হাসা কঠিন


 শাহনাজ মুন্নী

সিরিয়াস লেখক হিসেবে মরিয়ম সুলতানার খ্যাতি আছে। মানুষের দুঃখ-কষ্ট-বেদনা-যন্ত্রণা-হতাশা-অপ্রাপ্তি-অতৃপ্তির কথা লিখে পাঠকের চোখে পানি এনে ফেলতে তাঁর জুড়ি নেই। যদিও বেশ কিছুদিন ধরে তিনি কিছুই লিখছেন না। কেন যেন লেখার মুড আসছে না। এমন একটা বন্ধ্যা সময়ে খুব নামীদামি আর নাকউঁচু সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকের ফোন।

নানা রকম কথাবার্তার পর সবশেষে তাঁর অভিজাত পত্রিকার জন্য চিকন গলায় একটা গল্প চান তিনি।
তবে আপা, গল্পটা হতে হবে হাসির গল্প
মরিয়ম সুলতানা ঢোক গেলেন।
না, মানে, দাদা, হাসির গল্প তো আমি কখনো লিখি নাই, পারব কি না!
পারবেন আপা, পারবেন, চেষ্টা করেন।
ওপাশ থেকে সম্পাদক অভয় দেন, আর ফোন রেখে মহা বিপাকে পড়েন মরিয়ম সুলতানা। এত দিন ধরে তিনি ভেবে এসেছেন, হাসির গল্প মানেই হালকা ধরনের, চানাচুর টাইপের চটুল লেখা। তরল ব্যক্তিত্বের অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা অবসরে এসব গল্প পড়ে খামাকাই হাহা হিহি করে। নিজের ওপর খুব রাগ হয় মরিয়মের। 
কথা যখন দিয়ে ফেলেছেন গল্প তো লিখতেই হবে। তাই হাসির গল্পের আইডিয়া খোঁজার জন্য পাঁচ শ ঊনষাট টাকা খরচ করে বাজার থেকে অনেকগুলো জোকসের বই কিনে আনেন মরিয়ম। গ্রাম-বাংলার হাসি, ঢাকাইয়া হাসির গল্প, ৯৯৯টা জোকস একটা ফাউ, মোল্লা নাসিরউদ্দিনের মজার গল্প, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ হাসির মেলা, গোপাল ভাঁড়ের হাসির গল্প, দমফাটা হাস্য-কৌতুক, বিশ্বসেরা জোকস ও কৌতুক
এমনি সব বাহারি নামের বই। কিন্তু মনোযোগ দিয়ে বইগুলো পড়তে শুরু করার পর হাসির বদলে মরিয়মের কান্না পেতে লাগল, মানুষের বুদ্ধি এত কম কীভাবে হয় সেসব ভেবে? এত যুক্তিহীন, অসংগতিপূর্ণ, ছ্যাবলামো কথাবার্তায়, গল্পে মানুষ হাসে কী করে? তাঁর মনে হয়, এই আটটা বই আসলে একটাই বই, সবগুলোতে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এক ধরনের ঘটনাই লেখা আছে।
গোপাল ভাঁড়ের একটা গল্প এ রকম
গোপাল একটা পাঞ্জাবি কিনেছে, যেটা তার গায়ে বড় হয় (যেটা বড় হবে সেটা সে কিনল কেন? যা-ই হোক, ভুল করে কিনতে পারে!)। তারপর গোপাল সেই বড় পাঞ্জাবিটা নিয়ে গেল তার মা, বড়দি আর ছোড়দির কাছে, যাতে কেউ একজন পাঞ্জাবিটা কেটে ছোট করে দেয়। তো ওঁরা তিনজনই মহা ব্যস্ত। বললেন, পরে ছোট করে দেবেন। গোপালের আর তর সইল না, সে দরজির কাছে গিয়ে তক্ষুনি পাঞ্জাবিটা কেটে ছোট করে আনল। (খুবই ভালো কথা, আগেই সেটা করলি না কেন!)। তারপর গোপাল গেল গোসল করতে। সেই সময় মা ভাবলেন, আহা, যাই, ছেলেটার পাঞ্জাবিটা ছোট করে দিয়ে আসি। মা এসে পাঞ্জাবিটা ছোট করলেন। বড়দি হাতের কাজ সেরে ভাবলেন, যাই, ভাইটার পাঞ্জাবিটা ছোট করে দিই। বড়দি এসে কেটে পাঞ্জাবিটা ছোট করলেন। এবার ছোড়দির মনে হলো, গোপাল না বলেছিল, ওর পাঞ্জাবিটা ছোট করতে! ছোড়দি এসে সেটা কেটে আরও ছোট করে দিল। গোপাল গোসল করে এসে দেখে, পাঞ্জাবি কোথায়, পাঞ্জাবির বদলে একটা ব্লাউজ পড়ে আছে!
কেন? বড়দি, ছোড়দির কি একবারও মনে হলো না, গোপালের দেহটা কত বড়? এ রকম কাটাকুটি করলে গোপাল শেষ পর্যন্ত যে পাঞ্জাবিটা পরতে পারবে না, এটা খেয়াল হবে না তাঁদের?
খুবই যুক্তিহীন, ফালতু সব গল্প। স্বামী-স্ত্রীবিষয়ক কৌতুকগুলো তো আরও ভয়াবহ। এসবে সব সময় স্বামী আর স্ত্রী কলহে লিপ্ত এবং একজন আরেকজনকে কথার প্যাঁচে ঘায়েল করতে তত্পর। স্বামী অবিশ্বাস করছে স্ত্রীকে, স্ত্রী অবিশ্বাস করছে স্বামীকে। একজন আরেকজনের জীবনকে যেন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। মরিয়ম সুলতানা নিজে বিয়ে করেননি, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের রসায়নের ব্যাপারটি তাই তিনি ভালো বোঝেন না। কিন্তু দুজনের সম্পর্ক যদি এ রকম যুদ্ধংদেহি হয়, আর তা নিয়ে মানুষ হাসাহাসি করে, তাহলে সেই সম্পর্কের দরকার কী?
আরেক ধরনের কৌতুক আছে মাতালদের নিয়ে। মাতালেরা তালজ্ঞান হারিয়ে উদ্ভট সব মন্তব্য করবে, আর সেসব শুনে মানুষ দাঁত বের করে হাসবে, তা হয় কখনো?
মরিয়ম সুলতানা আরও খেয়াল করে দেখেছেন, কোনো মানুষ কাদায় পড়ে গেলে কিংবা পা পিছলালে অন্যরা সেসব দেখে হাসিতে কুটিপাটি হয়। আরে, একটা লোক পড়ে গেছে, সে ব্যথা পেতে পারে, তার হাত-পা ভেঙে যেতে পারে। সেসব কিছু ভাববে না? আহাম্মকের মতো হাসতে শুরু করবে? একজনের দুর্ভোগ কি তবে অন্যজনের হাসির কারণ?
মরিয়ম সুলতানার কলিগ শেখ আরিফ এ কথা শুনে বললেন,
এখন আর মানুষ পড়ে কোথায়, আপা? আগে গ্রামেগঞ্জে কাঁচা রাস্তা ছিল, বর্ষাকালে বৃষ্টি হয়ে সেসব রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে থাকত, আর সিনিয়ররা ধপাস ধপাস করে আছাড় খেত, লুঙ্গিটুঙ্গি জায়গায় থাকত না, সেসব দেখে আমরা পিচ্চিরা সব হাসতাম...কত দিন সে রকম হাসি না...!
শেখ আরিফের কণ্ঠ করুণ শোনায়। মরিয়ম সুলতানার রাগ হয়। অন্য মানুষ গাড্ডায় পড়লে, বিপদে পড়লে আমি কেন হাসব? একি নির্বোধ আচরণ!
মরিয়ম সুলতানা হাসির গল্প লেখার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে হাসি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা শুরু করেন।
তিনি লক্ষ করেন, শিশুরা কারণ ছাড়াই প্রচুর হাসতে পারে। তরুণ-তরুণীরাও সামান্য অজুহাতে হাসিতে ফেটে পড়ে। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের হাসির ব্যাপকতা কমতে থাকে। কেন?
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চামড়া মোটা হতে থাকে তো, তাই সহজে হাসি পায় না।
মরিয়ম সুলতানার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ভাগ্নি রিঙ্কু এই মন্তব্য করে নিজেই হাসিতে গড়িয়ে পড়ে। তারপর বিজ্ঞের মতো বলে,
একেকজন আসলে তার মানসিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে হাসে, বুঝছো খালা? যে দুশ্চিন্তামুক্ত, ঝামেলাবিহীন, তার হাসি আসে সহজে; যার মাথায় অনেক দুশ্চিন্তা, অনেক ঝামেলা, হাসির কথা শুনেও দেখবা তার হাসি পায় না।
রিঙ্কুকে ছেড়ে মরিয়ম তাঁর গৃহপরিচারিকাদের কাছে আসেন, হাসি সম্পর্কে সব বয়সী এবং সব শ্রেণীর মতামত জানা দরকার। কমবয়সী জয়তুন দাঁত বের করে বলে,
আমরার দেশে কয় বেক্কলের তিনবার হাসি। একবার না বুইজ্যা হাসে, আরেকবার বুইজ্যা হাসে, ফিরারবার আগের কথা মনে কইরা হাসে।
বয়স্ক আবুলের মার কথা হয় আরও খোলামেলা।
আমাগো দেশে কয়, বেক্কলের গু তিন জায়গায় লাগে। একবার পায়ে, পা থেইক্যা হাতে, হাত থেইক্যা শুঁকতে গিয়া নাকে।
মরিয়ম সুলতানা দুই গৃহপরিচারিকার হাসাহাসি পেছনে ফেলে এগিয়ে যান।
পাশের বাসার নতুন প্রতিবেশী দেখা করতে এসে বলে,
আপা, আপনি নাকি হাসির গল্প নিয়ে ভাবছেন? কী বলব আপা, আমাদের নাটোরে এক লোক ছিল। তার নাম জালাল। সে বায়ান্ন রকমের হাসি জানত। যেকোনো অনুষ্ঠানে জালালের কাজ ছিল হাসা। কত রকমের, কত ধরনের, কত জনের হাসি যে সে জানত... হা...হা...হা...।
জালালের হাসির কথা মনে করে প্রতিবেশী গা দুলিয়ে হাসতে থাকে, যেন তার চোখের সামনে এখন জালালের হাসির প্রদর্শনী চলছে।
আর এত সব হাসাহাসির মধ্যে মরিয়ম সুলতানা হাসির গল্প লিখতে না পেরে মুখ গোমড়া করে বসে থাকেন। তাঁর মনে হয়, হাসির গল্প লেখা খুবই কঠিন। হাসি মানে তো শুধু দুটো ঠোট ফাঁক করে দাঁত বের করা না, হাসি মানে আরও বেশি কিছু। সপ্তাহ ঘুরে আবার সেই নাকউঁচু সম্পাদকের ফোন আসে।
আপা, গল্পটা হয়েছে?
এবার মরিয়ম সুলতানার কেন যেন অকারণেই হাসি পায়। তিনি হাসতে হাসতে বলেন,
না দাদা, হাসির গল্প আমি লিখতে পারি নাই। দুঃখিত। কিছু মনে কইরেন না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ