রাশিদা সুলতানা
আমি আগে যেখানে
কাজ করতাম সেখানকার বেশিরভাগ লোক ছিল প্রভু কিংবা চাকর টাইপের। যারা চাকর তারা
আবার প্রভুও। যারা প্রভু তারাও চাকর। যিনি চাকর, তিনি তার
স্ত্রীর কাছে, আমজনতার কাছে প্রভু হয়ে ওঠেন, আর যিনি প্রভু, তিনি রাজনীতিবিদ, ক্ষমতাধরদের চাকর তো সবসময়ই। আর যারা প্রভু বা চাকর নন, তারা প্রায় ভূতের মতো অদৃশ্য। সন্দেহের চোখে তাদের দেখবার রেওয়াজ।
এক-দুইজন সরকারি ঊর্ধ্বতন প্রভুকে দেখেছি তাদের সন্তান-বয়সী প্রধানমন্ত্রীর
পুত্রকে কদমবুছি করে আনুগত্য দেখাতে। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, একবিংশ শতকে সরকারি কর্মকতা আর রাজনীতিবিদ, মন্ত্রীরাও
কেউ কেউ, মন্ত্রী আর প্রধানমন্ত্রীকে সুযোগ পেলেই কদমবুছি
করে থাকেন।
আমার প্রতিষ্ঠানের এক ঊর্ধ্বতন প্রভুকে একবার রেগেমেগে ফোনে শুয়োর বলেছিলাম। তিনি ক্ষমতাধরদের চাকর ছিলেন। তাদের সন্তুষ্ট করতে ৫০/১০০টা ক্রসফায়ারও করতে পারতেন। তিনি আমাকে বদলি করে দেন, বিভাগীয় মামলার পাঁয়তারা করেন। ভদ্রলোকের গলার নিচে থলথলে চর্বি। তিনি চোর ডাকাত মাদক-ব্যবসায়ী খুনি ড্রাগ-অ্যাডিক্ট সবার কাছ থেকে চাঁদা নিতেন। প্রয়োজনে প্রভুদের কিছু দিতেন। প্রচুর অর্থ, বাড়ি, নারী, শৌর্য এবং বীর্য তার। বুদ্ধিজীবীদের সাথেও দারুণ সখ্য। আমার বাসার ল্যান্ডফোন, মোবাইল, সবখানে আড়িপাতার যন্ত্র বসিয়ে দেন তিনি। দুয়েকবার মেরে ফেলার হুমকিও আসে। আমি দেশ ছেড়ে পালাবার কথা ভাবি।
আমার মনে এই বিশ্বাস জন্মায় যে বাংলাদেশে প্রায় সবখানেই প্রভু-চাকরেরই কাহিনী। তাড়িয়ে তাড়িয়ে ক্ষমতা উপভোগ করে মানুষ। যেখানে একটুকু ক্ষমতা-চর্চার সুযোগ আছে, সেখানেই মানুষ দানব হয়ে ওঠে। যতই বাজে সময় যাক, আমি নিশ্চিত ছিলাম এ জায়গা থেকে সরে যেতে পারবো। এ চিন্তা আমাকে গোপন শক্তি জোগাত। নিজেকে সান্ত্বনা দেই, আমি বেঁচে আছি, সুস্থ আছি। একসময় দেশ ছেড়ে চলে যাই।
এরপর নানা অভিজ্ঞতা... তীব্র তুষারপাতে, হিম বর্ষায়, রুক্ষ মরুভূমিতে, কখনো ধূসর প্রান্তরের পাশে ছোট কোনো গ্রামে। কোলাহলপূর্ণ জনপদ... বিষণ্ন উপত্যকার চূড়ায়... কতকিছু। বিদেশে ওসবই ‘অ্যানিমাল ফার্ম’ মনে হয়। ফরেন সার্ভিসে কর্মরত আমার এক বন্ধু ইরফানের সাথে একবার কোরিয়ার এক জেলখানায় গিয়েছিলাম, ওখানে আটক বাংলাদেশি এক কবিকে দেখতে। কবি মাসুম রহমান। তার কবিতা কোথাও প্রকাশিত হয় নাই। কবিতা লিখে দূতাবাসের মাধ্যমে তার পরিবারকে পাঠাতো।
জেলখানায় তার কক্ষে ঢুকতেই দেখি মেঝেতে বসে আছে ছেলেটি। উজ্জ্বল শ্যামলা, শুকনো ঠোঁট-মুখ, একজোড়া হলদে-লাল চোখ। আমাদের দেখেই চোখ নামিয়ে ফেলে। ‘প্রধানমন্ত্রী তো আসার কথা আমাকে এখান থেকে বের করে নিতে। আপনেরা আসছেন কেন? আপনারা কী করতে পারবেন?’ আমার বন্ধুটি হাত বাড়িয়ে দেয় করমর্দনের জন্য, আমিও দেই। করমর্দন-শেষে সে আবার নিশ্চুপ। মেঝেতে কিছু বই-ম্যাগাজিন ছড়ানো ছিটানো। দূতাবাসের মাধ্যমে তার বাবা-মা পাঠিয়েছে। মেঝে থেকে মুখ না তুলেই বলে, ‘আমার বাবা-মা শেষমেষ কোনোকিছুই করলো না।’ আমার বন্ধুটি বলে, ‘আপনার বাবা তাঁর পক্ষে যা-কিছু সম্ভব সবই করছেন। আর আমরাও আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে এখানে আপনি তাদের ও অন্যান্য সব কয়েদির সাথে দুর্ব্যবহার করেন। ফলে আমরা চেষ্টা করেও আপনার জন্য কিছু করতে পারবো বলে মনে হয় না।’
তরুণটি মারমুখী হয়ে ওঠে। ‘এখানে নাটক করতে এসেছেন কেন? বেরিয়ে যান। বেরিয়ে যান। পারলে আপনার প্রধানমন্ত্রীকে পাঠায়েন। আর আমার বাপ-মাকে বইলেন তারা তাদের পবিত্র দায়িত্ব সম্পন্ন করেছেন, আর কিছু করার দরকার নাই।’ আমার বন্ধুটি যথাসম্ভব মাথা ঠাণ্ডা রেখে বলে, ‘অযথা ভুল বুঝছেন আপনি।’ ‘মাথায় ঘুষি মাইরা এইখান থিকা বাইর কইরা দিবো। গেট লস্ট। মহামানবগিরি দেখায়েন না। বের হয়ে যান। আই উইল কিল ইউ। গেট লস্ট রাইট নাউ।’ তার চেহারা হিংস্র জন্তুর মতো আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। আমরা দু’জন তাড়া-খাওয়া পশুর মতো বেরিয়ে আসি।
আমি বন্ধুকে বলি, ‘ছেলেটা মানসিক রোগী, তাকে ডাক্তার দেখানো দরকার।’ সে বলে, ‘আমার আরেক কলিগের সাথে সে একইভাবে চরম দুর্ব্যবহার করেছে। জেল কর্তৃপক্ষ তাকে মানসিক রোগের ডাক্তার দেখিয়েছে। ডাক্তার নিশ্চিত করেছে, মানসিকভাবে সে সুস্থ।’ ইরফান বলে, ‘সে মাস্টার্স করছিলো এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে, কোরিয়ান কিছু বন্ধুর সাথে মাতাল অবস্থায় এক দোকানে গিয়ে ভয় দেখিয়ে জিনিসপত্র গাড়িতে তুলে নিয়েছিলো। এই ছেলেটা সরাসরি দোকান লুট বা সন্ত্রাসে ছিলো না। সে তাদের গাড়ি ড্রাইভ করছিলো। এখানকার আইন খুব কড়া।’
অনেকদিন ধরে বন্দি এই কবিকে নিয়ে নানা ভাবনা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। পরের ঘটনা ইরফানের কাছ থেকে টেলিফোনে জানি। দু’মাস পর ইরফান দেশে ফিরে গেলে ছেলেটার বাবা তার অফিসে এসে দেখা করেন। জানতে চান তার ছেলে কেমন আছে, দেখতে কেমন হয়েছে। স্বাস্থ্য কেমন... ছেলের সাথে ইরফানের কী কী কথা হয়েছে শুনতে চান, বারবার। ইরফানের কথা নিঃশ্বাস বন্ধ করে শোনেন। তারপর একেবারে নিশ্চুপ বসে থাকেন দশ-পনেরো মিনিট। তারপর জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি আমার ছেলেকে স্পর্শ করেছিলেন?’ ইরফান জবাব দেয়, ‘হ্যাঁ, হ্যান্ডশেক করেছিলাম।’ বাবা আরো কিছু সময় নীরব থেকে বলেন, ‘আমার ছেলেকে যে-হাতে ধরেছেন সে-হাতটা আমি একটু ধরি?’
আমার চারপাশে বাংলাদেশি শ্রমিকেরা ঠাণ্ডায় কাঁপছে। দেশে যাচ্ছে তারা। তাদের জন্য কোনো কম্বল নাই আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনে। গালফ এয়ার। বাহরাইন থেকে ঢাকা যাচ্ছিলাম রাতের ফ্লাইটে। পোকামাকড়ের মতো কিলবিল করতে করতে বাংলাদেশি শ্র্রমিকেরা ওঠে। ওদের সাথে দু’টি বাংলাদেশি বন্ধু-পরিবার উঠেছে, প্যারিস গিয়েছিলো। এক অর্থনীতিবিদ এবং এক ব্যবসায়ীর পরিবার। শ্রমিকদের নিয়ে তারা আলাপ করেন। অর্থনীতিবিদের স্ত্রী বলেন, ‘এই সমস্ত নোংরা লেবারগুলা যেসব ফ্লাইটে ওঠে, আমরা সেগুলি অ্যাভয়েড করি।’ ব্যবসায়ীর স্ত্রী বলে, ‘আমরাও। দেখবেন এরা ফ্লাইটে কী কী করে। এতো নোংরা, খারাপ, এতো আগলি, এদের কারণে দেশের মানসম্মান সব শেষ। এদের জন্যই নিজেকে বাংলাদেশি বলে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে।’ অর্থনীতিবিদের স্ত্রী বলেন, ‘ঠিকই বলেছেন।’
এদিকে ইকোনমি ক্লাসে হুটোপুটি লেগেছে কম্বল নিয়ে। পাঁচ-ছয়টা কম্বল কেবিন ক্রু নিয়ে এসেছিলো। পাঁচ-ছয়জন ছোঁ মেরে তা নিয়ে নেয়। অন্যরা এয়ার হোস্টেসকে জানায়, তাদের কম্বল নাই। কেবিন ক্রু জানায়, তারা আর দিতে পারবে না। ঠাণ্ডায় প্রতিটা মানুষ জমে প্রায় বরফ।
খাবারের ট্রলি নিয়ে যাবার সময় শ্রমিকেরা বেশ উৎসাহের সাথে হুইস্কি, বিয়ারের চাহিদা পেশ করে। এদের কেউ কেউ হয়তো জীবনে প্রথমবার হুইস্কি বা বিয়ার খাচ্ছে। হয়তো দেশি কোনো ভাইয়ের কাছে শুনেছে প্লেনে মাগনা পাওয়া যায় দারুণ সব জিনিস। কেবিন ক্রু বিয়ার, হুইস্কি দেয়। চেহারায় গাম্ভীর্য ফুটিয়ে একেকজন পান করে যায়। তাদের কোনো কোনো সতীর্থ আবার সহযাত্রীদের অধঃপতনে হতাশ এবং ক্রুদ্ধ হয়ে নীরবে বসে থাকে। একজন ছুটে গিয়ে বাথরুমে পৌঁছার আগেই বমি করে দিয়েছে। আরব চেহারার এক পুরুষ কেবিন ক্রু তার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকায় যেন ভস্ম করে ফেলবে। শ্রমিকটি ভীত কুকুরছানার মতো কুঁকড়ে যায়। এদিকে টয়লেটে কোনো শ্রমিক কিছু করেছে, নাকে কাপড় চাপা দিয়ে একজন কেবিন ক্রু সরে যায়। আরেকজন শ্রমিক দরজা খুলতে না পেরে বাথরুমের দরজা নষ্ট করে ফেলেছে। এক নারী কেবিন ক্রু তার পুরুষ কলিগকে ডেকে নিয়ে আসে। পুরুষটি এসে দরজা ঠিকঠাক করতে চেষ্টা করে, ‘বাস্টার্ড বাস্টার্ড’ বলে কয়েকবার বাংলাদেশি শ্রমিকদের গালি দেয়। হুইস্কি বিয়ার মাথায় উঠে ‘বাস্টার্ডেরা’ অনেকেই তখন সুর তুলে গান করছে সমবেতভাবে। কেউ কেউ একে-অন্যকে বাংলা গালি দিচ্ছে। আবার কেউ বাড়ি যাওয়া উদযাপন করছে। পাঁচ সারি পিছনে বসা কাউকে চিৎকার করে বলছে, ‘মামু, বাড়িত তো আইয়া পড়ছি, আর কয়েক ঘণ্টা পর গিয়া উঠমু।’
আমি একেকবার বিদেশে গেলে মনে হয়, দেশে ফিরে গিয়ে আর কোনোদিন বিদেশে আসবো না। আর কোনোদিন সন্তান-স্বজন ছেড়ে দূরে থাকবো না। ভালোবাসার মানুষদের চোখে দেখবো, স্পর্শ করবো... আমি ভালো থাকবো। আমি ভালো থাকবো। কিন্তু ঢাকা গেলে আবার অতীত আর ভবিষ্যতের দুঃস্বপ্নেরা তাড়া করে। অক্টোপাসের মতো চেপে ধরে। বন্ধু সুমন রহমান যেমন বলে, ‘এই জীবনে ট্র্যানজিশন আর শেষ হয় না।’ আমি মনে হয় সবখানেই বেখাপ্পা।
সেই যে ঊর্ধ্বতন কমর্কতা আমার ফোন ট্যাপ করলো, তারপর থেকেই বাংলাদেশে কোনোদিন ফোনে কথা বলে শান্তি পাই না। সারাক্ষণ মনে হয় আড়ি পাতছে কেউ। ঢাকা শহরের বাতাস থেকে ভীষণ মধুর ভালোবাসার স্মৃতি সপাং সপাং চাবকায়। তবু ঢাকায় বারবার ফিরে যাই। ‘এই জীবন লইয়া আমি কী করিবো?’ দারফুরে আইডিপি ক্যাম্পের এক তরুণ বলে, ‘আমার গ্রামের চারপাশে সরকারি মিলিটারি আর সরকারের সহযোগী আরব মিলিশিয়ারা এক রাতে পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলে। এক রাতের মধ্যে পুরো গ্রামটা নিশ্চিহ্ন করে দেয়। অন্ধকার রাতে আমি কিভাবে যে বেহুঁশের মতো দৌড়ে পালিয়েছি, কিভাবে বেঁচে গেছি নিজেও জানি না। সরকার মনে করতো, আমার গ্রামে বিদ্রোহীরা আছে। আমার বাবা-মা, ভাই-বোন কেউ বেঁচে নাই।’ তার গল্প শুনতে শুনতে পানি-খেতে-থাকা আমার আরেক সহকর্মী তার হাতের বোতল অর্ধেক পানিসহ ছুড়ে ফেলে। আপাদমস্তক ধূলিধূসর একদল শিশুর মধ্যে হুড়োহুড়ি লাগে পানির বোতলটা দখল করতে। আইডিপি ক্যাম্পের সামনে বালিতে শুয়ে থাকা এক বৃদ্ধ নিমের একটা ডাল নিয়ে বসে আছে। নিমপাতা মুখে দেয় সে। তার স্ত্রীরা, সন্তানেরা সবাই মারা গেছে।
রুক্ষ ঊষর মরুভূমিতে ছোট ছোট কাঁটাঝোঁপের মাঝে বিশাল বাস্তুচ্যুত মানুষের ক্যাম্প। এই ক্যাম্পের বেশিরভাগ মানুষই বিদ্রোহীদের সমর্থক বলে পরিচিত। রাতের অন্ধকারে ক্যাম্পে সরকারি মিলিটারি ঢোকে। ক্যাম্পের বিদ্রোহী নেতাদের কাছে আগে থেকেই এ তথ্য ছিলো। বিদ্রোহীরা নারী ও শিশুদের ক্যাম্পের ছোট ঘরগুলো থেকে বের করে আনে। বলে, ‘ক্যাম্পে সরকারি মিলিটারি ঢুকেছে, পুরুষরা তো পালাতে পারবে। তোমরা তো তা-ও পারবে না।’ ঘুম ভেঙে কেঁদে-ওঠা বাচ্চাদের মায়েরা কোলে নেয় বা একটা শিশু কোলে আরেকটা হাতে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে বের হয়। সার বেঁধে দাঁড়ায়। এপাশ থেকে বিদ্রোহীরাই প্রথম নারী ও শিশুদের গুলি করে। পালানোর জন্য তারা প্রাণভয়ে ছুটতে শুরু করে। বিদ্রোহীদের গুলির শব্দ বাড়ে। সরকারি বাহিনীর কাছে গিয়ে পৌঁছে নারী ও শিশুরা। সরকারি সেনাবাহিনী এলোপাথারি গুলি করে। গুলি খাওয়া মায়েদের লাশ, শিশুদের লাশ... মায়ের লাশের অদূরে ছিটকে পড়া একটা শিশু তখনো বেঁচে আছে। আহত মানুষের চিৎকার... মিডিয়া নিহত নারী ও শিশুদের ছবি তুলছে শাট শাট শাট। হিউম্যান শিল্ড।
দারফুরে মিশরীয় রেস্টুরেন্টে নেদারল্যান্ডসের এক বন্ধু রাইনট-এর সাথে বসি। কফির ধোঁয়ায় সে তার এক বন্ধুর কাহিনী মনে করিয়ে দেয়। রাইনট-এর মুখ থেকে ধোঁয়া বের হয়। কফি আর সিসার ধোঁয়া ছাড়া রুমে প্রায় সবই অদৃশ্য হয়ে যায়। ফাইরুজের গান বাজে ধোঁয়ার সাথে কুণ্ডলী পাকিয়ে। ইয়েমেনে রাইনটের অফিসের পাশেই খোলা মাঠ। তার পাশে হাসপাতাল। রাইনট দেখে তার অফিসের পাশ দিয়ে প্রতিদিনই হাতবাঁধা লোকজন নিয়ে যাওয়া হয়। সে লোকমুখে জানতে পারে এরা দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। পরে এদের গুলি করে হত্যা করা হয়।
প্রতিদিন সার বেঁধে বন্দিদের নিয়ে যায় হাসপাতালের দিকে। রাইনট এদের দেখতে রোজই তার জানালায় ছুটে যায়। পেছনে হাত বাঁধা লোকগুলি নির্লিপ্ত চেহারায় মাথা নিচু করে হেঁটে যায়। একজন বন্দি জানালায় দাঁড়ানো রাইনটকে দেখে। রাইনট তাকে দেখে হেসে মাথা নাড়ে। বন্দিটি হেসে মাথা নাড়ে। তার বাঁধা-হাত নাড়ার তো উপায় নাই। রাইনট জানায়, ‘লোকটার সাথে আমার এক ধরনের বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। প্রতিদিন সকালে আমি জানালার কাছে চলে যাই। আমি তার দিকে তাকিয়ে হেসে হাত নাড়ি। শিশুর মতো হেসে মাথা নেড়ে প্রতি-উত্তর জানায় সে। অদ্ভুত এক আকর্ষণ কাজ করে আমার মধ্যে। অফিসের মিটিং থাকলেও মিটিং ছেড়ে উঠে বন্দিরা যাবার সময় আমি জানালায় দাঁড়াই। বিশ্বাস করো, লোকটা শিশুর মতো মাথা ঝাঁকায় আমাকে দেখে।’
একদিন সকালে দেখি হাসপাতালের পিছনের মাঠে বহু লোক জড়ো হয়েছে। তার অফিসের পিয়ন জানায়, আজ কোনো এক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে গুলি করে এখানে মারা হবে। প্রচুর জনসমাগম, আইনশৃঙ্খলা-রক্ষাকারী বাহিনী। আমি আর রাইনট সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে খোলা মাঠের দিকে ছুটে যাই। ভিড় ঠেলে সামনে এগোই। চারপাশে মানুষ বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে আছে। খানিক পর পুলিশ নিয়ে আসে হন্তব্যকে। এ তো তার ঝাঁকড়া চুলের সেই বন্দি, যাকে রাইনট প্রতিদিন হাত নাড়াতো। হাতকড়া-বাঁধা মানুষটিকে শান্ত, স্থির মনে হচ্ছে। রাইনট হাত নেড়ে, মুখে শব্দ করে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। এতো ভিড়ের মাঝেও সাদা-চামড়ার রাইনট তার দৃষ্টি এড়ায় না। তার হাত নাড়ানোর প্রতি-উত্তরে সে চারপাশের মানুষের অস্তিত্ব ভুলে গিয়ে রাইনটকে মাথা ঝাঁকিয়ে শিশুর মতো হেসে অভিবাদন জানায়। তার হাতকড়া খুলে দেয়া হয়। এবার সে রাইনটকে খোলা দুই হাত নাড়ায়। হাসে। তারপর শান্ত ছেলের মতো উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে মাটিতে। পুলিশ টানা কয়েক রাউন্ড গুলি চালায় মাটিতে মানুষটির উপর। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবার পর লোকজনের ভিড় হালকা হয়ে যায়।
বাংলাদেশেরই দৈনিক পত্রিকায় এক ইন্টারভিউতে অনৈতিক সম্পর্কের পক্ষে একবার সাফাই গাই। ভেবেছিলাম লেখকদের সাতখুন মাফ। আমার হয় নাই। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নাকি পল্টন ময়দান ঠিক মনে নাই, লোকজন সমবেতভাবে আমার গায়ে থুথু নিক্ষেপ করে। যেন থুথু নিক্ষেপ প্রতিযোগিতা। সজোরে, সক্রোধে থুথু ছুড়তে গিয়ে এক দৈনিকের নারী পাতার সম্পাদিকার গাল ফুলে ঢোল হয়ে যায়। থুথুগুলো যেন আকাশ থেকে উড়ে উড়ে তুলার মতো ভেসে ভেসে নিচে নামে। প্রথমে আমার মনে হচ্ছিলো ওরা আমার কুশপুত্তলিকায় থুথু মারছে। কিন্তু ঠাণ্ডা জলীয় স্পর্শ আমার শরীরে টের পাচ্ছিলাম। তীব্র বাতাস। সবার চুল উড়ছে। ভিড়ের লোকজনের পাশে-পাশে কতগুলো দাঁতাল শুয়োরও উড়ে যাচ্ছে বাতাসে। আমার পাশে মাটিতে লাল নীল হলুদ লেজ-ঝোলানো একঝাঁক পাখি প্যারেডের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। উড়ে যাচ্ছে না। দিনেদুপুরে ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে অসংখ্য ঝিঁঝিঁর ডাক। এই ভিড়ে কোত্থেকে আমার প্রেমিক এসে হাজির হয়, বহু বছর যোগাযোগহীন যে। সে আমাকে বলে, ‘ভয় পেয়ো না, তুমি অনেক আগেই মরে গেছ। ওরা আর তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’
আমার প্রতিষ্ঠানের এক ঊর্ধ্বতন প্রভুকে একবার রেগেমেগে ফোনে শুয়োর বলেছিলাম। তিনি ক্ষমতাধরদের চাকর ছিলেন। তাদের সন্তুষ্ট করতে ৫০/১০০টা ক্রসফায়ারও করতে পারতেন। তিনি আমাকে বদলি করে দেন, বিভাগীয় মামলার পাঁয়তারা করেন। ভদ্রলোকের গলার নিচে থলথলে চর্বি। তিনি চোর ডাকাত মাদক-ব্যবসায়ী খুনি ড্রাগ-অ্যাডিক্ট সবার কাছ থেকে চাঁদা নিতেন। প্রয়োজনে প্রভুদের কিছু দিতেন। প্রচুর অর্থ, বাড়ি, নারী, শৌর্য এবং বীর্য তার। বুদ্ধিজীবীদের সাথেও দারুণ সখ্য। আমার বাসার ল্যান্ডফোন, মোবাইল, সবখানে আড়িপাতার যন্ত্র বসিয়ে দেন তিনি। দুয়েকবার মেরে ফেলার হুমকিও আসে। আমি দেশ ছেড়ে পালাবার কথা ভাবি।
আমার মনে এই বিশ্বাস জন্মায় যে বাংলাদেশে প্রায় সবখানেই প্রভু-চাকরেরই কাহিনী। তাড়িয়ে তাড়িয়ে ক্ষমতা উপভোগ করে মানুষ। যেখানে একটুকু ক্ষমতা-চর্চার সুযোগ আছে, সেখানেই মানুষ দানব হয়ে ওঠে। যতই বাজে সময় যাক, আমি নিশ্চিত ছিলাম এ জায়গা থেকে সরে যেতে পারবো। এ চিন্তা আমাকে গোপন শক্তি জোগাত। নিজেকে সান্ত্বনা দেই, আমি বেঁচে আছি, সুস্থ আছি। একসময় দেশ ছেড়ে চলে যাই।
এরপর নানা অভিজ্ঞতা... তীব্র তুষারপাতে, হিম বর্ষায়, রুক্ষ মরুভূমিতে, কখনো ধূসর প্রান্তরের পাশে ছোট কোনো গ্রামে। কোলাহলপূর্ণ জনপদ... বিষণ্ন উপত্যকার চূড়ায়... কতকিছু। বিদেশে ওসবই ‘অ্যানিমাল ফার্ম’ মনে হয়। ফরেন সার্ভিসে কর্মরত আমার এক বন্ধু ইরফানের সাথে একবার কোরিয়ার এক জেলখানায় গিয়েছিলাম, ওখানে আটক বাংলাদেশি এক কবিকে দেখতে। কবি মাসুম রহমান। তার কবিতা কোথাও প্রকাশিত হয় নাই। কবিতা লিখে দূতাবাসের মাধ্যমে তার পরিবারকে পাঠাতো।
জেলখানায় তার কক্ষে ঢুকতেই দেখি মেঝেতে বসে আছে ছেলেটি। উজ্জ্বল শ্যামলা, শুকনো ঠোঁট-মুখ, একজোড়া হলদে-লাল চোখ। আমাদের দেখেই চোখ নামিয়ে ফেলে। ‘প্রধানমন্ত্রী তো আসার কথা আমাকে এখান থেকে বের করে নিতে। আপনেরা আসছেন কেন? আপনারা কী করতে পারবেন?’ আমার বন্ধুটি হাত বাড়িয়ে দেয় করমর্দনের জন্য, আমিও দেই। করমর্দন-শেষে সে আবার নিশ্চুপ। মেঝেতে কিছু বই-ম্যাগাজিন ছড়ানো ছিটানো। দূতাবাসের মাধ্যমে তার বাবা-মা পাঠিয়েছে। মেঝে থেকে মুখ না তুলেই বলে, ‘আমার বাবা-মা শেষমেষ কোনোকিছুই করলো না।’ আমার বন্ধুটি বলে, ‘আপনার বাবা তাঁর পক্ষে যা-কিছু সম্ভব সবই করছেন। আর আমরাও আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে এখানে আপনি তাদের ও অন্যান্য সব কয়েদির সাথে দুর্ব্যবহার করেন। ফলে আমরা চেষ্টা করেও আপনার জন্য কিছু করতে পারবো বলে মনে হয় না।’
তরুণটি মারমুখী হয়ে ওঠে। ‘এখানে নাটক করতে এসেছেন কেন? বেরিয়ে যান। বেরিয়ে যান। পারলে আপনার প্রধানমন্ত্রীকে পাঠায়েন। আর আমার বাপ-মাকে বইলেন তারা তাদের পবিত্র দায়িত্ব সম্পন্ন করেছেন, আর কিছু করার দরকার নাই।’ আমার বন্ধুটি যথাসম্ভব মাথা ঠাণ্ডা রেখে বলে, ‘অযথা ভুল বুঝছেন আপনি।’ ‘মাথায় ঘুষি মাইরা এইখান থিকা বাইর কইরা দিবো। গেট লস্ট। মহামানবগিরি দেখায়েন না। বের হয়ে যান। আই উইল কিল ইউ। গেট লস্ট রাইট নাউ।’ তার চেহারা হিংস্র জন্তুর মতো আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। আমরা দু’জন তাড়া-খাওয়া পশুর মতো বেরিয়ে আসি।
আমি বন্ধুকে বলি, ‘ছেলেটা মানসিক রোগী, তাকে ডাক্তার দেখানো দরকার।’ সে বলে, ‘আমার আরেক কলিগের সাথে সে একইভাবে চরম দুর্ব্যবহার করেছে। জেল কর্তৃপক্ষ তাকে মানসিক রোগের ডাক্তার দেখিয়েছে। ডাক্তার নিশ্চিত করেছে, মানসিকভাবে সে সুস্থ।’ ইরফান বলে, ‘সে মাস্টার্স করছিলো এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে, কোরিয়ান কিছু বন্ধুর সাথে মাতাল অবস্থায় এক দোকানে গিয়ে ভয় দেখিয়ে জিনিসপত্র গাড়িতে তুলে নিয়েছিলো। এই ছেলেটা সরাসরি দোকান লুট বা সন্ত্রাসে ছিলো না। সে তাদের গাড়ি ড্রাইভ করছিলো। এখানকার আইন খুব কড়া।’
অনেকদিন ধরে বন্দি এই কবিকে নিয়ে নানা ভাবনা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। পরের ঘটনা ইরফানের কাছ থেকে টেলিফোনে জানি। দু’মাস পর ইরফান দেশে ফিরে গেলে ছেলেটার বাবা তার অফিসে এসে দেখা করেন। জানতে চান তার ছেলে কেমন আছে, দেখতে কেমন হয়েছে। স্বাস্থ্য কেমন... ছেলের সাথে ইরফানের কী কী কথা হয়েছে শুনতে চান, বারবার। ইরফানের কথা নিঃশ্বাস বন্ধ করে শোনেন। তারপর একেবারে নিশ্চুপ বসে থাকেন দশ-পনেরো মিনিট। তারপর জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি আমার ছেলেকে স্পর্শ করেছিলেন?’ ইরফান জবাব দেয়, ‘হ্যাঁ, হ্যান্ডশেক করেছিলাম।’ বাবা আরো কিছু সময় নীরব থেকে বলেন, ‘আমার ছেলেকে যে-হাতে ধরেছেন সে-হাতটা আমি একটু ধরি?’
আমার চারপাশে বাংলাদেশি শ্রমিকেরা ঠাণ্ডায় কাঁপছে। দেশে যাচ্ছে তারা। তাদের জন্য কোনো কম্বল নাই আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনে। গালফ এয়ার। বাহরাইন থেকে ঢাকা যাচ্ছিলাম রাতের ফ্লাইটে। পোকামাকড়ের মতো কিলবিল করতে করতে বাংলাদেশি শ্র্রমিকেরা ওঠে। ওদের সাথে দু’টি বাংলাদেশি বন্ধু-পরিবার উঠেছে, প্যারিস গিয়েছিলো। এক অর্থনীতিবিদ এবং এক ব্যবসায়ীর পরিবার। শ্রমিকদের নিয়ে তারা আলাপ করেন। অর্থনীতিবিদের স্ত্রী বলেন, ‘এই সমস্ত নোংরা লেবারগুলা যেসব ফ্লাইটে ওঠে, আমরা সেগুলি অ্যাভয়েড করি।’ ব্যবসায়ীর স্ত্রী বলে, ‘আমরাও। দেখবেন এরা ফ্লাইটে কী কী করে। এতো নোংরা, খারাপ, এতো আগলি, এদের কারণে দেশের মানসম্মান সব শেষ। এদের জন্যই নিজেকে বাংলাদেশি বলে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে।’ অর্থনীতিবিদের স্ত্রী বলেন, ‘ঠিকই বলেছেন।’
এদিকে ইকোনমি ক্লাসে হুটোপুটি লেগেছে কম্বল নিয়ে। পাঁচ-ছয়টা কম্বল কেবিন ক্রু নিয়ে এসেছিলো। পাঁচ-ছয়জন ছোঁ মেরে তা নিয়ে নেয়। অন্যরা এয়ার হোস্টেসকে জানায়, তাদের কম্বল নাই। কেবিন ক্রু জানায়, তারা আর দিতে পারবে না। ঠাণ্ডায় প্রতিটা মানুষ জমে প্রায় বরফ।
খাবারের ট্রলি নিয়ে যাবার সময় শ্রমিকেরা বেশ উৎসাহের সাথে হুইস্কি, বিয়ারের চাহিদা পেশ করে। এদের কেউ কেউ হয়তো জীবনে প্রথমবার হুইস্কি বা বিয়ার খাচ্ছে। হয়তো দেশি কোনো ভাইয়ের কাছে শুনেছে প্লেনে মাগনা পাওয়া যায় দারুণ সব জিনিস। কেবিন ক্রু বিয়ার, হুইস্কি দেয়। চেহারায় গাম্ভীর্য ফুটিয়ে একেকজন পান করে যায়। তাদের কোনো কোনো সতীর্থ আবার সহযাত্রীদের অধঃপতনে হতাশ এবং ক্রুদ্ধ হয়ে নীরবে বসে থাকে। একজন ছুটে গিয়ে বাথরুমে পৌঁছার আগেই বমি করে দিয়েছে। আরব চেহারার এক পুরুষ কেবিন ক্রু তার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকায় যেন ভস্ম করে ফেলবে। শ্রমিকটি ভীত কুকুরছানার মতো কুঁকড়ে যায়। এদিকে টয়লেটে কোনো শ্রমিক কিছু করেছে, নাকে কাপড় চাপা দিয়ে একজন কেবিন ক্রু সরে যায়। আরেকজন শ্রমিক দরজা খুলতে না পেরে বাথরুমের দরজা নষ্ট করে ফেলেছে। এক নারী কেবিন ক্রু তার পুরুষ কলিগকে ডেকে নিয়ে আসে। পুরুষটি এসে দরজা ঠিকঠাক করতে চেষ্টা করে, ‘বাস্টার্ড বাস্টার্ড’ বলে কয়েকবার বাংলাদেশি শ্রমিকদের গালি দেয়। হুইস্কি বিয়ার মাথায় উঠে ‘বাস্টার্ডেরা’ অনেকেই তখন সুর তুলে গান করছে সমবেতভাবে। কেউ কেউ একে-অন্যকে বাংলা গালি দিচ্ছে। আবার কেউ বাড়ি যাওয়া উদযাপন করছে। পাঁচ সারি পিছনে বসা কাউকে চিৎকার করে বলছে, ‘মামু, বাড়িত তো আইয়া পড়ছি, আর কয়েক ঘণ্টা পর গিয়া উঠমু।’
আমি একেকবার বিদেশে গেলে মনে হয়, দেশে ফিরে গিয়ে আর কোনোদিন বিদেশে আসবো না। আর কোনোদিন সন্তান-স্বজন ছেড়ে দূরে থাকবো না। ভালোবাসার মানুষদের চোখে দেখবো, স্পর্শ করবো... আমি ভালো থাকবো। আমি ভালো থাকবো। কিন্তু ঢাকা গেলে আবার অতীত আর ভবিষ্যতের দুঃস্বপ্নেরা তাড়া করে। অক্টোপাসের মতো চেপে ধরে। বন্ধু সুমন রহমান যেমন বলে, ‘এই জীবনে ট্র্যানজিশন আর শেষ হয় না।’ আমি মনে হয় সবখানেই বেখাপ্পা।
সেই যে ঊর্ধ্বতন কমর্কতা আমার ফোন ট্যাপ করলো, তারপর থেকেই বাংলাদেশে কোনোদিন ফোনে কথা বলে শান্তি পাই না। সারাক্ষণ মনে হয় আড়ি পাতছে কেউ। ঢাকা শহরের বাতাস থেকে ভীষণ মধুর ভালোবাসার স্মৃতি সপাং সপাং চাবকায়। তবু ঢাকায় বারবার ফিরে যাই। ‘এই জীবন লইয়া আমি কী করিবো?’ দারফুরে আইডিপি ক্যাম্পের এক তরুণ বলে, ‘আমার গ্রামের চারপাশে সরকারি মিলিটারি আর সরকারের সহযোগী আরব মিলিশিয়ারা এক রাতে পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলে। এক রাতের মধ্যে পুরো গ্রামটা নিশ্চিহ্ন করে দেয়। অন্ধকার রাতে আমি কিভাবে যে বেহুঁশের মতো দৌড়ে পালিয়েছি, কিভাবে বেঁচে গেছি নিজেও জানি না। সরকার মনে করতো, আমার গ্রামে বিদ্রোহীরা আছে। আমার বাবা-মা, ভাই-বোন কেউ বেঁচে নাই।’ তার গল্প শুনতে শুনতে পানি-খেতে-থাকা আমার আরেক সহকর্মী তার হাতের বোতল অর্ধেক পানিসহ ছুড়ে ফেলে। আপাদমস্তক ধূলিধূসর একদল শিশুর মধ্যে হুড়োহুড়ি লাগে পানির বোতলটা দখল করতে। আইডিপি ক্যাম্পের সামনে বালিতে শুয়ে থাকা এক বৃদ্ধ নিমের একটা ডাল নিয়ে বসে আছে। নিমপাতা মুখে দেয় সে। তার স্ত্রীরা, সন্তানেরা সবাই মারা গেছে।
রুক্ষ ঊষর মরুভূমিতে ছোট ছোট কাঁটাঝোঁপের মাঝে বিশাল বাস্তুচ্যুত মানুষের ক্যাম্প। এই ক্যাম্পের বেশিরভাগ মানুষই বিদ্রোহীদের সমর্থক বলে পরিচিত। রাতের অন্ধকারে ক্যাম্পে সরকারি মিলিটারি ঢোকে। ক্যাম্পের বিদ্রোহী নেতাদের কাছে আগে থেকেই এ তথ্য ছিলো। বিদ্রোহীরা নারী ও শিশুদের ক্যাম্পের ছোট ঘরগুলো থেকে বের করে আনে। বলে, ‘ক্যাম্পে সরকারি মিলিটারি ঢুকেছে, পুরুষরা তো পালাতে পারবে। তোমরা তো তা-ও পারবে না।’ ঘুম ভেঙে কেঁদে-ওঠা বাচ্চাদের মায়েরা কোলে নেয় বা একটা শিশু কোলে আরেকটা হাতে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে বের হয়। সার বেঁধে দাঁড়ায়। এপাশ থেকে বিদ্রোহীরাই প্রথম নারী ও শিশুদের গুলি করে। পালানোর জন্য তারা প্রাণভয়ে ছুটতে শুরু করে। বিদ্রোহীদের গুলির শব্দ বাড়ে। সরকারি বাহিনীর কাছে গিয়ে পৌঁছে নারী ও শিশুরা। সরকারি সেনাবাহিনী এলোপাথারি গুলি করে। গুলি খাওয়া মায়েদের লাশ, শিশুদের লাশ... মায়ের লাশের অদূরে ছিটকে পড়া একটা শিশু তখনো বেঁচে আছে। আহত মানুষের চিৎকার... মিডিয়া নিহত নারী ও শিশুদের ছবি তুলছে শাট শাট শাট। হিউম্যান শিল্ড।
দারফুরে মিশরীয় রেস্টুরেন্টে নেদারল্যান্ডসের এক বন্ধু রাইনট-এর সাথে বসি। কফির ধোঁয়ায় সে তার এক বন্ধুর কাহিনী মনে করিয়ে দেয়। রাইনট-এর মুখ থেকে ধোঁয়া বের হয়। কফি আর সিসার ধোঁয়া ছাড়া রুমে প্রায় সবই অদৃশ্য হয়ে যায়। ফাইরুজের গান বাজে ধোঁয়ার সাথে কুণ্ডলী পাকিয়ে। ইয়েমেনে রাইনটের অফিসের পাশেই খোলা মাঠ। তার পাশে হাসপাতাল। রাইনট দেখে তার অফিসের পাশ দিয়ে প্রতিদিনই হাতবাঁধা লোকজন নিয়ে যাওয়া হয়। সে লোকমুখে জানতে পারে এরা দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। পরে এদের গুলি করে হত্যা করা হয়।
প্রতিদিন সার বেঁধে বন্দিদের নিয়ে যায় হাসপাতালের দিকে। রাইনট এদের দেখতে রোজই তার জানালায় ছুটে যায়। পেছনে হাত বাঁধা লোকগুলি নির্লিপ্ত চেহারায় মাথা নিচু করে হেঁটে যায়। একজন বন্দি জানালায় দাঁড়ানো রাইনটকে দেখে। রাইনট তাকে দেখে হেসে মাথা নাড়ে। বন্দিটি হেসে মাথা নাড়ে। তার বাঁধা-হাত নাড়ার তো উপায় নাই। রাইনট জানায়, ‘লোকটার সাথে আমার এক ধরনের বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। প্রতিদিন সকালে আমি জানালার কাছে চলে যাই। আমি তার দিকে তাকিয়ে হেসে হাত নাড়ি। শিশুর মতো হেসে মাথা নেড়ে প্রতি-উত্তর জানায় সে। অদ্ভুত এক আকর্ষণ কাজ করে আমার মধ্যে। অফিসের মিটিং থাকলেও মিটিং ছেড়ে উঠে বন্দিরা যাবার সময় আমি জানালায় দাঁড়াই। বিশ্বাস করো, লোকটা শিশুর মতো মাথা ঝাঁকায় আমাকে দেখে।’
একদিন সকালে দেখি হাসপাতালের পিছনের মাঠে বহু লোক জড়ো হয়েছে। তার অফিসের পিয়ন জানায়, আজ কোনো এক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে গুলি করে এখানে মারা হবে। প্রচুর জনসমাগম, আইনশৃঙ্খলা-রক্ষাকারী বাহিনী। আমি আর রাইনট সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে খোলা মাঠের দিকে ছুটে যাই। ভিড় ঠেলে সামনে এগোই। চারপাশে মানুষ বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে আছে। খানিক পর পুলিশ নিয়ে আসে হন্তব্যকে। এ তো তার ঝাঁকড়া চুলের সেই বন্দি, যাকে রাইনট প্রতিদিন হাত নাড়াতো। হাতকড়া-বাঁধা মানুষটিকে শান্ত, স্থির মনে হচ্ছে। রাইনট হাত নেড়ে, মুখে শব্দ করে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। এতো ভিড়ের মাঝেও সাদা-চামড়ার রাইনট তার দৃষ্টি এড়ায় না। তার হাত নাড়ানোর প্রতি-উত্তরে সে চারপাশের মানুষের অস্তিত্ব ভুলে গিয়ে রাইনটকে মাথা ঝাঁকিয়ে শিশুর মতো হেসে অভিবাদন জানায়। তার হাতকড়া খুলে দেয়া হয়। এবার সে রাইনটকে খোলা দুই হাত নাড়ায়। হাসে। তারপর শান্ত ছেলের মতো উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে মাটিতে। পুলিশ টানা কয়েক রাউন্ড গুলি চালায় মাটিতে মানুষটির উপর। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবার পর লোকজনের ভিড় হালকা হয়ে যায়।
বাংলাদেশেরই দৈনিক পত্রিকায় এক ইন্টারভিউতে অনৈতিক সম্পর্কের পক্ষে একবার সাফাই গাই। ভেবেছিলাম লেখকদের সাতখুন মাফ। আমার হয় নাই। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নাকি পল্টন ময়দান ঠিক মনে নাই, লোকজন সমবেতভাবে আমার গায়ে থুথু নিক্ষেপ করে। যেন থুথু নিক্ষেপ প্রতিযোগিতা। সজোরে, সক্রোধে থুথু ছুড়তে গিয়ে এক দৈনিকের নারী পাতার সম্পাদিকার গাল ফুলে ঢোল হয়ে যায়। থুথুগুলো যেন আকাশ থেকে উড়ে উড়ে তুলার মতো ভেসে ভেসে নিচে নামে। প্রথমে আমার মনে হচ্ছিলো ওরা আমার কুশপুত্তলিকায় থুথু মারছে। কিন্তু ঠাণ্ডা জলীয় স্পর্শ আমার শরীরে টের পাচ্ছিলাম। তীব্র বাতাস। সবার চুল উড়ছে। ভিড়ের লোকজনের পাশে-পাশে কতগুলো দাঁতাল শুয়োরও উড়ে যাচ্ছে বাতাসে। আমার পাশে মাটিতে লাল নীল হলুদ লেজ-ঝোলানো একঝাঁক পাখি প্যারেডের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। উড়ে যাচ্ছে না। দিনেদুপুরে ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে অসংখ্য ঝিঁঝিঁর ডাক। এই ভিড়ে কোত্থেকে আমার প্রেমিক এসে হাজির হয়, বহু বছর যোগাযোগহীন যে। সে আমাকে বলে, ‘ভয় পেয়ো না, তুমি অনেক আগেই মরে গেছ। ওরা আর তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’
1 মন্তব্যসমূহ
ভাল লাগল। গল্প নয়, জীবনের কথপকথন। ছোট ছোট গল্পের ভুমিকা, অথচ - এগুলোর একেকটা দিয়ে হয়তো অনেক গুলো গল্প লেখা হতে পারত। তবুও নানান দেশ ঘুরে যে জীবন দেখা, এটা সে হিসেবে সেই ঘুরে দেখা জীবনের গল্প।
উত্তরমুছুনআপনার অনেক দারুণ গল্প আছে। গল্পের আকারে গল্প; আত্মজীবনীর আখ্যানের মতন নয় - সেরকম গল্পও এখানে পড়তে পেলে ভাল লাগবে।