ইস্ত্রি


শাহনাজ মুন্নী

আমার কোন ইস্ত্রি নেই, স্ত্রীও নেই। ইস্ত্রি না থাকায় আমি কুঁচকানো কাপড় চোপড় পরেই চলাফেরা করি আর স্ত্রী না থাকায় কেউ সেই কুঁচকানো কাপড় চোপড় নিয়ে আমার সাথে খ্যাচ-ম্যাচও করে না। অনেকেই বলেন, ইস্ত্রি আর স্ত্রীর স্বভাব নাকি খানিকটা কাছাকাছিই, দুজনই গরম স্বভাবী আর দুজনই সবকিছুকে ডলে পিষে সমান করে দিতে ওস্তাদ। ওদের কথা কতখানি সত্য আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না কারণ শুরুতেই বলেছিস্ত্রী বা ইস্ত্রি কোনটাই আমার নেই। তাছাড়া আমার পরনের  কাপড়ের মতো আমিও খানিকটা কুঁচকানো বা কুঁকড়ানো স্বভাবের, আমাদের আঞ্চলিক উচ্চারণে যাকে বলে ক্যাঁড়ার মতো স্বভাব। 
ক্যাঁড়া হচ্ছে, আপনারা জানেন, সেই কালো রঙের বহু পা বিশিষ্ট ছোট্ট লম্বাটে প্রাণী যে কিনা একটু বাঁধা পেলেই গোল হয়ে গুটিয়ে যায়, আমার অবশ্য কোন বাঁধা লাগে না এমনিতেই আমি নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকি, কচ্ছপের মতো আমার একটা সুন্দর খোলস থাকলে বেশ হতো, প্রয়োজন মতো গলাটা টেনে লম্বা করতাম আবার ইচ্ছে করলেই হাত পা গলা সহ ঢুকে যেতে পারতাম নিজের শক্ত খোলসে। গভীর বৃষ্টির শব্দ কিংবা কারো ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস দুটোই আমার কাছে সমান, দুটোই আমাকে এতো শীতল করে দেয় যে আমি সেঁধিয়ে যেতে চাই আমার গহীন কোটরে।

আপনাদের বলেছিলাম, আমার স্ত্রী নেই, কেন নেই? নেই, কারণ আমার একজন স্বামী আছেন, স্বামী থাকলে স্ত্রী থাকবে কিভাবে, উল্টো আমিই তো সেই স্বামীর স্ত্রী। বাড়িতে ইস্ত্রি না থাকায় আমার স্বামীরও কোন অসুবিধা নেই, কারণ ঘরে স্ত্রী আছেন যিনি তাকে ইচ্ছে মতো ডলে পিষে সমান করে ফেলবেন অথবা বাইরে লন্ড্রীর দোকান আছে, কাপড়-চোপড় সেখানে দিয়ে এলেই তা পরিপাটি হয়ে ফিরে আসে। না, আসলে সেসব কিছইু না, কারণ স্ত্রী হলেও আমি যে ইস্ত্রি স্বভাবী নই সেটা এতক্ষণে আপনারা নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন, প্রকৃত সত্য হচ্ছে আমার স্বামীও আমার মতোই ভীষণ কুঁচকানো স্বভাবী, নিজের মধ্যে কুঁকড়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করেন তিনি। আমরা দুই ক্যাঁড়া কিভাবে এক হলাম, সেটাই অনেকের কাছে শুধু নয় আমাদের কাছেও রীতিমতো বিস্ময়। আমাদের একের অন্যের প্রতি তেমন কোন দাবি-দাওয়া নেই, চাওয়া-পাওয়া নেই, আকাঙ্খা নেই, প্রত্যাশা নেই। আগ্রহ আছে কি-না, তাও প্রশ্ন। আমি আমার মতো আর তিনি তার মতো ঘন্টার পর ঘন্টা একই ভাবে যে যার কোটরে বন্দী থাকতে পছন্দ করি। আমাদের মধ্যে কোন রকম মিথস্ক্রিয়া না হওয়ায় কোন গল্পও তৈরি হয় না। সংকট বা সংঘর্ষও তৈরি হয় না। আমাদের ইস্ত্রি ও গল্পবিহীন জীবন কাটতে থাকে সরল রেখার মতো নিরুপদ্রবে .. আমাদের কাছে তথাকথিত উচ্চাকাঙ্খা অর্থহীন, চলমানতা নিরর্থক, প্রতিযোগিতা হাস্যকর, সূর্য বা চাঁদের আলো, দিন বা রাতের আঁধার আমাদের মধ্যে কোন পরিবর্তনই আনে না।

বলবেন, এভাবে কি বাঁচা যায়? অবশ্যই যায় যদি আপনার চাহিদা সীমিত হয়, যদি শপিং মলের উজ্জ্বল ঝলমলে জানালার হাতছানি থেকে আপনি নিজেকে আগলে রাখতে পারেন। বলবেন, সমাজ-সংসারের প্রতি দায়িত্বের কথা? কর্তব্যের কথা।  সেই দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করতে গিয়েই তো যত বিপদ, যত অনাসৃষ্টি.. যত দায়িত্বহীনতার জন্ম। আপনি বলবেন, সকলেই এমন হলে তো জগৎ সংসার অচল হয়ে যাবে। কথা সত্য, জগৎ সংসার তো আর আপনার আমার নিয়মে চলে না। সে চলে তার মতো। আমি বা আমরা চলি আমাদের মতো।

এভাবেই যখন বেশ নির্বিঘ্নে চলে যাচ্ছিলো সব কিছু তখন আমাদের কয়েকজন নাছোড়বান্দা আত্মীয় হঠাৎই আমাদের একটি অত্যাধুনিক ইলেকট্রিক্যাল ইস্ত্রি উপহার দেয়। আমরা বিরক্ত হয়ে নিদারুণ অবহেলায় সেটিকে খাটের নিচে নানারকম আবর্জনার সাথে ফেলে রাখি। ইস্ত্রির স্বভাব আমাদের মোটেও পছন্দ নয়, ইস্ত্রি হচ্ছে একটা ছোটখাটো বুলডোজার, রুদ্র স্বভাবের একপেশে যন্ত্র।  ইস্ত্রিটার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম হঠাৎ একদিন স্বপ্ন দেখি, ইস্ত্রিটা ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে ,তাকে কেন ব্যবহার করা হলো না সেই দুঃখে। ভারী মুশকিলে পড়লাম আমরা, যে কারো কান্না, তা সে রক্ত মাংসের মানুষেরই হোক বা লোহা লক্কড়ে তৈরি ইস্ত্রিরই হোক, আমাদের আরো কোটরমুখী করে তোলে। আমি ভাবলাম ইস্ত্রিটা কাউকে দান করে এই ভেজাল থেকে মুক্ত হয়ে যাই। শেষ পর্যন্ত তাই করলামরাস্তার পাশের একজন ভিখারিকে ডেকে ইস্ত্রিটা দান করে দিলাম। এবার নিজেকে বেশ ফুরফুরে ভারমুক্ত লাগলো, আমার পরনের প্রিয় কুঁচকানো কাপড়-চোপড়ে স্বস্তি ফিরে এলো। কিন্তু সেই স্বস্তি দীর্ঘস্থায়ী হলো না, কারণ দুদিন পরেই ভিখারি এসে ইস্ত্রিটা ফেরৎ দিয়ে গেল, কারণ এই বস্তু নাকি তার কোন উপকারেই লাগেনি। একে তো ফুটপাথে, যেখানে সে ঘুমায় সেখানে বিদ্যুৎ নেই তার উপর ইস্ত্রি করে পরার মতো কোন কাপড়ও তার নেই। এক দোকানে ইস্ত্রিটি বিক্রি করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছে সে, দোকানী তাকে উল্টো দোষী করেছে এই বলে যে, এটি নিশ্চয়ই চোরাই মাল, এমনকি এই মালসমেত তাকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করার ভয়ও দেখিয়েছে দোকানী। সুতরাং এই আপদ ভিখারি আর কিছুতেই তার সঙ্গে রাখতে রাজি না। ফলে ইস্ত্রি আবার আমাদের ঘরে খাটের তলায় তার পুরনো স্থানে শুয়ে বসে ঝিমুতে লাগলো .. আত্মীয়রা আমাদের উপর বেজায় খাপ্পা হয়ে গেলেন, এই জনগণ কি আসলে বৈচিত্র্য পছন্দ করে না ? আমরা যদি তোমাদের ইস্ত্রি করা ধবধবে পরিপাটি কাপড় দেখে নাক না কুঁচকাই, তবে তোমরা কেন আমাদের ইস্ত্রিবিহীন, কোঁচকানো কাপড় দেখে নাক সিঁটকাবে? আমি যদি আমার গহ্বরে শান্তিতে থাকি তবে তাতে তোমার আপত্তি কেনোআমি কি তোমাকে বলেছি আমার মতো হও .. নাকি আমি বললেই তুমি পাল্টে গিয়ে আমার মতো হয়ে যাবে? আমরা কি তোমাদের কোন ক্ষতি করছি বলো ..

ক্ষতি করি বা না করি আমাদের আত্মীয় স্বজনরা কিন্তু তাদের মহৎ উদ্দেশ্য থেকে নিরস্ত্র হলেন না। সর্বশেষ বিধ্বংসী অস্ত্র হিসেবে তারা আমাদের কাছে পাঠালেন একজন বিখ্যাত মানসিক চিকিৎসককে। সেই চিকিৎসক দীর্ঘ সময় আমাদের পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণ করে এমন একটি রোগ নির্ণয় করলেন, যে রোগ কিনা মনুষ্য সমাজে বড়ই দুর্লভ ও অপ্রচলিত। এইবার তিনি তার নানামুখী বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার মাধ্যমে আমাদের দূরারোগ্য ব্যাধী সারিয়ে তুলতে প্রবৃত্ত হলেন। বুঝলাম, নিজেদের মতো আমাদের আর থাকা হবে না। আমার স্বামী তাঁর গুটানো শরীর সোজা করে প্রস্তাব দিলেন লোকালয় থেকে পালিয়ে যাওয়ার। আমি সেই প্রস্তাবে সম্মত হলাম।

তারপর থেকে বাড়িঘর ফেলে রেখে এই জঙ্গলে নিজেদের মতো বসবাস করছি। কাঠঠোকরা পাখি একটি প্রাচীন গাছের অনুমতি সাপেক্ষে তার দীর্ঘ পেটানো শরীরে আমাদের দুজনের জন্য দুটি নির্মল গর্ত বানিয়ে দিয়েছে। সেখানে নিজের ভেতর নিজেকে গুটিয়ে রেখেছি মহা সুখে  .. আমাদের কোন ইস্ত্রি নেই, স্ত্রী ও নেই। না থাকাতে কোন অসুবিধাও নেই।   




লেখক পরিচিতি....................................।।
শাহনাজ মুন্নী


শাহনাজ মুন্নীর জন্ম ১৯৬৯-এর  ফেব্রুয়ারিঢাকায়। সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তিনি পেশায় টেলিভিশন সাংবাদিক। এটিএন বাংলার নিউজ এডিটর। সাংবাদিক হিসেবে বেশ জনপ্রিয়তা পেলেও তিনি মূলত লেখক। এ পর্যন্ত গল্প উপন্যাস গবেষণা মিলিয়ে তার বইয়ের সংখ্যা আঠারোটি। তার স্বভাবে আছে এক ধরণের নির্মোহতা। শিল্পেও তার প্রভাব দেখা যায়। তার গল্পে সবসময়ই একটা গল্প থাকে। চরিত্রগুলো বিকশিত হয় সহজিয়া প্রেরণায়। জবরদস্তি নয়সহজাত নির্দেশনা ধরেই যেন তার কথাশিল্পের চরিত্রগুলো নিজস্ব পথে পদচারণা করেন। তার কথাশিল্পের ভাষা রসবোধসম্পন্নকাব্যসংলগ্ন ও স্বতস্ফূর্ত। মুন্নীর কবিতাও তার ব্যক্তি স্বভাবের মতোই অউচ্চকিত। মৃদুভঙ্গীতে তিনি মোক্ষম বোধটি ব্যক্ত করে ফেলেন। যার অনুরণন থেকে যায় ঢেউ মিলিয়ে যাবার পরও।
(লিখেছেন: সরকার আমিন)
                 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ