পূরবী বসু
বিক্রমপুরের
এক গ্রাম। নাম দিঘলী। দিঘলী গ্রামে থাকে এক মেয়ে। বয়স বাইশ-তেইশ। হাইস্কুল শেষ করে
স্থানীয় কলেজে এক দু’বছর অনিয়মিত
পড়াশোনা করেছে। পরীক্ষা টরীক্ষা দেয়নি। এর বেশি আর কখনো বা অন্যত্র কিছু পড়াশোনা
করেনি। ঘরের কাজকাম মোটামুটি সব-ই করতে পারে। দেখতে তেমন আহামরি কিছু নয়। তবে
তারুণ্যের সাধারণ একটি দীপ্তি রয়েছে। বিয়ে হয়নি এখনো। তবে গ্রামের এক যুবককে সে
পছন্দ করে। তরুণটিও খুব ভালোবাসে তাকে।
সেই শিশুকাল
থেকে মেয়েটির একটাই কেবল স্বপ্ন। একটাই আশা, লক্ষ্য, সখ, যা কিছু বলা
যায়। সে আমেরিকা যেতে চায়। যেতে চায় কথাটা ঠিক হলো না। আমেরিকায় যেতে তাকে হবেই।
সেটাই তার একমাত্র গন্তব্য - ঠিক পরের পদক্ষেপ-ই সেটা। তাদের মত পরিবার থেকে
কীভাবে, কার সাহায্য নিয়ে বা পেয়ে সেই স্বপ্ন পূরণ
করা সম্ভব হবে সে জানে না। কিন্তু শুধু জানে, আমেরিকায়
তাকে যেতেই হবে। বিয়ে করে সংসারী হবার জন্যে মা-বাবার প্রস্তাব বা চাপ তাই সে কানে
নেয় না। এমন কি তার প্রেমিকের নিবিড় সাহচর্যে থাকার সময়ে, তার দুই পেশীবহুল বাহুর মাঝে পিষ্ট হতে
হতেও তার বিশেষ আকুতি তাকে টলাতে বা পথভ্রষ্ট করতে পারে না। তার প্রিয় মানুষটির
কাছে অন্যথায় সম্পূর্ণ বিবেচিত মেয়েটি বিয়ের কথা, এই দিঘলী
গ্রামে আটকা পড়ে যাওয়ার কথা শুনলেই প্রিয়তমের বাহুবন্ধন থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে। না, বিয়ে নয়, বিদেশে যেতে
হবে তাকে। আর অন্য কোন কিছু করার আগে, অন্য কিছু
ভাবার আগেই তাকে বেরিয়ে পড়তে হবে বিদেশের উদ্দেশ্যে। আর সেটা যে কোন বিদেশ নয়। খোদ
আমেরিকা। সেখানেই যেতে হবে তাকে। শুধু একটাই তো স্বপ্ন বা সাধ তার। এটুকু পূরণ হবে
না?
তার স্বপ্নে, সাধে, একাগ্রতায়
এবং সিদ্ধান্তে এতোটা অবিচল দেখে একদিন ঈশ্বর বাধ্য হয়ে তার স্বপ্ন পূরণ করার
অঙ্গীকার করলেন। কিন্তু তার সখমতো এতা বড় দাবী তিনি মেটাবেন, আর বিনিময়ে মেয়েটি কিছুই ছাড় দেবে না, সেটা তো হয় না। কিছু স্বার্থত্যাগ তো তাকে
করতেই হবে। তার মানে, কিছু রেখে
দিয়ে যেতে তাকে হবে পেছনে তার স্বদেশে।
অবশেষে
ঈশ্বরের কথামতো সে তার ছায়াটিকে দেশে রেখে যেতে রাজি হলো। কিন্তু কার কাছে রেখে
যাবে সে তার নিজস্ব এই সম্পদ, যার কানাকড়ি
মূল্য তার কাছে বা অন্য কারো কাছে আছে বলে সে মনে করে না। ফলে নির্দিষ্ট দিনে, নিজের ছায়াটিকে প্রেমিকের কাছে রেখে
মেয়েটি উড়োজাহাজে চড়ে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরে চলে এলো। আসার সময় প্রেমিককে বলে এল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে তার বিদেশে বৈধভাবে
থাকার কাগজপত্র যোগাড় করেই তার ভালোবাসার পাত্রটিকে সেখানে নিয়ে যাবে। কাগজ
পাঠালেই তার প্রিয়ার ছায়াসহ সে বিশাল উড়োজাহাড় চড়ে এসে তার সঙ্গে মিলিত হবে নিউ
ইয়র্ক শহরে।
ঈশ্বর যখন
তার বিদেশে যাবার অভিলাষ পূরণের প্রাথমিক শর্ত হিসেবে, অর্থাৎ তার আজীবন লালিত চাওয়ার প্রাপ্তির
বিনিময়ে তাকেও কিছু স্বার্থত্যাগ করতে বলেছিল, মেয়েটি কখনো
ভাবেনি, অন্য আর কিছু নয়, তার ছায়াটিকেই দেশে রেখে যেতে বলা হবে।
সে মনে মনে
ভাবার চেষ্টা করেছে, কী দিতে হতে
পারে তার? কী-ই বা আছে তার মতো সাধারণ একটি মেয়ের
যার বদলে ঈশ্বর এতো বড় একটা জিনিস, তার সারা
জীবনের একমাত্র চাওয়া পূর্ণ করবেন? কী হোতে
পারে সেই জিনিস যার বদলে সে তার স্বপ্নের দেশে উড়ে যেতে সক্ষম হবে?
ঈশ্বর তখন
একটু ভেবে বললেন, ‘তোমার
ছায়াখানা ছাড়তে হবে। আজ থেকে তোমার সঙ্গে সঙ্গে সর্বক্ষণ আর তোমার ছায়া ঘুরে
বেড়াবে না। তুমি আর ছায়া এখন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তোমার ছায়া রয়ে যাবে তোমার
দেশে, তোমার প্রেমিকের কাছে গচ্ছিত। এই ছায়া
ফিরে পেতে হলে আবার তোমাকে স্বদেশে ফিরে আসতে হবে। বিদেশ ফেলে। চিরকালের জন্যে।”
মেয়ে ভাবে, এটা কী আর এমন বেশি দেওয়া হলো। তার
প্রাপ্তির সংগে তুলনা করলে এতো নগণ্য। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল মেয়েটি। মহা
খুশিতেই। ছায়া তো আর কোন কাজে লাগে না দৈনন্দিন জীবনে। এতো তার চোখ, বা হাত, পা, মাথা নয়। ছায়া না থাকলে ক্ষতি কী?
কিন্তু তখন
সে বোঝেনি ছায়া শুধু সেটাই নয় যাকে সে এতোকাল দেখে আসছে; রোদে বা জ্যোৎ¯œায় দাঁড়ালে তার পিছু পিছু বা পাশে পাশে
ঘাসের ওপর বা বাঁধানো রাস্তার ওপর বিছানো এক খণ্ড কালো কাপড়ের বস্তুর মতো পড়ে
থাকতে; যার আকৃতি ঠিক তার হেলে পড়া শরীরের গড়নের
মতো। ছায়া সেটাই, যা সে চলতে
শুরু করলে তার সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে; যখন সে
হেঁটে যায়, সে হাঁটে; যখন দৌঁড়োয়, তখন ছায়াটিও দৌঁড়োয়। যখন সে থেমে যায়, ছায়াও তার পথচলা থামায়। ছায়া তাকে
সর্বক্ষণ অনুসরণ করে চলে, তার মতো
করেই হাতপা-মাথা-আঙ্গুল নাড়ায়, কিন্তু তার
সঙ্গে সঙ্গে কখনো কথা বলে না।
বিদেশে আগত
যাত্রী মেয়েটি ছায়া হারিয়ে প্রথমে মনে করে সে কিছুই হারায়নি। এতোবড় প্রাপ্তির
বিনিময়ে যেটুকু বিধাতা নিল তার কাছ থেকে তার তো কোন প্রয়োজন-ই নেই জীবনে। আসলে ওটা
ছিল তার শরীরের বাইরে অথচ শরীরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটা বাড়তি সংযোজন। সবচেয়ে বড়
কথা, ছায়াটি ছিল তার নিভৃতির অন্তরায়। কোথাও
কাউকে না বলে চুপি চুপি পা টিপে টিপে বেরিয়ে যাবার কোন উপায় ছিল না তার। তাকে দেখা
না গেলেও তার ছায়া কারো না কারো চোখে পড়তো-ই পড়তো। এখন সে একা। সম্পূর্ণ একা। ছায়া
দ্বারা পরিবৃত্ত নয়। সারাক্ষণ তার আরেক সত্তা, ছায়া
সর্বক্ষণ অনুসরণ করে বেড়ায় না তাকে।
কিন্তু
কিছুদিন গেলেই মেয়েটি টের পায়, ছায়া শুধু
ছায়া নয়, অর্থাৎ রোদে বা জ্যোৎ¯œায় তার পিছু পিছু চলা তার অবয়বের একটা
অস্পষ্ট কালো প্রতিফলন নয়। ছায়া তার চেয়েও বেশি কিছু।
সে বোঝে, ছায়ার সঙ্গে সে আরো অনেক কিছুই হারিয়েছে।
আয়নার সামনে বা শান্ত সরোবরের সামনে দাঁড়ালে নিজের প্রতিবিম্ব আজ আর দেখতে পায় না
মেয়েটি। সেখানে আজ ধূ ধূ শূণ্যতা। মাথা কুটলেও সে বুঝতে বা জানতে পারে না, সে দেখতে কেমন এখন। আজকে এই মুহূর্তেই বা
তাকে কেমন দেখাচ্ছে। একটু আগে বিয়ে বাড়িতে যাবার আগে তার ঠোঁটের ওপরে হালকাভাবে
যে রক্তাভ লিপস্টিক সে বুলিয়েছিল, সে জানে না
সেই লালচে রঙটি পাতলা ঠোঁট দুটো পেরিয়ে নাক আর ঠোঁটের মাঝখানের সরু অংশ পর্যন্ত
বি¯তৃত হয়ে আছে কিনা, বা সেখানে থ্যাবড়ে গিয়েছে কিনা। হাতে
আয়না। অথচ নিজেকে তার ভেতর দেখতে পায় না সে। লিপস্টিকটা যথার্থভাবে দেওয়া হয়েছে
কিনা, এ সামান্য জিনিসটুকুও আজ আর নিজের পক্ষে
জানার উপায় নেই তার। অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করতে হবে। মোট কথা, সে নিজে কে, কেমন সে
দেখতে, অন্যের কাছে তাকে কী রকম দেখাচ্ছে, শাড়ির সঙ্গে রঙ মিলিয়ে নীল রংÑএর টিপটা যে আজ দুপুরে পড়তে চেয়েছিল সে
কপালের ঠিক কেন্দ্রস্থলে, সেটা
সঠিকভাবে স্বস্থানে বসানো হয়েছে কিনা, এসব কোন
কিছু না জেনে, না বুঝতে পেরে, সবসময় অন্যের চোখ দিয়ে নিজেকে দেখতে গিয়ে
তার কেমন বিরক্তি এসে গেছে। এ কি কারো ভালো লাগে? এভাবে বেঁচে
থাকা যায়? না সে বেঁচে থাকার কোন অর্থ হয়?
দিন গেলে
মেয়েটি টের পায় ছায়াহীন সে আরো গভীরতর, আরো বড় কিছু
হারাতে বসেছে। সে বিদেশে এসেছে ঠিক-ই, কিন্তু বৈধ
কাগজপত্রের সন্ধান মেলা ভার। আজকাল সবকিছুই বেশ কঠিন হয়ে গেছে। অনেক বেশি কড়াকড়ি।
আগের মতো সহজ নেই আর। ঈশ্বরের দয়া বা কারসাজিতে তেমন পয়সাকড়ি ছাড়াই পাশের গ্রামের
ডিভি ভিসা পাওয়া যে যুবকের কাগজেকলমে পতœী সেজে সে
বিদেশে আসার সুযোগ পেয়েছিল, সে এদেশে
এসে এতো তাড়াতাড়ি তাকে পরিত্রাণ দেয়নি। বিদেশে আসার ছাড়পত্র সরবরাহ করে যে মস্ত বড়
উপকার করে ফেলেছে সে, তা কড়ায়গ-ায়
আদায় করে নিতে সে মেয়েটিকে নিজ শয্যায় যখন তখন টেনে নিতে দ্বিধা করেনি। মেয়েটির
আপত্তি বা অভিযোগে কর্ণপাত করেনি লোকটি। মেয়েটিরও প্রবলভাবে বাধা দেবার অধিকার বা
ক্ষমতা ছিল না। কেননা সে আইনসঙ্গতভাবেই এই যুবকের স্ত্রী, যদিও তাকে মোটেই পছন্দ করে না মেয়েটি।
ওদিকে দিঘলী
গ্রামে বসে, তার ছায়া গায়ে দিয়ে প্রতীক্ষারত তার
প্রকৃত প্রেমিক এতো দূরে বসেও মেয়েটির প্রতি এই শারীরিক নির্যাতন, এ অনাচার, মেয়েটির
পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বার বার এই লোকটির তরফ থেকে মেয়েটির শরীর খাবলে নেবার কদর্য
অকর্মটি পুরোপুরি এবং স্পষ্ট টের পাচ্ছে। কেঁপে কেঁপে উঠছে মেয়েটির ছায়া এই নির্জন
দিঘলী গ্রামের অন্তপুরে, প্রতিটি বার
যখন সে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারছে না মেয়েটির
প্রেমিক। না পেরে কেবল নিজে নিজেই সারাক্ষণ ছটফট করছে। এতো দূরে বসে কী করবে সে? ছায়াটা তার কাছে ফেলে রেখে দিয়ে তার
প্রেমিকা বড়ই কষ্ট ও যন্ত্রণা দিচ্ছে তাকে। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দগ্ধ করছে সারাক্ষণ।
অক্ষম ক্রোধে শুধু অঙ্গারের মতো একা একা জ্বলতে থাকে সে। নিজের ঘরের নিভৃতিতে, মেয়েটির কাছ থেকে বহুদূরে দিঘলী গ্রামে।
শুধু তো
এটাই নয়। জবরদস্তি করে তার শরীর ভোগ করছে বলে যত-ই খারাপ লাগুক, মেয়েটির প্রতি অন্তত বিরক্ত হয়নি তার
প্রেমিক। সহানুভূতি-ই জেগেছিল তার। কিন্তু এর পর দিন গিয়ে মাস আসে, মাসের পর বছর। কেটে যায় বছরের পর বছর। বৈধ
ভিসা যোগাড় বা প্রেমিকের এখানে আসা, কোনটাই এগোয়
না। এইরকম এক সময় তার ছায়ার মাধ্যমে দিঘলী গ্রামে বসে টের পায় তার প্রেমিক, মেয়েটি স্বেচ্ছায় দৈহিক সম্পর্ক গড়ে তুলছে
একজন নয়, একের পর এক, মোট দু’ জন, না না মোট
তিনজন, পুরুষের সঙ্গে। তার ভেতর আবার একজন বিদেশী
আমেরিকান। দিঘলীতে বসে কষ্টে নীল হয়ে যায় মেয়েটির প্রেমিক। ফোনে কথা হলে নিজের
অপমানের কথা ভুলে গিয়ে সেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করে সে। মেয়ে স্পষ্ট জানায়, সে সাধু সন্ন্যাসী কিছু নয়। সাধারণ একজন
মানুষ। সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, বাসনা তার-ও
আছে। যাদের সঙ্গে সে মিলিত হয়েছে তারা তার জীবনের স্থায়ী সঙ্গী নয় কেউ-ই- আত্মার
আত্মীয়-ও নয়। কিন্তু তার, মেয়েটির, শরীরেরও একটা চাহিদা আছে। আছে তাদেরও। ফলে
ওটা নিতান্ত-ই একটা পারস্পরিক সুবিধের-সমঝোতার ব্যাপার। মানবিক চাহিদা মেটাবার
ব্যাপার। এর বেশি কিছু নয়। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে তার প্রেমিকের খারাপ লাগার
কথা নয়। মেয়েটি আরো বলে তার দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে তার প্রেমিক যদি কারো সঙ্গে
বিচ্ছিন্নভাবে কোন রাত কাটায়, সে তা মেনে
নিতে, বুঝতে পারবে। কিছু মনে করবে না। স্বাভাবিক
সেটা, সে জন্যেই।
আরো দিন
গেলে মেয়েটি টের পায়, আস্তে আস্তে
তার আশেপাশের বা দূরদূরান্তে থাকা স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পরিচিত অনেকেই বয়সের ভারে, অসুস্থ হয়ে, একে একে
মারা যেতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে প্রায় সকল আপনজনকেই সে হারাতে বসে। কিন্তু তবু
এখনো নিজে বেঁচে আছে, বেঁচে আছে
এক অপরিচিত পরিবেশে যেখানে দীর্ঘদিনের চেনা সে হারাতে বসে। কিন্তু তবু এখনো নিজে
বেঁচে আছে, বেঁচে আছে এক অপরিচিত পরিবেশে যেখানে
দীর্ঘদিনের চেনা আর প্রায় কেউই নেই।
তখন মেয়েটি
ধীরে ধীরে বুঝতে পারলো, এভাবে বট
গাছের মতো সময় আগলে এখানে পড়ে থাকার কোন মানে হয় না। আত্মিক বাঁধন যাদের সঙ্গে
রয়েছে, তারাই যদি পাশে না থাকে এই বেঁচে থাকা তো
অর্থময়, সুখকর হতে পারে না। চারদিকে তাকিয়ে মেয়েটি
দেখে, তার দেশ থেকে এদেশে আসা লোকেরা এখন সকলেই
নতুন, প্রায় সবাই তরুণ, সকলেই অপরিচিত। আশে পাশে কেউ নেই যাদের
সঙ্গে বেড়ে উঠেছে সে- যাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠোিছল আগে, যারা নানানভাবে তার জীবনকে করেছে
সমৃদ্ধ-মূল্যবান। স্বদেশে ফেলে আসা তার সেই প্রেমিক যে বছরের পর বছর ধরে তার ছায়া
বয়ে বেড়াচ্ছে, তার জন্যে এখনো অপেক্ষা করছে, তাকে ভীষণভাবে পাশে চায় মেয়েটি। সে জানে, সে মানুষটি তার ছায়া আগলে আজো নিশ্চুপ পড়ে
আছে দিঘলীতে।
এদেশে
বৈধভাবে থেকে যাবার কাগজপত্র হবার সম্ভাবনা আর নেই, কয়েকবার
বাতিল হয়ে যাবার কারণে ওটা এখন নিশ্চয় অন্ধকার সিন্দুকের ভেতর কোথাও জায়গা করে
নিয়েছে স্থায়ীভাবে। এ ব্যাপারে মেয়েটাকে সবচেয়ে ক্ষতি করেছে সেই লোক যার বউ সেজে
সে এসেছিল এখানে। দীর্ঘদিন ধরে তাকে ব্যবহার করতে সে দেয়নি। ফুঁসে উঠেছিল। উঠতে
পেরেছিল কেননা তখন সে রোজগার করতে শুরু করেছে। পরিণামে তাকে পরিত্যাগ করে আক্ষরিক
অর্থেই পথে ফেলে দিয়ে চলে যায় লোকটি। তাকে ভিসা পেতে সাহায্য করা দূরে থাকু, সে যাতে বৈধ ভিসা কখনো না পায় সেই চেষ্টাই
করে যাচ্ছে সে। দূর থেকে। আর তখন থেকেই সম্পূর্ণ একা বেঁচে থাকার জন্যে ক্রমান্বয়ে
লড়ে যাচ্ছে মেয়েটি।
মেয়েটি ভাবে, এটা কেমনতর বেঁচে থাকা তাহলে? নিজের হাতে-পায়ের কুঁকড়ানো চামড়ার দিকে
তাকিয়ে সে বোঝে, বয়সের ভারে সে ক্লান্ত। তার মেরুদ- বাঁকা
হয়ে গেছে। কিন্তু সে জানে না, কোনমতেই
বলতে পারবে না, এখন সে দেখতে কেমন। আসলেই সে কে, যে বেঁচে আছে, যার দেহ ধারণ করে আছে, বহন করে যাচ্ছে তার সত্তা?
মেয়েটি তখন
ঈশ্বরকে বলে, ‘আমার বিদেশে থাকার সখ মিটেছে। তুমি আমাকে
ফিরিয়ে নিয়ে যাও আমার দিঘলী গ্রামে। সেখানে গেলে আমার ছায়াটি আমাকে ফিরিয়ে দাও
যাতে আমি তার সাথে একত্রিত হয়ে আবার একটি পূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে পারি। শেষবারের মত
নিজেকে প্রাণভরে একবার দেখতে পারি। জানতে পারি আমি কে? পরিচিত হতে পারি নিজের মুখমন্ডলের সঙ্গে।
তাছাড়া, আমি চাই আমার প্রেমিককে ভারমুক্ত করতে। আর
কতোকাল সে আমার ছায়া বয়ে বেড়াবে?..
(একটি
রূপকথার ছায়া অবলম্বনে)
0 মন্তব্যসমূহ