আহমাদ মোস্তফা কামাল
প্রায় সারাটি
জীবন একটি যাত্রাদলের জন্য ব্যয় করে এই বুড়ো বয়সে মধুবাবুর যেন কানড়বা ছাড়া
আর কোনো
সম্বলই নেই। আমরাÑ এই তুচ্ছ মফস্বল শহরের কতিপয় বেকার যুবকÑ
বসে বসে
তাঁর কানড়বা
দেখি, ফেলে আসা সোনালী জীবনের গল্প শুনি। মধুবাবু সবসময়ই আমাদের কাছে এক
আকর্ষণীয়
চরিত্রÑ একসময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত যাত্রাদল নিউ গণেশ অপেরার প্রতিষ্ঠাতা-
অধিকারী,
অসংখ্য মঞ্চসফল পালার
লেখক, আর শিল্পের জন্য জীবন সঁপে দেয়া এই মানুষটিকে
বরাবর আমরা
শ্রদ্ধার চোখে দেখে এসেছি। সত্যি কথা বলতে কী, শিল্পের জন্য যে জীবন
সঁপে
দিতে হয়,
নইলে হয় না,
শিল্পের দেবী ধরা দেন
না, এ উপলব্ধি আমরা তাঁর কাছ থেকেই লাভ
করেছি। আমরা
তাঁর কাছে ফিরে ফিরে আসি, গল্প শুনিÑ কতশত গল্প, যাত্রা দলের গল্প,
যাত্রাশিল্পীদের
গল্প, তাঁর নিজের জীবনের গল্প এবং সেইসঙ্গে অতি-উচ্চমার্গের এমন কিছু কথাবার্তা
যা আমরা অন্য
কোথাও শুনিনি কোনোদিন (অবশ্য গল্পের সাথে বাংলা মদের বোতলও থাকে,
গল্পের লোভে
নাকি বোতলের লোভে বারবার ছুটে আসি সেটা কখনো নিজেদের জিজ্ঞেস করে
আমলে বিএ পাশ
করা তো কম কথা নয়Ñ আমরা তা জানি, কিন্তু সব ছেড়ে কেন তিনি সারাজীবন
যাত্রাদল
নিয়ে পড়ে রইলেন আমরা বুঝে উঠতে পারিনা। জিজ্ঞেস করলে মধুবাবু লম্বা কাহিনী শুরু
করে দেন,
সেই কাহিনীর অধিকাংশ
জুড়ে থাকে তার শৈশব-কৈশোরের গল্প, থাকে প্র ম যৌবনের
গল্প আর
সেইসব গল্পের তোড়ে মূল প্রশড়বটি কখন কোন মুহূর্তে টুপ করে ঝরে পড়ে আমরা তা টেরই
পাই না!
আমাগো বাড়ি
আছিলো ধুলশুরাÑ নাম শুনছেন তো! ওই আজিমনগরের কাছে। তা আপনারা
ঠিকই কইছেন
দাদারাÑ সহায়-সম্পত্তি ভালোই আছিলো আমাগো। আজিমনগর বাজারে পাঁচটা
দোকান আছিলো,
জমিজিরাতও আছিলো ভালোই,
খ্যাতের ফসলে বছর পার
অইতো। বাবা
কইলেনÑ
তুই বংশের বড় পোলা,
পড়ালেখাডা কর,
তানাইলে ছোটগুলানও করবো
না। আমিও
পড়ালেখার নাম
কইরা ব্যবসাপাতির কাজকর্মে ফাঁকি দেওনের সুযোগ পাইলাম। পড়ালেখায় খারাপ
আছিলাম না।
ফাস্ট-সেকেন্ড অইতে পারি নাই কোনোদিন কিন্তু থার্ড পজিশনডা আমার জন্যে বান্ধা
আছিলো। স্কুল
ছাইড়া কলেজে গেলাম, সেইখানেও ভালোই করলাম, কিন্তু এমএ ক্লাশে
ভর্তি
অইয়া আর পড়তে
ইচ্ছা অইলো না...
যাত্রাদলে
ঢুকলেন কবে?
হেইডা পরের
ঘটনা। আগের ঘটনা আগে শোনেন। আজিমনগরে একবার সার্কাস পার্টি
আইলো,
আমি তখন স্কুলে পড়ি,
আমাগো স্কুলের মাঠেই
প্যান্ডেল পড়লো। সেই প্র ম সার্কাস
পার্টি
দেখলাম। তাগো কাণ্ডকারখানা দেইখা মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। সার্কাসের শো দেখতে
চাইলে মনের
জোর লাগে দাদা, তানাইলে হার্টফেল কইরা মারা পড়বেন। যেমুন আনন্দ সেইরকম
আবার
উত্তেজনা, সেইখানে তারা আপনেগো ভাবাভাবির সময় দিবো না, একটানা আইটেম
দেখাইয়া
যাইবো, আপনের দমবন্ধ কইরা দেইখা যাওন ছাড়া আর কিছু করার নাই। কত রকমের
খেলা তাগো,
কত রঙচঙ,
বাঘের খেলা,
হাতির খেলা,
বান্দরের খেলা। খালি কি
জন্তু-জানোয়ারের
খেলা,
আছে মানুষের খেলাও।
সেইডাই সবচে বেশি উত্তেজনার। ওই চিকন তারের উপর দিয়া
যখন যুবতী
মাইয়ারা হাঁইটা যায় তখন গায়ের লোম খাড়া অইয়া যায়, মনে অয়Ñ
এই পইড়া
গ্যালো বইলা,
কিন্তু পড়বো না,
পড়বো তো না-ই,
উল্টা নানারকম কসরত
দেখাইবো।
মাইয়াগুলার
শরীল য্যান চামড়ার না, য্যান রাবার দিয়া বানাইছে। এইসব দেইখা আমাগো মাথা
আউলাঝাউলা
অইয়া যায়। খালি মনে অয়Ñ অরাও মানুষ আমরাও মানুষ, অরা এতকিছু পারে
আমরা পারি না
ক্যান! সার্কাসদল চইলা যাওয়ার পরও সেই ভাব যায় না, মনে অয়Ñ
এইসবকিছু
আমারে শিখতে
অইবো, বন্ধুবান্ধবরা মিলা ফন্দি আঁটিÑ নিজেরাই একখান সার্কাস দল বানামু। হে
হে হে,
বুঝলেন না,
বাচ্চাপোলাপান যেমুন
ভাবে আর কি! অনেক বুদ্ধিসুদ্ধি কইরাও কোনো পথ
আর পাই না।
এইরকম উচাটন ভাব কাইটা গ্যালো বছরখানেক পর। ফের শীতে আইলো যাত্রার
দল।
প্যান্ডেল পড়লো আমাগো স্কুলের মাঠেই। সেই প্রম আমি যাত্রাদল দেখলাম। প্রমে মনে
করছিলামÑ
এইডাও সার্কাসপার্টির
মতোই কিছু একটা অইবো। কিন্তু হাতি-ঘোড়া-বাঘ-বান্দর
কিছুই তো
দেখি না! খালি মানুষ দিয়া এরা কি খেলা দেখাইবো? একটু মন খারাপই অইছিলো।
সেইটা কাইটা
গ্যালো প্রম পালা দেইখাই। কি কমু দাদা, প্র ম শো অইলো বাদশা সাজাহানের
পালা। সেইডা
দেইখা সাজাহানের লাইগা মন পুইড়া গ্যালো, এদ্দিন ইতিহাস বইতে তাঁর কথা
পড়ছি। কিন্তু
পালায় যা দেখাইলো তা বইতে লেখা নাই। বুঝলাম এগুলা ভিনড়বজাতের জিনিস।
সার্কাসপার্টির
মতো এগো রঙঢঙ চাকচিক্য নাই, কিন্তু আছে অন্য এক ক্ষমতা,
তানাইলে মানুষ
সারা রাত
ভইরা বইসা বইসা এগুলা দ্যাখে ক্যান? প্র মদিনই যাত্রাপালা আমার মন কাইড়া নিলো।
স্কুলের
পরীক্ষা শ্যাষ, পড়ালেখা নাই, কাজকর্ম তো করিই না,
লাইগা পড়লাম যাত্রাদলের
পিছনে।
রাইতে পালা
দেখি আর দিন ভইরা খালি প্যান্ডেলের চাইরপাশে ঘুরঘুর করি,
উঁকিঝুকি মারিÑ
যদি
কাউরে দ্যাখা
যায়! দিনের বেলা তারা খুব একটা প্যান্ডেল থেইকা বাইর অয় না। ওইখানে বইসা
সারাদিন করেন
কি ওনারাÑ এই ভাইবা আমাগো বন্ধুবান্ধবগো নাওয়া-খাওয়া বন্ধ। একদিন তাবুর
মধ্যে থেইকা
একজন বাইর অইলেন। দেইখাই চিনলামÑ রাইতের পালায় ইনি রানীমা
সাজছিলেন।
সাজপোশাক পাল্টাইছেন, চেহারা তো আর পাল্টাইতে পারেন নাই! রানীমারে
এইভাবে দেখতে
পামু ভাবতেও পারি নাইÑ হা কইরা চাইয়া রইছি। রানী আমারে ডাকতে আছেন
বুঝতেও পারি
নাইÑ বন্ধুবান্ধবের ধাক্কায় সম্বিৎ ফিরা পাইয়া দৌড়াইয়া গেলাম তার কাছে। তিনি
কইলেনÑ
এ্যাই খোকা,
আমারে এক খিলি পান আইনা
দিতে পারবা? আমি কোনো কথা কইতে
পারলাম না,
রানীমা পান চাইছেন আর
আমি আইনা দিতে পারুম নাÑ এইডা কোনো কথা অইলো!
দৌড় মাইরা
দোকান থেইকা দশখিলি পান আইনা তার হাতে দিলাম। তিনি দেইখা তো মহাখুশিÑ
ও মা,
তুমি এতগুলান আনছো,
তোমারে না কইলাম একখিলি
আনতে! আমি তো কোনো কথাই
কইতে পারি না,
রানীমা আমার লগে কথা
কইতেছেন, রানী মা! এর থেইকা আজব ব্যাপার আর
কী অইতে
পারে! ঘোর না কাটতেই তিনি আমারে লইয়া প্যান্ডেলের ভিতরে গেলেন। সেইখানে
আরো তাজ্জব
ব্যাপার। রাইতের রাজা-মন্ত্রী-সৈন্য-সামন্ত সব ঘুমাইতেছে,
এক কোণায় খালি
রাজকন্যা
জাইগা বইসা আছে। আহা কী যে সুন্দর তার মুখ, দাদারা কী কমু, এহনও চোখে ওই
মুখখান লাইগা
রইছে। কিন্তু খালি সুন্দর দেইখাই যে মনে গাইথা গেলো তা মনে অয় না,
আমি
বিষয়ডা লইয়া
অনেকদিন ভাবছি... বুঝতে চাইছি কী এমন আছিলো মাইয়াডার মধ্যে,
ক্যান এমুন
কইরা গাইথা
গ্যালো মনে, সারাজীবন ধইরা কত মাইয়াই তো দেখলাম, কতজনরে শিল্পী
বানাইলাম,
নায়িকা বানাইলাম,
প্রিন্সেস বানাইলামÑ
কাউরেই তো ওইরকম মনে
অইলো না!...
যাকগা,
সেই কাহিনী শোনেনÑ
মধুবাবু আবার শুরু করেনÑ
প্রতি দুই রাইত পর পর
নতুন নতুন
পালা অয়,
বাদশা সাজাহানের পালা,
শাহজাদা সেলিম আর
আনারকলির পালাÑ আরো কী কী, সব
নাম মনেও নাইÑ
এরপর একদিন শুনলাম আইজ
রাইতে সামাজিক পালা অইবো। তখনো জানি
না সামাজিক
পালা জিনিসডা কী! দেখতে গিয়া দেখিÑ এ তো আমাগোই কাহিনী,
এইখানে কোনো
রাজা-বাদশা
নাই, যারা আছে তারা আমাগো মতোই সাধারণ মানুষ। সেইদিন এক আজব
অভিজ্ঞতা
অইলো। মন দিয়া পালা দেখতেছি, দেখতে দেখতে হঠাৎ পাশ থেইকা ফুপাইয়া উঠার
আওয়াজ
পাইলাম। কেউ মনে হয় কানতেছে! হ তাইতো! ইট্টু পর আরেকজনÑ
এইবার এট্টু
জোরে। তারপর
আরেকজন। তারপর দেখলাম এক তাজ্জব ঘটনা। শয়ে শয়ে মানুষ কানতেছে।
কেউ ফুপাইয়া,
কেউ নীরবে,
কেউ হাউমাউ কইরা।
বুঝলেন দাদারা, ব্যাপারডা এট্টু কল্পনা করার
চেষ্টা করেন।
চারদিকে কানড়বার শব্দ...Ñ খেয়াল করি মধুবাবুর ভাষাভঙ্গি পাল্টে যাচ্ছে,
আমরা
নিবিড় হয়ে
বসে কান পাতি, জানি এইসব মুহূর্তে তিনি আশ্চর্য সব কথাবার্তা বলেন,
উচ্চমার্গের সব
কথাবার্তা,
এমন-সব কথা এই পোড়া এলাকায়
আর কেউ বলে নাÑ শত শত মানুষের নানারকম
কানড়বা আর
এতসব বিচিত্র ধ্বনির সম্মিলনে যেন তৈরি হচ্ছে এক অভূতপূর্ব সঙ্গীত-মুর্চ্ছনা। যে
বিলাপ করছিল
তার সুর যেন উঁচু লয়ে উঠে আবার ঢেউয়ে ঢেউয়ে নেমে আসছিল নিচু স্তরে,
যে
ফুপাচ্ছিল
তার শব্দটিকে মনে হচ্ছিল পাতার মর্মরধ্বনি, যে নিচু গলায় কাঁদছিল তারটা যেন হয়ে
উঠছিল বাঁশির
নিমগড়ব সুর। কী বলবোÑ সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য, এক অশ্র“ত সুর। মঞ্চের
মানুষগুলো
তখন আমার কাছে মৃত, আমি শুধু চারপাশে কানড়বার সুর শুনতে পাচ্ছি। কানড়বা,
কানড়বা,
কানড়বা।
মানুষ কাঁদছে। এর আগে কোনো ঘটনায় এতগুলো মানুষকে একসঙ্গে কাঁদতে দেখিনি।
আমার ঘোর
লেগে গেলো...
মধুবাবু চুপ
করে গেলেন। তার বন্ধ চোখের পাতা ভেজা, যেন ধ্যানস্থ হয়ে আছেন। সহজে
তার সেই
ধ্যান ভাঙেনা। অনেকক্ষণ পর জিজ্ঞেস করিÑ তারপর?
তার আর পর কি?
শো ভাঙলো। মানুষজন সব
বাড়ি ফিরা গ্যালো। বোজেন না, সারা রাইত
শো দেখলে
সকালে না ঘুমাইয়া উপায় আছে! কিন্তু আজব ব্যাপার কি জানেন,
দুফুরে কি বিকালে
সেই
মানুষগুলারে দেখি হা হা কইরা হাসতেছে, কাজকর্ম করতেছে চুটাইয়া। মনে অয়Ñ
এত সুখী
তাগো আর
কোনোদিন অইতে দেখি নাই। মনে অয়Ñ তাগো বুকে পাথর চাপা দেয়া আছিলো,
ধাক্কা দিয়া
কেউ য্যান সেই পাথর সরাইয়া দিছে। সেইসব দিন আর আইবো না দাদা। পদ্মায়
আমাগো বাড়ি
খাইলো, জমিজমা খাইলো, অজানা অপরাধে বাস্তুহারা অইলাম। বাবা-কাকারা
ব্যবসা করতেন
বইলা বাঁইচা গেছিলেন, অন্য গ্রামে গিয়া ঘর উঠাইলেন। কিন্তু আমার শান্তি লাগে
না। পদ্মার
পাড়ে গিয়া বইসা থাকি। দেখি... দেখি অসীম জলস্রোতের মধ্যে আমার জন্মভিটে ডুবে
আছে। কান
পেতে জলের শব্দ শুনি। মনে হয় কেউ যেন কাঁদছে। কে কাঁদে?
কে কাঁদে?
চারপাশে
তাকিয়ে দেখি
কেউ নেই। তাহলে কাঁদে কে? অনেকক্ষণ পর টের পাই কাঁদছি আমি নিজেই।...
দাদাগো আমার
সেই কান্দন আর থামে নাই। একদিন জিগাইছিলেন নাÑ আমি এত কান্দি ক্যান!
তয় শোনেনÑ
আমি এক বাস্তুহারা
মানুষ, আমার কোনো ঠিকানা নাই, ঘর নাই, বাড়ি নাই, আমি
কান্দুম না,
কানবো কে কন?
হ্যাঁ,
জিজ্ঞেস করেছিলাম বটে,
তিনি এত কাঁদেন কেন,
কিন্তু এই মুহূর্তে
তিনি যে উত্তর
দিলেন তা ঠিক
বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না আমাদের কাছে। বাস্তুহারা হবার শোকেই যদি তিনি
কাঁদেন,
তবে এতকাল কাঁদেননি কেন?
তাঁকে তো আজকে নতুন
দেখছি না, এই কিছুদিন আগেও
তো তিনি
ছিলেন উৎসাহ-উত্তেজনায় টইটম্বুর, নতুন নতুন পালা মঞ্চে আনার আয়োজনে ব্যস্তমুখর,
তখন তো
কানড়বার এই বিপুল আয়োজন দেখিনি! তবে মানুষ যে কখন কী কারণে বদলে যায়,
বলা
যায় না। হতেও
পারে যে, এতকাল কাজের নেশায় বাড়ির কথা মনে পড়েনি, এখন এই অখণ্ড
অবসরে
শৈশব-কৈশোর ফিরে আসে, ফিরে আসে বাড়ির স্মৃতি! তাঁর মুখে এমন কথা এর আগে
কোনোদিন
শুনিনি বলেই আমাদের কৌতূহল হয়, প্রসঙ্গটি হারিয়ে যাবার আগেই জিজ্ঞেস করিÑ
তবে যে কইলেন
অন্য গ্রামে গিয়া ঘর উঠাইছিলেন!
আরে ধুর
হেইডা কোনো বাড়ি অইলো? কয়ডা ঘর থাকলে বাড়ি অয় নাকি?
আগের বাড়িতে
আমার বাবার
জন্ম, ঠাকুরদা বানাইছিলেন, সেইখানে তার পদধুলি আছিলো, ঠাকুরমার আশির্বাদ
আছিলো... না
দাদারা এই কষ্ট আপনেরা বুঝবেন না।
আমরা সত্যিই
বুঝি না, এবং হয়তো এজন্যই এ নিয়ে খুব বেশি আগ্রহ বোধ করি না,
বরং
ওই
যাত্রাদলের গল্প শুনতেই ভালো লাগে বলে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে তাঁকেও সেখানেই নিয়ে আসি।
মধুবাবু
নিজেও সাধারণত সামাজিক পালা লেখেন, তাঁর পালাগুলো দেখেও মানুষ আকুল হয়ে
কাঁদে। আমরা
জিজ্ঞেস করিÑ ছোটকালের ওই অভিজ্ঞতার জন্যেই কি আপনে খালি সামাজিক
পালা লেখেন
দাদা?
তা কইতে
পারেন। রাজা-বাদশা-আমীর-ওমরা নিয়া পালা লেখতে মন চায় না,
মানুষরে
এইসব দেহাইয়া
কি লাভ? তয় লোকে পছন্দ করে বইলা মাঝে মাঝে অন্যের লেখা পালা করছি।
কিন্তু আপনে
এইরকম দুঃখের কাহিনী লেখেন ক্যান? মানুষ এমনেই দুঃখ-শোকে কাতর,
একটু আনন্দ
পাওয়ার জন্যে যাত্রা দেখতে আসে, সেইখানেও কানড়বাকাটি। এইসব দুঃখী মানুষগো
কান্দাইয়া
আপনে কী সুখ পান দাদা?
মধুবাবু
হাসেনÑ কথাডা ওইখানেই। আমি মানুষরে আসলে কান্দাইতেই চাই। কানতে
দেখলে খুশি
হই। মনে অয় আমি সফল হইছি, আমার লেখা সফল হইছে, অ্যাক্টরগো অভিনয়
সফল হইছে।
মানুষরে
কানতে দেখলে নিজেরে সফল মনে অয়, এইডা কেমন কথা কইলেন!
শোনেন দাদারা,
মানুষের যে এত
দুঃখ-কষ্ট, এত অভাব-অভিযোগ, এত অনিশ্চিত জীবনÑ
তাও মানুষ
কান্দে না ক্যান? মানুষের তো সবসময়ই কান্দার কথা। কন তাইলে,
কান্দে না ক্যান!
আমরা চুপ করে
থাকি। ভাবি, সত্যিই তোÑ এতসব দুঃখ-কষ্ট নিয়ে বেঁচে থেকেও মানুষ
এত কম কাঁদে
কেন? রহস্যটা কোথায়? মধুবাবুই উত্তর দেনÑ
কান্দে না
ক্যান জানেন? আসলে কানতে পারে না। চাইলেও পারে না। কান্দনডা এত সহজ
ব্যাপার না
গো দাদারা। শরীর কাইটা রক্ত বাইর করানোর চেয়ে চোখ ফাইটা জল বাইরানো
কঠিন। মানুষ
তো কানতে চায়, কাইন্দা বুকের ভার হালকা করতে চায়,
আমি খালি সেই সুযোগডা
কইরা দেই,
এমনভাবে পালা লেখি
য্যান তাগো মনে অয়Ñ এসবই তাগো জীবনের কথা, য্যান
দেইখা মন
ভইরা কানতে পারে। মানুষ কান্দে, মন হালকা কইরা বাড়ি ফিরা যায়। আর আমি
ভাবি,
এই এ্যাতগুলা মানুষের
মন আইজ হালকা কইরা দিলাম, অ্যাক্টরগো কইÑ তোমরা আইজ
অনেক বড়
পূণ্য করছো, মানুষের বুকের ভার নামায়া দিছো, পরকালে তোমাগো স্বর্গপ্রাপ্তি নিশ্চিত।
স্বর্গপ্রাপ্তি!
এর মইধ্যে আবার স্বর্গ আইলো কেমনে দাদা!
ক্যান,
এর চেয়ে বড় পূণ্য আর
আছে নাকি! খালি ধর্মকর্ম করলে কী আর অয় দাদা, ধর্মকর্ম
কইরা তাঁরে
সন্তুষ্ট করা যাইবো না। তিনি বড় কঠিন বিচারক, খালি নিজের স্বর্গপ্রাপ্তির চিন্তায় যারা
ধর্মকর্ম করে
তিনি তাগো ডাক শোনেন না।
আমরা আর তর্ক
বাড়াই নাÑ মধুবাবু আবার কঠিন কঠিন কথাবার্তা শুরু করেছেন। এই
মুহূর্তে
এইসব আমাদের মাথায় ঢুকবে না। ঢোকাতে চাইও না। নেশাটা কেবল জমে উঠতে শুরু
করেছে,
এখন এসব জটিল চিন্তা
মাথায় ঢুকতে দেয়া ঠিক হবে না। তাছাড়া কী করলে স্বর্গে যাওয়া
যাবে,
সেই চিন্তা করে কী লাভ
যদি এই পৃথিবীর জীবনটাই নরকতুল্য হয়ে থাকে! এইসব
উচ্চমার্গের
কথা এড়াতে আমরাÑ মধুবাবু কীভাবে যাত্রাদলের সঙ্গে জড়ালেন সেটাই আবার
জানতে চাই,
কিন্তু তিনি আগের মতোইÑ
হেইডাতো অনেক পরের ঘটনা,
আগের ঘটনা শোনেনÑ
বলে নতুন
উদ্যেমে কথা শুরু করেন। কিন্তু আমাদের আর ধৈর্য থাকে না। তিনি কী কী সব বলে
যান,
কানে ঢোকে না। আমরা
ভাবলেশহীন চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকি, তাঁর অবিরাম ঠোঁট
নাড়া দেখে
বুঝতে পারিÑ গল্প চলছে, এ গল্প সহজে থামবার নয়। বোতল দ্রুত ফুরিয়ে আসতে
থাকে,
আর আমরা চিন্তিত হয়ে
পড়িÑ এত তাড়াতাড়ি ফুরালে বাকি রাতটা কাটবে কীভাবে!
তারপর
বহুক্ষণÑ কতক্ষণ তা বলতে পারবো নাÑ পর আবার তার সেই বিখ্যাত কানড়বা শুরু হলে
আমরা সচেতন
হই। শুনতে পাই, তিনি বলছেনÑ
মনে করছিলাম
মরার আগ পর্যন্ত পালা নামামু, আমার পালা দেইখা মানুষ মন ভইরা কানবো,
কান্দনের
সাথে তাগো বুকের ভিতর থেইকা সব দুঃখ-কষ্ট বাইর অইয়া যাইবো,
বাড়ি ফিরবো হাসি
মুখ নিয়া।
সেই হাসিমুখের দিকে চাইয়া আমার মনে অইবোÑ জীবনডা স্বার্থক অইলো। পরপারে
গিয়া তাঁরে
কমু, ইহজনমে তোমারে ডাকাডাকি করতে পারি নাই, তয় তোমার মানুষগুলার
বুক
হালকা করার
চেষ্টা করছি। আমি এই এতটুক কর্ম নিয়া আসছি, তুমি যেমুন ইচ্ছা ফল দ্যাও। তা
আর অইলো না।
এই শেষ বয়সে আইসা সবচে বড় কষ্টটা আমারে দিলেন তিনি। নিজের হাতে
গড়া দলডা
চোখের সামনে শ্যাষ অইয়া গ্যালো, শো না করলে দল টিকায়া রাখা যায় নাকি,
কন?
দলের লোকজন
খাইবো কি? আমার তো আর অফুরান পয়সা নাই যে বছরের পর বছর ধইরা পুরা
দলডারে টানতে
পারুম! শিল্পীরা কে যে কোথায় গ্যাছে গা, মাইয়াগুলা মনে অয় বাড়ি ফিরা যাইতে
পারে নাই,
যাত্রাদলের মাইয়াগো তো
সমাজ গ্রহণ করে না, মনে অয় পাড়ায় নাম লেখাইছে, নাইলে
নিশিরানী
সাজছে, আর বাড়িই বা আছিলো কয়জনের, কন! হা ভগবান, তুমি আমারে এই শ্যাষ
বয়সে এ কেমন
শাস্তি দিলা? কি পাপ করছিলাম আমি? সরকারে যারা থাকে তারা না অয় আমাগো
কষ্ট বোজেনা,
এক কলমের খোঁচায় শো
বন্ধ কইরা দ্যায়, বোঝে না যে, শো না করলে যাত্রাদলের
টিকা থাকনের
কোনো পথ নাই, কিন্তু তুমি তো সব বোজো, বুইজা শুইনাও তুমি কিছুই করতে
পারলা না?
তোমার না এত ক্ষমতা,
এই তার নমুনা?
শোনেন দাদারা,
জিগাইছিলেন নাÑ
আমি
এত কান্দি
ক্যান? না কাইন্দা কি করুম কন? এতকাল আমার পালা দেইখা মানুষ কানছে,
আমি
হাসছি। এহন
যে তাগো কান্দাইতে পারি না, জানি তারা কানতে চায়, তাগো বুক ভরা কান্দনের
শব্দ আমি কান
পাতলেই শুনবার পারি, কিন্তু কিছুই করবার পারি না,
তাই একলা একলা বইসা
কান্দি,
সকলের কান্দা আমি একলা
বইসা কান্দি...
রাত বাড়ে,
সঙ্গে আমাদের নেশা বাড়ে,
বাড়ে যন্ত্রণা। যেসব
দুঃখ-কষ্ট মনের মধ্যে পাথরচাপা দিয়ে
হাসিমুখে
ঘুরে বেড়াই সবসময় আর সেই হাসিমুখ দেখে সবাই ভাবে আমরা বেশ সুখেই আছিÑ
টের পাই
সেগুলো যেন কানড়বা হয়ে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মধুবাবুকে আমাদের ঈর্ষা হয়। মনে হয়
লোকটা সুখীÑ
একমাত্র সুখী মানুষরাই
এভাবে কাঁদতে পারে, কেঁদে বুকের ভার হালকা করে
ফেলতে পারে।
আর কানড়বার জন্য তার দুঃখ-কষ্টের ধরনও আলাদা। এই ধরনের কষ্টের সঙ্গে
আমাদের পরিচয়
নেই। আমাদের আছে কেবল অবিরল গ−ানির গল্পÑ জীবন যাপনের গ−ানি,
যুবাবয়ে
স
মা-বাবা-ভাই-বোনের কাঁধের ওপর বোঝা হয়ে চেপে থাকার গ−ানি,
কারো কোনো কাজে না
লাগতে পারার
গ−ানি। মধুবাবুর আস্তানা থেকে বেরিয়ে শহরের পথ ধরে হাঁটতে
হাঁটতে আমরা
কালিগঙ্গার
পাড়ে এসে দাঁড়াই। কালিগঙ্গা মরতে বসেছে, তার বুকে এখন আর পানি নেই। শুনেছি,
মৃতপ্রায় নদী
জলের তৃষ্ণায় কাঁদে, আমরা বসে বসে সেই কানড়বার শব্দ শুনি,
নিজেরা কাঁদতে পারি
না। মনে হয়,
মধুবাবু যদি আমাদের
নিয়ে একটা পালা লিখতেন, যদি সেই পালা দেখে আমরা বুক
উজার করে
কাঁদতে পারতাম, যদি একটু কাঁদতে পারতাম...
মে,
২০০৬
0 মন্তব্যসমূহ