য রকমের দক্ষতা প্রদর্শন করল। প্রবল ঔৎসুক্য, বিস্ময়, আনন্দময়তা ও কিছুটা অশান্তি নিয়ে আমি তাদের দিকে মনোনিবেশ করলাম। গভীরভাবে। অবশেষে তারা পাশাপাশি বসল। কেউ কাউকে খেয়াল করল না। কিছুক্ষণ পর লোকটি বলল,”টাকা!”
“তুমি কখনোই সন্তুষ্ট হও না, “ মহিলাটি বিরক্তিসহকারে বলল।
মাটিতে থুথু ফেলে লোকটি বলল,”তুমি একটা পাগলী।“
“তুমি একটা চোর।“
সে মহিলাটিকে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে থাপ্পড় কষালো। মহিলাটিও একমুঠো মাটি নিয়ে লোকটির মুখে ছুঁড়ে দিলো। লোকটি ধুলিমাখা মুখে তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং তার টুঁটি চেপে ধরল। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। দুজনের ভেতরে। লোকটির হাতের চাপ থেতে রক্ষা পাওয়ার সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হলো মহিলাটির। তার কণ্ঠ দিয়ে স্বর বের হলো না। চোখের কোটর থেকে মণি বের হয়ে গেল। পা বাতাসের ভেতরে শূন্যে ঝুলতে থাকল। বোবা ভয়ে আমি দৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। যতক্ষণ পর্যন্ত না তার মুখ দিয়ে রক্ত বেয়ে পড়ল। আমার মুখ থেকে একটা চিৎকার বেরিয়ে গেল। লোকটি মাথা তোলার আগেই আমি পেছনে সরে আসলাম।
তারপর লাফ দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে পাগলের মতো ছুটলাম। যেদিকে দৃষ্টি যায়। শ্বাস বন্ধ হবার আগ পর্যন্ত থামলাম না। চারপাশ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই নেই। সম্বিত ফিরে পাওয়ার পর আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা চৌরাস্তার মোড়ে। উঁচু একটা ছাদের নীচে। এই জায়গাটিতে ইতিপূর্বে আমি কখনোই আসিনি। আমার কোনো ধারণাই নেই আমাদের বাসা থেতে জায়গাটি কতদূরে। এর দুইদিকেই দৃষ্টিহীন অন্ধ মানুষেরা বসেছিল। চারদিক থেতেই লোকজন আসছিল। কিন্তু তারা কেউই কারো দিকে খেয়াল করছিল না। ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় আমি বুঝতে পারলাম আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি। বাড়িতে ফিরে যেতে আমাকে অসংখ্য প্রতিবন্ধকতা পেরুতে হবে। আমি কি কোনো পথচারীকে জিজ্ঞেস করব পথ দেখানোর জন্যে? কী হবে তাতে? কেউ যদি আমাকে আবার মটরশুটি বিক্রেতা বা ভবঘুরে লোকটির কাছে পাঠিয়ে দেয়? তখন কি কোনো অলৌকিক কিছু ঘটবে? মাকে দেখতে পেয়ে তার দিকে ছুটে যাব? নাকি আমার উচিৎ হবে ঘুরে বেড়ানো, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি পরিচিত কোন ল্যান্ডমার্কে পৌঁছই। যেটা আমার যাওয়ার দিককে নির্দেশ করবে। আমি নিজেকে বললাম দ্রুত একটা দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে। কারণ, দিন শেষ হয়ে আসছে। অন্ধকার নেমে আসবে এখনই।
-------------
-------------
মূলঃ ‘The Conjurer Made off with the Dish’ by Naguib Mahfouz ( Naguib Mahfouz Abdelaziz Ibrahim Ahmed Al-Basha was an Egyptian writer who won the 1988 Nobel Prize for Literature) and this story Translated by Denys Johnson Davies.
লেখক পরিচিতি: খ্যাতনামা মিশরীয় লেখক নাগিব মাহফুজের জন্ম কায়রোতে ১৯১১ সালে। তাঁর অসাধারণ সৃষ্টিকর্মের জন্য তিনি ১৯৮৮ সালে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। আরবি ভাষাভাষী লেখদের মধ্যে তিনিই প্রথম নোবেল জয়ী লেখক। নাগিব মাহফুজ শতাধিক ছোটোগল্প এবং ত্রিশটির মতো উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস 'কায়রো ট্রিলজি' প্রকাশিত হয় ১৯৫৭ সালে। ২০০৬ সালে নাগিব মাহফুজ মৃত্যু বরণ করেন।
মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
অনুবাদক। প্রাবন্ধিক
বাংলাদেশে থাকেন।
6 মন্তব্যসমূহ
অসাধারন একটি গল্প ও ভীষন প্রাণবন্ত অনুবাদ
উত্তরমুছুনআপনার করা সুন্দর অনুবাদ গল্পটিকে টানটান রেখেছে। চমৎকার!
উত্তরমুছুনগল্পপাঠ-কে ধন্যবাদ। এই অনুবাদকের আরও অনুবাদ প্রকাশ করবেন, অনুরোধ রইল।
অসাধারণ আসাদ ভাই।
উত্তরমুছুনসত্যি অসাধারণ ভাবানুবাদ। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলেছি। ধন্যবাদ অনুবাদক।
উত্তরমুছুনগল্পটি অসাধারণ।
উত্তরমুছুনবাহ্ কত সরলপাঠ করে করা অনুবাদ
উত্তরমুছুন