বদলা


সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ

কতরকম বদলার ব্যবস্থাই না রয়েছে নানা ধর্মে ও অধর্মে। যিশু বলেছেন, এক গালে কেউ চড় দিলে অপর গালটি পেতে দেও। আরও কে-কে কী-কী বলেছেন তা-সব তো জানেন। যিশুরটিও যে জানেন না তা-ও বলছি না। আর শব্দটির কী ব্যঞ্জনা! কী ঝঙ্কার! এর প্রতিশব্দগুলিকে এর পাশে নেহাত নিরামিষাশী মনে হয় না কি? মনে হয় না, যে, প্রতিশোধ, ভেন্দেত্তা, - এগুলিসব বড় বেশি সাহিত্যিক? অর্থাত্ নীরক্ত? অথচ, বদলা - আহ্! বাংলা, হিন্দি, সকল প্রকার সিনেমার বিজ্ঞাপনে-অহো! ব দ্ লা! আভিধানিক অর্থটাই দেখুন না : বদ মানে বলা বাহুল্য, লা মানে নঞ্, নিগেটিভ, নাই, না - যথা লা-জবাব। একে বদ, তায় লা! বদলা, বোদলা, বোদল্যা, বোদলের...

কাজেই বদলার একটা গল্প :

আব্দুর রহিম শেঠ এবং আজাহার মোল্লা প্রতিযোগী আড়তদার। উভয়েরই একটি করে ছোট ভাই, জলিল শেঠ এবং আতাহার মোল্লা। তো একদিন ব্যবসায়িক রেশারেশির বশে রহিমের মনে হয় যে আজাহারকে খুন করা উচিত, এবং সে কতিপয় খুনেকে ভাড়া করে। অবশ্য শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত সে বদলায়, সে বলে, হালায় মইরা গেলে কার লগে গুঁতাগুঁতি করমু? - এবং খুনেদের বরং আজাহারের ভাই আতাহারকে কোতল করার আদেশ সে দেয়।
আতাহারকে হারিয়ে আজাহারের আহাজারি চলে তিন মাস। তারপর সে বলে, ভাই হারানোর দুঃখ যে আমারে দিছে, তারেও সেই দুঃখ দেওয়া হবে, কী বলো মিঞারা? - মিঞারা যা-ই বলুক, অচিরেই রহিম শেঠ, জলিল হারা হয়। রহিম, ভ্রাতৃশোকে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে, আজাহারের শপথ উক্তি রিপিট করে - ভাই হারানোর... ইত্যাদি। এবার কিন্তু মিঞারা বলে, কিন্তুক তার ভায়েরে তো তুমি আগেই...? রহিম কাজেই ধাতস্থ হয় এবং পূর্ববত্ কারবারে মনোনিবিষ্ট হয়। কিন্তু আহা রে! ভাইটার লাগি পাঁজরে পাঁজরে হাহাকার! মনের ভুলে খেনে খেনে - জলিল্যা! ওদিকে আজাহারেরও আড়তে অদৃশ্য আতাহারের ডাক প্রায়শঃ পড়ে।
দিন যায়।
শেঠ-মোল্লাদের কারবার আবার ভালোমতো চলতে লেগেছে। মোল্লার পাশের দোকানে শেঠ এলে মোল্লা কান খাড়া করে, শেঠ গলা উঁচোয়। এবং ভাইসি ভার্সা। দূর থেকে দেখতে পেলে আড়চোখ-চোরচোখ। এইরকম। - পরে একদিন গলিতে মুখামুখি। হায়! তারা কি এমন ভাব দেখাবে যে কেউ কাউকে দেখতেই পায় নি? কিন্তু যেখানে সরাসরি দুটো শরীর - দুদুটি আড়তদারের দরাজ গতর - শারীরিকভাবেই সরু একটা গলিতে... না দেখার ভাব কীভাবে? তো এখন কী করা লাগে? ভ্রাতৃহন্তাকে সালাম দিয়ে বলা - ভাইজান, ভালো?? নাকি, দাড়ি খিঁচে নাকে দুম? - কিন্তু, যার ভাইকে হত্যা করেছি, তাকে আবার মারধর? মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা?
দুজনের এইরূপ চিত্তবৈকল্যের এক পর্যায়ে, রহিম কিংবা আজাহার, বা হয়তো রহিমই, আমি ঠিক ঠিক বলতে পারব না, বলে, দ্যাখেন, আমরা দুজনেই ভাইহারা। একটা ভাই যার না মরছে, সেয়্ ছাড়া আর কে বুঝবো?
আজাহার (কিংবা রহিম) জবাব দেয়, সত্যই বলতেছেন, ভাইসাব। আমরা দুইজনেই এক দুঃখের দুঃখী।
তখন অন্যজন - আপনে... আপনে আমারে আতাহার ডাকতে পারেন, ভাইজান! - বলতে বলতে হুহু কাঁদে রহিম (সম্ভবতঃ)।
আপনেও আমারে জলিল ডাইকেন! - বলে কোলাকুলি।
ফলে, তারা বদলা নিয়েও ভ্রাতৃহীন হয় না। তাদের কারবার ও বিষয়াশয়ও ইন্ট্যাক্ট্ থাকে।
(১৯৯৬)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. "বদ মানে বলা বাহুল্য, লা মানে নঞ্, নিগেটিভ, নাই, না - যথা লা-জবাব।"

    দু'টো মিলে তাহলে কী দাঁড়ালো? বদ-না?
    মানে বদলা আসলে বদনা।

    উত্তরমুছুন