ঈশ্বরের কান্না


শমীক ঘোষ


আমি যেখানে যাই,ঈশ্বর যায় পিছন পিছন।

        কাল অনেকদিন পর আবার দেখা হল। গোভান্ডি স্টেশনের বাইরে,খালি গায়ে লুঙ্গি পরা ঈশ্বর চা খাচ্ছিল প্লাস্টিকের কাপে। বাঁ দিকে খোলা খাল,নোংরা,অনেক প্লাস্টিকে আটকে গিয়েছে। তারই মধ্যে জল ঘাঁটছে কতকগুলো অর্ধ উলঙ্গ ছেলে। আমায় দেখে এক গাল হাসল ঈশ্বর,ফোকলা দাঁত বিড়ি খেয়ে খেয়ে গাড় খয়েরী। চা খাবে?

        ঈশ্বরের সাথে আমার প্রথম আলাপ তালতলায়। পরস্পরের গা ছুঁয়ে দেওয়া চালের ফাঁকে যেটুকু গলি,তার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। ঈশ্বরের লুঙ্গির ট্যাঁকে গোঁজা ওয়ান শাটার। ঈশ্বর তখন সবে জামিন পেয়েছে। মার্ডার কেস। ফি সকালে যায় বজবজে,জ্যোতিষীর কাছে,আর ফি রাত্রে হাড়কাটা গলিতে আমিনার কাছে। ঈশ্বর আমাকে খুব ভালোবাসে। গরুর ভুনা খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছে নুর আমিনের দোকানে। ঈশ্বরের ধারণা নুর আমিন পয়সা চাইবে না। যদি চায় আমি দেব। আমি ঈশ্বরকে মারামারি করতে বারণ করেছি। হলুদ বাল্‌বের আলোয় আরও হলুদ ভুনার ঝোল। প্লেটের উপর আধসিদ্ধ শিক কাবাব। তখনো নরম। আর কাঁচা লঙ্কা। খেতে খেতে ঈশ্বর কেঁদে ফেলল। দাদা,কি করব আর বেরোনোর উপায় নেই। একবার যখন লাইনে ঢুকেছি আর বেরোতে পারব না। কথা ঘোরাতে আমি বললাম,ঈশ্বর ছাড়,পার্টি তোমাকে বাঁচাবে না?

        দাদা মাইরি বলছি,মায়ের নামে কিরা দিয়ে বলছি,আমি মারিনি মালটাকে। আমাকে বলল তুই সারেন্ডার কর, আমরা বাঁচাব। খানকির ছেলেরা কেউ বাঁচায় নি। পুলিশ কি মেরেছে দাদা। পেছনে রুল ঢুকিয়ে দিত।

        আমার ঘেন্না করল। মুখের মাংস থুক করে প্লেটে ফেললাম। বললাম,ঈশ্বর ছাড়,উঠি।

        দাদা,মায়ের কিরা আমি খুন করিনি।

        বাল করনি। এখন ভোগ। পার্টির পা চাটো। যদি বাঁচায়। আমার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। খাওয়ার সময় পিছনে রুল ঢোকানোর কথা বলায়।

        সেই রাত্রে অনির্বাণ আর আমি গিয়েছিলাম হাড় কাটা গলিতে। অনির্বাণ গাঁজা কিনবে আর আমি শহর দেখব। শির শিরে ভয় শিরদাঁড়ায়। পিছন থেকে কেউ ছুঁয়ে দিল বুঝি। প্রায় অন্ধকার। দুপাশে দাঁড়িয়ে শিককাবাবের মত নানা বয়সের আদুর গায়ের নারী। ছিনে জোঁকের মত গায়ে উঠে আসতে চায়। হবে নাকি তিরিশ টাকার? আর হাসি। তখনই প্রায় গায়ের উপর উঠে এসেছিল মেয়েটা। কালো, মোটা। যৌবন অনেক দিন আগে ছেড়ে গিয়েছে। উরুর উপর সেলুলয়েডের আস্তরণ, আর উরুর নিচে মোজা। কালো ছোট ফ্রক পরা। দাদা, আমি আমিনা। আপনি ঈশ্বরের বন্ধু?

        দাদা আপনি ঈশ্বরকে বাঁচান। ঈশ্বর ফেঁসে গেছে। ওর ফাঁসি হবে।

        অনির্বাণ আমাকে আর আমিনাকে দেখছিল অবাক হয়ে। আমি বললাম হলে হবে। তোমাকে তো আর বিয়ে করবে না ঈশ্বর। তুমি আমিনা এই হাড় কাটা গলির হাড় হয়ে থেক।

        ফেরার সময় আমাকে অনির্বাণ অনেক চার অক্ষর শুনিয়েছিল। শালা আমাদের পার্টিও ক্লাস বোঝে,স্ট্রাগল বোঝে। আমাদের পার্টি অফিসেও লেনিনের ছবি আছে। তাই বলে লুম্পেনদের সঙ্গে তোর এত ভাব কেন। বলতে বলতে, গাঁজা পোরা সিগারেট টানছিল অনির্বাণ। আর গোটা কলেজ স্ট্রীট দুলছিল গাঁজার ধোয়ায়।

        ঈশ্বর বদলায় না। বদলায় ঈশ্বরের পদবী। ঈশ্বর তখন মণ্ডল নয় মাহাতো। ঈশ্বরের পিঠে থ্রি নট থ্রি। কাকড়াঝোরের জঙ্গলে ঈশ্বরের সাথে আমার দেখা। ঈশ্বর আরও কালো হয়ে গেছে। কোটরে ঢোকা চোখ দুটো জ্বলজ্বলে। গায়ে পার্টির দেওয়া খাকি। ঈশ্বর তখন পিপলস গেরিলা আর্মি। ঈশ্বর পুলিশ মারে। আর পুলিশ ঈশ্বরদের মারে।

        আমি ঈশ্বরকে দেখে হতবাক। ঈশ্বর তোমার না ফাঁসি হওয়ার কথা। তুমি এইখানে!

        ঈশ্বরও আমাকে দেখেই চিনল। বলল, দাদা বুঝলে না সবটাই শেনি। আগে শেনি বিভাজন উচ্ছেদ করতে হবে। তা হলেই আর ফাঁসি হবে না। আমিনা হবে না। হাড়কাটা গলিও হবে না। ঈশ্বরের কণ্ঠে আত্মপ্রত্যয়।

        আমি বললাম কিন্তু ঈশ্বর পুলিশে ধরবে যে আবার। আগের বার পার্টি বাঁচিয়েছিল। তোমার এখনকার পার্টিতো নিজেই ধরা পড়লে ভোগে যাবে। তুমি কেন এদের দলে।

        দাদা,কি করব,খাওয়া জোটে না। গাছের পাতা খেয়েও খিদে মেটে না। ইঁদুর পর্যন্ত পাওয়া যায় না। দাদা কি খাব? ঘাস খেয়েও দেখেছি। এত শক্ত সিদ্ধ হয় না। দাদা কতদিন ভাত খাই নি। ভাত খেতে খুব ইচ্ছা করে দাদা। পার্টি বলে, পুলিশ মারতে মারতে যেদিন সব পুলিশ শেষ হয়ে যাবে সেদিন ভাত পাওয়া যাবে। জঙ্গলে ভাত। মাঠে ভাত। সাদা সাদা,নরম নরম,গরম গরম ভাত। দাদা একটু ভাত খাওয়াও না। ভাত আর নুন। আর কিচ্ছু চাই না।

        ফিরে আসছি। দেখলাম পুলিশ রাস্তা আটকে দিয়েছে। আমাকে দেখে বলল আপনি যান,আপনি শহরের,আপনাকে ছেড়ে দেওয়ার হুকুম আছে। তবে গ্রাম ফ্রাম নিয়ে বেশি মাথা ঘামাবেন না। শহরে নতুন নতুন কোম্পানি আসছে,আপনাদের মত লোকদের খুব দরকার। সবার চাকরি হয়ে যাবে।

        আমার পরে আরেকটা বাচ্চা মেয়ে। কালো। বছর পনেরো বয়স হবে। পুলিশ বলল তুই কে বে? এইখানে কেন? আগে দেখি তুই মেয়ে না ছেলে, জামা খোল।

        মেয়েটা কাঁদছিল। আমি আর পিছনে তাকাইনি। ঝাড়গ্রাম স্টেশনের দেওয়ালে ঐশ্বর্য রাইয়ের পোস্টার। খোলা পিঠ। চোখ জুড়িয়ে গেল। ট্রেন ধরলাম, কলকাতা ফিরব তাড়াতাড়ি। ফিল্ম দেখব বাড়ি ফিরে। মোনিকা বেলুচ্চির।

        ধোকলা আর খমন খাচ্ছিলাম। সাথে সিগারেট আর চা। খেয়ে উঠে দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করলাম, কিটলা থয়ু ? (কত হল?)? দাম দিয়ে বার হচ্ছি। দেখি ঈশ্বর। ফেজ টুপি। চাপ দাড়ি। না কাচা শেরওয়ানি। ঈশ্বর একটু মোটা হয়েছে। বললাম, ঈশ্বর না?

        জি। আমার নাম এখন খুদাবক্স। সেলাম আলেকুম।

        ওয়ালেকুম সেলাম ওয়া রহমতুল্লাহ ওয়া বরমুহ। কিন্তু ঈশ্বর থুড়ি খুদাবক্স,তুমি এইখানে কি করছ?

        জি হুজুর,আমি সেই দাঙ্গার সময় পালিয়ে গিয়েছিলাম। আবার এসেছি। শহরটা চিকনাই হয়ে গিয়েছে। এই জায়গাটা ছাড়া। এই পুরনো শহর আগের থেকেও নোংরা হয়ে গেছে। কিন্তু ভাই,সু করি শকসু (কি করতে পারি?)। যাহা ধান্দা ওহা রহনা পড়েগা।

        ঈশ্বরের সাথে আমার কথা হচ্ছিল হিন্দিতেগুজরাতিতে। ডাবি বাজু (বাঁ দিক) নিলাম। এই মুসলমান অঞ্চল। এইখানে দাঙ্গার সময় রক্ত ভাসত সকাল সন্ধ্যেয়। আর দূর আহমেদাবাদের হিন্দু অঞ্চল আলোয় ভেসে জানলা দিয়ে দেখত অনেক দূরের জ্বলা আগুন আর ধোঁয়া। দুদিকে নানা ধরণের বাড়ি। কারুর অট্টালিকা,কারুর ছোট বাড়ি। কারুর আবার বস্তি। এক সাথে থাকে আহমেদাবাদের সব খুদাবক্সেরা। রাস্তায় পিচ নেই। দূরে স্লটার-হাউস। নোংরা। ডেভেলপড আহমেদাবাদের এই মুসলিম ঘেটো। গরু কাটা বারণ। ঈশ্বর আমাকে ছাগলের গোস্ত খাইয়েছিল আর সাদা মুরগির ঝোল।

        সেই ঈশ্বর আবার মানকুর্দ স্টেশনের বাইরে। ঈশ্বরের পিছনে মুম্বাই শহরের এম ওয়ার্ড।  প্রায় পুরোটাই বস্তি। এইখানে শিশু মৃত্যুর হার সাব-সাহারাণ আফ্রিকার থেকেও বেশী। অনেক দূরে চেম্বুরের হাই রাইজ। চায়ের দোকানের রেডিওতে এফ এম বাজছে। হাউ টু গেট রিড অব দ্য মুম্বাই ট্রাফিক। বাই অ্যান অ্যাপার্টমেন্ট অ্যাট গোকুলধাম। হাই রাইজ অ্যাট টু ক্রোর অ্যান্ড আবভ।
        বাচ্চা ছেলেটা বাসন মাজছে। বালতির জল কালচে। ছেলেটার আঙুলগুলো জলে ভিজে সাদাটে হয়ে গেছে।

        চা খেতে খেতে,কোমরের দাদ চুলকচ্ছিল ঈশ্বর। সে রুটি কারখানায় চাকরী করে। ঈশ্বর কোনোদিন কাঁদেনি। তার আওয়াজ ঢেকে দিচ্ছিল,মুম্বাই শহরতলির লোকাল ট্রেন।


লেখক পরিচিতি
শমীক ঘোষ
গল্পকার, প্রবন্ধকার, অনুবাদক
লেখাপড়া : কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
বর্তমান নিবাস : মুম্বাই শহর



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ