জাবরার শকটে আলতাবানুর সফর

মানস চৌধুরী

জাবরার বিত্তান্ত

জাবরার নাম যে জবর আলী সেটা বুঝতে আমার অনেক সময় লেগেছে। যদ্দুর মনে পড়ে, প্রায় ওর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ অনিয়মিত হবার পরই সেই বোধোদয় ঘটেছে। আমার ধারণা ওর নিজেরও বুঝতে বেশ সময় লেগেছে। হতে পারে
পৌরসভার রিকশা লাইসেন্স করবার আগে ওর নিজেরও অবিশ্বাস ছিল যে ওর নাম জবর আলী। হতেও পারে। জাবরা দিয়ে ওর কাজ চলে যাচ্ছিল। কিন্তু আমাদের কিছুতেই চলত না। আমাদের মানে প্রাইমারি স্কুলে ওর সহপাঠীদের
কয়েকজনের। এই গুটিকতক আমাদের মধ্যে দারুণ যে মিলটা ছিল তা হচ্ছে আমাদের সকলের বাবাই সরকারী চাকরি করত। আর পার্থক্য, বেজায় পার্থক্য ছিল ঠাটবাঁটে, তবুও মিলটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
 
কাজ চলে যেত আমাদের অন্য সহপাঠীদেরও। তাদেরও বিশেষ সমস্যা হতে দেখিনি। যাদের সমস্যা হতো না তাদের মধ্যেও ভাল একটা মিল। সবাই কামলা-মজুরের ছেলে কিংবা মেয়ে। জবর আলী জাবরা হয়ে ছিল বলে ওদের কারোরই কখনো মনে হতো না যে ও লুকিয়ে আছে। লুকিয়ে থাকার পাত্রও সে নয়। কোনোভাবেই। সন্ধ্যাবেলায় যেদিন লুকোচুরি খেলতাম, আমরা বলতাম টুকি খেলা, সেই হয়ে আসা অন্ধকারে সবচেয়ে প্র ম জাবরাকে দেখা যাবেই। খানিকটা ওর প্রগলভতার কারণে। আর বাকিটা ওর গায়ের রঙের কারণে। একেবারেই ধলা। ওর মায়ের রঙ পেয়েছে। ওর মা বেশি ধলা নাকি আমার মা, তা নিয়ে ও তেমন ভুগত না। কিন্তু আমি ভুগতাম, অন্তত বেশ কিছুদিন। আর বাবরাও বোধহয় ভুগত, না ভুগলেও এই সত্যটার সহজ মীমাংসা চাইত। বাবরা হচ্ছে জাবরার ছোটভাই, আলতাবানু তার থেকেও ছোট। যাহোক! আমার বরাবরই খচখচ করেছে মন। আমি বরিশাল অঞ্চলের ছেলে।
 
সেখানে অলককে লোকে বলে অলইক্যা। রতনকে বলে রতইন্যা। লেদুর মত উ-কারান্ত নামও সেখানে লেউদ্যা। খুবই শক্ত ব্যবস্থা। কোনো নড়চড় হবার উপায় নেই। হলেই নামধারীর আইডেন্টিটি ক্রাইসিস হবে। হবেই। তখন তার
খচ্খচ্ করবে। কুষ্টিয়া অঞ্চলে যা কিছু স্বরাগম তার সবটাই ক্রিয়াপদে সেরে ফেলে। অনেকগুলো ‘ই’ মাঝখানে বসিয়ে দেয়, কিংবা অন্ত্যস্থ ‘য়’-তে ই-কার। ব্যাকরণ বইতে লিখবে ‘খেয়েছি’, ওখানে বলবে ‘খেইয়িছি’। এরকম। নামপদে
এরকম কিছু শুনিনি। আর জাবরা বিশেষ স্বরাগম দৃষ্টান্তও নয়। তারপরও আমি আশ্বস্ত হই না কিছুতেই। 

‘জাবরা আবার কী রকম নাম?’ আমি দিনকয়েক পর পর জিজ্ঞেস করতাম।
‘মানুষ আবার কী রকম নাম?’
 
জাবরা ব্যাখ্যা দেবার ছেলেই না। আমাকে ওখানে মানুষই বলত লোকে। এতবড় সত্যকেও আমার ভারি অপছন্দ হতো। প্রায়শই আমি ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করতাম, উচ্চারণ সমেত, কিভাবে আমি মানুষ নই। যাক্গে সে বেশ প্রহসন।
 
ক্লাস ফাইভের পরীক্ষা জাবরা দেয়নি। সারাবছরই ঘুরে ফিরে স্কুল দেখে গেছে। ও এসে পড়লে দেখতে এসেছে বলেই মনে হতো। এমনকি ফাইভের ক্লাশ দেখতে আসার জন্য ও ফোরের পরীক্ষাটা দিয়ে নিয়েছিল কিনা সেটাও
আমার খুব পরিষ্কার মনে পড়ে না। কিন্তু ওর নীতিবোধ এমন শক্ত না যে ফোরের পরীক্ষা না দিয়ে ক্লাশ ফাইভের ঘর দেখে যেতে ওর বাধবে। কিন্তু আমাদের খুবই বাধত। অন্তত আমার তো বটেই। জাবরারটা না হয় মনে নেই, কিন্তু রতন যেদিন স্যার বিহীন ঘর দেখে হাসতে হাসতে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো আমি কি ওকে মনে করিয়ে দিইনি যে ওর ফোরের পরীক্ষা শেষ না করে মোটেই সেখানে আসা ঠিক হয়নি? কিংবা আমার বলার মধ্যে এমন দৃঢ়তা কি ছিল না যে মুহূর্তের মধ্যে ওর হাসি মিলিয়ে গেল? এটা শক্ত নীতিবোধের ব্যাপার। আর জাবরার সেটা সামান্যই ছিল বলা যায়। ফলে মুফতে লেখাপড়া বিলি করবার সরকারী ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও জাবরা অজুহাত দেখিয়ে বিদায় নিল। লেখাপড়া থেকে পালাল। বলল যে ওর নাকি রোজগার করতে হবে। আমরা তখন খুবই পরিষ্কার বুঝতাম এসব চালাকি। মাথায় তো গোবর! এখন একটা অজুহাত খুঁজে পালিয়ে যাওয়া! আমাদের ফাঁকি দেয়া অত সোজা না!
ও যখন পৌরসভার লাইসেন্স নেয় তখন প্যাডেলে ভালমতো না হলেও নাগাল পায়। রিকশার বললাম বটে, লাইসেন্স নেয় ও ভ্যানের। পৌরসভায় দুইটা আলাদা লাইসেন্স। আলাদা নম্বর তাতে। আমরা ততদিনে হাইস্কুলে ভর্তি
হয়ে গেছি। চওড়া ওকে কখনো বলা না গেলেও বেশ লম্বাই ছিল। নাগাল পাওয়া ওর সহজ ব্যাপার।


জাবরার চালাকি
জাবরার চালাকিটা বোঝা গেল এর পরেই। যখন আর নিয়মিত দেখা হয় না।
দেখা গেল ও আগের থেকে গম্ভীর হয়ে গেছে। আর নাম জিজ্ঞেস করলে বলে
‘জবর আলী।’ তখন কেউ জাবরা নামটা মনে করিয়ে দিলেও, কিংবা মনে
করিয়ে দেবার জন্য ডাকলেও ও ততটা ব্যস্ততায় সাড়া দেয় না যতটা আগে
দিত, কিংবা জবর নামে ডাকলে তখনও যতটা ব্যস্ততায় দেয়। স্কুল ফাঁকি
দেবার মত ও নিজেরই এতকালের নামটাকে ফাঁকি দিতে লাগল। হোক সে নাম
আমাদের অস্বস্তির কারণ, তবু তো ওটা ওরই নাম ছিল। ওরই দায়িত্ব সেটা
রক্ষা করা। কিন্তু ও করেনি। ওর নীতিবোধ নিয়ে আর কিছু না বলাই ভাল।
জাবরার সঙ্গে দেখা হতো। হতোই। যেদিন আমি দূর থেকে ভাবতাম আজ
নিশ্চয়ই জাবরা দেখেনি, সেদিনও মোড় ঘুরবার ঠিক মুখেই ও ভ্যানগাড়িটা
থামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। পাশে আসতেই গম্ভীর মুখ চিরে একগাল হাসিতে
জিজ্ঞেস করত ‘কী মানুষ, দেখা সাক্ষাৎই নাই!’ আস্তে আস্তে ওর মানুষের
‘উ’কারটা ‘ও’ হতে শুরু করেছিল। পরে, আস্তে আস্তে। তখন শোনাত
‘মানোশ’। ‘ও’কারে মনোযোগ দিতে গিয়ে শেষে ‘স’-এর সঙ্গে অনেক বাতাস
ভরে দিত ও। যতটা আমার মনে পড়ে ওর এই ভ্যান থামিয়ে দাঁড়ানো কিংবা
রাস্তায় কথা বলা কোনোটাই আমার আনন্দের কারণ হয়নি। ভ্যান চালানোতেই
যে ওর মঙ্গল, সেটা যে কেন ওই সময়টুকু ও বুঝতো না আমি কিছুতেই ভেবে
পেতাম না।
‘তোমার আম্মা ভাল আছে?’
 
কেমন যেন একটা গলায় ও জিজ্ঞেস করত। তাকিয়ে থাকত আমার দিকে।
আবার আমার মাথার উপর দিয়ে রাস্তার ওধারে ওর চোখ এক চক্কর দিয়ে
আসত। মাঝে মধ্যে ওর গায়ে সাদা একটা জামা থাকত, প্রায় ছাই রঙের সাদা
একটা জামা। অন্য সময়ে হাতাকাটা গেঞ্জির ফোঁকরে ঘামে ভেজা ওর বগল
দেখা যেত। ও কথা বলত, আর হাত নাড়ত। আর ওর বগল চুঁয়ে একফোটা
ঘাম বুকের পাশ ঘেঁষে নামতে থাকত। জাবরা এবারে জিজ্ঞেস করে
রুটিনমাফিক--
‘তোমার আব্বা ভাল আছে?’
 
মোড়ের ধারে জাবরার ভ্যান থামানো দেখে নিজেকে পই পই করে
বোঝাতাম কিভাবে এবং কেন জাবরার সম্মুখে আমার হীন বোধ করার কোনো
কারণই নেই। তা তো বটেই, বরং জাবরারই বেশ কাঁচুমাচু লাগার কথা। মাথায়
গোবর নিয়ে তো আর আমি পালাইনি, পালিয়েছে জাবরা! আর যদি যথেষ্ট
কাঁচুমাচু সে না থাকে, তাহলে সাফ সাফ তোমার দাঁড়াবার, কথা বলবার, ওর
মূর্খতাকে ধরিয়ে দেবার যোগ্যতার সমস্যা। আমি পই পই করে বলতাম
নিজেকে। এবং প্রতিবারই ও কথা শুরু করবার আগ পর্যন্ত ভাবতাম যথেষ্ট
প্রস্তুতি নেয়া হয়ে গেছে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই ও জিজ্ঞেস করত--
‘তোমার আম্মা ভাল আছে?’ 

এমনই চালাক ছিল জাবরা। রিকশায় আমার থেকে ফুট খানেক উঁচুতে পা
ঝুলিয়ে, বগলের ঘাম ঝরিয়ে, রাস্তার এধার ওধার চোখ-চক্কর দিয়ে জাবরা
আমায় কাতর বানিয়ে আবার জিজ্ঞেস করত। প্রতিবার।
তিন নাম্বার প্রশড়ব থেকে জাবরার চালাকি নতুন মোড় নিত। নেবেই। জানা
কথা।
 
জাবরার ডান পা ততক্ষণে ভ্যানগাড়ির সামনের জোড়া রডে তোলা। কুমড়া
পাতার সবুজ তার লুঙ্গিখানায় ঘন খয়েরী খোপ খোপ দাগ কাটা। সেই লুঙ্গি
দারুণভাবে সামলে এক পা রডে তুলে ভ্যানে বসে জাবরা। আর এরপর রিংকুর
কথা জিজ্ঞেস করে।
 
‘রিংকু ভাল আছে? সেদিন দেইখলাম। তোমার কথা শুধিয়েলাম। রিংকু
ইশকুলে যায়?’
 
তিন চারটা কথা একত্রে বলে জাবরা। শেষ প্রশড়বটা করার সময় ও ‘ইশকুল’
শব্দটা বেশ খানিকক্ষণ টেনে বলে, আর ‘যায়’ শব্দটা তড়িঘড়ি করে যেন ছেড়ে
দেয়। এতক্ষণ পর্যন্ত ধৈর্য রেখে জাবরার কথাবার্তা সহ্য করার পর এই প্রশড়বটায়
আমার গা জ্বলে যায়। সেটাও যে আমি সহ্য করি, তার কারণ রিংকুর ইশকুলে
যাবার ঘোষণা দিতে পারলে আমার ক্ষতি কিছু নেই, লাভই বরং। জাবরা
এরপর একটু উচাটন হয়ে যেতে পারে, যায় সচরাচর। সেটা মন্দের ভাল অন্ত
ত। ওর ঐ ঠাটে বসে থাকা, আর ফূর্তির গলায় কথা বলতে থাকা কোনোটাই
যে ঠিক হচ্ছে না সেটা আমি বুঝতে পারি। কিন্তু তেমন কিছু করতে পারি না।
নিশপিশ লাগে। ইশকুল সংμান্ত খবরাদি দেবার পর ওর যে খানিক উচাটন
লাগে, সেটা ওর ঐ হামবড়া ভাব থেকে অনেক ভাল। অনেক আরাম লাগে
আমার। ফলে আমি বলি, বেশ খানিক হাসি মুখে ঝুলিয়ে রেখেই বলি--
‘স্কুলে যাবে নাতো কোথায় যাবে!’
আমার দৃঢ় জবাবে জাবরা খানিক বিব্রত হয়, ওর ভুল বোধহয় বুঝতে
পারে।
 
‘তাতো ঠিকই। এমনিই শুধিইলাম। গান গাইচ্ছে?’
‘তো, গান গাবে না কেন?’
‘হারমানি দিয়ে গাইচ্ছে? হারমানির মেলা দাম নাগো?’
দুইটা প্রশড়ব করে একটু থেমে শেষ প্রশড়বটা করে জাবরা। আমি আড়চোখে ওর
ভ্যানগাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকি।
‘এই ভ্যানগাড়ির থেকেউ বেশি?’
 
আসলে জাবরার বোধোদয় হয় না। আমারই বোঝা উচিত। আমার এত
সাফ সাফ স্বরেও ওর কথা থামে না। ভ্যানগাড়ির দাম বলা আসলে বাহানা।
আমি ওর এই প্রশড়ব নিয়ে মাথা ঘামাই না। মাথাটা তখন রাগে ভরা। রাগগুলো
তখন মাথায় চিন্তা হয়ে ঘুরতে থাকে।
 
রিংকু যখন হারমোনিয়াম নিয়ে বাজায়, দুই জানালাওয়ালা ঘরের একটা
জানালায় তখন জাবরা হাঁচড়ে পাঁচড়ে ওঠে। বাবরার এই বাতিক ছিল না। কুড়ি
ইঞ্চি পুরু দেয়ালের জানালায় বসবার জায়গা পাওয়া যায়। কিন্তু সেটা ঘরের
ভিতর দিকে। বাইরের দিকে পা রেখে দাঁড়ানোই কষ্ট। জানালা বেয়ে উঠেই
জাবরার পর্দা সরাতে হতো। মার হাতে সেলাই করা ছোটখাট লুঙ্গি মাপের
একখানা নীল পর্দা। জাবরার পাশে শিক ধরে শক্ত করে দাঁড়িয়ে আলতাবানু।
কপালে কাজলের টিপ। গলায় লাল সাদা পুঁতির মালা। জাবরা জানালা বেয়ে
ওঠার আগে ঠেলে ঠেলে আলতাকে তুলে দেয়। ঘরের মধ্যে তখন প্রায় নিজের
সমান মাপের একটা হারমোনিয়াম বাজাতে থাকে রিংকু। ইচ্ছেমত বাজায়। ও
যে বাতাস ভরে আওয়াজ করতে পারে তাতেই আমরা উত্তেজিত হয়ে থাকতাম।
ওর যে সুর করে হারমোনিয়াম বাজানোর কথা না, সেটা সবাই জানতাম।
জাবরাই জানত না। এই সঙ্গীতময় ঘরে তখন জানালায় ঝুলে থাকা জাবরা
আমাদের কেমন লাগত, এ নিয়ে ওর বিশেষ কোনো ধারণাই ছিল না। ও ঠিকই
জিজ্ঞেস করে বসত--
‘কি বাজাইচ্ছ গো?’
 
আর আলতাবানু তখন ওর ধ্যাবড়া-করে কাজলপরা চোখে রিংকুর দিকে
তাকায়। হারমোনিয়ামের দিকে তাকায়। ঘরের এদিক সেদিক তাকায়।
মাঝেমধ্যে তার ভাইয়ের দিকে, যার ঘাড়ে চড়ে একটু আগে এসেছে আর
জানালায় চড়েছে। ঘরের মধ্যে তখন হারমোনিয়াম আর প্রশংসা আর চাপা
গজগজানি। ঘর বলতে ছয় হাত চওড়া আর আট কি নয় হাত লম্বা একটা ঘর,
দুইটা জানালা, একটা কুলুঙ্গি। একটা খোলাবাজারের আমকাঠের খাট, একটা
জামকাঠের চৌকি−বাড়িওয়ালি দিয়েছেন। খাট আর চৌকি পাশাপাশি জোড়া
দিয়ে ঘরের অর্ধেক খেয়ে নেয়। ঢোকার দরজাটা ঘরের ঠিক মধ্যখানে হওয়াতে
খাটচৌকির জোড়া একপাল−া দরজা বন্ধ করে রাখে। অন্য অংশে কেরোসিনের
চুলা, দেয়ালের তাকে কৌটার রাজ্য, কাঁসার খানকয় বাসন আর গেলাস আর
চীনামাটির জোড়া মেলানো ছয় খানা কাপপিরিচ। সেই ঘরের জানালায় জাবরা
আর আলতাবানু ঘরের ভেতরে হারমোনিয়াম বাজছে। জাবরা আলতার পিঠে
হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করে--
‘দেইখিছিস?’
 
আলতা ঘরের অন্য প্রান্তের আধখোলা দরজার দিকে তাকায়। ঘরের মধ্যে
হারমোনিয়াম আর গজগজানি।
 
ভ্যানগাড়ি আর হারমোনিয়ামের দামের একটা তুলনামূলক আলোচনাতে
জাবরা সুবিধা করতে পারে না। কারণ, এসব ব্যাপারে যে প্রশ্রয় দিতে নেই সেই
নীতিবোধটা আমার খুব ভালই আছে। ততক্ষণে জাবরার পুরোপুরি মন উচাটন
হয়ে গেছে। জোড়া রড থেকে ডান পা নামিয়ে জাবরা প−াস্টিকের স্যান্ডেল
সমেত প্যাডেল ধরে। হাতল সোজা করতে করতে সামনে তাকায়। তারপর
একটা পরিস্থিতি বলার মত করে নিচু স্বরে বলে--
‘আলতা তো ইশকুলে যেইতেই চায় না!’
 
ওর মনের ভাবটা বুঝতে পেরে আমার মোটেই খুশি লাগেনি কখনো।
প্যাডেলে চাপ দেবার সময় ‘এইসু’ বলে যায় জাবরা। ওদের বাড়িতে যাবার
দাওয়াত দিয়ে চলে যায় ও।


আলতাবানু
আলতাবানুকে আমি প্র ম প্র ম দেখি জাবরার সঙ্গে। জাবরার ঘাড়ে, মানে
পিঠে সওয়ার হয়ে আমাদের তিরিশ টাকার বাসায় এসেছে। সত্যি করে বললে
বাসার উঠানে। দুজনেই হাঁপিয়ে ধুপিয়ে একশা। জাবরা হাঁপাচ্ছে আলতাকে
পিঠে করে নিয়ে এসে। অনেক তো আর বড় নয় ও আলতার থেকে। কত এই
চার, পাঁচ কি বড়জোর ছয় বছরের। আর আলতা হাঁপাচ্ছে এক হাতে ভাইয়ের
মাথা চেপে ধরে বসে থাকার অস্বস্তিতে। অন্য হাতে তখন তার লজেন্সের কাঠি।
পাঁচ পয়সায় পাওয়া যেত তখন। মিষ্টি খানিক ছিল, কিন্তু লাল ছিল আরো
বেশি। আলতার হাতের আঙুল, গাল, থুতনি, সম্ভবত জাবরার কিছু চুলও লালে
আর লালায় মাখামাখি। আলতা বটে। এমনিতেই, কাঠি লজেন্স না খেলেও,
আলতা লালচে। ওর মায়ের মত। কাঠি লজেন্সের লালটা আবার অন্য রকম।
লাল বললে চলে। কিন্তু গোলাপি বললে আরও ভাল। হাওয়াই মেঠাইয়ের মত।
নেশা ধরে যায় দেখতে থাকলে। উত্তেজনায় বার কয়েক আমি কিনেছি,
খেয়েছি। এ নিয়ে খানিক অশান্তিও হয়েছে। এই দারুণ লাল রঙটা বাবা কিংবা
মা কাউকেই খুশি করেনি কখনো। বাবা কিছুতেই বুঝতেন না চার আনা করে
টফি খাওয়ানোর পরও এটা কেন খাই। আমিও ভারি অবাক হতাম। টফি আর
এইটার মধ্যে তুলনাটা কিভাবে করেন তিনি। যাকগে সে অন্য প্রসঙ্গ। উঠোনে
এসেই ভাইয়ের পিঠ ছেঁচড়ে নেমে যেত আলতা। ফোলানো একটা ইজের ঘটি
প্যান্ট। পরা থাকলে এ্যালুমিনিয়ামের ঘটির মত গোল দেখায়। খালি গায়ে
গলায় একটা লাল সাদা পুঁতির মালা। চোখে কাজল। কপালেও একটা
কাজলের টিপ। পিঠ ছেঁচড়ে নেমেই কাঠি লজেন্সের মাথাটা জিহ্বায় ঠেসে ধরে,
চোয়ালটা ঝুলিয়ে, ঘাড়টা যতখানি পারা যায় ত্যারছা আর গোঁজ করে, বড় বড়
চোখ করে আমাদের দিকে তাকাবে আলতা। হতে পারে এইরকম দেখাগুলাই
আলতাকে আমার প্রম দেখা না। কিন্তু আলতা আর জাবরার কথা মনে করলে
এটাই আসে আগে। সেসব অনেক দিন আগের কথা। এখানে এসে প্রাইমারি
স্কুলে আমি থ্রিতে ভর্তি হয়েছি তখন।
 
আলতাবানুদের বাসা আর আমাদেরটা খুব কাছে। নতুন জায়গায় এসে
সর্বনিু তিরিশ টাকায় যে বাসাটা, পাকাও বটে, বাবা খুঁজে পেয়েছিলেন সেটা
ঘটনাচμে জাবরাদের পাড়াতেই। তারপরই আমাদের নিয়ে আসেন বাবা।
জাবরাদের বাসাটা আসলে বাড়ি। ওর আম্মা পৈতৃক সূত্রে একখণ্ড জমি
পেয়েছিলেন ভিটাতে। সেখানেই মাটির দেয়াল তুলে জাবরাদের ঘর। জাবরা,
বাবরা, আলতাবানু, ওদের আম্মা, আর আব্বা লালুমিয়া, গোলাপবানু তখন
একেবারে মায়ের কোলে। বোঝাই যাচ্ছে গোলাপবানু হচ্ছে গে আলতাবানুর
ছোট সবার ছোট বোন। লালুমিয়া কামলা খাটেন, ওখানে বলে মুনিষ খাটা।
যখন যা পান তাই করেন, কিন্তু তার পাকা হাত বেড়া বোনায়। চিটার বেড়ায়
সবচেয়ে পাকা, পুঁটুশও ভাল, বাঁশবাকালিরও করেন। অর্ধেক বছরই তাঁর কাজ
নাই। এসবই চলতে ফিরতে জানা। মাঝেমধ্যে জাবরার আম্মা এসে বলেন।
ধুলামাখা পায়ে আমাদের বাসার রকেই বসতেন তিনি। আমার মায়ের সঙ্গে
এসব আলোচনা তাঁর শেষে মোটামুটি সংসারের মাপে এসেই ঠেকে। ঠিক
কতজনার সংসার থাকা ভাল সাধারণত সেটা নিয়েই মা বলেন। সেরকমই মনে
পড়ে আমার। একেক দিন বাড়িওয়ালি আসতেন। আক্ষেপ করতেন,
দোকানদার ভাইয়েরা কিভাবে মুনিষের সঙ্গে বোনের বিয়ে দেয়। জাবরার দুই
মামা দোকানদার। চারপায়া দোকান তাঁদের।


সওয়ার
রাস্তায় চলতে ফিরতে জাবরার সঙ্গে দেখা হতো। আস্তে আস্তে সেটাও কমে
গেছে। আমরা তখন অন্য পাড়ায় থাকি।
রাস্তায় ভ্যান চালাতে চালাতে জাবরার পা আরো লম্বা হয়েছে তখন।
পুরোটাই নাগালে ওর। আমাদের বাসা বদলের সময়ে একবার জাবরাও ভ্যান
নিয়ে এসেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসায় গেছি। সেই গম্ভীর মুখ চিরে হঠাৎ
হাসি। জবর আলী। নরম নরম নতুন দাড়িতে ওকে অদ্ভুত রকমের সুন্দর
দেখায়। কখনো অবশ্য সেটা বলা হয়নি। দাড়িগুলো ও ঝুলিয়ে দিয়েছে।
জামাটা তখন অন্য রকম। ঝোলানো জামা। পাঞ্জাবির মত পাশে পকেট। কাঁধে
একটা গামছা। আমি সেবারে অনেক চেষ্টা করেছি ও যাতে কিছুতেই একহাত
এগিয়ে না থাকে। কিন্তু যেই না আমাকে জিজ্ঞেস করল ‘ভালো আছো?’ আমার
ঝামেলাটা পাকাতেই থাকল। এরপর যথারীতি ও আগের জায়গাতেই যেতে
থাকল, আর প্রশড়ব করতে থাকল। আর বাসা পর্যন্ত এসে যখন রিংকুকে দেখতে চাইল তখন ও পুরোপুরি মুরুব্বি। আমি যথারীতি ওর পোষা বেড়ালের মত।
 
আমি লক্ষ্য করলাম আগের মত একটা গোছানো রাগও তখন দাঁড়াচ্ছে না। বেশ
কঠিন পরিস্থিতি।
রিংকুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে জাবরা এবারে খবর জানতে চায়।
বিশ্ববিদ্যালয় ওর কাছে কলেজ।
‘তোমাদের কলেজটা সুন্দোর?’
আমি টেনে বলি ‘হ্যাঁ!’
জাবরা হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে ‘রিংকু ওই কলেজে পইড়বে?’
আমি বলি ‘হ্যাঁ, পড়বে তো!’
আলতাবানুর কথা জিজ্ঞেস করা আমার আর হয়ে ওঠে না। জাবরার কথা
এরপর ভুলতেই বসেছি।
ছুটির মধ্যে ঢাকা থেকে বাসায় গেছি। দুপুরে আলসেমি। আর সঙ্গে করে
নিয়ে যাওয়া ক্যাসেটের গান শুনছি। আমাদের তখন আড়াই ঘরের বাসা। রিংকু
এসে ক্যাসেট থামিয়ে বসে। হারমোনিয়াম বাজিয়ে একটা দুইটা গান গায়। এক
কথা দুই কথা কখন যেন জাবরা এসে পড়ে। মাকে জিজ্ঞেস করি--
‘মা, জাবরার খবর জানো কিছু? কী করে?’
‘কী আর করবে? তিনদিনে একদিন ভ্যান চালায়।’
‘তিনদিনে একদিন ভ্যান চালায় মানে কী?’
‘তোর বাবা তো বলল জাবরা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। রিংকুও তো বলল।
অসুখ হয়েছিল তো খুব।’
‘কী অসুখ?’
‘কে জানে! হাসপাতালেও তো ছিল। একমাসের মত। রাখে নাকি
অতদিন?’
‘হাসপাতালে বলেনি কী হয়েছে?’
‘জানি নাতো বাবা! আর জানলেই বা কী?’
খানিকক্ষণের জন্য চুপচাপ কাটে আমার। আবার গুছিয়ে জিজ্ঞেস করি--
‘আলতাবানুর খবর জানো?’
‘আলতাবানুর মেয়ে হয়েছে।’
‘কে বলল?’
‘রিংকুই তো বলল।’
‘জানলি কী করে রে?’ রিংকুকে আমি জিজ্ঞেস করি।
‘জাবরার সঙ্গে দেখা হলো রাস্তায়। ওর শরীরের কথা জিজ্ঞেস করলাম।
তখন নিজের কথা না বলে আলতার কথা বলল।’
‘কী অসুখ হয়েছে রে?’
‘কার?’ রিংকু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘জাবরার।’
‘আহা। ও তো বললই না কিছু। হাসল। হাসতেও পারে না ঠিকমত।’
আবারও খানিক চুপচাপ কাটে আমার।
‘আলতার শ্বশুরবাড়ি কই রে?’
‘ঝাউবাড়ি।’ রিংকু জানায়।
‘কী করে ওর বর?’
‘মুনিষ খাটে, আর কী করবে?’ মা বলেন এবারে।
‘আলতার মেয়ে হলো কি জাবরাদের বাড়িতে?’
‘না হাসপাতালে। বলল আলতাকে আনতে পারেনি। পয়সাপাতি নেই।
কাজবাজ প্রায় বন্ধ।’
‘তো?’
‘শ্বশুরবাড়িতেই ছিল। পানি নেমে গেছিল বলল। ওর ভ্যানে করে
হাসপাতালে নিয়ে এসেছে।’
‘ওর ভ্যানে মানে?’
‘জাবরার ভ্যানে!’ আমার প্রশেড়ব রিংকু অবাক হয়ে যায়। 

ভুলু চেয়ারম্যানের তামাকের গুদামে জাবরা ভ্যান নিয়ে এসেছে যখন ওর
আর নামানোর উপায় নেই। সামনে পড়ে থাকা তামাকের গাঁটের ওপর বসে
গামছা দিয়ে মুখ ঢাকে ও। মুখ মোছে, দাড়ি মোছে। অর্ধেক শরীরে মুখের
থেকে দাড়ি তখন বড় দেখায়। হাসপাতালের ডাক্তার বলেছে বিশ্রাম নিতে।
আটমণী ভ্যান থামিয়ে তামাকের গাঁটের ওপর বসে বিশ্রাম নেয় জাবরা।
গোলাপবানু তখন দৌড়ে আসে। বাবরাও তখন রিকশা চালায়। সেও রিকশা
নিয়ে খুঁজতে বেরিয়েছে জাবরাকে। গোলাপবানু এসে জাবরাকে জানায়।
ধুমধাম করে ভ্যান খালি করে জাবরা ঝাউবাড়িয়া ছোটে। চার মাইল রাস্তা।
জাবরার মনে হতে থাকে চৌদ্দ মাইল। আলতার কথা নাকি ডাক্তারের কথা
ভাবতে ভাবতে ও ঝাউবাড়িয়া ছোটে। আলতার বাড়ির উঠানে যখন ভ্যান
থামিয়ে দাঁড়ায় জাবরা, তখন ওকে ভাল দেখায়, নাকি আলতাকে ভাল দেখায়,
সেটা বলতে পারবে কদম, আলতার বর। দুপুর থেকেই আলতা ছটফট করছে।
আগের বার যখন হাসপাতালে গেছে, ডাক্তার বলেছে এ্যানিমিয়া। জাবরা
আসার এক দেড় ঘণ্টা আগে আলতার পানি নেমে গিয়েছে। কদম এদিক
সেদিক ভ্যানের জন্য দৌড়াদৌড়ি করে। নগদ একশ টাকার চিন্তায় পরিচিত
লোক খুঁজতে থাকে। হয়রান কদম দেখেছে জাবরার ভ্যান আসছে। কদম
দৌড়ে এসে পোঁটলা-পুঁটলি তৈরি করে। কদমের মা গোছাতে থাকেন কী
লাগবে।
 
ভ্যানের ওপর পোঁটলা দু’ তিনেকের মধ্যে শুয়ে আলতা। মাথার পাশে তার
শাশুড়ি। উরুর কাছ ঘেঁষে কদমের ছোট বোন। কদম পাশে পাশে দৌড়াচ্ছে।
গরুর গাড়ির রাস্তায় বর্ষাকালের কাদার চাঁই। বর্ষার পর ভীষণ শক্ত, ভীষণ
এবড়ো থেবড়ো। জাবরার শুকনো মুখ বেয়ে বড় বড় চোখে সেই রাস্তার মসৃণ
খাদগুলোতে তাকিয়ে থাকে। ভ্যানের চাকা রাখতে চায় সেখানে। ভ্যানের উপর
বসে দোয়া পড়তে থাকেন কদমের মা। নিঃশব্দে পড়তে থাকে জাবরাও। আর
আলতা সশব্দ। জাবরা এসে পেীঁছানোর পর থেকেই যন্ত্রণার চিৎকার থামিয়ে
দিয়েছে। ভ্যানে শুয়ে বড় বড় ঘন ঘন শ্বাস নিতে নিতে ভাইজানের সঙ্গে কথা
বলে আলতা--
‘ভাইজান। চিন্তা নাই। ঠিইক হইয়ে যাবে।’
 
জাবরার বুকে দুশ্চিন্তার ধুকপুকানি, নাকি একমাস হাসপাতালে কাটানো হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি ডাক্তারই ভাল জানেন।
 
এবারে চল্লিশ মাইলের চ্যালেঞ্জ লাগে জাবরার। ও আরো সাবধানে মসৃণ খাদ খোঁজে, আরো জোরে চালাতে চায়। হাসপাতালে এসে যখন পৌঁছায়, রাত তখন আটটা। ছোট শহরের হাসপাতাল প্রায় ডাক্তারশূন্যই থাকে। আটটায় তো
বটেই। তার মধ্যে বিছানা পর্যন্ত কখন আলতাকে নিয়ে যেতে পেরেছে, সেটা সঠিকভাবে জানা যায় না। তারপরই কেবল, কেবল তারপরই জাবরা এক গ্লাস পানি চেয়েছে কারো কাছে। পুরো গ্লাস খেতে পারেনি। তার আগেই হাসপাতালের বারান্দায়, মেঝেতে শুয়ে পড়েছে। 

রিংকু যখন জাবরাকে ওর শরীর নিয়ে জিজ্ঞেস করে, জাবরা সে কথা না বলে আলতার গল্প করেছে। আলতার মেয়ের গল্প করেছে। একমাস হাসপাতালে থাকার কথা মুখেও আনেনি। জিজ্ঞেস করাতে নাকি খালি হেসেছে। ডাক্তাররা ওকে বিশ্রাম নিতে বলেছিলেন। দ্বিতীয়বার যখন হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়, তখন চিনতে পারা নার্স-কম্পাউন্ডাররা কী বলে গালমন্দ করেছে জাবরা বলতেই পারবে না। কারণ ওই পানির গ্লাস না খেতেই মেঝেতে শুয়ে পড়েছে জাবরা। গালমন্দগুলো শুনতে পায়নি বলে ও দ্বিতীয় বার অসুস্থ হবার কথা ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দেয়নি রিংকুকে। আলতার কথা বলেই পার পেতে চেয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ