সায়ন্তন গোস্বামী
আজকে
ডকইয়ার্ড ভোঁভা - ছুটি। না, ঠিক ছুটি নয়,
আজ স্ট্রাইক, অর্থাৎ ছুটিই। প্রায়
সাড়ে-ছ বছর কাজ করছি, এই প্রথম এমন স্ট্রাইক হলো। কারণ?
... মারপিট। দুই দলের মধ্যে তুমুল মারপিট হলো গতকাল দুপুরে,
আমি দেখলাম। অনেকেই দেখলো, দূর থেকে।
মারপিট কেন হয়েছে, সেটা ঠিক জানিনা। বক্সীর দলের কোন ছেলে
নাকি তোলাবাজীর তিন হাজার সাতশো টাকা নিয়ে চম্পট দিয়েছে (পরে জানা গেছে), সেটা প্রথমে বক্সী ধরতে পারেনি। ভেবেছে বাবলুর দলের সাথে ছেলেটার আঁতাত
আছে। আরেকটা কারণ যেটা কানে এলো - এরিয়া নিয়ে ক্যঁ¡চাল!
গোটা ইয়ার্ডটা ঠিকঠাক ভাগাভাগি হয়নি, এতে কোনো এক পক্ষের
ক্ষতির পরিমাণ দিন-দিন বেড়েই চলছে - সুতরাং।।
সকালের খাবার সারলাম পাঁউরুটি, মামলেট আর চা দিয়ে। অনেকক্ষণ ধরে রসিয়ে রসিয়ে খেলাম। আধ ঘন্টা পায়চারী করলাম ডকে। এÉ¡লফা জাহাজটা বিশাল জন্তুর মতো গত আঠারো ঘন্টা ধরে থম্ মেরে দাঁড়িয়ে আছে। ডকের দক্ষিণ-দিকে খান পনেরো ট্রাক একসাথে পাথরের মতো আকৃতি তৈরি করেছে - লোডিং/আনলোডিং, এ-মুহূর্তে কিছুই না। সাদা রঙ-এর অনেকগুলো পাখি, আজ অবধি যাদের নাম বারবার জেনেও মনে রাখতে পারলামনা, খালি উড়ে-উড়ে বিভিন্ন জায়গায় বসছে - স্ট্রাইকের দিনে খেলে বেড়াচ্ছে ইচ্ছেমতো কাজের দিনেও এমন করে। নীল চেকের লম্বা রুমালটা ঘাড় থেকে নিজের হাতে নিলাম। স্বস্তির দিন, কিন্তু কাটাবো কেমন করে? গত রাতে ঘুমটাও ভালো হয়েছে। পেটে খাবার আছে। ঠাণ্ডা হাওয়া। অর্থাৎ সবই আছে। অর্থাৎ কিছু একটা নেই।
আমি সুন্দর কে ডাকলাম, কী রে, সক্কাল সক্কাল তাস বাঁটছিস, এই-এইখানে, একা-একা! তো কী করবো, সুন্দর মুখ তুলে চাইলো। কিছু একটা কর। আজ কিছু করার নেই, তাই কিছু একটা করতে পারবোনা, সুন্দরের হাতে লালপান বিবি। তাহলে চ, কোথাও ঘুরে আসি। না, ভালো লাগছেনা। আরে, ওঠ্ তো! আমি সুন্দরকে হাত ধরে টেনে তুললাম। ও তাসগুলো গুছিয়ে নিয়ে প্যাকেটে ভরলো।
কোথায় যাওয়া যায়? আপাতত বেশি দূরে নয়, আশে-পাশেই কোথাও। ৮টা - ৩৫। চত্বরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে চার-পাঁচজনকে দেখলাম। কাজের দিনেও এদিকটায় অন্য জায়গার তুলনায় কম গ্যাঞ্জাম থাকে। বাটিক-পাড়াতে যাই চ। সুন্দর ভুরু কোঁচকালো, আর জায়গা নেই? গেলে ক্ষতি তো নেই, বিড়ি আছে? সিগারেট আছে। জলদি দে। তিনটে দেশলাই কাঠি পুড়িয়ে সিগারেট ধরালাম। আর বল্, ম্যানেজার টাকা বাড়ালো? বাল্ বাড়িয়েছে। সেদিন বললো না যে বাড়াবে? ও কথার কথা, সুন্দর হাওয়ায়ে দুটো রিং ছাড়লো। এমন আমার সাথেও অনেকবার হয়েছে। ছ-সাত বছর কাজ করছি, খুব একটা ফাঁকিও দিইনা, ঘালিব মাঝে-মাঝেই বলে টাকা বাড়ানোর কথা, হয়ত কালকেই বলবে। এতগুলো বছরে মাইনে বেড়েছে মোটে দু-বার। সিগারেটের শেষটুকু ফেলে দিয়ে আমি আঙুল মটকালাম।
ডক-চত্বর থেকে বেড়িয়ে আমার বাঁদিকের রাস্তাটা নিলাম। ছোটখাটো একটা বাজার বসে রাস্তাটার দুপাশে। একটা অটো স্ট্যান্ড আছে। মিনিট পাঁচ-সাত হাঁটার পর আবার বাঁদিক ঘুরলাম - বাটিক পাড়া। এই নামটার পেছনে ইতিহাস জানা নেই দু-তিন পুরুষ আগে এই পাড়ার বাসিন্দারা বাটিকের জামাকাপড় তৈরি করতো? জানিনা। গলিগুলো কালো-কালো, জায়গাটা ঘিঞ্জি। বিড়ি নিয়ে নি, একটা গুমটির সামনে আমরা দাঁড়ালাম। আবার ঐখানে যাচ্ছিস, সুন্দর জিজ্ঞেস করলো। হাল্কার ওপর দিয়ে দেখে আসি। গত এক মাসে যাওয়া বাড়িয়ে দিয়েছিস। তো? আমার কী, যা খুশি কর, সুন্দরের মুখটা ব্যাজার হলো। যা খুশি নয়, পরে বুঝিয়ে বলবো - আমি লাল সুতোর বিড়িতে ফুঁ দিলাম।
পাড়াটার শেষ প্রান্তে একটা দোতলা বিল্ডিং। অনেকখানি চওড়া। দেওয়ালের পলেস্তরা খসে-খসে পড়ছে। সামনের জায়াগাটায় তিনখানা সাইকেল স্ট্যান্ড করানো আছে, একটা স্কুটার। চারটে লোক আর একটা মেয়েছেলে দাঁড়িয়ে-বসে আছে। বিল্ডিং-এ ঢোকার দরজার পাশেই একটা ছোট পেঁপে গাছ। আমি ঢুকলামনা আজ, মেজাজ খাট্টা, সুন্দর বলে উঠলো। কেন, কী হলো? নানা, ছাড়, সকাল-সকাল পোষায়না, এটা একটা টাইম হলো নাকি - ও নিজের কবজিটা ছাড়িয়ে নেয়। আরে একটুখানি তো আয়, আমি আবার বললাম ওকে। একটুখানি-ফেকটুখানি নয়, একদমই ইচ্ছে নেই এখন, তোর কতক্ষণের কাজ? - সুন্দর বিড়ির প্যাকেট-টা ছিঁড়লো। বলতে পারছিনা, ধরে নে কুড়ি মিনিট-মতো, দাড়িতে হাত বোলালাম আমি। ঠিক আছে, তুই কাজ মিটিয়ে আয়, আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। পাশেই বিলুদা ছিলো - চলো সুন্দর, এই রকে বসে আড্ডা দি, ও ব্যাটা ঘুরে আসুক!
আমি ভেতরে ঢুকলাম। একটা লম্বা করিডোর, দিনেরবেলাতেও আলো জ্বলছে - সবুজ। শেষ প্রান্তে করিডোরটা ডায়ে-বাঁয়ে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। অইখানে চেয়ার-টেবিল নিয়ে গুছিয়ে বসে আছে প্রীতমদা, ঠোঁটে মিহি হাসি। কোন দিকে, দাদা - প্রীতমদা রেজিস্টার খুললো। বাঁয়ে, ১৬ নং। দাঁড়াও দেখি (প্রীতমদা বাইফোকাল পড়ে), হ্যঁ¡, খালি আছে। এই যে টাকা, কোনার দিকে ছেঁড়া একটা নোট অনায়াসে চালিয়ে দিলাম।
করিডরে রীতেনের সাথে দেখা। আরে, নতুন শার্ট? ধুর্, দু-বছর পুরোনো, তা তুমি কোথায়, ষোলোতেই? হ্যঁ¡, ওই আর কি। রঙচটা নীল রঙের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম - ১৬। দরজাটা ভেজানো ছিলো, বেশিরভাগ সময় তাই থাকে। আলতো ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম।
ঘরটা আকারে মাঝারি, চৌকোনা, দশ বাই দশ মতন। দেওয়ালগুলো খড়খড়ে। কোনো জানলা নেই, শুধু একটা ছোট্ট ঘুলঘুলি আছে। এক কোনায় লঝ্ঝড়ে গোল টেবিল। তাতে প্লাস্টিকের জাগ, জলের গ্লাস। একটা বেঁটে-মতো আলনা আর আয়নাও আছে। ড্যাম্প আর রুম ফ্রেশনারের গন্ধ ঘরটায় ভুরভুর করছে। খাটের এক পাশে মেঝের দিকে চেয়ে রাজা বসে আছে।
রাজার সাথে আলাপ হপ্তা চারেক, ইতিমধ্যে গুনে-গুনে দশবার এসছি ওর ঘরে। এই বাড়িতে দুবছর ধরে আসছি ফি-হপ্তা। সবাই চেনা। বাইরে বিলুদা, প্রীতমদা, ডান করিডরের ঝিমলি, সুলেখা, বিশেষকরে সুলেখা - মেয়ে ভালো। আমায় একদিন বললো, তোমার শখের জিনিষ এসছে, দেখতে পারো। কী? - তখন আমার মুখে পান, উঠবো-উঠবো করছি। একটা ছেলে, পনেরো বছর বয়েস হবে, দুপুরবেলায় অনেকক্ষন ফোঁপালো। দেখতে হচ্ছে তো, আমি ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে প্রীতমদাকে বললাম, কোন নতুন ছেলে? কোন ঘরে? নিয়ে চলো, বেরনোর আগে দেখে যাই।
প্রথম কয়েক দিন রাজা ১২ নং ঘরে থাকতো। আমি ঢুকে নাম জিজ্ঞেস করলাম, ও উত্তর দিলো। মুখটা তুলে ধরলাম, আপত্তি করলোনা। দেখতে ভালো নয়, চোয়ালটা অদ্ভুত-রকম বসানো। চোখদুটো ছোট। মাথায় এক ঝাঁকড়া রূক্ষ চুল। শরীর রোগা-পাতলা, একটু কুঁজো মনে হয়েছিলো তখন। নিয়মিত যাতায়াতের ফলে ওর সাথে ভাব জমাতে দেরি হয়নি।
কিরে রাজা, মন খারাপ নাকি? আমি খাটে বাবু হয়ে বসলাম। না, এমনি। কী এমনি? এমনি বসে আছি। ছেলেটা চুপচাপ, কিন্তু আসল খদ্দেরের হাতে পড়লে কেমন ব্যবহার করবে তা বলা মুশকিল। আমাকেই একমাত্র বন্ধু বলে মনে করে, যদিও ও আমায় বন্ধু ভাবলো কি না, এই নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাই না।
মিইয়ে আছিস কেন? এখোনো মানাতে পারলি না? আমার ভালো লাগেনা এমন, সারাটাদিন একা-একা, রাজা বললো। তো করবিটা কী? আমি বিছানায় গা এলিয়ে দি। এর মধ্যেই নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে। বেশিদিন আমি তোকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারবোনা।
প্রথমদিন ওকে মিনিট তিনেক দেখেছিলাম। তার পরদিন বিকেলবেলাতেই ওর ঘরে যাই, ও আমায় দেখে হাউ-হাউ করে কেঁদে ফেলেছিলো। বোধহয় ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পেরেছিল। কিছুতেই কান্না থামাচ্ছিলোনা, শেষে আমি একটা চড় মারলাম - চুপ করে বসে, জলটল খেয়ে ধাতস্থ হয়েছিলো। সেই একদিনই ওমন করেছে, তারপর থেকে একটু কুঁকড়ে গেছে, মায়া হয়।
শোন রাজা, আমার গলার স্বর আরো নরম করি, একটা মাস তো প্রায় শেষ হতে চললো - তুই এসছিস। কিছুটা নিশ্চয়ই এতদিনে বুঝে গেছিস যে বাকী কাস্টমরেরা আমার মতন ব্যবহার করবেনা তোর সাথে। যখনই এসেছি এই কথাটা তোকে বলার চেষ্টা করেছি, করিনি? হুঁ। তবুও বুঝিসনি ঠিক মতন। এমন করে গেলে কিন্তু কপালে সত্যিই দু:খ আছে, আমি এসে-এসে বাঁচাতে পারবোনা। আমার ভাগ্যটা খারাপ, রাজা আস্তে করে বললো। ভাগ্য কে দোষ দিয়ে কিস্সু হবেনা, মার-ফার যদি না খেতে চাস, মানে-মানে সামলে নে। এতদিন হলো এসছিস, তোর তো এখনো হাতে খড়িই হলোনা!
আমি তো ব্যপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা, রাজা নড়ে-চড় বসলো। ন্যাকামি করিস না, আমি বিরক্ত হয়ে বললাম - যখন এত দিনেও, এত কথার পরেও বুঝিসনি তালে আর কোনোদিনই বুঝতে পারবি না, আমি আমার চুলে হাত বোলালাম। আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে পেঁদিয়ে সিধে করে দিতো, এত কথা বলতো না। তুমি তাহলে এত কথা বলছো কেন? চোপ্! সেটা আমার ব্যপার, আমি কথা বলবো না পেঁদাবো। মেয়েরাও তোর মতন ন্যাকা হয়না, তারা অনেক বেশি চোস্ত। খাটের এক কোনায় বসে তোর এই কুঁইকুঁই করা, একটা ঠিকঠাক খদ্দেরের পাল্লায় পড়লেই সব বেড়িয়ে যাবে।
রাজাকে ধরা হয়েছিলো ওর স্কুল থেকে ফেরার সময়ে। পনেরো বছর বয়েসে ক্লাস ফাইভ-এর ছাত্র, একটা এন/জি/ও ওর পড়াশোনা, থাকা-খাওয়ার খরচ চালাতো। ও মাকে চোখে দেখেনি, বাবা ছিলো, কিন্তু বাপ সম্পর্কে কোনো কথা বলতে চায়না। স্কুলে পড়াশোনা খুব-একটা পারতোনা, ওর মন খেলাধূলোয়। ফুটবল ওর প্রিয়, দূর পাল্লার শট নিতে ভালোবাসে - এইখানে আমার সাথে খুব মিল। শুরুর কটা দিন ও এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকতে পারতো না, সারা ঘরে পায়চারি করতো, ঘন ঘন জল খেতো আর লাগোয়া পুঁচকি বাথরুমটায় পেচ্ছাপ করতে করতে ফোঁপাতো। ইদানিং এই অস্থিরতা একটু হলেও কমেছে।
গালাগালগুলো শিখিয়েছিলাম মনে আছে? আমি একটা বিড়ি ধরালাম। সবগুলো মনে নেই। আগামী দিনে তোকে ঐ গালিগুলো খেতে হবে। মানেগুলো ঠিকঠাক ভাবে জান, মন হাল্কা হবে। অনেক গালাগাল আর তার মানেগুলো জেনে রাখা ভালো কাজ, মনটা ফুর্ফুরে হয়, আমি বোঝাই ওকে। আচ্ছা বল তো, সবচেয়ে কমন্ যেটা - বোকাচোদার মানে কী? ও সঠিক উত্তর দিলো। আমি হাসলাম। হ্যঁ¡, ভালো, তবে আরো তাড়াতাড়ি শিখতে হবে, কিছুদিন পর তুই নিজেই ব্যবহার করবি। স্কুলের ওই "শুয়োরের বাচ্চা-ফাচ্চা' থেকে বেড়িয়ে আয়, বড়োদের গালি শেখ - আমি বিড়িটা বাথরুমের খোলা দরজার দিকে ছুঁড়ে দি।
কিরকম-কিরকম কী করতে হবে? কাস্টমরেরা এলে? রাজা হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো। ওরা যেমনি বলবে তেমনি করবি। আমি তো তোকে কিছুই করলামনা, শুধু ভ্যাজর-ভ্যাজর করে গেলাম হাহাহাহাহাহাহা, জলটা দে। রাজা জলের জাগটা হাতে নিলো - জল নেই। আমায় দে, আমি নিয়ে আসছি। আমি দরজা থেকে শরীরটা আদ্ধেক বের করে রীতেনকে ডাকলাম - একটু জল ভরে আনো তো। আনছি, ছেলেটা ঠিকঠাকই, না? চলে যাবে, কী বলো? হ্যঁ¡, যাবে - আমি উত্তর দিলাম। রীতেন পাশের একটা বেসিন থেকে (তাতে এÉ¡কোয়াগার্ড) জল ভরে এনে দিলো। আমি ঘরে ঢুকে আবার ছিটকিনি দিয়ে দিলাম। জল খেয়ে রাজা কে জিজ্ঞেস করলাম - খাবি? হ্যঁ¡, দাও একটু।
ও চোখ বুজে জল খেলো। আমি জাগটা ওর হাতের থেকে নিয়ে টেবিলে রেখে বললাম - শোন রাজা (ওর পাছায় হাত বোলাতে-বোলাতে), খুব তাড়াতাড়ি এবারে কাজে ডুবে যেতে হবে। এখানে যারা আসে তাদের মাথা এমনিতেই গরম থাকে। অনেক ধরণের লোকই আসে - দাঁতের ডাক্তার, কেরানি, অটোওয়ালা। তাদের মধ্যে দুটো মিল, এক - তারা এখানে আসে দুই - তাদের সবার মাথা গরম। তুই যদি তাদের সাথে ন্যাকামি দেখাস, বেল্ট-ফেল্ট খুলে চাবকাবে তোকে। নিজের ভালো চাস তো এই সব খদ্দেরদের কথা শুনবি, যেমনি বলবে তেমন করবি, হাজারবার একই কথা তোকে বলে বলে মুখে রক্ত উঠে গেছে আমার।
আমি খাটে এসে আবার বসলাম। রাজা জিজ্ঞেস করলো - এই ঘরেই সব কাজ হয়, বাইরে যেতে হয়না? পাশে এসে বোস্। হ্যঁ¡ হয়, তবে কম। কিছু বড়লোক বাড়ির মেয়েছেলেরা গাড়ি পাঠায়ে মাঝে -সাঝে, বড় রাস্তায় দাঁড় করানো থাকে। তাদের বাড়ি গিয়ে সার্ভিস দিতে হয়। তোর সুলতানের সাথে আলাপ হয়নি এখনো? না, হয়নি। কী করিস, আলাপ করবি তো! খুব দারুণ ছেলে সুলতান, তোর চেয়ে চার-পাঁচ বছরের বড় হবে। ওর কাছে অনেক গল্প শুনতে পারবি, অনেক কিছু জানতে, শিখতে পারবি। রাজা একটা ছোট্ট হুঁ করলো।
ভাবিস না এত, আমি ওর মাথাটা ঝাঁকিয়ে দিলাম। কাল-পরশুর মধ্যেই তোর হাতেখড়ি হয়ে যাবে। আমি যাওয়ার পর রীতেন বা প্রীতমদা তোকে কিছু জিজ্ঞেস করে? হ্যঁ¡ করে। কী? জিজ্ঞেস করে ঠিকঠাক সার্ভিস দিয়েছিস তো? তুই কী বলিস? আমি বলি - হ্যঁ¡, দিয়েছি। হাহা - শালা মিথ্যুক। আমি হাতঘড়িটা ড্রেসিং টেবিল থেকে তুলে নি। আমি আজ উঠি, অনেকক্ষণ হলো। কবে আসবে আবার? দেখি, কবে আসি। আজ ডকে স্ট্রাইক, ফোকটে একটা ছুটি পেয়ে গেলাম, তাই এসেছিলাম। যাযা কথা বলে গেলাম সব মনে রাখিস, তোর অনেক কাজে লাগবে। আর দুম্দাম্ মনখারাপ করে না খেয়ে থাকিস না, তাতে লাভের লাভ কিছু হয়না। আমি ১৬ নং থেকে বেরিয়ে এলাম।
বাইরে এসে দেখি সুন্দর আগেই চলে গেছে। সুন্দর কই গেলো বিলুদা? চলে গেল তো ও! কখন? এই মিনিট দশেক আগে। কিছু বলে গেছে? না! তা তুমি সময় কেমন কাটালে? ভালোই। ষোলো তো? হ্যঁ¡। নতুন ছেলেটা ঠিকঠাক সার্ভিস দিচ্ছে? হ্যঁ¡-হ্যঁ¡, দিচ্ছে। একমাস ধরে তো তুমি একাই খাচ্ছো, ওদিকে সুলেখা বলছিলো সেদিন। হাহা, সত্যি সুলেখাও ...
বিলুদা, আমি ভেতর থেকে ঘুরে আসি, ছুটির দিন। তুমি বাইরে আছো তো কিছুক্ষণ? হ্যঁ¡ আছি, ঘুরে আয়। আমি আবার বাড়িটার ভেতরে ঢুকলাম, আবার সেই করিডোর, সবুজ আলো, প্রীতমদা, রেজিস্টার। কী হে? প্রীতমদা টেবিল বাজিয়ে প্রশ্ন করল। ডানদিক।
সকালের খাবার সারলাম পাঁউরুটি, মামলেট আর চা দিয়ে। অনেকক্ষণ ধরে রসিয়ে রসিয়ে খেলাম। আধ ঘন্টা পায়চারী করলাম ডকে। এÉ¡লফা জাহাজটা বিশাল জন্তুর মতো গত আঠারো ঘন্টা ধরে থম্ মেরে দাঁড়িয়ে আছে। ডকের দক্ষিণ-দিকে খান পনেরো ট্রাক একসাথে পাথরের মতো আকৃতি তৈরি করেছে - লোডিং/আনলোডিং, এ-মুহূর্তে কিছুই না। সাদা রঙ-এর অনেকগুলো পাখি, আজ অবধি যাদের নাম বারবার জেনেও মনে রাখতে পারলামনা, খালি উড়ে-উড়ে বিভিন্ন জায়গায় বসছে - স্ট্রাইকের দিনে খেলে বেড়াচ্ছে ইচ্ছেমতো কাজের দিনেও এমন করে। নীল চেকের লম্বা রুমালটা ঘাড় থেকে নিজের হাতে নিলাম। স্বস্তির দিন, কিন্তু কাটাবো কেমন করে? গত রাতে ঘুমটাও ভালো হয়েছে। পেটে খাবার আছে। ঠাণ্ডা হাওয়া। অর্থাৎ সবই আছে। অর্থাৎ কিছু একটা নেই।
আমি সুন্দর কে ডাকলাম, কী রে, সক্কাল সক্কাল তাস বাঁটছিস, এই-এইখানে, একা-একা! তো কী করবো, সুন্দর মুখ তুলে চাইলো। কিছু একটা কর। আজ কিছু করার নেই, তাই কিছু একটা করতে পারবোনা, সুন্দরের হাতে লালপান বিবি। তাহলে চ, কোথাও ঘুরে আসি। না, ভালো লাগছেনা। আরে, ওঠ্ তো! আমি সুন্দরকে হাত ধরে টেনে তুললাম। ও তাসগুলো গুছিয়ে নিয়ে প্যাকেটে ভরলো।
কোথায় যাওয়া যায়? আপাতত বেশি দূরে নয়, আশে-পাশেই কোথাও। ৮টা - ৩৫। চত্বরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে চার-পাঁচজনকে দেখলাম। কাজের দিনেও এদিকটায় অন্য জায়গার তুলনায় কম গ্যাঞ্জাম থাকে। বাটিক-পাড়াতে যাই চ। সুন্দর ভুরু কোঁচকালো, আর জায়গা নেই? গেলে ক্ষতি তো নেই, বিড়ি আছে? সিগারেট আছে। জলদি দে। তিনটে দেশলাই কাঠি পুড়িয়ে সিগারেট ধরালাম। আর বল্, ম্যানেজার টাকা বাড়ালো? বাল্ বাড়িয়েছে। সেদিন বললো না যে বাড়াবে? ও কথার কথা, সুন্দর হাওয়ায়ে দুটো রিং ছাড়লো। এমন আমার সাথেও অনেকবার হয়েছে। ছ-সাত বছর কাজ করছি, খুব একটা ফাঁকিও দিইনা, ঘালিব মাঝে-মাঝেই বলে টাকা বাড়ানোর কথা, হয়ত কালকেই বলবে। এতগুলো বছরে মাইনে বেড়েছে মোটে দু-বার। সিগারেটের শেষটুকু ফেলে দিয়ে আমি আঙুল মটকালাম।
ডক-চত্বর থেকে বেড়িয়ে আমার বাঁদিকের রাস্তাটা নিলাম। ছোটখাটো একটা বাজার বসে রাস্তাটার দুপাশে। একটা অটো স্ট্যান্ড আছে। মিনিট পাঁচ-সাত হাঁটার পর আবার বাঁদিক ঘুরলাম - বাটিক পাড়া। এই নামটার পেছনে ইতিহাস জানা নেই দু-তিন পুরুষ আগে এই পাড়ার বাসিন্দারা বাটিকের জামাকাপড় তৈরি করতো? জানিনা। গলিগুলো কালো-কালো, জায়গাটা ঘিঞ্জি। বিড়ি নিয়ে নি, একটা গুমটির সামনে আমরা দাঁড়ালাম। আবার ঐখানে যাচ্ছিস, সুন্দর জিজ্ঞেস করলো। হাল্কার ওপর দিয়ে দেখে আসি। গত এক মাসে যাওয়া বাড়িয়ে দিয়েছিস। তো? আমার কী, যা খুশি কর, সুন্দরের মুখটা ব্যাজার হলো। যা খুশি নয়, পরে বুঝিয়ে বলবো - আমি লাল সুতোর বিড়িতে ফুঁ দিলাম।
পাড়াটার শেষ প্রান্তে একটা দোতলা বিল্ডিং। অনেকখানি চওড়া। দেওয়ালের পলেস্তরা খসে-খসে পড়ছে। সামনের জায়াগাটায় তিনখানা সাইকেল স্ট্যান্ড করানো আছে, একটা স্কুটার। চারটে লোক আর একটা মেয়েছেলে দাঁড়িয়ে-বসে আছে। বিল্ডিং-এ ঢোকার দরজার পাশেই একটা ছোট পেঁপে গাছ। আমি ঢুকলামনা আজ, মেজাজ খাট্টা, সুন্দর বলে উঠলো। কেন, কী হলো? নানা, ছাড়, সকাল-সকাল পোষায়না, এটা একটা টাইম হলো নাকি - ও নিজের কবজিটা ছাড়িয়ে নেয়। আরে একটুখানি তো আয়, আমি আবার বললাম ওকে। একটুখানি-ফেকটুখানি নয়, একদমই ইচ্ছে নেই এখন, তোর কতক্ষণের কাজ? - সুন্দর বিড়ির প্যাকেট-টা ছিঁড়লো। বলতে পারছিনা, ধরে নে কুড়ি মিনিট-মতো, দাড়িতে হাত বোলালাম আমি। ঠিক আছে, তুই কাজ মিটিয়ে আয়, আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। পাশেই বিলুদা ছিলো - চলো সুন্দর, এই রকে বসে আড্ডা দি, ও ব্যাটা ঘুরে আসুক!
আমি ভেতরে ঢুকলাম। একটা লম্বা করিডোর, দিনেরবেলাতেও আলো জ্বলছে - সবুজ। শেষ প্রান্তে করিডোরটা ডায়ে-বাঁয়ে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। অইখানে চেয়ার-টেবিল নিয়ে গুছিয়ে বসে আছে প্রীতমদা, ঠোঁটে মিহি হাসি। কোন দিকে, দাদা - প্রীতমদা রেজিস্টার খুললো। বাঁয়ে, ১৬ নং। দাঁড়াও দেখি (প্রীতমদা বাইফোকাল পড়ে), হ্যঁ¡, খালি আছে। এই যে টাকা, কোনার দিকে ছেঁড়া একটা নোট অনায়াসে চালিয়ে দিলাম।
করিডরে রীতেনের সাথে দেখা। আরে, নতুন শার্ট? ধুর্, দু-বছর পুরোনো, তা তুমি কোথায়, ষোলোতেই? হ্যঁ¡, ওই আর কি। রঙচটা নীল রঙের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম - ১৬। দরজাটা ভেজানো ছিলো, বেশিরভাগ সময় তাই থাকে। আলতো ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম।
ঘরটা আকারে মাঝারি, চৌকোনা, দশ বাই দশ মতন। দেওয়ালগুলো খড়খড়ে। কোনো জানলা নেই, শুধু একটা ছোট্ট ঘুলঘুলি আছে। এক কোনায় লঝ্ঝড়ে গোল টেবিল। তাতে প্লাস্টিকের জাগ, জলের গ্লাস। একটা বেঁটে-মতো আলনা আর আয়নাও আছে। ড্যাম্প আর রুম ফ্রেশনারের গন্ধ ঘরটায় ভুরভুর করছে। খাটের এক পাশে মেঝের দিকে চেয়ে রাজা বসে আছে।
রাজার সাথে আলাপ হপ্তা চারেক, ইতিমধ্যে গুনে-গুনে দশবার এসছি ওর ঘরে। এই বাড়িতে দুবছর ধরে আসছি ফি-হপ্তা। সবাই চেনা। বাইরে বিলুদা, প্রীতমদা, ডান করিডরের ঝিমলি, সুলেখা, বিশেষকরে সুলেখা - মেয়ে ভালো। আমায় একদিন বললো, তোমার শখের জিনিষ এসছে, দেখতে পারো। কী? - তখন আমার মুখে পান, উঠবো-উঠবো করছি। একটা ছেলে, পনেরো বছর বয়েস হবে, দুপুরবেলায় অনেকক্ষন ফোঁপালো। দেখতে হচ্ছে তো, আমি ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে প্রীতমদাকে বললাম, কোন নতুন ছেলে? কোন ঘরে? নিয়ে চলো, বেরনোর আগে দেখে যাই।
প্রথম কয়েক দিন রাজা ১২ নং ঘরে থাকতো। আমি ঢুকে নাম জিজ্ঞেস করলাম, ও উত্তর দিলো। মুখটা তুলে ধরলাম, আপত্তি করলোনা। দেখতে ভালো নয়, চোয়ালটা অদ্ভুত-রকম বসানো। চোখদুটো ছোট। মাথায় এক ঝাঁকড়া রূক্ষ চুল। শরীর রোগা-পাতলা, একটু কুঁজো মনে হয়েছিলো তখন। নিয়মিত যাতায়াতের ফলে ওর সাথে ভাব জমাতে দেরি হয়নি।
কিরে রাজা, মন খারাপ নাকি? আমি খাটে বাবু হয়ে বসলাম। না, এমনি। কী এমনি? এমনি বসে আছি। ছেলেটা চুপচাপ, কিন্তু আসল খদ্দেরের হাতে পড়লে কেমন ব্যবহার করবে তা বলা মুশকিল। আমাকেই একমাত্র বন্ধু বলে মনে করে, যদিও ও আমায় বন্ধু ভাবলো কি না, এই নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাই না।
মিইয়ে আছিস কেন? এখোনো মানাতে পারলি না? আমার ভালো লাগেনা এমন, সারাটাদিন একা-একা, রাজা বললো। তো করবিটা কী? আমি বিছানায় গা এলিয়ে দি। এর মধ্যেই নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে। বেশিদিন আমি তোকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারবোনা।
প্রথমদিন ওকে মিনিট তিনেক দেখেছিলাম। তার পরদিন বিকেলবেলাতেই ওর ঘরে যাই, ও আমায় দেখে হাউ-হাউ করে কেঁদে ফেলেছিলো। বোধহয় ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পেরেছিল। কিছুতেই কান্না থামাচ্ছিলোনা, শেষে আমি একটা চড় মারলাম - চুপ করে বসে, জলটল খেয়ে ধাতস্থ হয়েছিলো। সেই একদিনই ওমন করেছে, তারপর থেকে একটু কুঁকড়ে গেছে, মায়া হয়।
শোন রাজা, আমার গলার স্বর আরো নরম করি, একটা মাস তো প্রায় শেষ হতে চললো - তুই এসছিস। কিছুটা নিশ্চয়ই এতদিনে বুঝে গেছিস যে বাকী কাস্টমরেরা আমার মতন ব্যবহার করবেনা তোর সাথে। যখনই এসেছি এই কথাটা তোকে বলার চেষ্টা করেছি, করিনি? হুঁ। তবুও বুঝিসনি ঠিক মতন। এমন করে গেলে কিন্তু কপালে সত্যিই দু:খ আছে, আমি এসে-এসে বাঁচাতে পারবোনা। আমার ভাগ্যটা খারাপ, রাজা আস্তে করে বললো। ভাগ্য কে দোষ দিয়ে কিস্সু হবেনা, মার-ফার যদি না খেতে চাস, মানে-মানে সামলে নে। এতদিন হলো এসছিস, তোর তো এখনো হাতে খড়িই হলোনা!
আমি তো ব্যপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা, রাজা নড়ে-চড় বসলো। ন্যাকামি করিস না, আমি বিরক্ত হয়ে বললাম - যখন এত দিনেও, এত কথার পরেও বুঝিসনি তালে আর কোনোদিনই বুঝতে পারবি না, আমি আমার চুলে হাত বোলালাম। আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে পেঁদিয়ে সিধে করে দিতো, এত কথা বলতো না। তুমি তাহলে এত কথা বলছো কেন? চোপ্! সেটা আমার ব্যপার, আমি কথা বলবো না পেঁদাবো। মেয়েরাও তোর মতন ন্যাকা হয়না, তারা অনেক বেশি চোস্ত। খাটের এক কোনায় বসে তোর এই কুঁইকুঁই করা, একটা ঠিকঠাক খদ্দেরের পাল্লায় পড়লেই সব বেড়িয়ে যাবে।
রাজাকে ধরা হয়েছিলো ওর স্কুল থেকে ফেরার সময়ে। পনেরো বছর বয়েসে ক্লাস ফাইভ-এর ছাত্র, একটা এন/জি/ও ওর পড়াশোনা, থাকা-খাওয়ার খরচ চালাতো। ও মাকে চোখে দেখেনি, বাবা ছিলো, কিন্তু বাপ সম্পর্কে কোনো কথা বলতে চায়না। স্কুলে পড়াশোনা খুব-একটা পারতোনা, ওর মন খেলাধূলোয়। ফুটবল ওর প্রিয়, দূর পাল্লার শট নিতে ভালোবাসে - এইখানে আমার সাথে খুব মিল। শুরুর কটা দিন ও এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকতে পারতো না, সারা ঘরে পায়চারি করতো, ঘন ঘন জল খেতো আর লাগোয়া পুঁচকি বাথরুমটায় পেচ্ছাপ করতে করতে ফোঁপাতো। ইদানিং এই অস্থিরতা একটু হলেও কমেছে।
গালাগালগুলো শিখিয়েছিলাম মনে আছে? আমি একটা বিড়ি ধরালাম। সবগুলো মনে নেই। আগামী দিনে তোকে ঐ গালিগুলো খেতে হবে। মানেগুলো ঠিকঠাক ভাবে জান, মন হাল্কা হবে। অনেক গালাগাল আর তার মানেগুলো জেনে রাখা ভালো কাজ, মনটা ফুর্ফুরে হয়, আমি বোঝাই ওকে। আচ্ছা বল তো, সবচেয়ে কমন্ যেটা - বোকাচোদার মানে কী? ও সঠিক উত্তর দিলো। আমি হাসলাম। হ্যঁ¡, ভালো, তবে আরো তাড়াতাড়ি শিখতে হবে, কিছুদিন পর তুই নিজেই ব্যবহার করবি। স্কুলের ওই "শুয়োরের বাচ্চা-ফাচ্চা' থেকে বেড়িয়ে আয়, বড়োদের গালি শেখ - আমি বিড়িটা বাথরুমের খোলা দরজার দিকে ছুঁড়ে দি।
কিরকম-কিরকম কী করতে হবে? কাস্টমরেরা এলে? রাজা হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো। ওরা যেমনি বলবে তেমনি করবি। আমি তো তোকে কিছুই করলামনা, শুধু ভ্যাজর-ভ্যাজর করে গেলাম হাহাহাহাহাহাহা, জলটা দে। রাজা জলের জাগটা হাতে নিলো - জল নেই। আমায় দে, আমি নিয়ে আসছি। আমি দরজা থেকে শরীরটা আদ্ধেক বের করে রীতেনকে ডাকলাম - একটু জল ভরে আনো তো। আনছি, ছেলেটা ঠিকঠাকই, না? চলে যাবে, কী বলো? হ্যঁ¡, যাবে - আমি উত্তর দিলাম। রীতেন পাশের একটা বেসিন থেকে (তাতে এÉ¡কোয়াগার্ড) জল ভরে এনে দিলো। আমি ঘরে ঢুকে আবার ছিটকিনি দিয়ে দিলাম। জল খেয়ে রাজা কে জিজ্ঞেস করলাম - খাবি? হ্যঁ¡, দাও একটু।
ও চোখ বুজে জল খেলো। আমি জাগটা ওর হাতের থেকে নিয়ে টেবিলে রেখে বললাম - শোন রাজা (ওর পাছায় হাত বোলাতে-বোলাতে), খুব তাড়াতাড়ি এবারে কাজে ডুবে যেতে হবে। এখানে যারা আসে তাদের মাথা এমনিতেই গরম থাকে। অনেক ধরণের লোকই আসে - দাঁতের ডাক্তার, কেরানি, অটোওয়ালা। তাদের মধ্যে দুটো মিল, এক - তারা এখানে আসে দুই - তাদের সবার মাথা গরম। তুই যদি তাদের সাথে ন্যাকামি দেখাস, বেল্ট-ফেল্ট খুলে চাবকাবে তোকে। নিজের ভালো চাস তো এই সব খদ্দেরদের কথা শুনবি, যেমনি বলবে তেমন করবি, হাজারবার একই কথা তোকে বলে বলে মুখে রক্ত উঠে গেছে আমার।
আমি খাটে এসে আবার বসলাম। রাজা জিজ্ঞেস করলো - এই ঘরেই সব কাজ হয়, বাইরে যেতে হয়না? পাশে এসে বোস্। হ্যঁ¡ হয়, তবে কম। কিছু বড়লোক বাড়ির মেয়েছেলেরা গাড়ি পাঠায়ে মাঝে -সাঝে, বড় রাস্তায় দাঁড় করানো থাকে। তাদের বাড়ি গিয়ে সার্ভিস দিতে হয়। তোর সুলতানের সাথে আলাপ হয়নি এখনো? না, হয়নি। কী করিস, আলাপ করবি তো! খুব দারুণ ছেলে সুলতান, তোর চেয়ে চার-পাঁচ বছরের বড় হবে। ওর কাছে অনেক গল্প শুনতে পারবি, অনেক কিছু জানতে, শিখতে পারবি। রাজা একটা ছোট্ট হুঁ করলো।
ভাবিস না এত, আমি ওর মাথাটা ঝাঁকিয়ে দিলাম। কাল-পরশুর মধ্যেই তোর হাতেখড়ি হয়ে যাবে। আমি যাওয়ার পর রীতেন বা প্রীতমদা তোকে কিছু জিজ্ঞেস করে? হ্যঁ¡ করে। কী? জিজ্ঞেস করে ঠিকঠাক সার্ভিস দিয়েছিস তো? তুই কী বলিস? আমি বলি - হ্যঁ¡, দিয়েছি। হাহা - শালা মিথ্যুক। আমি হাতঘড়িটা ড্রেসিং টেবিল থেকে তুলে নি। আমি আজ উঠি, অনেকক্ষণ হলো। কবে আসবে আবার? দেখি, কবে আসি। আজ ডকে স্ট্রাইক, ফোকটে একটা ছুটি পেয়ে গেলাম, তাই এসেছিলাম। যাযা কথা বলে গেলাম সব মনে রাখিস, তোর অনেক কাজে লাগবে। আর দুম্দাম্ মনখারাপ করে না খেয়ে থাকিস না, তাতে লাভের লাভ কিছু হয়না। আমি ১৬ নং থেকে বেরিয়ে এলাম।
বাইরে এসে দেখি সুন্দর আগেই চলে গেছে। সুন্দর কই গেলো বিলুদা? চলে গেল তো ও! কখন? এই মিনিট দশেক আগে। কিছু বলে গেছে? না! তা তুমি সময় কেমন কাটালে? ভালোই। ষোলো তো? হ্যঁ¡। নতুন ছেলেটা ঠিকঠাক সার্ভিস দিচ্ছে? হ্যঁ¡-হ্যঁ¡, দিচ্ছে। একমাস ধরে তো তুমি একাই খাচ্ছো, ওদিকে সুলেখা বলছিলো সেদিন। হাহা, সত্যি সুলেখাও ...
বিলুদা, আমি ভেতর থেকে ঘুরে আসি, ছুটির দিন। তুমি বাইরে আছো তো কিছুক্ষণ? হ্যঁ¡ আছি, ঘুরে আয়। আমি আবার বাড়িটার ভেতরে ঢুকলাম, আবার সেই করিডোর, সবুজ আলো, প্রীতমদা, রেজিস্টার। কী হে? প্রীতমদা টেবিল বাজিয়ে প্রশ্ন করল। ডানদিক।
0 মন্তব্যসমূহ